তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
4

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃশেষ_পর্ব

রাশা জানালার পাশের সিটে বসেছে৷ প্লেন টেক অফ করার পর সিট বেল্ট খুলে সিটের হাতলে হাত রেখে এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে মেঘেদের আনাগোনা দেখতে লাগলো। বুক চিড়ে কান্না আসছে তার। ঠোঁট কামড়ে কোনমতে কান্না আটকে অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। কিছু সময় পর পাশের সিট থেকে একজন তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিলো। বিরক্ত হলো সে। ও কি টিস্যু চেয়েছে নাকি! এমনিতেই মন মেজাজ ভালো নেই, তার উপর এইসব উটকো ঝামেলা। তবুও ভদ্রতার খাতিরে ছোট করে বললো,
–লাগবে না। ধন্যবাদ।

দৃষ্টি তার তখনও বাইরের দিকে। কে টিস্যু দিয়েছে তার দিকে ফিরেও তাকালো না৷ এই অপমান করার পরেও পাশের সিটের মানুষটার আক্কেল জ্ঞান কম আছে বলেই তার বোধ হলো৷ না বলার পরেও হ্যাংলার মতো এখনও হাত বাড়িয়েই আছে৷ উষিরের উপরের রাগটা পাশের সিটের মানুষটার ব্যবহারে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বড় বড় শ্বাস ফেলে কড়া কিছু কথা শুনানোর জন্য ঘুরতেই এক মূহুর্তের জন্য থমকালো। পাশের সিটের সেই বেয়াদপ মানুষটা উষিরই। তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। রাশার ঠোঁট ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠলো। তারপর উষিরের বুকে ঝাপিয়ে পরে কান্না শুরু করে দিলো। উষির মৃদু হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে চাইলো। কিছুক্ষণ পর আশেপাশের সবার অদ্ভুত নজর দেখে রাশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–সবাই কেমন নজরে তাকিয়ে আছে দেখেছো? ঠিক করে বসো।

রাশা কান্না করতে করতেই মাথা নাড়লো। উষির প্রশান্তির শ্বাস ফেলে মুচকি হেসে তার মাথায় চুমু দিয়ে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো। নিজেই এমন কাজ করেছে অথচ রাশাকে দোষ দিয়ে আফসোসের সাথে বললো,
–লজ্জায় আমার মাথা কাঁ’টা যাচ্ছে রাশা। কি না কি করাচ্ছো আমাকে দিয়ে!

রাশা উষিরের বুকে মুখ গুজে লাজুক হাসলো। তক্ষুনি একজন এয়ার হোস্টেস এসে বিনয়ী সুরে বললো,
–এনি প্রবলেম স্যার?

লজ্জায় উষিরের মাথা এবারে সত্যি সত্যি কাঁ’টা যাওয়ার জোগাড়। এয়ার হোস্টেসকে উত্তর দেওয়ার আগে একটু ঝুঁকে রাশাকে ফিসফিস করে বললো,
–ঠিক করে বসো রাশা। সবার প্রবলেম হচ্ছে৷

রাশা এবারেও মাথা নাড়লো। শুধু মাথা নেড়েই ক্ষান্ত হলো না। উষিরের বুকে এমন ভাবে মুখ গুজে রাখলো যে মনে হলো, বুকের ভেতরে অপা’রে’শন করে ঢোকা গেলে এই মূহুর্তে সে সেটাই করতো। উষির ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,
–সরি, আমার ওয়াইফ একটু সিক। প্রথমবার প্লেন জার্নি করছে তো। খুব ভয় পেয়েছে। বুঝতেই পারছেন।

কথার সাথে মাথায় আঙুল ঘুরিয়ে রাশার মেন্টাল হওয়ার সার্টিফিকেট দিতেও ভুললো না৷ সব শুনে এয়ার হোস্টেস মিটিমিটি হেসে মাথা নেড়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকার পর রাশা মিনমিন করে বললো,
–সরি উষির।

–উহু, মাফ হবে না।

রাশা ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা তুললো। তারপর ক্ষোভ মেশানো গলায় বললো,
–তুমি না আসলে আমি সোজা টেমস নদীতে ঝাঁপ দিতাম। তখন মাফ করতে?

উষির ভ্রু কুঁচকে রাগী চোখে তার দিকে তাকাতেই রাশা আবার বুকে মাথা রেখে বড় করে শ্বাস ফেলে কথা ঘুরিয়ে বললো,
–আমি এই ফ্লাইটে যাবো সেটা তুমি জানলে কিভাবে?

–ওয়েল, এটাতে একটু ক্ষমতা ঝাহির করতে হয়েছিলো।

নাটকীয় সুরে বলে দুজনেই হেসে ফেললো। তারপর বেশ সিরিয়াস হয়ে বললো,
–ফ্রেন্ডের সহায়তায় তোমার নাম খুঁজে বের করেছি। আর তারপর লাকিলি লাস্ট মোমেন্টে টিকিট পেয়েছি। অ্যান্ড দ্য এন্ড, তোমার পাশের জনকে আমার সিটে বসিয়ে আমি তোমার কাছে চলে এসেছি।

–আর কোথাও যাবে না তো?

রাশার গলায় অসহায়ত্বের সুর। উষির তাকে আস্বস্ত করে নাটকীয় সুরে গানের লাইনে নিজের উত্তর দিলো,
–তুমি যেখানে, আমি সেখানে।

বলেই আবার হেসে উঠলো। উষির নিজের কথা প্রতিটি ক্ষণে পালন করেছে৷ রাজনীতি ছেড়ে রাশার জন্য লন্ডনে সেটেল হয়ে গেলো। পরের দুই বছর রাশা নিজের ব্যারিস্টার পড়ার স্বপ্ন পূরণ করেছে। আর উষির তার আরেকটা স্বপ্ন পূরণে কালিনারি আর্টসের দুই বছরের কোর্স কমপ্লিট করে সেখানেই রেস্টুরেন্ট ওপেন করেছে৷ তাদের কোম্পানি লন্ডনে নতুন একটা ব্রাঞ্চ ওপেন করায় উজান আর নোঙরও তাদের কাছে চলে আসলো। এরপর নোঙরও উষিরের পথ অনুসরণ করে কালিনারি আর্টসের কোর্স বেশ সফলতার সাথে শেষ করে সেই রেস্টুরেন্টেই হেড শেফের অর্থাৎ উষিরের অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে জয়েন হয়েছে। এসবের পর কেঁটে গেছে আরো তিন বছর। মোটমাট এই পাঁচ বছরে উষির রাশার জীবনে নতুন দুই অতিথি এসেছে। তিন বছরের জমজ দুই মেয়ে, পর্শিয়া আর উর্শিয়া। মেয়েদের আগমনে সবাই খুশি হলেও নোঙর হসপিটালেই হাত পা ছড়িয়ে কান্না শুরু করেছিলো৷ তার অনেক শখ, রাশার ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দেবে। কিন্তু ছেলের বদলে তো মেয়ে হলো৷ এখন উপায়! কোন কিছুতেই তাকে যখন মানানো গেলো না তখন নোঙরের না হওয়া ছেলে যত ছোটই হোক, বিয়ে তাদের মেয়ের সাথেই দেওয়া হবে বলে চুপ করানো হয়েছিলো। কিন্তু এখন ছয় মাসের ছেলেকে কোলে নিয়ে প্রায় প্রায়ই পুরোনো কথাটা সবাইকে মনে করিয়ে দেয়।

উষির মেয়েদের ছাড়া রেস্টুরেন্টে একদমই যায় না৷ মেয়েদের সামনে না রাখলে নাকি তার হাত চলে না। রাশা সকালে তাদের ডে কেয়ারে রেখে আসে আর ছুটির পর উষির গিয়ে তাদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায়। লাঞ্চ সেখানে করার পর বিকালে রাশা আসলে একসাথে চারজন বাড়ি ফেরে।
নোঙর এখনও তার মাতৃত্বকালীন ছুটি কাঁটাচ্ছে। ছুটি কবে শেষ করবে তা একমাত্র সেই জানে। তার পরেও প্রায় প্রায়ই বেবি স্ট্রলারে তার ছেলে উষানকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট চলে আসে আর নানান রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে। কন্সিভ করার পর থেকে তার খাবারের টেস্ট একদম বদলে গেছে। নতুন টেস্ট অনুসারেই পুরোনো রান্নার নতুন স্বাদ তৈরির পরীক্ষা নিরিক্ষা চলে সর্বক্ষণ।

সময়টা এখন বিকাল। ছুটির দিন হলেও উজানের মিটিং থাকায় রেস্টুরেন্ট খোলা রাখা হয়েছে৷ তার মিটিং উষিরের রেস্টুরেন্টেই হয়। নোঙর এটাকে বিজনেস স্ট্র‍্যাটেজি নাম দিয়েছে।

–পাপা

মেয়ের আদো আদো বুলির ডাক শুনে উষিরের মন ভরে উঠলো। মেয়েকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে নরম গালে নিজের গাল ঠেকিয়ে বললো,
–ইয়েস পাপা?

–ওয়ান্ত ইউ মিত মাই বিএপ?

উষির চমকে উঠে মেয়ের দিকে তাকালো। আদো আদো বুলিতে ইংরেজি শিখেছে সবার আগে৷ বিদেশে থাকার এই এক কুফল৷ মেয়ে মাতৃভাষা শেখার আগে গড়গড় করে ইংরেজদের ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছে। সাথে তাদের কালচারও। নিজের দেশের এক সম্মানিত সাবেক নেতা হিসেবে ব্যাপারটা তার মোটেও ভালো লাগে না। নাহলে বাঙালি মেয়ে হয়ে বাবাকে বিএফ সম্পর্কে বলে! কি ভয়ংকর!

–সরি পাপা শুনতে পায়নি। আবার বলো?

মেয়ের ইংরেজি উত্তর তাকেও ইংরেজিতেই দিতে হয়। নাহলে এই আধা ইংরেজী ম্যাডাম বুঝতে পারেন না।

–বয়পেন্ত। পত্তি দানে।

–দানে আবার কি?

রাশা অফিস থেকে ফিরতেই তাদের দেখে সেখানে এসেছিলো। আর তখনই বাবা মেয়ের এই কথোপকথন শুনে বিচলিত গলায় প্রশ্নটা করলো। উষির মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে বেশ গর্বিত গলায় বললো,
–ও বলছে, পর্শি জানে। মেয়ের এইটুকু ভাষা বোঝো না?

–কি করে বুঝবো? আমি তো আর সাত বছর পর্যন্ত তোতলা ছিলাম না। কোন শব্দের অক্ষরও উল্টাপাল্টা বলতাম না। সেন্টেন্সেও ভুল হতো না।

রাশার মুখ বেঁকিয়ে বলা কথাটা শুনে উষিরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। ভিডিওকলে মাহফুজা একবার বলেছিলো, পর্শিয়া নির্ঘাত রাশার মতো হয়েছে৷ একদম স্পষ্ট করে কথা বলে। আর উর্শিয়া বাবার মতো। উষির নাকি সাত বছরের আগে স্পষ্ট করে কথাই বলেনি। কথা যেমন আটকে যেতো তেমনই উল্টাপাল্টা শব্দ ব্যবহার করতো৷ আর সেটা সবাই শুনে ফেলেছিলো। তারপর থেকে রাশার এক ডায়লগ।

স্ত্রীর কথার জবাব অন্য সময়ের জন্য তুলে রেখে ঝুঁকে মেয়ের গাল টেনে আদূরে গলায় বললো,
–পাপা, তুমি এখন অনেক ছোট। এই বয়সে এইসব করতে হয় না। আগে বড় হও তারপর বয়ফ্রেন্ড বানাবে।

–নো। মাই বপ্পেন্দ। তুমি না মারি, আমি কই বলবি না।

উর্শিয়া ফ্লোরে পা বাড়ি দিয়ে দুই হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে নিজের রাগ জাহির করলো। উষির বহু কৌশলে মেয়েদের বাংলা শেখাচ্ছিলো। আর এই হলো তার ফল! বড় মেয়েটা কি সুন্দর বাংলা বলে আর ছোট মেয়েটা বাংলা বলতে গেলেই কি দিয়ে কি বলে তা বোঝার সাধ্য উষিরের ছাড়া আর কারোর নেই। অথচ গড়গড় করে ইংরেজি বলে চলে৷ উষির মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আহত স্বরে বললো,
–পাপা বোঝেনি মা। তুমি ইংরেজদেরই ফলো করো।

যদিও কথাটা উষিরের জন্য লজ্জার তবুও বলতেই হয়, মাঝে মাঝে সেও ছোট মেয়ের কথা বুঝতে পারে না। বাবার কথায় উর্শিয়া ঠোঁট উলটে আহ্লাদী গলায় কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো৷ উষির অসহায় চোখে রাশার দিকে তাকাতেই রাশা তপ্ত শ্বাস ফেলে হাঁটু মুড়ে উর্শিয়ার সামনে বসলো। তারপর মেয়ের হাতে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বললো,
–আপুকে খুঁজে নিয়ে এসো। পিকনিকে যাওয়ার সময় হয়েছে তো৷ গো ফাস্ট বেবি।

পিকনকের কথায় উর্শিয়ার চোখ চকচক করে উঠলো। নতুন হওয়া বয়ফ্রেন্ডকে ভুলে এক দৌঁড়ে বোনের খোঁজে বের হলো। উর্শিয়া চলে যেতেই উষির রাশার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে বিচলিত গলায় বললো,
–মেয়ে আমাদের এই বয়সে বয়ফ্রেন্ড বানাচ্ছে! চিন্তা করতে পারো!

–এতে অস্বাভাবিক কি আছে? পশ্চিমা কালচারে এটা নরমাল।

–কিন্তু আমরা তো এখানকার না।

–এখানে তো আছি। বাচ্চারা যা দেখে তাই তো শেখে। আর তাছাড়া এখানে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড এতোটাও বোল্ড হিসেবে কেউ নেয়ই না। ইচ্ছে না হলে ছেড়ে দেবে সিমপল। এই সামান্য জিনিস নিয়ে এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই৷ তুমি এখানে ওকে হাজার বুঝাও, বাইরে গেলে যে কে সে-ই হয়ে যাবে। এমন করে তাকানোর কি আছে?

উষিরের তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে কথা বলতে বলতেই তেঁতে উঠলো রাশা। উষির গুরুগম্ভীর গলায় বললো,
–তোমারও বয়ফ্রেন্ড ছিলো তাই না?

–অবশ্যই ছিলো।

উষির হ্যাচকা টানে রাশার কোমড় চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–ডিড হি কিস ইউ?

উষিরের আচারণে রাশা হালকা বিরক্ত হলো। তার বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
–আমি যদি এখন হ্যাঁ বলি তাহলে রেগে যাবে, আর যদি না বলি তাহলে বিশ্বাস করবে না। সন্দেহ করবে। তাই এই চ্যাপ্টার ক্লোজ করাই ভালো।

–আন্সার দাও?

উষির হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে ধমক দিলো। রাশা তপ্ত শ্বাস ফেলে মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে না বুঝাতেই উষির বাঁকা হাসলো। তারপর আশেপাশে নজর বুলিয়ে ঝুঁকে রাশার ঠোঁটে হালকা করে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিলো। রাশা রাগার বদলে লজ্জা পেয়ে তার দিকে মারকুটে চোখে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করলো।

উর্ষিয়া ছোট ছোট পায়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে বোনকে খুঁজতে খুঁজতে উজানের মিটিং প্লেসে চলে আসলো। তার মিটিংটা একজন বাঙালির সাথেই হচ্ছিলো। কিউট বার্বি ডলের মতো দেখতে বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে তিনি হাতের ইশারায় কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,

–তোমার নাম কি মা?

–ওত্তিয়া দাবুন

লোকটি নামের আতাপাতা খুঁজে না পেয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলো। উজান ভাতিজিকে কোলে নিয়ে হেসে ফেলে বললো,
–উর্শিয়া জাবিন।

নাম শুনে লোকটি এক গাল হাসলো। তক্ষনি পর্শিয়াও বোনকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে উপস্থিত হলো। লোকটি একই বয়সী আরেকটি মেয়েকে দেখে তাকেও কাছে ডাকলো।
–আর তোমার নাম কি মা?

–পর্শিয়া জাবিন।

স্পষ্ট উত্তর। লোকটা আবার থতমত খেয়ে গেলো। তিন বছরের একটা বাচ্চার মুখে এতো স্পষ্ট শব্দ সাধারণ শোনা যায় না। উষির মৃদু হেসে ভাতিজিকে কোল থেকে নামিয়ে বললো,
–ওরা টুইন্স।

লোকটি এবারে চরম বিষ্মিত হল। জমজদের চেহারা একই রকম হয় বলে যাদের ধারণা, তাদের এই দুইজনকে দেখা উচিৎ। না তাদের চেহারার কোন মিল আছে আর না আচার-আচরণে। একদন উত্তর মেরু হলে আরেকজন দক্ষিণ মেরু। পর্শিয়া যেমন শান্ত, তেমনই ম্যাচিউর আর বুঝদার। উর্শিয়া ঠিক তার উলটো৷ আবার পর্শিয়া বাবার চেহারা পেলেও ব্যবহার পেয়েছে মায়ের। অন্যদিকে উর্শিয়ার চেহারা মায়ের মতো হলেও ব্যবহার পেয়েছে বাবার। তাদের এই কম্বিনেশন প্রথমবার খেয়াল করেছিলো আফসার সাহেব। তারপর থেকে উর্শিয়া কোন কান্ড ঘটালেই ফুল কনফিডেন্স নিয়ে বলেন,
–একেবারে বাপ কা বেটি। তার পাপাই এই কাজ করতো, সেখানে মেয়ে করবে না!

এই কথার আসল অর্থ ফাঁস হওয়ার পরে ছোট মেয়েকে বেশ চোখে চোখে রাখে উষির৷ না জানি কখন কি কান্ড করে, পরে ওর সাথে সাথে তার নামটাও জুড়ে যাবে। সবাই তখন এটাই বলবে যে, আরেহ! উষিরও এমনটাই করেছিলো নাকি! আরে বাবা, কেউ কি নতুন কিছু ঘটাতে পারে না নাকি! এই ক্ষেত্রে সে মেয়ের মতোই বাচ্চা হয়ে যায়। কারো নামের অভিযোগ যে নিজের নামের সাথে যোগ করবে না। সেটা নিজের মেয়ে হলেও না।

উর্শিয়ার ব্রেকাপ করানোর দ্বায়িত্ব গিয়ে পরলো নোঙরের উপর। সব শুনে তার মুখ হা হয়ে গেলো। অবাক বিষ্ময়ে উজানের দিকে তাকিয়ে বললো,
–তোমার না হওয়া ছেলের বউ দেখি এই পিচ্চি বয়সে বয়ফ্রেন্ড বানাচ্ছে! এই তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো?

নোঙর চট করে তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কোমড়ে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো। উজান মুখ খুলবে তার আগেই টেবিল থেকে কেক কাঁটার প্লাস্টিকের চা’কু তার দিকে বাড়িয়ে শাসিয়ে বললো,
–একবার খালি বলো, ছিলো। তারপর এই চা’কু যদি তোমার পেটে না ঢুকিয়েছি তাহলে আমিও নোঙর খন্দকার না।

উজান টেবিলের সাথে কোমড় ঠেকিয়ে হাত ভাজ করে বললো,
–জানতেও চাচ্ছো আবার মারতেও চাচ্ছো?

–মানে ছিলো? নাকি আছে?

নোঙর রেগে চাকু গলায় রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললো৷ উজান হেসে ফেলে একটু কাছে গিয়ে ঝুঁকে আঙুল তার গালে বুলিয়ে মোহময় স্বরে বললো,
–উহু, বউ আছে।

নোঙর নরম হলো। চোখ মুদে লাজুক হাসলো। উর্শিয়াকে দেখে উজান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–উর্শিকে বোঝাও। তোমার উপর দ্বায়িত্ব পরেছে তো।

নোঙরের দ্বায়িত্বের কথা মনে পরতেই দাঁতে জিভ কাঁটলো। এরপর উর্শিয়াকে কোলে তুলে মোলায়েম স্বরে বললো,
–মামনি, এই বয়সে প্রেম করতে হয় না। তুমি আগে বড় হও তারপর বয়ফ্রেন্ডের কথা চিন্তা কোরো। আপাতত ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকো৷ আপাতত না। সবসময়ই ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকবে। যাকে তাকে তো আমি আমার ছেলে বানাতে পারবো না। এটা বুঝতে হবে তো। আমার ছেলেটা তোমার বড় হলে আমার এতো চিন্তাই থাকতো না।

নোঙরের আরেকটা প্ল্যানের মধ্যে এই প্ল্যানটাও সামিল হয়েছে৷ নেহাৎই বাইরে বিয়ে হলে যেই ছেলেকে নিজের ছেলে বানিয়ে নেবে। তাহলেই তো শখ পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু তার ছোট বড়-র আফসোস আর ফুরায় না!
নোঙরের শেষের কথা শুনে উজান রেগে উঠলো,
–পাগল হয়ে গেছো? বাচ্চা মানুষকে কিসব কানপড়া দিচ্ছো তুমি? মনে গেঁথে গেলে তখন কি করবে?

–আরে মনে রাখার জন্যই তো বলছি৷ তবে বড় হলেও কিন্তু সমস্যা নেই। এসব তো অহরহ হয়।

–মানি, বয়পেন্দ গুড। তুমি মিত্তা বলচি। আমরা কেলি না ফুটলবল, বাব্বি ডল, কিচেন কিচেন।

উর্শিয়া দুই ঝুটি নাড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে রাগী গলায় বললো৷
নোঙর হতাশার শ্বাস ফেলে উর্শিয়াকে তার কোল থেকে উজানের কোলে দিতে দিতে বললো,
–তুমিই বুঝাও ওকে। আমি তো ওর কথাই বুঝি না তার আবার বুঝাবো কি! তার থেকে ভালো আমি ভাইয়ার কাছে যাই। আমাদের নতুন রেসিপি কতদূর গেলো সেটা দেখতে হবে।

উজান কি করবে বুঝতে না পেরে উর্শিয়াকে ভাইকে পাহারায় বসিয়ে সেখান থেকে দ্রুত চলে গেলো। উর্শিয়া উষানের বেবি স্ট্রলারে ঝুঁকে তার নরম গালে নিজের ছোট ছোট আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। এই সুযোগে উষান আর ছোট ছোট নরম হাতের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য বোনের গলার পুতির মালা খপ করে ধরে খিলখিল করে হেসে উঠলো। পুতির মালাটা টিচারের সাহায্য দুইদিনের চেষ্টায় বানিয়েছিলো সে৷ এখন সেটার অন্তিম মূহুর্ত দেখে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো। তার গগনবিদারী কান্নার আওয়াজে সবাই হুরমুর করে সেখানে উপস্থিত হলো। কিন্তু ততক্ষণে মালার সব পুতি কিছু বেবি স্ট্রলারে আর কিছু মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে৷ উর্শিয়ার অবস্থা আরো করুন৷ সে মালার কষ্টে ফ্লোরে শুয়ে হাত পা নাচিয়ে, গড়িয়ে গড়িয়ে কান্না করছে। উর্শিয়া বাবার থেকে আরেকটা গুন বেশ ভালোমতো পেয়েছে৷ একবার কান্না শুরু করলে সহজে থামে না। এখন এই কান্না ঘুমানোর আগে থামবে বলে মনে হয় না। তাই কান্নারত মেয়েকে কোলে নিয়েই তারা ভ্রমণে বের হলো।

লন্ডনে তখন বসন্তকাল। ম্যাপল লিফের সময়। ম্যাপল ট্রির মাঝে সূর্য ডোবা দেখতে তারা হল্যান্ড পার্কে এসে উপস্থিত হলো। শত শত ম্যাপল ট্রির মধ্যে দিয়ে সন্ধ্যা হওয়া দেখার প্ল্যান সেই কবে থেকে তারা করে রেখেছে৷ অবশেষে সময় পেলো। বসন্তের মৃদু মন্দ বাতাদে মরা পাতা ঝির ঝির করে নিচে গড়িয়ে পরছে। মরা পাতা দেখতে যে এতো সুখ হয়, তা তারা এতোদিনে এসে বুঝলো। মরা পাতার সুখ তো সুখের সময়ই টের পাওয়া যায়।
একসময় আকাশ লাল করে সূর্য ডুবে গেলো। উর্শিয়া বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে অনেক আগেই৷ অপর পাশে পর্শিয়া মায়ের আঙুল আকড়ে সূর্য ডোবার পরের লাল মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। আর রাশা উষিরের কাঁধে মাথা রেখে সূর্য ডোবার পরের লাল আকাশ দেখতে লাগলো।
বেবি স্ট্রলারের ভেতরে পরা মরা ম্যাপল লিফ আকড়ে ধরে মুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে উষান। নোঙর মহা উৎসাহে সেটার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। আর উজান স্ত্রী সন্তানের একান্ত মূহুর্ত নিজের ক্যামেরায় সাক্ষী করে রাখলো। এরপর দুই ফ্যামিলি একত্র হয়ে লম্বা রাস্তায় ম্যাপল লিফ পেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার আকাশের মেঘ দেখতে লাগলো। মনোমুগ্ধকর, সিগ্ধ আর ভালোবাসাময়। ঠিক তাদের জীবনের মতো।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে