#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ২০
“আচ্ছা পেখম তোর কি মনে হয় উচ্ছ্বাস ভাই ফিরে আসবে?”
পেখম হাসিমুখে বললো,”আসবে না মানে? অবশ্যই আসবে, একশোবার আসবে। শোন আমি একটা সিনেমা দেখেছিলাম। নায়ক নায়িকাকে ফেলে অনেক দূরে চলে যায়। নায়িকা অনেক কষ্ট পায়। তবুও নায়ক ফিরে আসে না। এরপর হঠাৎ করে একদিন নায়িকার অন্য একটা ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। যেদিন বিয়ে, ঠিক সেদিন নায়ক ফিরে আসে। শেষমেশ নায়কের সাথেই বিয়ে হয়।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”তো এখানে ওই গল্প শোনানোর মানে কি?”
পেখম ঠোঁট উলটে বললো,”তুইও এক কাজ কর। ওই টাক বেটা নিয়াজকে বিয়ের ঘোষণা দে। ঠিক বিয়ের দিন দেখবি উচ্ছ্বাস ভাই এসে হাজির। একদম পঙ্ক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে তোকে নিয়ে যাবে। বেচারা নিয়াজ টাক মাথায় সরষের তেল ঢালবে।”
প্রিয়তা রাগে লাল হয়ে বললো,”পেখম ভালো হবে না কিন্তু।”
“আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হ। তোর এই পেঁচার মতো মুখটা দেখতে আর ভালো লাগছে না। তাই একটু মজা করলাম তোর সাথে।”
প্রিয়তা ধীরে ধীরে হেঁটে জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। রাতের আকাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করে, কোথাও মেঘ জমেছে কিনা। কারণ মেঘ জমলেই বৃষ্টি হতে পারে। আর ওই মানুষটা কথা দিয়েছে যে এরকম কোনো এক মাতাল করা বৃষ্টির দিনে সে আসবে। কথা দিয়ে কথা না রাখার মানুষ সে না।
পেখম উঠে এসে আপার পিছনে দাঁড়ায়। প্রিয়তার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,”আপা আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস?”
প্রিয়তা মৃদু গলায় বললো,”কি?”
“আমার মনে হয় তুই উচ্ছ্বাস ভাইকে যতোটা ভালোবাসিস, উনি তোকে তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসে।”
প্রিয়তা চমকে উঠে বললো,”কীভাবে বুঝলি?”
“সেই পহেলা বৈশাখের দিনের কথা মনে আছে? ওইদিন উনার চোখেমুখে আমি রাগের আড়ালে তোর জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম।”
প্রিয়তার শরীরে উষ্ণ স্রোত বয়ে যায়।
নিজেকে সামলে পেখমের কান ঈষৎ টেনে বললো,”খুব পেকেছিস তুই। এবার বাবাকে বলে তোর ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।”
পেখম খিলখিল করে হেসে দেয়। প্রিয়তাও হাসে। অনেকদিন পর দুই বোনের হাসির শব্দ শোনা যায়।
কবির শাহ টিউশন করিয়ে ফিরেই প্রথম মেয়েদের ঘরে আসে, এরপর অন্য কথা। মেয়েদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দুই মেয়েকে এভাবে খোলা প্রাণে হাসতে দেখে মনটাই ভালো হয়ে যায় তার। বড় মেয়েটার মুখে কতোদিন পর হাসি দেখা গেলো। মেয়েটা না হাসলে যে বাড়ি নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।
“আচ্ছা আমি বরং তবে পরেই আসি।”
দুই বোন ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে দেখতেই হাসি থামিয়ে দেয় জোর করে। তাও ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকে।
পেখম ছুটে যেয়ে বাবার এক হাত চেপে ধরে।
“পরে আসবে মানে? এমন কি কোনোদিন হয়েছে যে তুমি বাইরে থেকে ফিরে আমাদের ঘরে পরে এসেছো?”
কবির শাহ মুচকি হাসে।
“তোরা দুই বোন তো খুব হাসাহাসি করছিলি, তাই আর বিরক্ত করতে চাইনি তোদের।”
প্রিয়তা স্মিত হেসে বাবার আরেক হাত ধরে।
“তুমি শুধুমাত্র আমাদের বাবা নও, তুমি আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সেই শৈশব থেকে দেখে আসছি তুমি যেমন বটবৃক্ষের মতো আমাদের আগলে রেখেছে ঠিক তেমনই বন্ধুর মতো পাশে থেকেছো। তুমি আসায় আমরা বিরক্ত হবো?”
দুই মেয়ে দুই পাশ থেকে হাত চেপে রেখেছে শক্ত করে। কবির শাহ চাইলেও চোখের পানিটুকু মুছতে পারছে না।
“ও বাবা খুব খিদে পেয়েছে।”
প্রিয়তা পেখমের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো,”একটু আগেই তো সন্ধ্যার নাস্তা করলি, এরমধ্যেই খিদে পেয়ে গেলো তোর?”
পেখম অসহায় মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”পেলে কি করবো বাবা?”
কবির শাহ দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে তাকায়।
মেয়েদের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,”চটপটি খাবি?”
পেখম হইহই করে উঠতেই কবির শাহ মুখে আঙ্গুল দেয়।
“আস্তে আস্তে চিৎকার কর। তোর মা জানলে কুরুক্ষেত্র বাঁধাবে। গতবার পেট খারাপ বাঁধিয়ে তুই তোর মায়ের কাছে বকা শুনিয়েছিস আমাকে।”
পেখম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”আমি?”
প্রিয়তা চোখমুখ কুঁচকে বললো,”তা নয়তো কি? বললাম এক প্লেট খা আপাতত। গুণে গুণে তিন প্লেট সাবাড় করে ফেললি। এরপর বাড়ি এসে পেট খারাপটা যে হলো তোর। এরপর থেকেই তো মা আমাদের বাইরে চটপটি খাওয়া বন্ধ করে দিলো।”
কবির শাহ দুই মেয়েকে থামায়।
“থাম থাম, তোদের চিৎকারেই তো তোদের মা বুঝতে পারবে। যেতে চাইলে ঝটপট তৈরি হয়ে নে। সময় মাত্র পাঁচ মিনিট।”
“বাবা পাঁচ মিনিটে তৈরি হওয়া যায়?”
কবির শাহ একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকায়, যে দৃষ্টির অর্থ যেতে চাইলে পাঁচ মিনিটেই তৈরি হতে হবে।
“মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
কবির শাহ জোর করে হেসে বললো,”এই একটু হাওয়া খেয়ে আসি। কি রে চুপ করে আছিস কেনো তোরা? বল কিছু।”
পেখমও একটা তেলতেলে হাসি দিয়ে বললো,”হ্যা মা, যা গরম পড়েছে। বাইরে থেকে একটু হাওয়া খেয়ে এলে মন্দ হয়না।”
মার্জিয়া বেগম কাজ করতে করতে নির্লিপ্ত মুখে বললো,”গতবার হাওয়া খেতে যেয়ে যে পেট খারাপ বাঁধালে, এবারও এমন কিছু হলে আমাকে রাতে ডাকতে আসবে না। ‘ওমা পেট ব্যথা করছে, ও মা ওষুধ দাও।’ যে হাওয়া খাওয়াতে উষ্কানি দিচ্ছে তাকেই ডেকো, কেমন?”
কবির শাহ দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। বরাবরই তার স্ত্রীর বুদ্ধির কাছে হেরে যেতেই হয় তাকে।
“আসলে মার্জিয়া তুমি যা ভাবছো এমন কিছু না……”
“এই নমুনা দু’টোকে আমি পেটে ধরেছি তুমি না মাষ্টারমশাই। তাই ওদের মুখ দেখলে আমি ওদের ভিতরে কি চলছে বলে দিতে পারি।”
শেষের কথাটা মার্জিয়া বেগম কিছুটা জোর দিয়ে বলে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কবির শাহ ছোট্ট করে হেসে স্ত্রীর কাছে যেয়ে দাঁড়ায়।
“পাঁচ মিনিটে তৈরি হতে পারবে?”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”এই রাতে তৈরি হবো মানে?”
“আজ নাহয় তুমিও আমাদের সাথে হাওয়া খাবে।”
“না না আমি এসবের মধ্যে নেই।”
প্রিয়তা পেখম দুইজনই ভীষণ জোরাজোরি শুরু করে দেয়।
“ও মা চলো না, খুব মজা হবে।”
মেয়েদের না বলার জন্য কবির শাহের দিকে তাকাতেই সে কিছুটা থমকে যায়। কবির শাহ সুন্দর করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো চোখ দিয়েই আকুতি করছে।
মার্জিয়া বেগম কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”আমি যেতে পারি কিন্তু একটা শর্তে। আমি কিছু খাবো না।”
পেখম চিৎকার করে বললো,”আচ্ছা মা, সে দেখা যাবে। মনির চাচা চটপটি যা বানায় না, ঘ্রাণেই তোমার…..”
মার্জিয়া বেগম রাগী চোখে তার দিকে তাকাতেই পেখম থেমে যায়।
“অনুরোধটা যখন রাখলেই তবে আরেকটা অনুরোধ রাখবে মার্জিয়া?”
“আবার কি?”
“তোমার ওই ধূসর পাড়ের নীল শাড়িটা পরবে? ওটায় দারুণ লাগে তোমাকে।”
মার্জিয়া বেগম কপট রাগ দেখায়, ভিতর ভিতর লজ্জায় লাল হয়ে যায় একদম। মেয়েদের সামনে লোকটা কি শুরু করেছে? বয়স বাড়ছে আর বোধবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে লোকটার।
পেখম প্রিয়তার ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো,”আপা রে আমাদের কেউ এখনো প্রেম দেখিয়ে শাড়ি পরার আবদার করেনা। দেখেই যেতে হবে আমাদের।”
মার্জিয়া বেগম কোমরে হাত বেঁধে বললো,”অসভ্য মেয়ে, বাবা মায়ের সাথে মজা করা হচ্ছে? এবার কিন্তু মার খাবি আমার কাছে।”
মার্জিয়ার রাগ দেখে কবির শাহ হাসে। হাসি সংক্রামক, প্রিয়তা আর পেখমও নিজেদের জীবনের সব কষ্ট ভুলে মন খুলে হাসতে থাকে। মধ্যবিত্ত সংসারের পুঁজি বুঝি শুধু এই নির্মল হাসিটুকুই। এটাই তাদের বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র।
ঘোরাঘুরি করে আসতে আসতে বড্ড রাত হয়ে যায়। প্রিয়তা ঘড়িতে দেখে রাত প্রায় দশটা বাজতে চললো। গরমে ঘামে ভিজে অস্থির হয়ে আছে তারা। তবুও মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে আছে। কতোদিন পর তারা চারজন এভাবে মজা করে চটপটি খেলো। ওরা বড় হয়ে যাওয়ার পর এমন সুযোগ আর তেমন আসেনি তাদের জীবনে।
কিন্তু দূর থেকেই তাদের বাড়ির সামনে মর্জিনা বেগমের গাড়ি থেমে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায় তারা।
মার্জিয়া বেগম কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”কি হয়েছে বলো তো? আপা এতো রাতে এখানে কেনো? কোনো সমস্যা হলো নাকি?”
“আমিও তো বুঝতে পারছি না।”
দ্রুততার সাথে হেঁটে আসে মার্জিয়া বেগম। গাড়ির সামনেই ঘর্মাক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে মর্জিনা বেগম।
“কি সমস্যা তোদের? সবাই মিলে গিয়েছিস কোথায়?”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেওয়ার আগেই পেখম মুখ টিপে হেসে বললো,”চটপটি খেতে গিয়েছিলাম খালা, আপনি খাবেন? মনির চাচার চটপটি যা মজার। খেলেই পাগল হয়ে যাবেন আপনি।”
“তুই থাম তো, আমি খাবো নাকি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চটপটি। ওসব মধ্যবিত্তদেরই সাজে।”
কবির শাহ মুখটা অন্ধকার করে বললো,”দেখে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছে আপনাকে। ঘরে যান, বিশ্রাম করুন। মার্জিয়া, তুমি আপাকে নিয়ে ঘরে এসো।”
মেয়েদের নিয়ে কবির শাহ চলে যায়।
মার্জিয়া বেগম মাথা নিচু করে বললো,”তুমি প্রিয়তার বাবার সামনে এভাবে না বললেও পারতে আপা। মধ্যবিত্ত হওয়াটা কি দোষের? বরং ওই মানুষটা তার অল্প রোজগারে আমাদের যেভাবে সুখী রেখেছে, অনেক ধনীরাও হয়তো তা পারেনা।”
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”তুই আবার কবে থেকে তোর বরের মতো এমন কাব্যিক কথা শুরু করলি মার্জিয়া? তোর কখনো ইচ্ছা হয়না দামী রেস্টুরেন্টে খেতে, দামী শাড়ি পরে এমন গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে? ইচ্ছা হয় ঠিকই, পারিস না।”
মার্জিয়া বেগম ঝট করে আপার দিকে তাকায়।
“মনে করো যে ইচ্ছা হয়, কি করবে তাহলে বলো? আমি তো নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করিনি। যখন বাবাটা আমার বিয়েটা দিচ্ছিলেন তখন নিষেধ করোনি কেনো? নিষেধ যখন করোনি তখন আমাকে আমার মতো করে সুখী হতে দাও। প্রতিনিয়ত তুমি আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছো তুমি কতোটা সুখে আছো আর আমি কতোটা কষ্টে। না আমি পেরেছি তোমার মতো বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে, না পেরেছি আমার সংসারে সুখী হতে। আগে খুব আফসোস হতো আপা, বিশ্বাস করো এখন আর হয়না, সত্যিই হয়না। এই মাঝবয়সে এসে মনে হয় আমার জীবনটা তো প্রায় শেষই হতে চললো, আমার মেয়েদের জীবন শুরু। আমি যা পাইনি আমি চাই ওরা যেনো পায়। ওদের সুখেই আমার সুখ হবে।”
একনাগাড়ে কথা শেষ করে মার্জিয়া বেগম থামে। তার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল।
মর্জিনা বেগম কিছুক্ষণ উশখুশ করে। সে সবসময় চায় নিজের প্রতিপত্তি মার্জিয়ার মাধ্যমে এই বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করতে। আর এতোদিন সে সফল হয়েছেও। মার্জিয়া বোকা, তার মাথায় এসব ঢুকিয়ে তাকে বশে আনতে পেরেছে। ইদানীং মার্জিয়া বেগম অল্পেই ছ্যাৎ করে ওঠে, দু’চারটা কথাও শুনিয়ে দেয় বড় বোনকে।
মর্জিনা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বললো,”খুব দরদ উথলে পড়ছে স্বামীর উপর, তাইনা? যত্তসব আদিখ্যেতা।”
“আপা, এতো রাতে তুমি এসেছো? কিছু বলবে তুমি? ঘরে চলো।”
“বলতে তো এসেছি বটেই। তবে ঘরে যাওয়া যাবে না এখন। ঘরে গেলেই তোর ওই মহাজ্ঞানী স্বামীটা এসে কথার মধ্যে ঢুকে যাবে।”
মার্জিয়া বেগম বিরক্ত চোখে তাকায় বোনের দিকে, কিছু বলেনা।
“বেশ, এখানেই বলো কি বলবে।”
মর্জিনা বেগম এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললো,”তোদের বাড়ির ওই আশ্রিত ছেলেটা কোথায়?”
“আপা, ওকে বারবার আশ্রিত বলার কি খুব দরকার? কিছুদিন বিপদে পড়েছিলো, এখানে ছিলো। এখন এখান থেকে চলে গেছে।”
মর্জিনা বেগম মনে মনে বললো,’স্বামী তো মাথায় ভালোই জ্ঞান ঢুকিয়েছে। দুইদিন আগে নিজে যে ছেলেকে দেখতে পারতো না, এখন তার হয়েই কথা বলছে। দেখছি তোকে…..’
“এখান থেকে চলে গেছে না ছাই, বরং এখানে যা পারতো না দূরে যেতে তাই করার চেষ্টা করছে।”
“তার মানে? কি বলতে চাচ্ছো তুমি?”
“তোর মেয়ে তো চুটিয়ে প্রেম করছে ওই বদমায়েশটার সাথে। ছি ছি, শেষে কিনা পচা গর্তে পা দিলো তোর মেয়ে?”
মার্জিয়া বেগমের শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে।
“আপা এসবের মানে কি? খোলসা করে বলো।”
“ওই ছেলে তোর মেয়েকে প্রেমপত্র দেয়, তাও প্রিয়তার কলেজে যেয়ে। পুরো কলেজে ছি ছি পড়ে গেছে। এমন মফস্বল শহরে এই কাজ কেউ করে?”
মার্জিয়া বেগমের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
“তুমি জানলে কীভাবে? আমি কাছে থেকেও কিছু জানতে পারলাম না।”
মর্জিনা বেগমের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। জায়গামতো লেগেছে ওষুধ। এবার শুধু প্রলেপ দেওয়ার পালা।
“এসব খবর কি আর চাপা থাকে রে? কলেজের আশেপাশের সবাই পর্যন্ত জেনে গেছে। যার হাত দিয়ে ওই ছেলে প্রেমপত্র পাঠিয়েছে, সে জানিয়েছে নিয়াজকে। নিয়াজ ছেলেটা তো ওই কলেজের একজন হর্তাকর্তা বলা যায়, কতো টাকা ডোনেট করে প্রতিবছর কলেজে ভাবতে পারবি না। ছেলেটা এমন ভালো, বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পরেও কলেজে সবাইকে জানিয়েছে প্রিয়তা তার হবু স্ত্রী, যাতে কেউ সাহস না করে ওকে কোনো কটু কথা বলতে। নিয়াজ এ কথা শোনার সাথে সাথে কি ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। ছুটে এসেছে আমার কাছে। মন খারাপ করে বলছিলো, ‘খালা ওর যে আমার সাথে বিয়ে হবে না তা নিয়ে আমার দু:খ নেই। ও যেখানে ভালো থাকবে তাতেই আমার ভালো লাগবে। কিন্তু অমন ফুলের মতো একটা মেয়ে একটা বখাটে ছেলের সাথে প্রেম করছে ভেবেই আমার কষ্ট হচ্ছে।’
কি ভালো ছেলে তুই ভাব একবার। এতো অপমান সহ্য করার পরেও কেমন প্রিয়তার কথা ভাবছে।”
মার্জিয়া বেগম রাগে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। মর্জিনা বেগম সেদিকে তাকিয়েই মুখ টিপে হাসে।
“শুধু কি তাই? কতো আশা নিয়ে ছেলেটা বড় মাছ কিনে এনেছিলো এ বাড়িতে, ওই বদ ছেলেটা ওর গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে। দূর দূর করে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে।”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে বললো,”গায়ে হাত তুলেছে? উচ্ছ্বাস তো এমন ছেলে নয়।”
“তুই চুপ কর তো। নিয়াজ কি মিথ্যে বলেছে? এখনো ছেলেটার মুখ বাঁকা হয়ে আছে মার খেয়ে।”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না। রাগে তার শরীর কাঁপছে। ইচ্ছা করছে এখনই মেয়ের চুলের মুঠি চেপে ধরে ইচ্ছামতো মারতে। আহ্লাদ পেয়ে অসভ্য হয়েছে। বখাটে এক ছেলের সাথে প্রেম? এজন্যই বুঝি ছেলেটা এ বাড়ি ছেড়েছে।
“তুই আবার মেয়েটাকে কিছু বলিস না। ছোট মানুষ একটা ভুল করে ফেলেছে। দোষ তো ওই ফাজিল ছেলেটার।”
“ইচ্ছা তো করছে মেয়েটাকে মেরেই ফেলতে। কিন্তু ওর বাবার জন্যই তো কিছু করতে পারিনা।”
“আমার কি মনে হয় জানিস মার্জিয়া? কবির নিজেও চায় ওই ছেলের সাথেই মেয়েকে বিয়ে দিতে।”
“কি বলছো আপা? ওর বাবা কেনো চাইবে এমন?”
“এমন একটা ভাব করছিস যেনো কিছু জানিস না। বিয়ের আগে ওই ছেলের মায়ের সাথে যে কবিরের প্রেম ছিলো ভুলে গেছিস তুই? নিজের প্রেম সফল করতে না পেরে মেয়েকে উষ্কে দিচ্ছে। নাহলে তুই ভাব নিয়াজের মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিতে মেয়ের বাবারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতো ভালো সম্বন্ধ হাতছাড়া করতে চায় কবির।”
বিস্ফারিত চোখে মর্জিনা বেগমের দিকে তাকায় মার্জিয়া। এমন কিছু তো আগে ভাবেনি কখনো।
“আমি ছুটতে ছুটতে এসেছি তোর কাছে। একটু আগেই তুই বললি তুই যা পাস নি, মেয়েরা পেলেই তোর শান্তি। তুই কি চাস না মেয়ে সুখী হোক?”
মার্জিয়া বেগম নির্লিপ্ত চোখে আপার দিকে তাকিয়ে বললো,”তাহলে কি করা উচিত আপা এখন?”
মুখে ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে মর্জিনা বেগম ফিসফিস করে বললো,”নিয়াজ এখনো প্রিয়তার জন্য পাগল হয়ে আছে। কবিরকে কিছু একটা বুঝিয়ে রাজি করিয়ে ফেল।”
মার্জিয়া বেগম অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”কিন্তু আপা সে কি রাজি হবে? তুমি তো তার স্বভাব জানোই।”
“মেয়েরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। ছলেবলে কৌশলে যেভাবেই হোক রাজি করাতে হবে তোকে। আর একটা কথা, যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। পারলে এই সপ্তাহতেই।”
“কি বলছো আপা? এই সপ্তাহেই?”
“যদি সব জানতে পেরে তোর মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায় ওই ছেলেটা এরমধ্যে, তখন কি করবি?”
মার্জিয়া বেগম অস্বস্তিতে ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকায়। কিছুই ভালো লাগছে না তার। কি করবে এখন? আপার কথা ফেলে দেওয়াও যাচ্ছে না।
“আর হ্যা, প্রিয়তাকে এ কয়দিন কলেজে যেতে দিস না। বিয়ে হয়ে গেলে এতো পড়ে কি হবে? ওদের কি কম আছে? তাছাড়া ওরা মেয়েদের এতো পড়াশোনা পছন্দও করেনা। মেয়েরা থাকবে সারাদিন বাড়িতে, ওদের এতো পড়ে কি হবে?”
“কি বলছো আপা? মেয়েটা উচ্চমাধ্যমিকও দিবে না?”
“বিয়েটা একবার হয়ে যাক, প্রিয়তা চাইলে নাহয় কোনোভাবে নিয়াজকে বুঝিয়ে আবার কলেজে যাবে। নিয়াজ কি প্রিয়তার কথা ফেলে দিবে?”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না, কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না সে। যদি সত্যিই এমন প্রেমপত্র দেওয়া নেওয়া হয় তবে সত্যিই তো অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কীভাবে আটকাবে সে এখন?
“চলি রে আজ, তোর মেয়েদের ভালো চাই বলেই ছুটে ছুটে আসি। অন্য কেউ হলে কবিরের এমন ব্যবহারের পরে কবেই সম্পর্ক চুকেবুকে দিতো। নেহাৎ তোর মেয়েদের নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসি তাই।”
মার্জিয়া বেগম পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে হাসতে হাসতে মর্জিনা বেগম গাড়িতে ওঠে। মার্জিয়া বেগমের সামনে দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে যায়।
মার্জিয়া ঘোর লাগা চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আচ্ছা, তার মেয়েটাও যদি এমন দামী গাড়ি করে ঘুরে বেড়ায়, দামী শাড়ি পরে তবে মা হিসেবে তার কি আনন্দ হবে না? আচ্ছা, এসব না পেয়েও কি সে খারাপ আছে? যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে পড়তে চায় মার্জিয়া বেগমের।
আকাশে আজ হাজারটা তারার মেলা। উচ্ছ্বাস মাটিতেই মাদুর পেতে শুয়ে তারার দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে তারা গোণার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে।
“মা ওই উজ্জ্বল তারাটা তুমি, সবসময় কেমন জ্বলজ্বল করে চলেছো। আর তার পাশেরই ওই বড় তারাটা বাবা। কি সুন্দর পাশাপাশি আছো তোমরা।”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো,”জানো মা প্রথমবারের মতো কোনো মায়াবতীর চোখে আটকে গিয়েছি আমি। সকাল নেই সন্ধ্যা নেই চোখজোড়া আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি একদন্ডও শান্তি পাচ্ছিনা তাকে না দেখে। তুমি সবসময় বলতে না, আমার জীবনে একটা মায়াবতী আসবে? মা জানো ও তোমার মতোই ভালো। আমি ওর চোখে আমার জন্য এক আকাশ সমান ভালোবাসা দেখেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এটা ওর বয়সের আবেগ। কিন্তু যতো দিন গেছে আমার মনে হয়েছে এই অনুভূতি শুধুমাত্র আবেগের চেয়েও অনেক ঊর্ধ্বে। মা আমি চাইনি আমার এই রঙহীন জীবনে ওকে ঠাঁই দিতে। কিন্তু মা, এই অন্তরটা কি কারো শাসন বারণ মানে? আমি কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছি ওর কাছ থেকে। কিন্তু প্রতিটা দিন আমার একেকটা বছরের মতো লেগেছে ওকে ছাড়া। তৃষ্ণায় গলা, বুক খা খা করছে আমার। তুমি বলে দাও মা আমি কি করবো? আমি যে কাপুরষ নই মা।”
“ও ভাইজান।”
উচ্ছ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দোকানে থাকা ছোট ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে, ওর নাম মকবুল।
“কি রে মকবুল মিয়া, কিছু বলবি?”
“বাড়ি যাইবেন না আফনে? সারারাত এইখানে শুইয়া তারাগো লগে আলাপ করবেন?”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে উঠে বসে।
“একটা সিগারেট নিয়ে আয় দোকান থেকে।”
মকবুল বিরস মুখে নিজের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দেয়। উচ্ছ্বাস নি:শব্দে এসে সিগারেটটা ধরায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।
“এইসব না খাইলে হয়না? শরীরের ক্ষতি হয়।”
উচ্ছ্বাস মকবুলের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমার শরীরের ক্ষতি হলে তোর কি?”
মকবুল উত্তর দেয়না, শার্টের হাতায় চোখ মোছে। সে নিজেও জানেনা কেনো, এই কয়দিনেই এই মানুষটাকে সে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে। লোকটার দিকে তাকালেই তার মায়া হয়। কিছুটা পাগলাটে মনে হয় তার এই মানুষটাকে। একা একা তারার সাথে কথা বলে।
“কাঁদিস কেনো রে বেটা?”
“কান্দি না, চোখে কি যেনো পড়ছে।”
উচ্ছ্বাস ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাসে।
“ভাইজান হ্যায় কি অনেক সুন্দরী?”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কে?”
“আপনার ভালোবাসার মানুষটা।”
উচ্ছ্বাস হতভম্ব হয়ে বললো,”তুই এসব কীভাবে জানিস?”
মকবুল নিজের হলুদ দাঁত বের করে হাসে।
“আপনারে দেখলেই বোঝা যায়। যারা প্রেম করে তারাই এমন বেবাগী হইয়া যায়।”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না।
“কইলেন না? হ্যায় কি অনেক সুন্দরী?”
উচ্ছ্বাস ম্লান হেসে মাথা নাড়ায়।
“বোধহয় অনেক সুন্দরী।”
“বোধহয় ক্যান?”
“কারণ তারে দেখার পর আর কাউরে সুন্দর লাগে নাই।”
মকবুল কিছু বলতে যাবে তার আগেই দুইটা ছেলে হন্তদন্ত হয়ে উচ্ছ্বাসের কাছে এসে দাঁড়ায়। দুইজনের মুখই কালো কাপড়ে অর্ধেক ঢাকা। উচ্ছ্বাস তাদের চিনতে পারে।
“মকবুল তুই যা এখন।”
মকবুল লোক দু’টোর দিকে তাকিয়ে চলে যায়।
“ভাই একটা সুখবর আছে আপনার জন্য। বলতে পারেন সুবর্ণ সুযোগ আছে আজ রাতে আপনার জন্য।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি সুযোগ?”
ছেলেটা চারপাশে চোখ বুলিয়ে আস্তে আস্তে বললো,”আপনার ছোট চাচা আজ এক মহিলা নিয়ে উত্তরের ওই নিরিবিলি বাড়িটায় থাকবে, আর কেউ থাকবে না। খবর আছে কোনো গার্ডও থাকবে না আজ ওখানে।”
উচ্ছ্বাস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
“তুই নিশ্চিত?”
“একশত ভাগ ভাই। আপনি আমারে চিনেন না? আমি কি ভুল তথ্য দিতে পারি?”
দশ মিনিটের মধ্যে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়ে যায়। চারিদিকে ধুলা উড়তে থাকে। উচ্ছ্বাস শার্টের হাতায় চোখ ঢাকে। হঠাৎ করেই তারাগুলো উবে যেয়ে কালো মেঘে ঢেকে যায় রাতের আকাশ। যে কোনো মুহুর্তে অঝোরে বৃষ্টি নামবে।
এখন উচ্ছ্বাসের সামনে দু’টো পথ খোলা। বাবা মায়ের হয়ে প্রতিশোধ নেওয়া নয়তো প্রিয়তার কাছে ছুটে যাওয়া। তাকে যে সে কথা দিয়েছে ঝুম বৃষ্টির রাতে সে প্রেমিক হয়ে ধরা দিবে প্রিয়তার কাছে।
“ভাই কি করবেন? সব তৈরি আছে।”
উচ্ছ্বাস হতবিহ্বল হয়ে তাকায়। প্রকৃতির চারদিক তখন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ঝড়ো দমকা হাওয়ায়।
জানালার শিকগুলো শক্ত করে চেপে ধরে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। চোখের পলক ফেলতেও যেনো ভুলে গেছে। পলক ফেললেই যেনো মানুষটা পালিয়ে যাবে। তীব্র গরমের শেষে স্বস্তির ঝড়ো হাওয়া বইছে। প্রিয়তার মনেও বইছে, তবে সে বাতাস প্রেমের। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। যদি আজ মানুষটা আসে, সে সারারাত তার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে, রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলো হবে এক বৃষ্টিময় প্রেমের সাক্ষী। আর তার বিশ্বাস সে আসবেই, তাকে কথা দিয়েছে যে সে। আসতে তো তাকে হবে, হবেই।
(চলবে……..)
#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ২১
“আপা, এই আপা। আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? এখানে শুয়ে আছিস কেনো তুই? এই আপা, এই।”
পেখম অবাক হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপাকে পাশে না পেয়ে বেশ অবাক হয় সে। তার ঘুমকাতুরে আপাটা কখনোই সকালে তার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। তাড়াতাড়ি করে সে উঠে এসে দেখে প্রিয়তা জানালার পাশে মাটিতেই কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। গত রাতে অনেক ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। প্রিয়তার পরনের জামার কিছু অংশ এখনো ভেজা। তার মানে কি সে গতকাল সারারাত এখানেই ছিলো?
পেখম আঁৎকে উঠে প্রিয়তার গায়ে হাত দিতেই থমকে যায়। প্রিয়তার শরীর অসম্ভব গরম, জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। পেখমের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়।
“বাবা, ও মা, তাড়াতাড়ি এসো তোমরা।”
কবির শাহ পেখমের গলা পেয়ে ছুটে ছুটতে এসে দেখে প্রিয়তা মাটিতে অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। পেখম তার কোলে প্রিয়তার মাথা ধরে কান্নাকাটি করছে।
কবির শাহের যেনো পা দু’টো ভারী হয়ে যায়। আর এক কদমও হেঁটে যেতে পারবে না এমন মনে হচ্ছে।
মার্জিয়া বেগমও দৌড়ে আসে।
“কি হয়েছে এখানে? প্রিয়তা মাটিতে শুয়ে আছে কেনো?”
পেখম ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,”ও মা, সকালে উঠে দেখি আপা মাটিতেই শুয়ে আছে এভাবে। এখন গায়ে হাত দিয়ে দেখি গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা কেঁপে ওঠে। কবির শাহ তখনও পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। তার মনে হচ্ছে বুঝি কলিজাটাই ছিঁড়ে যাচ্ছে তার।
শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রায় জ্ঞান হারিয়েছে প্রিয়তা। তার মাথার কাছে বসে একনাগাড়ে মাথায় পানি দিচ্ছে মার্জিয়া বেগম। হাত কাঁপছে তার থরথর করে। গত রাতেই মেয়েটা কতো হাসিখুশি ছিলো, একসাথে চটপটি খেতে গেলো হৈ হৈ করে। অনেক কষ্টে নিজের কান্নাটা চেপে ধরে রাখে সে।
পেখম কবির শাহের বুকের উপর মাথা রেখে কাঁদছে।
“বাবা আপা ঠিক হয়ে যাবে তো? ও বাবা বলো না। আপার কিছু হবে না তো?”
কবির শাহ ঠোঁট কামড়ে বললো,”কিচ্ছু হবে না ওর, কিচ্ছু না।”
জ্বরের ঘোরে হঠাৎ প্রলাপ বকে ওঠে প্রিয়তা৷ সবাই চমকে উঠে তাকায় তার দিকে।
মার্জিয়া বেগম ছলছল চোখে কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে প্রিয়তার বাবা।”
কবির শাহ ছুটে মেয়ের মাথার কাছে এসে বসে।
“এইযে মা আমি এখানে। বাবা চলে এসেছে আর কোনো ভয় নেই। বাবা এক চুটকি মেরে সব সমস্যার সমাধান করে দিবে।”
প্রিয়তা অস্পষ্টভাবে কিছু বলেই যাচ্ছে একনাগাড়ে।
পেখম কিছু একটা সন্দেহ করে কান খাঁড়া করে।
‘আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন। আমি ভুল করেছি আপনাকে বিশ্বাস করে। আসলেই আপনি আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। আমি সারাটা রাত বৃষ্টির পানিতে ভিজে আপনার অপেক্ষা করেছি। এতোটা বোকা আমি?’
পেখম ভয়ে ভয়ে বাবা মায়ের দিকে তাকায়। তারা কিছু শুনে ফেলেনি তো?
মার্জিয়া বেগম মাথায় পানি দিয়েই যাচ্ছে আর কবির শাহ মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে নি:শব্দে কাঁদছে। মনে হয়না তারা কিছু শুনেছে।
পেখম এগিয়ে এসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”ও মা আপাকে তো ওষুধ দিতে হবে এখনই। তুমি যাও আপার জন্য তার আগে কিছু খাবার নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণে আপার মাথায় পানি দিচ্ছি।”
মার্জিয়া বেগম আঁচলে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। মেয়ের জন্য হঠাৎ করেই ভীষণ মায়া হচ্ছে তার। এইতো সেদিনই মেয়েটা প্রথম হাঁটা শিখলো, সারা ঘর যেনো প্রজাপতির মতো দৌড়ে বেড়াতো। কি মিষ্টি লাগতো দেখতে। আর যখন আধো আধো বুলিতে প্রথম মা ডাকলো কি অসম্ভব শান্তি হতো তার। এরই মাঝে এতোগুলা বছর কখন কেটে গেলো সে বুঝতেই পারলো না। মনে হয় বুঝি সেদিনের কথা।
“মেয়েকে দেখো প্রিয়তার বাবা।”
“আমি আছি আমার কলিজার কাছে তুমি যাও।”
মার্জিয়া বেগম চলে যেতেই পেখম আপার খুব কাছে এসে বসে। আপার হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে।
“পেখম, আপার কাছে একটু বোস। আমি স্কুলে বলে আসি আজ ক্লাস নিবো না। আসার সময় মোহনলাল ডাক্তারকেও ডেকে আনবো।”
পেখম মাথা নেড়ে বাবাকে আশ্বস্ত করে। কবির শাহ কিছুক্ষণ মেয়ের রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায়।
“আপা, এই আপা। আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস তুই? কার আসার কথা ছিলো গত রাতে?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। পেখম এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় আবারও বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই আসতে চেয়েছিলো?”
প্রিয়তা কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। তার চোখমুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। ভীষণ খারাপ লাগে সেদিকে তাকিয়ে পেখমের।
“আপা তুই তাকিয়েছিস? কেমন লাগছে এখন তোর?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”পানি খাবো, পানি।”
“ভাই তাই বলে খু’ন করলেন আপনি? কাজটা কি ঠিক হলো? আপনি আমাদের বলেছিলেন শুধু একটু ভয় দেখাবেন। কিন্তু এ কি করলেন? এখন যে আমরাও ফেঁ’সে যাবো আপনার সাথে।”
উচ্ছ্বাস হাতের সিগারেটটা টান দিয়ে ফেলে সামনের ছেলেটার কলার চেপে ধরে। রাগী লাল চোখে তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,”আমি বলছি না, এই খু’নটা আমি করিনি? আমি যাওয়ার আগেই কেউ মেরে রেখে গিয়েছে ওকে। আর কতোবার বলবো তোদের?”
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললো,”কীভাবে বিশ্বাস করবো ভাই এই কথা? আপনি যেভাবে গত রাতে রাম’দা নিয়ে ছুটে গেলেন। আর তার সাথে এতো শত্রুতা কার থাকতে পারে?”
উচ্ছ্বাস জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে।
ছেলেটা কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”ভাই আমাদের পাঁচিলের বাইরে রেখে আপনি ভিতরে গেলেন। কি হয়েছিলো তারপর?”
কিছুক্ষণ থেমে উচ্ছ্বাস আবারও একটা সিগারেট ধরায়। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,”আমি যখন বাড়ির ভিতরে যাই পাঁচিল টপকে তখন দেখি বাড়ির ভিতরটা একদম অন্ধকার। এক ফোঁটা আলো নেই কোথাও। এমনকি গেটে গার্ডও ছিলো না কোনো। আমি কিছুটা অবাক হই। এরপর আস্তে আস্তে পা টিপে বাড়ির সামনের দরজায় হাত রাখতেই দরজাটা খুলে যায় নিজে থেকে। আমি আরো অবাক হই তখন। আমি ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকি। চারদিকে এতো অন্ধকার যে কিচ্ছু দেখতে পারছিলাম না। আমি সুইচবোর্ড খোঁজার জন্য দেওয়াল হাতড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ ধাতব কিছুটা পা বেঁধে আমি পড়ে যাই। আমার শার্টের পিছন থেকে রাম’দাটা নিচে পড়ে যায়। আমি উঠে দাঁড়াতেই দেখি আমার হাতে কোনো একটা তরল লেগে আছে। কিছুটা পিচ্ছিল তরল। আমি গন্ধটা নিতেই দেখি একটা বুনো গন্ধ, খুব পরিচিত। হঠাৎ সুইচবোর্ড হাতে পেতেই জ্বালিয়ে দিই। আর সামনে যা দেখি…..”
“কি দেখেছেন?”
উচ্ছ্বাস একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,”বাদ দে সেসব। তবে এই কাজ আমি করিনি। কিন্তু আমি শুধু ভাবছি আর কে করতে পারে এই কাজ? আমি কার এতোটা শত্রুতা থাকতে পারে ওর সাথে?”
উচ্ছ্বাস চিন্তিত মুখে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে।
প্রিয়তার অসুখ শুনে ছুটে এসেছে সেতারা। আসার পর থেকে প্রিয়তার হাত ধরে মুখ ভোঁতা করে বসে আছে সে। তার চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব কেঁদেছে কিছুক্ষণ আগেই। তার স্বামী আরিফও এসেছে সাথে। বসার ঘরে গম্ভীর হয়ে বসে আছে সে। সেতারার কথা হয়ে গেলে একবারে তাকে নিয়ে আবার চলে যাবে।
সেতারার দিকে তাকিয়ে পেখম, প্রিয়তা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কিন্তু কেউ কিছু বলেনা।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর প্রিয়তা সেতারার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললো,”আপা তুমি ঠিক আছো তো?”
সেতারা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”এমন কেনো বলছিস? আমি ঠিক আছি তো।”
“আসলে তোমাকে কেমন অসুস্থ লাগছে। এমন এলোমেলো আগে কখনো লাগেনি তোমাকে।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেতারা আস্তে আস্তে বললো,”একটা কথা বলবো প্রিয়তা?”
“হ্যা আপা বলো না।”
সেতারা একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”শুধুমাত্র টাকাপয়সা দেখে বিয়ে করিস না। হ্যা জীবনে টাকার প্রয়োজন আছে, তবে সেই প্রয়োজন ভালোবাসার ঊর্ধ্বে না।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে সেতারার দিকে তাকায়।
পেখম পাশ থেকে মুখ টিপে হেসে বললো,”আজ কার মুখে কি শুনছি। তুমি তো সারাজীবন বলেছো টাকা ছাড়া শান্তি নেই, প্রেম ভালোবাসার কোনো দাম নেই। আজ তুমি কিনা এসব বলছো।”
সেতারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রিয়তা কঠিন দৃষ্টিতে পেখমের দিকে তাকায়। পেখম চুপ করে যায়।
প্রিয়তা ঈষৎ হেসে সেতারার দিকে তাকায়।
“আচ্ছা সেতারা আপা, তুমি একটা কথা বলো তো। ভালোবাসা কি সবসময় ভালো রাখে?”
সেতারা থতমত খেয়ে যায়।
“কি হলো আপা উত্তর দাও। টাকাপয়সা এগুলো সুখী করতে যথেষ্ট নয় এটা হয়তো সত্যি। কিন্তু কাউকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসার পরেও কি সুখী হওয়া যায় সবসময়?”
সেতারা মাথা নিচু করে বসে থাকে। বিয়ের আগে একজন তাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। তাকে খুব মনে পড়ে মাঝে মাঝে। পুরো দুনিয়ার সামনে সুখী মেয়েটাও গভীর রাতে বালিশে মুখ গুঁজে ফোঁপায় আর পূর্ব প্রেমিকের কথা ভাবে। তার কনুইতে, গলায় কিংবা ঘাড়ে হয়তো তখন আঘাতের লাল দাগ। পরের দিন সকালেই আবার প্রসাধনীর প্রলেপে ঢাকতে হবে সেই দাগ, নাহলে যে মানুষ জেনে যাবে ভদ্র মুখোশের আড়ালে থাকা আরিফ ঠিক কতোটা ভয়ংকর।
“সমস্যা কি তোমার?”
সেতারা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”আস্তে কথা বলো আরিফ। সবাই শুনতে পাবে।”
আরিফ রাগে লাল হয়ে গেলো। গলার স্বর আরো চড়িয়ে বললো,”কে কি শুনতে পেলো আমার জানার দরকার নেই। তুমি এক্ষুনি আমার সাথে বাড়িতে যাবে।”
সেতারা মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললো,”ওরা খুব করে চাচ্ছে আজ রাতটা যেনো এখানে থেকে যাই।”
আরিফ ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি বললে তুমি?”
কেঁপে ওঠে সেতারা।
“আসলে ওরা অনেক অনুরোধ করছিলো……”
“আমার বাবা যে কাজের লোকের রান্না করা খাবার খায়না তুমি জানো না?”
সেতারা ঢোক চেপে বললো,”আজ রাতটা নাহয় আম্মা রান্না করবে।”
চিৎকার করে ওঠে আরিফ। চুলের মুঠি চেপে ধরে সেতারার। ব্যথায় চোখ বন্ধ করে সেতারা। তার চেয়ে বড় দুশ্চিন্তা খালা বা খালু এই অবস্থায় দেখে ফেললে কি হবে? চোখে পানি চলে আসে তার।
“তোর এতো বড় সাহস। তুই এই বয়সে আমার মা কে রান্নাঘরে যেতে বলিস। তাহলে তোকে রেখে আমার লাভটা কি? তোর পিছনে এতো টাকা খরচ করবো কেনো আমি তাহলে? বাড়ির সব কাজ কাজের লোক করে। তুই শুধু রান্নাটা করিস। রানীর হালে থাকিস। সেইটাও পারবি না?”
“পারবো না তাতো বলিনি। আমি তো রোজ রোজ রান্না করতে বলছি না উনাকে। একটা রাতের জন্য……”
“খুব মুখ হয়েছে তাইনা? এই মুখ কীভাবে বন্ধ করতে হয় আমার ভালো করে জানা আছে। আজ যদি আমাকে একা বাড়িতে ফিরতে হয়, তবে মনে রাখিস সারাজীবন তোকে এখানেই থাকতে হবে। তোর জন্য আমার বাড়ির দরজা বন্ধ।”
কেঁপে উঠে তাকায় সেতারা স্বামীর দিকে। জামাইয়ের এসব আচরণ সম্পর্কে সবই জানে তার মা মর্জিনা বেগম। কিন্তু তার বড়লোক সোসাইটিতে নিজেকে সমুন্নত রাখাটা এতোটাই দরকার যে মেয়ের কষ্ট তাকে স্পর্শ করেনা। তাকে মানিয়েই চলতে হবে স্বামীর ঘরে।
ঠিক তখনই রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে মার্জিয়া বেগম দরজার কাছে আসে। তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে সামনের দৃশ্য দেখে। এ কি দেখছে সে? তবে যে সে শুনে এসেছে রাজরানীর মতো থাকে সেতারা? এই রাজরানীর হাল?
বিশ হাজার টাকা দামের কাতান শাড়িটা সরে যেয়ে কাঁধের দগদগে আঘাতের ঘা দেখা যাচ্ছে। দুই ভরী ওজনের সোনার চুড়ির উপর হাত চেপে ধরায় চুড়ির দাগ পড়ে যাচ্ছে নরম ফর্সা হাতে। তবে কি লাভ এই দামী শাড়ির? কি লাভ এই গহনার? তবে কি এটাই সেতারার জীবন? এভাবেই রেখেছে তার কোটিপতি স্বামী তাকে? কই প্রিয়তার বাবা তো কোনোদিন তার দিকে রাগী চোখে তাকায়নি পর্যন্ত।
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে মার্জিয়া বেগমের। এ কি ভুলের সাগরে ভাসছিলো সে এতোদিন? আস্তে আস্তে পা ফেলে বসার ঘরে আসে সে। মাথাটা অসম্ভব ঘুরছে। পানি পিপাসা পাচ্ছে। চোখজোড়া অস্বাভাবিক জ্বলছে।
“পানি নাও।”
চমকে উঠে তাকাতেই মার্জিয়া দেখে কবির শাহ এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে রেখেছে তার সামনে।
“পানি এনেছো কেনো?”
“তোমার তৃষ্ণা পেয়েছে তাই।”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি কীভাবে জানলে?”
কবির শাহ সুন্দর করে হাসে।
“কি যে বলো মার্জিয়া, একুশটা বছর হতে যাচ্ছে এই মানুষটা আমার। তার কখন কি প্রয়োজন এটা জানতে না পারলে কীভাবে তার সারাজীবনের দায়িত্ব নিলাম আমি বলো? নাও পানিটা খেয়ে নাও। সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমার উপর। একদিকে মেয়ে অসুস্থ, আবার জামাইয়ের জন্য এতো রান্নাবান্না। বাকি যা কাজ আছে আমি করে ফেলবো। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো এখানে দু’দণ্ড। আমার পুতুল বউটা যে এতো কষ্ট করতে পারে না।”
আচমকা শব্দ করে কেঁদে দেয় মার্জিয়া বেগম। হতবাক হয়ে যায় কবির শাহ। সে কিছু বলার আগেই মার্জিয়া বেগম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। একাধারে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে সে। কবির শাহ কিছু না বুঝেই স্ত্রীকে আঁকড়ে ধরে দুই হাতে। আরো জোরে কেঁদে দেয় মার্জিয়া।
“কি হয়েছে মার্জিয়া আমাকে বলো? কে কষ্ট দিয়েছে তোমাকে?”
“আমাকে মাফ করে দাও তুমি। তুমি মাফ না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি, পাপ করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
“তুমি কোনো অন্যায় করোনি মার্জিয়া। আমার তোমার উপর সত্যিই কোনো অভিযোগ নেই, একদম সত্যি। তুমি সবসময় নীলিমার কথা ভেবে একা একাই কষ্ট পাও। তুমি কোনোদিন জানতে পারলে না, সে আমার অতীত ছিলো। আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ তুমি, শুধুই তুমি।”
মার্জিয়া বেগমের বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। তার ইচ্ছা করছে না এই মানুষটার বিশালতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে।
কবির শাহ মাথা চুলকে বললো,”ঘরে যেয়ে মেয়ে, মেয়ে জামাই আছে মহিলাটি কি ভুলেই গেলো? বলছি এগুলো কি ঘরে যেয়ে করা যায়না?”
মার্জিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দেয়। কবির শাহকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
শব্দ করে হেসে দেয় কবির শাহ।
“তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগে এভাবে কান্নার মধ্যে হঠাৎ হেসে দিলে।”
মার্জিয়া বেগম একদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকায়। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে দুনিয়া উলটে গেলেও স্বামীর সাথে আর খারাপ ব্যবহার করবে না সে। যে দামী সম্পদ সে জীবনে পেয়েছে পৃথিবীর সব সম্পদ একত্র করলেও তার সমান হবে না। মেয়ের জীবনের সিদ্ধান্তগুলোও খুব ভেবেচিন্তে নিতে হবে এবার। কোনো ভুল করা যাবে না।
কালো চাদরে নিজেকে ঢেকে নেয় উচ্ছ্বাস। ঠোঁটের কোণায় সিগারেটের আগুন জ্বলজ্বল করে তার। দুই হাত প্যান্টের পকেটে।
“ভাই আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“আমাকে এখন যেতে হবে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। তার চোখজোড়া দেখতে না পারলে আজ আমি খু’ন হয়ে যাবো নিজের হাতেই।”
“পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে খু’নীকে।”
“আমি তো খু’নী না। আমি কেনো লুকিয়ে থাকবো?”
“আপনি বুঝতে পারছেন না।”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে মিজানের কাঁধে হাত রাখে।
“পুলিশ আমাকে বন্দী করবে কিনা জানিনা, আমি ইতোমধ্যে নন্দিনীর হাতে বন্দী হয়ে আছি। তার হাতের ইশারা আমার দরজায় কড়া নাড়ছে প্রতিনিয়ত। আমাকে যেতে হবে, হবেই।”
ছেলে দু’টোকে রেখেই উচ্ছ্বাস নেমে যায় রাস্তায়। তাদের কেনো যেনো মনে হচ্ছে মানুষটা কোনো বিপদে পড়বে, তাদের বাঁচাতে হবে তাকে। যে কোনো মূল্যে।
রাস্তায় সিগারেটটা ফেলে পায়ের সাথে পিষে ফেলে উচ্ছ্বাস।
“আজকের মতো তোকে ছুটি ধোঁয়া। তোর জন্য তার কোনো কষ্ট হোক, তা আমি সহ্য করবো না।”
(চলবে…..)