#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ১২
বৈশাখের প্রথম রাতেই কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। সারাদিনের অসহ্য গরমের পর একটু শান্তির ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া। প্রকৃতির বুকে নেমে এসেছে একরাশ প্রশান্তি।
শুধু স্বস্তি নেই প্রিয়তার মনে। পাশেই পেখম শুয়ে আছে। প্রিয়তা ঘরের বাতি নিভিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়েছে। অন্ধকার অসহ্য লাগছে এখন।
“আপা।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না।
পেখম উঠে বসে প্রিয়তার পাশে।
“আপা শুনছিস কি বলছি?”
প্রিয়তা যন্ত্রের মতো বললো,”এখনো ঘুমাসনি কেনো?”
পেখম মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বললো,”একটা কথা বলবো আপা? রাগ করবি না তো?”
প্রিয়তা নির্লিপ্ত চোখে পেখমের দিকে তাকায়।
“কি কথা?”
পেখম একটু থেমে বললো,”আজ উচ্ছ্বাস ভাই গিয়েছিলো তোর কলেজের অনুষ্ঠানে।”
এ কথা প্রিয়তা জানে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে পেখম আরো কিছু জানে।
“তোর প্রথম নাচ শেষ হওয়ার কিছু সময় পর উনাকে আমি দেখেছি। উনি ভীষণ রেগে ছিলেন। আর উনার হাতে অনেকগুলো গোলাপফুল ছিলো। ফুলগুলো উনি মাটিতে আছড়ে ফেলছিলেন। আমি যখন উনাকে জিজ্ঞেস করলাম উনি তোর নাচ দেখেছে কিনা। উনি কেনো যেনো খুব রেগে গেলেন। কি হয়েছে আপা উনার?”
প্রিয়তা পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। তার মাথা কাজ করছে না।
পেখম প্রিয়তার গায়ে হাত দিয়ে বললো,”আপা আমার একটা কথা রাখবি?”
প্রিয়তা চুপ করে থাকে।
“তুই একবার উনার সাথে কথা বল। উনি কেনো আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চান?”
প্রিয়তা বালিশে হেলান দিয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে।
“কি হলো আপা? শুয়ে পড়লি যে?”
প্রিয়তা কপালের উপর একটা হাত রেখে চোখ বন্ধ করে।
“মোমবাতিটা নিভিয়ে দে পেখম, বড্ড চোখে লাগছে আলোটা।”
পেখম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মোমের আলো এতোটাও প্রখর না যে চোখে লাগবে। সে বুঝতে পারে নিশ্চয়ই আপা আর উচ্ছ্বাস ভাইয়ের মধ্যে কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। দুইজনের চোখেই রাগের আড়ালে একটা চাপা কষ্ট দেখতে পেয়েছে সে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে পেখম।
বেশ কিছুক্ষণ উচ্ছ্বাসের ঘরের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। ইচ্ছা করছে ছুটে যেয়ে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরতে। এই দূরত্ব আর সহ্য হচ্ছে না তার। সবাই বলে এটা নাকি আবেগের বয়স। কিন্তু আবেগ হলে কি সত্যিই এতোটা কষ্ট হয়?
খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে জীবনটা ভালোবাসার মানুষটার সাথে কাটিয়ে দিলে? ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে জীবনটা কি সে গুছিয়ে দিতে পারবে না? জীবন তো একটাই। সময় গেলে যে সাধন হবে না।
“প্রিয়তা।”
মায়ের ডাকে চমকে ওঠে প্রিয়তা। মা কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে সে বুঝতেই পারেনি। এখন কি হবে? তাকে কি ভুল বুঝবে মা?
অতি সন্তর্পণে চোখের পানিটা মুছে ফেলার চেষ্টা করে প্রিয়তা। মার্জিয়া বেগম সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
“এখানে কি করছিস তুই?”
প্রিয়তা চাপা গলায় বললো,”পানি খেতে এসেছিলাম মা।”
বলার সময় গলাটা ঈষৎ কেঁপে ওঠে তার। যে চোখ এড়ায় না মার্জিয়া বেগমের।
একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে মার্জিয়া বেগম বললো,”তুই মনে হয় খেয়াল করিস নি, পানি তোর শোবার ঘরের মাথার কাছেই ছিলো।”
প্রিয়তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে।
“চল আমার সাথে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কোথায় যাবো মা?”
“আজ তুই আমার সাথে ঘুমাবি।”
প্রিয়তা আমতা আমতা করে বললো,”কিন্তু বাবা….”
“তোর বাবাকে আজ বসার ঘরে ঘুমাতে বলেছি। বলেছি আজ আমার বড় মেয়ের সাথে রাত জেগে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। তোর কোনো আপত্তি নেই তো?”
প্রিয়তা থতমত খেয়ে যায় মায়ের কথায়। কি বলবে বুঝতে পারেনা। মায়ের হঠাৎ এমন ব্যবহার অবাক করছে তাকে।
“কি রে চুপ করে আছিস কেনো? আগে তো মা কে ছাড়া ঘুমাতেই পারতিস না।”
এটা সত্যি, প্রিয়তা মা কে ছাড়া ঘুমাতেই চাইতো না আগে। কিন্তু তা অনেক বছর আগের কথা। প্রায় আট বছর সে আলাদা ঘুমায়।
মার্জিয়া বেগম কোমল হাতে মেয়ের হাত ধরে।
“কি রে চল।”
প্রিয়তাকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে তার হাত ধরে টেনে মার্জিয়া বেগম নিজের ঘরে নিয়ে যায়। প্রিয়তার ঘোর লাগে। সে বুঝতে পারছে না মায়ের এই ব্যবহারে তার ভালো লাগছে নাকি খারাপ।
মেয়ের মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মার্জিয়া বেগম। ঝড়-বৃষ্টি থামার পর বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। বাইরে একনাগাড়ে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। সেই ডাকে পরিবেশ রোমাঞ্চকর লাগে আরো।
“মনে আছে আগে রাত জেগে গল্প শোনাতে হতো তোকে। আমি যতো ক্লান্তই থাকি না কেনো, গল্প শোনাতে হবেই তোকে। কবে যে এতো বড় হয়ে গেলি তোরা।”
প্রিয়তার চোখে নোনাজল ভরে যায়। যে কোনো মুহুর্তে প্লাবন নামবে।
“আচ্ছা প্রিয়তা তোর কি খুব মন খারাপ হয়?”
প্রিয়তা আবারও চমকে ওঠে।
“কেনো মা?”
“এমনিতেই, তোর মতো বয়সটায় আমারও এমন হতো। হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ হতো, আবার হঠাৎ মন ভালো হয়ে যেতো। তোরও কি এমন কিছু হয়?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার।
“শোন মা, তোরা হয়তো ভাবিস তোর বাবার সংসারে এসে আমি খুশি না। আমি তোর বাবাকে পছন্দ করিনা এটাই জানিস তোরা ছোট থেকে। কিন্তু এটা সত্যি না। মেয়েরা বড় হওয়ার পর মায়ের বন্ধু হয়ে যায়। তাই আজ আমার সব কথা তোকে বলবো। তুই কি শুনতে চাস?”
প্রিয়তা অস্ফুট শব্দে সম্মতি জানায়।
মার্জিয়া বেগম উদাস গলায় বললো,”তোর বাবাকে আমি অনেক ভালোবাসি, অনেক। হয়তো উনি আমাকে যতোটা ভালোবাসেন তার চেয়েও বেশি। তুই এখন বলবি, যদি তাই হয় বাবাকে কষ্ট দাও কেনো? বাবার সাথে সবসময় চিৎকার করো কেনো? এই উত্তর আসলে আমি দিতে পারবো না। একটা মেয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে একটা নতুন সংসারে আসে। তার স্বামী তাকে অনেক ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে। কিন্তু সে যখন বিয়ের পরই জানতে পারে তার স্বামীর একজন পূর্ব প্রেমিকা আছে তখন তার স্বপ্নগুলো কাঁচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। দূর থেকে স্ট্রিটের আলো জানালা গলে মায়ের মুখে এসে পড়ছে। মায়ের দুই গাল ভেজা। কি যে মায়াবতী লাগছে মা কে। প্রিয়তার অদ্ভুত কষ্ট হয় মায়ের জন্য। খুব ইচ্ছা করছে মা কে জড়িয়ে ধরতে।
“আমি জানিনা এটা তোকে আমার বলা উচিত হচ্ছে কিনা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এখন তোকে কথাগুলো জানানো দরকার। জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত গুলো অনেক ভেবেচিন্তে নিতে হয়। আর মা হিসেবে আমার দায়িত্ব তোকে ঠিক পথটা দেখানো।”
মার্জিয়া বেগম থামে, প্রিয়তা অধীর হয়ে অপেক্ষা করে মায়ের কথা শোনার জন্য।
“বিয়ের পর তোর বাবাকে আমি যতো আবিষ্কার করলাম, তত তাকে ভালোবাসতে শুরু করলাম। সত্যি বলতে প্রথমে আমার উনাকে ভালো লাগেনি। আমার সাথে বয়সেও মানানসই না, সামান্য ছাপোষা চাকরি। অনেকটা নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ঠিক এমন সময় তোর বড় খালার কি বিত্তশালী পরিবারে বিয়ে হয়েছে। মন খারাপও লাগতো। আমার বাবার উপর রাগ হতো। কেনো উনি আমাকে এমন একজনের সাথে বিয়ে দিলেন। কিন্তু বিয়ের কিছু মাস পর বুঝেছিলাম আমার বাবা ভুল করেননি। আমি একজন খাঁটি মানুষ পেয়েছি জীবনে। কতোদিন শুধু আলু ভর্তা খেয়ে দিন পার করেছি। তবুও আমি অভিযোগ করিনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমি একটা ভয়াবহ সত্যির মুখোমুখি হলাম, যা আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আমার সাজানো স্বপ্নগুলো বালুঝড়ের মতো উড়ে যেতে থাকে।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো মায়ের কথা শুনছিলো প্রিয়তা।
“কি সেই সত্যি মা?”
মার্জিয়া বেগম চোখের পানি মুছে ছোট্ট করে হাসে। কি বিষাদে মাখা সেই হাসি। প্রিয়তার অসম্ভব কষ্ট হতে থাকে মায়ের জন্য।
“তোর বাবা বিয়ের আগে অন্য একজনকে ভালোবাসতো। বলতে গেলে তার জন্য উন্মাদ ছিলো। যদিও আমাকে বিয়ের পর কিছুই বুঝতে দেয়নি সে। আমি জেনেছিলাম তার লেখা ডায়েরির কিছু অংশ পড়ে।”
প্রিয়তা ধড়ফড় করে উঠে বসে। মায়ের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
“মা এসব কি বলছো তুমি?”
“আমি জানি এটা তোমার শুনতে ভালো লাগবে না। তবে সত্যি এটাই। তোমার বাবা তার দু:সম্পর্কের বোন নীলিমাকে ভালোবাসতো। অবশ্য ভালোবাসতো বলছি কেনো, হয়তো এখনো বাসে।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে বললো,”নীলিমা মানে?”
মার্জিয়া বেগম হালকা করে মাথা নেড়ে বললো,”তুমি যা সন্দেহ করেছো ঠিক তাই। উচ্ছ্বাসের মা নীলিমার সাথেই প্রেম ছিলো তোমার বাবার।”
মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে প্রিয়তার। কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চায়না সে এই কথা। এমন কিছুই কখনো মনে হয়নি তার বাবার কোনো ব্যবহারে।
“কলেজ জীবন থেকেই দুইজন দুইজনকে ভালোবাসতো। এরপর হঠাৎই নীলিমা হারিয়ে যায়। তোর বাবা খোঁজ নিয়ে দেখে উচ্চমাধ্যমিকের পরেই নীলিমাকে বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। তোর বাবাকে জানাতে পর্যন্ত পারেনি সে। তখন থেকেই মানুষটা একটা ভগ্ন হৃদয় নিয়ে বেঁচে ছিলো। এরপর অনেক বছর পর হঠাৎ করেই আবার যোগাযোগ হয় নীলিমার সাথে। এই শহরে নতুন এসে তোর বাবা দিশা পাচ্ছিলো না। এমন সময় নীলিমা আবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো। ওখানেই তোর বাবা ছিলো বেশ কয়েক মাস। এরপর চাকরি পাওয়ার পর ওই বাড়ি ছেড়ে দেয় সে। যদিও সে ও বাড়িতে কখনোই থাকতে চায়নি। কিন্তু তার কাছে আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। বৃদ্ধ বাবা মা অসুস্থতায় জর্জরিত গ্রামের বাড়িতে। ছোট তিন ভাইবোন। তারা সবাই বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে শহর থেকে কিছু পাঠাতে পারলেই খেতে পারবে। তাই বাধ্য হয়ে নীলিমার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয় তাকে।”
মার্জিয়া বেগম থামে। জোরে জোরে শ্বাস পড়তে থাকে তার। প্রিয়তা স্তম্ভিত হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তার এখন কি বলা উচিত সে বুঝতে পারছে না।
“মা।
মার্জিয়া বেগম হালকা হেসে মেয়ের দিকে তাকায়।
“তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”
মার্জিয়া বেগম দুই হাত মেলে দেয়। প্রিয়তা ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকের উপর। মায়ের বুকে মাথা দিয়ে যেনো তার ভিতরের কষ্ট টুকু টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে।
“তোমার কি খুব কষ্ট মা?”
মার্জিয়া বেগম শব্দ করে হেসে দেয়।
“কে বলেছে আমার কষ্ট? তোর বাবা আমাকে এই ভাঙা ঘরেও রানী করে রেখেছে। কখনো বুঝতে দেয়নি আমি তার জীবনের দ্বিতীয় নারী। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়েছে কোথাও যেনো সুরটা ঠিক নেই। পুরুষের প্রথম প্রেম হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ পুরুষ তার প্রথম প্রেমকে কোনোদিন ভুলতে পারেনা। তোর বাবাও হয়তো পারেনি। তাই তো, তাদের অবর্তমানে আমার নিষেধ সত্ত্বেও উচ্ছ্বাসকে নিজের কাছে এনে রেখেছে। হয়তো উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে সে নীলিমাকে দেখতে পায়।”
প্রিয়তা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মা কে। তার চোখের উষ্ণ পানি টের পায় মার্জিয়া বেগম তার বুকে।
“তোর বাবা একজন অসাধারণ মানুষ রে। আজকের পর যেনো তার উপর তোর সম্মান এতোটুকুও কমে না যায়, এই আদেশ আমার থাকবে। মানুষটা সারাটা জীবন অনেক কষ্ট করেছে। সংসারের কিছু অতিরিক্ত আয়ের জন্য স্কুল ছুটির পর টিউশন করেছে। তার দুই মেয়ে তার চোখের মণি।”
প্রিয়তার মায়ের উপর থাকা সব রাগ, সব অভিমান গলে যেতে থাকে। এক তিক্ত সত্যের মুখোমুখি আজ সে হয়েছে। হজম করতে পারছে না সে। আচ্ছা উচ্ছ্বাস ভাই কি এগুলো জানে?
“এই কথাগুলো তোদের আমি কোনোদিন জানাতে চাইনি। আজ কেনো জানালাম জানিস? আমি চাইনা আমার জীবনটা যেমন সঙ্কোচে কেটেছে। সবসময় মনে হয়েছে আমি আমার জীবনের প্রথম পুরুষের দ্বিতীয় নারী। আমি চাইনা আমার মেয়েদের জীবনটা এভাবে কেটে যাক। যে পুরুষটাই তোদের জীবনে আসুক না কেনো, তাদের জীবনে যেনো তোরাই প্রথম নারী হোস। জীবনের বড় সিদ্ধান্ত গুলো নেওয়ার আগে অনেক বার ভাবতে হবে। হয়তো-বা যে মানুষটাকে আপাত দৃষ্টিতে অসাধারণ কেউ মনে হচ্ছে, সে মানুষটা হতেও পারে তেমন না। তোর বয়সটা এমনই। এই বয়সে হেমলক নামক বিষটাও অমৃত মনে হয়। আমি তোর জীবনের সুখের বাঁধা হতে চাইনা। কিন্তু মা হিসেবে তোকে কিছু উপদেশ তো দিতে পারি, তাইনা?”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে ধরে। মা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে সে ভালো করেই বুঝতে পারে।
“কেউ যদি নিজে থেকে চলে যেতে চায়, তাকে যেতে দে। আটকে রাখার চেষ্টা করিস না। যদি নিজেকে প্রমাণ করতে পারে, তবে সে হবে তোর জন্য খাঁটি পুরুষ। মন খারাপ করে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে ভালোবাসা আটকে রাখা যায়?”
প্রিয়তা ছটফট করছে ভিতর ভিতর। অস্থির লাগছে তার পুরো শরীর জুড়ে।
“মারে, জীবনটা এটা নয় যে তুই যেটা সামনে দেখতে পাচ্ছিস। জীবনটা আরো অনেক বড়। আর নারীর মন? সে যে অনেক সাধনার বস্তু। এতোটাও সস্তা করে দিস না নিজেকে।”
প্রিয়তাকে চুপ থাকতে দেখে মার্জিয়া বেগম ম্লান হাসে। মেয়ের ভিতর এখন কি তাণ্ডব চলছে সে ভালো করেই বুঝতে পারছে। ভয়ংকর একটা সময় পার করছে মেয়ে। এখনই লাগাম না টানলে জোরেসোরে একটা ধাক্কা খাবে অচিরেই।
“ঘুম পেয়েছে নিশ্চয়ই অনেক? ঘুমিয়ে পড়। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মায়ের কাছে সব মন খারাপের ওষুধ আছে। দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে।”
প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো,”তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো মা।”
দুইজনই চুপচাপ শুয়ে পড়লো। কিন্তু কেউ জানলো না দুইজন অসমবয়সী নারী পাশাপাশি শুয়ে একটা নির্ঘুম রাত পার করলো। আবার হয়তো-বা তারা জানে তারা দুইজনই আজ জেগে। দূরে একটা রাত জাগা পাখি ডাকতে ডাকতে চলে যায়। ঝড়ে আটকে থাকা পাখি পরিবারের কাছে যেতে মরিয়া। পরিবার যে এক ভয়ংকর মায়ার জায়গা।
“ভাই এতো রাতে ডেকে পাঠালেন যে? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
উচ্ছ্বাস সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।
“ভাই আগে তো এভাবে সিগারেট খেতেন না। হঠাৎ এমন নেশা হয়ে গেলো এটা আপনার?”
উচ্ছ্বাস বিরক্ত হয়ে বললো,”সেসব তোমার না জানলেও হবে। তোমাকে যে কাজের জন্য বলেছি তার খবর জানাও।”
ছেলেটা ইতস্তত করে বললো,”আপনার মেজো চাচা রোজ রাত এগারোটায় ওদিকের মাছের বাজার সংলগ্ন রাস্তা হয়ে বাড়ি ফেরে। অতো রাতে তেমন মানুষ থাকে না ওখানে। বলতে গেলে ফাঁকাই থাকে রাস্তা।”
উচ্ছ্বাসের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।
“বাকিদের খবর বলো।”
“আপনার সেজো চাচার খবর সঠিক বলতে পারবো না এখনো। উনি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বাড়ি ফেরে। কখনো রাত দশটা আবার কখনো সন্ধ্যা সাতটা। কিন্তু আপনার ছোট চাচার ব্যাপারে দারুণ একটা খবর দিতে পারি।”
“কি?”
ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার আওয়াজ নামিয়ে বললো,”উনার নারীঘটিত অভ্যাস আছে। প্রায়ই একটা মহিলার সাথে একটা ফাঁকা ফ্লাটে যেতে দেখা যায় তাকে। আমার মনে হয় ওই সময়টাই আপনার জন্য সুবর্ণ সুযোগ হবে।”
উচ্ছ্বাস ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,”খুব ভালো, খুব ভালো।”
ছেলেটা মাথা নিচু করে বললো,”ভাই যদি বেয়াদবি না নেন একটা কথা বলি?”
“কি কথা?”
“আপনার মতো তুখোড় একজন ছাত্র, এভাবে জীবনটা শেষ করে দিবেন? আরেকটু ভাবলে হতো না? যারা যাওয়ার তারা তো চলেই গেছে। সম্পত্তি তো এখনো আপনার হাতেই আছে। আপনি চাইলেই ওদের ভোগদখল থেকে সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবেন…..”
উচ্ছ্বাস চোখ তুলে তাকাতেই ছেলেটা ভয়ে থেমে যায়।
“বেয়াদবি নিবেন না ভাই। আপনার জন্য আমার কষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কাছের ভাই আপনি আমার। আপনার মতো এমন উজ্জ্বল নক্ষত্র আমি কমই দেখেছি। আপনার জীবনটা এভাবে শেষ হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। কি চমৎকার গান করতেন আপনি অনুষ্ঠানগুলোয়। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আপনি সেবার লাল পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন পহেলা বৈশাখে। টিএসসিতে বসে আমাদের গান করে শুনিয়েছিলেন। মোর্ত্তজা স্যার বলেছিলেন, রাজপুত্র। সেই আপনি এভাবে ঝরে পড়ে যাচ্ছেন৷ তিলে তিলে আপনাকে শেষ হতে দেখতে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে আমার।”
উচ্ছ্বাস খোলা গলায় হাসে। ছেলেটার নাম মিথুন। উচ্ছ্বাস মিথুনের কাঁধে হাত রাখে।
“আমার জীবনটা আর আগের মতো নেই মিথুন। একটা কালবৈশাখী ঝড় এলোমেলো করে দিয়েছে সবকিছু। আমি আমার বুকের ভিতরটা কাউকে দেখাতে পারছি না। যতোদিন না পর্যন্ত আমি প্রতিশোধ নিতে না পারছি আমার র ক্ত ঠান্ডা হবে না। প্রতি রাতে আমার শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দুর তেজ আমাকে ঘুমাতে দেয়না। আর জীবনের কথা বলছো? জীবন তো সেদিনই আমার শেষ হয়ে গেছে, নতুন করে আর কি হবে?”
মিথুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
উচ্ছ্বাস রাস্তায় নেমে পড়ে। সিগারেট বের করেও ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। মুখটা কেমন তেতে আছে তার। কিছুই ভালো লাগছে না। এক রমনীর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা শান্তি খুঁজে পেয়েছিলো সে। অনেকটা অমাবস্যার রাতে দূরের কোনো তারা জ্বলজ্বল করে অন্ধকার কাটানোর বৃথা চেষ্টা করার পর। ডুবন্ত মানুষ কচুরিপানা আঁকড়ে হলেও বাঁচতে চায়। তার অবচেতন মন কোনোভাবে ওই কিশোরীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো। কিন্তু তা কি আর সম্ভব? কখনোই সম্ভব না।
ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। উচ্ছ্বাস ঠিক করে বাকিটা রাত সে রাস্তাতেই কাটাবে। রাতের সৌন্দর্য দেখবে। ঝড়ের পর শীতল আবহাওয়ায় হাঁটতে ভালো লাগছে তার।
যতোবার ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ততবার এক অষ্টাদশী কিশোরীর মুখ ভেসে আসছে তার চোখের সামনে। যে বন্যার মতো উত্তাল হয়ে ছুটে আসছে তার কাছে। কিংবা কখনো দীঘির টলটলে পানির মতো শান্ত। যার দুই চোখে সাতটা মহাদেশের মানচিত্র যেনো কেউ নিপুণ তুলির আঁচড়ে এঁকে দিয়েছে। যার গজদন্তের হাসি বারবার উচ্ছ্বাসের শক্ত প্রাচীর ভেঙে চলে অবিরত।
ভোরের আগেই দূর থেকে একটা চায়ের দোকান খোলা দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বাস যায় সেদিকে।
“এক বোতল পানি দাও।”
চায়ের দোকানদার কথা না বলে পানির বোতক এগিয়ে দেয়।
উচ্ছ্বাস ঢকঢক করে প্রায় সবটুকুই এক নি:শ্বাসে খেয়ে ফেলে। হৃদয়টা শুকনো মরুভূমির মতো খা খা করছে তার। কোনোভাবেই তৃষ্ণা মেটে না তার। বাকি পানিটুকু মাথায় ঢেলে দেয় সে। ভেজা চুলগুলো চুইয়ে পানি পড়তে থাকে।
উচ্ছ্বাস বোতল এগিয়ে দেয়।
“ফিরে যাও ভাগ্নে, ফিরে যাও।”
উচ্ছ্বাস এদিক ওদিক তাকিয়ে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমাকে বলছো?”
“তোমারেই বলতেছি ভাগ্নে। তার উপর রাগ করে থেকো না। মেয়েরা হলো এই মনে করো পদ্মফুলের মতো। যতো যত্ন করবা, তত পাপড়ি মেলতে থাকবো। যত্ন করবা না, শুকাইয়া মরে যাবো। তাই সময় থাকতেই ফিরে যাও। নিজেও কষ্ট পেয়ো না, তারেও কষ্ট দিও না। যাইয়া দেখো সে-ও রাইত জেগে বসে আছে তোমার জন্য।”
উচ্ছ্বাস হতভম্ব হয়ে বললো,”কি বলছেন আপনি এসব?”
দোকানদার হাসতে হাসতে বললো,”এই সময় সব প্রেমিকগুলোই আমার দোকানে আসে। আগের রাতে প্রেমিকার সাথে ঝামেলা করে, সারারাত রাত জেগে রাস্তায় হাঁটে। ভোরবেলা আমার দোকানে আইসা পানি খায়। আমি সবাইরে ফিরে যেতে বলি। নারীর মন, সে বড় অমূল্য ধন। পাইলে হাত ছাড়া কইরো না ভাগ্নে।”
উচ্ছ্বাস পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। দোকানদান জোরে গান ধরে,’তোমার বাড়ি রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কপ, বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না।’
অন্ধকার ভেদ করে তখন কেবলই আলো ফুটছে, এদিকে খোলা গলার গান। উচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে এক নতুন সূর্যোদয় দেখে।
(চলবে…..)