তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-১৫+১৬

0
6

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১৫

“কোথায় গিয়েছিলি তুই প্রিয়তা?”
প্রিয়তার সামনে দুই জোড়া তীক্ষ্ণ চোখ। সে অসহায়বোধ করে। এদিকওদিক তাকিয়ে বাবাকে খোঁজে। কিন্তু কোথাও বাবাকে দেখতে পাচ্ছে না। আসলেই বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে। নিজেই বুঝতে পারেনি এতোটা দেরি কীভাবে করে ফেললো সে। বেশ আগে থেকেই অদ্ভুত একটা দোষ আছে তার। খুব মন খারাপ হলে নদীর পাড়ে চলে যায়। নদীর বিশালতার মাঝে নিজের কষ্টটুকু, মন খারাপ টুকু বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কখনোই এভাবে রাত করেনা। আজ কলেজ ছুটির পর ভীষণভাবে বিষাদ দখল করে নিয়েছিলো তার মনটা। কিছুই ভালো লাগছিলো না। আগপাছ কিছু না ভেবেই ছুটে গিয়েছিলো নদীর পাড়ে। কিন্তু কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে সে টেরও পায়নি। এখন বুঝতে পারছে কতোটা বড় ভুল করে ফেলেছে সে। পেখমটাকেও আশেপাশে দেখতে পাচ্ছে না। আর ওই রাগী লোকটা তাকে বাড়িতে ফেলেই কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেলো।
মার্জিয়া বেগম ধীর পায়ে এগিয়ে আসে প্রিয়তার দিকে। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,”তোর সারা শরীরে কাদামাটি কেনো? কোথায় ছিলি এতোক্ষণ তুই?”
মর্জিনা বেগম চিৎকার করে উঠে বললো,”এভাবে জিজ্ঞেস করলে ও কিচ্ছু বলবে না। চড় কষিয়ে দে দুই গালে দুইটা। কলেজে উঠে ডানা মেলেছে। ডানা ছেঁটে দিবো এবার।”
প্রিয়তা ঈষৎ কেঁপে খালার দিকে তাকায়।
মার্জিয়া বেগম হাত উঁচু করে আপাকে থামায়।
“আপা চিৎকার করোনা, আমি কথা বলছি।”
মার্জিয়া বেগমের চিৎকার চেচামেচিতেই অভ্যস্ত মেয়েরা। তার এমন শান্ত দৃষ্টিই ভিতরটা নাড়া দিয়ে দিচ্ছে প্রিয়তার।
প্রিয়তার গায়ের কাদা শুকিয়ে গেছে কিছু। মার্জিয়া বেগম হাত দিয়ে ঝেঁড়ে দেয় সেগুলো।
“কি হলো উত্তর দাও। শরীরে এতো কাদা লাগলো কীভাবে?”
প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয়,”মা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।”
“ঘড়িতে এখন সময় প্রায় সাড়ে আটটা। তোমার কলেজ ছুটি হয় বিকাল চারটায়। আমার জানামতে আজ বাড়তি ক্লাসও ছিলো না। এই চার ঘণ্টা কোথায় ছিলে তুমি?”
প্রিয়তা কিছু বলার আগেই মার্জিয়া বেগম আবার থামায় তাকে।
“দয়া করে বলবে না তুমি কোনো বান্ধবীর বাড়িতে ছিলে। আমি তোমার সব বান্ধবীর বাড়িতে খোঁজ নিয়েছি। সাহস থাকলে সত্যটা বলো।”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে দাঁড়ায়। নিজেরই নিজেকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করছে। কীভাবে পারলো সে এতো বড় ভুল করতে? সে কি ভুলে গেছে, মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের ছোট একটা ভুলই পাপ হয়ে ধরা দিতে পারে?
“তুমি কোথায় এমন ছিলে যে উচ্ছ্বাস এতো দ্রুত তোমাকে খুঁজে পেলো? সে কি জানতো তুমি কোথায় থাকতে পারো?”
প্রিয়তা ফ্যাকাশে মুখে তাকায় মায়ের দিকে।
“মা তুমি আমার কথাটা শোনো…..”
প্রিয়তা কথা শেষ করার আগেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে মর্জিনা বেগম।
“ও আর কি বলবে? বলার মতো মুখ আছে ওর? বাপ মায়ের মুখে চুনকালি মিশিয়েই শান্ত হবে ও। বিয়ে দিয়ে আপদ বিদেয় কর।”
প্রিয়তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে এবার। শান্ত মেয়েটা ফুঁসে ওঠে হঠাৎ।
“খালা দয়া করে একটু চুপ করবেন আপনি? আমার পুরো কথাটা না শুনে তখন থেকে এতোগুলো কথা বলে যাচ্ছেন আপনি। আপনার সমস্যাটা কি?”
প্রিয়তা কথা শেষ করতে না করতেই একটা বলিষ্ঠ হাতের চড় এসে পড়ে তার মুখে। মুহুর্তের মধ্যে তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায় সে। হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই তার বিস্ময় বাঁধ ভাঙে।

“বাবা….”
“এক্ষুনি ক্ষমা চাও তোমার খালার কাছে।”
“বাবা তুমি আমাকে মারলে?”
“ক্ষমা চাইতে বলেছি তোমাকে।”
কবির শাহের অগ্নিমূর্তির সামনে হতবাক মার্জিয়া বেগমও। যে বাবা কখনো মেয়েদের শরীরে ফুলের টোকা ফেলতে দেয়নি, উঁচু গলায় ধমক পর্যন্ত দেয়নি সে কিনা আজ মেয়ের গায়ে হাত তুললো? বোঝাই যাচ্ছে কতোটা রাগ পুষে রেখেছে সে ভিতরে।
প্রিয়তা তখনও গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। সে কি এতো বড় শাস্তি পাওয়ার মতো ভুল করেছে?
“এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাদের আমি? নিজে অন্যায় করেছো, তার উপর বড়দের সাথে এভাবে কথা বলছো। যে কারণে আমি আজীবন গর্ব করেছি, আমার মেয়েদের আমি আমার আদর্শে বড় করেছি। আজ সেই তুমি কিনা আমার মাথাটা এভাবে নিচু করে দিলে?”
কবির শাহের কথা শেষ হওয়ার পরেও ঘর গমগম করতে থাকে। সারা ঘরে পিনপতন নীরবতা।

মর্জিনা বেগম মুখ টিপে হেসে মনে মনে বললো,’বেশ হয়েছে। খুব গর্ব মেয়েদের নিয়ে তাইনা? আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তোলার ফল এবার বুঝবে কবির।’

প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়ায়। এখনো তার দৃষ্টি বাবার দিকে নিবদ্ধ। সমস্ত বিস্ময় যেনো অতিক্রম করে ফেলেছে সে।
মর্জিনা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে। এরপর ভাঙা গলায় বিড়বিড় করে বললো,”খালা আমাকে ক্ষমা করে দিন, আর হবে না এমন।”
ঠোঁট উলটে মর্জিনা বেগম বললো,”হ্যা সেই আর কি। তোদের তো আবার অন্যরকম ব্যাপার। তোর বাবা তোদের পড়াশোনা করিয়ে জজ ব্যারিস্টার বানাবে, সেই সাথে বেয়াদব বানাবে। আমাদের মেয়েকে আমরা এতো পড়ালেখাও করাইনি, এতো অসভ্যও বানাইনি।”
কবির শাহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললো,”ও তো ক্ষমা চেয়েছে। তারপরও এতো কথা বলছেন কেনো? প্রিয়তা, তুমি তোমার ঘরে যাও। পরে তোমার সাথে কথা বলবো আমি।”
ফ্যালফ্যাল করে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তা। চোখের পানির বাঁধ মানছে না। নিজের সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার এমন নতুন রূপ পৃথিবীর কেউ সহ্য করতে পারেনা।
“কি হলো? তোমাকে যেতে বললাম না? ঘরে যেয়ে কাপড় পালটে নাও। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা বসে যাবে।”
প্রিয়তা আস্তে করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে ঘরে চলে যায়।

প্রিয়তা যেতেই কবির শাহ চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসে পড়ে। শুধুমাত্র সে জানে এতোক্ষণ তার মনের উপর দিয়ে, শরীরের উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গেছে। উন্মাদের মতো ছুটে বেরিয়েছে সে। একটা সময়ে মনে হচ্ছিলো, মেয়েকে এই মুহুর্তে খুঁজে না পেলে এক্ষুনি হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়ে যে তার শরীরেরই অংশ। এটা কীভাবে বোঝাবে সে?

“কবির বলছিলাম কি….”
কবির শাহ নির্লিপ্ত চোখে মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা আপনার গাড়ির ড্রাইভার আপনাকে খুঁজছিলো। রাত তো অনেক হলো।”
অপমানে মর্জিনা বেগমের মুখ কালো হয়ে ওঠে। তাহলে কি কবির তাকে চলে যেতে বলছে পরোক্ষভাবে? বিয়ের কথাটা তো তুলতেই পারলো না সেভাবে।

কোনো কথা না বলে মর্জিনা বেগম হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কবির শাহ মাথায় হাত চেপে হেলান দেয় চেয়ারে।

মার্জিয়া বেগম নি:শব্দে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ায়।
“মার্জিয়া।”
“বলো।”
“আমি বাবা হিসেবে কি ব্যর্থ হলাম? আসলেই কি তোমরা যা বলতে তাই সঠিক? আমি ওদের কখনো শাসন করিনি, ওদের মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে দিয়েছি খোলা আকাশে। এটাই কি আমার ভুল ছিলো? আমি শিক্ষক, সুশিক্ষিত মানুষ তৈরির কারিগর আমি। এই হাত দিয়ে কতোশত ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দিয়েছি, মানুষের মতো মানুষ করেছি। সেই আমি কিনা নিজের সন্তান মানুষ করতে ব্যর্থ হলাম?”
মার্জিয়া বেগম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”তুমি এমন করছো কেনো? মেয়ে একটা ভুল করে ফেলেছে। হয়তো সত্যিই কোনো বিপদে পড়েছিলো। পুরোটা না শুনে….”
মার্জিয়া বেগমকে থামিয়ে দেয় কবির শাহ। মেয়ে কোনো বিপদে পড়েনি, সে যে একটা কান্ডজ্ঞানহীন কাজ করেছে এটা সে খবর পেয়েছে। সেই সাথে আরো অনেক কিছু জেনেছে।
“আমাকে এক কাপ চা করে দিবে মার্জিয়া? মাথাটা আর চাপ নিতে পারছে না।”
স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মার্জিয়া বেগম চলে যায়।

রাত বাড়তে না বাড়তেই পুরো শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে উচ্ছ্বাসের। ক্ষণে ক্ষণেই কাঁপছে সে জ্বরের দাপটে। কোনো কিছুরই খেয়াল নেই। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। উঠে যেয়ে পানি খাওয়ার মতো শক্তি তার নেই।

খাবার টেবিলে মাথা নিচু করে বসে খাবার নাড়াচাড়া করছে কবির শাহ। টেবিলটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। প্রিয়তা বা উচ্ছ্বাস কেউ নেই টেবিলে। পেখম শুধু এক কোণায় বসে চুপচাপ খাচ্ছে।
“তুমি খাবার নিয়ে কোথায় যাচ্ছো মার্জিয়া?”
“মেয়েটা ভয়ে এখানে আসতে পারছে না। সারারাত কি না খেয়ে থাকবে?”
“খাবার রেখে দাও। ওকে বলো এখানে এসে খেতে।”
পেখম আস্তে আস্তে বললো,”বাবা আপা বলেছে সে আসবে না।”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”তাহলে ওর খাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
মার্জিয়া বেগম ভীষণ অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকায়। কি এমন জেনেছে সে? যে মেয়ে বলতে সে পাগল, মেয়েকে না খাইয়ে নিজে কখনো খায়না সে কিনা আজ এতো বড় কথা বলতে পারলো?

কিছুক্ষণ খাবার নাড়াচাড়া করে পাতেই হাত ধুয়ে উঠে পড়লো কবির শাহ।
মার্জিয়া বেগম কিছু বললো না। মেয়ের জন্য বাবার মনের অবস্থা ভালো করেই বুঝতে পারছে সে।

বালিশে মুখ গুঁজে ফোঁপাচ্ছে প্রিয়তা। কোনোদিন ভাবতে পারেনি তার বাবা তার সাথে এমন আচরণ করবে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে তার। কান্নার শক্তিও অবশিষ্ট নেই শরীরে আর।
“আপা কাঁদিস না। বাবা রেগে যেয়ে এমনটা করে ফেলেছে। রাগ কমলেই বাবা ঠিক নিজের ভুল বুঝতে পারবে তুই দেখিস। তখন নিজে তোর কাছে আসবে।”
প্রিয়তা লাল চোখে পেখমের দিকে তাকায়।
“আমি ভুল করেছি, বাবা একবার কেনো দশবার চড় দিক আমাকে। আমার কোনো আফসোস নেই। বাবা আমার পুরো কথাটা না শুনে খালার কাছে ক্ষমা চাইতে বললো, তারপর থেকে আমার মুখটাও দেখলো না। কষ্টটা তো এজন্যই পাচ্ছি আমি।”
পেখম মাথা নিচু করে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাইও তখন থেকে ঘরের দরজা আটকে রয়েছে। বাবা উনার খোঁজও করেনি একবারও।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”বাবা কি কিছু সন্দেহ করলো? কিন্তু বিশ্বাস কর, সবাই যা ভাবছে তা সত্যি না। আমাকে কিছু বলার সুযোগটা কেনো কেউ দিচ্ছে না?”
“আপা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বাবার সাথে কথা বল তুই। বড় খালা আজ আরেকটা সুযোগ পেয়ে গেলো। যদি সত্যি এবার তোর বিয়েটা দিয়ে দেয়?”
বালিশে হেলান দিয়ে আবারও শব্দ করে কেঁদে দেয় সে। সামান্য ভুল থেকে কতো বড় বিপদ আসতে চলেছে তার। এতোদিন বাবা ছিলো তার পাশে। শত বিপর্যয়ের মধ্যেও বাবা পাশে থাকলে কোনো ভয় থাকে না। আজ বাবাও তাকে ভুল বুঝলো। কি হবে এখন?

ভোরবেলা দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে মার্জিয়া বেগম কিছুটা বিরক্ত হয়। মানুষটা নিশ্চয়ই আজও হাঁটতে যাওয়ার সময় কিছু একটা ফেলে গেছে। কবির শাহ রোজ সকালে হাঁটতে যায়। ঠিক তার দুই মিনিট পরই আবার ফিরে এসে বলে কিছু একটা ফেলে গেছে।
রাগে গজগজ করতে করতে দরজা খুলতেই কিছুটা থমকে যায় মার্জিয়া বেগম। কথা সরে না মুখ দিয়ে।
“খালাম্মা ভালো আছেন?”
মার্জিয়া বেগম মিনমিন করে বললো,”বাবা তুমি এখানে?”
নিয়াজ মোর্শেদ এক গাল হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করে মার্জিয়া বেগমকে।
ইতস্তত করতে থাকে মার্জিয়া বেগম।
“এই তোরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ঝুড়িগুলো বাড়ির ভিতরে নিয়ে আয়।”
দুইটা ছেলে বড় বড় দুইটা ঝুড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। বাঁধা দেওয়ার অবকাশটুকুও পায়না মার্জিয়া বেগম।
“এসব কি হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এগুলো কি?”
“সব বলছি খালাম্মা। আগে যদি একটু পানি খাওয়াতেন।”
কথা বলতে বলতেই নিয়াজ ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে। এমনভাবে সে চলাফেরা করছে যেনো সে এ বাড়িরই লোক।

গ্লাসের পুরো পানিটা শেষ করে নিয়াজ আবারও হাসে।
“খালুজানকে দেখতে পাচ্ছি না, উনি কোথায়?”
“উনি সকালে হাঁটতে যান। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছি না আমি। একটু পরিষ্কার করে বলবে? আর সাথে এগুলো কি এনেছো?”
“কেনো খালাম্মা? মর্জিনা খালা যে আমাকে বললেন এ বাড়িতে আসার কথা। তাই তো আর দেরি করলাম না। সকাল সকাল চলে আসলাম। আর খালি হাতে কীভাবে আসি বলুন তো? তাই আপনাদের জন্য সামান্য উপহার নিয়ে এলাম।”
মার্জিয়া বেগম বুঝতে পারে এতোক্ষণে, এসব তার আপার কাজ। তার আপা পাঠিয়েছে নিয়াজকে। হয়তো ভেঙে যাওয়া সম্বন্ধটা আবার জোড়া লাগাতে চাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে মার্জিয়া বেগম দরজার দিকে তাকায়। মেয়েদের বাবা চলে এলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে।
“উপহারের কি দরকার ছিলো বাবা?”
“তেমন কিছুই না খালাম্মা। আগের দিন খালুজানকে দেখলাম বাজারে একটা ছোট মাছ কেনার জন্য দোকানদারের সাথে দরদাম করছে। তাই ভাবলাম ছোট একটা মাছ উপহার দিই উনাকে। সামান্যই কিছু জিনিস।”
ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে মুখ হা হয়ে যায় মার্জিয়া বেগমের। এটা নাকি ছোট মাছ! বিশাল আকারের মাছ, সাথে আরো অনেক বাজার এনে হাজির ছেলেটা। এই সামান্য বাজারই তাদের সারা মাসের বাজার।
মার্জিয়া বেগম রাগ হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পারেনা। অদ্ভুত একটা ভালো লাগা মন ছেয়ে যায় তার। নিশ্চয়ই আসার সময় এলাকার মানুষ সবাই দেখেছে নিয়াজকে। খুব কি ক্ষতি হবে ছেলেটার সাথে প্রিয়তার বিয়ে হলে? বয়সটা যা একটু বেশি, তাতে কি? পুরুষ মানুষের বয়স দিয়ে কি হবে? সারাজীবন সে যা কষ্ট করে এসেছে, মেয়েরাও তাই করবে নাকি? মধ্যবিত্ত মায়েদের মাঝে মাঝে সন্তানের সুখের জন্য লোভী হতে হয়। তার হতে দোষ কি?

মার্জিয়া বেগম মুখে হাসি টেনে বললো,”তুমি নাশতা করবে তো?”
“সে আপনি যদি আদেশ করেন, তবে তো করতেই হবে।”
“বেশ বেশ। তুমি একটু বিশ্রাম করো। তোমার খালুজান এলে আজ একসাথে নাশতা করেই যাবে।”
মার্জিয়া বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। ঘরে যা আছে তাই দিয়ে ভালো কিছু নাশতা বানাতে হবে। অস্থির অস্থির লাগে তার।

ঘরের চারপাশ ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে দেখে নিয়াজ। নিতান্তই মধ্যবিত্তের ছোঁয়া বাড়ির প্রতিটা কোণায়। ঠোঁটে অবজ্ঞার হাসি ফুটে ওঠে তার। সে দিব্বি বুঝতে পারছে কোথায় হাত করতে হবে। মেয়ের মা কিঞ্চিৎ লোভী আছে। এখানেই কলকব্জা নাড়তে হবে। এমন মায়ের মেয়েকে হাতের পুতুল বানানো সহজ।

হঠাৎ করেই ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে উচ্ছ্বাসের। শরীরটা বেশ হালকা হালকা লাগছে এখন। জ্বর নেমে গেলেও শীত শীত ভাবটা শরীর থেকে যাচ্ছে না। কালো একটা ভারী চাদর গায়ের উপর চাপিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। ঠোঁটের কোণায় সিগারেট ঝোলায়। এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
বসার ঘরে বসে থাকা নিপাট ভদ্রলোকের সামনে নিজেকে ভীষণ এলোমেলো লাগে তার। পিছন থেকে বোঝা যাচ্ছে না কে। এতো সকালে কে বা আসবে?

নিয়াজ মোর্শেদকে দেখে ভিতর ভিতর চমকে যায় সে। এতো সকালে এই লোক এখানে কি করে?
নিয়াজও অবাক হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। এমন সুদর্শন যুবক খুব কমই দেখেছে সে। এলোমেলো রুক্ষ চুল, নির্ঘুম লাল চোখ, খোঁচা খোঁচা দাড়িতেও যে কোনো পুরুষকে এতো সুন্দর লাগতে পারে তা ধারণা ছিলো না। গ্রীক পুরাণে দেবতাদের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, ঠিক তেমন। কিন্তু কথা হলো, যুবকটা কে? তার জানামতে কবির শাহের কোনো ছেলে নেই।
নিয়াজ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
উচ্ছ্বাস সেই হাতের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
কিছুটা অপমানিত বোধ করে নিয়াজ।
তবুও মুখে জোর করে হাসি টেনে ধরে নিয়াজ।
“শুভ সকাল। আমার নাম….”
উচ্ছ্বাস হাত উঁচু করে তাকে থামায়।
“আপনার পরিচয় আমি জানি। কিন্তু আপনি এখানে কেনো এসেছেন?”
মুখটা অন্ধকার হয়ে যায় নিয়াজের।
“ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা।”
উচ্ছ্বাস ঠোঁট থেকে সিগারেটটা নামিয়ে শান্ত গলায় বললো,”যতোদূর জানি আপনি এ বাড়ির মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর মেয়ের বাবা নিজেই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলো। পুনরায় আপনি এখানে কি চান?”
অপমানে নিয়াজের মুখ কালো হয়ে যায়। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে সে কপালের। সরু চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। শান্ত লোকটাকে দেখে কেমন ভয় ভয় করছে নিয়াজের। শান্ত দেখালেও ভিতর ভিতর সিংহের মতো তেজ লোকটার সে বুঝতে পারে।
জিজ্ঞাসু চোখে উচ্ছ্বাস তাকায় নিয়াজের দিকে।
“আসলে আপনি ভুল বুঝছেন। এদিক থেকেই যাচ্ছিলাম আমি। যেহেতু এদিকে পরিচিত একটা বাড়ি আছে, তাই ভাবলাম ঘুরে যাই। আচ্ছা আমি নাহয় আরেকদিন আসবো আজ যাই।”
নিয়াজ কোনো এক অদ্ভুত কারণে সামনের মানুষটাকে ভয় পাচ্ছে। সে নিজেও জানেনা কেনো। তার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার তো করেনি।

নিয়াজ দরজার দিকে পা বাড়াতেই উচ্ছ্বাসের চোখে পড়ে সামনে রাখা দুইটা ঝুড়ির দিকে। ঝুড়িভর্তি বিভিন্ন বাজার।
“একটু দাঁড়ান।”
নিয়াজ যন্ত্রের মতো থেমে যায়।
“এগুলো কি আপনি এনেছেন?”
“জ্বি।”
“কেনো? আপনি কি যে বাড়িতেই মেয়ে দেখতে যান বিয়ে হোক বা না হোক সে বাড়িতেই বাজার নিয়ে যান?”
নিয়াজ উচ্ছ্বাস কৌতুক করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু তার মুখে কোনো কৌতুকের চিহ্ন নেই। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিয়াজের দিকে।
“এভাবে ভাববেন না। আসলে সেদিন খালুজানকে ছোট মাছ কিনতে দেখলাম দোকানে, আর তাই…..”
“আর তাই আপনার মনে হলো আপনার খালুজানের বাড়িতে মাছ কিনে দেওয়া আপনার নৈতিক দায়িত্ব? আরেহ বাহ! আমিও এমন খালুজান হতে চাই। বাজারে যেয়ে ছোট মাছ কিনবো, পরদিন বাড়িতে বড় মাছ চলে আসবে। বলছি, এমন খালুজান হতে কি করা লাগবে?”
নিয়াজ অবাক হয়ে দেখে চোখমুখ কঠিন রেখে একটা মানুষ কীভাবে এমন রসালো কথা বলতে পারে? সে কি আসলেই মজা করছে?
“আমি এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি, এক্ষুনি।”
“জ্বি, দুইটা ঝুড়ি নিজে মাথায় করে নিয়ে যাবেন। আপনার ভাগ্য ভালো আপনার সেই খালুজান এখন বাড়িতে নেই। উনি যদি দেখতেন তবে আপনার খবর ছিলো।”
নিয়াজ প্রমাদ গোণে। এই ছেলেটা আবার কে? বাপ রে, ছেলে তো নয় যেনো সাক্ষাৎ আগুন। সাধারণ কথার মধ্যে এতো তেজ থাকতে পারে এই ছেলেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।
কোনোরকমে ঝুড়িগুলো টানতে টানতে নিয়াজ বাইরে নিয়ে যায়।
উচ্ছ্বাস বুকে দুই হাত বেঁধে শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

নিয়াজ চলে যাওয়ার দুই মিনিট পর হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া যায়।
উচ্ছ্বাস সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বিরক্ত মুখে দরজা খুলতেই ভ্রু কুঁচকে যায় তার।

দরজায় অতি সজ্জিত এক রমনী দাঁড়িয়ে আছে মুখ হা করে। উচ্ছ্বাস ভালো করে দেখে চেনার চেষ্টা করে আগেও এই মেয়েকে এ বাড়ি দেখেছে কিনা। কিন্তু প্রসাধনীর পরতে চেনাই মুশকিল। উচ্ছ্বাস মুখ কুঁচকে ভাবে, এই মেয়ে আবার কে? এতো সকালে এভাবে সঙ সাজে কে?
এদিকে মেয়েটা হা করে উচ্ছ্বাসকে দেখেই চলেছে। পলকও পড়ছে না চোখের। সামনের মানুষটা এতো সুন্দর কেনো এটাই বুঝতে পারছে না সে। মাথা খারাপ লাগে তার।
“মুখটা বন্ধ করুন দয়া করে। এতো বড় হা করেছেন যে মুখের ভিতরের আলজিহ্বা দেখা যাচ্ছে। খুবই বিশ্রী লাগছে দেখতে।”
মেয়েটা সাথে সাথে মুখ বন্ধ করে। কিছুটা অপ্রস্তুতও হয়ে যায়। ইশ, কি ভীষণ সুন্দর করে কথা বলে লোকটা। একদম পুরুষালী গম্ভীর গলার আওয়াজ।
“কাকে চাই আপনার? মনে তো হচ্ছে ভুল ঠিকানায় এসেছেন। এখানে কারো বিয়ে হচ্ছে না।”
মেয়েটা অবাক হয়ে বললো,”কার বিয়ে হবে?”
উচ্ছ্বাস বিরস মুখে সিগারেটটা ফেলে দেয়।
“আপনার যে সাজসজ্জা, দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিয়েবাড়ি এসেছেন।”
নিয়াজের মতো একই সমস্যায় পড়ে মেয়েটা। এমন গম্ভীর মুখে কীভাবে এভাবে কথা বলছে? সে কি মজা করছে?
“বলছিলাম প্রিয়তা আছে? একসাথে কলেজে যেতাম আর কি।”
উচ্ছ্বাস ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়িতে সময় প্রায় সাতটা, আর প্রিয়তা কলেজে যায় নয়টায়। এই মেয়ের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে হয়তো।

“নীলু আপা, আপনি এখানে?”
উচ্ছ্বাস চমকে উঠে পিছনে তাকাতেই দেখে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে উচ্ছ্বাসের। মেয়েটা কি ঘুমায় নি সারারাত? এমন রুগ্ন লাগছে কেনো তাকে? সামনের চুলগুলো রুক্ষ হয়ে মাথার উপর উড়ছে। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে। আচ্ছা, ও কি সারারাত কেঁদেছে? তার মতোই তৃষ্ণার্ত রাত কেটেছে তার? তবুও কি ভীষণ মোহনীয় লাগছে তাকে। উচ্ছ্বাস চোখে নামিয়ে নেয়। সারা দুনিয়ার সামনে সুতীক্ষ্ণ চোখে তাকালেও, এই শ্যামসুষমার সামনে আজ সে কোনোভাবেই চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। গতরাতের অব্যক্ত অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলতে পারে, সেই ভয়ে।

সকাল সকাল উচ্ছ্বাস আর নীলুকে একসাথে দেখে বুক কেঁপে ওঠে প্রিয়তার। এই মেয়ে এখানে কেনো? একদম বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে। কি উদ্দেশ্য তার?
নীলু লাজুক মুখে হেসে বললো,”চলে এলাম রে প্রিয়তা। আজ একসাথে কলেজে যাবো।”
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। বুকের ভিতরটায় হঠাৎ একটা চাপা ব্যথা টের পায় সে। সুক্ষ্ম কিন্তু চিনচিনে ব্যথাটা পুরো শরীরেই মনে হয় ছড়িতে পড়বে।
সে হারাতে চায়না এই যুবকটাকে। মনের অজান্তেই সে প্রেমে পড়েছে এই লোকটার। ভিতরটা পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ার আগেই মানুষটার বরফমিশ্রিত প্রেম তার চাই, চাই-ই।

(চলবে…….)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব:১৬

প্রিয়তা বিস্ফারিত চোখে নীলুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে সোজা বাড়িতে চলে এসেছে? নীলুর সেদিকে মন নেই। সে উচ্ছ্বাসকে দেখতেই ব্যস্ত। উচ্ছ্বাস শুধু একদৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকানো।

ঠিক এমন সময় নাশতা নিয়ে ঘরে ঢোকে মার্জিয়া বেগম। ঢুকতেই পরিস্থিতি বুঝতে তার কিছুক্ষণ সময় লাগে। নিয়াজ কোথায়? আর নতুন মেয়েটাই বা কে?
মার্জিয়া বেগমকে দেখে নীলু এগিয়ে আসে হাসিমুখে।
“চাচী ভালো আছেন?”
মার্জিয়া বেগম জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
উচ্ছ্বাস মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনি যাকে খুঁজছেন সে চলে গেছে।”
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো,”চলে গেছে মানে? ওর তো যাওয়ার কথা না। কে বলেছে ওকে যেতে?”
প্রিয়তা একবার মায়ের দিকে আরেকবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। এখানে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কে এসেছিলো? আর কে বা চলে গেছে?
“আমি চলে যেতে বলেছি।”
মার্জিয়া বেগম হতবাক হয়ে বললো,”তুমি বলেছো মানে? তুমি কে বলার?”
“আমি বলার কেউ না মামি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো মামা এখন বাড়িতে নেই। একটা বাইরের লোক ঘরে থাকাটা আমার কাছে ভালো লাগেনি।”
রাগে ফোঁসফোঁস করে ওঠে মার্জিয়া বেগম। দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললো,”দাঁড়াও তোমাকে দেখছি আমি।”
নীলুর দিকে তাকিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে মার্জিয়া বেগম বললো,”তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না মা।”
নীলু ঈষৎ হেসে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কি রে চাচীকে আমার পরিচয় দে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে দেখলো নীলু মেয়েটা মাথায় ইতোমধ্যে কাপড় টেনে দিয়েছে। নতুন বউয়ের মতো আচরণ করছে। সে কি নিজেকে বাড়ির বউ মনে করছে?
“মা উনি নীলু আপা। আমার কলেজের সিনিয়র। আমার নাচটাও উনি তুলে দিয়েছিলেন।”
মার্জিয়া বেগম একগাল হেসে বললো,”আগে বলবে তো, এসো। নাশতা করবে আজ আমাদের সাথে।”
প্রিয়তা হঠাৎ চেচিয়ে উঠলো,”কেনো কি দরকার?”
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো,”এটা কেমন অসভ্যতা প্রিয়তা? কি দরকার মানে?”
নীলু উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে লাজুক গলায় বললো,”কোনো সমস্যা নেই চাচী। ও আমার সাথে মজা করেছে। আমি কিছু মনে করিনি।”
“তা তুমি হঠাৎ কিছু না বলে এলে যে? কোনো দরকার প্রিয়তার সাথে তোমার?”
নীলু কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। এরপর হেসে বললো,”চাচী আজ তো প্রিয়তার জন্মদিন। তাই কলেজে ওর জন্য ছোট্ট একটা আয়োজন করেছি আমরা। আমি এসেছি ওকে নিতে।”
প্রিয়তা জিভ কামড়ায়। ছি ছি, এতোক্ষণ কতো কি ভেবেছে মেয়েটাকে নিয়ে। নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়।

মার্জিয়া বেগম আঁৎকে ওঠে। এতোসব ঝামেলার মধ্যে ভুলেই গিয়েছিলো আজ যে মেয়েটার জন্মদিন। মেয়ের বাবা অন্যবার কতো উচ্ছল থাকে এই দিনে। আজ সে-ও কিছু মনে করেনি।
মার্জিয়া বেগম জোর করে নীলুকে টেবিলে বসায়।
নীলু গাঢ় গলায় উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললো,”এইযে শুনছেন?”
উচ্ছ্বাস তখনও ঘোরের মধ্যে। আজ প্রিয়তার জন্মদিন? মেয়েটার জীবনের এক বিশেষ দিন। সে দিনেও মেয়েটার মুখটা এমন বিষাদে ছেয়ে আছে কেনো? কোন গ্রহণ লেগেছে চাঁদে আজ?
“এইযে শুনুন, আমি ডাকছি।”
বিরক্ত হয়ে উচ্ছ্বাস তাকায় নীলুর দিকে।
“বলছি আপনি খেতে বসবেন না?”
ঝাঁঝের সাথে উচ্ছ্বাস বললো,”জ্বি না, আপনি উদরপূর্তি করুন, তাতেই হবে।”
হনহন করে হেঁটে উচ্ছ্বাস বেরিয়ে যায়।
মার্জিয়া বেগম রাগান্বিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি কিছু মনে করোনা মা। ও একটু এমন রগচটা।”
“না না চাচী, কিছু মনে করিনি। কিছু মনে করতেই পারিনা আমি।”
নীলুর লাজুক কথাগুলো কাঁটার মতো গায়ে বিঁধে প্রিয়তার। মনে হচ্ছে গরম তাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে সে। না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সহ্য করতে।

প্রিয়তা আজ শাড়ি পরে কলেজে যাবে। তার জন্মদিনে সবাই যে তার জন্য এতো সুন্দর করে আয়োজন করবে এটা তার কল্পনার বাইরে ছিলো।
পেখম মায়ের গাঢ় নীল সিল্কের শাড়িটা পরে। চুলগুলো আনাড়ি হাতে খোঁপা করে নেয়। পেখম ছুটে যেয়ে তার লাগানো গাছ থেকে কয়েকটা নীল অপরাজিতা ফুল এনে দেয় তার খোঁপায়। ছোট্ট একটা নীল টিপও পরিয়ে দেয় ভ্রুযুগলের মাঝে। আয়নায় নিজেকে দেখেই লজ্জা পেয়ে যায় প্রিয়তা।
নীলু আমতা আমতা করে বললো,”তোকে তো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে প্রিয়তা।”
প্রিয়তা ছোট্ট করে হাসে।

মার্জিয়া বেগমকে চুপচাপ থাকতে দেখে কবির শাহ এগিয়ে আসে তার কাছে।
“কি হলো মার্জিয়া? তোমাকে এমন লাগছে কেনো?”
মার্জিয়া বেগম ঝাঁঝ দেখিয়ে বললো,”কবে থেকে ওই বাইরের ছেলেটাকে ঘরের সদস্য বানিয়ে ফেলেছো তুমি বলো তো? যাওয়ার কথা বলে যাচ্ছে না কেনো ও?”
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে বললো,”আবার কি হয়েছে?”
“কিছু হয়নি, এবার হবে।”
“কি হবে?”
“আশ্রিত হয়ে নিজেকে বাড়ির মানুষ মনে করার উচিত শিক্ষা পাবে।”
“মার্জিয়া আমার কথা শোনো…..”
মার্জিয়া বেগম জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,”যাই হোক, আজ যে মেয়ের জন্মদিন তুমি কি ভুলে গিয়েছো?”
কবির শাহ কিছু না বলে চুপ করে যায়।
“কি হলো কথা বলছো না যে?”
“উনিশ বছর আগে এই দিনে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখটা পেয়েছিলাম। প্রথম বাবা হওয়ার সুখ। ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা গুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে যখন ও জানান দিচ্ছিলো পৃথিবীতে ওর উপস্থিতি। সেই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিলো সারাজীবন এই ফুটফুটে চেহারাটা দেখে কাটিয়ে দিতে পারবো, আর কিচ্ছু লাগবে না। সেই দিনটা আমি কীভাবে ভুলে যাই মার্জিয়া?”
কবির শাহের চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি জমে। মার্জিয়া বেগম কিছুটা নরম হয়ে স্বামীর কাঁধে হাত রাখে।
“তাহলে সকাল সকাল মেয়েটাকে ‘শুভ জন্মদিন’ টুকুও জানালে না কেনো? প্রতিবার তো এইদিনে তুমিই ওর ঘুম ভাঙাও। এখনো রাগ করে আছো মেয়েটার উপর?”
কবির শাহ ম্লান হাসে। মার্জিয়া বেগম মুগ্ধ হয়ে স্বামীর হাসি দেখে। পুরুষ মানুষের হাসিও এতো সুন্দর হয় বুঝি? বিয়ের এতোগুলা বছর পরেও মানুষটার হাসির প্রেমে পড়ছে সে বারবার।
“শোনো মার্জিয়া, বাবা মায়ের অভিমান হয় সন্তানের উপর, রাগ নয়। ও তো আমারই সন্তান, আমার র ক্ত, আমার শরীরের অংশ। কীভাবে ওর উপর রাগ করে থাকবো আমি? তবে সন্তান কোনো ভুল করলেও বাবা হিসেবে তাকে শুধরে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”
মার্জিয়া বেগম কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীলু এসে দাঁড়ায় সেখানে।
“চাচী দেখুন তো, প্রিয়তাকে কেমন লাগছে?”
মার্জিয়া বেগম আর কবির শাহ দুইজনই তাকায় একসাথে। তাকাতেই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় প্রিয়তার উপর। কিশোরী মেয়েরা হঠাৎ হঠাৎ শাড়ি পরলে বাবা মায়ের সামনে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যায় তারা।
প্রিয়তা মাথা নিচু করে শাড়ি কুঁচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। মূলত সে এখন মা বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারবে না।

মার্জিয়া বেগম মুচকি হেসে এগিয়ে যায় প্রিয়তার দিকে। তার চিবুক এক হাত দিয়ে তুলে অবাক হয়ে তাকায় মেয়েটার দিকে। তার বড় বোন মর্জিনা বেগম সবসময় বলে, মেয়ে কালো, অসুন্দর। কালো মেয়েদের নাকি সমাজে অসুন্দরই বলা হয়। কিন্তু কই? মর্জিনা আপা কি কখনো মেয়েটার আসল রূপ দেখার চেষ্টা করেছে? শ্যামবর্ণের যে আলাদা সৌন্দর্য আছে এটা কি সে জানে? যদি জানতো তবে সে বুঝতো এই চোখজোড়ার গভীরতায় কি মায়া আছে। লম্বা অক্ষিপল্লব, কুচকুচে কালো চোখের মণি কি যথেষ্ট নয় কোনো মেয়েকে অপরূপা করে তুলতে? আর এইযে, মেঘের মতো কালো কোমর ছাড়ানো চুল, গজদন্তের মিষ্টি হাসি, চাঁদের মতো মুখটা? সব সৌন্দর্য কি ম্লান গায়ের রঙের কাছে? গায়ের রঙ সব মোহনীয়তা ছাপিয়ে গেছে?
মার্জিয়া বেগমের চোখে পানি চিকচিক করে ওঠে।
ব্যস্ত হয়ে ওঠে প্রিয়তা।
“ওমা তুমি কাঁদছো কেনো?”
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মার্জিয়া বেগম বললো,”কই কাঁদছি না তো। চোখে কি যেনো পড়েছে।”
প্রিয়তাকে তার মা চোখের ইশারা করে বাবার কাছে যাওয়ার জন্য। কবির শাহ অন্য দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সে জানে, এখন মেয়ের দিকে তাকালে সে দূর্বল হয়ে পড়বে। আপাতত নিজের দূর্বলতা দেখাতে চাচ্ছে না সে। কিন্তু কতক্ষণ পারবে সে জানেনা।

প্রিয়তা ভীরু ভীরু পায়ে বাবার কাছে এসে দাঁড়ায়। ইচ্ছা করছে বাবার বুকে মাথা রেখে খুব কাঁদতে। কিন্তু একটা বাঁধা কাজ করছে।
প্রিয়তা আস্তে করে ডাক দেয়,”বাবা।”
“হুম বলো।”
“তাকাবে না আমার দিকে?”
কবির শাহের ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যেতে থাকে। এই ডাক অস্বীকার করার ক্ষমতা কেনো সৃষ্টিকর্তা তাকে দিলেন না?
“বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখেছি আমার জন্মদিনের সকালে তুমি আমার ঘুম ভাঙাও। তোমার মুখের মিষ্টি পবিত্র হাসি দেখে আমার ঘুম ভাঙে। আজ কেনো তা হলো না বাবা? এতোটাই রেগে আছো আমার উপর?”
কবির শাহ নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়।
“এখন তোমরা বড় হয়ে যাচ্ছো। নিজেদের ভালো নিজেরাই বুঝতে শিখেছো। এখন আর বাবার ভালোবাসা কি দরকার?”
প্রিয়তা নিজেকে সামলাতে পারেনা। ছুটে যেয়ে বাবার বুকের উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে। বাঁধ ভাঙে কবির শাহেরও। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে।
“আমি বড় হতে চাইনা বাবা, একটুও চাইনা। যে বড় হওয়াতে তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে হয়, সেই বড় হওয়া আমার জন্য অভিশাপ। তুমি আমাকে আরো মারো বাবা, তবুও আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিও না। আমি জীবনে সবকিছু ছাড়তে পারবো, কিন্তু তোমার ভালোবাসা না। আমি মরেই যাবো বাবা।”
কবির শাহ কাঁদতে কাঁদতে কথাই বলতে পারছে না। মার্জিয়া বেগম আঁচলে চোখে মুছে অন্যদিকে চলে যায়। এতো সুখের দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায়না, বুকে ব্যথা করে।

“খুব ব্যথা লেগেছিলো মা? বাবা অনেক ব্যথা দিয়ে ফেলেছে?”
“একদম না বাবা। আমার একটুও ব্যথা করেনি। শুধু তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো এই যন্ত্রণা আমাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। আমি যে তোমাকে ছাড়া অসহায় বাবা।”
কবির শাহ মেয়ের চোখের পানি মুছে দেয়।
“আজ আমার কাছ থেকে তুই কি উপহার চাস বল। আজ তুই যা চাইবি, আমি তোকে তাই দিবো।”
“বাবা তুমি আজ নিজে হাতে আমাকে খাইয়ে দিবে? সেই ছোটবেলার মতো।”
কবির শাহ কান্নার মধ্যেও হেসে দেয়। মেয়েটা এতো মিষ্টি কেনো তার? সে কীভাবে বোঝাবে গতকাল রাতটা তার জীবনের সবচাইতে কষ্টের রাত ছিলো। সে যে তার আদরের মেয়েটার গায়ে হাত তুলেছে। এরচেয়ে কষ্টের একটা বাবার কাছে আর কি হতে পারে? পুরো রাত কেটেছে তারও নির্ঘুম।

ছাদে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাস। ওঘর থেকে শুনেছে আজ প্রিয়তা শাড়ি পরবে। শত চেষ্টা করেও চোখের তৃষ্ণা মেটানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে পারেনি সে। মোহনীয় শ্যামসুষমা রূপটা দেখার জন্য উন্মাদের মতো ছুটে এসেছে সে ছাদে। কষ্টে ভরা জীবনটায় মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে কি সে বাঁচতে চাচ্ছে? ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচতে চায়।

বিরক্ত হয়ে চলেই যাচ্ছিলো, হঠাৎ তার শরীর থমকে দাঁড়ায়। একটা নীল প্রজাপতি যেনো উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। স্তব্ধ হয়ে যায় উচ্ছ্বাস সেদিকে তাকিয়ে। খোঁপায় গোঁজা নীল অপরাজিতার সৌন্দর্যও যেনো হার মানছে মেয়েটার কাছে। সত্যিই তবে কি প্রাচীর ভাঙলো তার? প্রেমে পড়লো সে অবশেষে?
নীলুর পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় একটা টান পড়ে প্রিয়তার। তার মস্তিষ্ক শূন্য লাগে। আবেগী মনটা বার বার বলছে, পিছনে ফিরে তাকা প্রিয়তা, একবার পিছনে ফিরে তাকা। হয়তো অপূর্ব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখতে পারবি। অসম্ভব সুদর্শন এক যুবক অপার মুগ্ধতা নিয়ে তার যাওয়ার পথে চেয়ে আছে। যার দুই চোখ জুড়ে অবাধ্য প্রেমের অবাধ বিচরণ।

প্রথমে নীলুই তাকায়। হতবাক হয়ে যায় সে।
“ইশ প্রিয়তা ছেলেটা আমার দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে পিছনে তাকিয়ে দেখ আবার। আমি তো প্রেমে পড়তে পড়তে পাগলই হয়ে যাবো।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কার কথা বলছেন নীলু আপা? কে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে?”
“পিছনে ফিরে দেখ তো একবার।”
প্রিয়তা ইতস্তত করে পিছনে তাকাতেই থমকে যায়। চোখাচোখি হয় দুইজনের। দূর থেকেই ভিতরকার সব বাঁধ ভেঙে যায় দুইজনের। ভিতরের সকল তৃষ্ণা মেটায় দুইজন।
“কি রে দেখেছিস?”
ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে প্রিয়তা। বিরক্ত হয়ে বললো,”আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে কেনো? উনি এই সময় এমনিতেই ছাদে থাকে।”
“তুই চুপ কর তো, হিংসুটে মেয়ে। আমার মতো সুন্দরী মেয়ে আগে দেখেছে উনি? এজন্যই তো দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। সোজা ছুটে এসেছে ছাদে।”
রাগে চোখে পানি চলে আসে প্রিয়তার। নীলুকে পিছে রেখেই হনহন করে হেঁটে চলে যায় সে। নীলু উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে প্রিয়তার পিছে দৌড়ায়।

উচ্ছ্বাস তখনও তাকিয়ে সেদিকে। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে ওঠে সে। পিছনে তাকাতেই দেখে কবির শাহ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ কিছুটা গম্ভীর।

উচ্ছ্বাস কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”মামা আপনি? কিছু বলবেন?”
“তুমি কি অসুস্থ উচ্ছ্বাস?”
“তেমন কিছু না মামা, ঠিক আছি আমি।”
“নিজের আবেগকে প্রকাশ করতে এতো কিসের আপত্তি তোমাদের বলতে পারো?”
উচ্ছ্বাস অবাক চোখে তাকায় কবির শাহের উপর। কথা সরে না মুখ দিয়ে।
“সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখো, নাহলে পরে অনুশোচনা করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যাবে।”
“মামা আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি।”
কবির শাহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ উচ্ছ্বাসের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমার মেয়ের সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে পারবে? কথা দিতে পারবে কখনো কোনো দু:খ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না?”
উচ্ছ্বাস বিস্ফারিত চোখে তাকায় কবির শাহের দিকে।
“মামা…..”
“আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও।”
উচ্ছ্বাস কথা বলতে পারেনা। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। এই মুহুর্তে কি বলা উচিত সে বুঝতে পারেনা।
“দেখো উচ্ছ্বাস, আমি শিক্ষক মানুষ। আমি যা বলি সোজাসুজি বলতে পছন্দ করি। তুমি হয়তো কোনোদিনও জানতে পারবে না আমি তোমাকে ঠিক কতোটা স্নেহ করি, ভালোবাসি। এর কারণ কি আমি তাও জানিনা। তোমার দিকে তাকিয়ে আমি নীলিমাকে দেখতে পাই, এটা একটা কারণ হতে পারে। তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। পুরো দুনিয়ার কাছে তুমি খারাপ, রগচটা হলেও আমি জানি তুমি কি। আমি বিশ্বাস করে আমার জীবনের সেরা সম্পদ তোমার হাতে তুলে দিতে পারি। যদি তুমি আমাকে কথা দাও তুমি আমার রত্নকে আমার চেয়েও বেশি যত্নে রাখবে, আমার রাজকন্যাকে রানী করে রাখবে তবে আমি নির্দ্বিধায় তোমার কাছে আমার কলিজার টুকরোকে তোমার হাতে তুলে দিবো।”
উচ্ছ্বাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষণ দূর্বল লাগে তার শরীর। মনে হচ্ছে জ্বরটা আবার আসবে। শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছে সে।

উচ্ছ্বাসের হাত থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিজের হাতে নেয় কবির শাহ। সেদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,”আর যদি সে সাহস না থাকে, এই সিগারেটের ধোঁয়ায় জীবন শেষ করে দিতে চাও, তবে আমার মেয়ের পথ থেকে সরে দাঁড়াও। তোমার ছায়া আমার মেয়ের জীবনে পড়তে দিও না। আমার মেয়েটা খুব আবেগী। ওর কোনো কষ্ট বাবা হয়ে আমি সহ্য করবো না। আর যদি ওর পাশে থাকতে চাও ওকে সময় দাও। ওর বয়স কাঁচা। ভালোমন্দ বোঝার বয়স হয়নি এখনো। আবেগে ভাসার বয়সে মহাপুরুষ হয়ে ওর কাছে ধরা দিও না।”
সিগারেটের প্যাকেটটা আবার ধরিয়ে দেয় উচ্ছ্বাসের হাতে।
“এটা তুমি রাখো। চাইলে আমি ছুড়ে ফেলে দিতে পারতাম এটা। কিন্তু দিবো না। জীবন তোমার, তুমি সিদ্ধান্ত নিবে এটা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবে নাকি আগুনের শিখার মতো উজ্জ্বল করবে।”
আর কথা বাড়ায় না কবির শাহ। হতবিহ্বল এক জোড়া চোখকে পিছনে ফেলে ছাদ থেকে নেমে যায় সে। ছাদের উপরই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে উচ্ছ্বাস। কি করবে সে এখন? নিজের আবেগকে গুরুত্ব দিবে? সে কি ভালোবেসে ফেলেনি ওই হরিণ চোখের মায়াবতীকে? নাকি বাবা মায়ের হয়ে প্রতিশোধ নিবে? এভাবেই ছেড়ে দিবে জানোয়ারগুলোকে? যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে পড়তে চায় তার। দুই হাতে চুল চেপে ধরে সে।

সিঁড়ির মুখেই ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো পেখম। উচ্ছ্বাসকে দেখেই দ্রুততার সাথে এগিয়ে আসে সে।
“উচ্ছ্বাস ভাই।”
রক্তলাল চোখে উচ্ছ্বাস তাকায় পেখমের দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায় পেখম।
“উচ্ছ্বাস ভাই আপনি ঠিক আছেন তো?”
গম্ভীর গলায় উচ্ছ্বাস বললো,”কিছু বলবে?”
পেখম এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,”আপা আপনাকে একটা কথা বলতে বলেছে উচ্ছ্বাস ভাই।”
“কি কথা?”
পেখম মাথা নিচু করে বললো,”আজ আপার জন্মদিন। আপার জীবনের বিশেষ একটা দিন। আজ আপার কলেজের ক্লাস শেষ হবে বিকাল চারটায়। আপা যদি আপনার মনে এতোটুকুও জায়গা দখল করে থাকে, তবে কলেজ ছুটির পর কলেজ গেটের সামনে থাকবেন আপনি। আর যদি না থাকেন আপা বুঝবে তার উপস্থিতি শুধুমাত্রই বিরক্তির কারণ আপনার কাছে। সে আর কোনোদিন আপনার সামনে আবেদনময়ী হয়ে ধরা দিবে না। আর কোনো অনুভূতি আপনার জন্য তার থাকবে না, অন্তত আপনার সামনে তা দেখাবে না। এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন আপনি কি করবেন।”
পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পেখমের কথাগুলো শোনে উচ্ছ্বাস। কি সিদ্ধান্ত নিবে সে? কি করা উচিত তার এখন? আর যাই হোক, গতকাল রাত তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে ওই চোখজোড়া ছাড়া সে থাকতে পারবে না। কিন্তু সে কি পারবে কবির শাহের কলিজার টুকরোকে সারাজীবন আগলে রাখতে?
“উচ্ছ্বাস ভাই…..”
পেখমের ডাকে ধাতস্থ হয় উচ্ছ্বাস।
“তুমি এখন যাও পেখম। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।”
“আপনি কি করতে চাচ্ছেন?”
ভয়ংকর শান্ত দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাস তাকায় পেখমের দিকে, পেখম চুপসে যায়। মানুষটাকে ভয় পায় সে ভীষণ। কোনো কথা না বলে চলে যায় সে সেখান থেকে। বারবার পিছন ঘুরে তাকায় সে। উচ্ছ্বাস নির্লিপ্ত।

বিকাল চারটা বেজে দশ মিনিট। এতোক্ষণ শাড়ি পরে থাকায় বেশ অস্বস্তি লাগছে প্রিয়তার। কলেজ গেটে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা উঁকি দিতে থাকে তার।
‘পেখম কি বলতে পারলো কথাগুলো উনাকে? কি করবে উনি? আসবে এখানে? নাকি সে বোকার স্বর্গেই বাস করছে? তার জন্য মানু্ষটার কোনো অনুভূতিই কখনো ছিলো না? কিন্তু আজ যদি উনি না আসে তবে তার কথা অনুযায়ী সে আর কোনোদিন উচ্ছ্বাসের সামনে যেতে পারবে না, নিজের কোনো আবেগ বা অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবে না।

কান্না পেতে থাকে প্রিয়তার। শাড়ির আঁচলটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়, সময় বেড়েই যাচ্ছে।
রুনা হঠাৎ প্রিয়তার কাছে এসে বললো,”তুই এখনো বাড়ি যাসনি কেনো প্রিয়তা? আজ তোর জন্মদিন। সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
প্রিয়তা উদাস গলায় অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”কেউ অপেক্ষা করবে না, কেউ বসে নেই আমার জন্য। কেউ ভালোবাসে না আমাকে।”
রুনা অবাক হয়ে বললো,”এসব কি বলছিস তুই?”
প্রিয়তা তার দিকে তাকিয়ে বিষাদ মাখা ঠোঁটে হাসে। রুনার খুব কষ্ট হয়ে সেই হাসি দেখে। কি এমন কষ্ট মেয়েটার মনে?

“এই প্রিয়তা।”
“বল।”
“জানিস তো, রাজপুত্রের মতো দেখতে একটা যুবক আমাদের এদিকে আসছে। নীল পাঞ্জাবিতে সাক্ষাৎ আগুন লাগছে। হাতে আবার গোলাপ। না জানি কোন ভাগ্যবতীর ভাগ্যে আছে গোলাপটা। এমন প্রেমিক পেলে তো আমি শুধু গোলাপ দিয়েই জীবন পার করে দিতে পারতাম। আর কিছুই লাগতো না।”
প্রিয়তা মুচকি হেসে বললো,”তোর স্বভাব আর পরিবর্তন হলো না।”
হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সে। কি বললো রুনা? সুদর্শন যুবক, নীল পাঞ্জাবি আর হাতে গোলাপ?
বুকটা ধকধক করে ওঠে তার। পিছন ঘুরে তাকানোর সাহস হয়না। যদি পিছন ঘুরে দেখে সে যা ভাবছে তা না? কল্পনা করতেও ভয়ে করছে তার।

আচমকা উচ্ছ্বাস এসে দাঁড়ায় প্রিয়তার সামনে। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে প্রিয়তা।

হাতে থাকা গোলাপটা এগিয়ে দেয় তার দিকে।
“শুভ জন্মদিন। নীল গোলাপ খুঁজতে যেয়ে দেরি হয়ে গেলো। তবুও পেলাম না। পরে মনে হলো লাল গোলাপই মানাবে তোমার হাতে।”
রুনা চোখ বড় বড় করে একবার উচ্ছ্বাসের দিকে আরেকবার প্রিয়তার দিকে তাকায়।
প্রিয়তা নিশ্চিত সে স্বপ্ন দেখছে, অবশ্যই স্বপ্ন। এটা সত্যি হতে পারে না, কোনোভাবেই না।

(চলবে…….)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে