#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ১৮
নীল চুড়ি গুলো হাতে নিয়ে বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে প্রিয়তা। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার। কি যে ভালো লাগছে তার। ইচ্ছা করছে সবসময় পরে থাকতে এগুলো। সে ঠিক করেছে আজ সারারাত এগুলো পরে থাকবে সে।
দূরে বসে আপার কাণ্ড দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে পেখম। অনেকদিন পর আপাকে এতোটা খুশি দেখে খুব ভালো লাগছে তার। এই আপার মুখে সে সবসময় এমন হাসি দেখতে চায়। আপার মুখটা গোমড়া থাকলে তার কিছুই ভালো লাগেনা।
“আপা।”
প্রিয়তা আনমনে উত্তর দেয়,”বল।”
“চুড়িগুলো খুব মানিয়েছে তোর হাতে। মনে হচ্ছে তোর জন্যই বুঝি বানানো হয়েছে।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে মিটমিট করে হাসে। পেখম অবাক হয়ে দেখে সেই হাসি। আচ্ছা প্রথম প্রেমে পড়লে কি মেয়েদের রূপ কয়েক গুণ বেড়ে যায়?
পেখম ধীরে ধীরে হেঁটে এসে প্রিয়তার পাশে দাঁড়ায়। আপার কাঁধে হাত রাখতেই প্রিয়তা হাসিমুখে তাকায় পেখমের দিকে।
“আপা আজ বুঝি তুই অনেক খুশি?”
প্রিয়তা পেখমের দুই হাত ধরে তাকে ঘুরাতে থাকে। পেখম চিৎকার করে বলতে থাকে,”ওরে আপা থাম থাম। এবার তো মাথা ঘুরে পড়েই যাবো।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা? প্রিয়তা একনাগাড়ে ঘুরাতেই থাকে পেখমকে।
“অনেক খুশি আজ আমি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েটা আজকের জন্য আমি।”
“তা এতো খুশির কারণ কি তোর প্রিয়তা?”
পেখমকে থামিয়ে দিয়ে দরজার দিকে তাকায় প্রিয়তা। তার বড় খালার মেয়ে সেতারা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
প্রিয়তা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে সেতারার কাছে এগিয়ে যায়।
“সেতারা আপা তুমি কখন এলে?”
“এইতো এলাম বেশ কিছুক্ষণ। এসে তোদের দুই বোনের কাণ্ড দেখছিলাম। মেয়েটাকে তো এক্ষুনি ঘোরাতে ঘোরাতে ফেলেই দিচ্ছিলি।”
প্রিয়তা মিষ্টি করে হাসে। আজ তার সবকিছু ভালো লাগছে। যদি বড় খালা এসে তাকে বকাঝকাও করে তাও ভালো লাগবে ওর শুনতে।
সেতারা প্রিয়তার পাশ কাটিয়ে খাটে এসে বসে। চারদিক ভালো করে তাকাতেই দেখে টেবিলে বরাবরের মতো একগাদা গল্পের বই।
“তোর এই গল্পের বই পড়ার অভ্যাসটা আর গেলো না। কয়দিন পর তো শুনবো বিয়ের পর নাচটাও ছাড়বি না।”
প্রিয়তার মুখ কালো হয়ে যায়।
পেখম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”কেনো সেতারা আপা? বিয়ের পর আপার নাচ ছাড়তে হবে কেনো?”
সেতারা অবাক হয়ে বললো,”তো বিয়ের পরও কি ও ধেই ধেই করে নাচবে? ওর বর কি বলবে? দেখলি না বিয়ের আগে এতো সুন্দর গান করতাম। বিয়ের পর তোর দুলাভাই বললো গান বন্ধ করে সংসারে মন দাও। শুনতেই হলো তার কথা।”
পেখম সেতারার কাঁধে থুতনি রেখে বললো,”আচ্ছা সেতারা আপা দুলাভাই বিয়ের আগে থেকে ফুটবল খেলতো, বিয়ের পর তাকে নিষেধ করোনি? বলোনি যে ফুটবল খেলা যাবে না?”
সেতারা অবাক হয়ে বললো,”শোনো মেয়ের কথা। ও ফুটবল খেলবে আমি নিষেধ করবো কেনো?”
পেখম মুচকি হেসে বললো,”ওমা তো বলবে না যে বিয়ের পর এভাবে ধেই ধেই করে ফুটবল খেলা যাবে না। ফুটবল বাদ দিয়ে সংসারে মন দাও।”
“কি যে বলিস তুই পেখম। তুই আর বড় হবি না, ছোটটি থেকে যাবি। পুরুষ মানুষের এসব একটু আধটু শখ থাকতেই পারে, এগুলো দোষের কিছু না।”
প্রিয়তা ঈষৎ হেসে এগিয়ে আসে। ওদের পাশে বসে সেতারার বাম হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,”এসব নিয়ম কে বানিয়েছে সেতারা আপা? পুরুষেরা নাকি আমরা মেয়েরাই? একটা মেয়ে বিয়ের পর নাচলে সেইটা ধেই ধেই করে নাচা আর একটা পুরুষ যখন সবার মধ্যে হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলছে তা তার শখ।”
সেতারা বিরক্ত হয়ে বললো,”খালু যে কেনো তোদের এতো পড়াশোনা করাতে গেলো বুঝি না। পড়াশোনা করে এসব উল্টাপাল্টা কথা শিখেছিস। কোথায় কি উদাহরণ টানছিস নিজেরাই জানিস না।”
পেখম স্মিত হেসে বললো,”আমরা উল্টাপাল্টা বলছি নাকি তুমি নিজের যুক্তি খণ্ডাতে ব্যর্থ?”
সেতারা চুপ করে থাকে। প্রিয়তা পরিস্থিতি সামলাতে সেতারাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,”পেখম এবার থাম তো, আপাকে আর জ্বালাস না। সেতারা আপা তুমি একটা গান ধরো তো। কতোদিন শুনিনা তোমার গান।”
সেতারা ভ্রু কুঁচকে বললো,”পাগল হয়েছিস তুই? কতোদিন আগেই সেসব বাদ দিয়েছি।”
“কেনো বাদ দিলে আপা? নিজের সত্ত্বাটাকে নিজেই গলা টি’পে মেরে ফেললে?”
সেতারা উদাস হয়ে বললো,”বিয়ের পর মেয়েদের আলাদা সত্ত্বা বলে কিছু থাকে না। সংসারটাকে আপন করাই তাদের কাছে মুখ্য।”
“তুমি সুখী তাতে?”
“অবশ্যই সুখী আমি। কিসের অভাব আমার? দামী গাড়িতে চলাফেরা করি, নিত্যনতুন দামী শাড়ি, গহনা পরি। জীবনে সুখী হতে আর কি লাগে বল তো?”
প্রিয়তা ম্লান হেসে বললো,”তাহলে তোমার চোখের নিচে কালি কেনো সেতারা আপা তোমার? যে সৌন্দর্য দেখে তোমাকে দুলাভাই বিয়ে করে নিয়ে গেলো, কোথায় সেই সৌন্দর্য? তোমার এতো সুখের মাঝেও কখনো হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে বুকের মধ্যে ব্যথা করেনা? গান গাওয়ার জন্য গলা শুকিয়ে আসে না? অস্বীকার করতে পারবে তুমি?”
সেতারা ইতস্তত করতে থাকে। তার এসব আলোচনা ভালো লাগছে না। প্রিয়তার বলা একটা কথাও মিথ্যা না। কিন্তু এসব বলে এখন কিছু হবে না। তার জীবনের পথ বেঁকে গেছে। এই অদৃষ্টকেই তাকে আপন করে নিতে হবে, এখানেই খুঁজতে হবে সুখ। মিথ্যা সুখের চাদরে মুড়িয়ে রাখতে হবে নিজেকে।
সেতারা জোর করে হেসে বললো,”তুই রাখ তো এসব ভারী ভারী কথা, গল্পের বই পড়ে মাথাটা নষ্ট হয়ে গেছে তোর। এখন আমাকে তোর গল্প বল।”
“আমার আবার কি গল্প সেতারা আপা?”
“এইযে তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? শুনলাম কলেজের অনুষ্ঠানে নাকি খুব সুন্দর নেচেছিস।”
প্রিয়তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
সেতারা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,”তোর নাকি একটা প্রেমিক হয়েছে। ভবঘুরে এক ছেলেকে নাকি মন দিয়ে ফেলেছিস তুই।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে বললো,”এসব কথা কে বলেছে আপা তোমাকে?”
“এসব কি আর চাপা থাকে? তুই নাকি সেই ছেলের জন্য নিয়াজের সাথে এতো ভালো সম্পর্কটাকেও বারণ করে দিয়েছিস। যাই বলিস, তুই কিন্তু ভুল করেছিস। নিয়াজকে বিয়ে করলে রাজরানী হয়ে থাকতে পারতিস আজ।”
প্রিয়তার মাথা শব্দশুন্য হয়ে যায়। সে খুব ভালো করে বুঝতে পারে বড় খালা এসব নোংরা কথা ছড়াচ্ছে। সে ভেবেছিলো আজ সে মন খারাপ করবে না। কিন্তু হঠাৎই সে টের পায় তার মন খারাপ হচ্ছে। সামনে বসে থাকা সেতারা আপাকে একটুও সহ্য হচ্ছে না এখন।
“তুই আবার আমার কথায় কিছু মনে করিস না। বড় বোন হিসেবে সাবধান করে দিলাম। এসব ভবঘুরে বাউন্ডুলে ছেলেদের ফাঁদে পা দিস না ভুলেও। জীবনটা অনেক বড়। আবেগে জীবন চলে না।”
প্রিয়তা ধীরে ধীরে হেঁটে যেয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়। আজ আকাশে অর্ধ চাঁদ উঠেছে। চারপাশটা খুব মায়াবী লাগছে দেখতে।
“জীবনটা হয়তো অনেক বড়, কিন্তু জীবনটা তো একটাই আপা। সুখ খুঁজতে খুঁজতে ভালোবাসা হারিয়ে ফেলবো না তো আমরা?”
সেতারা উত্তর দেয়না। জলভরা দুই চোখ নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
অস্থির হয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করছে প্রিয়তা। অনেক রাত হলো, এখনো উচ্ছ্বাস ফেরেনি। কেমন যেনো কু ডাক ডাকছে মনের মধ্যে। কোথায় গেলো মানুষটা? উত্তেজনায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে প্রিয়তার কপালে।
“প্রিয়তা খেতে আয় মা।”
প্রিয়তা ঈষৎ চমকে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”বাবা তোমরা খেয়ে নাও, আমি পরে খাবো।”
কবির শাহ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়তার কাছে এগিয়ে আসে। তার মাথায় হাত রেখে বললো,”আজ তোর জন্মদিন। আর আজ আমি তোকে রেখেই খেতে বসবো? এমন কি কোনোদিন হয়েছে?”
প্রিয়তার বুকে অসহ্য রকম ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে নি:শ্বাসটাও ঠিকমতো নিতে পারছে না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। সময় এখন রাত দশটা বেজে বারো মিনিট। উচ্ছ্বাস কখনোই এতোটা দেরি করে না ফিরতে।
“আমার খেতে ইচ্ছা করছে না বাবা। আমাকে জোর করো না দয়া করে।”
প্রিয়তার কণ্ঠের উত্তাপ টের পায় কবির শাহ। নিজেও চিন্তা করছে উচ্ছ্বাসের জন্য। তবে কি সকালে বলা কথাগুলোতে কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা? সত্যি সত্যিই চলে গেলো বাড়ি ছেড়ে? অনেক বেশি অভিমান করে ফেললো?
“মা রে ছাদে যাবি?”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”এতো রাতে ছাদে যাবো কেনো বাবা?”
“অনেক দিন তোর সাথে মন খুলে গল্প করা হয়না। আজ তোর সাথে একটু গল্প করতে ইচ্ছা করছে। শুধু তুই আর আমি। বড্ড গরম লাগছে ঘরে। বাইরে সুন্দর হাওয়া আছে। দেখবি তোর ভালো লাগবে।”
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারে না প্রিয়তা। সে জানে এখন তার কিছু ভালো লাগবে না, কিছুই না।
“প্রিয়তা।”
“বলো বাবা।”
“তোর কি খুব বেশি মন খারাপ?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। এখন মুখ খুললেই সে কেঁদে দিবে। মনটা খুব নরম ওর। অনেক মন খারাপের সময় কেউ সুন্দর করে কথা বললেও ওর চোখে পানি চলে আসে।
“দূরের তারাগুলো দেখ, কেমন জ্বলজ্বল করছে। তুই কি জানিস দূর আকাশে যতো তারা দেখছিস তার অনেকগুলোর অস্তিত্বই এখন আর নেই।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”অস্তিত্ব না থাকলে আমরা ওগুলো কীভাবে দেখছি বাবা?”
কবির শাহ মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
“তারাগুলোকে যতোটা কাছে তুই মনে করছিস ওরা কিন্তু এতো কাছে না। লক্ষ কিংবা কোটি আলোকবর্ষ দূরে ওরা। ওখান থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছাতেও অনেক সময় প্রয়োজন হয়। হয়তো আমরা এখন যা দেখছি শুধুই তারার আলো। তারাগুলোর বেশিরভাগেরই অস্তিত্ব এখন নেই। কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে গেছে।”
প্রিয়তা ঘোর লাগা চোখে একবার বাবার দিকে আরেকবার তারাগুলোর দিকে তাকায়। কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে সবকিছু তার। এমনও আবার হয় নাকি? কিন্তু বাবা যে বললো? বাবা অনেক বই পড়ে, সে ভুল বলতেই পারেনা।
“আমাদের জীবনে হঠাৎ হঠাৎ এমন মানুষ আসে জানিস তো? যারা আমাদের জীবনে আলো ছড়ায়। আমাদের মনে হয় তাদের আলো ছাড়া আমরা অপূর্ণ। কিন্তু সত্যি বলতে তাদের অবস্থান অনেক অনেক ক্রোশ দূরে আমাদের চেয়ে। হয়তো ওই আলোকবর্ষ সমান দূরে। তারা চায়না নিজেদের অস্তিত্ব আমাদের জীবনে রাখতে। তবুও আমরা ওই আলোটুকুর লোভে তাদের আঁকড়ে বাঁচতে চাই। মিথ্যা মরিচীকার মতো তারা ধরা দেয় বার বার। শেষে এসে কষ্টই পেতে হয় শুধু।”
প্রিয়তা বুঝতে পারে বাবার কথাগুলো। কিন্তু বাবা হঠাৎ এসব কেনো বলছে বুঝতে পারেনা। তবে কি বাবা জানে কিছু উচ্ছ্বাস ভাইয়ের ব্যাপারে? সাহস করে জিজ্ঞেসও করতে পারে না প্রিয়তা।
মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে কবির শাহ তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,”তুই খুব আবেগী আর কোমল একটা মেয়ে। অল্পেই তুই ভেঙে পড়িস। সবাই চাইবে তোকে আরো ভেঙে দিয়ে চলে যেতে। কারণ কি জানিস? যারা কোমল, নরম তাদের ভেঙেচুরে দেওয়া মানুষের একটা নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি। কেউ কেউ পৈশাচিক আনন্দ পায় এই কাজটা করে। কিন্তু মেয়েটা যে আমার, আমার শরীরের অংশ। তার কোনো কষ্ট যে আমি সহ্য করতে পারবো না।”
প্রিয়তা আচমকা বাবার বুকে মাথা রেখে চিৎকার করে কেঁদে দেয়। কবির শাহ তাকে থামায় না। কাঁদুক মেয়েটা, কেঁদে হালকা করুক নিজেকে। ওর এখন শক্ত হওয়া উচিত।
“বাবা।”
“বল মা।”
“আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো বাবা? মনে হচ্ছে আমি আমার জীবনের খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলেছি।”
“তোর মনে আছে, তুই ছোটবেলায় তোর প্রিয় পেন্সিলটা হারিয়ে ফেললি। যেটা তোর খালুজান বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিলো তোকে। তখন এখানের কোনো দোকানে সেই পেন্সিল পাওয়া গেলো না। তুই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলি। আমি অনেক খুঁজে অবিকল একই না হলেও অনেকটা কাছাকাছি দেখতে একটা পেন্সিল এনে দিয়েছিলাম তোকে। তুই খুব খুশি হয়েছিলি পেন্সিলটা পেয়ে। সব প্রিয় জিনিসেরই একটা রিপ্লেসমেন্ট থাকে।”
প্রিয়তা বাবার বুকের উপর থেকে মাথা তুলে চোখে মুছে অন্যদিকে তাকায়।
এরপর যন্ত্রের মতো বললো,”তোমাকে কখনো বলা হয়নি বাবা, তুমি কষ্ট পাবে বলে। তোমার আনা ওই পেন্সিল সেদিন আমার পছন্দ হয়নি। আমি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া পেন্সিলটার রিপ্লেসমেন্ট এখনো পাইনি। প্রিয় জিনিসের রিপ্লেসমেন্ট হয়না বাবা। যেটা হয় তা হলো স্বান্তনা।”
কবির শাহ স্তব্ধ হয়ে যায় মেয়ের কথা শুনে। মেয়েটা হঠাৎ এতোটা বড় হয়ে গেলো? সে বুঝতেও পারলো না?
“নিচে এসো বাবা, মা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।”
হতভম্ব বাবাকে একা রেখেই প্রিয়তা নিচে চলে আসে।
রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। উচ্ছ্বাসের ঘরে জবুথবু হয়ে বসে আছে প্রিয়তা। উচ্ছ্বাস ফেরেনি। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। এখন আর কাঁদতেও ইচ্ছা করছে না, ভীষণ দূর্বল লাগছে।
দূরেই উচ্ছ্বাসের গীটারটা পড়ে আছে ভীষণ অনাদরে। প্রিয়তা ধীরে ধীরে হেঁটে যেয়ে গীটারটা হাতে নেয়। তারগুলোতে আঙ্গুল পড়তেই টুংটাং শব্দ ওঠে।
প্রিয়তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি পড়ে গীটারের উপর।
“আপনি যদি চলেই যাবেন তবে মিথ্যা আশা কেনো দিলেন আমাকে? তবে কি ভুলটা আমারই ছিলো? আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি? সবাই বলতো এই কথা। মা, বড় খালা, সেতারা আপা। আমি কারো কথাই কানে তুলিনি। ভেবেছিলাম আপনি আলাদা। আমার জীবনে আপনিই প্রথম পুরুষ যাকে দেখে আমি নিজের অজান্তেই শিউরে উঠেছি। আমি জানিনা ভালোবাসা কি কিংবা প্রেমে পড়া কাকে বলে। শুধু আপনাকে দেখার পর থেকে আর কোনো পুরুষকে ভালো লাগেনা। সবসময় আপনার কাছে থাকতে ইচ্ছা করে। আপনি ঘুমিয়ে থাকলে কতোবার যে জানালার পর্দা সরিয়ে আপনার ঘুমন্ত মুখটা দেখেছি তা শুধু আমার এই বেহায়া চোখ দু’টো জানে। অবাধ্য মনটা আপনার দু’টো চোখের গভীরতায় খেই হারিয়ে বারবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যদি একে ভালোবাসা বলে তবে আমি পুরো দুনিয়ার সামনে চিৎকার করে বলতে পারি আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি ভেবেছিলাম আমার এই বেহায়া ভালোবাসা বুঝি একটু হলেও আপনার পাষাণ মনটাকে আকৃষ্ট করেছে আমার প্রতি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আপনি আমাকে সবার কাছে ছোট করে দিলেন উচ্ছ্বাস ভাই। আপনি আমার ক্ষমা পাবেন না, কোনোদিন না।”
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে প্রিয়তা। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়। জীবনের একটা বিশেষ দিন এভাবে চোখের পানিতে প্লাবিত হয়ে যাবে সে কোনোদিন ভাবতে পারেনি।
মাঝরাতে বাড়ির দরজায় জোরে জোরে করাঘাত পড়ে। ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে বসে কবির শাহ। স্বামীর পাশে মার্জিয়া বেগমও উঠে বসে।
ভয়ে, দুশ্চিন্তায় কবির শাহের বুক কাঁপতে থাকে। এমনিও রাতে ঘুম আসেনি সেভাবে। ছেলেটা কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেলো, এখন কি অবস্থায় আছে এই ভয়ংকর চিন্তাগুলো ঘুমাতে দেয়নি তাকে।
ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে রাত তিনটা পঞ্চাশ বাজে। কে আসবে এই অসময়ে? উচ্ছ্বাস? নাকি কোনো খারাপ সংবাদ?
“কোথায় যাচ্ছো তুমি? এতো রাতে তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না আমি।”
“এটা কেমন কথা মার্জিয়া? কে এসেছে দেখবো না?”
“এতো রাতে কে আসবে? দেখো তোমার ওই বোনের ছেলে নেশা করে মাতাল হয়ে এলো কিনা।”
কবির শাহ স্ত্রীর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,”একদম নোংরা কথা বলবে না ওকে নিয়ে। ও এমন ছেলে নয় তুমি ভালো করেই জানো?”
মার্জিয়া বেগম মুখ বাঁকায়।
অপরিচিত এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। আগে কখনো তাকে দেখেনি কবির শাহ। চশমা চোখের চিকন একটা ছেলে। কবির শাহ চোখের চশমাটা ভালো করে পরে তাকায় ছেলেটার দিকে, চেনার চেষ্টা করে।
“আপনি কি কবির শাহ? উচ্ছ্বাস ভাইয়ের মামা?”
কবির শাহ ভয়ে ভয়ে বললো,”হ্যা আমি কবির শাহ। উচ্ছ্বাস কোথায়? কি অবস্থায় আছে ও? ভালো আছে তো?”
মার্জিয়া বেগম ততক্ষণে স্বামীর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ছেলেটা অবাক হয়ে বললো,”এ কি বলছেন মামা? উচ্ছ্বাস ভাই বাড়িতে নেই? কোথায় গিয়েছেন উনি?”
কবির শাহের মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে ওঠে। মার্জিয়া বেগম ধরে বসে তাকে।
“আপনি ঠিক আছেন মামা?”
“তোমার পরিচয় কি বাবা? উচ্ছ্বাসকে কীভাবে চিনো তুমি?”
ছেলেটা কিছুক্ষণ থেমে বললো,”এতোকিছু বলতে পারবো না আপনাকে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলতে এসেছি। উনি আসার সাথে সাথে বলে দিবেন দয়া করে। উনার প্রাণনাশের ঝুঁকি আছে।”
প্রিয়তার ঘুম হয়নি সারারাত। বাইরের ঘরে এতো শব্দ শুনে ছুটে এসেছে সে। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়।
কবির শাহ চিৎকার করে বললো,”প্রাণনাশের ঝুঁকি মানে? কি হয়েছে উচ্ছ্বাসের?”
ছেলেটা একবার মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললো,”উনার চাচারা হন্যে হয়ে খুঁজছে উনাকে। উনার বাবা মায়ের মতো উনাকেও……”
কবির শাহ থরথর করে কাঁপতে থাকে। মার্জিয়া বেগম কিছু না বুঝে তাকায় কবির শাহের দিকে। সে তো জানে উচ্ছ্বাসের বাবা মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এসবের মধ্যে উচ্ছ্বাসের চাচারা এলো কোথা থেকে? উচ্ছ্বাসের প্রাণনাশের ঝুঁকি-ই বা হবে কেনো তাতে?
“এসব কি বলছো বাবা তুমি?”
“আমি চলি মামা। আমি উনাকে সাবধান করে দিতে এসেছিলাম। কিন্তু উনি বাড়িতে নেই শুনে অনেক দুশ্চিন্তা হচ্ছে এখন। উনার চাচারা মানুষ ভালো না। উনি একা, কি করবেন উনি?”
ছেলেটা দাঁড়ায় না। একদমে কথাগুলো বলে চলে যায়।
কবির শাহ কাঁপা কাঁপা পায়ে এসে চেয়ারে বসে। তার সামনে পুরো পৃথিবীটাই যেনো ঘুরছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে। ছেলেটা কোথায় গেলো? কাউকে কিছু না বলে এভাবে কেনো চলে গেলো? তবে কি ইতোমধ্যেই সে ওদের হাতে বন্দী হয়েছে? ওরা কি মেরে ফেলেছে উচ্ছ্বাসকে এতোক্ষণে?
কবির শাহ আর ভাবতে পারেনা। ডুকরে কেঁদে ওঠে। নীলিমার সন্তানকে সে রক্ষা করতে পারলো না? এতোটা ব্যর্থ সে আজ?
মার্জিয়া বেগমের মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু স্বামীর এই অবস্থায় কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। ছেলেটার জন্য এই প্রথম সে এক অজানা মায়া অনুভব করছে বুকের ভিতর। কিছুটা দুশ্চিন্তা তাকেও ঘিরেও ফেলেছে। কোথায় গেলো ছেলেটা এই চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে তার। একেই কি বলে মাতৃত্ব? যাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারতো না, যার উপস্থিতি কাঁটার মতো বিঁধতো চোখে তার জন্যই অস্থির লাগছে এখন। সে তো সবসময় চেয়েছিলো ছেলেটা যেনো আর না আসে তার চোখের সামনে, চলে যায় চিরতরে এই বাড়ি ছেড়ে। তার তো ভালো লাগার কথা। তবে এমন কেনো লাগছে আজ? সে নিজেও তো একজন মা। এক মা হারা ছেলের জন্য এতো খারাপ লাগছে কেনো তার?
স্বামীকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায়না সে। শুধু তার মাথায় হাত দিয়ে ফিসফিস করে বললো,”চিন্তা করোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। ও ফিরে আসবে দেখো তুমি, ওকে আসতেই হবে।”
পা দু’টো অনড় হয়ে আছে প্রিয়তার। মনে হচ্ছে এক পা-ও আর এগোতে পারবে না সে। ভিতর থেকে বোবাকান্না গুলো ঠেলে বাইরে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু এক অজানা শক্তি গলাটা চেপে ধরে রেখেছে যেনো তার।
হঠাৎ প্রিয়তার মনে পড়ে চুড়ির সাথে একটা চিরকুটও তো মোড়ানো ছিলো কাগজের সাথে। উত্তেজনায় তো ভুলেই গিয়েছিলো চিরকুটটার কথা।
ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে দেয় প্রিয়তা। উন্মাদের মতো চিরকুটটা খুঁজতে থাকে সে। সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে নিমিষেই। হাত-পা ভীষণ কাঁপছে তার।
কিছুক্ষণ পর ফেলে দেওয়া কাগজগুলোর মধ্য থেকে দুমড়ানো মোচড়ানো চিরকুটটা বের করে সে। সাধারণ কাগজ ভেবে ফেলেই দিয়েছিলো ওটা। সাথে সাথে চোখের সামনে মেলে ধরে ওটা।
নন্দিনী,
নামটা কি তোমার পছন্দ? ঠিক যেমন পছন্দ তোমার বৃষ্টি কিংবা মোটা মোটা গল্পের বইগুলো? নামটা আমার খুব পছন্দ। কারণ আমার বাবা আমার মা কে এই নামে ডাকতো। আমি কেনো তোমাকে এই নামে ডাকলাম সেই উত্তর জানতে চেয়ো না, আমার নিজের কাছেও নেই।
হরিণচোখের কন্যা, তুমি যে আমার প্রেমে পড়েছো এ কথা অনেক আগেই আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কি করবো বলো? আমার এই ভাঙাচোরা জীবনে তোমার মতো ফুলের কোমল পাপড়িকে আমি জায়গা দিতে চাইনি। তুমি এলোমেলো হয়ে যাবে ঝড়ের মতো। কিন্তু এক সময় দেখলাম, আমি নিজেও নিজের অজান্তে অল্প অল্প করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি ওই চোখজোড়ায়। আমি নিজেকে সামলানোর অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। দুনিয়ার সব সৌন্দর্য তোমার কাছে বারবার ম্লান হয়েছে। আমি আটকাতে পারিনি নিজেকে।
তুমি যখন এই চিঠি পড়বে হয়তো আমি তোমার থেকে তখন অনেকটাই দূরে। তবে তুমি চিন্তা করোনা। আমি ফিরে আসবো তোমার কাছে। তোমাকে কথা দিলাম। আমি স্বার্থপর হবো। আমার এই এলোমেলো জীবনটাকে গোছানোর ভার আমি তোমাকে দিবো। যদি এই অপরাধে আমার শাস্তি হয়, তবে হোক। তবুও আমি স্বার্থপর হবোই।
শেষে আর একটা কথা বলি? কাজল লেপ্টে যাওয়ার জন্য আমার ভালোবাসাই যথেষ্ট, তার জন্য এভাবে দিনরাত এক করে কাঁদতে হবে না।
তুমি চাইলে মহাবিশ্ব হাতের নাগালে এনে দিতে পারি, আর তো সামান্য চাঁদ।
চন্দ্রাবতী আমার ধ্বংসযজ্ঞ ভরা জীবনে তুমি সর্বনাশের শুরু, তুমি মরণ ফাঁদ।
ইতি,
তোমাকে যন্ত্রণায় ম্লান করিয়ে দেওয়া এক যুবক।
প্রিয়তা চিঠিটা কাঁপা হাতে মুখের চেপে ধরে। মনে হচ্ছে এখানে মানুষটার গায়ের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হয় প্রিয়তার। ঝাপসা হয়ে আসে তার সামনের সবকিছু।
(চলবে……)
#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ১৯
প্রিয়তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মার্জিয়া বেগম। এক রাতেই মেয়েটার চোখমুখের অবস্থা করুণ। চোখের নিচে কালি পড়েছে, কেমন যেনো কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে চোখ দু’টো। মার্জিয়া বেগমের রাগের উত্তাপ বাড়ে ভিতর ভিতর। এমন একটা ভাব করছে যেনো ওর মা মারা গেছে। তার ইচ্ছা করছে মেয়ে গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে। মেয়ে এখন যেই বয়সটা পার করছে তা সাক্ষাৎ আগুন। এই আগুন নেভানোর জন্য পানি লাগবে। আর পানি হলো মায়ের মুখের মিষ্টি কথা।
“কি রে প্রিয়তা? আজ এতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লি যে? অন্যদিন তো হাতি দিয়ে টানলেও তোর ঘুম ভাঙে না।”
প্রিয়তা ম্লান স্বরে বললো,”আজ কলেজে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”বলছি আজ কলেজে না গেলে হয়না?”
প্রিয়তা ঝট করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,”কেনো আজ কি?”
মার্জিয়া বেগম আমতা আমতা করে বললো,”তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর শরীরটা ভালো না।”
প্রিয়তা কঠিন গলায় বললো,”আমি ঠিক আছি।”
“চল প্রিয়তা, আজ আমি তোকে কলেজে নামিয়ে দিবো।”
কবির শাহ কখন এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পাশে টেরই পায়নি ওরা।
“কেনো বাবা তোমাকে যেতে হবে কেনো?”
“আমি গেলে কি তোর সমস্যা হবে?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে না-সূচক মাথা নাড়ে।
কবির শাহ মুচকি হাসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে।
প্রচন্ড দূর্বল লাগছে প্রিয়তার শরীরটা। সারারাত ঘুম হয়নি, ঠিকমতো খায়নি। ঘরের মধ্যে অসহ্য লাগছিলো তাই নিজের সাথে জোর করে কলেজে এসেছে। ক্লাসে ঢুকেই চুপচাপ এক কোণায় বসে আছে প্রিয়তা।
“কি গো সখী? মনটা মনে হচ্ছে খারাপ। এখন তো তোমারই দিন। মুখে হাসি ঝলমল করবে।”
রুনার কথায় প্রিয়তা কিছুটা চমকে ওঠে। মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বললো,”রুনা তুই কখন এলি?”
“এই এলাম গো বেশ কিছুক্ষণ। তোমার তো কোনোদিকেই মন নেই এখন। থাকবেই বা কীভাবে? এখন যে স্বপ্নপুরুষের ধ্যানে মগ্ন তুমি।”
“দেখ রুনা…..”
“হুম বুঝছি বুঝছি। আর কিছু বলার দরকার নেই। এখন ফটাফট বলে ফেল তো, সুদর্শন পুরুষটি কে?”
প্রিয়তা আস্তে আস্তে বললো,”কোন পুরুষের কথা বলছিস?”
“ইশ কি নাটকটাই না করতে পারিস তুই। বললেই কি তোর মানুষটাকে আমি নিয়ে নিবো নাকি?”
প্রিয়তা গলার স্বর আরো অনেকটা নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,”দেখ রুনা তুই যা ভাবছিস তা নয়।”
“কিছু ভাবছি না, যা দেখার নিজের চোখেই দেখেছি গতকাল। লাল গোলাপ কারা যে ওভাবে দেয় আমরা জানি।”
রুনা মুখ টিপে হাসতে থাকে।
হঠাৎ রুনাকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়তা ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। রুনা হাসি থামিয়ে থমকে যায় প্রিয়তার কান্না দেখে। সবসময় হাসিমুখে থাকা মেয়েটার চোখে পানি কেনো?
রুনা ব্যস্ত হয়ে বললো,”কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেনো তুই? দয়া করে বলবি কি হয়েছে?”
প্রিয়তা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,”আমার কিছু ভালো লাগছে না রুনা। আমার মনটা ভালো করে দে।”
রুনা প্রিয়তার মাথায় হাত রাখে। সেই স্কুলজীবন থেকেই বন্ধুত্ত্ব দুইজনের। যেনো বান্ধবী নয়, দুই বোন। মেয়েটাকে দেখেই মনে হচ্ছে চাপা কোনো কষ্ট পুষে রেখেছে সে ভিতরে। কান্নারত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তারও কষ্ট হতে থাকে।
“প্রিয়তা তুই কি ভীষণ ভাবে কারো ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছিস?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। লাল পদ্মের মতো এক জোড়া চোখে রুনার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।
সারারাত ঘুম হয়নি আরো একটা মানুষের। সে হলো উচ্ছ্বাস। সারারাত রাস্তায় হেঁটেছে সে। চোখজোড়া লাল হয়ে আছে তার। সারাটা রাত রাস্তায় হেঁটে সে নিজেকে সময় দিয়ে চেয়েছে। নিজের মনকে প্রশ্ন করেছে সে কি সত্যিই প্রিয়তাকে ভালোবাসে? নাকি সম্মুখে প্রতিদিন মেয়েটার মিষ্টত্ব একটু একটু করে বৃদ্ধি পেয়ে তার চোখে ধরা দিচ্ছে বলে তার অবচেতন মন তাকে ভালোবাসা বলে ধরে নিয়েছে? আর যাই হোক, মেয়েটাকে কষ্ট দিতে পারবে না সে। যদি সত্যিই মেয়েটার অনুপস্থিতি তাকে পীড়া দেয়, তবে সে বুঝবে সে প্রিয়তাকে ভালোবেসেছে। আর যদি তা না হয় তবে সরে আসবে প্রিয়তার জীবন থেকে।
কিন্তু সকাল হতে না হতেই এক আবদ্ধকর বিষাদে মনটা ছেয়ে যায় তার। মনে হচ্ছে কয়েক যুগ হয়ে গেছে মেয়েটাকে দেখেনা সে। এমন তো আগে কখনো কারো জন্য হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে একটা মেয়েকে মন দিয়েছিলো সে। মেয়েটাও তাকে ভালোবাসতো। দুইজনের ডিপার্টমেন্ট ছিলো আলাদা। দুইজনের ক্লাস শেষ হলে তারা টিএসসিতে একসাথে হাঁটতো। মেয়েটার হাসিটা খুব বেশি পছন্দ ছিলো উচ্ছ্বাসের। কিন্তু মেয়েটার মনে হয়তো অন্য কিছু ছিলো। আর তাইতো মাঝ রাস্তাতেই উচ্ছ্বাসকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরতে দ্বিধাবোধ করলো না। অনেক কষ্ট পেয়েছিলো উচ্ছ্বাস। প্রেম-ভালোবাসা এসবের উপর থেকে মন উঠে গিয়েছিলো একরকম। এরপরই এলো তার জীবনের ভয়ংকরতম সেই কালো অধ্যায়।
সকাল হতে না হতেই প্রিয়তার কলেজের সামনে দাঁড়িয়েছে উচ্ছ্বাস। সারারাত ঘুম না হওয়ায় চোখ জ্বলছে তার। মেয়েটাকে এক নজর দেখার তৃষ্ণা তাকে জেঁকে বসেছে।
কলেজের সামনে একটা দোকান থেকে সিগারেট জ্বালিয়ে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে কলেজ গেটের দিকে।
হঠাৎ দূর থেকে প্রিয়তাকে দেখেই সময় থমকে যায় তার। অসম্ভব ক্লান্তি ভরা মুখটা দেখে বুকের মধ্যে খচখচ করে ওঠে। সে কি একটু বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললো মেয়েটাকে? সিগারেট জ্বলতে জ্বলতে হাতের অনেকটা কাছে চলে এসেছে। যে কোনো সময় পুড়ে যাবে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই তার। কি অসম্ভব স্নিগ্ধতা ঘিরে আছে মেয়েটার চারপাশ।
“ও ভাই ওইভাবে কি দেখেন? সিগারেটে হাত পুড়বো তো।”
উচ্ছ্বাস ধাতস্থ হয়ে সিগারেটটা ফেলে দেয়, ততক্ষণে আঙ্গুলে কিছুটা আগুনের ছ্যাঁকা লেগেছে। কিন্তু একটুও কষ্ট হচ্ছে না তার, পুড়ছে তী তার হৃদয়টা।
“কড়া করে একটা চা লাগাও তো?”
দোকানদার আপন মনে হাসতে হাসতে চা বানাতে থাকে।
“প্রেমে পড়ছেন ভাই?”
উচ্ছ্বাস চমকে দোকানদারের দিকে তাকায়, উত্তর দেয়না।
“যদি ভালোবাসেন তবে এভাবে লুকিয়ে না দেখে তারে বলে দেন। মনের মধ্যে কথা লুকায় রাখলে মনে ক্ষত সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষত সহজে শুকাতে চায়না।”
উচ্ছ্বাস বিরক্ত গলায় বললো,”চা লাগাও তাড়াতাড়ি, কথা কম বলো।”
দোকানদার আপন মনে হাসতে হাসতে বললো,”আপনার ভাবীরে ভীষণ ভালো পাইতাম, সে-ও আমারে ভালো পাইতো। কিন্তু লজ্জায়, ভয়ে কেউ কাউরে কোনোদিন বলিনি। হঠাৎ একদিন সে কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে হাজির। আমি কই, ঘটনা কি, কান্দো ক্যান? সে বললো আইজ রাতেই তার বিয়ে। আমার মাথায় পড়লো বাজ। আমি তখন বেকার। তারে নিয়া রাখবো কই, খাইতে দিবো কি? ফিরায় দিতেই চাইছিলাম। কিন্তু কি জানেন তো? মায়ায় জড়ায় গেলাম তার কান্নাভেজা চোখ দুইটা দেখে। মায়া এক ভয়ংকর নেশার নাম গো ভাইজান। জীবনের সব নেশা অতিক্রম করে ফেলতে পারবেন কিন্তু মায়া কাটাইতে পারবেন না। এটাই জগৎ সংসারের নিয়ম। সাহস কইরা বিয়ে করে ফেললাম। এরপরই এই দোকানডা দিলাম। কি যে দিন কাটাইছি ভাইজান। একটা ডিম ভেজে দুইজন খাইতাম। সে আমারে মুখে তুলে খাওয়ায় দিতো। কি যে স্বাদ সেই ডিম ভাজিতে ভাইজান, এখনো সেই স্বাদ ভুলিনি। ভাঙা টিনের ছাদ থেকে জ্যোৎস্নার আলো আসতো ঘরে। আমি গীত গাইতাম, সে আঁচলের তলায় মুখ লুকায় মিটমিট করে হাসতো। আমার মনে হতো বেহেশত কি এর চাইতেও সুন্দর? এই সুখের চাইতে আর কিছু সুন্দর হইতে পারে?”
উচ্ছ্বাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো দোকানদারের কথা শুনছিলো। একরকম ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলো সে।
“তাইলে তো ভাবী খুবই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। এখনো কি একসাথে ডিম ভাজা খাওয়া হয়?”
দোকানদার আবার হাসে, কিন্তু এবারের হাসিটা উচ্ছ্বাসের কাছে খুব বিষাদের লাগে।
“দিন গুণতেছি ভাইজান, মৃত্যুর দিন। একসাথে যেদিন বেহেশতে যাবো সেদিন আবারও ডিম ভাজা খাবো। একটা ডিম দুইজন মিলে।”
উচ্ছ্বাস চমকে উঠে বললো,”তার মানে?”
“বিয়ের দুই বছরের মাথায় সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে আমার সোনাপাখিটা তার ছানা নিয়াই মরে গেছে। সেই থেকে এই চৌদ্দ বছর আমি একা। ওইযে বললাম মায়া, মহিলা গেছে গেছে কিন্তু আমারে তার মায়া কাটানোর ঔষধটা দিয়ে যায়নি। এখনো তার মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়ায় আছি আমি। আর কাউরে জীবনে আনতেই পারলাম না।”
উচ্ছ্বাসের মনে হলো জমাট বাঁধা কোনো কষ্ট গলার মধ্যে আটকে আছে। শ্যামসুষমা তরুণীটার জন্য বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা যন্ত্রণা হচ্ছে হঠাৎ।
“বুঝছেন ভাই, চেষ্টা করি দিনের মধ্যে একটাও খারাপ কাজ না করার। তারে তো আল্লাহ বেহেশতে নিবে, জীবনে কোনো পাপ কাজ সে করেনি। তার সাথে বেহেশতে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনা। সেখানের ফেরেশতা যদি বলে একটা ডিম খাও কেনো? দুইজন দুইটা খাও। আমি তখন ফেরেশতারে বলবো দুইজন মিলে একটাই খাবো। বেহেশতে তো সব আছে, খালি বিচ্ছেদ নাই, তাই না ভাইজান?”
উচ্ছ্বাস উঠে দাঁড়ায়। মাথাটা অসম্ভব ঘোরাচ্ছে তার। ইচ্ছা করছে ছুটে যেয়ে মেয়েটাকে উন্মাদের মতো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।
“যদি কাউরে ভালোবেসে থাকেন, দেরি না করে বলে দেন। যে কয়টা দিন একসাথে থাকবেন সে কয়টা দিনই জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। দিন ফুরায় গেলেই সব শেষ।”
উচ্ছ্বাস ছোট্ট করে হাসে, কিছু বলেনা। ব্যস্ত শহরটাকে বড় এলোমেলো লাগে তার। কোনো এক অপরূপার চোখের মাঝে যেনো শহরটা আটকে আছে।
ক্লাস শেষ করে কলেজ গেটেই বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলো নীলু। হঠাৎ তার চোখ যায় অদূরেই এক জোড়া চোখের দিকে। যে অধীর আগ্রহে কলেজের দিকেই তাকিয়ে আছে। আর সেই চোখজোড়া দেখে বুকের মধ্যে হাতুড়িপেটা হতে থাকে নীলুর। ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, না ঘুমানো লাল চোখে, হাতে সিগারেট, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। হাতা গুটিয়ে রাখা নীল পাঞ্জাবিতে ঠিক যেনো গ্রীক কোনো দেবতা। নীলুর মাথা খারাপ হওয়ার জন্য এতোটুকুই বোধহয় যথেষ্ট ছিলো। নিশ্চয়ই তার সাথে দেখা করতে এসেছে। গতকাল একবার দেখেই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছে ছেলেটা, সে নিশ্চিত।
“এই দেখ তো আমাকে কেমন লাগছে। চুলগুলো কি খুব রুক্ষ দেখাচ্ছে? ইশ কেনো যে আজ চুলে খোঁপা করলাম না।”
নীলুর বান্ধবী ইশিতা হালকা হেসে বললো,”এমন ভাব করছিস যেনো ওই সুদর্শন ছেলেটা তোর প্রেমিক।”
নীলু চোখ পাকিয়ে বললো,”প্রেমিক এখনো হয়নি, তবে হবে।”
ইশিতা মুখ বাঁকিয়ে বললো,”এতোই সোজা বুঝি?”
“তুই দেখবি? ও আমাকে দেখতেই এখানে এসেছে।”
ইশিতা চোখ বড় বড় করে বললো,”আমি মজা করে বলেছি।”
“কিন্তু আমি মজা করিনি, আয় আমার সাথে।”
ইশিতাকে জোর করে টানতে টানতে নীলু উচ্ছ্বাসের সামনে দাঁড়ায়। তবে উচ্ছ্বাসের তার দিকে কোনো খেয়াল নেই।
উচ্ছ্বাসের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য দুইবার খুকখুক করে কাশে নীলু। উচ্ছ্বাস তাকায় না। ইশিতা মুখ টিপে হাসে।
রাগে লাল হয়ে নীলু বললো,”এইযে শুনছেন?”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে নীলুর দিকে তাকায়।
“কি ব্যাপার?”
নীলু লাজুক মুখে হেসে বললো,”ভালো আছেন আপনি?”
উচ্ছ্বাস রুক্ষ গলায় বললো,”তাতে আপনার কি? আপনাকে কি আমি চিনি?”
মুখটা চুপসে যায় নীলুর। এই লোকটার কি ভুলে যাওয়ার রোগ আছে? গতকালই দেখা হলো, আর আজ কিনা বলছে চিনেই না?
“আপনি আমাকে চিনতে পারেননি?”
উচ্ছ্বাস চোখমুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবার চেষ্টা করে।
এরপর ঈষৎ হেসে বললো,”ও হ্যা চিনেছি।”
নীলু বাঁকা ঠোঁটে হেসে ইশিতার দিকে তাকায়। যেনো যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে।
“আপনি এই কলেজের ঝাড়ুদার মহিলাটা তাইনা? পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম মনে হয় ঝাড়ু দিতে।”
মুখটা ঝুলে যায় নীলুর। লোকটা কি পাগল? কি বলছে এসব? কলেজের নামকরা সুন্দরী, সব ছেলেরা যার জন্য পাগল তাকে কিনা বললো ঝাড়ুদার মহিলা?
ইশিতা হেসেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে ওদিকে।
নীলু কঠিন গলায় বললো,”আমি কেনো ঝাড়ুদার মহিলা হতে যাবো? আমি নীলু।”
“নীলু হোন বা কালু হোন আমার কাছে কি চান?”
রাগে, দু:খে চোখে পানি চলে আসে নীলুর। নেহাৎ লোকটা সুদর্শন বলে, নাহলে ঠেকা পড়েছিলো এভাবে যেচে পড়ে অপমানিত হতে?
“আপনি কি কিছুই মনে করতে পারছেন না? গতকাল যে প্রিয়তাদের বাড়িতে আপনার সাথে আমার দেখা হলো। আপনি ছাদ থেকে আমাকে দেখছিলেন বারবার।”
উচ্ছ্বাস নির্লিপ্ত গলায় বললো,”ছাদ থেকে দেখার মতো কোনো বস্তু আপনি নন। এবার চিনেছি আপনাকে। গতকাল তো এমন সাজ সেজেছিলেন যে আপনি প্রসাধনী ব্যবহার করেছেন নাকি প্রসাধনী আপনাকে ব্যবহার করেছে বোঝা মুশকিল ছিলো। এজন্যই চিনতে পারিনি আজ।”
নীলু লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়। এ বান্দা যে যেনোতেনো বান্দা নয় সে ভালো করে বুঝতে পারছে।
“দাঁড়িয়ে আছেন যে? দাঁড়াতে হলে একটু দূরে যেয়ে দাঁড়াবেন। ভীষণ ঘামের দুর্গন্ধ আসছে। যে গরমটা পড়েছে, বুঝতেই পারছেন। আমি আবার দুর্গন্ধ নিতে পারিনা।”
নীলু বিস্ফারিত চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। একটা মানুষ এমন কঠিন মুখে এরকম কথা কীভাবে বলতে পারে?
ইশিতা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে নীলুর গায়ে। নীলু এক ঝটকা দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়।
“ভাইয়া আপনি তো খুব মজার মানুষ। আপনাকে দেখলে কিন্তু মনে হয়না এতো মজার মানুষ আপনি।”
“আপনাকে দেখলেও মনে হয় না আপনি এভাবে পেত্নীর মতো হাসতে পারেন। বাপরে, এটা মানুষের হাসি? মনে হচ্ছিলো একটা হায়েনা হাসছে।”
ইশিতার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। নীলু ইশিতা দিকে তাকিয়ে মুখ হাসে। মনে মনে বলে,’দেখ কেমন লাগে। সুন্দর ছেলে দেখে খুব ভাব জমাতে গিয়েছিলি।’
ইশিতা বুঝতে পারে নিজের সম্মান রাখতে হলে এই ছেলের সামনে থেকে চলে যেতে হবে। এটা ছেলে নাকি এলিয়েন?
“চল নীলু, এখান থেকে চল।”
“আরে দাঁড়া তো তুই।”
এরপর কিছুটা উশখুশ করে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে নীলু বললো,”আপনি এখানে যে? প্রিয়তাকে নিতে এসেছেন? ওদের ছুটি হওয়ার তো অনেক দেরি। চলুন না, ওদিক কোথাও যেয়ে বসি।”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে।
“একটা কাজ করে দিতে পারবেন?”
নীলু ঘোর লাগা গলায় বললো,”একটা কেনো, একশটা কাজ বলুন না।”
“আপনাকে দেখে মনে হয়না একশোটা কাজ পারবেন। তাই একটাই কাজ দিচ্ছি।”
নীলু থতমত খেয়ে যায়।
“আপনাকে একটা কাগজ দিচ্ছি, ওটা প্রিয়তার হাতে পৌঁছে দিবেন। এটাই আপনার কাজ।”
“ব্যস এতোটুকুই?”
“জ্বি এতোটুকুই।”
নীলু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো,”কিন্তু কিসের কাগজ?”
“ওর পেট খারাপ হয়েছে তো। কাগজে ওষুধের নাম লিখে দিবো, আপনার সমস্যা?”
“পেট খারাপ?”
উচ্ছ্বাস পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে নীলুর হাতে দেয়।
নীলু চিরকুটটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,”প্রিয়তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে জানেন তো? ব্যবসায়ী নিয়াজ মোর্শেদের সাথে।”
উচ্ছ্বাসের মুখটা বিষিয়ে উঠলো। এই খবর কলেজ পর্যন্তও জেনে গেছে?
“কেনো আপনার হিংসা হচ্ছে নাকি? হিংসা হলে আপনিই বিয়ে করে নিন না নিয়াজ মোর্শেদকে, খুব মানাবে।”
নীলু রাগান্বিত হয়ে বললো,”আমার এসব শখ নেই।”
“এবার দয়া করে কাগজটা প্রিয়তাকে দিয়ে আসুন। ভুলেও এটা খুলে পড়ার চেষ্টা করবেন না।”
“পড়লে কি হবে?”
উচ্ছ্বাস নীলুর চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকায়। নীলু কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।
“পড়লে আপনারও পেট খারাপ হবে।”
হতভম্ব নীলু আর ইশিতাকে পিছনে ফেলে উচ্ছ্বাস চলে যায়।
“ছেলেটা কে রে নীলু? বাপ রে বাপ, ছেলে তো নয় যেনো সাক্ষাৎ এক অ্যানাকোন্ডা। নি:শ্বাস দিয়েই যেনো বিষ বের হয়।”
নীলু মিটমিট করে হেসে বললো,”ঠিক এমন আগুন পুরুষই আমার পছন্দ। ইশ কি দুষ্টু!”
ইশিতা জোর করে হেসে নীলুর দিকে তাকায়।
ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি থেকে নামছিলো প্রিয়তা। রুনা তার হাত ধরে তাকে নামাচ্ছে। মেয়েটার শরীরটা বড্ড নরম লাগছে। রুনা ঠিক করেছে আজ ওকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিবে, একা ছাড়বে না কোনোভাবেই।
সিঁড়ির মুখেই পথ আগলে দাঁড়ায় নীলু ওদের।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে নীলুর দিকে তাকিয়ে বললো,”নীলু আপা, কিছু বলবেন?”
“কি হয়েছে তোর প্রিয়তা?”
“আমার আবার কি হবে?”
“কিছুই হয়নি?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। তার বুকটা ঢিপঢিপ করছে। এই মেয়েটাকে তার অদ্ভুত কারণেই ভালো লাগেনা।
নীলু শব্দ করে হেসে বললো,”পেট খারাপ এটা বলতে আবার লজ্জা কিসের?”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”পেট খারাপ?”
“আমাকেও লজ্জা পাস নাকি তুই? তোর উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কাছে তো লজ্জা পাস না, তাকে ঠিকই জানিয়েছিস।”
হতবাক হয়ে যায় প্রিয়তা। এসব কি বলছে নীলু আপা? কোনো কথা সরে না মুখ দিয়ে তার।
“নীলু আপা…..”
নীলু হেসে বললো,”এই নে তোর ওষুধ। তোর ওই অতিরিক্ত সুন্দর ভাইটা এটা আমার হাতে দিয়ে গেলো। বললো এখানে তোর পেট খারাপের ওষুধের নাম লেখা আছে।”
প্রিয়তা ভয়ংকরভাবে চমকে ওঠে। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা নেয়। মনে হচ্ছে কাগজ না, বরং তার প্রাণটাই লুকিয়ে আছে এর মধ্যে।
“উনি কোথায় নীলু আপা?”
“উনি তো চলে গিয়েছেন এটা দিয়েই। আচ্ছা উনি কি তোদের বাড়িতে আর থাকেন না? কোথায় থাকেন রে? ঠিকানাটা দে না। কিছু না, রোজ সকালে উনি যে কালো শার্টটা পরে সিগারেট খান বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, ওটা দেখবো শুধু।”
প্রিয়তা যন্ত্রের মতো বললো,”আমি জানিনা উনি কোথায় থাকেন।”
নীলু রাগী চোখে কিছুক্ষণ প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে চলে যায়।
শক্ত করে চিঠিটা হাতের মধ্যে চেপে ধরে আছে প্রিয়তা। খুলতে ভয় পাচ্ছে সে। খুললেই তো শেষ হয়ে যাবে চিঠিটা। তার চেয়ে যতোক্ষণ হাতে আছে, থাক না।
একাই রিকশাতে বাড়ি ফিরছে সে। রুনা আসতে চাইলেও সে বলেছে দরকার হবে না। একাই চলে যেতে পারবে।
‘চাঁদ মুখে গ্রহণ লেগেছে কেনো? অমাবস্যা দেখতে অভ্যস্ত নই আমি। আমার সবসময় পূর্ণচন্দ্র লাগবে। যার জ্যোৎস্নায় সব মন খারাপ ধুয়েমুছে যাবে। ঝুম বৃষ্টির অপেক্ষা করো নন্দিনী। তার আগ পর্যন্ত যেনো জ্যোৎস্না ফুরিয়ে না যায় চাঁদ থেকে।’
চিঠিটা বুকে চেপে ধরে হু হু করে কাঁদছে প্রিয়তা। না এটা কষ্টের কান্না নয়। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে সে ক্ষণে ক্ষণে। আচ্ছা, খুব শান্তি হলে কি এভাবে কান্না পায়? আগে তো জানতো না সে। সুখের কান্নারও যে অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য আছে, এটা আগে বুঝতে পারেনি কেনো সে?
বয়স্ক রিকশাওয়ালা প্রিয়তার কান্নার আওয়াজে পিছন ঘুরে তাকায়। কম বয়সী মেয়েটার কান্নায় বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে তার।
“কাইন্দো না আম্মাজান, কাইন্দো না। ফেইল মারছো পরীক্ষায়? একবার মারছো তাতে কি হইছে? তার জন্য এইভাবে কানতে হইবো? পরের বার ঠিক পাশ দিবা, আমি দোয়া কইরা দিলাম। চোক্ষের পানি মুছো তো আম্মাজান, এতো সুন্দর ফুটফুটে মাইয়্যার চোক্ষে কান্দন মানায় না।”
হাসবে না হাসবে না করেও প্রিয়তা হেসে দেয়। সবকিছু আবারও রঙিন লাগতে শুরু করেছে তার। জীবন সুন্দর, অসম্ভব সুন্দর।
(চলবে……)