তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৭+৮

0
9

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৭

বিয়ের কথা পাবলিক হতেই উষিরের উপর একটা ছোট ইন্টারভিউ দেওয়ার চাপ আসে। সাংবাদিককে অথোরিটিই পাঠাবে। শুধু তাকে কিছু প্রশ্নের সুন্দর ও ব্যাখ্যামূলক উত্তর দিতে হবে। উষিরের রাজি না হয়ে উপায় ছিলো না। সকাল সকাল সাংবাদিক আসার আগেই রাশাকে বেশ সাবধান করে বলে দিলো,

–তুমি একটাও কথা বলবে না। যা বলার সব আমি বলবো।

রাশাও শান্ত, ভদ্র আর বাধ্য মেয়ের মতো কাধ নাচিয়ে উত্তর দিলো,

–ওকে।

তবে তার শান্ত আর বাধ্যতা সেখানেই শেষ। সাংবাদিকের সামনে যেতেই নিজের ফর্মে ফেরত গেলো। সাংবাদিক কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই রাশা বলে উঠলো,

–ইন্টারভিউ এর আগে আমাদের কিছু শর্ত আছে।

উষির চকিতে তাকালো রাশার দিকে। চাপা গলায় বললো,

–সব কথাবার্তা আগেই হয়ে গেছে৷ এখন শুধু ছোট করে একটা ইন্টারভিউ দিতে হবে। প্লিজ চুপ করে থাকো।

রাশা মন দিয়ে উষিরের কথা শুনলো। তারপর মিষ্টি হেসে সাংবাদিককে আবার বললো,

–শুধু আমার কিছু শর্ত আছে। সেগুলো মানলেই আমি ইন্টারভিউ দেবো।

সাংবাদিকের জন্য এসব নতুন না। প্রায় মানুষই কথা বলার আগেই শর্ত রাখে। এখানেও যে এমন কিছু হবে, সে ব্যাপারে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর করলেন,

–শর্তগুলো বলুন? রাখার চেষ্টা করবো।

রাশা হাসলো। মিষ্টি হাসির পেছনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেই উষিরের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো।

–ইন্টারভিউ কোথায় প্রকাশ করবেন? টিভিতে, নিউজপেপারে নাকি অনলাইন নিউজ পোর্টালে?

–অনলাইন নিউজ পোর্টালে।

রাশার হাসি চওড়া হলো। উষিরের দেওয়া চাপা স্বরের ধমক উড়িয়ে দিয়ে আবার বললো,

–সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরির ভাতিজি আর শিল্পপতি হামিদ চৌধুরীর ছোট কন্যার বিয়ের নিউজ, অনলাইন নিউজ পোর্টালে দিলে ভালো হবে নাকি টিআরপি বাড়াতে টিভিতে দিলে ভালো হবে সেটা আপনারাই ভালো জানবেন।

সামনে আড়াম করে বসে থাকা সাংবাদিক বিষ্ময়ে সোজা হয়ে বসলো। বিষ্ময়ে খানিক বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। চৌধুরী পরিবারের মেয়েদের কখনই সামনে আনা হয়নি৷ বলা চলে, বেশ রাখঢাক রেখেই তারা চলাফেরা করে। ছেলেদের সবাইও যে সামনে এসেছে, তা না। চৌধুরী পরিবারের চার ছেলের মধ্যে শুধুমাত্র শাহরিয়ার চৌধুরী বাবার পথ অনুসরণ করে রাজনীতিতে এসেছে। বাকি তিন ছেলের খবর মিডিয়া জানে না। মাঝে তাদের পরিবারের এক ছেলেকে নিয়ে নিউজ বের হলেও স্পষ্ট ভুয়া নিউজ বলে পরেরদিনই তা সরিয়ে ফেলা হয়। বিত্তবান এই পরিবার সম্পর্কে সবার জ্ঞান অতি সীমিত। সেখানে একজন এসে সেই পরিবারের মেয়ে বলে নিজেকে দাবী করলেই তো বিশ্বাস করা যায় না। সাংবাদিক মহাশয়ও করলেন না। বিষ্ময়াভাব কাঁটতেই প্রশ্ন ছুড়লেন,

–আমি আপনার কথা কিভাবে বিশ্বাস করবো? আমার জানামতে চৌধুরী পরিবারের কোন মানুষ প্রকাশ্যে আসে না। তারা নিজেদের আড়ালে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন।

রাশা আলতো হেসে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। তারপর হাঁটুতে হাত রেখে বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে বললো,

–আপনাকে প্রমাণ দেওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই। বিশ্বাস করলে করুন না হলে না করুন। আমি তো শুধু আপনাদের উপকার করতে চাইছিলাম।

সাংবাদিক অধৈর্য হলো। উশখুশ করে বললো,

–প্লিজ ম্যাডাম, কিছু তো প্রমাণ দেন? আপনি বুঝতে পারছেন না, যদি আমি এইটা প্রকাশ করি তাহলে আমার ক্যারিয়ারের গ্রিন লাইট জ্বলে উঠবে। প্রমোশন পাক্কা!

উষির রেগে গেলো। কড়া গলায় বললো,

–আমরা আপনাকে কোন প্রমান দেবো না। যেটা করতে এসেছেন সেটাই করুন।

সাংবাদিক ফ্যাকাসে গলায় বললো,

–প্লিজ স্যার, এটা আমার বেতনের প্রশ্ন।

রাশা হেসে ফেললো। মাথা নেড়ে বললো,

–বেতন সব থেকে বেশি ইম্পর্টেন্ট। কিন্তু আমি আমার পরিচয়ের কোন প্রমাণ আপনাকে দেবো না। বলা চলে আপনার সুবিধার জন্যই দেবো না। কারন এটা আপনি প্রকাশ করলে আপনার চাকরি তো যাবেই সাথে আপনাদের অফিসও বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবারের কোন ঘটনা সামনে আসুক সেটা বড় বাবা চায় না। তাই আমি যেটা বলছি সেটাই করুন। লাভ আখেরে আপনারই হবে।

হাতে পেয়ে যাওয়া কোটি টাকার লটারির টিকিট নষ্ট হলে যেমন কষ্ট হয়, সাংবাদিক মহশয়েরও তেমনই কষ্ট হলো। আহত হলো খুব। বিমর্ষ স্বরে বললো,

–বলুন?

উষির উঠে দাঁড়ালো। চোয়াল শক্ত করে বললো,

–আপনারাই তাহলে কথা বলুন, আমি আসছি। আমার অপচয় করার মতো এতো সময় নেই।

সাংবাদিক আতকে উঠে উষিরকে আটকালো,

–প্লিজ স্যার, যে এক ঘন্টা সময় নিয়েছি সেই এক ঘন্টা একটু কনসিডার করুন। আমার চাকরির প্রশ্ন স্যার?

উষির কথা মানলেও রাগ ছাড়লো না। চুপচাপ বসে রাগে ফুঁসতে লাগলো। রাশা সতেজ গলায় বললো,

–ইন্টারভিউটা চেষ্টা করবেন নিউজপেপারে প্যারাগ্রাফ আকারে দিতে। সরাসরি কথোপকথন দেবেন না। তাহলেই আমার পরিচয় পেয়ে যাবেন। সাথে দেখবেন, আপনাদের অবস্থা হবে ধরি মাছ আর না ছুঁই পানি টাইপ হয়ে যাবে। দুই দিনে রিচ বেড়ে হাই হয়ে যাবে।

সাংবাদিক মহাশয় খুব একটা চালাকচতুর না। তাই রাশার কথার আক্ষরিক অর্থ বুঝতে পারলো না। কিছুটা দোনোমনা করে নিমরাজি হলেন। রাশা শুরু করলো তার কাহিনী,

–আমাদের প্রথম দেখা হয় হলুদ সন্ধ্যায়।

উষির চমকে উঠলো। এই মেয়েটা আবার সত্যি সত্যি সব বলে না দেয়! বেশ রাগত গলায় মৃদু শাসানি দিয়ে বললো,

–রাশা, বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

রাশা উষিরের থেকেও ফিসফিস করে বললো,

–বি কোয়াইট, জান!

জান শুনে তাজ্জব বনে গেলো উষির। মূহুর্তেই চোখ মুখ শক্ত করে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। ভাবখানা এমন, এখন যা খুশি হয়ে যায় সে একটা অক্ষরও বলবে না। রাশা উষিরের রাগ পাত্তা দিলো না। আবার বলা শুরু করলো,

–আমার মেজো চাচা আর বাবা মানে আমার শ্বশুরমশাই খুব ভালো ফ্রেন্ড। সেই সুবাদে তাদের এক মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের মেয়ের বিয়েতে তারা অতিথি ছিলেন। মেজো বাবার সাথে আমিও ছিলাম। আর বাবার সাথে উষির৷ সেখানেই এই লাজুক, কাটখোট্টা মানুষটার সাথে আমার পরিচয়। প্রথমে বন্ধুত্ব আর তারপর কখন প্রেম হয়ে গেলো, বুঝিই-নি৷ আমাদের বিয়েটা পূর্বপরিকল্পিত ছিলো না। আমার বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক হয়েছিলো৷ উষির সেটা শুনে একদম হিরোর মতো আমার বাড়িতে এন্ট্রি নিলো। আমার বাবার সামনে বুক টানটান করে বললো, আমাকে বিয়ে করতে চায়। বাড়ির কেউ এই বিয়েতে রাজী ছিলো না। জল অনেকদূর গড়ানোর পর বড় বাবা সবটা মেনে নিলেন। কিন্তু শর্ত রাখলেন, বিয়ের পর তাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না। প্রেমের টানে মেনেও নিলাম। ভাবলাম, এখন রেগে থাকলেও কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। যদিও বড় বাবা এক কথার মানুষ তবুও আশা আছে। দেখি ভবিষ্যতে কি হয়। যাই হোক, তারপর এখান থেকে বাবা আর উষির গেলো। ঘরোয়াভাবেই ওর সাথে আমার বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। এইতো কাহিনী৷ সংক্ষিপ্ত আকারে বললেও ব্যাপারটা সংক্ষিপ্ত হয়নি৷ অনেক চড়াই উৎরাই পেরোনোর পরই আমরা আজ একসাথে। অনেকেই বলবে, এটা একদম ঠিক হয়নি। পরিবারের অমতে গিয়ে বিয়ে করা একদম উচিৎ ছিলো না। কিন্তু উষির একজন পাবলিক ফিগার পরে, আগে সে একজন মানুষ। গভীর প্রেমে তো মানুষ নিজের অস্তিত্ব ভুলে বসে। উষির আর আমিও সেই কাতারেই পরেছি। আপনারা সবাই উষিরকে খুব ভালোভাবেই চেনেন। আপনারাই বিচার করবেন, আমি ঠিক কাজ করেছি নাকি ভুল।

উষিরের কথা বন্ধ ছিলো। কিন্তু সেটা রাগের জন্য নয়। রাশার নির্দ্বিধায় বলা এই মিথ্যে শুনে তার বাক্য অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। রাশার কথার মাঝে লাজুক হাসা, আবার মন খারাপের বাক্য শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলা, সবটাই কি নিঁখুত অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটে তুলছে! আর শেষের দিকে ছলছল চোখে উষিরের দিকে তাকিয়ে যখন চোখ মুখে লাজুক হেসে তার হাত দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো, তখন উষিরের মনে হলো, এই অভিনেত্রী এখনও অস্কার পায়নি কেনো!

সাংবাদিক সাহেব অত্যাধিক ইমোশনাল হয়ে পরেছেন। ভেজা স্বরে ছোট করে প্রশ্ন করলেন,

–জুয়েলারি দান করার ব্যাপারে কিছু বলুন?

রাশা আবার মিষ্টি হাসলো। বললো,

–ওগুলোর বেশিরভাগই আমার বিয়ের অর্নামেন্টস। আমার পরিবারের একটা রীতি আছে। বিয়ের পরেরদিন নববধূ গ্রামের সবার মাঝে দান সদকা করে। আমি সেই রীতিই অনুসরণ করেছি। বাড়ির দেওয়া ওই অর্নামেন্টস ছাড়া আর কিছুই আমার ছিলো না। তাই সেগুলোই দান করে রিচুয়াল মেইনটেইন করেছি। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম, আমার অর্নামেন্টগুলো কোন একটা ভালো কাজে আসুক। আর সেটা এসেছেও। এতো আড়ালে থেকে চ্যারিটি করার পরও কিভাবে যে ব্যাপারটা পাবলিক হলো, কিছুই বুঝতে পারছি না। সব জায়গায় এখন এটাই চর্চা হচ্ছে। আ’ম সারপ্রাইজড!

–নারীদের গহনাই হলো তাদের জীবন। বিশেষ করে বিয়ের গহনা তারা সারাজীবন আগলে রাখে। আবার নারীরা তাদের গহনাকে বিপদের সঙ্গীও বলে। বিয়ের স্মৃতি রাখার জন্য একবারও মনে হয়নি, অন্তত কিছু একটা নিজের কাছে রাখবেন? কিংবা বিপদের সঙ্গী করে নিজের কাছে রাখবেন?

–বিয়ের স্মৃতি হিসেবে স্বামী মানুষটা পাশে থাকলেই হলো। আর আরেকটা প্রশ্নের উত্তর হলো, আমি বিশ্বাস করি, মানুষই মানুষের বিপদে এগিয়ে আসে। তাই আমি বিপদে পরলেও নিশ্চয় মানুষই এগিয়ে আসবে।

ইন্টারভিউ শেষ হয়ে যেতেই ফটোসেশান শুরু হলো। ডিপ অফ হোয়াইট সালোয়ার কামিজ পরে উষিরের পাশে দাঁড়ালো রাশা। উষির ম্যাচিং পাঞ্চাবি পরে আছে৷ এক হাত রাশার কোমড়ে আর রাশার এক হাত উষিরের কাঁধ আকড়ে আছে। ছবিটা দারুন হয়েছে৷ রাশা মুগ্ধ হয়ে বললো,

–আপনি তো দেখি দারুন ছবি তোলেন! আমাকে এক কপি পাঠাবেন প্লিজ।

সাংবাদিক সাহেব লাজুক হাসলো। রাশা ফের বললো,

–সুন্দর করে সাজিয়ে লিখবেন। আর স্পেশালি লিখবেন, উষিরের সাথে দেখা হয়নি। তার অনুমতি নিয়েই তার স্ত্রীর সাথে আপনার কথা হয়েছে। আর লিখবেন, তার স্ত্রীর পরিবার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতে রাজী হয়নি। আর উষির ইন্টারভিউ এর শেষের দিকে এসেছে। তারপরই ছবি তোলা হয়েছে। মনে থাকবে?

সাংবাদিক মহাশয় ঢোক গিলে মাথা হেলিয়ে সায় জানালেন। সাংবাদিক চলে যেতেই রাশা কোমড়ে হাত রেখে বেশ গর্বের সাথে উষিরকে বললো,

–দেখলে তো সব কেমন ইজিলি হয়ে গেলো৷ এতো সহজ ব্যাপারকে তোমরা এতো জটিল করো!

তারা তখন লনে ছিলো। পাশাপাশি হাঁটছিলো দুইজন। রাশা জুতা খুলে নরম ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটছে৷ উষির সেদিকে একপলক তাকিয়ে বললো,

–এতোগুল কথার মাঝে আবার বাবা আর তোমার কাকার ফ্রেন্ডশিপ ছাড়া আর একটা ওয়ার্ডও কি সত্যি বলেছো?

–কতগুলোই তো বললাম।

বলেই রাশা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। উষির চোখ ছোট ছোট করে বললো,

–কোনটা?

রাশা বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,

–আমি সত্যিই চেয়েছিলাম, গহনাগুলো কারো উপকারে লাগুক।

–ইউ আর যাস্ট ইম্পসিবল! তোমার মতো আর একজনও বোধহয় এই দুনিয়ায় আসেনি। আসলে আমার মতোই কারো লাইফ হেল থাকতো৷ তাতে যদি একটু শান্তনা পেতাম!

রাশা আবার হেসে ফেললো। উষির মুগ্ধ হতে হতে হলো না। রাশার এক হাত টেনে থামিয়ে বললো,

–কত টাকার শপিং করেছো জানো?

রাশা দাঁতে জিভ কেঁটে বললো,

–ছি ছি ছি! তুমি আমাকে টাকার খোঁটা দিচ্ছো? আমি কি শুধু আমার জন্য শপিং করেছি? সবার জন্যই তো করেছি৷ এমনকি তোমার জন্যেও করেছি। মন বড় করতে হয় বুঝেছো?

উষির বুঝলো নাকি বোঝা গেলো না। বললো,

–ক্রেডিটকার্ড ফেরত দেবে কখন?

রাশা আকাশ থেকে পরলো, এমন ভঙ্গিতে আহ্লাদী স্বরে বললো,

–বিয়ের পর একটাই জিনিস দিয়েছো। সেটাও ফেরত চাইছো?

উষির চোখ ছোট ছোট করে শাসিয়ে বললো,

–অ্যাকাউন্ড ক্লোজ করে দেবো কিন্তু?

রাশা কোমড়ে হাত রেখে দ্বিগুণ শাসিয়ে বললো,

–রাশাকে চেনার জন্য দুইদিনই যথেষ্ট। এই দুই দিনেও যখন চেনোনি তাখন তোমার বুদ্ধির পরিমাণ জানা হয়ে গেছে। বন্ধ করেই দেখো কি করি।

বলেই গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। উষির বিড়বিড় করলো,

–ইনক্রেডিবল! কোন গ্রহ থেকে এসেছে কে জানে!

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৮

ছবিগুলো উষির আর মেয়েটার বেশ অন্তরঙ্গ মূহুর্তের সাক্ষী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। বিয়ের তিন চার দিনের মাথায় নিজের স্বামীর এমন ছবি দেখা কোন মেয়েরই কাম্য নয়। কিন্তু সেখানে রাশা নির্লিপ্ত। সে বেশ মজা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। বিয়ের কথা জানাজানি হওয়ার পরেই এরকমটা শুরু হয়েছে৷ রাশা প্রায় সময়ই বিভিন্ন সাইট থেকে ছবি বের করে জুম করে করে দেখে। এখনও তাই করছে। উষির ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনি করছিলো আর আয়নার ভেতর থেকে রাশাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিলো। রাশার মিটিমিটি হাসিটা বেশ অসহ্য হয়ে উঠেছে উষিরের। একসময় আর না পেরে রাশার সামনে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বললো,

–এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখে এতো হাসছো?

রাশার চোখে মুখে ছেয়ে থাকা হাসির রেশ এবারে ঠোঁটের কোনে এসে গেলো। বেশ আগ্রহ নিয়ে উষিরের সামনে ফোন ধরে বললো,

–তোমার ছবিগুলো দেখছিলাম।

ছবিগুলো দেখে অপ্রস্তুত হলো উষির। পরক্ষণেই চোখ গরম করে রাশার মাথায় টোকা দিয়ে বললো,

–নির্লজ্জের এসব কি দেখছো? সব কিছু ফেক। এআই দিয়ে বানানো।

রাশার হাসি চওড়া হলো। প্রফুল্লচিত্তে বললো,

–সেটা তো একটা পাগল দেখলেও বুঝতে পারবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, মেয়েদের রুচি ঠিক কতটা খারাপ হলে তারা তোমাকে সিলেক্ট করে? নিজেই নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো। সুন্দর চেহারা ছাড়া আর কিছু কি নজরে পরে? পলিটিশিয়ান মানুষদের থাকতে হয় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। তোমার সব বুদ্ধি ওই লম্বা হাঁটুতে আটকে আছে। শুধু বডি দেখালে হয় না। যোগ্যতাও থাকতে হয়।

উষির প্রথম বাক্যটায় পরে রইলো। বাকি কথাগুলোতে কানও দিলো না। তার মানে রাশা বুঝতে পেরেছে, উষির তেমন ছেলে না। বুকে হাওয়া দোল খেয়ে গেলো। মন আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। কৌতুহলবশত বলে বসলো,

–তুমি কিভাবে বুঝলে?

রাশা ফোন রেখে উষিরের দিকে তাকালো। তারপর হাত নেড়ে বুঝানোর মতো করে বললো,

–তোমার নাকের ফুটো অত্যাধিক বড়। এই ছবিতে তেমনটা নাই। আবার তোমার ডান হাতে একটা বড় তিল আছে। এখানে একদম ফ্রেশ হাত। তোমার কান দুটো নরমাল হলেও ছবির কানদুটো তোমার নাকের ফুটোর অত্যাধিক বড়। আবার…

উষির রেগে গেলো। সে কি ভাবলো আর বলে বসলো কি! তার থেকে ভালো কিছু আশা করাটাই ভুল হয়েছে৷ বড্ড ভুল হয়ে গেছে। রাশাকে থামিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,

–যথেষ্ট হয়েছে। আর শুনতে চাই না।

রাশা দায়সারা ভাবে কাঁধ নাচিয়ে উষিরের রাগ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো। তারপর বললো,

–এসব ফেক হলেও তোমার ভার্জিনিটি সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ইউ নো হোয়াট, কোন পুরুষই শুদ্ধ পুরুষ না। মানে চরিত্রের দোষ সবারই আছে। তার উপর তুমি পাবলিক ফিগার। কিছু না কিছু তো অবশ্যই করে এসেছো। বলা যায় না, হয়তো এতোদূর আসতে নিজের দেহ বিসর্জন…

উষিরের কি হলো কে জানে! রাশার কথা শেষ হওয়ার আগেই একটু ঝুঁকে রাশার মাথার পেছনে হাত দিয়ে শক্ত হাতে তার মুখটা নিজের মুখোমুখি করলো। তারপর রাশাকে হতবাক করে দিয়ে তার ঠোঁটে একটা শক্ত চুমু খেয়ে বললো,

–মাই লিপস যাস্ট লস্ট দেয়ার ভার্জিনিটি।

রাশা ফ্যালফ্যাল করে উষিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। কাজটা করার পর উষির নিজেই কেমন একটা হয়ে গেলো। বুকে দোল খাওয়া ধুকপুক বেশি বেড়ে গেলো। বড় বড় দুটো ঢোক গিলে বাইরের দিকে হাঁটা ধরলো। অন্যদিকে রাশার ধাতস্থ হতে অনেকটা সময় লেগে গেলো। সজ্ঞানে ফিরতেই বিষ্মত হলো, রেগে গেলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

–হি কিসড মি! হাউ ডেয়ার হি ডু দ্যাট! উষিইইইইইইর!

চিৎকার করে উঠলো রাশা। নিচ থেকে তার চিৎকার শুনে উষিরের বিষম উঠলো। শাহিদা উষিরের পিঠ চাপড়ে চিন্তিত স্বরে বললো,

–আবার কিছু করেছিস নাকি?

উষির কাঁধ নাচিয়ে না জানার ভাণ ধরে বললো,

–জানি না তো। জানোই তো কেমন মেন্টাল। রাগ নাকের ডগায় উঠেই থাকে।

এবারে বন্যা চিন্তিত হলো। মুখের খাবার শেষ করে বললো,

–কিন্তু ভাইয়া, ভাবিকে তো আমি তেমন একটা রাগতে দেখিনি!

উষির ধমকে উঠলো,

–চুপচাপ খা। বড়দের মাঝখানে নাক গলাচ্ছিস কেন?

বন্যা বড় শ্বাস ফেলে চিন্তিত মুখেই খেতে লাগলো। তার মুখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারে, মাত্র হয়ে যাওয়া কথাটা নিয়ে সে সত্যিই ভীষণ চিন্তিত। শাহিদা বিরক্ত হয়ে ময়নাকে বললো,

–তোকে না রাশাকে ডেকে আনতে বললাম। এখনও যাসনি কেন?

কথাটা শুনেই উষির প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পরলো। তাড়াহুড়ো করে বললো,

–তিনটায় আমার ফিল্ডে কিছু কাজ আছে। ভুলেই গেছি। আসছি আমি।

বলেই কাউকে কিছু বলতে না দিয়েই চলে গেলো। মাহফুজা বিচলিত গলায় বললো,

–ছেলেটা যে কি বেছে নিলো ভাবি! পছন্দের রুই মাছটাও শান্তিতে খেতে পারলো না। তার থেকে বড় ভাই আর উজানের সাথে ব্যবসা দেখলে কত ভালো হতো।

শাহিদা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর ছেলের বলা কথাটাই রিপিট করলো,

–শখের দাম ষোল আনা।

কথাটা রাজনীতিতে ঢোকার আগে সবাই বাঁধা দেওয়াতে বলেছিলো উষির৷ মানে এটাই দাঁড়িয়েছিলো, যা কিছু হয়ে যাক তার পছন্দের কাজটাই সে করবে। সেটার মূল্যই তার কাছে সব থেকে বেশি। এরপর আর কেউ কিছুই বলেনি। এখনও কিছুই বলে না। তবে পান থেকে চুন খোসলে খোঁটা দিতেও ছাড়ে না।

দুপুরে ওমন বাজখাঁই চুমুর পর উষিরের কথা মনে হতেই কেমন ইতস্তত লাগে রাশার। সাথে রাগ তো ফ্রীতেই পাওয়া যাচ্ছিলো। উষির আসার আগ পর্যন্ত অনেক কথা মনে মনে গুছিয়েছে। উষির বাড়ি আসলো বেশ রাত করে। ভেবেছে, রাশা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ঢুকবে। কিন্তু হলো উলটো। রাশা তার জন্যেই জেগে বসে ছিলো। রুমে ঢুকতেই জাগ্রত রাশাকে দেখে তটস্থ হলো সে। মনকে অনেকবার বুঝিয়েছে, পরনারীকে তো স্পর্শ করেনি৷ যাকে করেছে, সে তার বিবাহিতা নারী৷ তাহলে এতো অস্বস্তি কেনো! তবুও মন মানেনি। কেমন একটা লাগতে শুরু করেছিলো।
রুমে ঢুকেই সোজা ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঘড়ি খোলার অযুহাতে আয়না দিয়ে বিছানায় শক্ত হয়ে বসে থাকা রাশাকে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। তবে সেটা আর করতে হলো না। রাশা এসে উষিরের পাশে এসে দাঁড়ালো। মুখ সোজা সামনের দিলে, উষিরের বিপরীত দিকে। আড় চোখে তাকিয়ে তার মুখ দেখা গেলেও সোজাসুজি দেখতে ঘাড় ঘুরাতেই হবে। উষির দ্বিতীয়টাই বেছে নিলো। ঘাড় ঘুড়িয়ে রাশার দিকে তাকালো। রাশা সামনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখশ্রী শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,

–দেখো, আর ওসব কিছু করবে না বলে দিচ্ছি। ভালো মানুষ পেয়ে যা খুশি করবে সেটা হবে না। বিয়ের আগে আমি রিচ ছিলাম। ইচ্ছামতো টাকা পয়সা খরচ করতাম। বিয়ের পর যতক্ষণ জুয়েলারিগুলো ছিলো ততক্ষণ রিচ ছিলাম। গহনার সাথে সাথে আমার রিচ জাতীয় সমস্যাও চলে গেছে। আমি এখন রিচ থেকে আছড়ে পরে পোওর হয়ে গেছি। মাত্র বিশ হাজার টাকা স্যালারির একটা চাকরি করি। প্রতি মাসে আমার নির্দিষ্ট কিছু খরচখরচা আছে৷ এরমধ্যে তোমার পলিটিক্সের পেছনে কনট্রিবিউট করার মতো উপায় আমার নেই৷ আমাকে কিডন্যাপ করেও লাভ হবে না। আর দুপুরে যেগুলো করলে সেগুলোর পর আমার কাছে টাকা থাকলেও আমি তোমাকে দিতাম না৷

বড় করে শ্বাস ফেললো রাশা। উষিরের দিকে আড় চোখে একবার তাকিয়ে আবার সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে কঠিন গলায় বললো,

–সব কথার শেষ কথা, এইরকম ফাউল মার্কা কাজ আর করবে না। নিজের ঠোঁট সংযত রাখো।

উষির তাজ্জব বনে গেলো। সাথে রাগও হলো৷ তার ওমন ভালবেসে দেওয়া প্রথম চুমুটাকে ঘুষ ভাবছে! ঘুষ! ভেট! গিফট! সুযোগ সন্ধানী কাজ কর্ম! ভারি অপমানিত হলো উষির। রেগে লাল হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠলো৷

রাতে শোয়ার পরে রাশা যখন আবার উষিরের বালিশে চলে আসলো তখন উষির ঘুরে রাশার মুখোমুখি হলো৷ তার আদর করে দেওয়া চুমুকে ঘুষ বলা! এখন সে আরো চুমু দেবে। সেও দেখতে চায়, রাশা ঠিক কত কি ঘুষ দিতে পারে। ভাবনামতো কাজও করলো। রাশার গালে, কপালে, ঠোঁটে, নাকে অনবরত চুমুর বন্যা বইয়ে দিলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও একসময় রাশা আর চুপ থাকলো না। চোখ মুখ কুঁচকে নিজের গালে নিজেই চড় বসালো৷ বিড়বিড় করে ঘুম জড়ানো গলায় বললো,

–উহুহু ক্যাকটাস মশা মশা মশা..

অর্ধ অসমাপ্ত কথাটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দ্বিতীয়বারের মতো উষিরকে হতবিহ্বল করে ঘুমের দেশে পারি জমালো সে। তার চুমু একেবারে ক্যাকটাস মশা হয়ে গেলো! অজান্তেই হাত নিজের গালে নিয়ে গেলো৷ এতো শখ করে রাখা চাপ দাড়িগুলো ক্যাকটাস মশা! এমন মশার অস্তিত্ব আদৌ কি পৃথিবীতে আছে!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে