#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৪
রাতের খাবার নিয়ে রাশা আর শাহিদার মধ্যে বড়সড় বাকবিতন্ডা হলো। এটাকে নিরব বাকবিতন্ডাও বলা যায়। রাশা রাতে খাবে চিকেন স্যুপ। কিন্তু শাহিদা কিছুতেই চিকেন স্যুপ বানাতে দেবেন না। এই মেয়ের কোন রকমের মন মনানিই তিনি আর সহ্য করবেন না। কিন্তু রাশা তো জানেই, হবে সেটাই যেটা সে চাইবে। আর এই বাকবিতন্ডায় যে সেই জিতবে সেটাও জানতো৷ আর হলোও তাই৷ একসময় শাহিদা আর না পেরে বললো,
–চিকেন স্যুপ কিভাবে বানায়, জানো তুমি?
রাশা স্ব-গর্বে মাথা নেড়ে বললো,
–অবশ্যই জানি।
শাহিদার কথাটা একদম বিশ্বাস হলো না। দুই হাত ভাজ করে বললো,
–আচ্ছা! বলো দেখি?
–চিকেন, ওয়াটার অ্যান্ড..অ্যান্ড স্পাইসেস।
উপকরণগুলোর নাম বেশ সময় নিয়ে ভেবে ভেবে বললো রাশা। আসেপাশের সবাই মিটিমিটি হাসতে লাগলো৷ শাহিদা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
–কি কি স্পাইসেস?
রাশা আবার ঢোক গিললো। দুই একটা মশলার নামই তার জানা আছে। সেগুলোতেই কাজ সারতে চাইলো,
–ওইতো, যেগুলো দিয়ে কুকিং হয় লাইক চিলি পাউডার, টারমারিক পাউডার, সল্ট..
–সল্ট স্পাইসেস?
বন্যা চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে উঠলো। রাশা ঠোঁট উলটে কাধ নাচিয়ে বললো,
–আরে বাবা হলেই তো হলো। দেয় নাকি সেটাই ম্যাটার করে।
শাহিদা মুখ টিপে হেসে বললো,
–আচ্ছা, তাহলে যাও আর রান্না করে খাও।
রাশা দাঁত বের করে হেসে বেশ গর্বের সাথে হেঁটে রান্নাঘরে যেতে যেতে বললো,
–অ্যাজ ইউ লাইক বেস্ট মাই ডিয়ার খালাম্মা।
শাহিদার রাগে শরীর জ্বলে উঠলো। রাশাকে অনেক কথা শুনানোর তীব্র ইচ্ছেকে দমিয়ে দরজা খুললো। কারন তখন কলিংবেল বেজে উঠেছে৷ দরজা খুলতেই উষিরের ক্লান্ত মুখশ্রী নজরে পরলো। শাহিদার বুকটা হাহাকার করে উঠলো৷ লিভিংরুমের সোফায় বসা পর্যন্ত ছেলেকে কাছ ছাড়া করলেন না। এমনকি বসার পরও ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ছেলের সাথে এতো বড় একটা কান্ড ঘটে গেলো, এখন নিশ্চয় ছেলেটা খুব ভেঙে পরেছে। তবে উষিরকে দেখে খুব একটা চিন্তিত মনে হলো না। স্বাভাবিক ভাবেই কাঁধের ব্যাগ সোফার পাশে রেখে সোফা টেবিলের উপর পা তুলে আড়াম করে বসলো। বৃষ্টির বোধহয় এই আড়ামটা সহ্য হলো না। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হেসে বলে উঠলো,
–ভাইয়ার তো আজকে বাসর রাত। ডেকোরেটরদের ফোন করে বাসরঘর সাজাতে বলবো বড়মা?
বড়মা শব্দটা বেশ টেনে লম্বা করে বলে মুখ টিপে হাসলো বৃষ্টি। উষির চমকে বৃষ্টির দিকে তাকালো। ক্ষণকালের জন্য তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। তারপর যখন মনে পরলো আজ সকালেই এক দূর্ঘটনার মধ্যে তার বিয়ে হয়েছে তক্ষুনি চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আজ তার সম্মান নিয়ে চূড়ান্ত এক ছেলেখেলা হয়েছে। সেটা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো কিভাবে! অবশ্য সারাদিন ঘুরে ফিরে টিম মেম্বারদের নিয়ে কাজ করে ভুলেই গেছিলো যে আজ এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। রাগে উষিরের দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছা হচ্ছে। বাবাকে মাঝরাস্তায় রেখে আসার সময় ভেবেছিলো, আর কোনদিন বাড়ি ফিরবে না। আর চব্বিশ ঘণ্টা না যেতেই কেমন ভ্যাবলার মতো বাড়ি ফিরে এসেছে। বাবা দেখলেই বলবে,
–খুব তো দেমাগ নিয়ে বললে, বাড়ি ফিরবো না। একদিনও বাপের ছায়া ছাড়া টিকতে পারলে না? এই নাকি তুমি আবার পলিটিক্স করবে! লজ্জার কথা!
আত্মসম্মানে আঘাত লেগে চট করে উঠে দাঁড়ালো উষির। নিজের ভুল ঢাকতে আমতা-আমতা করে বললো,
–আমি আমার জামাকাপড় নিতে এসেছি।
উষির আসার পরে বন্যা নিজ দ্বায়িত্বে আফসার সাহেবকে খবর দিয়েছে। আফসার সাহেব সেই যে দুপুরের পর বাড়ি ফিরে নিজের কাজের ঘরে ঢুকেছিলেন, তারপর আর বের হননি। পারিবারিক এই ঝামেলা থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই তার এই ব্যবহার। কিন্তু ঝামেলা থেকে মুক্তি চাইলেই কি আর মুক্তি পাওয়া যায়!
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই উষিরের শেষের বাক্য কানে গেলো। সাথে সাথেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসতে আসতে বললেন,
–জামাকাপড় নিয়ে কোথায় যাবে শুনি?
উষিরের দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। চোয়াল শক্ত, হাত মুঠো করা। স্থির, দৃঢ় গলায় বাবার প্রশ্নের উত্তর দিলো,
–আমার কি থাকার জায়গা অভাব আছে নাকি? ফ্ল্যাট আছে, ক্লাব আছে, পার্টি অফিস আছে।
আফসার সাহেব ছেলের কাছাকাছি এসে গমগমে স্বরে বললেন,
–তাহলে সাথে করে বউকেও নিয়ে যেও।
উষির দৃঢ় গলায় বললো,
–আমার কোন বউ টউ নেই।
–ঠাটিয়ে একটা চড় দেবো বেয়াদব ছেলে। বিয়ে করে বলছো বউ নেই? তোমার পার্টি অফিসে আর তোমার জনগনের মধ্যে কথাটা পাবলিশ করলে কি হবে বুঝতে পারছো?
আফসার সাহেব প্রচন্ড রেগে গেছেন। শাহিদা হালকা রাগ দেখিয়ে শক্ত গলায় বললো,
–কে বলবে?
আফসার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে পরিহাসের সুরে বললেন,
–সেই মহান দ্বায়িত্বটা আমিই পালন করবো।
নিজেদের কাজ ফেলে রাশা আর ময়না রান্নাঘর থেকেই লিভিংরুমে চলা বাকবিতন্ডা দেখতে লাগলো। নিজের প্রসঙ্গ আসায় রাশার কান খাঁড়া হয়ে উঠলো। নিজেকে আর আঁটকাতে না পেরে লিভিংরুমের দোরগোড়ায় হাজির হলো।
শাহিদার চোখে পানি চলে এসেছে। নাক টেনে অভিমানী গলায় বললো,
–তুমি বাবা নামে কলঙ্ক!
–ঠিক বলেছো শাহিদা। এই কলঙ্কিত বাবার ছেলে আজ একটা মেয়ের দ্বায়িত্ব নিয়েছে। এখন কলঙ্কিত বাবা হয়ে ছেলে সেই দ্বায়িত্ব পালন করছে নাকি সেটাও তো আমাকেই দেখতে হবে।
এরপর কঠিন গলায় বললো,
–তুমি তোমার ছেলেকে বলো রাশাকে নিয়ে বাইরে দাঁড়াতে। সম্মানের সাথে ছেলের বউকে বরণ করে ঘরে তুলবে তুমি।
উষির বাবার কথা না মেনে দুই পা ফেলে বললো,
–আমি চলে যাচ্ছি।
আফসার সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন,
–খবরদার বলছি উষির! এটা আমার আদেশ।
শাহিদা ভয়ে কেঁপে উঠলো। বাকিরা কানে আঙুল চাপা দিতে বাধ্য হলো। বাবার বাধ্য ছেলে হিসেবে পরিচিত উষির বাবার আদেশ ফেলতে পারলো না। গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালো। টি-শার্ট আর থি-কোয়াটার ট্রাউজার পরা রাশাও গিয়ে উষিরের পাশে দাঁড়ালো। ময়না চট করে ঘর থেকে রাশার বিয়ের ওড়না নিয়ে এসে রাশার মাথায় পরিয়ে দিলো। বিয়ের শাড়ি ময়নাকে দিলেও বিয়ের ওড়না নিজের কাছেই রেখেছিলো। কারণ ওড়নাটা রাশা নিজে পছন্দ করে কিনেছিলো। যদিও শাড়ির সাথে ম্যাচিং করেই তবুও কিনেছিলো তো রাশা নিজেই। ময়না দুইজনকে একসাথে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলো। কি মানিয়েছে দুজনকে! মনে মনে প্রাণ ভরে দোয়াও করে দিলো।
বন্যা আর বৃষ্টি বধূ বরণের ড্রেসাপের এই অড কম্বিনেশন দেখে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলো না। ক্যামেরায় ফটাফট ফটো ক্যাপচার করতে লাগলো।
গত রাতের রান্না করা পায়েস ফ্রিজে পরেছিলো। মাহফুজা সেটা এনেই শাহিদার হাতে তুলে দিলো। মুখ কালো করে সেই পায়েসই উষিরের মুখে আর রাশার মুখে দিলো। একবার খেয়েই রাশা মুগ্ধ হয়ে গেলো।
–ওয়াও খালাম্মা! কি টেস্টি পায়েস! পুরোটা খাই?
শাহিদা থমথমে মুখে পুরো বাটি রাশার হতে তুলে দিলো। রাশা আরেক চামচ মুখে তুলে চোখ বুজে স্বাদ অনুভব করলো। তারপর চোখ খুলে আনন্দিত গলায় বললো,
–কে রান্না করেছে?
বন্যা উচ্ছ্বাসিত স্বরে বললো,
–মা রান্না করেছে।
রাশা মিষ্টি হেসে মাহফুজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
–তুমি রান্না করেছো আন্টি? এতো টেস্টি রান্না করো? আসো তোমাকে একটা পাপ্পি দেই।
মাহফুজা ভয়ংকর দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আতংকিত দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকালো৷ তারপর কয়েক পা পিছিয়ে দূরত্ব বজায় রাখলো। তার এক মেয়ে তাকে বিপদে ফেললেও আরেক মেয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করলো। বৃষ্টি বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,
–পরের সেশন কিন্তু সালাম করা।
রাশা বৃষ্টির কথা শুনে আগে পুরো পায়েস শেষ করে মাথায় ভালো করে ঘোমটা টেনে নিলো। তারপর এগিয়ে এসে শাহিদার পা ছুঁইয়ে সালাম করতে চাইলো। সাথে সাথে শাহিদা দুই পা পিছিয়ে গেলো। রাশা হেসে ফেলে আবার দুই পা এগিয়ে গেলো। এভাবে বেশ কয়েকপা পেছানোর পর মাহফুজা এসে শাহিদাকে ধরলো। সাবধান করে বললো,
–সালাম না করা পর্যন্ত ছাড়বে না ভাবি। তার থেকে ভালো হবে এনার্জি খরচ না করে সালাম করতে দেওয়া।
রাশা দাঁত বের করে হেসে বললো,
–বুদ্ধিমতী আন্টি।
বলেই শাহিদা আর মাহফুজা দুইজনকেই সালাম করে উঠে দাঁড়ালো। শাহিদা ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলে কয়েকদিন আগে গড়া গোল্ড আর স্টোনের মিশেলে তৈরি চিকন চেইনের ব্রেসলেটটা উপহারস্বরুপ রাশার হাতে পরিয়ে দিলো। শাহিদার বুক হাহাকার করে উঠলো। আফসার সাহেব এটা না এনে দিলে কিছুতেই তিনি এই মেয়েকে ব্রেসলেটটা দিতেন না। কত শখ করে বানিয়েছে ছেলের বউএর জন্য। কিন্তু এমব বউকে দিতে হবে এটা কল্পনায় আসলেও বোধহয় ব্রেসলেটটা বানাতেন না।
পায়েস খাওয়ার পরই উষির হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেছিলো। খানিকপর বন্যার সাহায্যে রাশাও ঘরের সামনে গেলো। লাগেজগুলো এখনও ময়নার ঘরেই পরে আছে। কাল সকালে ওগুলো পাঠাবে বললো। তাই খালিহাতেই স্বামীর ঘরে প্রবেশ করলো রাশা।
উষির ক্লোজেট থেকে নিজের জামাকাপড় বের করছিলো। রাশা প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো। উষিরের কাছাকাছি গিয়ে বললো,
–দেখো, আমরা কিন্তু ম্যাচিউরিটির সাথে একটা অ্যাগ্রিমেন্টে আসতে পারি। লাইক, গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি। আমরা একসাথে যখন থাকবোই তখন দুই দিক থেকেই সমান এফোর্ট দিতে হবে। যেমন ধরো, আমাদের এই অ্যাগ্রিমেন্টে থাকবে, কেউ নক না করে ঘরে ঢুকতে পারবে না। আবার কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলাতে পারবে না। এই ধরনের একটা অ্যাগ্রিমেন্ট করলে কিন্তু ব্যাপারটা খুব ভালো হয় রাইট?
বেশ কয়েক চক্কর চলন্ত উষিরের পেছনে চলেও নিজের কথার উত্তর পেলো না রাশা৷ একসময় বিরক্ত হয়ে উষিরের হাত থেকে পোশাক টেনে নিয়ে বললো,
–কিছু বলছি আমি? কথা বলছো না কেনো?
উষির রেগে চিৎকার করে উঠলো,
–গো টু হেল।
–গেলে তোমার সাথেই যাবো বুঝেছো। আংকেল কি বললো মনে নেই? সব পাবলিক করে দেবে। সব মানে সব..
উষির রেগে রাশার হাত মুচড়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। তারপর হিসহিসিয়ে বললো,
–আমার সম্মান নিয়ে খেলেছো আজকে? তুমি জানতে, ওই ঘটনায় আমার কোন দোষ নেই। তারপরও তুমি কিছুই বলোনি। এখন এতো ঢং করছো, লজ্জা করছে না?
রাশা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলালো। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টার কোন কমতি রাখছে না৷ তাই উষিরের সামনেও ভেজা বেড়াল হলো না। হাসার চেষ্টা করলো,
–তোমার গায়ে এতো শক্তি! বাপরে বাপ!
উষির রাশাকে ছেড়ে দিতেই দুই কদম পিছিয়ে হাত ডলতে ডলটে রাশা বললো,
–ওই ঘটনার কথা বলছো তো? প্রথমত, সম্মানহানি শুধু তোমার না, আমারও হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সবাই সবটা জানে। শুধু কিছু একটা করা দরকার ছিলো জন্য করেছে। আর তৃতীয়ত, তোমার জন্য এটা নতুন কি ব্যাপার। দুইদিন পর পরই তো তোমাদের মতো পলিটিশিয়ানদের নতুন নতুন রিউমার ছড়ায়।
উষির ভয়ংকর দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকিয়ে লাগেজের চেইন আঁটকে বিছানা থেকে নামালো। রাশা আঁতকে উঠে উষিরের হাত টেনে বললো,
–আরে আরে, যাচ্ছো কেনো? আমাদের কথা তো শেষ হয়নি।
উষির নিজের হাত ছাড়িয়ে ঝুঁকে রাশার মুখের সামনে মুখ নিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
–আমাদের আর কোন কথা নেই। বুঝেছো?
শেষের শব্দটা চিৎকার করে বলেছিলো উষির। রাশা কেঁপে উঠলেও চুপ থাকলো না। উষিরের পেছনে ছুটতে ছুটতে বললো,
–আরে বাবা, ঘটনাটা তো শুনে যাও। প্লিজ?
আগে গিয়ে দরজার সামনে দুই হাত দুই দিকে দিয়ে দাঁড়িয়ে এক নিঃস্বাসে বললো,
–বিয়ে বাড়িতে তো অনেক লোকজন থাকে। তাই অতো লোকের ভিড়ে আমি ঘুমাতেই পারছিলাম না। না ঘুমালে তো বিয়েতে মজাই করতে পারতাম না। তাই ভাবলাম, নিলয় ভাইয়ার ঘর তো ফাঁকাই আছে। ওখানে গিয়েই ঘুমাই। আমি কি জানতাম নাকি যে ওই ঘরে তুমিও আছো। আমি তো জানতাম, নিলয় ভাইয়া নিজের ঘর কারো সাথে শেয়ার করে না তাই হয়তো ভাইয়ার রুমটা ফাঁকাই আছে। সত্যি জানলে কি নিজের এতো বড় ক্ষতি করতাম বলো? সৌরভকে আমি কত্তো ভালোবাসি। আমি তো নিজের ভালোবাসাকে হারালাম!
কোন কথাটা যে সত্যি আর কোন কথাটা যে বানানো তা হয়তো রাশা নিজেও বেমালুল ভুলে গেছে। আপাতত উষিরকে মানানোই তার এক মাত্র উদ্দেশ্য।
উষির রাগী গলার স্পষ্ট ভাবে বললো,
–আমি রাজি না।
রাশা এবারে হুমকির পথ বেছে নিলো,
–তুমি যদি রাজি না হও তাহলে আমি সু’ইসা’ইড করবো।
উষির বেশ মজা পেয়েছে, এমন ভাবে বললো,
–রিয়েলি?
–হুম।
–বড় বাঁচা বাঁচবো। গো অ্যাহেড। আ’ম সুপার এক্সাইটেড।
রাশা আড় চোখে উষিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–ম’রবো না। নিজের সুবিধামতোই সব করবো। আর তোমার নামে অ্যালিগেশন আনবো। তুমি বিয়ের পর থেকে আমাকে মেন্টালি আর ফিজিক্যালি টর্চার করছো। এরপর কি হবে জানো, তোমাকে তোমার পার্টি অফিসে ঢুকতেও দেবে না। ঘাড় ধরে বের করে দেবে। তোমার পলিটিক্স ক্যারিয়ার সেখানেই ফিনিশড!
উষির লাগেজ রেখে দুই তালি বাজিয়ে বললো,
–সুপার্ব আইডিয়া। আইডিয়াটা এক্সিকিউট করলেও করতে পারে। ক্যারি অন।
রাশা হতাশার সুরে বললো,
–তুমি এতো জেদি কেনো বলোতো? তোমার জায়গায় সৌরভ হলে এতোক্ষণে নাচতে নাচতে রাজি হয়ে যেতো।
উষির কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রাশাকে দেখতে লাগলো। খুব রাগ হলো রাশার। বিরক্তির সাথে বিড়বিড় করলো,
–কোন হেলদোল নেই! আশ্চর্য! এই মাথা নিয়ে করে পলিটক্স! ধ্যাত!
তারপর বড় করে শ্বাস ফেলে ঢোক গিলে উষিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। দুই হাত জরো করে অনুরোধ করলো,
–বাবা আমাকে ত্যাজ্য করে দিয়েছে। পরিবারের সবাই আমাকে ত্যাগ করেছে। আমার ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সব ব্লক করে রেখেছে। দুনিয়ার সব থেকে গরীব, দুঃখী আর অসহায় মেয়েটাকে একটু সাহায্য করো প্লিজ? তোমার এলাকায় এসেছি। আমি তো এখন তোমার ডাবল দ্বায়িত্ব। প্লিজ সাহায্য করো, প্লিইইইজ?
উষিরের মন গললো নাকি বোঝা গেলো না। শুধু নির্বিকার গলায় বললো,
-এখন কি করতে চাচ্ছো?
রাশা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বললো,
–তেমন কিছুই না। ঘরের বাইরে আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ আর ভেতরে আমরা নিজেরা নিজেদের মতো চলবো। আর একটা অ্যাগ্রিমেন্ট অনেক জরুরি। আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্য কিছু রুল তৈরি করবো আর সেটাই আমরা ফলো করবো। এতে তুমিও হ্যাপি আর আমিও হ্যাপি।
উষির হাপ নিঃশ্বাস ফেলে পেছন পথে হেঁটে বললো,
–ভেবে দেখবো।
রাশা উত্তেজিত হয়ে উঠলো,
–আরে ভাবাভাবির কি আছে? আমি এক্ষুনি অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার তৈরি করছি।
নিজের কথা শেষ করে খুঁজে খুঁজে খাতা কলম বের করে লিখতে শুরু করলো,
নিয়মসমূহ-
১. অনুমতি ব্যতীত ঘরে প্রবেশ নিষেধ।
২. কেউ কারো কোন জিনিসে হাত দেবে না। এমনকি কেউ কারো ব্যাপারে কথাও বলবে না।
৩. ক্লোজেটের ডান পাশ রাশার এবং বাম পাশ উষিরের। এবং বেডের বাম পাশ রাশার এবং ডান পাশ উষিরের। এবং বাকি তৈজসপত্রও এভাবেই দুটি অংশে ভাগ করা থাকবে। এবং কেউ কারো অংশে দখলদারি করবে না।
৪. অ্যালকোহল সেবন করে ঘরে আসা যাবে না। এবং ঘরে স্মোক করা যাবে না।
লেখা শেষে খাতা উষিরের হাতে দিয়ে বললো,
–আপাতত এইটুকুই পেরেছি। পরে মনে পরলে আস্তে আস্তে অ্যাড করে দেবো।
উষির বিছানায় বসে খাতা হাতে ভ্রু কুঁচকে বললো,
–এখানে অ্যালকোহলের ব্যাপার আসছে কেনো?
রাশা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
–খুব বিশ্রী গন্ধ আসে। একবার টেস্ট করেছিলাম। টানা দুইদিন ভাত খেতে পারিনি। তাই ওটা বাদ।
উষির মাথা নেড়ে মনোযোগ দিয়ে আবার পুরোটা পড়ে বললো,
–আরেকটা জিনিস অ্যাড করো। কেউ কারো টাকায় নজর দেবে না।
রাশা অত্যান্ত দুঃখী গলায় বললো,
–আজ গরীব হয়েছি জন্য এতো বড় অপমান করতে পারলে? টাকার তেজ দেখাচ্ছো আমাকে? মনে বড্ড আঘাত দিলে!
বলেই জোরে নাক টানলো। অর্থাৎ কান্না করতে চাচ্ছে। তবে এতে উষির একদম গললো না। রাশার হাত থেকে কলম ছিনিয়ে নিয়ে বললো,
— আমিই লিখছি।
পাঁচ নম্বর নিয়ম হিসেবে টাকার ব্যাপারটা লিখে কুটিল হেসে রাশার দিকে তাকালো উষির। তারপর নিয়মের খাতাটা যত্ন করে রেখে নিজের নির্ধারণ করা জায়গায় গিয়ে শুয়ে পরলো। রাশা হতাশ হয়ে নিজেও ঘুমালো। এবং পরেরদিন সকাল থেকে দুজনেই খুব দ্বায়িত্বের সাথে নিয়মগুলো ভঙ্গ করতে লাগলো।
চলবে…
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৫
সকাল সারে সাতটা থেকে অ্যালার্ম বেজে চলেছিলো। প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর বাজা এই অ্যালার্মের শব্দে উষির মহা বিরক্ত। একসময় আর না পেরে দুম করে উঠে বসলো। রাশা নিজের বর্ডার ক্রস করে উষিরের বালিশে এসে শুয়ে পরেছে৷ আর উষির নিজের সাইডের, নিজের বালিশের একদম কর্নারের জায়গায় শুয়ে ছিলো। রাশার বালিশ তার পায়ের দিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ ব্ল্যাংকেটও অর্ধেক মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বাকি অর্ধেক রাশা নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। এসির পাওয়ার চব্বিশে দেওয়া। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো উষিরের। এসির পাওয়ার সাতাশের নিচে কোনদিনও দেয়নি সে৷ ঠান্ডা খুব একটা সহ্য করতে পারে না। এই মেয়ে কখন পাওয়ার কমালো আর কখন এইভাবে এসে শুয়ে পরলো, কিচ্ছু টের পায়নি! অবশ্য বিড়ালের মতো এমন গা ঘেঁষে শুয়ে থাকলে ঠান্ডা বুঝবেই বা কিভাবে!
আবার অ্যালার্ম বেজে উঠলো। রাগে কিড়মিড়িয়ে উঠলো উষির৷ ওপাশ থেকে মোবাইল নিয়ে রাশার কানের কাছে ধরলো। তবুও তার কোন হেলদোল নেই। শুধু একটু চোখ কুঁচকে বিরক্তির ভাব করে আবার ব্ল্যাংকেট মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। উষির হাল ছাড়লো না। এবারে রাশার ফোনের সাথে নিজের ফোনেও সেম টিউন অন করে দুই ফোন একসাথে ধরলো। কাজও হলো। ধরফর করে উঠে বসলো রাশা। চোখ ডলে চোখ খোলার চেষ্টা চালালো। না পেরে আবার শুয়ে পরতে চাইলো। উষির হাত শক্ত করে ধরে বসিয়ে রাখলো৷ তারপর বেড সাইড টেবিল থেকে পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে রাশার মুখে ছুড়ে মারলো। চমকে উঠলো রাশা। দিশা না পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে মুখের পানি মুছে অতি কষ্টে উষিরের দিকে তাকালো৷ উষির রাগে ফুঁসছিলো। রাশা রেগে বললো,
–পানি দিলে কেনো?
উষির দ্বিগুণ রেগে উঠলো,
–অ্যালার্ম দিয়ে আমার ঘুম নষ্ট করলে কেনো?
চকিতে হুশ ফিরলো রাশা। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো পৌনে আটটা বাজে। উষিরকে আর কিছুই বললো না। তড়িৎ উঠে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে ড্রিম লাইট অফ করে বাকি সব লাইট অন করে দিলো৷ সাথে এসির সুইচও অফ করে দিলো। রাশা উঠে যাওয়ায় উষির আবার শুয়ে পরেছিলো। কিন্তু এমন ব্যবহারে ভয়ংকর রেগে বিছানা ছেড়ে তেড়ে গেলো রাশার দিকে। রাশা নিজেকে সেফ করতে এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। উষির বাইরে থেকে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে বললো,
–এরপর আবার আমার সাথে ফাজলামো করতে আসলে দ্বিতীয়বার ভেবে আসবে। অন্তত আজকের দিনের কথা মাথায় রেখে আসবে, বুঝেছো?
রাশা তখন কিছুই বুঝলো না। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হওয়ার সময় আসল মানেটা বুঝলো। তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। উষির আবার ঘুমে কাত হয়ে পরে আছে। বেশ কয়েকবার ডেকেও লাভ হলো না। মেজাজ অত্যাধিক খারাপ হলেও কষ্ট পেলো খুব। ওয়াশরুমে ঢুকে এমন আটকে থাকতে হবে, সেটা কে জানতো!
ওয়াশরুমের দরজা খুললো দশটার পর। রাশা ওখানেই ঘুমিয়ে পরেছিলো। উষির দেয়াল ঘেঁষে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ঘুমন্ত রাশাকে দেখলো। তারপর আশেপাশে দেখলো। রাশা দুই পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। শাওয়ারটা একটু এদিক ওদিক ঘুরালে পানি সোজা রাশার উপর পরবে। বাঁকা হাসলো উষির। তারপর প্ল্যান মাফিক কাজ করে সফলতাও পেলো। হকচকিয়ে উঠে পরলো রাশা। ভিজে একাকার অবস্থা। ঘটনা বুঝতে পেরে আগুন চোখে উষিরের দিকে তাকালো। উষিরও স্থির দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা হুমকি দিয়ে চলে গেলো।
রাশা সকালে হওয়া ঘটনা বেমালুম চেপে গেলো। ড্রেস চেঞ্জ করে উষিরের একটা স্লিভলেস টি-শার্ট আর একটা শর্টস পরলো। টি-শার্ট তার হাঁটু পর্যন্ত চলে আসতে চাইছিলো আর শর্টস তার থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট হয়ে রইলো। উষির ভ্রু কুঁচকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখলো৷ রাশা সেটা পাত্তাও দিলো না৷
ভেজা চুলগুলো এখনও হালকা করে বাঁধা। আজকে চাকরির প্রথম দিন আর আজকেই লেট করে ফেললো। তাই আর দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব রান্নাঘরে হাজির হলো। ময়না থালাবাসন মাজছিলো আর মাহফুজা কিছু একটা রান্না করছিলো। শাহিদা ডাইনিং টেবিলে বসে মটরশুটির দানা আলাদা করছে। রাশাকে রেখেই তেঁতে উঠলো সে,
–আজ তো বাড়ির বউ হয়েই এসেছো। তাহলে আজকে এসব কি পরে এসেছো?
রাশা কোমড়ে হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাজ খুঁজছিলো। ওভাবেই বললো,
–সরি খালাম্মা, এখন আমি ডিউটিতে এসেছি। একটু দেরি হয়েছে কিন্তু আমি আমার কাজে ভীষণ সিনসিয়ার। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি, প্লিজ।
হকচকিয়ে গেলো শাহিদা। তাকে পুনরায় হকচকিয়ে দিয়ে পেটে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো রাশা। কাতরাতে কাতরাতে বললো,
–সেই কাল অল্প পায়েস খেয়েছি। ক্ষিদের জ্বালায় ম’রে গেলাম!
শাহিদা কপাল কুঁচকে কিছুটা গরম করেই বললো,
–তো খেতে মানা কে করেছে?
রান্নাঘর থেকে সোজা এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পরলো রাশা,
–খেতে দিচ্ছো আর কই? আমি কি কিছু চিনি নাকি যে নিজে নিয়ে খাবো!
শাহিদা ময়নাকে হাঁক দিয়ে ডেকে রাশাকে খাবার দিতে বললেন। ময়না তড়িঘড়ি করে হাত ধুরে রান্নাঘর থেকে পরোটা, ভাজি আর মিষ্টি দিয়ে গেলো৷ রাশার পরোটা একদম পছন্দ না। কিন্তু কিছু বললো না। সেটাই গোগ্রাসে গিলতে লাগলো৷ খাওয়া শেষে আবার রান্নাঘরে গেলো। ময়নার থালাবাসন মাজা শেষ। রাশা ঠোঁট কামড়ে কিছু চিন্তা করে তার খাওয়া প্লেট এনে সিঙ্কের উপর রাখলো। প্লেট উল্টেপাল্টে কিছু দেখে অল্প ডিসওয়াসিং লিকুইড প্লেটে দিয়ে হাত দিয়েই অল্প ছড়িয়ে সাথে সাথেই পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললো। তারপর এক চোখ বুজে প্লেট মুখের সামনে ধরলো। ঠোঁট কামড়ে পরিষ্কার কেমন হয়েছে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। প্লেট রাখার জায়গায় প্লেটটা রেখে এবারে রান্নার কাছে গেলো। মাহফুজার থেকে জোর করে হাতের চামচ নিয়ে একটু পাতিলে নাড়াচাড়া করলো। মাহফুজা মোরব্বা বানাচ্ছিলো। রাশার কান্ড দেখে খুব বিরক্ত হলো। চামচ ফিরিয়ে দিতেই একপ্রকার ছোঁ মেরে চামচ নিয়ে নিলো।
এরপর আসলো ঘর মোছা আর ঘর ঝাট দেওয়ার কাজ। ময়নার থেকে ঝাটা নিয়ে সবাইকে অবাক করে রান্নাঘরটা কোনমতে ঝাট দিলো৷ তারপর মপ চুপচুপ করে ভিজিয়ে এনে পুরো রান্নাঘর ভিজিয়ে ফেললো। এরপর রাশার মুখে হাসি ফুটে উঠলো৷ শাহিদার দিকে তাকিয়ে বললো,
–সব কাজ কিন্তু শেষ খালাম্মা। এবার আমার ছুটি চাই।
মাহফুজা অবাক হয়ে এতোক্ষণ দেখছিলো। এবারে বললো,
–এটা কেমন কাজ ছিলো? এই টুকু কাজের পেমেন্ট বিশ হাজার!
রাশা গম্ভীরমুখে বললো,
–অ্যাগ্রিমেন্টে কিন্তু শুধু কাজের কথা লেখা আছে। কতটুকু করবো তা লেখা নেই।
মাহফুজা তটস্থ ভঙ্গিতে বললো,
–তাহলে পরিমাণও অ্যাড করে দেই। এই কাজের জন্য বিশ হাজার নষ্ট করার কোন মানেই হয় না!
রাশা স্থির চোখে তাকিয়ে বললো,
–অ্যাকর্ডিং টু রুল, এটা পসিবল না।
–এই রুল কবে তৈরি হলো?
রাশা দাঁত বের করে হাসলো,
–আজ, এখনই।
শাহিদা চুপ করে নিজের কাজ করছিলো। এই একদিনে রাশার প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি খুব ভালো বুঝে গেছেন। তাই আর নিজের মাথা ব্যাথা বাড়াতে চাইলেন না। রাশার সেটা সহ্য হলো বলে মনে হলো না। খাতা আনতে লিভিংরুমে হাজির হলো। ময়না রাশার কথা শুনে মাহফুজাকে মিনমিন করে বললো,
–আমিও একখান ওইসব কাগজ তৈরি করমু ম্যাডাম?
মাহফুজা ভয়ংকর এক ধমক দিয়ে ময়নাকে থামিয়ে দিলো। এমন চলতে থাকলে তো বাড়িতে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। সবাই নিজেদের মন মরজি কাগজের অ্যাগ্রিমেন্টের দোহাই দিয়ে করিয়ে নেবে!
রাশা নিজের ছুটির দরখাস্ত শাহিদার দিকে ধরে কলম বাড়িয়ে দিলো৷ শাহিদা ভ্রু কুঁচকে দেখে বুঝলো, ওটা ছুটির দরখাস্ত ছিলো৷ তাকে কোন প্রশ্ন করতে হলো না। রাশা নিজে থেকেই বললো,
–আমি একটু শপিংএ যাবো। যেহেতু সব কাজ শেষ তাই নিয়মমাফিক আমাকে ছুটি দিতেই হবে।
শাহিদা থমথমে গলায় বললো,
–তোমার নিয়মের মধ্যে আর কি কি নিয়ম পরে?
রাশা সুন্দর করে হেসে বললো,
–সেটা পরিবেশ, পরিস্থিতি আর মানুষভেদে তৈরি হয়। আগে থেকে কিছু বলা সম্ভব হয় না।
শাহিদা আর কথা বাড়ালেন না। কলমের আঁচড় টেনে ছুটির দরখাস্ত অ্যাপ্রুভ করলেন।
রাশা দরখাস্ত পকেটে পুড়ে সোজা রুমে চলে গেলো। উষির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছিলো। হাতে এক গাদা জেল নিয়ে মাঝারি সাইজের চুলগুলোকে সাইজ করে দিচ্ছিলো। রাশা সরাসরি গিয়ে উষিরের সামনে দাঁড়ালো। বলাই বাহুল্য, অনুমতি নেওয়ার ধার দিয়েও সে যায়নি।
উষির ভ্রু কুঁচকে রাশার বাড়িয়ে ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
–সমস্যা কি?
–কিছুই না। শপিংএ যাবো। টাকা লাগবে।
–কাল রাতের অ্যাগ্রিমেন্টের কথা ভুলে গেছো নাকি?
–না, ভুলবো কেনো? আমি তো আজীবনের জন্য নিচ্ছি না। ধার চাচ্ছি।
উষির স্পষ্ট গলায় বললো,
–দেওয়া যাবে না।
–আচ্ছা মানুষ তো তুমি! কেউ ধার চাইলে এভাবে মানা করতে আছে নাকি? তুমি না পলিটিক্স করো। আর ধার দিতে পারছো না? এমন করলে কিন্তু ভোট দেবো না।
–তোমার ভোট আমার দরকারও নাই।
রাশা বুঝলো, এভাবে হবে না। অন্য পথ ধরতে হবে। গলার স্বর নরম করে বললো,
–আন্টি এইসব ড্রেস মানে তোমার না, আমার কাছে যেমন ড্রেস আছে ওইগুলো পরতে মানা করেছে। নতুন বউএর নাকি শ্বশুরবাড়িতে এইসব মানে ওইসব মানে টি-শার্ট, টপস এক্সেট্রা এক্সেট্রা পরতে হয় না। আমার কাছে তো বাড়তি কিছুই নাই। যা ছিলো সব তো সৌরভের কিনে দেওয়া। কথা ছিলো, বিয়ের পর আমি ওর দেওয়া ড্রেসই পরবো। কিন্তু বিয়ে তো হয়ইনি। এখন ওর দেওয়া ড্রেস পরলে তোমার কি ভালো লাগবে বলো?
উষির কাজে শেষ করে রাশার দিকে একপলক তাকিয়ে পারফিউম হাত নিলো। তারপর নির্লিপ্ত সুরে বললো,
— খুব লাগবে। তোমার পিছনে আমি এক টাকাও খরচ করবো না।
রাশা চুপ করে বড় করে শ্বাস নিলো। তারপর মুখে আরো মধু ঢেলে বললো,
–ওগুলো তো আনিনি। ভেবেছিলাম কারো ভালো লাগবে না, তাই রেখেই এসেছি।
–ভালো করেছো।
বলেই পারফিউম মেখে হাত ঘড়ি পরতে লাগলো। রাশা উৎকণ্ঠিত গলায় বললো,
–তোমাদের বাড়িতে কেউ আসলে যদি দেখে নিউ ব্রাইড শর্টস আর ক্রপ টপ পরে ঘুরছে, তাহলে কি কারো ভালো লাগবে?
উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুঝলো, টাকা না দেওয়া পর্যন্ত পিছু ছাড়বে না। তাই বললো,
–কবে ফেরত দেবে?
–কি?
–টাকা। ধার নিলে কবে ফেরত দেবে?
–বেতন পাওয়ার পর।
রাশা চোখ পিটপিট করে নিরীহ ভঙ্গিতে উত্তর দিলো। উষিরের তার কাজ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না। ভাবলো হয়তো আগে থেকেই কোন চাকরি করতো, সেটার কথাই বলছে৷
একটা কাগজ কলম নিয়ে আসলো৷ রাশার সামনে ধরে বললো,
–এখানে সবটা স্পষ্ট করে লিখে সাইন করে দাও।
রাশা হাসার চেষ্টা করলো,
–আবার এসব কেনো?
–তোমাকে প্রচন্ড পরিমাণে বিশ্বাস করি তো তাই এইসব। লেখো কত টাকা নিচ্ছো আর কবে ফেরত দেবে।
রাশা গম্ভীরমুখে লিখলো,
“বেতন পাইবার মূহুর্তে টাকা পরিশোধ করা হইবে।”
লিখে ডেট লিখে নিচে নিজের সাইন করে করুন মুখ করে কাগজটা উষিরের কাছে ফেরত দিলো। টাকার অ্যামাউন্ডের ব্যাপারে মাথা ঘামালো না উষির। নিজের ক্রেডিট কার্ড রাশার দিকে বাড়িয়ে দিলো। সাথে পাসওয়ার্ডও লিখে দিলো। রাশা কার্ড উলটে পালটে দেখে বললো,
–এটার লিমিট কত?
–আনলিমিটেড।
রাশা বেশ সময় নিয়ে মিটমিট করে হাসলো। তারপর টেনে টেনে বললো,
–আচ্ছা..ঠিক আছে ঠিক আছে। ধন্যবাদ। বর হলে এমনই হতে হয়। গুড হাজবেন্ড!
উষির কপাল কুঁচকে রাশার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। সকালে জরুরি মিটিং ছিলো তার। না খেয়েই চলে গেলো। রাশা ক্রেডিট কার্ড যত্ন করে রেখে আবার নিচে গেলো নিজের লাগেজ আনতে।
ময়না রাশার লাগেজের সাথে গহনার বক্স আর শাড়িও এনে দিলো। রাশা বিরক্ত হয়ে বললো,
–জুয়েলারি এনেছো কেনো? এটা তো তোমাকে দিয়েছি। দেওয়া জিনিস কেউ ফেরত নেয় নাকি?
ময়না কেঁদে ফেললো,
–সারাডি রাত ঘুমাইবার পারি নাই গো। এই জিনিস আমার হলি আমার জীবনডা শ্যাষ হয়ে যাবি। আমি আর পারমু না। তোমার জিনিস তুমিই নেও।
রাশা সজোরে ঘাড় নাড়লো। জুয়েলারি বক্স আর শাড়ি ময়নার হাতে জোর করে তুলে দিয়ে বললো,
–কখনোই না। কাউকে দেওয়া জিনিস আমি ফেরত নেই না। এগুলো তোমার মানে তোমারই।
ময়না এবারে শাহিদার কাছে ছুটলো। হুহু করে কেঁদে উঠে বললো,
–ম্যাডাম, আফনে কিছু কন? আমি গরীব মানুষ। এই গয়নার ভাড় নিবার পারমু না।
শাহিদা গম্ভীরমুখে মোটর দানা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন,
–ওর জিনিস ও ভালো মনে করেছে দিয়েছে। এখানে আমি কি বলবো?
মাহফুজারও একই কথা। ময়না পরলো অথৈ জলে। কূল না পেয়ে ফ্লোরে বসে কপাল চাপড়ে বিলাপ করতে লাগলো। রাশা হতভম্ব হয়ে গেলো। চোখ পিটপিট করে ময়নার কান্নার ধরন দেখতে লাগলো। কান্নার স্টাইলটা তার দারুন লাগলো। শিখে নিতে লাগলো ভালো করে। শাহিদা বিরক্ত হয়ে বললো,
–লকারে রেখে আয়, তাহলেই তো হলো।
–ও ম্যাডাম, তহন আরো চিন্তায় থাকমু। মনে হইবো, তালা ভাইঙ্গা কেউ নিয়া গেছে। এতো গয়না আমি কিছুতেই নিমু না। নিলে আমি বাঁচবার পারমু না।
রাশা বিরক্ত হয়ে দুইটা হার, এক সেট কানের দুল, দুটো চুরি আর একটা আংটি বের করে বললো,
–আচ্ছা তো শাড়িটা নাও। আর এইগুলো নাও?
জুয়েলারি বক্সে জুয়েলারি ছাড়াও আরো কিছু জুয়েলারি ছিলো৷ ময়না সেগুলো না নেওয়াতে রাশা সিদ্ধান্ত নিলো, রাস্তায় যেতে যেতে যত ভিক্ষারি দেখবে, সবাইকে একটা একটা করে দিয়ে দেবে। করলোও তাই। শপিং করতে যাওয়ার সময় সবাইকে একটা একটা করে জুয়েলারি দিয়ে দিলো। তারা যখন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো তখন রাশা মিষ্টি হেসে বলেছিলো,
–আমার বরের জন্য দোয়া করবেন। আপনাদের জন্যেই কাজ করে। সবসময় যেনো ভালো পথে আপনাদের সেবা করতে পারে, সেই দোয়াই করেন। সাথে তার সুস্থতার দোয়াও করবেন। সুস্থ না থাকলে তো আর কাজ করতে পারবে না।
ভিক্ষারিদের মধ্যেকার একজন বললো,
–তোমার বরের নাম কি মা?
–উষির৷ পুরো নাম আদনান কায়সার৷ আপনাদের সেবাতেই নিজেকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখে।
রাশার কর্মকান্ডে পথচারীরাও হতভম্ব ছিলো। কিছু কিছু অতি উৎসাহী পথচারী ছবিও তুলে রেখেছে। কিন্তু সবার পরিচিত উষিরের নাম শুনে প্রায় সকলেরই চক্ষু চরকগাছ। সবারই ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন, উষির বিয়ে করলো কবে?
আবার কিছু মানুষ ভাবলো, মেয়েটা মিথ্যা বলছে। এইরকম মেয়েদের তো অভাব নেই। কত মেয়েই নিজেদের কল্পনার জগতে থেকে এইসব কথাবার্তা ছড়ায়! তবে কথাটা ছড়াতে সময় লাগলো না। এলাকা থেকে শুরু করে স্যোশালমিডিয়াতেও উষিরের বিয়ের খবর আর রাশার দানশীলতার খবর ছড়িয়ে পরলো।
চলবে…