#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ১৭
রুনা প্রিয়তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,”তুই চিনিস উনাকে?”
প্রিয়তা এখনো ঘোর থেকে বের হতে পারছে না। তার পুরো শরীর কাঁপছে। আচ্ছা সে কি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে? মাঝ রাস্তায় এভাবে পড়ে গেলে তো ভারী কেলেংকারী হবে। উচ্ছ্বাস কি তাকে ধরবে পড়ে যাওয়ার আগে?
উচ্ছ্বাস ভারী পুরুষালী গলায় বললো,”কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ফুলটা নিবে না?”
প্রিয়তা মৃদুস্বরে বললো,”ফুলটা আপনি আমার জন্য এনেছেন?”
উচ্ছ্বাস এদিক ওদিক তাকায়।
এরপর রুনার দিকে তাকিয়ে বললো,”আজ কি আপনার জন্মদিন?”
রুনা যন্ত্রের মতো না-সূচক মাথা নাড়ে।
“এখানে তো আপনারা দুইজন ছাড়া আর কাউকে দেখছি না আশেপাশে। যদি আপনার জন্মদিন না হয় ফুলটা নিশ্চয়ই আজ যার জন্মদিন তার জন্য।”
রুনা শব্দ করে হেসে দেয়। প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে ফুলটা নেয়।
ছোট্ট করে বললো,”ধন্যবাদ আপনাকে।”
উচ্ছ্বাস দুই হাত পিছনে বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে, যা কিছু হয়ে যাক এই মায়াবতীকে সে ছাড়তে পারবে না। জীবন একটাই, হোক না কিছু ভুল, ক্ষতি কি?
প্রিয়তা লাজুক চোখে একবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। তার মনে হচ্ছে এটা কোনো স্বপ্ন, তার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন। যদি স্বপ্নও হয়, এই ঘুম যেনো আর না ভাঙে। এভাবেই যেনো জীবনটা কেটে যায়।
রুনা অবাক হয়ে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। কলেজের ডাকসাইটে সুন্দরী সে। লোকে আড়ালে আগুন সুন্দরী বলে তাকে। অথচ এই মানুষটা পাশে এমন এক সুন্দরীকে রেখে, এক শ্যামবর্ণা মেয়ের দিকে অপার মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। না, সেই দৃষ্টিতে কোনো লোভ নেই, কোনো কামুকতা নেই, নেই কোনো অশোভন চাহনী। শুধু এক গভীর মায়া ডুবে আছে চোখেমুখে। কে এই ছেলেটা? কি পরিচয় তার? প্রিয়তার সাথে কি সম্পর্ক হতে পারে?
কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে যায়। রুনাই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে।
হালকা কেশে মুখ টিপে হাসে সে। প্রিয়তার কাছে এসে আস্তে আস্তে বললো,”আজ চললাম সখী, কাল তোমার খবর আছে। কলেজে আসো একবার। ডুবে ডুবে জল খাওয়া বের করবো তোমার।”
প্রিয়তা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
“এখনই চলে যাবি? আরেকটু থাক। আমার কেমন ভয় করছে।”
“ইশ ঢং দেখো মেয়ের। আর একটুও থাকবো না। তোমার প্রেমিকের যে রাগী চেহারা। আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় মেরেই বসবে আমাকে।”
প্রিয়তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুনা হাসতে হাসতে চলে যায়।
প্রিয়তা স্তব্ধ হয়ে যায়। কানে বার বার বাজতে থাকে ‘তোমার প্রেমিক, তোমার প্রেমিক।’ সত্যিই কি এতোটা সুখ আছে তার কপালে?
“চলো কিছুক্ষণ হাঁটি?”
প্রিয়তা চমকে ওঠে আবার। ইশ, আজকের বিকেলটা এতো সুন্দর কেনো? সবকিছু এতো রঙিন লাগছে কেনো আজ? কলেজ গেটে দাঁড়ানো ঝালমুড়িওয়ালা, রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো রঙবেরঙের বেলুন বিক্রি করা ছোট্ট ছেলেটা কিংবা ঘাসের উপর উড়ে বেড়ানো সবুজ ঘাসফড়িং সবকিছু সুন্দর লাগছে, সবকিছু দারুণ লাগছে। প্রিয়তার দুই চোখে জল ভরে যায়।
“যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে।”
প্রিয়তা গাঢ় গলায় বললো,”চলুন।”
পাশাপাশি হাঁটছে উচ্ছ্বাস-প্রিয়তা। মাঝে মাঝে উচ্ছ্বাসকে আড়চোখে দেখছে সে। নিজেকে একটা রঙিন প্রজাপতি মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে ছোট্ট দু’টো ডানা হলেই উড়ে বেড়াতো ঘাসের উপর, ফুলের উপর। কি ভীষণ শান্তি, আর কি চাই জীবনে?
“তুমি শাড়ি পরলে শাড়িটিকে বেশ মানায়। তুমি টিপ পরলে টিপের মন ভালো হয়ে যায়। নন্দিনী, তুমি পাশে থাকলে জীবন সুন্দর হয়ে যায়।”
উচ্ছ্বাসের ঘোর লাগা কণ্ঠ শুনে হকচকিয়ে যায় প্রিয়তা। এই কথাগুলো কি তাকে বললো? কি হয়েছে এই মানুষটার আজ?
উচ্ছ্বাস সুন্দর করে হাসে।
“বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে বন্ধুদের সাথে রাত জাগতাম প্রায়ই। ওরা জোর করতো দুই লাইন কবিতা বলতে। তখন লিখেছিলাম ছোট্ট কবিতাটি।”
প্রিয়তার বুকের মধ্যে কেমন ব্যথা করে ওঠে। কিছু সময়ের জন্য প্রিয়তার মনে হয়েছিলো লাইন দু’টো বুঝি তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে।
“এতো সুন্দর কবিতা তো এমনিতেই মাথায় আসার কথা না। নিশ্চয়ই কোনো নন্দিনীকে কল্পনা করে লিখেছেন।”
উচ্ছ্বাস উদাস গলায় বললো,”যদি তাই হয় তবে কি আমার পাপ হবে? সেই পাপে কি হবে জেল? আদালত, ফাঁ সি দিবে?”
প্রিয়তা ঝট করে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। তার মানে কি উচ্ছ্বাসের জীবনে আগেও কোনো মেয়ে এসেছে?
প্রিয়তার ছলছল চোখ দেখে শব্দ করে হেসে দেয় উচ্ছ্বাস। প্রিয়তা হতবাক হয়ে দেখে সেই হাসি। একটা পুরুষ মানুষ এতো সুন্দর করে কেনো হাসবে? কেনো?
সন্ধ্যা মিলিয়েছে কিছু সময় আগে। এখনো পশ্চিম আকাশ রক্তিম হয়ে আছে। এই সামান্য আলোতে উচ্ছ্বাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীকে অসামান্য লাগে।
“জানো প্রিয়তা, আমার মা অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। আমার ছোট ছোট সৃজনশীলতার হাতে খড়ি আমার মায়ের হাত ধরেই। আমি যখন গান করতাম মা মায়াভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে। আসলেই মানুষটার কথা শুনে ভীষণ কষ্ট হয় তার। মা ছাড়া দুনিয়া বড্ড নিষ্ঠুর।
“মা একটা কথা বলতো, সন্ধ্যা মিলানোর এই সময়ের আলোকে বলে কন্যাসুন্দর আলো। এই আলোতে সাধারণ মেয়েকেও অসাধারণ লাগে। গোধূলির আলো ললনাদের সৌন্দর্য নাকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আবার গ্রামের দিকে এই আলোকে পাত্রপক্ষ ঠকানো আলোও বলে।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”পাত্রপক্ষ ঠকানো আলো মানে?”
“মানে গ্রামের দিকে কোনো মেয়ে কালো হলে নাকি পাত্রপক্ষকে এই সময়ে মেয়ে দেখানো হতো। এতে মেয়ের সৌন্দর্য বেড়ে যেতো। পাত্রের পছন্দ হয়ে যেতো মুহুর্তেই।”
উচ্ছ্বাসের কথা শুনে প্রিয়তা চোখ বড় বড় করে তাকায়। এরপর খিলখিল করে হেসে দেয়। নীড়ে কিছু পাখি ফিরছিলো তখনই। তাদের গুঞ্জনের সাথে প্রিয়তার অসম্ভব মিষ্টি হাসি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
উচ্ছ্বাস সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে বললো,”নন্দিনীর হাসির পানে বার বার চাহনী দেওয়া কি অপরাধ? যদি অপরাধ হয় তবে সেই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি আমার হোক, বারবার হোক।”
হাসি থামিয়ে প্রিয়তা তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। আজকের এই সন্ধ্যাটাকে অসহ্য সুন্দর লাগছে তার। নিজেই নিজেকে হিংসা করছে। এই মানুষটা এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে? হঠাৎ কেনো-ই বা বলছে আজ?
হাঁটতে হাঁটতে উচ্ছ্বাস হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে।
“এ কি দাঁড়িয়ে পড়লেন যে?”
“তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার আছে প্রিয়তা।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললো,”আজকের এই সন্ধ্যাটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার। আমার আর কোনো উপহার চাইনা।”
ঠোঁট কামড়ে হাসে উচ্ছ্বাস। আচমকাই লজ্জা পেয়ে যায় প্রিয়তা। কি বলে ফেললো সে? এখন তাকাবে কীভাবে সে মানুষটার চোখের দিকে? কি লজ্জা! কি লজ্জা!
পকেট থেকে উচ্ছ্বাস কাগজে মোড়ানো একটা উপহার বের করে প্রিয়তার হাতে দেয়।
“কাচের চুড়ি খুব পছন্দ আমার। আমার মা খুব ভালোবাসতো কাচের চুড়ি পরতে। প্রায়ই মা আর আমি টিএসসিতে ঘুরতে যেতাম। মা কে হাতভর্তি কাচের চুড়ি কিনে দিতাম। আজ অনেকদিন পর চুড়ি কিনলাম। তোমার হাতে সুন্দর লাগবে।”
প্রিয়তা হাত বাড়িতে চুড়িগুলো নেয়। কাগজটা খুলতেই দেখে একমুঠ নীল কাচের চুড়ি। সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট।
প্রিয়তা সাথে সাথেই চুড়িগুলো হাতে পরে নেয়। রিনিঝিনি শব্দ করে ওঠে সেগুলো।
প্রিয়তার চোখ ভর্তি পানি। যে কোনো সময় টুপ করে নিচে পড়বে।
এক ফোঁটা পানি পড়তেই উচ্ছ্বাস এক আঙ্গুল বাড়িতে ধরে।
“হীরার টুকরোগুলো অনেক মূল্যবান প্রিয়তা, এভাবে নষ্ট করোনা।”
প্রিয়তা কিছুই বলতে পারেনা। এখন কিছু বললেই সে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে।
“বাড়ি ফিরে যাও।”
“আপনি যাবেন না?”
“ওটা যে আমার নিজের বাড়ি নয়। কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই। তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছে।”
উচ্ছ্বাসের কথা শুনে খটকা লাগে প্রিয়তার। হঠাৎ এমন বলছে কেনো উনি?
উচ্ছ্বাস সুন্দর করে হেসে বললো,”তুমি যাও, আমি আসবো।”
প্রিয়তা অসহিষ্ণু কিছু বলতে যেয়ে থেমে যায়। তার মনে হচ্ছে এখন উচ্ছ্বাসকে যেতে দিলে আর কোনোদিন তার দেখা পাবে না। চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবে। এমন মনে হচ্ছে কেনো তার?
“কি হলো যাও?”
প্রিয়তা আকুল হয়ে বললো,”আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য।”
উচ্ছ্বাস কিছু বলেনা, নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার দিকে।
যেতে যেতে প্রিয়তা আবার পিছনে তাকায়। এখনো বটবৃক্ষের মতো মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে বুকে দুই হাত বেঁধে। প্রিয়তা বাড়িতে না ঢোকা পর্যন্ত সে মনে হয় যাবেনা। প্রিয়তার ইচ্ছা করে ছুটে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে। কোনো এক অদম্য নেশা তাকে চেপে ধরে। এমন লাগছে কেনো তার? সে তো বলেছে সে ফিরে আসবে। তবুও কেনো বার বার মনে হচ্ছে সব পেয়েও হারিয়ে ফেলবে?
অন্ধকার নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। তবুও উচ্ছ্বাস দূর থেকে বুঝতে পারছে মেয়েটা কাঁদছে। তার চোখের পানিগুলো মুক্তোর মতো গড়িয়ে পড়ছে দুই গাল বেয়ে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাস পা বাড়ায় অজানার দিকে।
‘কাঁদো প্রিয়তা, মন ভরে কাঁদো। শেষবারের মতো কেঁদে নাও। আর কাঁদতে দিবো না তোমাকে।’
(চলবে…..)