#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৯
“বাড়িতে ডা’কাত পরেছে৷” এটা ছিলো ঘটনার সূত্রপাত। দরজার ওই পাশের ব্যক্তিটিকে চরম বিরক্তিতে ফেলে রাশা বেশ কনফিডেন্সের সাথে ঘোষণা করলো,
–বাড়িতে ডা’কাত পরেছে। আমি স্পষ্ট শুনেছি।
রাত বাজে তিনটা৷ কলিংবেলের শব্দ সর্বপ্রথম রাশার কানে যায়। তারপর থেকেই ড্রয়িংরুমে এসে বসে আছে৷ একে একে সবাই এসে জড়ো হলেও সে কাউকে দরজা খুলতে দেয়নি। সবার মধ্যে একমাত্র বন্যাই রাশার কথায় অতিরিক্ত ভয় পেয়েছে। দুই বেনি করা চুলে হাত পেঁচিয়ে ভয়ার্থ গলায় বললো,
–বাড়িতে ডা’কাত কি কলিংবেল দিয়ে আসে?
রাশা মাথা হেলিয়ে সায় জানালো। দিলো এক ভয়ংকর তথ্য,
–আজকালকার স্মার্ট ডা’কাতরা কলিংবেল দিয়েই আসে৷ দরজা ভাঙার এনার্জি অন্যান্য কাজে লাগায়। আমাদের একটা মেড ছিলো। তার গ্রামে এমন ডা’কাতি হয়েছিলো। সবার হাত পা বেঁধে পুরো বাড়ির জিনিসপত্র ডাকাতি করেছিলো৷ ফার্নিচারগুলো খুলে খুলে ট্রাক ভর্তি করে ফেলেছিলো৷ রান্নাঘরের র্যাশন পর্যন্ত ছাড়েনি।
ময়না আতকে উঠলো৷ তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে৷ রাশার দেওয়া গহনাগুলোর কথা সর্বপ্রথম মাথায় আসলো। ওগুলো লুকাতে পারলে ভালো হতো। তবে গল্পটার শেষটাও জানা জরুরি। তাহলে ভালো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। তাই জিজ্ঞাসা করলো,
–কি সাংঘাতিক ডা’কাইত ভাবি!! তারফর কি হইলো?
রাশা কাঁধ নাচিয়ে ঠোঁট উলটে বললো,
–তারপর আর কি? সকালে দেখা গেলো, বাড়ির সবাই ফাঁকা ঘরে হাত পা বেঁধে পরে আছে। সে এক সাংঘাতিক ঘটনা!
সবার রিঅ্যাকশন জানা হলো না। তার আগেই উষির দ্রুত বেগে সিঁড়ি দিয়ে নামলো। লিভিংরুমে সবাইকে দেখে খানিক থমকালো। তারপর বিরক্ত নিয়ে বললো,
–সবাই এখানে মিটিং করছো আর কেউই দরজা খুলছো না? আবার ফোনও ধরছো না। উজান কখন থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ফোন করতে করতে শেষ! দরজা খোলা বাদ দিয়ে কি এখানে সিরিয়ালের রিহার্সাল করছো?
শাহিদা রাশার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রাগী গলায় বললো,
–যেখানে তোর বউ আছে সেখানে সিরিয়ালের রিহার্সাল না হয়ে উপায় আছে? তার বাবার বাড়ি থেকে পাঠানো ডা’কাত পরেছে বাড়িতে। দরজা খোলা মানা।
রাশা চোখ বড় বড় করে শাহিদার দিকে তাকালো। আফসোস করে বললো,
–কি মিথ্যা কথা খালাম্মা! এতো মিথ্যা বলতে আত্মা কাঁপলো না?
উষির আরো বিরক্ত হলো। দরজার কাছে যেতে যেতে মায়ের কথার প্রতিউত্তর করলো,
–ডা’কাত কলিংবেল দিয়ে আসে?
দরজা খুললো উষির৷ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা চওড়া এক সুদর্শন পুরুষ। স্কাই ব্লু রঙা শার্টের উপর নেভি ব্লু রঙের ওয়েস্ট কোট পরা। একই রঙের কোট আর প্যান্ট। ডান হাতে লাগেজ আর বাম হাতে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই লাগেজের উপর থেকে কোট তুলে হাতে নিলো৷ তারপর ভেতরে প্রবেশ করতেই রাশার প্রশ্নের মুখোমুখি হলো,
–তোমাকে কি আমি চিনি?
উজান থমকালো, হকচকালো। একপলক বাড়ির সকলের দিকে তাকিয়ে উষিরের দিকে তাকালো৷ তারপর আমতা-আমতা করে বললো,
–মেবি না।
রাশা উত্তরে যেনো বেশ শান্তি পেলো। পেছন ঘুরে বাড়ির সবার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে ভাষণ দেওয়ার মতো করে বললো,
–দেখেছো, বললাম না ডা’কাত পরেছে? অপরিচিত মানুষকে ডা’কাত বলবো না তো আর কি বলবো? পরিচয় তো জানি না। আর, এক তো তোমাদের বাড়ির কাজ কারবার! কেউ নিজের পরিচয় দিতেই চাও না। আরে বাবা, পরিচয় না দিলে আমি জানবো কিভাবে কে আমার কি হয়? এই যেমন ছোট কাকি। যদি ওনার পরিচয় আমার বুদ্ধি দিয়ে না বুঝতাম তাহলে তো আপু ডেকে বসতাম আর খালাম্মাকে বড় আপু ডাকতে হতো।
রাশার কথায় দুই শাশুড়িকে স্পষ্ট পটানোর চেষ্টা ছিলো৷ তবে কেউ-ই পটলো না। মাহফুজা ছেলের এহেন অবস্থা দেখে বেশ রেগে ছিলো। আরো রেগে বললো,
–নিজের গাধামিকে ঢাকতে আর কতগুলো গাধার মতো কথাবার্তা বলবে?
রাশা একটু থামলো। চোখ পিটপিট করে ইতিউতি তাকিয়ে নরম গলায় বললো,
–নিজের কনফেসে সব বলা যায়৷ বিশ্বাস করা না করা তোমাদের ব্যাপার।
তারপর সটান উজানের দিকে ঘুরলো। উজান তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। নিজের হকচকানো ভাবটা এখনও হজম হয়নি। তার উপর রাশা পুনরায় তাকে শাসিয়ে বললো,
–তোমার জন্যই আমাকে এতোগুলো কথা হজম করতে হচ্ছে৷ এখন নিজের পরিচয় আমাকে দেবে কি না সেইটা বলো?
উজান বেশ সময় নিয়ে বললো,
–আম-আমি আজলান কায়সার৷ উষিরের ছোট ভাই।
রাশা বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে শাহিদাকে বললো,
–তোমার আরেকটা ছেলে আছে আন্টি? একবারও বলার প্রয়োজন মনে করলে না? ছি ছি ছি! সেম অন ইউ! মনে বড্ড কষ্ট দিলে।
বেশ দুঃখী হলো সে। মুখটা করুন করে ফেললো। উজান ব্যাপারটা সমাধান করতে চাইলো,
–না না, আপনি ভুল বুঝছেন ভাবি। উনি আমার বড় মা। আমি উষিরের কাজিন হই, চাচাতো ভাই।
রাশা মুখ বিকৃত করে বললো,
–আপনি! ভাবি! ইসস! কি জঘন্য লাগছে শুনতে। ভাবি শব্দটা শুনলেই মাথায় সর্বপ্রথম একটা জিনিসই আসে। ফ্লার্টার দেবর!
উজান তাজ্জব বনে গেলো। বৃষ্টি আর বন্যা ইঁচড়ে পাকাদের মতো মুখ টিপে হাসলো। মাহফুজা অনেক্ষন সহ্য করে আর পারলো না। থমথমে গলায় উজানকে বললো,
–উজান, তুই ফ্রেশ হতে যা। আমি খাওয়ার জন্য কিছু বানাচ্ছি।
মাহফুজার কথা শুনে রাশা চোখ বড় বড় করে বিষ্ময়ে বললো,
–তোমার নাম উজান!
পরক্ষণেই ফিঁক করে হেসে ফেলে বললো,
–কার গাঙের উজান তুমি? কাকে ছ্যাঁকা দিয়ে ভাসিয়ে অন্য জায়গায় দিয়ে এসেছো?
উজান কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বের হলো,
–হ্যাঁ?
রাশা বুঝানোর মতো করে বললো,
–আরে একটা গান আছে না,
উজান গাঙে নাও ভাসাইয়া বন্ধু গেলা কই
দিয়া গেলা প্রানে ব্যাথা কেমন করে সই..
বৃষ্টির গানের গলা দারুন ছিলো। রাশার কবিতার তালে বলা লাইনগুলো বেশ রসিয়ে কষিয়ে সুর ধরে গাইতে লাগলো।
উষির অনেকক্ষণ এই মেলোড্রামা সহ্য করে উজানের কাঁধ চাপড়ে বললো,
–বেস্ট অফ লাক ভাই।
বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো৷ উষির চলে যেতেই এতোক্ষণ ধরে চলা আসরটা ভেঙে খানখান হয়ে গেলো৷ একে একে সবাই চলে যেতে লাগলো। রাশা অবাক হয়ে বললো,
–দেখেছো, বিপদে কিন্তু এই রাশাই সবার কাজে আসে। ছেলেটা না জানি কোথা থেকে এতোদিন পর বাড়ি ফিরলো আর কারো কোন গুরুত্বই নাই! তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি তোমার জন্য আজ রান্না করবো।
উজান নরম গলায় বললো,
–লাগবে না ভাবি। আমি ফ্লাইটে খেয়েছি৷ আর ক্ষিদে নেই।
রাশা বিরক্ত হলো। বললো,
–নো ভাবি টাবি! তোমার থেকে কত ছোট আমি! এই বয়সে আমি তোমার মতো হ্যান্ডসামের ভাবি হতে পারবো না। আমাদের চেয়ারার কি মিল দেখেছো? বোধহয় তুমি আমার বড় ভাই-ই হবে। আন্টি হয়তো তোমাকে চুরি করে এনেছে। অবশ্য ভালোই করেছে৷ আমাকেও চুরি করা উচিৎ ছিলো! যাই হোক, ইট’স মাই ব্যাড লাক!
উজান হেসে ফেললো। বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,
–থ্যাঙ্কিউ, আমার তিন নাম্বার বোন রাশা৷ আজকে আমাকে এতো স্পেশাল ভাবে ওয়েলকাম করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি এখন কিছুই খাবো না। এখন তুমি আমার বোন জামাইয়ের কাছে যেতে পারো।
রাশাও উজানের পথ অনুসরণ করে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে এক হাত বুকে রেখে একটু ঝুঁকে বললো,
–ইট’স মাই প্লেজার ভাইয়া। গুড নাইট।
চলে গেলো রাশা। উজান জ্বলজ্বলে চোখে রাশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো৷ মুখে এক চিলতে হাসি৷ এই প্রথমবার জার্নি করে এসে একটুও ক্লান্ত লাগছে না। মনটা এতো ভালো হয়েছে, যেটা বলার বাইরে!
***
প্রতিদিনের মতোই রাশার সকাল শুরু হলো অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভেঙে৷ উষির আজকে পাশে নেই। অনেক আগেই উঠে পরেছে৷ রাশা বেশ জানে, উষির ভোর ভোর উঠে এক্সারসাইজ করতে গেছে৷ সৌন্দর্য ধরে রাখতে হবে তো৷ নাহলে তো ভোট পাবে না৷ মুখ বাঁকালো রাশা। বিড়বিড় করে বললো,
–যেই আমার চেহারা, নাম তার পেয়ারা আলী!
বলেই ফিক করে হেসে উঠলো৷ পেয়ারা আলী নামটা বেশ সুন্দর৷ উষিরের সাথে একদম মানানসই। রাশা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, উষিরকে পেয়ারা আলী বলেই ডাকবে। সকাল সকাল এহেন সিদ্ধান্তে মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে গেলো৷ ফুরফুরে মেজাজেই রান্নাঘরে গেলো৷ এখন থেকে তার ডিউটি শুরু৷ আজকে প্লেটের সাথে একটা গ্লাস আর চামচও পরিষ্কার করলো৷ সময় নিয়ে আস্তে আস্তে শসাও কাঁটলো। তারপর শসা খেতে খেতে দুধও জ্বাল দিলো। সবশেষে ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে রান্নাঘর ঝাট দিলো৷ তারপর কাজ শেষ করে হাঁপ ছাড়লো।
রাশার কাজের বিহাইন্ড দ্যা সিনও আছে। ময়না থালাবাসন মাজছিলো। রাশা গিয়ে মাজা প্লেট, গ্লাস আর চামচ পুনরায় পানি দিয়ে ধুরে রাখলো৷ শসা স্লাইস করে কাঁটা ছিলো। সেই স্লাইসের মধ্যে দিয়ে আরেকবার ছুড়ি চালিয়ে আবার কাঁটলো সে। মাহফুজা দুধ জ্বাল দিচ্ছিলো। রাশা গিয়ে দুধে এক চামচ চিনি মিশিয়ে দুইবার চামচ নাড়লো। চিনি গললো নাকি বোঝা গেলো না৷ এরপর টেবিল মোছার পালা। টেবিলের এক কোনায় পানি পরে ছিলো একটু। সেটুকুই মুছলো সে। রান্নাঘরের ফ্লোরে পরে থাকা অল্প ময়লা ঝাটা দিয়ে ঝাট দিয়ে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দিলো।
সব কাজ শেষে টেবিলে চেয়ার টেনে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। গ্লাসে পানি ঢেলে বললো,
–কত কাজ করলাম আজকে! এতো কাজ ডেইলি করলে বাড়ি বাড়ি কাজ করার বিজনেসটা শুরু করে ফেলবো।
রাশার কাজের ধরনে রাগে ফুঁসছিলো শাহিদা। একসময় ঝাঁজালো স্বরে বললো,
–এসব আর কতদিন চলবে?
রাশা অবুঝের মতো বললো,
–কোনসব?
শাহিদা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–এই কাজের নাটক।
রাশা আফসোসে মাথা নাড়লো। বললো,
–আ’ম সরি খালাম্মা, বাট তোমার অ্যাগ্রিমেন্টে কাজের পরিমাণটা হাইলাইট করা উচিৎ ছিলো। আমি তোমাকে বলেছিলাম, কিছু লেখার হলে লিখে নাও। তুমি সুযোগ মিস করেছো। এখন কিছুই করার নাই।
–তোমার কিছুই করতে হবে না। এমনিতেই মাস শেষে বিশ হাজার দিয়ে দেবো।
–না না খালাম্মা। আমি আমার কথায় একদম পাক্কা। শুয়ে বসে টাকা ইনকাম করে নিজের সম্মান হারাতে চাই না।
ময়না ফিক করে হেসে ফেললো। মাহফুজা আর শাহিদার চোখ গরম উপেক্ষা করে বললো,
–ভাবি, আমারেও একখান ওই কাগজ দিয়েন। কাম করতে করতে মাথার ঘাম পায়ে পরে। তাও কাম শেষ হয় না। ওই কাগজ থাকলে কাম একটু কম করা লাগতো।
রাশা মাথা দুলিয়ে বিজ্ঞের মতো বললো,
— লাভ হবে বলে মনে হয় না। উল্টে আরো বেশি কাজ করা লাগতে পারে। রিস্কি হয়ে যাবে খুব।
আহত হলো ময়না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিলো। উজান আর উষির দুজনেই এক সাথে খেতে আসলো। দুজনেরই পরনে ঘরে পরার টি-শার্ট আর ট্রাইজার। তাদের দেখে চকিতে উঠে দাঁড়ালো রাশা। শাহিদা বিরক্ত হয়ে বললো,
–উঠলে কেনো? খাওয়া দাওয়া করা লাগবে না নাকি?
রাশা হকচকিয়ে গেলো। তার বাড়িতে ছেলে আর মেয়েদের একসাথে খাওয়া নিষেধ। আগে ছেলেরা খেয়ে উঠে গেলে তারপর মেয়েরা খায়। এই বাড়িতে আসার পরে শাহিদা, মাহফুজার সাথেই খেতে বসেছে। তাই ভেবেছে এখানকারও একই নিয়ম। একটু দোনোমনা করে বললো,
–একসাথেই খেতে বসবো?
–তা নয়তো কি? খাওয়া তো খাওয়াই৷ এতো বাছবিচার করার কি আছে?
উজান হাত টেনে রাশাকে নিজের পাশের চেয়ারে বসালো। বললো,
–তুমি বসো তো রাশা। দেখি আজকে কি কি রান্না হয়েছে।
রাশা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
–আমিও রান্না করেছি ভাইয়া।
মাহফুজা রাগ নিয়ে বললো,
–বড় ভাইয়ের বউ তোর। নাম ধরে কেন ডাকছিস?
উজান ভ্রু বাঁকিয়ে জবাব দিলো,
–কে বড়? উষির? মাত্র তিন মাসের বড়। ওকেই ভাই বলি না আর ওর বউকে ভাবি ডাকবো? দেখো, আমাদের চেহারার কতো মিল? আমরা তো ভাই বোন হওয়ার যোগ্য।
মাহফুজা থমথমে গলায় রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে ছুটলেন। শাহিদাও রান্নাঘরে গেলো। এই দুইজন এক হলে তাদের মাথা খারাপ হতে বাধ্য, সেটা তারা বেশ বুঝেছে।
উজান কৌতুহল নিয়ে রাশাকে প্রশ্ন করলো,
–কি রান্না করেছো?
–দুধ জ্বাল দিয়েছি।
মাহফুজা পেছন থেকে ফোঁড়ন কাটলো,
–দুইবার হাত নেড়েছো। জ্বাল দাওনি।
রাশা ফোস করে শ্বাস ফেলে উজানের কাছে অভিযোগ করলো,
–এরা আমার কাজ এতো হিংসা করে ভাইয়া! কাজের কোন দামই দিতে চায় না।
উজান রাশাকে শান্তনা দিয়ে বললো,
–আমি এসেছি না? এখন সবাইকে ঠিক করে ফেলবো।
রাশা হিহি করে হেসে ফেলে। পরক্ষণেই তার ফোনে কল আসে। মুখশ্রী গম্ভীর হয়ে যায়। ফোন হাতে উঠে চলে যায়। তীক্ষ্ণ চোখে ব্যাপারটা দেখে উষির। আর উজানের দৃষ্টি থাকে উষিরের দিকে। রাশা ফিরতেই উষিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
–তোমাদের এখানে কোর্ট কোথায়?
উষির সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো,
–কেনো?
রাশা রুটি ছিড়ে মুখে পুরলো। চিবোতে চিবোতে বললো,
–তোমার নামে হ্যারেজমেন্টের কেস করবো। তাই একটু খোঁজ দরকার। তারিখে তারিখে হাজিরা দিতে হবে তো।
উজানের বিষম উঠে গেলো। উষির দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–বলবো না। খুঁজে দিও।
রাশা বিরক্তিকর শব্দ করে বললো,
–কিসব বাচ্চাদের পাল্লায় যে পরলাম!
উজান হাসতে নিয়েও হাসলো না। উলটে রাশাকে ভরসা দিয়ে বললো,
–আমি নিয়ে যাবো। কোন সমস্যা নেই।
রাশা মাথা হেলিয়ে সায় জানালো। তার মুখ এখনও গম্ভীর, চিন্তিত। উষির গভীর চোখে দেখছে সেটা। উজান মিটিমিটি হেসে বিড়বিড় করলো,
–তুমি তো ফেঁসেছো ভাইজান। একেবারে ধপাস!
চলবে…
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১০
আলাদত চত্ত্বরে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। এই ভিড়ের মাঝে নির্দিষ্ট মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। উত্তপ্ত রোদেও সৌরভ ঠিকি রাশাকে খুঁজে নিলো। রাশা নিজের কাজ শেষে আদালতের ভেতর থেকে বের হচ্ছিলো। পরনে শুভ্র রঙা সালোয়ার সুট। কাঁধে কালো লেদারের হোবো ব্যাগ। চুলগুলো পনিটেল করে রাখা৷ হাতে নীল রঙা ফাইল নিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছে। সৌরভ পিছু ডাকলো,
–রাশা!
রাশা থমকালো, হকচকালো। গলাটা পরিচিত ভীষণ। কপাল কুঁচকে পেছন ঘুরলো। সৌরভকে দেখে কুঁচকানো কপাল সোজা হলেও সেখানে বিরক্তি ফুটে উঠলো। সৌরভ মলিন এসে এগিয়ে আসলো। নিষ্প্রভ স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
–কেমন আছো?
রাশা গভীর শ্বাস ফেললো। ছেলেটা এখনও পিছু ছাড়েনি! কিছু কড়া কথা শুনাতে চাইলো। কিন্তু সৌরভ ভীষণ নরম মনের মানুষ। কিছু করে টরে বসলে আবার সমস্যা হয়ে যাবে। তাই হাসিমুখেই খোঁচা মারলো,
–খুব সুখে আছি। শান্তিতে সংসার করছি।
সৌরভ আহত হলো। নীরস গলায় বললো,
–তোমার কি একবারও আমার কথা মনে পরেনি?
–না।
রাশার কঠিন জবাবের সৌরভের তীর বিদ্ধ করার মতো কষ্ট হলো। চোখ বুজে নিজেকে সামলালো। বিষন্ন স্বরে বললো,
–তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি রাশা। তুমিও তো আমাকে ভালোবাসতে।
রাশা হাত ভাজ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ফাইল বুকের সাথে চেপে ধরে আছে। সৌরভের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললো,
–রং। তোমাকে আমি ভালোবাসতাম না। সেই কথা এর আগে অনেকবারই বলেছি। এটাও বলেছি যে, আই ডোন্ট বিলিভ ইন লাভ। এনি কাইন্ড অফ লাভ! অবশ্য এটা তোমার মাথায় ঢোকার কথাও না।
এনি কাইন্ড অফ লাভ বাক্যটা বেশ জোরের সাথে বললো রাশা। সৌরভ আরেকটু এগিয়ে রাশার হাত ধরতে চাইলো। রাশা দুই পা পিছিয়ে গেলো। লজ্জিত হলো সে৷ ভেজা স্বরে অনুরোধ করলো,
–ফিরে এসো প্লিজ। আমি জানি, তুমি ওইদিন ইচ্ছে করে ওসব করোনি। এর ভেতর কোন না কোন ঘটনা আছেই আছে। আই ট্রাস্ট ইউ। নিজের থেকেও বেশি ট্রাস্ট করি তোমাকে। ওই ওই ছেলেটা তোমাকে ফাঁসিয়েছে না? আমি জানি সব। ভেতরে ভেতরে তো এসব চক্রান্তই চলছিলো।
রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেললে বলো,
–চলো, বসে কথা বলি।
সৌরভের মুখ উজ্জ্বল হলো৷ পাশাপাশি হেঁটে আদালত চত্ত্বরে থাকা একটা টি-স্টলে বসলো। আশেপাশে অনেক উকিল, বাদী ঘোরাফেরা করছে। কিছু বসে আলোচনাও করছে। রাশা আর সৌরভ যে স্টলে গিয়ে বসলো, সেখানে আগে থেকেই দুইজন বসে ছিলো। তাদের বসতে দেখে উঠে চলে গেলো। রাশা সেদিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সৌরভকে প্রশ্ন করলো,
–তুমি এখানে কেনো এসেছো?
সৌরভের দৃষ্টি রাশার দিকে ছিলো। মুগ্ধ সেই দৃষ্টি মাঝে মাঝেই ঘোলা হয়ে উঠছে৷
–তোমার সাথে দেখা করতে। প্রতিদিনই আসি, জানো? আমি জানতাম, তুমি একদিন না একদিন এখানে অবশ্যই আসবে।
চকিতে সৌরভের দিকে তাকালো রাশা। সৌরভ দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। দুই কাপ চা এসে দিয়ে গেলো। দুজনের জন্যেই কড়া লিকারের আদা চা এসেছিলো। রাশা হাতে নিলো। প্লাস্টিকের কাপ ধরা মুশকিল। সৌরভ আর তার মাঝখানের ফাঁকা জায়গা কাপটার নতুন অবস্থান হলো। রাশা কাপের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে সৌরভকে বুঝাতে চাইলো,
–লিসেন সৌরভ, তোমাকে কিছু কথা বলি। মন দিয়ে শোনো। প্রতিটা মানুষের একটা পারসোনালিটি থাকা উচিৎ। নিজেকে নিজের সম্মান করা উচিৎ। নিজেকে নিজে সম্মান করলে তবেই অপরের থেকে সম্মান পাওয়া যায়। তুমি নিজেকে এক ফোঁটাও সম্মান করো না৷ তাই তোমাকে দেখলে আমার একটুও সম্মান আসে না। মায়ের আঁচলের তলায় আর বাপ ভাইয়ের ছায়ার তলায় ঢুকে আর কতদিন থাকবে? গ্রো আপ ম্যান। ইট’স ইয়োর লাইফ। নিজের লাইফে নিজের অধিকার তো থাকা উচিৎ।
রাশার কথায় মলিন হেসে সৌরভ বললো,
–তোমাকে ছাড়া লাইফটা আবার লাইফ হলো নাকি?
রাশা কপাল চাপড়ালো৷ অন্যদিকে ঘটে গেলো আরেক ঘটনা। বানিজ্যমন্ত্রীর সাথে উষিরের বেশ খাতিরদারি রয়েছে। তারই কোর্টে একটা দরকারী কাজ ছিলো। উষির নিজে সেই কাজ করার দ্বায়িত্ব নিলো। কারনটা অবশ্য অন্য। কোর্টে আসা তার জন্য ভীষণ দরকারী। রাশার কোর্টের কথাটা তার মাথায় ঘুরঘুর করছে। কিছুতেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না। নিজে এসে দেখতে চায়, রাশা এখানে কি কাজে এসেছে।
উষির বেশ শান্ত আর চিন্তিত মুখে আলাদত চত্ত্বরে আসলেও দূরে রাশাকে একটা ছেলের সাথে বসে থাকতে দেখে মুখ কঠিন হয়ে গেলো। ছেলেটা বেশ লম্বা, চওড়া ,সুদর্শন। পরিপাটি পোশাক, মাথার চুলগুলো দীর্ঘ সময় নিয়ে সেট করা হয়েছে। দেখেই সব বোঝা যাচ্ছে। এই ছেলের সাথে রাশার কি দরকার থাকতে পারে? খারাপ চিন্তা মাথায় আসতেই হাতের ফাইল খামচে ধরলো সে। ফিরতি পথ ধরতে পা ঘুরালো। তারপর কি মনে হতেই আর ফিরলো না। দ্রুত পায়ে রাশার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। শুনতে চাইলো তাদের কথা। কিন্তু আফসোস! কোন কথাই তার কানে গেলো না। তাদের চারপাশ এমনই ফাঁকা ছিলো যে চাইলেও কাছে গিয়ে কথা শুনতে পেতো না। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো উষিরের। রাশার কথা শেষ হওয়ার প্রতিক্ষা করতে লাগলো।
রাশা ভীষণ বিরক্ত নিয়ে বললো,
–এইসব সো কল্ড লাভ মানুষকে ভিখারি বানিয়ে দেয়। তুমি খুব ভালো একজন মানুষ৷ এসব বাদ দাও৷ প্লিজ! আই রিকুয়েস্টেড ইউ। ইট’স হাই টাইম টু ডু দ্যাট।
শেষ কথাগুলো রাশা মন থেকে অনুরোধ করে বললো। সৌরভ যেনো পণ করেছে, সে কোন কথা বুঝবে না। রাশার কথাও এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো। নত বদনে বললো,
–আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো রাশা। অনেক বছর পর্যন্ত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
রাশা রাগে ডান পা দিয়ে সজোরে মাটিতে বাড়ি দিলো। আক্রোশ মেশানো গলায় বললো,
–ঠিক এই কারনে, ঠিক এই কারনে তোমাকে আমার একটুও পছন্দ হয় না। তুমি তোমার ভালোবাসা নিয়েই পরে থাকো। বেস্ট অফ লাক ইউথ ইয়োর স্টুপিড লাভ।
সৌরভ ফ্যাকাসে গলায় বললো,
–তুমি যখন কাউকে ভালোবাসবে তখন আমাকে বুঝবে রাশা। এই দেখো, তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসবে মনে করে হৃদয় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। অন্য কাউকে ভালোবেসো না প্লিজ।
চোখ কুঁচকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সৌরভ। দেখে মনে হলো, হাজারটা ভিমরুলের কামড় খেয়েছে। রাশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–সো মাচ ইরিটেটিং! তুমি একটা কাজ করো, চিকিৎসা নাও। সময়মতো চিকিৎসা নিলে ভালো হয়ে যাবে।
সৌরভ মলিন হেসে বললো,
–আমার ডাক্তার তো তুমি।
রাশা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই ছেলেকে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে না পেয়ে বোধহয় সৃষ্টিকর্তার কাছে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলো। তারপর সৌরভের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,
–এইসব থার্ডক্লাস ফার্ট কার কাছ থেকে শিখেছো?
সৌরভ আবারও মলিন হাসলো,
–তোমার প্রেমে পরে শিখেছি।
রাশা থমথমে গলায় বললো,
–আমি বিবাহিত সৌরভ। কথাটা ভুলে কেনো যাচ্ছো?
–সেটাই তো সহ্য করতে পারছি না। তুমি আমার না, তুমি অন্য কারো! আমাকে মারতে এই একটা বাক্যই যথেষ্ট।
রাশা কপাল চাপড়ে উঠে পরলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
–যথেষ্ট হয়েছে! আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি তোমার দুঃখবিলাস করো। আমার অনেক কাজ আছে।
বলেই রাশা পথ চলতে শুরু করলো। সৌরভ পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,
–রাশা, আই বেগ ইউ। প্লিজ, কাম ব্যাক। রাশা?
রাশা শুনলো না। নিজের গন্তব্যে ফিরে চললো। ওইদিকে চায়ের বিল দেওয়ার চক্করে রাশার পিছু নিতে না পেরে সৌরভ নিজের চুল নিজেই খামচে ধরলো।
মেইন রাস্তায় সিএনজি, রিক্সা থাকে। রাশার গন্তব্য সেদিকেই। কোর্টের এড়িয়া থেকে বেরোনোর আগেই হাতের টানে বাঁধা পেলো। রাশা ভাবলো সৌরভ হয়তো তার পিছু নিয়েছে। পেছন ঘুরে কড়া কিছু শোনাতে চাইলো। কিন্তু পেছন ঘুরতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। উষির রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাশা তাকাতেই তিরিক্ষি স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
–ছেলেটা কে?
রাশা প্রথমে চমকে উঠলো৷ পরক্ষণেই নিজের চমকানো ভাব দমিয়ে মুখে হাসি টেনে বললো,
–আরেহ! তুমি এখানে কি করছো?
উষির সে কথার জবাব দিলো না। গলার স্বর আরো কঠিন করে অধৈর্য গলায় আবার প্রশ্ন করলো,
–ছেলেটা কে?
রাশা নিজের হাত ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাত ভাজ করে উষিরকে কিছু মনে করানোর চেষ্টা চালালো,
–ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন মিস্টার উষির, অ্যাকোরডিং টু আওয়ার অ্যাগ্রিমেন্ট, আমরা কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলাবো না।
ফাইল আগেই ব্যাগে ঢুকানোর জন্য স্বস্তির শ্বাস ফেললো রাশা৷ উষির তীব্র রাগে রাশার কবজি চেপে হিসহিসিয়ে বললো,
–গো টু হেল উইথ ইউর অ্যাগ্রিমেন্ট! তুমি বলো ছেলেটা কে?
ব্যাথায় মুখ কুঁচকে গেলো রাশার। তবে ব্যাথা প্রকাশ করলো না। নিজের অনুভূতি প্রকাশে বরাবরই সে নীরব। নিজের অনূভুতি কারো কাছে প্রকাশ করলে নিজেকে ছোট করা হয়। এটাই তার রীতি। তাই এবারেও ব্যাথার অনুভূতি প্রকাশ করলো না। সম্পূর্ণ বিপরীত অনূভুতি প্রকাশ করলো। হেসে ফেলে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
–হাউ রুড! ও সৌরভ। আনফরচুনেটলি আমার এক্স।
উষির হাত ছাড়লো না৷ উলটে আরো তীব্র হলো। বিরাট বড় বট গাছের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। তবুও রাশা ঘেমে উঠলো। ব্যাথায় চোখে পানি চলে আসছে। উষিরের ক্ষীপ্ত গলায় আবার প্রশ্ন করলো,
–কোর্টে এসেছো এক্সের সাথে দেখা করতে?
–আরে নাহ! বলেছিলাম তো তোমার নামে কেস করতে এসেছিলাম। মাঝখান থেকে পুরোনো সম্পর্কের একজনের সাথে দেখা হলো। কথাবার্তা না বললে খারাপ দেখায় তাই বললাম দুই এক কথা। তুমি বলো, তুমি এখানে কেনো এসেছো?
নরম হলো উষির। এতোক্ষণ ধরে করা রাগে নিজেই অবাক হলো। হাত ছেড়ে দুই পা পিছিয়ে দাঁড়ালো। এক হাতে রাখা ফাইল এখন আরেক হাতে ট্রান্সফার করলো৷ তারপর ফাঁকা হাত দিয়ে পাঞ্চাবির হাতার ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
–তুমি আমার নামে কতগুলো কেস করলে, সেটা দেখতেই এসেছি।
রাশা কোমরে হাত রেখে ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,
–উহু! আমার সাথে চালাকি না। সত্যি সত্যি বলো?
উষির হাতের ফাইল উঁচিয়ে বললো,
–এটা জজের থেকে অ্যাপ্রুভ করাতে হবে। সেইজন্যই এসেছি।
–দেখি?
হাত বাড়িয়ে ফাইলটা চাইলো সে। উষির ফাইলটা তার হাতে দিতেই মনোযোগ দিয়ে পুরো ফাইল চেক করলো। তারপর বিষ্ময়ে বললো,
–এটা তো বড় অংকের লোন! অনেক বড় অংক! কোন কোম্পানির নামে নিতে চাচ্ছে। কার কোম্পানি এটা?
উষির দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো,
–মন্ত্রীর।
–কোন মন্ত্রীর?
উষির ভ্রু নাচিয়ে বললো,
–সেটা জেনে তোমার কি কাজ?
রাশা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো,
–ও মাই গড! তুমি! তুমি রাশার হাজবেন্ড হয়ে এমপি মন্ত্রীদের পেছনে ঘোরো! আর এই ঘোরাকে তুমি পলিটিক্স বলো! মাই গুডনেস! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! লিটারেলি তুমি এইসব করো?
–নতুন নতুন পলিটিক্স করতে গেলে কারো না কারো আশ্রয়ে যেতে হয়। তুমি এসব বুঝবে না।
রাশা প্রায় আহাজারি করে উঠলো,
–ওইদিকে আমি কাউকে আত্মসম্মানের জ্ঞান দিয়ে আসলাম আর এইদিকে আমার ঘরওয়ালারই মিনিমাম সেল্ফ রেসপেক্ট নাই!
রাশাকে দেখে মনে হলো, কষ্টে তার বুক ফেঁটে আসছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–কোন জজের কাছে যাবে?
উষির তার প্রথম কথার কড়া জবাব দিতে নিয়েও চুপ হয়ে গেলো। পাবলিকপ্লেসে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা অনুচিত। তাই শেষের প্রশ্নটার উত্তর ঝটপট দিলো,
–যে থাকবে তার কাছেই যাবো।
–পরিচিত কেউ নেই?
–না।
–এসব কাজে পরিচিত কাউকে লাগে। অপরিচিত কেউ এতো রিস্ক কেনো নেবে?
–পরিচয় হওয়ার জন্য নামই যথেষ্ট।
উষির বেশ গর্বের সাথে উত্তর দিলো। রাশা মুখ ভেঙচে বললো,
–হাহ! আসছে আমার মন্ত্রীর চামচামি করতে!
তারপর সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–ফলো মি।
উষির এবারেও তার কথার জবাব দিলো না। মনে মনে অপমানগুলো গুছিয়ে রাখলো। সব সুদে আসলে ফেরত দেবে।
রাশা আর উষির একটা বড় দোতলা বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়ালো। তারপর রাশা উষিরকে সেখানে রেখে একা ভেতরে চলে গেলো। খানিক পরে চিন্তিত উষিরকে নিশ্চিন্ত করে ফিরে আসলো। হাসিমুখে উষিরের সামনে ফাইল ধরে বললো,
–তোমার কাজ শেষ।
উষির ফাইল চেক করে সন্দেহী স্বরে প্রশ্ন করলো,
–তোমার পরিচিত জজ আছে নাকি?
রাশা চোখ টিপে বললো,
–আমি কোন ফ্যামিলির মেয়ে ভুলে গেলে চলবে না। তোমার ট্রিক অনুযায়ী নাম দিয়েই কাজ হাসিল। সাথে একটু হুমকি ধামকি।
উষির স্পষ্ট বুঝলো, রাশা মিথ্যা বলছে। বুঝেও কিছু বললো না। রাশাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেলো। ফিরলো রাতে। রাশা বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে চিপস খাচ্ছিলো আর টিভি দেখছিলো। উষিরকে দেখেই সব ছেড়ে ছুড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
–কি গিফট পেলে?
উষির হাতঘড়ি খুলছিলো। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
–কিসের গিফট?
রাশার মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো,
–এতো টাকার লোনের অ্যাপ্রুভাল নিয়ে দেওয়া হলো আর তার বদলে গিফট দেবে না? এটা কেমন কথা। অ্যাটলিস্ট নিউলি ম্যারেড কাপলদের হানিমুনের ব্যবস্থা তো করে দিতে পারতো।
উষির পাঞ্চাবির বোতাম খুলছিলো। রাশার কথা শুনে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,
–হানিমুনের ইচ্ছে হচ্ছে নাকি?
রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলো। চোখ বুজে বললো,
–এতোক্ষণে তো আমি আর সৌরভ প্যারিসে থাকতাম। সেখান থেকে গ্রিসে যাওয়ার কথা ছিলো। পুরো এক মাসের প্ল্যান করা ছিলো আমাদের। তোমাকে হানিমুন ট্রিট দিলে প্যারিস আর গ্রিস ভ্রমণের কষ্টটা তাতে একটু লাঘব হতো।
উষিরের মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। এগিয়ে এসে রাশার মুখের উপর ঝুঁকে ক্রোধে জর্জরিত ভয়ংকর স্বরে শাসিয়ে বললো,
–আর একবার সৌরভের নাম মুখে আনলে সৌরভ নামক মানুষটার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আর থাকবে না। মাইন্ড ইট।
রাশা অবাক বিষ্ময়ে চোখ খুললো। উষির ক্ষিপ্ত পায়ে ক্লোজেট থেকে জামাকাপড় নিয়ে স্ব-শব্দে ক্লোজেট বন্ধ করলো। তারপর বাথরুমের দরজাও সর্বোচ্চ শক্তিতে বন্ধ করলো। রাশা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বিড়বিড় করলো,
–সৌরভকে গালি দিতে দিতে আরেকটা সৌরভ কপালে এসে জুটলো নাকি!
চলবে…