#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ২৪
“কি হয়েছে পেখম?”
প্রিয়তা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে পেখমের দিকে। উচ্ছ্বাস মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে কোনো খারাপ সংবাদ শুনতে চায়না। এই পরিবারটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে সে।
“আপা, আপা।”
পেখমের কাঁধ চেপে ধরে তাকে ঝাঁকাতে থাকে প্রিয়তা।
“কি হয়েছে বল, চুপ করে আছিস কেনো? বাবা ভালো আছে তো?”
পেখম হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,”আপা, বাবার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। কথা বলতে পারছে না। তোকে খুঁজছে, বারবার ইশারা করে তোকে ডাকছে তোকে।”
শরীরের সব শক্তি যেনো ফুরিয়ে যায় প্রিয়তার। মাটিতে বসে পড়ে সাথে সাথে। পেখম আপাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।
উচ্ছ্বাসের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। পরম মমতায় দুই বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এতো সুন্দর দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায়না। চোখে পানি চলে আসে।
“কান্নাকাটি পরে করলেও হবে। এখন যাও দুইজন, বাবার কাছে যাও।”
পেখম চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।
“উচ্ছ্বাস ভাই।”
“বলো পেখম।”
“আজ যা হয়েছে আপনার জন্য হয়েছে। আমরা আপনাকে যতোই ধন্যবাদ দিই সেইটা কম হয়ে যাবে। আপনি ফেরেশতার মতো এসে আজ আমাদের এই বিপদ থেকে বাঁচালেন।”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা এখনো ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
বাঁকা ঠোঁটে হেসে উচ্ছ্বাস বললো,”এসব কথা বলতে নেই পেখম। আমরা মানুষ, ফেরেশতা নই। আমাদের ক্ষমতা সামান্য, অতি সামান্য। তবে আমরা চাইলেই আমাদের এই সামান্য ক্ষমতাটা কাজে লাগিয়ে অসামান্য কাজ করতে পারি।”
প্রিয়তা ঘাড় ঘুরিয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। উচ্ছ্বাস দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে উদাসভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে মাত্রই। আকাশে দুই’একটা তারা জ্বলে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। উচ্ছ্বাস হয়তো সেই তারাদের মধ্যে নিজের বাবা মা কে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
“যাও পেখম, তোমাদের বাবা তোমাদের অপেক্ষায় বসে আছে।”
“আপনি যাবেন না উচ্ছ্বাস ভাই?”
“কেউ আমার অপেক্ষায় নেই পেখম। আমি আমার এই নষ্ট জীবনে আর বাঁধা পড়তে চাইনা, তোমরা যাও।”
প্রিয়তা উঠে দাঁড়ায়। ভ্রু কুঁচকে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে।
পেখম আস্তে আস্তে বললো,”আমাদের পরিবারটাকে নিজের ভাবতে পারেননা উচ্ছ্বাস ভাই? মা তার ভুল আজ বুঝতে পেরেছে, সে তার ব্যবহারের জন্য কষ্টও পেয়েছে। খুব ক্ষতি হয় আমাদের আপন ভাবতে?”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হাসে।
“তোমরা ভালো থেকো, আবার দেখা হবে।”
পেখম প্রিয়তার বাহু চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,”তাকিয়ে দেখছিস কি আপা? উচ্ছ্বাস ভাই চলে যাচ্ছে, আটকাবি না তাকে?”
প্রিয়তা ম্লান হেসে বললো,”যে চলে যেতে চায় তাকে কি আটকানো যায়?”
উচ্ছ্বাস পিছন ঘুরে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে হাসে। প্রিয়তার পুরো সত্ত্বা কেঁপে ওঠে। সেই হাসি, যে হাসির জন্য সে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। কেনো আটকাতে পারছে না সে মানুষটাকে?
“আটকানোর ক্ষমতা আমি সবাইকে দিই নি, কিন্তু যাকে দিয়েছি সে চাইলেই আমাকে আটকাতে পারে। কারণ তার জন্য আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে।”
হতভম্ব দুই বোনকে পিছনে রেখে উচ্ছ্বাস চলে যায়। তার অবয়বটা ঝাপসা হয়ে ওঠে প্রিয়তার চোখের পানিতে।
বাবার দুই পাশে দাঁড়িয়ে নি:শব্দে চোখের পানি ফেলছে দুই বোন। পায়ের কাছে নির্লিপ্তভাবে বসে আছে মার্জিয়া বেগম। কবির শাহকে আরো কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। ক্ষত শোকাতে অনেকটা সময় লাগবে। এখন তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। যন্ত্রণাটা তীব্র হচ্ছিলো সময়ের সাথে।
“মা।”
পেখমের ডাকে মার্জিয়া বেগম চোখ তুলে তাকায়।
“খালাকে তো খবর পাঠালে, একবারও এলো না। আমাদের খোঁজটুকুও নিলো না। কেমন আপন মানুষ আমাদের? অথচ এই মানুষটার জন্য তুমি কম অশান্তি করোনি বাবার সাথে। ছোট থেকে দেখে আসছি, খালা যেদিন বাড়িতে আসতো তুমি বাবার সাথে সেদিনই কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করছো। এখন বুঝলে তো মা, রক্তের সম্পর্ক থাকলেই কেউ আপন হয়না?”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।
প্রিয়তা পেখমের হাত ধরে টেনে বললো,”হচ্ছেটা কি পেখম? এখন কি এসব বলার সময়? মায়ের মনের অবস্থাটা বুঝবি না?”
“কি বুঝবো আপা? ওই ভদ্রমহিলা আমাদ্রর জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিয়েছিলো। আমাদের মায়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে কম অশান্তি করেনি আমাদের সংসারে। অথচ আজ দেখ, আমাদের এমন ভয়ংকর বিপদের সময় সে অনুপস্থিত। ওই মহিলার জন্যই তো মা উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে দিনের পর দিন, তার উষ্কানিতেই। চলে গেলো মানুষটা আমাদের বাড়ি ছেড়ে। অথচ আজ উনি না থাকলে আমাদের কি অবস্থা হতো একবার ভেবেছিস? থানা-পুলিশ কিছুই বুঝতাম না আমরা। মানুষটা আজীবন আমাদের কাছে সুপারম্যান হয়ে থাকবে আজকের দিনটার জন্য।”
প্রিয়তা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
কেবিন থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় প্রিয়তা। আকাশে যেনো হাজারটা তারা উঠেছে আজ। প্রিয়তা খোঁপা থেকে চুলগুলো আলগা করে দেয়। মাথা চেপে ছিলো যেনো খোঁপাটা। একটু শান্তি লাগছে চুল খুলে দেওয়ায়।
“আপনার নাম প্রিয়তা?”
কারো ডাকে চমকে উঠে তাকায় প্রিয়তা। বিরক্তমুখে একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
“জ্বি আমি প্রিয়তা।”
“কোথায় ছিলেন বলুন তো এতোক্ষণ? এটা নিয়ে কতোক্ষণ অপেক্ষা করছি।”
নার্সটা একটা ব্যাগ তুলে ধরে।
“ঠিক বুঝলাম না। এটা কি?”
নার্সটা দ্বিগুণ বিরক্ত হয়ে বললো,”আপনাদের সাথে যে কমবয়সী ছেলেটা এসেছিলো সে এটা আপনাকে দিতে বলেছে।”
ব্যাগটা প্রিয়তার হাতে দিয়েই বিদায় হয় সে।
হতবাক হয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তা। উচ্ছ্বাস ভাই কি দিয়েছে তার জন্য?
তড়িঘড়ি করে ব্যাগটা খুলতেই ভীষণ অবাক হয়ে যায় প্রিয়তা। ব্যাগভর্তি খাবার। এতোসব কাণ্ডের মধ্যে ওর খেয়ালই নেই সারাদিনে তেমন খাওয়া হয়নি ওদের কারোই। বাবার এই খবর শুনে ক্ষুধার বোধটাও ছিলো না কারো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খাবারটা ভীষণ দরকার ছিলো। শরীরে একবিন্দু শক্তি নেই কারোই।
খাবারের সাথে ছোট্ট একটা সাদা কাগজ দেখে হাতে তুলে নেয় প্রিয়তা ওটা।
‘নন্দিনী,
এ এযাবৎকাল আমি কাউকে আমার সাথে উদ্ধত আচরণ করার সাহস দিইনি। কেউ আমার উপর রাগ দেখাক, আমি পছন্দ করিনি। এই অধিকার ছিলো শুধুমাত্র আমার মায়ের। মায়ের পরে এই রগচটা ছেলেটা কাউকেই সেই অধিকার দেয়নি। তবে আজ তুমি যখন আমার সাথে রাগ দেখিয়েছো, বিশ্বাস করো আমি তোমাকে আটকাতে পারিনি। খুব ইচ্ছা করছিলো, কেউ আমার উপর রাগ দেখাক, অভিমান করুক। আমার অবচেতন মনটা যেনো ভেবেই নিয়েছে তোমার অধিকার আছে আমার উপর রাগ দেখানোর। জানিনা কেনো কিছু বলতে পারলাম না আমি। তবে সেদিন আমি ওদের মেরেছিলাম তোমার কথা ভেবে নয়। আমি শুনেছিলাম কলেজে থাকতে আমার মা কে কিছু বখাটে উত্যক্ত করায় তোমার বাবা তাদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলো। মা আমাকে ছোট থেকে শিখিয়েছে, মেয়েদের কেউ লাঞ্চিত করলে সাথে সাথে প্রতিবাদ করতে। আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। তবে তুমি নিশ্চিত থাকো, আজকের পর ওদের সাহস হবে না তোমাদের পরিবারের ক্ষতি করা দূরে থাক, তোমাদের দিকে চোখে তুলে তাকানোর। তুমি বরং অভিমানটুকু জমা করে রেখে দাও, আমার তৃষ্ণার্ত বুকটা কারো একরাশ অভিমান ভাঙানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।
খাবারের উপর রাগ করোনা। আমি জানি তুমি না খেয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারোনা। এখন তোমার সুস্থ থাকা যে খুব দরকার। তোমার বাবা মায়ের পাশে তোমাকে থাকতে হবে। তাই ছোট্ট অনুরোধ, খেয়ে নিও।
ইতি,
সম্বোধনের জায়গাটা ফাঁকা থাক। তুমি ইচ্ছামতো কিছু লিখে দিও এখানে।
চিঠিটা ছয়বার পড়লো প্রিয়তা। পড়তে পড়তে মুখস্ত হয়ে গেলো। তবুও যেনো প্রতিবার পড়ার সময় নতুন লাগছে তার। নিজের ব্যবহারের জন্য নিজের উপরই চরম ঘৃণা হচ্ছে তার। বাবার এই অবস্থায় মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। যতো রাগ সব ওই মানুষটার উপর দেখিয়েছে। নিজের উপর রাগে নিজের চুলগুলো চেপে ধরে সে।
চিঠিটা বুকের উপর রাখতেই কাঁধে কারো স্পর্শে চমকে উঠে তাকায় প্রিয়তা।
মার্জিয়া বেগম শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে।
“মা তুমি এখানে?”
প্রিয়তা চিঠিটা হাতের মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে।
“এখানে একা দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
“ও কিছু নয় মা। তুমি খুব ক্লান্ত মা, খাবারটুকু খেয়ে নাও।”
মার্জিয়া বেগম খাবারের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বললো,”এতো খাবার কে এনেছে?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই দিয়েছে মা।”
মার্জিয়া বেগম কথা বলেনা। কিছুদূর এগিয়ে যায়। বেশ কিছু সময় নিস্তব্ধতায় কাটে সময়।
“ছেলেটা কি আমাকে ক্ষমা করতে পারেনি?”
“এমন কেনো বলছো মা?”
“কেনো চলে গেলো এভাবে? ওর ঋণটুকু কীভাবে শোধ করবো আমি?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“তুই কি জানিস ও কোথায় আছে?”
প্রিয়তা ঝট করে চোখ তুলে বললো,”আমি কীভাবে জানবো মা?”
মার্জিয়া বেগম স্মিত হেসে বললো,”আমি আসলে নীলিমাকে হিংসা করতাম। এটাই সত্যি। উচ্ছ্বাসের মধ্যে আমি সবসময় ওর মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারতাম। আমি একটা মা হয়ে কীভাবে ওকে ওর জীবনের একটা কঠিন সময়ে ওর সাথে এতো দুর্ব্যবহার করতে পারলাম? আমি কোনোদিন ক্ষমা পাবো না এই অন্যায়ের।”
প্রিয়তা মায়ের কাঁধে হাত রাখে।
“মা সব ভুলে যাও। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব ভেবে নিজের মনকে পেরেশানিতে ফেলোনা।”
মার্জিয়া বেগম প্রিয়তার হাতটা চেপে ধরে।
“প্রিয়তা, ও আবার আসবে তো? ওকে আমি এবার অনেক ভালোবাসবো। একদম ওর মা যেভাবে ওকে ভালোবাসতো, ঠিক তেমন।”
প্রিয়তা মায়ের বুকে মাথা রাখে। চোখ বন্ধ করতেই উচ্ছ্বাসের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
“আসবে মা, উনাকে আসতেই হবে।” প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো।
লোহার চেয়ারের উপর শান্তভাবে বসে আছে উচ্ছ্বাস। তার সামনে তিনটা যুবককে বেঁধে রাখা হয়েছে। তারা কাঁপছে ভয়ে।
“ভাই আমাদের অপরাধ কি?”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হাসে।
“অপরাধ? তোরা জানিস না কি তোদের অপরাধ?”
ছেলেগুলো একে অন্যের দিকে তাকায়।
“কবির শাহকে ছুরির আঘাত করেছিস কে?”
ছেলেগুলো সাথে সাথে বাঁধা অবস্থায় উচ্ছ্বাসের পায়ের কাছে এসে পড়ে। উচ্ছ্বাস পা ছাড়িয়ে নেয়।
“ভুল হয়ে গেছে বড় ভাই। আর কোনোদিন হবেনা। এখন থেকে উনারে দেখলে সালাম দিবো আমরা।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু নাচিয়ে বললো,”তাই নাকি? কীভাবে বিশ্বাস করবো আমি এই কথা?”
“বিশ্বাস করুন বড় ভাই আমাদের। আর এই ভুল হবে না।”
উচ্ছ্বাস ধীর পায়ে হেঁটে যায় একজনের কাছে। হাঁটু গেড়ে তাদের সামনে বসে।
হঠাৎ একজনের চুলগুলো চেপে ধরে তার চোখে চোখ রাখে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে ছেলেটা।
“গতবার তোদের সাবধান করে দিয়েছিলাম প্রিয়তার দিকে চোখ তুলে তাকাবি না। আজ তোরা ওর বাবার গায়ে হাত তুলেছিস। তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিস। তোদের শত্রুতা আমার সাথে, উনাকে কেনো ছুরি আঘাত করলি?”
“মাফ করে দিন এবারের মতো।”
চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে দূরে ফেলে দেয় ছেলেটাকে উচ্ছ্বাস।
“তোদের মেরে হাত নষ্ট করবো না আমি। তোদের শায়েস্তা করার জন্য আমার ছোট ভাইগুলোই যথেষ্ট।”
“এই রাসেল।”
রাসেল ছুটে আসে উচ্ছ্বাসের কাছে।
“জ্বি ভাই।”
“বলে দেওয়া লাগবে কি করতে হবে?”
রাসেল দাঁত বের করে হেসে বললো,”না ভাই।”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে চলে যায়। রাসেল হাসতে হাসতে তাকায় ছেলেগুলোর দিকে।
সকাল হতে না হতেই মর্জিনা বেগম এসে হাজির হাসপাতালে। এসেই চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করেছে। মার্জিয়া বেগম একটাবারও তাকায়নি বোনের দিকে। প্রিয়তা আর পেখম দুইজন বাবার পাশে বসে আছে।
কবির শাহ আস্তে আস্তে বললো,”উনি কাঁদছেন কেনো এভাবে?”
পেখম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”নাটক করছে বাবা।”
কবির শাহের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও চোখ কটমট করে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”এগুলো কেমন ধরণের কথা? এসব শিক্ষা দিয়েছি তোমাদের আমি?”
পেখম মুখ ভেংচি দেয়।
“প্রিয়তা।
“জ্বি বাবা।”
“উনাকে কাঁদতে নিষেধ কর এভাবে। হাসপাতালে আরো রোগী আছে। উনার চিৎকারে তারা অস্বস্তি বোধ করবে।”
“কবির, তোমার এ কি অবস্থা। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি কাল। এ কি হয়ে গেলো?”
কবির শাহ হালকা হেসে বললো,”বেঁচে আছি আপা। হয়তো আপনি আশা করেননি এটা।”
মর্জিনা বেগম কান্না থামিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,”কি বললে তুমি?”
“তেমন কিছু না আপা। কান্নাকাটি করে আর কি হবে, শান্ত হোন। আমি ভালো আছি।”
প্রিয়তা এতোক্ষণ চুপ করে বসে ছিলো।
খালার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললো,”খালা, আপনি সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাহলে গতকাল কেনো খোঁজ নিলেননা আমাদের? আমরা কীভাবে আছি, কোন অবস্থায় আছি। একটাবার জানার প্রয়োজন মনে করেননি।”
মর্জিনা বেগম অপ্রস্তুত ভাবে হাসার চেষ্টা করে।
মার্জিয়া বেগম হঠাৎ বোনের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“কেনো এসেছো আপা?”
“কি বললি মার্জিয়া?”
“বলছি কেনো এসেছো? মানুষটা মারা গেছে কিনা এটা দেখতে এসেছো?”
উঠে দাঁড়ায় মর্জিনা বেগম
“এসব কি বলছিস তুই মার্জিয়া? মাথা ঠিক আছে তোর?”
আচমকা চিৎকার করে ওঠে মার্জিয়া বেগম।
“তুমি আমার বোন নও আপা, হতেই পারোনা। আমি সারাটা জীবন বোকার স্বর্গে বাস করে গেলাম। তোমার শেখানো বুলি আওড়িয়ে মানুষটার সাথে ঝগড়া করে গেলাম। সংসারে অশান্তি করে গেলাম। অথচ আজ আমার এই দু:সময়ে তোমাকে পাশে পেলাম না। এই তোমার ভালোবাসা আপা? তুমি এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে, এক্ষুনি।”
কথা শেষ করতে পারেনা মার্জিয়া। তার আগেই মাথাটা ঘুরে ওঠে তার। বসে পড়তেই কবির শাহ এক হাত দিয়ে ধরে বসে তাকে।
পেখম মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”খালা আপনি চলে যান, আর দাঁড়াবেন না এখানে। মা অসুস্থ হয়ে পড়ুক তা নিশ্চয়ই আপনি চাননা।”
রাগে, অপমানে মুখটা লাল হয়ে ওঠে মর্জিনা বেগমের। কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায় সে। হনহন করে হেঁটে কেবিন থেকে বের হয়ে যায় মর্জিনা বেগম।
কবির শাহ ঈষৎ হেসে দুই মেয়ের দিকে তাকায়।
“হ্যা রে আমার কন্যারা, তোর মায়ের এমন রণমুর্তি আগে কখনো দেখেছিস তোরা?”
প্রিয়তা আর পেখম দুইজনই হেসে মাথা নাড়ে।
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,”শোন তোরা, প্রিয় মানুষের দু:সময়ে মানুষের মধ্যে অদ্ভুত এক শক্তি ভর করে। খুব সাধারণ, শান্ত মানুষটাও অশান্ত হয়ে ওঠে। তোরাও এক সময় বুঝবি।”
প্রিয়তা আনমনা হয়ে যায়। উচ্ছ্বাসের মুখটা চোখের সামনে ঘুরপাক খেতে থাকে বারবার। তাকে একটাবার দেখার তৃষ্ণা পাগল করে দিচ্ছে তাকে।
তখনই কবির শাহের মুষ্টির ভিতর পরম মমতায় হাতটা দিয়ে ভরসার আশ্রয় খুঁজছে মার্জিয়া বেগম। দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে তার।
(চলবে…..)
#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ২৫ (নতুন পর্ব)
কবির শাহকে বাড়িতে আনা হয়েছে আটদিন হাসপাতালে থাকার পর। এই আটদিনে পৃথিবীটাকে নতুন করে চিনেছে মার্জিয়া বেগম, প্রিয়তা আর পেখম। মার্জিয়া বেগম কোনোদিন ভাবতে পারেনি স্বামীর অবর্তমানে দুনিয়াটা এতো কঠিন হবে। এই ক’দিন সে দিনরাত এক করে স্বামীর সেবা করেছে, বেডের পাশেই মেঝেতে বিছানা করে ঘুমিয়েছে, প্রিয়তা জোর করে কিছু খাওয়ালে খেয়েছে নাহলে না। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কবির শাহ দেখেছে মার্জিয়া জায়নামাজে বসে কাঁদছে। সে একনাগাড়ে স্বামীর সুস্থতা চেয়েছে আর এ পর্যন্ত বাইরের মানুষের কুমন্ত্রণায় মানুষটার উপর যে মানসিক অত্যা’চার করেছে তার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। সে এই কয়দিনেই বুঝতে পেরেছে একটা বয়সে এসে মেয়েদের কাছে স্বামী-সন্তানের চেয়ে আপন আর কেউ হতে পারেনা, কেউ-ই না।
“মার্জিয়া।”
কবির শাহের ডাকে মার্জিয়া ছুটে আসে তার কাছে। এখন তার সর্বক্ষণ কাটে স্বামীর কোথায় অসুবিধা হচ্ছে সেসব চিন্তা করে। এতোদিন পর বাড়িতে এসে দেখে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে, সেই সাথে কবির শাহের জন্য আলাদা রান্নাবান্না। মার্জিয়া বেগম চোখে অন্ধকার দেখে। প্রিয়তা আর পেখম অবশ্য আজ কলেজ বা স্কুলে যায়নি। আজ সারাদিন তারা মা’কে সাহায্য করবে ঠিক করেছে।
“কি হয়েছে? তোমার কিছু লাগবে?”
কবির শাহ মুচকি হেসে ঘাড় নাড়ে।
“তাহলে ডাকলে যে? শরীর খারাপ লাগছে আবার? ডাক্তারকে ফোন করবো একটা?”
“কিছুই হয়নি মার্জিয়া, তুমি আমার কাছে এসে একটু বসবে?”
মার্জিয়া বেগম ঈষৎ কেঁপে ওঠে। ধীর পায়ে হেঁটে কবির শাহের মাথার কাছে বসে।
“তোমার হাতটা একটু ধরি মার্জিয়া?”
মার্জিয়া অবাক হয়ে কবির শাহের দিকে তাকায়, কিছু বলেনা। কবির শাহ পরম যত্নে স্ত্রীর হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয়। হাত বুলিয়ে দেয় হাতে।
“আমি কোনোদিন চাইনি এই নরম হাতটা জীবনের যাঁতাকলে পিষে শক্ত হয়ে যাক। আমার টাকা কম থাকতে পারে, হয়তো অনেকগুলো কাজের লোক রেখে দিতে পারিনি তোমার সাহায্যের জন্য কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি স্কুল থেকে ফিরেই তোমার হাতে হাতে কিছুটা কাজ আগায় দেওয়ায় জন্য যাতে তোমার কষ্ট না হয়। জানিনা কতোটুকু পেরেছি, তবুও আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। কিন্তু আমি জানি তুমি আমার সাথে সুখী হতে পারোনি। তোমাকে দামী শাড়ি বা গহনায় মুড়ে দিতে পারিনি, দামী গাড়ি উপহার দিতে পারিনি বিবাহবার্ষিকীতে। আমি স্বামী হিসেবে ব্যর্থ মার্জিয়া। তোমার সব অভিযোগ মাথা পেতে নিয়ে আমি দুনিয়া ছাড়তে চাই, আমার এতোটুকুও আফসোস নেই।”
কবির শাহের কথায় চিৎকার করে ওঠে মার্জিয়া। তার খুব অসহায় লাগতে থাকে।
“এসব কি বলছো তুমি? কোথায় খারাপ লাগছে তোমার আমার বলো? প্রিয়তা আর পেখমকে ডাকি?”
“শরীরে তো কোথাও খারাপ লাগছে না মার্জিয়া, খারাপ লাগছে মনে। পারবে ডাক্তার এই রোগ সারাতে?”
“মনে খারাপ লাগার কারণ কি?”
“এই কয়দিনে আমি এক অন্য মার্জিয়াকে আবিষ্কার করেছি। এই মার্জিয়ার চোখে আমার জন্য একরাশ ভালোবাসা দেখেছি, দেখেছি আমার জন্য নির্ঘুম রাত কাটিয়ে চোখের নিচে হওয়া কালো দাগ। তুমি রাত জেগে জায়নামাজে বসে আমার জন্য কেঁদেছো, তুমি জানতে পারোনি আমিও তোমার কান্না দেখে কেঁদেছি। এতোসবের মধ্যে আমার মনে হয়েছে আমি কি এই নিখাঁদ ভালোবাসার যোগ্য? আমার মতো অযোগ্য একটা লোক, যে তার স্ত্রীকে কখনো ভালো রাখতেই পারেনি তার জন্য তার স্ত্রী এতো কিছু করবে? আমি নিজের কাছে ছোট হয়েছি মার্জিয়া।”
মার্জিয়া বেগম আচমকা স্বামীর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে। কবির শাহ আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“তুমি এসব কেনো বলছো? আমার কোনো ব্যবহারে কি তুমি কষ্ট পেয়েছো? পেয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দাও কিংবা শাস্তি দাও। কিন্তু এভাবে কথা বলোনা দয়া করে। আমি সহ্য করতে পারছি না।”
“মার্জিয়া বিশ্বাস করো নিলীমা আমার জীবনে নেহাৎ একটা আবেগের নাম ছিলো, আর কিছু না। কিন্তু ভালোবাসার নারী বলতে যা বোঝায় তুমি তাই। যেদিন তোমাকে বিয়ে করে এ বাড়িতে নিয়ে আসি সেদিন থেকে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে তোমাকেই ভালোবেসেছি। তুমি আমার কাছে সেই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটাই আছো যেমনটা বিশ বছর আগে ছিলে।”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না, এখনো ফোঁপাতে থাকে।
“উচ্ছ্বাসকে এ বাড়িতে আনার পিছনে কখনোই ওর মায়ের প্রতি আমার পুরোনো আবেগটা কারণ ছিলোনা। আর তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো।”
মার্জিয়া বেগম মাথা উঁচু করে বললো,”উচ্ছ্বাস আর ফিরে আসবে না আমাদের কাছে?”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”আমি জানিনা মার্জিয়া। যে ভয়ে ওকে এ বাড়িতে এনেছিলাম সম্ভবত তাই সত্য হবে।”
“কি ভয়?”
“তোমাদের জানিয়েছিলাম ওর বাবা মা একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কারণ আমি জানতাম আসল ঘটনা বললে তুমি কোনোভাবেই ওকে বাড়িতে থাকতে দিতে না।”
“কি সেই ঘটনা?”
কবির শাহ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, মার্জিয়া অধীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“ওর বাবা মা কোনো দুর্ঘটনায় মারা যায়নি, ওদেরকে মেরে ফেলা হয়েছে।”
মার্জিয়া বেগম আঁৎকে ওঠে।
“এসব কি বলছো?”
“ওর তিন চাচা মিলে ওর বাবার অগাধ সম্পত্তির জন্য ওর বাবা মা দুইজনকেই খু’ন করেছে। উচ্ছ্বাসকেও মারতো কিন্তু ততক্ষণে প্রতিবেশীরা কিছু আন্দাজ করতে পেরে এগিয়ে আসায় ওরা পালিয়ে যায়। উচ্ছ্বাস নিজে চোখে ওর বাবা মা’কে খু’ন হতে দেখেছে।”
কবির শাহ থামার পর সারাঘরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। মার্জিয়া বেগম স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। এমন কিছু শুনতে হতে পারে কখনো সে ভাবতেও পারেনি। একটা বাবা-মা হারা ছেলে যে কিনা নিজের চোখে বাবা -মা’কে খু’ন হতে দেখেছে তার সাথে সে কি নোংরা ব্যবহারটা করেছে দিনের পর দিন। আর সেই ছেলেই কিনা তাদের বিপদে সবার আগে ছুটে এসেছে, যেখানে নিজের লোকেরাই আসেনি। লজ্জায়, কষ্টে মার্জিয়ার ভিতরটা ভেঙেচুরে যায়। একটা মা হয়ে কীভাবে পারলো সে এই কাজটা করতে?
“কি ভাবছো মার্জিয়া?”
মার্জিয়া বেগম কথা বলতে পারেনা। ছেলেটার জন্য একরাশ মায়া অনুভব করে সে। যদি আরেকটু ভালো ব্যবহার করতো, যদি পছন্দের খাবার গুলো নিজে পাশে বসিয়ে খাওয়াতে পারতো, আরেকটু ভালো ব্যবহার করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? এটা কি করলো সে? কীভাবে এই ভুলের মাশুল দিবে সে?
“কষ্ট পেয়ো না মার্জিয়া, তোমার দিক থেকে তুমি ঠিক। আমি তোমাকে কোনোভাবেই দোষ দিই না।”
“কিন্তু আমি যে পাপ করেছি প্রিয়তার বাবা, অনেক বড় পাপ। আচ্ছা ও কি আর ফিরে আসবে কখনো আমাদের কাছে? আমি দরকার হয় ওর কাছে ক্ষমা চাইবো অনেক করে? ও ক্ষমা করবে না আমাকে?”
কবির শাহ শূণ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি জানিনা ও কি করবে, আদৌ আর ফিরে আসবে কিনা।”
“এমন বলছো কেনো?”
“ওর চোখে আমি প্রতিশোধের আগুন দেখেছি মার্জিয়া। ওর র’ক্ত গরম হয়ে আছে। প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত সেই র’ক্ত ঠান্ডা হবে না।”
মার্জিয়া ভয়ার্ত গলায় বললো,”ও কি করতে চাচ্ছে?”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”খু’নের বদলে খু’ন।”
ভয়াবহভাবে চমকে মার্জিয়া তাকায় কবির শাহের দিকে, কবির শাহ নির্লিপ্ত।
“ও সত্যি এমন কাজ করবে? কখনো না, কোনোদিন না।”
“আমার এখানে থাকলে হয়তো আমি করতে দিতাম না এমনটা, যেভাবে হোক ওকে আটকাতাম। কিন্তু এখন তো আমি জানিই না ও কোথায় আছে, কীভাবে আছে। এটা যদি হয় আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না মার্জিয়া। ওর বাবা মা আমার জন্য অনেক করেছে, অনেক। কিন্তু আমি পারলাম না ওদের কলিজার টুকরো, একমাত্র সন্তানকে আগলে রাখতে। আমি ব্যর্থ মার্জিয়া।”
কবির শাহ চোখ থেকে আসা দুই ফোঁটা পানি তৎক্ষনাৎ মুছে ফেলে।
মার্জিয়া বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”আমার বিশ্বাস ও এমন কিছু করবে না।”
“এতোটা নিশ্চিত কীভাবে বলতে পারছো?”
“কারণ ওর চোখে আমি ভালোবাসা দেখেছি। যে পুরুষ মন থেকে কাউকে অসম্ভব ভালোবাসে, সে বাঁচতে চায়। কারণ ভালোবাসা নিয়ে বাঁচার মতো সুখ পৃথিবীতে আর দুইটা হয়না।”
কবির শাহ হতভম্ব হয়ে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“আমি মা হয়ে বুঝতে পেরেছি ও প্রিয়তাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছে। এই ভালোবাসার টান ও ছিঁড়তে পারবে না। ও কোনো অন্যায় কাজে জড়াবে না। কারণ ওকে ফিরতে হবে, প্রিয়তার কাছে ওকে ফিরতেই হবে।”
“তুমি সত্যি বলছো মার্জিয়া? ও ফিরে আসলে তুমি ওকে মেনে নিবে?”
মার্জিয়া স্মিত হাসে।
“প্রকৃতি যা চায় তার বাইরে যাওয়ার সাধ্যি আমার কোথায় মাষ্টারমশাই? আমি যে অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ ব্যতীত আর কিছুই নয় প্রকৃতির কাছে।”
কবির শাহ স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে। তার নিজেরও এখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে মার্জিয়ার কথাই সত্য হবে, যদি তাই হয় তারচেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছু হবে তার কাছে।
দরজায় অনেকক্ষণ ধরে করাঘাতের আওয়াজ শুনে প্রিয়তা দরজা খুলে দেয়। আর তারপরই বেশ অবাক হয়ে যায় সে। দরজার বাইরে তার বড় খালা দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হওয়ার কারণ মর্জিনা বেগম এসেছে সেইটা নয়, তার চোখমুখ অসম্ভব ফোলা। চোখ লাল হয়ে আছে, মনে হচ্ছে অনেক কেঁদেছে সারারাত জেগে। প্রসাধনীর ছিঁটেফোঁটাও নেই মুখে। তার বদলে যেনো একরাশ কষ্ট আর যন্ত্রণায় ছেয়ে আছে মুখটা। বড় খালার এমন রূপের সাথে ও পরিচিত নয়। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখেছে ভীষণ হাসিখুশি, প্রফুল্ল একটা মুখ তার। সবসময় চওড়া প্রসাধনীতে আবৃত সেই মুখ। হঠাৎ তার কি এমন হলো?
“খালা।”
প্রিয়তাকে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে মর্জিনা বেগম।
“ভিতরে আসতে বলবি না রে প্রিয়তা?”
প্রিয়তা ইতস্তত করে বললো,”কেনো বলবো না? আসুন না খালা। বাবাকে আজকেই বাড়িতে আনা হয়েছে।”
মর্জিনা বেগম কাঁপা কাঁপা পায়ে ঘরের ভিতর ঢোকে।
“কে এসেছে রে প্রিয়তা?”
মার্জিয়া বেগম কবির শাহের পাশেই বসে ছিলো। আচমকাই ঘরের বাইরে নিজের বড় বোনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে যায়। এই মানুষটাকে সে আর একবিন্দুও সহ্য করতে পারছে না।
মার্জিয়া বোনের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,”আপা তুমি এখানে? তুমি কেনো এসেছো এখানে? আবার নতুন শাড়ি না গহনা কিনলে? বিশ্বাস করো আপা তোমার শাড়ি, গহনা দেখার একটুও ইচ্ছা নেই আমার।”
কবির শাহ কিছুটা বিরক্ত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,”এসব কি হচ্ছে মার্জিয়া?”
মার্জিয়া চিৎকার করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় কবির শাহ।
“আপা আপনি বসুন না।”
মর্জিনা বেগমের কান্নাজড়িত চেহারা চোখ এড়ায় না দুইজনের কারোই। কিন্তু নিজে থেকে কেউ কিছু বলেনা।
মর্জিনা বেগম বোনের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বললো,”আমার উপর তোর অনেক রাগ তাইনা রে মার্জিয়া?”
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হঠাৎ এভাবে কেনো কথা বলছে সে? এমনভাবে তো কোনো সময় কথা বলে না তার বোন।
“আপা আমার না এখন সত্যি এতো অতিরিক্ত সময় নেই বাইরের কারো উপর রাগ করার। এখন আমি অনেক ব্যস্ত। সারাটাজীবন তোমার কথা শুনে এই সংসারটা আপন করতে পারিনি, এই মানুষটাকে ভুল বুঝেছি। এখন সেই ভুল সংশোধনের সময় এসেছে। আমি ঠিক করেছি যে কয়টা দিন বেঁচে থাকবো শুধু এই সংসারে মন দিবো, আগলে রাখবো দুই হাতে। এখন আমার অনেক দায়িত্ব আপা। কারো উপর রাগ হওয়ার কোনো সময়ই নেই আমার, বিশ্বাস করো।”
কবির শাহ হৃষ্টচিত্তে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এমন একটা দিনের অপেক্ষাতেই সে ছিলো এতো বছর। আজ নিজেকে স্বার্থক মনে হচ্ছে।
হঠাৎ দুইজনকে চরম অবাক করে দিয়ে মর্জিনা বেগম শব্দ করে কেঁদে দেয়। প্রথমে আস্তে আস্তে হলেও আচমকা তা হাউমাউ করে কান্নায় রূপ নেয়। হতভম্ব হয়ে যায় কবির শাহ আর মার্জিয়া।
“মার্জিয়া তুমি বসে আছো কেনো এভাবে? দেখো আপার কি হলো? আপা এভাবে কাঁদছে কেনো?”
মার্জিয়া বেগম অপ্রস্তুত হয়। তবে কি একটু বেশি কঠিন আচরণ করে ফেললো বোনের সাথে? এটাই কি স্বাভাবিক ছিলোনা সে যা করেছে? কিন্তু এটুকু কারণে আপা এভাবে কাঁদবে? সে তো এভাবে কখনো কাঁদে না।
“মার্জিয়া আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি ভুল করেছি, পাপ করেছি। তোরা আমাকে ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। কবির আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমার দুই মেয়েকে ডাকো, তাদের কাছেও ক্ষমা চাইবো আমি।”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে মার্জিয়া বেগম ছুটে আসে বোনের কাছে। হাত রাখে তার পিঠে। দূর্বল শরীর নিয়ে কবির শাহ-ও এগিয়ে আসার চেষ্টা করে। মর্জিনা বেগমের এমন রূপের সাথে কেউ পরিচিত না ওরা। নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিছু হয়েছে।
“আপা তোমার কি হয়েছে একটু বলবে? এভাবে কাঁদছো কেনো তুমি?”
“মার্জিয়া আমাকে কিছুদিন এখানে থাকতে দিবি? আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি তোদের কাছে একটু বুক ভরে নি:শ্বাস নিতে চাই। কবির তুমি থাকতে দিবে আমাকে কিছুদিন এখানে?”
কবির শাহ কিছু না বুঝে মার্জিয়ার দিকে তাকায়। ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে দুইজনেরই।
“কিন্তু তোমার ওই আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি ছেড়ে আমার এই ছোট্ট ভাঙা বাড়িতে তোমার থাকতে কষ্ট হবে না আপা?”
কবির শাহ শীতল চোখে মার্জিয়ার দিকে তাকাতেই সে চুপ করে যায়।
“হ্যা আজ তোর বলার দিন, তুই বল মার্জিয়া। বিশ বছর ধরে আমি বলেছি, তুই শুনেছিস। আজ তুই বলবি আমি শুনবো। কিন্তু তারপরেও আমি বেহায়ার মতো কিছুদিন এই বাড়িতেই আশ্রয় নিবো।”
“কোনো সমস্যা নেই আপা। আপনার যতোদিন ইচ্ছা এখানে থাকবেন। আর আশ্রয় বলেছেন কেনো? এটা আপনার বোনের বাড়ি। আপনি থাকতেই পারেন এখানে। মার্জিয়া, প্রিয়তাকে বলো উচ্ছ্বাস যে ঘরে থাকতো ভালো করে ঘরটা গুছিয়ে দিতে। আপার যা যা লাগে ব্যবস্থা করো। আলমারিতে টাকা রাখা আছে কিছু। উনার কাছ থেকে শুনে কি কি উনার প্রয়োজন এনে দাও।”
মর্জিনা বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠে।
“আমাকে আর লজ্জা দিও না কবির। আমি তোমাকে কারণে অকারণে অনেক অপমান করেছি, অশান্তি সৃষ্টি করেছি তোমার সংসারে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এগুলো ইচ্ছা করে করিনি। আমি তোমাদের হিংসা করতাম। না চাইতেও তোমাদের হিংসা করেছি আমি মনের অজান্তে। আমার অবচেতন মন তোমাদের সুখ দেখে বড্ড হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতো।”
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমাদের কেনো হিংসা করবেন আপা? আপনার তুলনায় আমাদের তো কিছুই নেই। দামী শাড়ি গহনা, বিলাসবহুল আবাস, দামী গাড়ি কিছুই আমি আপনার বোনকে দিতে পারিনি। একবুক ভালোবাসা ছাড়া এই সংসারে আমার দেওয়ার মতো কিছুই ছিলোনা। তবুও কেনো আমাদের হিংসা করতেন আপনি?”
মর্জিনা বেগম ধরা গলায় বললো,”ওই ভালোবাসার অভাবেই তোমাদের হিংসা করতাম কবির।”
মার্জিয়া বেগম বেশ অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকায়। মর্জিনা বেগম উঠে দাঁড়ায় বসা থেকে। হাঁটতে হাঁটতে জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। বাইরের একফালি উঠোনে কবির শাহ বেশ কিছু ফুল আর সবজির গাছ লাগিয়েছে। দুপুরের আগের রোদে এতো সুন্দর লাগছে দেখতে। মর্জিনা বেগমের চোখ ছাপিয়ে ওঠে আবারও পানিতে।
“মার্জিয়া আজ একটা সত্য কথা বলবো তোদের। যে সত্য তোরা কেউ জানিস না।”
“কি সত্য আপা?
“আমি সুখে নেই মার্জিয়া। মিথ্যা সুখের অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমি ভয়ংকর এক কষ্টের যাঁতাকলে পিষে মরেছি আজীবন। যন্ত্রণার ছাপ মুছতে ব্যবহার করেছি প্রসাধনীর প্রলেপ। মানুষের সাথে কুৎসিত ব্যবহার করে নিজের মধ্যকার যন্ত্রণাটা কমানোর চেষ্টা করে আজীবন। কিন্তু আমি এখন ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত আমি। আমি আর পারছি না এই মিথ্যা অভিনয় করতে।”
এমন অত্যাশ্চর্য কথা আগে কোনোদিন শোনেনি ওরা কেউ। মনে হচ্ছে কোনো স্বপ্ন দেখছে, এ-ও সম্ভব? মার্জিয়া কিছু বলতে গেলে কবির শাহ ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। মর্জিনা বেগম নিজে থেকে সব বলুক।
“তোর দুলাভাই আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি মার্জিয়া। তার দরকার ছিলো বাড়িতে একটা রূপবতী স্ত্রী,ব্যস। এ বাদে আমার প্রতি স্ত্রী হিসেবে তার কোনো টান ছিলোনা।”
“আপা এসব কি বলছো?”
“এটাই সত্যি মার্জিয়া। তার অন্য কোথাও প্রেম ছিলো, বেশিরভাগ দিনেই সে ওই মেয়ের কাছেই থাকতো। আর ঠিক সেসব দিনেই আমি খুব সুন্দর করে সেজেগুজে, দামী শাড়ি গহনা পরে, দামী গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়তাম। আমি যে কতোটা সুখী এটা মানুষকে জানাতে।”
মার্জিয়া বেগম হতভম্ব চোখে কবির শাহের দিকে তাকায়। কবির শাহ মাথা নিচু করে বসে থাকে। সে এসব কথা আগে থেকেই জানে, খবর এসেছে আগেই তার কানে। কিন্তু স্ত্রী কষ্ট পাবে তাই কখনো কিছু বলেনি।
“আমার মেয়েটাও আমার মতোই কষ্টে আছে রে মার্জিয়া। ওর বাবা জোর করে নিজের বিজনেস পার্টনারের ছেলের সাথে ওকে বিয়ে দিয়েছে। মা মেয়ের কপাল একই রকম। টাকাপয়সা, সোনাদানার অভাব নেই। কিন্তু যেটার অভাব ছিলো তা হলো ভালোবাসা। যা আমরা কেউ পাইনি।”
“আপা তুমি যে বলতে তুমি অনেক সুখী। টাকা ছাড়া সুখ কেনা যায়না। আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে তুমি দেখিয়েছো তুমি কতোটা সুখী আর আমি কতোটা যন্ত্রণায় আছি। আর বোকা আমি তোমার ওসব কথায় প্ররোচিত হয়ে উদাসীন থেকেছি আমার সংসারে, স্বামীর সাথে রুক্ষ ব্যবহার করেছি একই সাথে দূরত্ব বাড়িয়েছি মেয়ে দু’টোর সাথে। কেনো করলে আপা এমন?”
মর্জিনা বেগম হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুই বলার নেই তার, কি বলবে? মার্জিয়ার একটা কথাও যে মিথ্যা নয়।
“কিন্তু আপা দোষ তোমার না, কোনোভাবেই তোমাকে দোষ দিয়ে দায় নিশ্চিত হতে পারিনা আমি। আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী, আমি কেনো তোমার কথায় প্ররোচিত হবো? আমি তো বাচ্চা ছিলাম না।”
কবির শাহ স্ত্রীর হাতে হাত রাখতেই মার্জিয়া বেগম ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করে।
“তোমাদের কারো এখানে দোষ নেই মার্জিয়া। না আপার না তোমার। তোমরা দুইজনই যেটা করেছো তা মানব স্বভাবসুলভ আচরণ। সৃষ্টির শুরু থেকে এমনটা হয়ে আসছে। তোমরা অস্বীকার করবে কীভাবে? দুলাভাইয়ের ব্যাপারে সবকিছু আমি জানতাম, কিন্তু কোনোদিন কাউকে বলিনি। এমনকি সেতারার বিয়েতে আমি এজন্যই উপস্থিত ছিলাম না। আমি জানতাম ওর যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে ভালো নয়। বিয়ে আটকানোর চেষ্টা করায় দুলাভাই আমার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেছিলো।”
মার্জিয়া অসহায় গলায় বললো,”আমাকে এগুলো আগে বলোনি কেনো তুমি?”
“ইচ্ছা হয়নি, জোর করে তোমাকে আমার দিকে, এই সংসারের দিকে আকৃষ্ট করতে চাইনি। আমি চেয়েছি তুমি যেনো নিজে থেকে, নিজের চিন্তাধারা থেকেই এই সংসারে আবদ্ধ হও। দেখো আজ আমি সফল। তুমি নিজে থেকে ধরা দিয়েছো আমার কাছে। আমি আজ অনেক খুশি।”
মার্জিয়া বেগম একবার স্বামীর দিকে আরেকবার বোনের দিকে তাকায়। এই প্রথম নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবতী নারী মনে হচ্ছে নিজেকে। একইসাথে বড়বোনের কষ্টে জর্জরিত মুখটা দেখে মায়া অনুভবও করছে। সত্যি এই দুনিয়া বড়ই অদ্ভুত!
পেখমের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। পেখমের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নিজের মতো কাপড়ে কি যেনো সেলাই করছে। পেখমের এই অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করছে প্রিয়তা বেশ কিছুদিন। সে কোনো এক অজানা কারণে প্রিয়তাকে এড়িয়ে চলছে। কথাও বলছে না খুব বেশি। ও তো এমন ছিলোনা। অল্পতেই কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিতো প্রিয়তার।
“পেখম।”
পেখম অস্ফুট স্বরে সাড়া দেয়।
“আমার দিকে তাকা পেখম।”
“দেখছোই তো একটা কাজ করছি আপা।”
“আমার কথাটা আগে গুরুত্বপূর্ণ। রাখ তোর কাজ।”
“রাখতে পারবো না, যা বলার বলো।”
প্রিয়তা হঠাৎ জোর করে পেখমের হাত থেকে কাপড়টা কেড়ে দেয়। পেখম বিরক্ত হয়ে বোনের দিকে তাকায়।
“কি হয়েছে আপা? এসবের মানে কি?”
“তোর কি হয়েছে?”
“কি হবে?”
“আমার সাথে কথা বলছিস না কেনো তুই কিছুদিন ধরে? আমি কি করেছি?”
পেখম স্মিত হেসে বললো,”বলছি তো।”
প্রিয়তা অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”বাবা হাসপাতালে থাকা সময় থেকেই আমি খেয়াল করছি তুই আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিস না, বললেও খুব কম। তুই তো এমন ছিলিনা।”
“বললাম তো কিছু হয়নি আপা। কেনো এক কথা বারবার বলছিস?”
প্রিয়তা কান্নাভেজা চোখে বোনের দিকে তাকায়। ছোট থেকে দুই বোনের খুব মিল। কেউ কাউকে ছেড়ে এক দণ্ড থাকতে পারেনা। হঠাৎ বোনের এমন ব্যবহার খুব পোড়াচ্ছে প্রিয়তাকে।
আপার চোখে পানি দেখে পেখমের মন কিছুটা গলে, কিন্তু পুরোপুরি না।
“কাপড়টা দে আপা।”
“তুই আমার সাথে ঠিকমতো কথা না বলা পর্যন্ত আমি কিন্তু খাওয়াদাওয়াই করবো না বলে দিলাম।”
“এসব পাগলামির মানে কি আপা?”
“বেশ তোর কথা বলা লাগবে না, গেলাম আমি। আমার জিদ তুই জানিস।”
প্রিয়তা উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেখম পিছন থেকে তার হাত চেপে ধরে।
“আপা উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সাথে তুই খুব খারাপ আচরণ করেছিস। যেটা আমার একদম পছন্দ হয়নি। সে আমাদের জন্য যা করেছে, তুই নিজের গায়ে সব র’ক্ত ঢেলে দিলেও তার শোধ দিতে পারবি? ওই সময় যদি মানুষটা এগিয়ে না আসতো আজ কি হতো একবার ভেবেছিস? কিন্তু তুই কি করলি? এমন একজন মানুষের সাথে হাসপাতালে দাঁড়িয়ে এতো খারাপ ব্যবহার করলি। যে তোকে এতোটা ভালোবাসে, তার সাথে কীভাবে এমন করলি তুই?”
প্রিয়তা কাঠের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। পেখমকে সে কীভাবে বোঝাবে সেদিনের পর থেকে সে নিজেও ভালো নেই। অস্থির মনটা বারবার খুঁজে ফিরেছে ওই মানুষটাকে। কিন্তু কোথাও কোনো হদিস নেই। কর্পূরের মতো উবে গেলো একরাশ অভিমান বুকে নিয়ে। পেখম কি জানে সেদিনের পর থেকে প্রিয়তা একটা রাতও ঘুমাতে পারেনি। বারবার উচ্ছ্বাসের কথা ভেবেছে। অনুতপ্ত হয়েছে কিন্তু বাবার এমন অবস্থায় কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি।
“কেনো করলি এমন?”
“আমার মাথা ঠিক ছিলোনা। কি করেছি, কি বলেছি আমি নিজেও জানিনা।”
“তোর এই না জানার দায়ভার কে নিবে আপা? আমাদের কাছে আর ফিরে আসবে না মানুষটা। খুব ভালো লাগছে এবার? নিজের ভালোবাসাকে নিজে দূরে ঠেলে দিলি, খুব ভালো লাগছে এবার তাইনা?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা শরীরে ধপ করে বসে পড়ে পেখমের কাছে। ম্লান গলায় বললো,”উনি আর ফিরে আসবে না পেখম?”
“জানিনা আপা। না আসাটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
প্রিয়তা দুই হাঁটু জড়ো করে মুখ ঠেকায় সেখানে। শরীরটা অসম্ভব কাঁপছে তার, মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। অনুশোচনার আগুনের তাপে দগ্ধ হয়ে পুড়ছে সে প্রতিনিয়ত। এই জ্বর তো কিছুই না তার কাছে।
সকালে নাশতার টেবিলে কবির শাহ পত্রিকা নিয়ে বসেছে। অনেকদিন পর প্রিয়তা কলেজে যাবে আজ। খিদা না থাকলেও মায়ের জোরাজোরিতে খাবার নিয়ে বসেছে বাবার পাশে।
হঠাৎ কবির শাহের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিচে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মার্জিয়া বেগম ছুটে আসে শব্দ শুনেই। প্রিয়তা বাবার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,”বাবা সব ঠিক আছে? এমন লাগছে কেনো তোমাকে?”
কবির শাহ কোনো কথা বলতে পারেনা। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে থাকে শুধু। একদৃষ্টিতে পত্রিকার দিকে তাকিয়ে আছে সে। তার দৃষ্টিতে ভয়।
প্রিয়তা কিছু না বুঝে পত্রিকাটা নিজের হাতে তুলে নিতেই ছিটকে পড়ে দূরে। ফ্রন্ট পেজে বড় করে উচ্ছ্বাসের ছবি ছাপা। কলিজাটা ধকধক করে ওঠে তার।
শিরোনামে ছিলো:
‘প্রতিহিংসার বলি হলো তিন চাচা, খু’ন করলো আপন ভাতিজা।’
খবরের কাগজটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারায় প্রিয়তা।
(চলবে……)