#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ২২
বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে প্রিয়তা আর পেখম। ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। দুই বোনের কারো চোখে ঘুম নেই।
“আপা ঘুমিয়েছিস?”
প্রিয়তা অস্ফুট স্বরে উত্তর দেয়,”না।”
“তোর কি খুব বেশি মন খারাপ?”
“না তো, মন খারাপ হবে কেনো?”
পেখম উঠে বসে, আধশোয়া অবস্থাত কাত হয়ে আপার দিকে তাকায়।
“আচ্ছা আপা উচ্ছ্বাস ভাই যদি ফিরে আসে কখনো? যদি এসে বলে উনিও তোকে খুব ভালোবাসে। তাহলে কি করবি তুই?”
প্রিয়তার বুকটা ঈষৎ কেঁপে ওঠে। সে জানে এটা কোনোদিনও সম্ভব না। মানুষটা আসলেই তাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। যদি বাসতো এভাবে তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতো না কাপুরুষের মতো। মিথ্যা আশাও দিতো না।
“কি রে আপা চুপ করে আছিস কেনো? কিছু বল।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় পেখমের দিকে।
“সকালে তোর স্কুল আছে না? দয়া করে চুপ করে ঘুমানোর চেষ্টা কর।”
প্রিয়তা পাশ ফিরে শোয়। তার চোখের কোণা থেকে দুই ফোঁটা পানি এসে পড়ে বালিশের উপর। সে যতো চেষ্টা করছে সব কিছু ভুলে যেতে, অনুভূতিগুলো যেনো তত বেশি জোরালো হচ্ছে তার। এ যেনো তার আবেগ আর মস্তিষ্কের এক কঠিন খেলা।
ঠিক কতোটা সময় পেরিয়েছে জানা নেই, হঠাৎ পেখম লাফ দিয়ে উঠে বসে।
প্রিয়তা কিছুটা বিরক্ত হয়ে পিছন ঘুরে বললো,”কি সমস্যা?”
পেখম ভয়ার্ত গলায় বললো,”আপা কোথায় যেনো একটা শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে জানালায় কেউ টোকা দিচ্ছে।”
প্রিয়তা রাগী গলায় বললো,”কে আবার টোকা দিবে? পাশের নারকেল গাছটায় যে বিশাল দাঁতওয়ালা ভূতটা থাকে ওটা মনে হয় তোকে খুঁজতে এসেছে। তোকে ভারী পছন্দ করে কিনা!”
বলা বাহুল্য, পেখমের ভূতের ভয় সাংঘাতিক। প্রিয়তা এরজন্য ওকে প্রায়ই খোঁচা দেয়।
পেখম কান্নারত গলায় বললো,”আপা আমি সত্যি বলছি। তুই ভালো করে কান পেতে শোন।”
প্রিয়তা শোয়া থেকে উঠে বসে।
“শোন পেখম আমার সকালে কলেজ যেতে হবে। এতো রাতে তোর উদ্ভট কথা শোনার সময় নেই এখন আমার। আর তাছাড়া…..”
প্রিয়তার কথার মাঝেই আবার শব্দ শোনা যায় জানালায়। এবার বেশ জোরালো। কেউ যেনো মহাবিরক্ত হয়ে জানালায় টোকা দিচ্ছে।
শব্দটা এবার প্রিয়তার কানেও যায়। চোখ বড় বড় করে তাকায় সে সেদিকে। পেখম জাপটে ধরে আপাকে।
“এবার বিশ্বাস হলো তো তোর?”
প্রিয়তা ঠোঁটের কাছে আঙ্গুল নিয়ে শসসসস শব্দ করে।
“আস্তে কথা বল। আমার মনে হয় চোর এসেছে। টোকা দিয়ে নিশ্চিত হচ্ছে আমরা জেগে আছি কিনা।”
পেখম ঢোক চেপে বললো,”কি বললি আপা? চোর? এখন কি হবে?”
“আমি দেখছি, শান্ত হ তুই। এতো বড় সাহস আমাদের জানালায় টোকা দেয়?”
“তোকে কোথাও যেতে দিবো না আমি। বাবাকে ডাকতে হবে।”
প্রিয়তা চোখ কুঁচকে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”এতো রাতে বাবাকে ডেকে তার ঘুমটা না ভাঙালেই তোর হচ্ছে না? আমরা বড় হয়েছি না?”
পেখম ভয়ে ভয়ে একবার আপার দিকে আরেকবার জানালার দিকে তাকায়। শব্দটা ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলেছে।
প্রিয়তা এক লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়। ইতিউতি খুঁজে কিছু না পেয়ে পড়ার টেবিল থেকে কাঠের স্কেলটা হাতে তুলে নেয়।
“আজকে ওই চোরের একদিন কি আমার একদিন।”
“আপা আমার মনে হচ্ছে না ওটা চোর। তুই কি বোকা? চোর কি শব্দ করে সবাইকে জানিয়ে চুরি করতে আসে?”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে।
“কথাটা মন্দ বলিস নি তুই।”
“হ্যা আপা সেজন্যই তো বলছি বাবাকে ডাকি।”
প্রিয়তা স্কেলটা হাতে চেপে ধরে বললো,”আমাদের তো আর জানালা ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে না কেউ। আগে দেখি ঘটনা কি, পরে বাবাকে জানানো যাবে। তুই চুপ করে আমার পিছু পিছু আয়।”
পেখম ইতস্তত করতে থাকে। তার আপাটা এতো জেদী কেনো এটাই বুঝতে পারে না সে। নরম মনের মেয়েগুলো এমনই জেদী হয়।
পা টিপ টিপে প্রিয়তা জানালার পাশে দাঁড়ায়। অগত্যা পেখমকেও আসতে হয়।
প্রিয়তা চাপা গলায় ফিসফিস করে বললো,”শোন পেখম, একদম চিৎকার করবি না। জানালাটা খুলেই স্কেল দিয়ে আচ্ছামতো মারবো যে-ই থাকুক। বদমাশটাকে উচিত শিক্ষা দিবো। এতো রাতে মেয়েদের ঘরের জানালায় টোকা দেওয়ার সাহস যেনো আর না করে।”
পেখম ফ্যাকাশে মুখে তাকায় আপার দিকে।
আস্তে আস্তে জানালাটা খুলতে থাকে প্রিয়তা, পেখম পিছন থেকে আপার জামা চেপে ধরে। ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
জানালাটা খুলতেই হালকা আলোয় চাদরে পেঁচানো এক মুর্তিমান যুবককে দেখে চোখমুখ শক্ত হয়ে ওঠে প্রিয়তার। হাতের স্কেলটা জানালার শিকের ভিতর দিয়ে বাইরে বের করে দেয়। কেউ কিছু বোঝার আগেই যুবকের কাঁধে পিঠে বেশ কয়েকবার স্কেলের আঘাত বসিয়ে দেয়। শব্দও হয় বেশ সেদিক থেকে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যুবকটা বিন্দুমাত্র নড়ছে না। বরং চাদরের মধ্যে দুইটা চোখ যেনো অতি বিস্ময়ে জ্বলজ্বল করছে তার।
প্রিয়তা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,”এই কে তুই? এতো বড় সাহস আমাদের ঘরের জানালায় টোকা দিস।”
পেখম প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা ওটা নড়ে না কেনো রে? আদৌ মানুষ তো নাকি অন্য কিছু?”
প্রিয়তা বিজয়ীর হাসি হেসে বললো,”আরে মার খেয়ে নড়াচড়া করতে পারছে না বুঝিস নাই? ভাবতেই পারেনি মনে হয় এমন কিছু হবে।”
আচমকা যুবকটার গম্ভীর গলার আওয়াজ ভেসে আসে।
“হ্যা আসলেই ভাবতে পারিনি এমন কিছু হবে।”
ঝট করে সেদিকে ঘুরে তাকায় দুইবোন। প্রিয়তার হাত থেকে স্কেলটা মাটিতে পড়ে যায়। কাঠের স্কেল ঠনঠন করে শব্দ করে ওঠে।
পেখম চাপা গলায় চিৎকার করে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই?”
প্রিয়তা যেনো কথা বলতেই ভুলে গেছে। মুখটা হা হয়ে আছে তার। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি ভূত দেখলেও এতোটা চমকাতো না সে।
উচ্ছ্বাস চাদরটা মাথা থেকে খুলে গায়ে পেঁচিয়ে নেয়। চাঁদের হালকা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় সেই চিরচেনা রাজপুত্রের মুখখানা। চোখজোড়া ঈষৎ লাল, সারামুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল আর ভ্রু জোড়া কোঁচকানো। অবাক বিস্ময়ে লাল চোখজোড়া প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রিয়তা তোতলাতে তোতলাতে বললো,”আপনি? এটা সত্যি আপনি?”
উচ্ছ্বাস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”হ্যা সত্যি আমি, যাকে তুমি একটু আগে কাঠের স্কেল দিয়ে পিটিয়েছো। এই, মাথামোটা মেয়ে আগে দেখবে তো কে এসেছে। দেখে তো মনে হয় গায়ে একবিন্দু শক্তি নেই। পাটকাঠির মতো হাতে এতো জোর? ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানো না এমন একটা ভাব ধরে থাকো। অথচ….”
উচ্ছ্বাস নিজের ঘাড়ে হাত বোলায়।
প্রিয়তা এখনো হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেখম একবার উচ্ছ্বাসের দিকের আরেকবার নিজের আপার দিকে তাকায়। তার মনটা বেশ ভালো লাগছে এখন। উচ্ছ্বাস ভাই ফিরে এসেছে, তার আপা নিশ্চয়ই আবার হাসিখুশি হবে আগের মতো।
প্রিয়তা মাথা চুলকে বললো,”আপনিই বা চোরের মতো জানালায় টোকা দিচ্ছেন কেনো? আমি তো ভেবেছি চোর এসেছে।”
উচ্ছ্বাস হতবাক হয়ে বললো,”তোমাকে ক্ষীণ বুদ্ধির মেয়ে ভেবেছিলাম, আসলে তোমার মাথায় যে গোবরটুকুও নেই সেইটা তো বুঝিনি। এই মেয়ে, চোর এলে কি জানালায় টোকা দিয়ে শব্দ করে সবাইকে জাগিয়ে ঘরে ঢোকে?”
প্রিয়তা মাথা চুলকিয়ে বললো,”আসলেই তো, এটা আমাদ মাথায় আসেনি কেনো?”
“কারণ তোমার মাথায় উৎকৃষ্ট মানের ছাগলের লাদি ঠাসা।”
পেখম শব্দ করে হেসে দেয়। প্রিয়তা তার দিকে তাকিয়ে রাগ করতে যেয়েও করেনা। তার মনটা অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন।
“বলছিলাম যে আপনি কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন? ওষুধ এনে দিই?”
উচ্ছ্বাস মুচকি হাসে।
“ওষুধ নিতেই এসেছি।”
“তার মানে?”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ থেমে ভারী গলায় বললো,”বের হবে প্রিয়তা?”
প্রিয়ত হতভম্ব হয়ে যায়, মুখ ঝুলে যায় তার।
“কি বললেন বুঝতে পারিনি।”
উচ্ছ্বাস ক্লান্ত গলায় বললো,”গভীর রাতের রাস্তা দেখেছো কখনো? কীভাবে চাঁদ উঁকি দেয় মেঘপুঞ্জের মধ্য থেকে, কীভাবে রাস্তার কালো পিচগুলো জ্যোৎস্নায় রূপালী বর্ণ ধারণ করে চিকচিক করে, কীভাবে রাতজাগা পাখি তারস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে পালায়৷ দেখেছো কখনো?”
প্রিয়তা বুঝতে পারেনা কি করবে সে। ফ্যাকাশে মুখে পেখমের দিকে তাকায়। পেখমও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে বললো,”ভয় পাচ্ছো? তবে থাক।”
প্রিয়তা মিনমিন করে বললো,”না না ভয় পাবো কেনো?”
“বিশ্বাস রাখতে পারো আমার উপর। তোমার বাবার রাজকন্যাকে আগলে রাখতে উচ্ছ্বাস মৃত্যুমুখে পড়তে দুইবার ভাববে না।”
প্রিয়তার শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগে। পেখমের দিকে তাকাতেই পেখম চোখ টিপে তাকে আশ্বস্ত করে।
“আপা যা, আমি এদিকটা সামলে নিবো। তবে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।”
প্রিয়তা পেখমের হাতের উপর হাত রাখে। তার হাত বরফের মতো ঠান্ডা। এমন দু:সাহস করার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু অদ্ভুত এক নেশা তাকে টানছে বাইরে। ভিতর থেকে কেউ বলছে, সব শেকল ভেঙে যা প্রিয়তা, এটাই সুযোগ।
প্রিয়তা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বাইরে। উচ্ছ্বাস এখনো দরাজ চোখে তার দিকে তাকানো। তার প্রতিটা নি:শ্বাস যেনো তাকে ভরসার মায়াজালে টানছে। চোখ বন্ধ করে বড় একটা নি:শ্বাস ছাড়ে প্রিয়তা।
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যোৎস্না থইথই করছে চারপাশে। সেই মায়াভরা আলোয় দুই মানব-মানবী পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। দুইজনের মনেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা অপরজনের হাতটা চেপে ধরার। কিন্তু কোনো এক বাঁধায় দুইজনই সামলে রেখেছে নিজেদের।
“এখনও কি একটুও স্বাভাবিক হতে পারছো না?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে বললো,”হয়েছি।”
“তাহলে চুপ করে আছো কেনো?”
“ভয় করছে।”
“কিসের?”
“জানিনা।”
আবারও নীরবতা। মফস্বলি রাস্তা রাত হতে না হতেই ফাঁকা হয়ে যায়। কদাচিত দুই/একটা রিকশা চলছে। এর বাইরে আর কোনো মানুষ নেই।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“করো।”
“এতোদিন কোথায় ছিলেন? কাউকে কিছু না বলে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য আছে? একটাবারও কি মনে হয়নি কেউ আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করবে, অস্থির হয়ে যাবে?”
উচ্ছ্বাস জোরে জোরে হাসে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।
“খুব হাসির কোনো কথা বললাম নাকি?”
উচ্ছ্বাস হাসি থামিয়ে শূন্যের দিকে তাকায়।
“কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে না প্রিয়তা, কেউ আমার জন্য দুশ্চিন্তা করবে না। আমি একজন বাঁধনহারা, নীড়হারা পাখি। আমার কোনো পিছুটান নেই।”
প্রিয়তা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখে বিন্দু বিন্দু জল জমা হয়। চাঁদের আলোয় সেই জল রূপার টুকরোর মতো চিকচিক করে ওঠে। উচ্ছ্বাসও থেমে যায়। প্রিয়তার দিকে তাকাতেই তার বুকে ঈষৎ ধাক্কা লাগে। এক স্বর্গীয় মায়ায় ডুবে আছে তার সামনে দাঁড়ানো তরুণীর মুখটা। এই মায়ার উৎস কি?
“দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো?”
“আমি বাড়ি ফিরে যাবো, এক্ষুনি।”
“কেনো ভালো লাগছে না হাঁটতে?”
প্রিয়তা কিছুক্ষণ থেমে ঘনঘন শ্বাস নেয়। উচ্ছ্বাস বুঝতে পারে প্রিয়তা কিছু বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। সে বুকে হাত বেঁধে অপেক্ষা করতে থাকে।
“নিজেকে ভাবেনটা কি আপনি? মহাপুরুষ হয়ে গিয়েছেন আপনি? যা ইচ্ছা করবেন, মায়া লাগাবেন এরপর ভবঘুরে জীবন কাটাবেন? মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা করতে খুব ভালো লাগে আপনার, তাইনা? যদি আপনার মনে হয়েই থাকে কেউ আপনার জন্য অপেক্ষা করবে না, কেউ দুশ্চিন্তা করবে না তবে কেনো এসেছেন আমার কাছে? কেনো আমাকে বারবার মিথ্যা আশা দিয়েছেন? কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন। একটা বারও মনে হলো না আমার কতোটা কষ্ট হতে পারে। আমার দমবন্ধ হয়ে আসতো মাঝে মাঝে। এরকম অনুভূতি কখনো হয়নি আমার। আপনি তো অবুঝ নন। কেনো করলেন তবে আমার সাথে এমনটা?”
উচ্ছ্বাস ঠোঁট কামড়ে হাসে। নরম মেয়েগুলো রেগে গেলে অদ্ভুত আচরণ করে। রাগে ফোঁসফোঁস করা মেয়েটার নাকের ডগা লাল হয়ে আছে, চোখ বেয়ে অবাধ্য জলকণা গুলো বিরতিহীন ভাবে পড়ছে। মেয়েটা কি কোনোদিন জানতে পারবে ওকে এই অবস্থায় কতোটা মায়াবতী লাগছে?
উচ্ছ্বাসের হাসি দেখে প্রিয়তা আরো রেগে যায়। হঠাৎ করেই উল্টোদিক ফিরে হনহন করে হেঁটে যেতে গেলেই উচ্ছ্বাস তার হাত চেপে ধরে পিছন থেকে। প্রিয়তা পাথরের মূর্তির মতো থেমে যায়। বুকটা ধকধক করে ওঠে তার।
আচমকাই উচ্ছ্বাস তাকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের দিকে ফেরায়। নিজের অনেকটা কাছে টেনে এনে প্রিয়তার উত্তাপটুকু নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করে। প্রিয়তা স্তম্ভিত হয়ে যায়। মাথা নিচু করে রাখে, মুখ তোলার সাহস নেই তার।
উচ্ছ্বাস ঘোরলাগা গলায় বললো,”একটু আগে যে কথাগুলো বললে এখন আবার বলো।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। সত্যিই তার এখন সাহস নেই কথাগুলো আবার বলার। সে এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে উচ্ছ্বাসের হৃৎস্পন্দনগুলো।
“কি হলো বলবে না?”
প্রিয়তা নিজের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে উচ্ছ্বাসের বাহুডোর থেকে।
“ছাড়ুন আমাকে, ফিরতে হবে।”
“আজ না ফিরলে হয়না?”
প্রিয়তা ঝট করে চোখ তুলে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। তাকানোর পর মনে হয় না তাকালেই বুঝি ভালো হতো। কীভাবে এখন সে এই চোখজোড়ার মায়া থেকে নিজেকে উদ্ধার করবে? এই মায়া কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ কি আদৌ আছে খোলা?
“একটু আগে কি যেনো বললে তুমি? আমি মায়া লাগিয়েছি? কাকে মায়া লাগালাম?”
প্রিয়তা গাঢ় গলায় বললো,”কাউকে না, কাউকে না।”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে চাপা গলায় ফিসফিস করে বললো,”কিন্তু আমি তো আরেকজনের মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেলাম। এখন আমার কি গতি হবে?”
প্রিয়তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে তিরতির করে।
“কার মায়ায়?”
“এক নন্দিনী, যার দৃষ্টিতে আমি বারবার খেই হারিয়ে ফেলি। যার গজদন্তের হাসিতে দুই/একটা হৃৎস্পন্দন হুটহাট হারিয়ে ফেলি। চাঁদের চেয়েও সুন্দর সেই প্রিয়তমার মায়ায় আটকে গিয়েছি তো আমি। তার অনুপস্থিতি আমাকে নরক সমান যন্ত্রণা দেয়, সে কি বুঝবে কখনো?”
প্রিয়তা মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছে। তার বুকটা ক্রমাগত হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে। তার মানে এই মানুষটাও তাকে ভালোবাসে? সত্যিই কি এতোটা ভাগ্য তার আছে?
“প্রিয়তা।”
প্রিয়তা অস্ফুট স্বরে বললো,”বলুন।”
“যদি কখনো জানতে পারো আমার অতীতের মতো আমার ভবিষ্যতটাও অন্ধকার হতে পারে, তবে কি তোমার অনুভূতিগুলো এখনো এতোটাই জ্বলজ্বলে থাকবে?”
প্রিয়তা কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ে।
“ভেবে বলো নন্দিনী। সামান্যতম ভুল জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে।”
প্রিয়তা আস্তে আস্তে বললো,”সেই ভুলের সাথে যদি আপনি মিশে থাকেন তবে, আমি সেই ভুল বারবার করতেও রাজি। যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকতো, আমি সেই জন্মেও এই ভুল করতে চাইতাম।”
উচ্ছ্বাস ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।
নিজের মুখটা প্রিয়তার কানের কাছে এনে বললো,”পরজন্ম লাগবে না নন্দিনী, এ জন্মেই তোমার সবটুকু অনুভূতির দায়িত্ব আমি নিলাম। কথা দিলাম, তোমাকে আর একবিন্দুও কষ্ট পেতে দিবো না।”
প্রিয়তা আকুল হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাতেই আচমকা উচ্ছ্বাস তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হেসে তার নিটোল বাঁ পায়ের পাতাটা নিজের উরুর উপর রাখে। প্রিয়তা যেনো অবাক হওয়ার পালাও অতিক্রম করে ফেলেছে।
পকেট থেকে একটা নূপুর বের করে উচ্ছ্বাস পরিয়ে তার প্রিয়তার পায়ে। রূপারঙা নুপুরটা চাঁদের আলোয় ঝকমক করে ওঠে। প্রিয়তা নিশ্চিত সে স্বপ্ন দেখছে, অবশ্যই স্বপ্ন। এতো সুখ বাস্তবে হতে পারে না, কখনোই না।
“নন্দিনী, আজ থেকে তোমাকে ভালোবাসার ভার নিলাম। যদি কখনো মৃত্যু আসে, তবে ক্ষমা করে দিও। কিন্তু যতোদিন আমার শ্বাস চলবে, ততদিন প্রিয়তার উপর থেকে প্রিয়তার নিজের অধিকার সরিয়ে আমার অধিকার রেখে যাবো। নন্দিনী কি রাজি হবে? পারবে আমার জন্য অপেক্ষা করতে?”
প্রিয়তা ঘোরলাগা চোখে উচ্ছ্বাসের চোখের দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টিতে না আছে কোনো কপটতা, না আছে লোভ আর না আছে বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্রয়। কিছু একটা তো আছেই চোখজোড়ায়৷ যে অনুভূতি একেবারেই নতুন, এক্কেবারে নতুন।
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটার উপর নিজের কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখে। তার বরফশীতল হাতের ছোঁয়ায় উচ্ছ্বাসের সব উত্তপ্ততা নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে যায়।
প্রজাপতির মতো যেনো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রিয়তা সকাল সকাল। কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে আর মাঝে মাঝেই গুণগুণ করে গান গেয়ে উঠছে নিজের মনেই। মার্জিয়া বেগম নিজের কাজ করতে করতে আড়চোখে তাকায় মেয়ের দিকে। মেয়েটা অনেকদিন মনমরা হয়ে পড়েছিলো। গতকাল আবার জ্বরও হলো। হঠাৎ করে কি এমন হলো আজ তার।
“মা খুব খিদে পেয়েছে, খেতে দাও।”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”তোর খিদে পেয়েছে? সূর্য আজ কোনদিক থেকে উঠলো? যে মেয়ে খাবার দেখলে একশো হাত দূরে থাকে, আজ সকাল সকাল খিদে পেয়ে গেলো তার?”
কবির শাহও ততক্ষণে হাজির হয়েছে।
মার্জিয়া বেগম কথা না বলে সবাইকে খেতে দেয়। মেয়েটা খুব আরাম করে খাচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া হয় তার। গতকাল সেতারা আর তার স্বামীর কীর্তি দেখে খুব ভয় করছে তার। বুকটা কেঁপে ওঠে তার সহসাই। সেতারার জায়গায় নিজের মেয়ের মুখটা বসাতেই ভয় পেয়ে যায় সে। গাড়ি-বাড়ি, সম্পদ এগুলোর লোভে পড়ে সে মেয়েদের ক্ষতি করতে যাচ্ছিলো নাতো?
“মা তুমি কি কিছু বলবে আমাকে? ওভাবে তাকিয়ে আছো যে?”
মার্জিয়া বেগম নিজেকে সামলে বললো,”না ও কিছু না। তুই কি কলেজে যাবি? তোর শরীরটা ভাল না।”
“হ্যা মা, সামনেই পরীক্ষা। এখন একদম বাড়ি বসে থাকা যাবে না। তাছাড়া আমি এখন একদম সুস্থ।”
পেখম আপার দিকে তাকিয়ে কুটকুট করে হাসে, প্রিয়তা লাজুক মুখে মাথা নিচু করে বসে থাকে।
কবির শাহ খেতে খেতে বললো,”যেতে চায় যাক না। শরীর খারাপ লাগলে নাহয় ছুটি নিয়ে চলে আসবে। তুমি আর বাঁধা দিও না।”
মার্জিয়া বেগম কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে যায়। মেয়েটার মুখে যে কারণেই হোক অনেকদিন পর হাসি দেখে দিয়েছে। সে এই হাসি হারিয়ে যাওয়ার কারণ হতে চায়না।
প্রিয়তা বের হওয়ার মুখেই দরজায় বড় খালাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে যায়। এতো সকাল সকাল এই মহিলা কেনো এসেছে?
মর্জিনা বেগম ভ্রু কুঁচকে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কোথায় যাচ্ছিস?”
“কলেজে যাচ্ছি খালা।”
“তোর মা বারণ করেনি যেতে?”
প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”মা বারণ করবে কেনো খালা?”
মর্জিনা বেগম কথা না বলে ফুঁসতে থাকে।
প্রিয়তা আস্তে আস্তে বললো,”আমি আসি খালা? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
মর্জিনা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই একরকম উড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়ে প্রিয়তা। মনে মনে বলে,’উফ খুব বাঁচা বেঁচে গেলাম আজ।’
“তোর সমস্যা কি মার্জিয়া?”
মার্জিয়া বেগম বাঁকা চোখে একবার বোনের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। নিজের কাজগুলো করতে করতে উত্তর দেয়,”কিসের সমস্যা আপা?”
মর্জিনা বেগম যেনো রাগে ফেটে পড়ে।
“এতো কিছু বলার পরেও মেয়েকে কলেজে পাঠিয়ে দিলি? একটা কেলেঙ্কারি না হওয়া পর্যন্ত শোধরাবি না তাইনা?”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না। সকালের এই সময়টা অনেক ব্যস্ত থাকে সে। কথা বলার বা শোনার সময় খুব কম।
তাকে চুপ থাকতে দেখে আরো রেগে যায় মর্জিনা বেগম।
“দেখ মার্জিয়া, নিয়াজের বাড়ি থেকে চায়না তাদের বাড়ির বউ পড়াশোনা করুক, তাছাড়া……”
মর্জিনা বেগমের কথার মাঝেই তার দিকে তাকায় মার্জিয়া বেগম। তার শীতল চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় মর্জিনা বেগম আচমকা।
“আপা মেয়েটা আমার, নিয়াজের পরিবারের না। ও পড়াশোনা করবে কি করবে না ঠিক করবো আমি আর ওর বাবা। কোনো নিয়াজ কিংবা বাইরের কেউ না।”
মর্জিনা বেগম হতবাক হয়ে যায়। এভাবে কেনো কথা বলছে তার বোন তার সাথে?
“তুই কি পরোক্ষভাবে আমাকে বাইরের লোক বললি?”
মার্জিয়া বেগম ঈষৎ হেসে বললো,”পরোক্ষভাবে না আপা প্রত্যক্ষভাবেই বললাম।”
মর্জিনা বেগম চিৎকার করে ওঠে।
“মার্জিয়া মুখে লাগাম টান। ভুলে যাস না তোর মেয়েদের জন্য আমি কতো কিছু করেছি এ পর্যন্ত।”
“একদম ভুলে যাইনি আপা। আমি কৃতজ্ঞ তার জন্য তোমার কাছে। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে আমার মেয়েদের সুখ বলি দেওয়ার কারণ তোমাকে হতে দিবো আমি। আমি বেঁচে থাকতে এ অধিকার কাউকে দিবো না আমি।”
মর্জিনা বেগম অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় বোনের দিকে। কি হলো কি তার হঠাৎ করে?
“আমি তোর মেয়েদের সুখের বলির কারণ? তোর মতো অবস্থা যেনো ওদের না হয়, এজন্য আমি…..”
রক্তচক্ষু মেলে তাকায় বোনের দিকে মার্জিয়া বেগম।
“আমি মা হিসেবে চাই, আমার মেয়েদের অবস্থা যেনো আমার মতোই হয়। ওদের বাবার মতো একজন খাঁটি মানুষ ওদের জীবনে আসুক। যে আর কিছু দিতে না পারলেও সম্মানটুকু দিবে সংসারে।”
মার্জিয়া বেগমের কঠোর কণ্ঠের মুখে থতমত খেয়ে যায় মর্জিনা বেগম। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। একদিনের মধ্যে কি হয়ে গেলো বোনটার তার? কে ব্রেইনওয়াশ করলো তার?
“তুই কি ভেবে বলছিস?”
“একশোবার ভেবে বলছি। আমার মেয়েদের চিন্তা না করে নিজের মেয়েটার দিকে এবার একটু তাকাও আপা। অন্যের সুখ চাইতে যেয়ে তোমার নিজের মেয়েটার কতো বড় সর্বনাশ করেছো একটু দেখো এবার।”
“আমি আমার মেয়ের সর্বনাশ করেছি? জানিস ওর বরের কতো টাকা? টাকায় মুড়িয়ে রাখে মেয়েটাকে।”
মার্জিয়া বেগম শব্দ করে হেসে বললো,”টাকার থেকে অনেক ঊর্ধ্বে রয়েছে সম্মান। পৃথিবীর সব টাকা একত্র করেও সম্মান কিনতে পাওয়া যায়না সংসারে। মেয়েটার চোখের নিচের কালির কারণ খোঁজার চেষ্টা করো আপা একদিন। সেদিন সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।”
মর্জিনা বেগম জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে।
“আমি যে ভুলের সাগরে ডুবে ছিলাম, আমি অনুতপ্ত তার জন্য। আমি চিৎকার করে এখন বলতে পারি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী একজন মেয়ে। কারণ আমার পাশে আমার বটবৃক্ষের মতো স্বামী আছে। যে আমাকে সমস্ত প্রতিকূলতা থেকে এক হাতে সামলাতে জানে। কোটি টাকার খাটে শুয়ে চোখের পানি ফেলার চাইতে, ভাঙা ঘরে শুয়ে সুখের জোয়ারে ভাসা হাজার গুণে ভালো। যেটা হয়তো তুমি কোনোদিন বুঝতে পারবে না।”
চিৎকার করে মর্জিনা বেগম উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,”তোর মেয়েদের আর কোনো ভালোমন্দতে আমি নেই। যা খুশি কর তোরা।”
দরজাতেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলো কবির শাহ। সাইকেলের চাবি ফেলে যাওয়াতে ফিরে এসেছিলো সে। এসেই দুই বোনের কথার মাঝে পড়ে যায়। কাউকে বুঝতে না দিয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো সে তার স্ত্রীর কথা শোনার জন্য। বুকটা আনন্দে ভরে গেছে তার।
“ধন্যবাদ আপা।”
মর্জিনা বেগম কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”ধন্যবাদ কিসের?”
“এইযে আপনি শেষ যে কথাটা বললেন, তার জন্য।”
“অসভ্য কোথাকার।”
হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় মর্জিনা বেগম। গালভরে হাসে কবির শাহ।
হঠাৎ পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরতেই মার্জিয়া বেগম হকচকিয়ে যায়।
“এ কি, তুমি এখানে কেনো? যাও নি এখনো?”
“ভাগ্যিস আজ সাইকেলের চাবিটা ভুলে বাড়িতেই ফেলে গিয়েছিলাম। নাহলে কীভাবে জানতাম আমার বউটা আমাকে এতো ভালোবাসে।”
মার্জিয়া বেগম লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
“বুড়ো বয়সে এসব কি শুরু করেছো তুমি?”
“মেয়েরা কিন্তু বাড়িতে নেই।”
কবির শাহ হাসে, মার্জিয়া বেগমও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসে।
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের হাতের উপর হাত রেখে বললো,”তুমি একদম ঠিক বলেছো। আমার মেয়েদের জন্য একদম খাঁটি মানুষ লাগবে। যারা আমাদের রাজকন্যাদের রানী বানিয়ে রাখবে।হোক ভাঙা ঘর, অভাব থাকুক। তবে ভালোবাসার অভাবটা যেনো কোনোদিন না হয়।”
মার্জিয়া বেগম স্বামীর হাতের উপর আলতো চাপ দিয়ে বললো,”ঠিক আমাদের মতো।”
কবির শাহ স্বপ্নালু চোখ স্ত্রীর দিকে তাকায়। তার বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে যায় নিমিষেই।
(চলবে……)
#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ২৩
ক্লাস শেষে প্রিয়তা রুনার সাথে সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো। সিঁড়ির মুখেই নীলুকে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুনা থেমে যায়, প্রিয়তা তাকায় না সেদিকে।
“কি রে দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো? বাড়িতে যাবি না?”
রুনা ফিসফিস করে বললো,”প্রিয়তা, নীলু আপা মনে হয় তোকে কিছু বলতে চায়।”
“আমার উনার সাথে কোনো কথা নেই। তোর এতো দরকার হলে তুই কথা বল, আমি গেলাম।”
প্রিয়তা কিছুটা ঝাঁঝের সাথে সামনে এগোতে গেলেই নীলু ঝট করে তার বাহু চেপে ধরে।
“ওদিকে চল প্রিয়তা, তোর সাথে আমার কথা আছে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”এখানেই বলুন না, ওদিকে কেনো যেতে হবে?”
নীলু প্রিয়তার কথা শোনে না। প্রিয়তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় কিছুটা নির্জন জায়গায়।
“কি হয়েছে কি নীলু আপা? আমার কাছে কি চান আপনি?”
নীলুর চোখমুখ লাল হয়ে আছে, মনে হয় সে কেঁদেছে কিছুক্ষণ আগেই।
“প্রিয়তা আমি সত্যিই অসহায় হয়ে তোর কাছে এসেছি। তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস না। আমি জানিনা আমি কি করবো। আমার অসহ্য লাগছে সবকিছু।”
প্রিয়তা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নীলুর দিকে। বোঝার চেষ্টা করে নীলুর কথা।
“দয়া কর প্রিয়তা, এখন তুই ছাড়া আমি কাউকে পাচ্ছি না যে আমাকে এই চোরাবালি থেকে টেনে তুলবে।”
নীলুর কান্নাজড়িত মুখটা দেখে খুব মায়া হয় প্রিয়তার। তার মুখের কঠিন রেখাগুলো কিছুটা সহজ হয়ে আসে।
যথাসম্ভব নরম গলায় প্রিয়তা বললো,”কি হয়েছে নীলু আপা? আমাকে সবটা খুলে বলুন।”
নীলু নাক টানে, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। প্রিয়তা অপেক্ষা করে নীলুর দিকে তাকিয়ে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নীলু মুখ খোলে।
“সারাজীবন রূপের অহংকার ছিলো আমার মধ্যে। আমি মনে করতাম আমি যাকে পছন্দ করবো, সে-ই আমার হবে। কতো ছেলেদের মন নিয়ে খেলেছি আমি। কিন্তু সত্যি বলতে কখনো প্রেম কি আমি বুঝিনি। সত্যিকারের ভালোবাসা কি বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে আমি প্রেমে পড়েছি। খুব বিশ্রীভাবে একজনের প্রেমে পড়ে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। আমাকে বলে দে আমি কি করবো।”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”কার প্রেমে পড়েছেন নীলু আপা?”
প্রিয়তা নি:শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে নীলু কার নাম বলতে চলেছে, তবুও সে শুনতে চায়।
নীলু ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। প্রিয়তা ইতস্তত করতে থাকে।
“প্রিয়তা আমি তোর উচ্ছ্বাস ভাইয়ের প্রেমে পড়েছি। আমি মানুষটাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছি। কতোগুলো দিন হয়ে যায় আমি উনাকে দেখতে পারছি না। এই বিরহ যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। হয় তুই আমাকে উনার ঠিকানা দে, নাহয় আমাকে শেষ করে দে একেবারে।”
প্রিয়তার কান গরম হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগেই যার জন্য এতো মায়া লাগছিলো, তাকেই বিষের মতো লাগে প্রিয়তার। নীলুর নির্লজ্জতা দেখে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে যেনো সে।
আচমকা নীলু প্রিয়তার হাত চেপে ধরে। প্রিয়তার কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
“তুই আমাকে ফিরিয়ে দিবি না প্রিয়তা, এটা আমি জানি। তুই বল উনি কোথায় আছে। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোর কাছে।”
তড়িৎগতিতে হাত সরিয়ে নেয় প্রিয়তা। রাগে নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তার।
“আপনি আসলে কি চান নীলু আপা? এসব পাগলামির মানে কি? আপনি কি ষোড়শী কিশোরী? এভাবে কাউকে দেখেই প্রেম হয়ে যায়? কতোটুকু জানেন আপনি উনার ব্যাপারে? খোঁজ রাখেন তার সম্পর্কে? কি তার পরিচয়, কি তার পূর্ব জীবন আর কোথায় তার পরিবার? কিছুই না জেনে এভাবে প্রেমে পড়ার বয়স কি আপনার আছে?”
কান্নাভেজা চোখে নীলু তাকায় প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা এখনো রাগে কাঁপছে, ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে তার।
“উনার পরিবার বলতে কেউ নেই, বলতে পারেন অনাথ একজন মানুষ সে। বাবা-মা সবাইকে হারিয়ে যখন সে পাগলপ্রায়, তখন আমার বাবা তাকে আমাদের বাড়িতে এনে তোলে। আপনার বাবা এই এলাকার একজন নামীদামী মানুষ। তিনি কি এমন একজন ছেলে যার পরিবার বলে কিছুই নেই তার কাছে মেয়েকে তুলে দিবেন? নাকি আপনি যাবেন এমন কারো কাছে?”
নীলু বিস্ফারিত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন কিছু শুনতে হবে সে কোনোদিন ভাবতে পারেনি। ঠোঁট কাঁপতে থাকে তার তিরতির করে।
প্রিয়তা নিজেকে কিছুটা সামলে নরম গলায় বললো,”নীলু আপা, আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। আপনি যেটাকে ভালোবাসা বলছেন, সেটা নেহাৎই ভালো লাগা, আর কিছুই নয়। সারাজীবন আপনি এটাই দেখে এসেছেন যে, আপনি যাকে প্রেম নিবেদন করেছেন সে নিজেই প্রেমিক পুরুষ হয়ে আপনার কাছে ধরা দিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম এমন একজনকে আপনি দেখেছেন, যে আপনার ভালোবাসাকে পাত্তাই দেয়নি। আপনি তার এই ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছেন। এমন সুদর্শন ব্যক্তিত্ববান একজন মানুষকে চট করে ভালো লেগে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন তার কালো অতীতকে একইভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না, তখন বুঝতে পারবেন এটা ভালোবাসা নয়, ভালোলাগা।”
প্রিয়তা থামে, সে নিজেও জানেনা এতোগুলো কথা সে কীভাবে একনাগাড়ে বলে গেলো। কেউ তাকে এগুলো শিখিয়ে দেয়নি, এগুলো প্রতিটা তার মনের কথা। সে তো নিজেই উচ্ছ্বাসের সবকিছু মেনে নিয়ে তাকে ভালোবেসেছে।
নীলু আহত গলায় বললো,”তুই এগুলো মিথ্যা বলছিস তাইনা? আমি জানি সব মিথ্যা, সব।”
রাগে, ক্ষোভে প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে তাকায় নীলুর দিকে। এই মুহুর্তে এই লজ্জাহীনা মেয়েটার দিকে তাকালেই অস্বস্তি লাগছে তার।
“বেশ আমি মিথ্যা বলছি, তবে আপনি নিজেই খোঁজ নিয়ে দেখুন। দয়া করে আমাকে এসব বলতে আসবেন না।”
প্রিয়তার আরো কিছু শোনানোর ইচ্ছা ছিলো নীলুকে। কিন্তু অতিরিক্ত রাগে সে কোনো কথা বলতে পারেনা। নীলুকে ওই অবস্থায় রেখেই হনহন করে হেঁটে চলে যায় সেখান থেকে। স্থাণুর মতো জমে নীলু দাঁড়িয়ে থাকে শূণ্যের দিকে দৃষ্টি ফেলে।
বাড়ির কাছে আসতেই প্রিয়তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। তার মনে হয় সবকিছু ঠিক নেই, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। বাড়ির সদর দরজায় বড় একটা তালা ঝুলছে। সাধারণত এই সময় এরকমটা হওয়ার কথা না। তাছাড়া তার মা মার্জিয়া বেগম জানে সে এখন কলেজ থেকে ফিরবে। এই সময়ে দরজা বন্ধ থাকার কোনো কারণই নেই।
প্রিয়তা ছুটে এসে তালাটা উল্টেপাল্টে দেখে। ভীষণ অসহায় লাগে তার। তাকে না জানিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা না তার মায়ের। সে অনেকবার চিৎকার করে পেখমকে ডাকে, তার বাবাকে ডাকে। তার বাবা এই সময় বাড়িতে থাকে না। স্কুল শেষে সে টিউশন পড়ায় কয়েকজন ছাত্রকে।
টিউশনের কথা মনে পড়তেই তার মাথায় আসে তার বাবা তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই পড়ায়। প্রিয়তা ঠিক করে সে সেখানে যাবে।
ঠিক এমন সময় পাশের বাড়ির একজন ভদ্রমহিলা ছুটে আসে প্রিয়তার কাছে।
“মা গো, তুমি ফিরেছো?”
“কি হয়েছে চাচী? এমন লাগছে কেনো আপনাকে?”
মহিলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রিয়তা অস্থির হয়ে তার কাঁধে হাত রেখে চিৎকার করে বললো,”চাচী দয়া করে বলুন কি হয়েছে। আপনি জানেন আমার মা কোথায়?”
মহিলাকে চুপ থাকতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় প্রিয়তা। অজানা আশঙ্কায় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার। সে নিশ্চিত কোনো বিপদ হয়েছে, অনেক বড় কোনো বিপদ।
নিজের ডেরায় বসে পা ছড়িয়ে সিগারেট টানছিলো উচ্ছ্বাস। মন না চাইতেও প্রিয়তার মুখটা বারবার ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। কতোশত রূপবতী মেয়ে চোখে পড়ে, কখনো তো প্রিয়তার মতো ভালো লাগেনি তাকে। কি আছে ওই শ্যামবর্ণা মায়াবতীটার মধ্যে? উচ্ছ্বাস মনের অজান্তেই হেসে দেয়।
ঠিক এমন সময় রাসেল এসে বললো,”ভাই আপনি এখানে? অনেক বড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে তাকায় রাসেলের দিকে।
“কি হয়েছে রাসেল? সব ঠিক আছে তো?”
ছেলেটা আমতা আমতা করতে থাকে।
উচ্ছ্বাস সিগারেট ফেলে দিয়ে রাসেলের কাঁধে হাত রেখে বললো,”এই রাসেল আমার দিকে তাকা, কি হয়েছে বল। প্রিয়তা, প্রিয়তা ঠিক আছে তো?”
রাসেল মাথা নাড়ে।
কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাস। তার কাছে এখন প্রিয়তার ভালো থাকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই।
“তাহলে কি হয়েছে? শয়তানগুলোর মধ্যে একটাও কি মরেছে?”
রাসেল মাথা নিচু করে বললো,”আপনার মামাকে কে বা কারা যেনো ছুড়ি আঘাত করেছে। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে।”
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় উচ্ছ্বাস। হতভম্ব হয়ে যায় সে রাসেলের কথা শুনে।
“তুই কার কথা বলছিস? এক মিনিট, তুই কোনোভাবে প্রিয়তার বাবার কথা বলছিস না তো?”
রাসেল মাথা নিচু করে বললো,”স্কুল শেষে টিউশন পড়াতে যাওয়ার সময় কবির শাহকে কারা যেনো ছুড়ি আঘাত করেছে। অবস্থা খুবই শোচনীয়। উনার স্ত্রী উনাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। তবে যতোটা শুনলাম, অবস্থা ভালো না।”
উচ্ছ্বাস চিৎকার করে ছিটকে যায় দূরে। এই মানুষটাকে সে নিজের বাবার মতো ভালোবেসে ফেলেছে। মাঝে মাঝে নিজেকে ওই মানুষটার সন্তান ভেবে ফেলেছে সে বারবার। তার কিছু হয়ে গেলে উচ্ছ্বাস আবারও কাছের মানুষ হারানোর মতো কষ্ট পাবে।
হঠাৎ প্রিয়তার কথা মনে পড়তেই তার চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে।
“রাসেল।”
“জ্বি ভাই বলেন।”
“উনি এখন কোন হাসপাতালে আছে?”
রাসেল চোখ বড় বড় করে বললো,”আপনি যাবেন?”
রাসেলের চোখে চোখ রেখে উচ্ছ্বাস বললো,”কথা কম। এখন ওদের আমাকে দরকার, বুঝতে পেরেছিস?”
মায়ের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে শুণ্যের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। তার মনে হচ্ছে কোনো একটা দু:স্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তারা, ভয়ংকর একটা দু:স্বপ্ন। ঘুমটা ভেঙে গেলেই স্বপ্নটাও ভেঙে যাবে। তখন আবার দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। বাবা হাসিমুখে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে, আর মা অল্পতেই রেগে বাবার সাথে চিৎকার করছে। মা যতো রাগ করছে, বাবা তত মিটমিট করে হাসছে। এই মুহূর্তটা সত্যি হতে পারেনা, কোনোভাবেই না। এটা অবশ্যই একটা দু:স্বপ্ন, তাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে বাজে দু:স্বপ্ন।
মার্জিয়া বেগমের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছিলো সে। পেখম মায়ের মুখে পানি ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়েছে। প্রিয়তা ঠিক তখনই এসে পৌঁছায়।
এই মুহুর্তে মার্জিয়া বেগম কাঁদছে না। প্রিয়তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে নির্লিপ্ত চোখে বসে আছে। প্রিয়তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি এসে পড়ে মার্জিয়া বেগমের হাতের উপর।
“মানুষটা তার জীবনে কাউকে কোনোদিন ছোট করে কথা বলেনি। কাউকে কষ্ট দেয়নি। সবাইকে শুধু ভালোবাসা বিলিয়েই গেলো। কে তার শত্রু হতে পারে? কে করতে পারে এই কাজ? আজীবন সহজ সরল থাকা মানুষটাকে এতো বড় শাস্তি কে দিলো?”
মার্জিয়া বেগম আবারও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
প্রিয়তা মায়ের মাথাটা আরো শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,”শান্ত হও মা, শান্ত হও। আমার বাবার শত্রু কেউ হতে পারে না।”
“সারাজীবন মানুষটাকে ভুল বুঝে গেলাম। এই প্রথম আমার মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে আমি একা। ওই মানুষটা ছাড়া আমার আর কেউ নেই এই দুনিয়ায়। আমি অন্ধ ওকে ছাড়া। কেনো এই দিন দেখতে হলো আমাকে?”
পেখম ফুঁপিয়েই যাচ্ছে মায়ের পাশে বসে। বাবা ছাড়া আসলেই তারা অন্ধ। খারাপ কিছু এখন ভাবতেও পারছে না তারা কেউ।
“আপা।”
প্রিয়তা লাল ভেজা চোখে পেখমের দিকে তাকায়।
“আমার সাথে একটু ওদিকে চল। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আছে তোর সাথে।”
প্রিয়তা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”এখানেই বল, মায়ের এই অবস্থায় মাকে ফেলে যাবো কীভাবে?”
“এখানে বলা যাবে না আপা। তবে তোকে এখনই কথাটা বলতে হবে আমাকে।”
প্রিয়তা মার্জিয়া বেগমের মাথাটা চেয়ারে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তার শরীরও ক্লান্তি আর অবসাদে ভেঙে পড়ছে। বাবার ভালো কোনো খবর না পাওয়া পর্যন্ত অস্থির হয়ে আছে মনটা।
প্রিয়তাকে টানতে টানতে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসে পেখম। কিছুটা ইতস্তত করে আস্তে আস্তে সে বললো,”আপা কারা এই কাজ করেছে এটা মনে হয় আমি জানি।”
প্রিয়তা চমকে উঠে বললো,”কি বলছিস তুই? যদি জানিস তাহলে এতোক্ষণ চুপ করে আছিস কেনো? কে করেছে এই কাজ?”
পেখম চাপা গলায় বললো,”আমার এক বন্ধু স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখেছিলো কয়েকটা ছেলের সাথে বাবার তর্কবিতর্ক হচ্ছিলো। তারা বলছিলো, বাবা নাকি একজন গুন্ডা দিয়ে তাদের মার খাইয়েছে। সম্ভবত ওরা তারাই ছিলো, যারা তোকে কলেজ থেকে ফেরার পথে বিরক্ত করতো। আর উচ্ছ্বাস ভাই যাদের খুব মেরেছিলো। হতে পারে ওরাই এভাবে প্রতিশোধ নিলো বাবার উপর।”
পেখমের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় প্রিয়তা। তার মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা বুঝি গলার কাছে এসে ধকধক করে কাঁপছে। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলেই পেখম তাকে চেপে ধরে।
“আপা তুই ঠিক আছিস?”
প্রিয়তা পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়ে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে তার। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে জ্ঞান হারাবে।
“দেখুন আপনাদের সব কথাই বুঝতে পারছি আমরা। তবে আমাদের ব্যাপারটাও তো আপনাদের বুঝতে হবে। এটা একটা পুলিশ কেস। এভাবে আমরা হুট করে চিকিৎসা শুরু করে দিতে পারিনা। যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়, আমাদেরই সমস্যা হবে। কেনো বুঝতে চাচ্ছেন না আপনারা? তাছাড়া এমন ক্রিটিকাল চিকিৎসার জন্য এককালীন আপনাদের বেশ কিছু টাকা জমা করতে হবে। নাহলে আমরা কোনোভাবেই উনার চিকিৎসা শুরু করতে পারবো না।”
মার্জিয়া বেগম হাতজোড় করে ডাক্তারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,”আমার দুইটা মাত্র মেয়ে, ওরা এখনো অনেক ছোট। এসব থানাপুলিশ ওরা কিছুই বোঝে না। কাছের আত্মীয় বলতে আমার একজন বোন আছে। আমি তাকে খবর পাঠিয়েছি অনেকক্ষণ হলো। সে আসলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি দয়া করে এভাবে চিকিৎসা বন্ধ করে দিবেন না, মানুষটা মরে যাবে।”
মার্জিয়া বেগম চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। হাসপাতাল ভারী হয়ে ওঠে মার্জিয়া বেগমের কান্নায়।
“দেখুন আপনাদের পারিবারিক সমস্যা বুঝতে যেয়ে তো আমরা বিপদে পড়তে পারিনা। নিয়মের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। আগে জিডি করবেন এরপর টাকা জমা দিবেন। তারপর আমরা আমাদের কাজ শুরু করবো। এর আগে আমরা রোগীর শরীর স্পর্শ করতে পারবো না।”
“সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে ডাক্তার সাহেব, আপনি আপনার কাজ শুরু করুন।”
গম্ভীর পুরুষালি গলার আওয়াজ শুনে সবাই চমকে উঠে তাকায়। আওয়াজের দিকে ঘুরে তাকাতেই থমকে যায় সবাই।
বুকে হাত বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। তার চোখে কালো সানগ্লাস পরে থাকায় সে কোনদিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যাচ্ছেনা।
মার্জিয়া বেগম হতভম্ব গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস, তুমি?”
পেখম হেসে দেয় কষ্টের মাঝেও। শুধু প্রিয়তার মুখে হাসি নেই। সে অবিশ্বাস্য চোখে শুধু তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে।
ডাক্তার এগিয়ে যায় উচ্ছ্বাসের কাছে।
“আপনি কে? আপনার পরিচয় কি?”
উচ্ছ্বাস চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে বললো,”আমি কে এই মুহুর্তে আপনার না জানলেও চলবে। আপনি যে কারণে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি করছেন আমি সেগুলো ইতোমধ্যেই কাউন্টারে জমা করে দিয়েছি, চাইলে দেখে নিবেন। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব উনার চিকিৎসা শুরু করুন।”
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে।
“আপনারা ডাক্তার, কসাই না। সবকিছুর উপরে আপনাদের কাছে রোগীর জীবন বাঁচানোটাই মুখ্য হওয়া উচিত। এখন এভাবে তাকিয়ে না থেকে আপনার কাজে যান। রোগীকে সুস্থ না করে আমি হাসপাতাল ছাড়বো না। আপনার যা কিছু দরকার আমাকে এসে বলবেন। উনাদের কিছু বলে তাদের মানসিক অবস্থাটা আরো দূর্বল করে দিবেন না।”
ডাক্তার মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। মার্জিয়া বেগম আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
ডাক্তার চলে যেতেই পেখম ছুটে আসে উচ্ছ্বাসের কাছে।
“উচ্ছ্বাস ভাই।”
শব্দ করে কেঁদে দেয় সে। উচ্ছ্বাস হালকা হেসে পেখমের মাথায় হাত রেখে বললো,”কেঁদো না পেখম। তোমার বাবা আর যাই হোক, তার দুই রাজকন্যার চোখের পানি সহ্য করতে পারতো না। চোখ মুছে মায়ের পাশে বসো। কোনো ভয় নেই, আমি আছি। যে কোনো দরকারে আমাকে পাশে পাবে।”
উচ্ছ্বাস কথা শেষ করে প্রিয়তার দিকে তাকায়। মাত্র কয়েক ঘন্টায় মেয়েটাকে চেনাই যাচ্ছেনা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে তার। লাল পদ্মের মতো লাগছে তার চোখ দু’টো। উচ্ছ্বাসের ইচ্ছা করে খুব যত্নে তার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলতে,’ভয়ের কি আছে? আমি আছি তো পাশে।’
প্রিয়তা অনড় দাঁড়িয়ে আছে। উচ্ছ্বাস আসায় সে খুশি নাকি অখুশি বোঝা যাচ্ছেনা। তার ব্যবহারে উচ্ছ্বাস কিছুটা অবাক হয়। পরক্ষণেই ভাবে হয়তো বাবার এমন অবস্থায় সে কোনো অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না।
মার্জিয়া বেগম ধীর পায়ে হেঁটে উচ্ছ্বাসের সামনে এসে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাস ম্লান হেসে বললো,”মামী ভয় পাবেন না। উনার মতো ফেরেশতা তুল্য একজন মানুষের জীবন এভাবে চলে যেতে পারেনা। উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন, দেখে নিবেন আপনি।”
মার্জিয়া বেগম উচ্ছ্বাসের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”কেনো তুমি আমাদের জন্য এতোকিছু করছো? তোমার সাথে তো আমি অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। আমার জন্য তুমি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছো। তবে আজ হঠাৎ…..”
“ওই মানুষটা আমার জন্য যা করেছে, আমার আমার জীবনের প্রতিটা রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তার ঋণ শোধ করতে পারবো না। এটা তার কাছে কিছুই না।”
“তবে কি তুমি ঋণ শোধ করতে চাচ্ছো?”
“কিছু কিছু মানুষের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে চাইনা। তাদের কাছে আজীবন আম ঋণী থাকতে চাই। কবির শাহ নামক মানুষটা আমার জীবনে একটি বটবৃক্ষ। তার কাছে আমি আজীবন ঋণী থাকতে চাই। এটা শুধুমাত্র আপনাদের থেকে পাওয়া ভালোবাসার ছোট্ট একটা বহিঃপ্রকাশ, আর কিচ্ছু না।”
মার্জিয়া বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ওঠে।
“আমার নিজের লোকেরা পর্যন্ত আমার এই বিপদে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। অথচ তাদের কথা শুনে আমি আমার পরিবারে কতো অশান্তি করেছি, মানুষটাকে ছোট করেছি।”
উচ্ছ্বাস পকেট থেকে রুমাল বের করে মার্জিয়া বেগমের দিকে তুলে ধরে।
“কাঁদবেন না মামী। আমার মা নেই, মায়ের মতো কারো চোখে আমি পানি সহ্য করতে পারিনা। এ ক্ষমতা আমাকে সৃষ্টিকর্তা দেয়নি।”
মার্জিয়া বেগম কাঁপা কাঁপা হাতে রুমালটা হাতে তুলে নেয়। একদৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায় সে। ছেলেটাকে আজ এতো আপন লাগছে কেনো? মনে হচ্ছে ছেলেটার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে। অনেক অন্যায় করেছে সে এই ছেলেটার সাথে। বাবা-মাকে হারিয়ে অসহায় অবস্থায় তাদের কাছে এসেছিলো। সে কি পারতো না একটু স্নেহের পরশে ছেলেটাকে আগলে রাখতে? খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? অনুশোচনায় আড়ষ্ট হয়ে আসে মার্জিয়া বেগম।
“মহান সাজা কি আপনার স্বভাবেই আছে?”
হাসপাতাল থেকে বাইরে এসে উচ্ছ্বাস সিগারেট ধরিয়েছিলো, কারণ ভিতরে ধূমপান নিষেধ।
প্রিয়তাকে দেখেই উচ্ছ্বাস সিগারেট ফেলে দেয়।
“তুমি এখানে?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না, কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে।
“আমি আসায় মনে হচ্ছে তুমি খুশি হও নি।”
“আজ যদি আপনি আমাদের জীবনে না আসতেন, তবে হয়তো এই দিনটাই আমাদের দেখতে হতো না।”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে বললো,”ঠিক বুঝলাম না তোমার কথা।”
“নায়ক সাজতে ইচ্ছা করে? বিপদে হাজির হয়ে নিজেকে সুপারম্যান মনে করেন? আজ আপনার এই অতিরিক্ত মহান সাজার জন্য আমাদের এই অবস্থা।”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার শরীর থেকে সিগারেটের ধোঁয়া মিশ্রিত একটা গন্ধ আসছে। যে গন্ধ প্রিয়তার অসম্ভব প্রিয় ছিলো। কিন্তু আজ ভালো লাগছে না।
“তুমি কি বলছো এসব? তুমি কি কোনো কারণে মামার এই অবস্থার জন্য আমাকে দায়ী করছো?”
প্রিয়তা হালকা চিৎকার করে বললো,”অবশ্যই আপনি দায়ী। আজ আপনার জন্য এই অবস্থা আমাদের।”
চোখ বড় বড় করে উচ্ছ্বাস ফিসফিস করে বললো,”পাগল হয়ে গেলো নাকি শুয়োপোকাটা?”
“এই কি বললেন আমাকে?”
“কিছু বলিনি। দয়া করে এটা বলো তোমাদের এই অবস্থার জন্য আমি কীভাবে দায়ী?”
প্রিয়তা ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,”আমাকে কলেজ থেকে ফেরার সময় বিরক্ত করেছে দেখে কেনো মারতে গেলেন তাদের? কে বলেছিলো এতো মাতব্বরি করতে? আমি বলেছিলাম? আমাকে একটু কলেজে এগিয়ে দিতে বলেছিলাম, এটাই কি আমার অন্যায় ছিলো? কে বলেছিলো এতো হিরো সাজতে?”
একদমে কথাগুলো বলে থামে প্রিয়তা।
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”ওই বদমাশগুলোই কি তবে মামার উপর আক্রমণ করেছে?”
“জেনে কি করবেন আপনি? আমার মারবেন ওদের? আমাদের পুরো পরিবারটাকে এবার শেষ করে দিতে চান?”
উচ্ছ্বাস দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,”তুমি শুধু বলো এই কাজ কি ওরা করেছে? তুমি কি নিশ্চিত?”
“এবার থামুন দয়া করে, অনেক করেছেন আমার জন্য। আর কিচ্ছু করা লাগবে না। আমি হাতজোড় করে অনুরোধ করছি আপনার কাছে।”
উচ্ছ্বাস জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। তার ফর্সামুখ রাগে লাল হয়ে যায়।
ঠিক এমন সময় পেখমের চিৎকারে কেঁপে ওঠে উচ্ছ্বাস, প্রিয়তা দুইজনই। পেখম চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ওদের দিকেই ছুটে আসছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে প্রিয়তার। কোনো খারাপ খবর কি নিয়ে আসছে পেখম? প্রিয়তার মনে হয় এবার সত্যিই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে।
(চলবে…….)