#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ১৩
কাঁচাবাজারে ঢুকে মাথা খারাপ অবস্থা কবির শাহের। সবকিছুর দাম আকাশচুম্বী। তার মতো ছাপোষা চাকরিজীবীর জন্য বেশিরভাগ জিনিসই সাধ্যের বাইরে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট দেখে মাছ দোকানদারকে দেখিয়ে কবির শাহ বললো,”এটার দাম কতো রাখবে বাবা?”
দোকানদার কবির শাহের দিকে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে বললো,”এটার দাম আসে ছয়শো টাকা। আপনার জন্য পাঁচশো পঞ্চাশ টাকা রাখবো।”
কবির শাহ সুন্দর করে হাসে।
“আমার জন্য এতো ছাড় দেওয়ার কারণ কি বাবা?”
দোকানদার কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”আচ্ছা যান আরো পঞ্চাশ টাকা কম দিয়েন। একদাম পাঁচশো রাখবো।”
কবির শাহ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
“আমার জন্য কম করার দরকার নেই রে বাবা। এখনো দুইটা হাত, দুইটা পা সচল আছে। কিছু রোজগার করে খেতে পারি। কম যদি করতেই হয় যারা অত্যন্ত গরীব, টাকার অভাবে মাছ খাওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের জন্য করো। মাছটা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দাও। আমি তোমাকে ছয়শো টাকাই দিবো।”
দোকানদারের মুখ হাঁ হয়ে যায়। ব্যবসা করতে যেয়ে বহু অদ্ভুত মানুষ চোখে পড়েছে। কিন্তু এমন কিসিমের মানুষ এই প্রথম দেখলো সে। সে নিজে থেকে একশো টাকা কমাতে চাচ্ছে, আর উনি কিনা কমাবে না? দোকানদারের সন্দেহ হয়, লোকটা কি পাগল?
“কি হলো তোমার? এভাবে তাকিয়ে আছো যে? ভাবছো তো কেনো তুমি কম করতে চাইলেও আমি রাজি হলাম না?”
দোকানদার কথা না বলে চুপ করে থাকে। সে নিশ্চিত এই মানুষটা পাগল। এদের সাথে বেশি তর্ক করতে নেই।
“শোনো বাবা, তুমি আমাকে আসল দামটা বলতে পারতে, আমি হয়তো কিছু দামাদামি করতাম। কিন্তু তুমি আমার পোষাক দেখে আমাকে অত্যন্ত নিম্নশ্রেণীর কেউ ভেবেছো। এজন্যই আমার জন্য কমাতে চাইছো। কিছুক্ষণ আগেই আমি খেয়াল করেছি, একজন ক্রেতার কাছ থেকে তুমি এক টাকাও কমাওনি। তুমি হয়তো আমাকে সম্মান করতে চেয়েছো। তবে এই শিক্ষাটা তোমার আজীবন থাকবে। আজকের আমার এই একশো টাকা তুমি কোনো অথর্ব মানুষের কাছ থেকে কম রেখো, তাতেই হবে।”
দোকানদার মাথা নিচু করে থাকে। লোকটা ভুল বলেনি। সে সত্যিই করুণা করতে চেয়েছিলো মানুষটাকে। তবে তার কথা শুনে এখন নিজের মধ্যে অপরাধবোধ হচ্ছে।
“মন খারাপ করোনা। শিক্ষক মানুষ তো, সবাইকেই নিজের ছাত্র ভেবে ফেলি। দাও মাছটা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দাও।”
দোকানদার কোনো কথা না বলে মাছটা কবির শাহের ব্যাগে ঢোকাতে গেলেই একটা গম্ভীর গলার আওয়াজে থেমে যায় সে।
“এই শফিক, চাচার ব্যাগে সবচেয়ে বড় মাছটা দে।”
কবির শাহ আর শফিক দুইজনই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ভালো করে চশমাটা পরে কবির শাহ চেনার চেষ্টা করে ছেলেটাকে। খুব চেনা চেনা লাগছে মুখটা, কোথায় যেনো দেখেছে। বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তিও দূর্বল হয়ে যাচ্ছে মনে হয়।
“নিয়াজ সাহেব।”
“কথা কম বল শফিক, তোর দোকানের সবচেয়ে বড় মাছটা এই চাচার ব্যাগে ঢুকিয়ে দে।”
কবির শাহ মুচকি হেসে বললো,”তোমাকে খুব চেনা লাগছে। দু:খিত চিনতে পারছি না। কিন্তু আমার এতো বড় মাছ লাগবে না বাবা।”
“আহা চাচাজান আপনি এতো চিন্তা করবেন না তো। টাকার ভাবনা আপনার না, আমার। এই মাছটা আমার পক্ষ থেকে আপনাকে দিবো।”
কবির শাহ এবার কিছুটা কঠিন দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকায়। তার চোখ সরু।
“তুমি দিবে মানে? তুমি কেনো দিবে?”
নিয়াজ খোলা গলায় হেসে বললো,”মনে করুন আমি মাছটা আপনাকে উপহার দিচ্ছি।”
কবির শাহ চোখের চশমাটা ঠিক করে আবার তাকায় নিয়াজের দিকে।
“তুমি আমাকে মাছ উপহার দিবে মানে? তুমি কি চিনো আমাকে?”
নিয়াজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,”চিনতেও তো পারি।”
হঠাৎ করেই কবির শাহের মনে পড়ে যায়। এইতো সেই ছেলেটা, যে প্রিয়তাকে দেখতে এসেছিলো কিছুদিন আগে। সে মানা করে দিয়েছিলো এই বিয়েতে। এখন এই ছেলেটা তার কাছে কি চায়? মাছ-ই না উপহার দিতে চাচ্ছে কেনো?
“দেখো বাবা, আমার মনে হয় আমি তোমাকে চিনেছি। তবে আমি অত্যন্ত দু:খিত আমি তোমার কোনো উপহার নিতে পারবো না।”
নিয়াজ কিছু বলতে গেলে কবির শাহ ধীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। সেই চোখে কিছু একটা ছিলোই, নিয়াজ থেমে যায়। সে বুঝতে পারে এভাবে হবে না। এই লোক মারাত্মক ব্যক্তিত্ববান। সাধারণত এমন নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষগুলো এমনই হয়। এভাবে কাজ হবে না, অন্য কোনোভাবে চেষ্টা করতে হবে।
বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রিকশা থেকে নামতেই প্রিয়তাকে দেখে মনটা ভালো হয়ে যায় কবির শাহের। তার মেয়েটা বড্ড রূপবতী। শ্যামলা রঙেও যে মেয়েদের আলাদা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তা প্রিয়তাকে দেখলে বোঝা যায়। লম্বা চুলগুলো বেনী করে, ভ্রুযুগলের মাঝে ছোট্ট একটা কালো টিপ দিলে মেয়েটাকে অসামান্য সুন্দরী লাগে। মেয়ে গায়ের রঙ তার পেলেও চেহারার আদল পেয়েছে মায়ের মতো। মেয়েদের মা যুবতী বয়সে ভীষণ সুন্দরী ছিলো।
কবির শাহ চোখ নামিয়ে নেয় মেয়ের দিক থেকে। বাবা মায়ের নজর সন্তানের উপর বেশি পড়ে।
বাবাকে দেখেই ছুটে আসে প্রিয়তা। দরদর করে ঘাম পড়ছে বাবার কপাল থেকে। ব্যস্ত হয়ে যায় সে। নিজের ওড়নার কোণা দিয়ে বাবার কপাল মুছে দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,”বাবা তুমি তো ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছো। দাও বাজারের ব্যাগ আমার হাতে দাও।”
কবির শাহ টের পেলেন একটু আগে নিয়াজ নামক ছেলেটার উপর হওয়া রাগ আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে তার। মেয়েটা তার বড্ড বেশি মায়াবতী।
কবির শাহ মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”শান্ত হ মা। আমি ঠিক আছি।”
“তুমি চলো বাবা, তোমাকে লেবুর শরবত করে দিবো।”
হঠাৎ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে চোখে পানি চলে আসে কবির শাহের। নিজের মা কে হারিয়েছে সেই সতেরো বছর আগে। একমাত্র মা-ই এভাবে মায়া করতো তার জন্য। এই মেয়ে দু’টোকে তো সে তেমন কিছুই দিতে পারেনা। তবুও মেয়েগুলো তাকে এতো মায়া করে কেনো? কি উৎস এই মায়ার?
“প্রিয়তা মা।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় বাবার দিকে।
“আজ তোকে আমার কিছু দিতে ইচ্ছা করছে। কোনোদিন তো মুখ ফুটে কিছু চাস না তুই আমার কাছ। আজ তুই যা চাইবি তোকে তাই দিবো আমি। বল আমার কাছে কি চাস তুই?”
প্রিয়তা সুন্দর করে হাসে বাবার কথা শুনে। আচমকাই বাবাকে জড়িয়ে বাবার বুকের উপর মাথা রেখে বললো,”কে বলেছে তুমি আমাকে কিছু দাওনি? তুমি হলে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা। তুমি আমাকে যতোটা ভালোবাসা দিয়েছো, আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।”
কবির শাহ ঈষৎ কেঁপে ওঠে মেয়ের কথা শুনে। বাজারের ব্যাগটা পায়ের কাছে ফেলে কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়ের মাথায় হাত দেয়। তার মন বলছে মেয়েটার মনের ভিতর যে এক আকাশ সমান কষ্ট পুষে রেখেছে। চাপা স্বভাবের মেয়ে, মুখ ফুটে কিছু বলবেও না। মেয়ের সাথে কি খোলামেলা এই বিষয়ে কথা বলা উচিত? নাকি সে অপেক্ষা করবে মেয়েটা নিজে থেকে বলা পর্যন্ত?
দূর থেকে বাবা মেয়েকে এভাবে দেখে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মার্জিয়া বেগম। বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেলো মনে হচ্ছে। তার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো, গতকাল রাতে মেয়েকে এতো কথা জানানোর পর মেয়ে তার বাবাকে আগের মতো ভালোবাসতে বা শ্রদ্ধা করতে পারবে কিনা। কিন্তু সকাল হতে না হতেই বাপ মেয়ের এতো ভালোবাসা দেখে কিছুটা প্রশান্তি ভর করে তার মনে। ঠোঁটে ছোট্ট একটা হাসি ফুটে ওঠে তার।
কিছুক্ষণ আগেই ক্লাস শেষ হয়েছে প্রিয়তার। বাড়ি ফেরার জন্য একটাও রিকশা পাচ্ছে না সে কলেজ গেটের সামনে। এদিকে ঘেমে নেয়ে একাকার সে। কিছুটা মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এখনই রোদটা এমন প্রখর হতে হলো? প্রিয়তা ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে।
পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রিয়তা চমকে যায় কিছুটা। তাকাতেই দেখে নীলু আপা দাঁড়িয়ে আছে, মুখ টিপে হাসছে সে।
প্রিয়তা শুকনো মুখে হাসে।
“কি রে প্রিয়তা কেমন আছিস?”
“ভালো আছি নীলু আপা।” প্রিয়তা বেশি কথা বাড়ায় না।
“আচ্ছা তুই আমাদের জানাসনি কেনো বল তো এর আগে?”
“কিসের কথা বলছেন নীলু আপা?”
নীলু প্রিয়তার গাল টিপে দিয়ে বললো,”আহা কচি খুকি, কিচ্ছু বুঝেননা উনি।”
প্রিয়তা ভিতর ভিতর বিরক্ত হয়। কিন্তু মুখে প্রকাশ করেনা। মুখে জোর করে একটা হাসি টেনে প্রিয়তা বললো,”আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না নীলু আপা, কিসের কথা বলছেন আপনি?”
নীলু এদিক ওদিক তাকিয়ে নীচু গলায় বললো,”নিয়াজ মোর্শেদের মতো এমন নামীদামী একজনের বাগদত্তা তুই, এটা আগে আমাদের জানাসনি কেনো? জানালে বুঝি তোর হবু বরকে আমি নিয়ে নিতাম?”
প্রিয়তার শরীরটা কেমন রাগে ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। সে তীক্ষ্ণ চোখে নীলুর দিকে তাকায়। মেয়েটা এখনো কীভাবে হেসে যাচ্ছে। বয়সে বড় না হলে প্রিয়তা বুঝি একটা চড় মেরেই বসতো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে। তার রাগ সাংঘাতিক।
“দেখুন নীলু আপা….”
“আরে হয়েছে হয়েছে, আর থামিয়ে কি হবে? যা জানার গতকালের পর সবাই জেনে গেছে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কি জেনেছে আপা?”
নীলু শব্দ করে হেসে বললো,”কয়দিন পর নিজেই জানতে পারবি কি জেনেছে। কিন্তু তোকে আজ অন্য একটা কথা বলার জন্য এসেছি। তুই কথা দে আমাকে সাহায্য করবি।”
প্রিয়তার মুখ রাগে থমথম করছে। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছনা সে। এই অসভ্য লোকটা বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। সাথে লেগেছে এই গায়ে পড়া মেয়েটা। প্রিয়তা বুঝতে পারে সময় থাকতে কিছু না করলে পানি আরো গড়াবে। নাহ, যা করার তাকেই করতে হবে। প্রয়োজন হলে বড় খালাকে ডেকে শক্ত করে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে হবে।
“আমি সাহায্য করবো মানে? আমি আবার কি করবো?”
নীলুর মুখটা সাথে সাথে পালটে যায়। একটু আগে যে ফিচেল হাসি দিচ্ছিলো তার মুখটাই লজ্জায় লাল হয়ে যায়। লাজুক মুখে মাথা নিচু করে হাসতে থাকে সে।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি ব্যাপার বলুন তো নীলু আপা?”
নীলু গলা আরো নামিয়ে বললো,”বেশ কিছুদিন তোদের বাড়ির সামনে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। প্রায় দিনই কালো শার্ট পরে থাকে। কোনোদিকে না তাকিয়ে একমনে সিগারেট টানতে থাকে, আবার বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। আমার জানামতে তোর তো কোনো ভাই নেই, তবে উনি কে?”
প্রিয়তার বুকটা কেঁপে ওঠে। নীলু আপা কার কথা বলছে? উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথা নয় তো?
প্রিয়তা যন্ত্রের মতো বললো,”কার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না আপা।”
নীলু ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,”নাটক করিস না তো, ঠিকই বুঝতে পারছিস তুই।”
প্রিয়তা সামনের দিকে পা চালিয়ে বললো,”আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে নীলু আপা, আমাকে যেতে হবে।”
পিছন থেকে নীলু হাত টেনে ধরে প্রিয়তার। রাগী মুখে বললো,”যাবিই তো, তোকে আটকে রাখবো নাকি আমি? আগে উনার পরিচয়টা তো বলে যা।”
প্রিয়তা দাঁত কিড়মিড় করে বললো,”উনার নাম উচ্ছ্বাস, আমার দু:সম্পর্কের ফুপুর ছেলে উনি। উনার বাবা মা দুইজনই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ায় কিছুদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে এসেছেন। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো চলে যাবেন। এর বেশি আর কিছু জানিনা আপা উনার ব্যাপারে।”
নীলু আবারও মুচকি হাসে।
“শোন না প্রিয়তা, উনাকে আমার খুব মনে ধরেছে। আমাদের একটু পরিচয় করিয়ে দে না।”
আঁৎকে উঠে প্রিয়তা তাকায় নীলুর দিকে।
“এসব কি বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে আপনার? এটা সম্ভব না, কোনোদিনও সম্ভব না।”
প্রিয়তা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।
নীলু চোখমুখ কুঁচকে বললো,”কেনো সম্ভব না শুনি? উনার মতো একজন সুদর্শন পুরুষকে পছন্দ হওয়াটা কি অপরাধ? নাকি তোর হিংসা হচ্ছে আবার সত্যি করে বল তো।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে বললো,”আমার হিংসা হবে মানে? কি বলছেন আপনি?”
“হতেও পারে, এমন একজন রাজপুত্র। যে কোনো মেয়েরই স্বপ্নের পুরুষ হতে পারে।”
প্রিয়তা এবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় নীলুর দিকে। সামনে দাঁড়ানো এই যুবতীটাকে অসহ্য লাগছে তার এখন।
“দেখুন নীলু আপা, একটু বেশি বেশি করছেন আপনি এবার। কি জানেন উনার ব্যাপারে আপনি? পছন্দ হয়েছে তাতেই প্রেম করতে চান? অদ্ভুত মেয়ে তো আপনি।”
নীলু রাগে লাল হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কি ভেবেছিস তুই পরিচয় করিয়ে না দিলে আমি নিজে থেকে পারবো না পরিচিত হতে? আমি এই কলেজের সেরা সুন্দরী। আমি চাইলেই উনার সাথে প্রেম করতে পারবো। আর করে দেখাবো তোকে। তুই তখন দেখে নিস।”
নীলু কথা না বাড়িয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায়।
রাগে, কষ্টে, অভিমানে চোখে পানি চলে আসে প্রিয়তার। নীলু ভুল কিছু বলেনি। মেয়েটা আসলেই ভীষণ রূপবতী। আচ্ছা, সে তো নীলুর রূপের কাছে কিছুই না। উচ্ছ্বাস ভাই কি আবার উনাকে পছন্দ করে ফেলবে? এ কি বিপদ আবার?
প্রিয়তার মাথার উপর দিয়ে মনে হচ্ছে আগুন উঠছে। মাথা তাওয়ার মতো গরম হয়ে আছে। এই মুহুর্তে কয়েক কলস ঠান্ডা পানি মাথায় না ঢাললে শান্তি হবে না, কিছুতেই হবে না।
খাটের উপর শুয়ে গান শুনছিলো পেখম। টকটকে লাল মুখে ঝড়ের বেগে আপাকে ঢুকতে দেখে এক ঝটকায় শোয়া থেকে উঠে বসে সে। এই আপাটার আবার কি হলো? আজকাল বড্ড রেগে যাচ্ছে মেয়েটা কথায় কথায়। এর কারণও পেখম জানে। মেয়েরা নতুন নতুন প্রেমে পড়লে তাদের অনুভূতিগুলো প্রখর হতে থাকে আগের চেয়ে। সে শুনেছে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে।
প্রিয়তা ধপ করে বসে পড়ে খাটে। রাগে শরীর কাঁপছে তার। চোখ বন্ধ করে একশো থেকে উলটো দিক গুণতে থাকে সে।
পেখম ভয়ে ভয়ে বললো,”আপা কি হয়েছে তোর? রাগ করে আছিস কেনো?”
প্রিয়তা কিছুটা দমে যায়। আসলেই তো রাগ করছে কেনো সে? ওই মানুষটা তো তার প্রেমিক না। এমনকি প্রিয়তাকে পছন্দও করেনা সে। তার জন্য এভাবে রাগ করাটা কি ছেলেমানুষী না?
“আপা, এই আপা।”
প্রিয়তা ঝট করে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই কোথায়?”
“বাড়িতে নেই আপা।”
“কোথায় গিয়েছেন মহারাজ এখন? মেয়ে পটাতে বুঝি?”
পেখমের মুখ হা হয়ে যায়।
“এসব কি বলছিস আপা?”
প্রিয়তা উঠে দাঁড়ায়।
“শোন আমি মাথায় পানি ঢালতে যাচ্ছি, বরফ শীতল ঠান্ডা পানি। তোর উচ্ছ্বাস ভাই এলে আমাকে খবর দিস।”
প্রিয়তা যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলো, সেই বেগেই বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।
পেখম বিড়বিড় করে বললো,”আচ্ছা নতুন প্রেমে পড়লে কি মেয়েদের মাথাও কিছুটা খারাপ হয়ে যায়? এটা তো বান্ধবীদের কাছ থেকে শোনা হয়নি।”
প্রিয়তা ভেবেছিলো মানুষটার সামনে অনেক রাগ দেখাতে পারবে সে। কিন্তু কোথায় কি? তার ঘরের সামনে আসতেই বুকটা কেমন চুপসে গেছে তার। ঘর থেকে সিগারেটের তীব্র ধোঁয়া আর গন্ধ ভেসে আসছে।
প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে আস্তে বললো,”এইজন্য বুঝি বাড়ির বাইরে যেয়ে এতো সিগারেট খাওয়া তাইনা? সিগারেটের ধোঁয়া দেখিয়ে মেয়েদের প্রেমে ফেলানো। আর মেয়েদেরও বলিহারি। এসব দেখে কেউ প্রেমে পড়ে? ছি কি রুচি!”
“বাইরে দাঁড়িয়ে পেত্নীর মতো এভাবে বিড়বিড় না করে কি বলতে আসা হয়েছে বলে চলে গেলে ভালো হয়। এতো রাতে পেত্নী হোক বা পেত্নীর মতো দেখতে মানুষ কেউ বিরক্ত করুক, আমার পছন্দ না।”
প্রিয়তা শুকনো ঢোক চাপে। তার রাগের পারদ তরতর করে নিচে নামছিলো কিছুক্ষণ আগেই। হঠাৎ রাগটা আবার বেড়ে যায়। তাকে পেত্নী বলা? সে যদি পেত্নী হয় তবে সেই রূপসী পরীটা কে? ওই নীলু বুঝি?
প্রিয়তা পা টিপে টিপে উচ্ছ্বাসের ঘরে ঢোকে। ভীষণ অন্ধকার ঘরটা। অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই দেখে উচ্ছ্বাস স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি ব্যাপার? কি চাই এখানে?”
প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে হাতে রাখা ব্যাগটা এগিয়ে দেয় উচ্ছ্বাসের দিকে।
উচ্ছ্বাস দুই ভ্রু নাচায়।
প্রিয়তা শীতল গলায় বললো,”আপনাকে অত্যন্ত ধন্যবাদ এতো সুন্দর শাড়িটা আমাকে দেওয়ার জন্য। তবে শাড়িটা যেহেতু আপনার মায়ের, তাই এটাতে হয়তো অনেক স্মৃতি মিশে আছে। তাই এটা ফেরত দিতে এসেছি।”
প্রিয়তার মনে হয়েছিলো উচ্ছ্বাস এটা নিবে না, তাকে দিয়ে দিবে। মূলত সে উচ্ছ্বাসের সাথে কথা বলতে আসার একটা বাহানা খুঁজছিলো।
কিন্তু প্রিয়তাকে চরম অবাক করে দিয়ে উচ্ছ্বাস অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”খাটের উপর রেখে চলে যাও।”
প্রিয়তা চোখ বড় বড় করে তাকায়।
“শুনতে পাওনি মনে হয়। বলেছি শাড়িটা খাটের উপর রেখে দিয়ে চলে যাও।”
প্রিয়তা কিছুটা ধাতস্থ হয়ে শাড়িটা রেখে দেয়। বারবার বাঁকা চোখে উচ্ছ্বাসকে দেখতে থাকে সে। কিন্তু উচ্ছ্বাস এখনো অন্যদিকে তাকানো।
ধীর পায়ে হেঁটে দরজা পর্যন্ত যেয়ে কি মনে করে আবার ঘুরে তাকায় প্রিয়তা।
উচ্ছ্বাস নির্লিপ্ত চোখে তার দিকে তাকায়।
প্রিয়তা একটা লম্বা শ্বাস ফেলে, চোখ বন্ধ করে এক নি:শ্বাসে বলতে থাকে।
“দেখুন আপনি এতো সিগারেট খান আমার একদম পছন্দ না। তাও ভালো কথা, বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে খাওয়ার কি দরকার? আর কালো শার্ট পরে তো প্রশ্নই ওঠে না। আগামীকাল থেকে যেনো আর না দেখি।”
প্রিয়তা কথা শেষ করেও চোখ বন্ধ করে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বুঝতে পারে এক জোড়া অগ্নিকুন্ডলীর মতো চোখ তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। যেনো চোখ দিয়ে আগুন বের করেই তাকে ভস্ম করে দিবে। এ কি করলো সে? কথা ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় কি এখন?
উচ্ছ্বাস আস্তে আস্তে হেঁটে এসে প্রিয়তার সামনে দাঁড়ায়। মেয়েটা আজ শ্বেতশুভ্র একটা শাড়ি পরেছে। তরুণী মেয়েরা হঠাৎ হঠাৎ শাড়ি পরলে ভীষণ মোহনীয় লাগে দেখতে, চোখ সরানো যায়না। দুই ভ্রুয়ের মাঝে একটা ছোট্ট কালো টিপ। হাতভর্তি সাদা কালো কাচের চুড়ি। আচ্ছা, এতো রাতে মেয়েটা এমন মোহনীয় সাজে সেজেছে কেনো? সে কি কোনোভাবে উচ্ছ্বাসের দূর্বলতা বুঝে ফেলছে?
প্রিয়তার অনেকটা কাছে এসে দাঁড়ায় উচ্ছ্বাস। প্রিয়তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তার নি:শ্বাসের শব্দ।
“কি বললে তুমি? আবার বলো তো।”
প্রিয়তা ভয় পেয়ে ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। উচ্ছ্বাস পিছন থেকে তার হাত চেপে ধরে। দুই/তিনটা কাচের চুড়ি আলগোছে ভেঙে নিচে পড়ে যায়। প্রিয়তার বুকটা ধুকধুক করে ওঠে।
“উত্তর না দিয়ে পালাচ্ছো যে?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”কিছু বলিনি, কিছু বলিনি।”
“আমি যে শুনলাম তুমি বললে। আমাকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছো, কালো শার্ট পরতে নিষেধ করেছো।”
প্রিয়তা হাত মোচড়াতে থাকে।
অন্য হাতে থাকা সিগারেটটা দূরে ছুড়ে ফেলে দেয় উচ্ছ্বাস। এরপর হেঁচকা টান দিয়ে প্রিয়তাকে সামনে টেনে নিয়ে আসে। প্রিয়তার কপালের উপর তার কিছু অবাধ্য চুল এসে পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে ঘোর লাগে উচ্ছ্বাসের।
হঠাৎ হালকা ফুঁ দিতেই চুলগুলো উড়ে যেতে থাকে। প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে যায়। সে বুঝতে পারছে না এসব কি করছে মানুষটা। সে কি জানে কি করছে সে? নিজের মধ্যে সে কি আছে এখন? এই প্রথম তার এতোটা কাছে আসা। স্থাণুর মতো জমে গেছে সে। এক পা ও যেনো আর নড়তে পারবে না।
প্রিয়তা তোতলাতে তোতলাতে বললো,”আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি।”
উচ্ছ্বাস নেশাক্ত গলায় বললো,”তাহলে কি বলতে চেয়েছো শুনি?”
প্রিয়তা টের পায় তার পা দু’টো অবশ হয়ে যাচ্ছে।
উচ্ছ্বাস তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”শোনো মায়াবতী, আগুনের পাশে উড়তে থাকা পতঙ্গ হতে চেয়ো না। আগুনের টানে পতঙ্গ এক সময় ঝাঁপ দেয় লেলিহান শিখায়। এতে কিন্তু আগুনের কোনো ক্ষতি হয়না। কিন্তু পতঙ্গ জ্বলে অঙ্গার হয়ে যায়। অসহ্য রকম সুন্দর জীবনে খুঁত হিসেবে শুধু এই গজদন্তটাই থাকুক। যে খুঁত, হাজারও নিখুঁত বিন্যাসকে টেক্কা দিতে পারে। আর কোনো খুঁত জীবনে টেনে এনো না। পতঙ্গের মতো পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে, টেরও পাবে না। যখন টের পাবে, তখন বড্ড দেরি হয়ে যাবে। চারদিকে তাকিয়ে দেখবে শুধু ধোঁয়াশা আর ধোঁয়াশা।”
কথা শেষ করেই হাতের বাঁধন আলগা করে দেয় উচ্ছ্বাস। ছাড়া পেতেই ভেজা কপোতীর মতো কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।
উচ্ছ্বাস সেই তুলনায় শান্ত।
প্রিয়তা আস্তে আস্তে পা ফেলে দরজার দিকে এগোয়। কি হয়ে গেলো দুই মিনিটের মধ্যে। তার সত্ত্বা অনুভূতি শূণ্য হতে থাকে।
“এইযে নন্দিনী, একটা দিয়াশলাই দিতে পারবে?”
প্রিয়তা আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,”কি করবেন?”
উচ্ছ্বাস তার চোখের গভীরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”কালো শার্ট বাদে অন্য শার্ট গুলো পুড়িয়ে ফেলবো।”
প্রিয়তা হতাশ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
(চলবে….)
#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ১৪
বসার ঘরে চিন্তিত মুখে বসে আছে কবির শাহ। তার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। পাশেই শরীর এলিয়ে বসে আছে মার্জিয়া বেগম। ক্ষণে ক্ষণে কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে সে। পেখম ভয়ে ভয়ে একবার বাবার দিকে তাকায়, আরেকবার মায়ের দিকে।
ঘটনা মোটেই সামান্য নয়। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে চললো, এখনো প্রিয়তা কলেজ থেকে বাড়ি ফেরেনি। সাধারণত এমন অবুঝের মতো কাজ সে কোনোদিন করেনা। কলেজ শেষ করেই সোজা বাড়ি চলে আসে। যদি কোনোদিন দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আগেই বাড়িতে জানিয়ে দেয়।
এক এক করে প্রিয়তার সব বান্ধবীদের কাছে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। কেউ জানেনা প্রিয়তা কোথায়। শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিলো কলেজ গেটের সামনেই। এরপর আর কেউ কিছু জানেনা।
মার্জিয়া বেগম ঠোঁট কামড়ে বললো,”আমার মেয়েকে এনে দাও, যেখান থেকে পারো আমার মেয়েকে আমার কাছে এনে দাও। আমার মেয়ের কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচবো না।”
কবির শাহ কিছুটা ইতস্তত করে স্ত্রীর মাথায় হাত রাখে। মার্জিয়া বেগম হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
“তুমি এতো ভাবছো কেনো? আমি দেখছি তো।”
মার্জিয়া বেগম চিৎকার করে বললো,”ভাববো না, চুপ করে বসে থাকবো? চারদিকের অবস্থা ভয়াবহ তুমি জানো না? কেউ যদি মেয়েটাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়?”
কবির শাহ আর পেখম একসাথে শিউরে উঠে তাকায় তার দিকে।
“এসব কি বলছো তুমি মার্জিয়া? মাথা ঠিক আছে তোমার? কে করবে এই কাজ? আমার প্রিয়তার সাথে কার শত্রুতা থাকতে পারে?”
মার্জিয়া বেগম মাথা চেপে ধরে বললো,”আমি কিচ্ছু জানিনা। তুমি যেখান থেকে পারো আমার মেয়েকে এনে দাও, এক্ষুনি।”
কবির শাহ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে উঠে দাঁড়ায়।
“পেখম।”
পেখম ধীর কণ্ঠে বললো,”জ্বি বাবা।”
“আমার পাঞ্জাবিটা এনে দে ভিতর থেকে, আমি বেরোবো।”
মার্জিয়া বেগম মাথা উঁচু করে বললো,”তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
“মেয়েটা তো আমার। আমাকে তো জানতেই হবে ও কোথায়। আমি থানায় যাচ্ছি।”
মার্জিয়া বেগম লাফ দিয়ে উঠে বললো,”আমিও যাবো তোমার সাথে।”
কবির শাহ কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শোনা যায়। সবাই চমকে উঠে তাকায়। পেখম দৌড়ে যায় দরজার দিকে।
মার্জিয়া বেগম চোখ মুছে বললো,”নিশ্চয়ই আমার প্রিয়তা এসেছে।”
কয়েক সেকেন্ড বাদেই অন্ধকার মুখে ঘরে ঢোকে পেখম।
“মা।”
“কোথায়, প্রিয়তা কোথায়?”
পেখম মাথা নিচু করে বললো,”আপা না মা, বড় খালা এসেছে।”
মার্জিয়া বেগম আবারও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।
মর্জিনা বেগম ঘরে ঢুকেই পরিস্থিতি এমন দেখে ঘাবড়ে যায়। দৌড়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো,”কি হয়েছে তোর? এভাবে কাঁদছিস কেনো? এই কবির কি হয়েছে ওর?”
কবির শাহের উত্তর দিতে হয়না।
মার্জিয়া বেগম ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,”আপা আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে, সব শেষ হয়ে গেছে আমার।”
“মানে কি? কি হয়েছে বলবি তো?”
“আপা আমার মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিয়তা বাড়ি ফেরেনি এখনো।”
“বাড়ি ফেরেনি মানে? এসব কি বলছিস তুই? কবির এসব কি শুনছি?”
কবির শাহ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।
মর্জিনা বেগম কপাল চাপড়ে বললো,”ঠিক এই কারণে আমি বলি, মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করানোর দরকার নেই। এখন যদি মেয়েটার নিয়াজের সাথে বিয়ে হতো, শ্বশুরবাড়িতে আরাম আয়েশে থাকতো। তোদের আর কোনো চিন্তাই থাকতো না। না তা হবে না। তোর বর তো বিদুষী বানাবে মেয়েদের। এখন দেখ কি হয়।”
মর্জিনা বেগমের কথা শুনে মার্জিয়া বেগম আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে। কবির শাহ বিরক্ত হয়ে তাকায় মর্জিনার দিকে। কিছু বলতে ইচ্ছা করেনা তার।
“এই মার্জিয়া তোর মেয়ের আবার কোনো গোপন প্রেমিক নেই তো? হতেও পারে তার সাথেই তোর মেয়ে পালিয়ে গেছে।”
কবির শাহ এবার চুপ থাকতে পারেনা।
তেজী গলায় মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”এবার মুখে একটু লাগাম টানুন আপা। বলতে বলতে কোথায় যেয়ে ঠেকেছেন ঠাওর করতে পারছেন না।”
ঝাঁঝিয়ে ওঠে মর্জিনা বেগমও।
“ভুলটা কি বললাম আমি? মিলিয়ে নিও আমার কথাই ঠিক হবে। এই বয়সের মেয়েরা হলো সাক্ষাৎ আগুন। এদেরকে বেশি মাথায় তুললে এদের শিখা বাড়তেই থাকে শুধু। যখন আমার কথা সত্যি হবে তখন এতো তেজ কোথায় যায় তোমার দেখবো।”
কবির শাহ ম্লান হেসে বললো,”আপনি খুশি হবেন এমনটা হলে? আমার মুখে চুনকালি মাখলে আপনার ভালো লাগবে তো? যদি না লাগে তাহলে দয়া করে চুপ করুন। আমি হাতজোড় করছি।”
মর্জিনা বেগম চুপ করে যায়।
এরপর কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে ভারী গলায় পেখমকে ডেকে বললো,”এই পেখম, তোদের বাড়ির ওই আশ্রিত ছেলেটা কোথায় রে?”
পেখম ভ্রু কুঁচকে বললো,”কার কথা বলছেন খালা?”
“ইশ বুঝতে পারছিস না যেনো। ওইযে তোর বাপ একটা এতীম ছেলেকে বাড়িতে টেনে এনে তুলেছে না? তার কথা বলছি।”
পেখম চাপা গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথা বলছেন? উনি তো বাড়িতে নেই। এই সময় উনি বাড়িতে থাকে না।”
মর্জিনা বেগমের মুখ সাথে সাথে জ্বলে উঠলো।
“এইতো বুঝেছি। দুইয়ে দুইয়ে চার হলো এবার। আমার সন্দেহই ঠিক।”
কবির শাহ অবাক হয়ে বললো,”কি বলতে চাচ্ছেন আপা?”
“বলতে চাচ্ছি না, বলছি। মার্জিয়া তোকে আগেই সাবধান করেছিলাম আমি, তোর মনে আছে? এইসব ছেলেদের বাড়ি থেকে বের করে দে। বাড়িতে এতো বড় বড় দুই মেয়ে। ঠিক হলো তো আমার কথা? নিশ্চয়ই ভুলভাল কিছু বুঝিয়ে তোর মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে ও।”
কবির শাহ হতভম্ব হয়ে তাকায় তার দিকে। মার্জিয়া বেগমও হতবাক।
“আপা আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?”
“না জানার কি হলো? প্রিয়তা কখনো এতো দেরি করেনা। ওই ছোকরাও এখন বাড়িতে নেই। তার মানে কি দাঁড়ালো?”
কেউ কিছু বলার আগে পেখম আস্তে আস্তে বললো,”খালা উচ্ছ্বাস ভাই তো প্রতিদিনই এই সময় বাড়িতে থাকেনা। আর তাছাড়া উনি এমন মানুষই নয়। আপনি ভুল বুঝছেন উনাকে।”
পেখমের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে মর্জিনা বেগম।
“চুপ কর তুই। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের চামচা এসেছে। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে তুই সব জানিস। সত্যি করে বল পেখম। এখনো সময় আছে।”
পেখম ভীত গলায় বললো,”কি বলছেন খালা? আমি কিছু জানিনা। ও বাবা সত্যিই আমি কিছু জানিনা।”
“আমার ব্যাপারে কিছু বলছিলেন?”
হঠাৎ একটা গম্ভীর গলার আওয়াজে সবাই থমকে যায় ওরা। দরজার দিকে তাকাতেই দেখে বুকে দুই হাত বেঁধে সুঠাম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। তার চোখের দৃষ্টি মর্জিনা বেগমের দিকে নিবদ্ধ। শান্ত দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই এমন কিছু ছিলো, মর্জিনা বেগম কিছু সময়ের জন্য চোখ নামিয়ে নেয়।
“কি হলো চুপ করে আছেন যে ম্যাডাম? খুব সম্ভবত আপনিই কিছু বলছিলেন কিছুক্ষণ আগে।”
মর্জিনা বেগম কিছু বলার আগেই কবির শাহ ছুটে যায় উচ্ছ্বাসের কাছে। হঠাৎ করেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে উচ্ছ্বাসকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দেয় সে।
অপ্রস্তুত হয়ে যায় উচ্ছ্বাস নিজেও। পুরুষ মানুষ খুব বেশি কষ্ট না পেলে কাঁদে না। এমন হাসিখুশি, ভালো একজন মানুষকে কাঁদতে দেখে উচ্ছ্বাসের বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে।
“মামা কি হয়েছে আমাকে একটু বলুন তো। কেনো কাঁদছেন এভাবে?”
“বাবা আমার মাথা কাজ করছে না। আমাকে তুমি একটু থানায় নিয়ে চলো। আমি হাঁটতে পারছি না আর এক কদমও। আমার মেয়েটা এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে কিছুই জানিনা। আমার শরীর আর চলছে না।”
উচ্ছ্বাসের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। মুহুর্তেই এক শ্যামবর্ণা কাজল চোখের তরুণীর গজদন্তের মিষ্টি হাসি ভেসে ওঠে। কি হয়েছে ওর? ওর কোনো বিপদ হয়নি তো?
বেরোনোর মুখে অন্ধকার মুখ করে পেখম দাঁড়িয়ে। তার চোখমুখ ছলছল করছে।
তাকে দেখেই থমকে দাঁড়ায় উচ্ছ্বাস।
কি একটা ভেবে মুচকি হেসে বললো,”চিন্তা করোনা পেখম। আপা ফিরে আসবে।”
“উচ্ছ্বাস ভাই।”
“বলো পেখম।”
“আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”
“বলো শুনছি।”
এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে পেখম বললো,”আপা আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাস মুহুর্তেই স্তব্ধ হয়ে পেখমের দিকে তাকায়। তার হাত-পা অনড় হয়ে যায়।
“তোমাকে এই কথা বলেছে তোমার আপা?”
পেখম না-সূচক মাথা নাড়ে।
“তবে কীভাবে জানলে?”
“আপনি যেদিন আপাকে বকা দেন, সেদিন রাতে আপা জেগে থাকে। একটুও ঘুমাতে পারেনা। গল্পের বইতে মুখ গুঁজে আপা নি:শব্দে শুধু কাঁদে। আনমনেই আপনার নামটা আপার বইখাতাতে লিখে। আর সেদিন তো ঘুমের ঘোরে….”
“কি হয়েছে ঘুমের ঘোরে?”
“কিছু না। আপনি আমাকে সত্যি করে বলুন তো, আপনি বুঝতে পারেননি?”
উচ্ছ্বাস ম্লান হাসে। বিষাদে মাখা সেই হাসিটা দেখে কষ্ট হয় পেখমের। মনে হয় এই মানুষটাও কোনো একটা কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে রেখেছে, ভয়ংকর এক কষ্ট।
“শোনো পেখম, তোমার আর তোমার আপার বয়সটা বড্ড কাঁচা। তোমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারোনা। পরিস্থিতি তোমাদের বুঝতে দেয়না। কিন্তু আমাদের মতো ছেলেদের, তোমার খালার ভাষায় আশ্রিত ছেলেদের অনেক কিছু বুঝতে হয়। তাই এসব আবেগে গা না ভাসিয়ে তোমার বাবার কথা চিন্তা করো। উনার অনেক স্বপ্ন তোমাদের ঘিরে।”
উচ্ছ্বাসের কথার মধ্যে কিছু তো একটা ছিলো। বয়সে কাঁচা হলেও পেখম ঠিক বুঝতে পারে, এই স্বরের মধ্যেও প্রেম আছে।
“ঘরে যাও পেখম। আমাকে বেরোতে হবে। তোমার আপাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
“আপনি তো তাকে শুধু কষ্টই দেন, তাহলে কেনো খুঁজে বের করতে চান তাকে?”
উচ্ছ্বাস সুন্দর করে হাসে।
“মনে করো দায়িত্ববোধ থেকে। তোমার বাবা আমার আশ্রয়দাতা। আমার খুব কঠিন একটা সময়ে তিনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। এতোটুকু দায়িত্ববোধ তো থাকেই আমার, তাইনা?”
“শুধুই দায়িত্ববোধ? আর কিছুই না?”
উচ্ছ্বাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”না আর কিছুই না।”
পেখম চুপ করে থাকে। উচ্ছ্বাস বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেখম আবার ডাক দেয় তাকে।
“আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই আমি।”
“পরে শুনবো পেখম, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“হয়তো উপকারেই আসবে আপনার।”
উচ্ছ্বাস থেমে যেয়ে তাকায় পেখমের দিকে।
“তুমি কি জানো তোমার আপা কোথায়?”
পেখম ফিসফিস করে বললো,”আমি নিশ্চিত নই। তবে আপার যখন খুব মন খারাপ থাকে, কোনোভাবেই মন ভালো হয়না তখন আপা ওর কলেজের পাশের একটা শান বাঁধানো নদীর ঘাঁট আছে, ওখানে চুপচাপ একা বসে থাকে। খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে তো, মন খারাপ হলে নিজের মধ্যেই সেটুকু শুষে নেওয়ার চেষ্টা করে।”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায়। পেখম দেওয়ালে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে। যে কোনো মুহুর্তে ঝড় ছাড়বে। উচ্ছ্বাস উন্মাদের মতো খুঁজছে প্রিয়তাকে। পেখমের কথামতো নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে সে। তীব্র বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে চোখমুখের উপর পড়ছে। ঝড়ো বাতাসে অজস্র ধুলো ওড়াউড়ি করছে। তবুও সে ছুটছে, তাকে খুঁজে বের করতেই হবে মেয়েটাকে। এখানে যদি না থাকে কোথায় যাবে সে?
হঠাৎই দূরে অন্ধকারের মধ্যে নীল ওড়না দেখে বুকটা ধকধক করে ওঠে উচ্ছ্বাসের। মনে হচ্ছে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে আসা কোনো বিষাদকুমারী খরস্রোতা পানির ঢেউ দেখায় ব্যস্ত। জগতের আর কোনো খেয়াল তার নেই।
উচ্ছ্বাস ধীর পায়ে হেঁটে প্রিয়তার অনেকটা কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। এখনও প্রিয়তা বুঝতেই পারেনি তার উপস্থিতি।
“তুমি যে বোকা তা জানতাম। তবে এতোটা জ্ঞানবুদ্ধিহীন একটা মেয়ে এটা জানা ছিলো না। ভাগ্যগুণে এটাও জানা হয়ে গেলো।”
ভয়াবহভাবে চমকে প্রিয়তা তাকায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে উচ্ছ্বাসের দিকে। এটা কি সত্যি নাকি কোনো ভ্রম?
প্রিয়তা তোতলাতে তোতলাতে বললো,”আপনি এখানে? এটা নিশ্চয়ই আমার কল্পনা।”
ধমকে ওঠে উচ্ছ্বাস।
“চুপ করো তুমি। লজ্জা করা দরকার তোমার। বাড়িতে বাবা মা তোমার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে, আর এখানে তুমি কল্পনার সাগরে ভাসছো? মাথায় কি সমস্যা আছে তোমার?”
কেঁপে ওঠে প্রিয়তা উচ্ছ্বাসের কথায়। এখনো সে ধাতস্থ হতে পারেনি। উচ্ছ্বাস কীভাবে জানবে সে এখানে আছে? এটা তো তার জানার কথা না।
“আপনি কীভাবে জানেন আমি এখানে?”
উচ্ছ্বাস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”স্বপ্নে দেখলাম। মহারানী রাজ্য ছেড়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায় সে মজা করছে কিনা বুঝতে। কিন্তু কোথাও মজার কোনো চিহ্ন নেই তার মুখে।
“বাড়িতে চলো, সবাই অপেক্ষা করছে।”
প্রিয়তা ম্লান গলায় বললো,”আপনি যান, আমি যাবো না। আমার মন ভালো না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়বো না।”
উচ্ছ্বাস গলার স্বর আরো চড়িয়ে বললো,”শেষ বারের মতো বলছি। তুমি আমার সাথে ফিরবে কি না?”
প্রিয়তা গাঢ় গলায় বললো,”না।”
আচমকা উচ্ছ্বাস প্রিয়তার বাম হাত শক্ত করে চেপে ধরে। প্রিয়তা হতবিহ্বল হয়ে যায়।
“কি করছেন আপনি? লাগছে আমার, ছাড়ুন।”
“অনুরোধ করেছিলাম, শোনোনি। এবার এভাবেই তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাবো।”
“আমার কথাটা শুনুন…..”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার হাত ধরে টানতে থাকে। ঘাঁট থেকে উঠতেই নদীর পাড়ের নরম কাদামাটি। প্রিয়তা নিজেকে আটকাতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তে কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
“উচ্ছ্বাস ভাই ছাড়ুন আমাকে….”
বলতে না বলতেই একটা পাথরের টুকরোর সাথে আঘাত লেগে উচ্ছ্বাস মাটিতে পড়ে যায়, সাথে সাথে প্রিয়তাও এসে পড়ে উচ্ছ্বাসের বুকের উপর।
ঠান্ডা ঝড়ো হাওয়া হুট করেই বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে। বলা নেই, কওয়া নেই অজস্র ফোঁটায় শীতল বারিধারা পড়তে থাকে। প্রকৃতিও হয়তো চাচ্ছে, দুই মানব মানবীর ভিতরকার সকল দূরত্ব ঘুচে যাক। তারা একে অন্যের অনেকটা কাছে চলে আসুক। এই খরস্রোতা নদী হোক তার সাক্ষী। শীতল বর্ষার জল হোক তাদের প্রণয়ের মিলনকারী।
প্রিয়তার চুল চুইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি এসে পড়ে উচ্ছ্বাসের মুখে। মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ ভেসে আসে উচ্ছ্বাসের নাকে। এটা কি কোনো প্রসাধনীর ঘ্রাণ নাকি তার শরীরের? উচ্ছ্বাস বুঝতে পারেনা।
পানিতে কাজল লেপ্টে যায় প্রিয়তার। এতে তার মাধুর্য আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। উচ্ছ্বাস সেই দৃষ্টির সামনে অসহায় বোধ করে। সে ভুলে যায় তার পরিচয়, তার উদ্দেশ্য, তার ভবিষ্যৎ। তার সামনে এখন শুধু এক মোহিনীর বাস। বাদবাকি আর সব কিছু ভুল, সব কিছু মেকি।
দূরের কোনো এক নৌকার মাঝি গান ধরেছে,’ওরে নীল দরিয়ে, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া। বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি হায় রে, কান্দে রইয়া রইয়া।’
প্রিয়তা ওঠার তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু কোনো এক অজানা শিকড় তাকে টেনে ধরে রাখে। সে জানে যে কোনো সময় তার তৃষ্ণার্ত চিত্ত, অধর বেঈমানী করবে তার সাথে। কোনো এক ভুলে আচ্ছাদিত হবে, যার মাসুল দিতে হবে সারাজীবন ধরে। তবুও কোনো যাদুবলে মানুষটা তাকে নিজের সাথে আটকে রেখেছে? সে নাহয় উঠতে পারছে না। তাই বলে উনিও কি উঠাবে না?
এই কম্পমান শীতল জলে শরীর কাঁপলেও ভিতর জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে দু’টো পিপাসার্ত কপোত-কপোতীর।
প্রিয়তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে তিরতির করে। এটা কি ঠান্ডায় নাকি কোনো ভুলের আগাম বার্তা সে বুঝতে পারেনা।
সেই ঠোঁটজোড়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রম জাগে উচ্ছ্বাসের। এখন সে উচ্ছ্বাস নয়। সে গ্রীক কোনো দেবতা, জিউস। আর তার সামনে স্বয়ং তার রানী ‘হেরা’। একটাই তো জীবন, ছোট্ট একটা ভুল করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?
মর্জিনা বেগম মার্জিয়া বেগমের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অনবরত। মার্জিয়া কেঁদেই চলেছে। ঘড়িতে সময় রাত আটটা বেজে পনেরো মিনিট। বৃষ্টির বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝড়ো বাতাসের বেগ। সেই সাথে দুশ্চিন্তার পারদও বাড়ছে মার্জিয়া বেগমের।
“ও আপা, এখনো তো ওর বাবা এলো না মেয়েকে নিয়ে। কি হবে এখন? কোথায় গেলো আমার মেয়ে?”
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”মেয়ে যদি প্রেমিকের সাথে পালায় তবে আর পাবি কীভাবে? নিজে থেকে দুইদিন পর ফিরে আসবে, অপেক্ষা কর।”
মার্জিয়া বেগম হালকা চিৎকার করে বললো,”দয়া করে এগুলো বলো না আপা। তুমি কি বুঝতে পারছো না আমার মনের অবস্থাটা? সান্ত্বনা দিতে না পারো, অন্তত খোঁচা দেওয়া কথাগুলো বন্ধ করো।”
কিছুটা দমে যায় মর্জিনা বেগম।
একটু থেমে আবার বললো,”শোন মার্জিয়া, একটা কথা বলে রাখি। এ যাত্রায় মেয়ে ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে এলে আর দেরি করিস না। নিয়াজ এখনো বিয়ে করেনি। তার নাকি প্রিয়তাকে খুবই মনে ধরেছে। বিয়ে করলে নাকি ওই মেয়েকেই করবে। তাই যতো দ্রুত সম্ভব, এসব কথা পাঁচ কান হওয়ার আগেই বিয়েটা পাকা করে ফেল। অনেক শুনেছিস কবিরের কথা, আর না। এবার নিজে একটু শক্ত হ।”
মার্জিয়া বেগম কান্নাভেজা লাল চোখে আপার দিকে তাকায়। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পায়না।
“মা মা, আপা ফিরেছে।”
পেখমের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শুনে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ে মর্জিনা আর মার্জিয়া। মার্জিয়া বেগম মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলেই পেখম ছুটে এসে মা কে ধরে।
“কোথায় আমার প্রিয়তা? কোথায় ও?”
ধীর পায়ে আস্তে আস্তে হেঁটে প্রিয়তা দাঁড়ায় বসার ঘরে। তার সারা শরীর কাঁদায় মাখামাখি। পানিতে ভিজে চুপসে আছে সে। একটা নীড়হারা পাখির মতো কাঁপছে সে থরথর করে। ভয়ে, উত্তেজনায় কিংবা ঠান্ডায়। অথবা সব মিশ্র অনুভূতিতে। লম্বা চুলগুলো খোলা, এলোমেলো। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে অনেক আগেই।
মার্জিয়া বেগম হতভম্ব হয়ে বললো,”এ কি অবস্থা তোর?”
বাড়ি ফিরেই সোজা ছাদে উঠেছে উচ্ছ্বাস। টিপটিপ বৃষ্টি এখনো ঝরে যাচ্ছে। তার মধ্যেই সিগারেট ধরিয়েছে সে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। না, সে কোনো ভুল করেনি। অধরজোড়া যখন খুব তৃষ্ণা নিয়ে অনেকটা কাছাকাছি, সে জোড়ার দূরত্ব মাত্র এক সেন্টিমিটার। ঠিক সেই সময় উচ্ছ্বাস ধাতস্থ হয়। এ কি করতে যাচ্ছিলো সে? এ যে পাপ, অন্যায়। তার কঠিন সময়ে যে দু’টো হাত সাহায্যের জন্য তার দিকে বাড়িয়েছে, সে কীভাবে বেঈমানী করবে তার সাথে?
ধাক্কা দিতেই প্রিয়তা ছিটকে যেয়ে কাদার মধ্যে পড়ে। উঠে দাঁড়ায় উচ্ছ্বাস সাথে সাথে। অন্যদিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলে,”আমি ওদিকে অপেক্ষা করছি, চলে এসো। আর রাতের এই নির্জনতাই শুধু সাক্ষী হোক। আর কেউ যেনো আজকের এই কথা না জানে।”
এক ব্যথায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া হৃদয়েশ্বরী কন্যার করুণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে উচ্ছ্বাস চলে যায় সেখান থেকে।
তবুও কেনো এতো কান্না পাচ্ছে তার? মনে হচ্ছে অতি মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেললো সে বুকের বাঁ পাশ থেকে। কি হারালো? তবে কি সত্যিই সে এতোটা জায়গাজুড়ে ছিলো? নাহলে কেনো এতো বিষাদের ক্ষত হচ্ছে?
আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাস গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে বললো,”মা মা গো, তোমার ছেলেটার মনের অসুখ হয়েছে খুব। তুমি আমার মন ভালো করে দাও। মা তুমি শুনতে পাচ্ছো? তোমার ছেলের মনের জ্বর হয়েছে। তুমি বলে দাও আমি কি করবো?”
আচ্ছা, ঠিক তখন কি কোনো উজ্জ্বল তারকা হেসেছিলো তার দিকে তাকিয়ে? সে কথা উচ্ছ্বাস জানেনা। সে তখন তীব্র মাথা যন্ত্রণায় নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে তীব্র যন্ত্রণায়। বুকের ভিতরের এক সুবিশাল ক্ষতের যন্ত্রণায়।
(চলবে…….)