তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৩৯+৪০

0
62

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৯

বিকালের দিকে রাশার ফোনে এক অতি পরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলো৷ কলার আইডি দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ফোন কানে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল মেজাজে বললো,
–কাজল কেমন আছে?

ওপাশে কাজল নামের মেয়েটির মুখেও মুচকি হাসি চলে আসলো। তারপর গাল ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে বললো,
–কাজল ভালো আছে কিন্তু রাশা আপুর উপর রেগে আছে। তুমি এতো টাকা দিয়েছো কেনো?

রাশা খিলখিল করে হেসে উঠলো৷ তারপর বেশ নাটকীয় স্বরে বলল,
–ডোনেশন দিয়েছি তো৷

–এতো টাকার ডোনেশন দিয়ে কি করবো? আমরা তো ডোনেশন নেই না। এটা আমাদের নিয়মবহির্ভূত কাজ।

রাশা হাসি থামিয়ে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
–তোমার যদি এতো টাকা থাকতো তাহলে তুমি কি করতে?

–আমি আমাদের আলোর দিশারিতেই খরচ করতাম।

–এইজন্যই তো আমি তোমাকে দিচ্ছি। গিফট হিসেবে দিচ্ছি তো। এখন যদি গিফট হিসেবে তোমাকে জোরে কয়েকটা চড়ও দেই তাহলেও তোমার সেটা হাসিমুখে মেনে নিতে হবে। বুঝেছো?

কাজল আবার হেসে ফেললো। রাশাও হেসে দিলো৷ বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সব প্রপার্টি সে বিক্রি করে দিয়েছে। তাও একেবারে জলের দরে। কয়েকশো কোটি টাকার প্রপার্টি দ্বন্দ্বের কারনে কোটিতে নেমে এসেছিলো। আর রাশা তার থেকেও কম দামে সব প্রপার্টি বিক্রি করেছে। তাও যে মন্ত্রীর সাথে তার বড় বাবার বিরোধ লেগেছিলো, সেই মন্ত্রীর কাছেই৷ আর সেই সব টাকা খাগড়াছড়ির সেই অরফানেজে ডোনেট করেছে। দুর্নীতির টাকা কোন তো ভালো কাজে লাগুক।

খবর বোধহয় ততক্ষণে পৌঁছে গেছে। তাই তো বাড়ির বড় ছেলে সুলতান চৌধুরীর কল আসলো। মূহুর্তেই রাশার হাসিখুশি মনটা বিস্বাদে ভরে গেলো। ওই বাড়ির সব থেকে বেশি রাগ যে মানুষটার উপর, সেই মানুষটা হলো এই সুলতান চৌধুরী। বাড়ির অন্যায়কে সহ্য করতে পারে না জন্য বাড়ি ছেড়েছে কিন্তু সাহস করে প্রতিবাদ করতে পারেনি। রাগটা ঠিক এই কারনেই।

–এমন করছিস কেনো রাশা? বাড়ির সবাই তোর উপর খুব রেগে আছে। বাবা যদি রাগের মাথায় তোর কোন ক্ষতি করে দেয় তখন?

ফোন ধরার সাথে সাথেই ফোনের ওপাশ থেকে সুলতান ভারি গলায় বেশ করুন করে কথাটা বললো। এপাশে রাশা তেঁতে উঠলো,
–তুমি যদি ওদের বিরুদ্ধে কোন স্টেপ না নাও তাহলে তোমার এই পোলাইটনেসের কোন দাম নেই।

ব্যাস! আর তারপরই দ্বিতীয় কোন কথা না বলে কল কেঁটে ফোন সুইচ অফ করে দিলো। তারপর বিগড়ে যাওয়া মুড ঠিক করতে নোঙরকে খুঁজতে কিচেনে আসলো৷ দিনের বেশিরভাগ সময়টা নোঙর এই কিচেনেই কাঁটিয়ে দেয়৷ বাড়ি ফেরার পরদিন থেকেই রান্নার দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে সে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন রেসিপি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়৷ যেমন আজকে কাবাব বানাচ্ছে৷ কিসের কাবাব তা সেই জানে। রাশার তো খাওয়া দিয়ে কথা।

রাশা কিচেনে গিয়ে বেশ আয়েশ করে কাবাবের প্লেট হাতে নিয়ে কেবিনেটের উপর পা তুলে বসে কাবাব খেতে লাগলো৷ একটা করে মুখে দিচ্ছে আর স্বাদে চোখ বুজে আসছে। তার থেকে কিছুটা দূরেই নোঙর কাবাব ভাজছে। রাশা তার দিকে ফিরে মুগ্ধ গলায় বললো,
–তোমার রান্না যে এতো টেস্টি! তোমার মতো মেয়ে ঘরে ঘরে থাকা দরকার।

নোঙর হেসে ফেলে বললো,
–প্র‍্যাকটিস করলে সব সম্ভব হয় আপু।

–মোটেও না। আমি হাজারবার রান্নাঘরে রান্না শিখতে গেছি। একবারও সফল হই নাই। বাড়ির এমন একটা মেয়ে নেই যে আমাকে রান্না শেখাতে আসেনি। সবাই শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। আমি আসলে পরিমাণটা বুঝতে পারি না। ওটাই তো মেইন। রান্না না একটা আর্ট বুঝেছো? এই আর্ট সবার মাঝে থাকে না। যেমন আমি!

এবারে রাশা বেশ উচ্চশব্দে হেসে উঠলো৷ নোঙর লাজুক হেসে রাশার প্লেটে আরো দুটো কাবাব তুলে দিয়ে মন খারাপের ভঙ্গিতে বললো,
–তোমার যেমন রান্না হয় না, আমার তেমন পড়াশোনা হয় না। কতো ট্যালেন্টেড তুমি। আর আমি কিছুই পারি না৷

–কে বলেছে, তুমি কিছু পারো না!

রাশা এক লাফে কেবিনেট থেকে নেমে বেশ সিরিয়াস মুখোভঙ্গী করে আবারও বললো,
–সবাই যেমন সব কিছু পারে না, তেমনই সবাই কোন না কোন ব্যাপারে এক্সপার্ট থাকে। যেমন তুমি কুকিংএ এক্সপার্ট। আর আমি আর্গুমেন্টে৷ আবার তুমি ট্যান পরলে কি লাগালে ট্যান রিমুভ হয় তা জানো, আর আমি সোজা পার্লারে চলে যাই। আমাকে যেগুলো শিখিয়েছিলে, আমি সে সব ভুলে বসে আছি। অথচ তোমার সব মনে থাকে। একজন মানুষের তাই করা উচিৎ, যাতে সে এক্সপার্ট। যেমন তুমি কুকিং এ এক্সপার্ট আর আমি..

রাশা ঠোঁট কামড়ে কথা আটকালো। নোঙর কৌতুহলী গলায় জানতে চাইলো,
–তুমি?

–আমি…আমি আর্গুমেন্টে, ঝগড়ায়।

রাশা কাঁধ নাচিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো। নোঙর হেসে ফেললে আবার কাবাব ভাজায় মনোযোগ দিলো। তারপর হঠাৎই হাত থামিয়ে বললো,
–আপু, তোমাকে সাজিয়ে দেই?

রাশা থতমত খেয়ে তাড়াহুড়ো করে নাকচ করলো,
–না না। আমি শুধু শুধু সেজে কি করবো? ওসব খুব ঝামেলার।

–কোন ঝামেলার না আপু৷ ভাইয়ার জন্য সাজবে। আমি এমন সুন্দর করে সাজিয়ে দেবো যে ভাইয়া নজর ফেরাতে পারবে না। যদিও এমনিতেও ফেরাতে পারে না।

বলেই কাঁধ দিয়ে রাশার কাঁধে ধাক্কা দিলো। রাশা হেসে ফেললো। সেই লাজুক হাসি যা হুটহাট দেখা যায়।

****
উষিরের বাইরে যাওয়ার এক ফোঁটা ইচ্ছাও ছিলো না। বেশ আড়ামে এসি রুমে পায়ের উপর পা তুলে বসে মোবাইল স্ক্রল করছিলো৷ কোন আপডেট জানা কিংবা তার পেজ পর্যবেক্ষণ করাও তার একটা দ্বায়িত্ব। এখন সেই দ্বায়িত্বই পালন করছে। এরমধ্যেই তার দলের এক ছেলে তার কাছে এসে বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
–ভাই, বাজারের বড় দোকানদার চাঁদা দিতে চাচ্ছে না।

উষিরের ভ্রু কুঁচকে গেলো। মোবাইল থেকে নজর সরিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
–চাঁদা তো আমার দ্বায়িত্বে না।

–মেয়র মেয়ের সাথে ছুটি কাটাতে বিদেশ গেছে। তাই মন্ত্রীসাহেব আপনার কথা কইলো।

উষির মোবাইল রেখে কপাল ঘষে বিরক্তি নিয়ে বললো,
–দোকানদারকে আমার কথা বলিসনি?

ছেলেটি এবারে বেশ কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো,
–বলছি ভাই, কাম হয় নাই।

উষির দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাঞ্চাবির কলার ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো,
–চল একটু মোলাকাত করে আসি।

উষির তার দলবল নিয়ে বড় বাজারের সেই দোকানে আসলো। বেশ বড় মুদির দোকান ছিলো সেটা। বেশ নামডাকও আছে। দোকানে মালিক একাই বসে ছিলো। কর্মচারী না দেখে সবাই সামান্য অবাক হলেও আমলে নিলো না। উষির ভেতরে দলবল নিয়ে ঢুকে সানগ্লাস খুলে হাতে নিলো। তারপর পাঞ্চাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে বেশ দাম্ভিক ভাবে বললো,
–হ্যাঁ ভাই, কি সমস্যা?

দলবল দেখে দোকানদার লোকটির গলা শুকিয়ে গেছে৷ উষিরের কথা শুনে পিলে চমকে ওঠার মতো ভয় পেয়ে নিজের আসন ছেড়ে উঠে ভয়ার্ত গলায় বললো,
–কিসের সমস্যা ভাই?

–চাঁদা দেও না কেন? জানের মায়া নাই? ফ্যামিলির চিন্তা নাই?

উষির একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে কথাটা বললো। লোকটা থতমত খেয়ে আর্ত গলায় বললো,
–জ-জ্বি ভাই। দিচ্ছি।

উষির বাঁকা হাসলো। তারপর বজ্রকণ্ঠে ডেকে উঠলো,
–মানিক?

মানিক নামের ছেলেটি তার পাসে দাঁড়িয়ে বিনীত গলায় বললো,
–জ্বি ভাই?

উষির আলগোছে পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
–শাটার নামিয়ে ফেল দ্রুত। আর লাইট দিবি না। রুম অন্ধকার চাই।

হুকুম করা মাত্র কাজ হয়ে গেলো। লাইট বন্ধ হতেই উষির ফোনের ক্যামেরা অন করে চারিদিকে ঘুরাতে লাগলো আর তখনই একটা সুক্ষ্ম নীল আলো তার নজর কাড়লো। মুখের হাসি আরো চওড়া হলো। দোকানদার লোকটির মাথায় বজ্রপাত ঘটিয়ে কাষ্ঠ হেসে ভারি গলায় বললো,
–আমার সাথে চালাকি? কাজটা কি ভালো হলো?

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হুকুম দিলো সবাইকে,
–দোকানে যেনো কোন মাল না থাকে৷ টাকায় হাত দিবি না, কিন্তু মাল ছাড়বি না। দেখে যেনো মনে হয়, দোকানদার বস্তা সমেত সব দান করে দিয়েছে। আর এই মালগুলা এতিমখানায় দিয়ে আসবি। বাজার দেওয়া, রান্না করা, খাওয়া সবটা ক্যাপচার করে সোশ্যালমিডিয়ায় পোস্ট দিবি। ক্যাপশন দিবি, উষির ভাইয়ের পক্ষ থেকে এতিমদের দাওয়াত।

–ভাই মন্ত্রীর নাম নিমু না?

যে ছেলেটি কথাটা বলেছে, উষির সেই ছেলেটির কাঁধ চাপড়ে বললো,
–আরে বাচ্চা, নিজেদের পকেটেও কিছু রাখতে হয়। সব কাজের পর ফলের ভাগ পুরোটা বিলাতে হয় না। নিজের কাছেও কিছু রাখতে হয়৷ তবেই উপরে ওঠা যায়। তোর এখনও এসব বোঝার সময় হয় নাই।

দোকানদার লোকটির হাত মুখ বাঁধা। চোখের সামনে তার সর্বস্ব লুট করা হচ্ছে তার সে কিছুই করতে পারছে না। চোখ দিয়ে টপাটপ পানি পরছে৷ এরমাঝেও উষিরের কথাটা কানে যেতেই মূহুর্তকালের জন্য বেদনা ভুলে হা হয়ে তাদের দিকে তাকালো। রাজনীতির আড়ালের এই খবর তার অজানা। চেয়েছিলো তো এই লুটরাজের বিরুদ্ধে কথা বলতে, কিন্তু হারাচ্ছে সবই। এইজন্যই হয়তো কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে না।
উষির অসহায় ভাবে কাঁদতে থাকা লোকটির দিকে তীক্ষ্ণ এক নজর নিক্ষেপ করে বাইরে এসে বসলো। তারপর চুলে আঙুল চালিয়ে মোবাইল পকেট থেকে বের করতে করতে আফসোসের সুরে পাশে দাঁড়ানো মানিকের উদ্দেশ্যে বললো,
–ইসস বউ! বউকে খুব মিস করছি বুঝলি। নতুন নতুন বিয়ে করছি তো। বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকতে ইচ্ছা করে। আমাদের আবার বউ পাগলা নামে বংশগত একটা রোগ আছে।

মানিক নামের ছেলেটির বুক হাহাকার করে উঠলো। তার গার্লফ্রেন্ডের সদ্যই বিয়ে হয়েছে। সেই কষ্টই এখনও ভুলতে পারেনি। এখন আবার নতুন করে কষ্ট পেলো। নাক টেনে কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে দুইজন ছেলে প্রায় মারামারি করতে করতে উষিরের কাছে এসে অভিযোগের খাতা খুলে বসলো,
–ভাই, এই কাজ্জুর বাচ্চা দোকান থাইকা টেকা মারছে। স্বীকারও করে না।

লম্বা চওড়া ছেলেটির অভিযোগের বিরুদ্ধে মারকুটে চেহারার আরেকটি ছেলে লম্বা ছেলেটিকে ঘুষি দেওয়ার জন্য হাত তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–মিছা কথা ভাই। ও মারছে।

–ভেরি গুড কাজ্জু। তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি আমি। তবে আর একটা টাকাও সরালে তার কঠিন বিচার হবে। বি কেয়ারফুল।

উষির ছেলেটির কাঁধ চাপড়ে শাসিয়ে বললো। ছেলেটি কাচুমাচু ভঙ্গিতে সরে গেলো। ওখানকার কাজ শেষে গাড়িতে উঠতেই রাশার কল আসলো৷ উষির মুচকি হেসে কল রিসিভ করতেই রাশার ক্লান্ত স্বর কানে আসলো,
–কখন আসবে?

–মিস করছো নাকি?

–হুম

উষির বেশ দুষ্টমি করে জিজ্ঞাসা করেছিলো। কিন্তু উত্তর শোনার পর হার্ট বিট করা মিস করলো বলে মনে হলো৷ সময় থমকে গেলো। কপালের ঘাম মুছে ঢোক গিললো সে। স্ত্রীর এমন কথা শুনে কোনো স্বামী এমন নার্ভাস হয় নাকি জানা নেই। তবে উষির হলো। শ্বাস চেপে আর কিছু না বলে কল কেঁটে দিলো। রাশার মন খারাপ হলো ভীষণ। ভাবলো, উষির আসবে না। নোঙরের যত্ন করে পরিয়ে দেওয়া শাড়িটা খুলে ফেললো৷ মাথার গাজরা, হাতের চুড়ি, কানের দুল, মালা সবগুলো খুলে বিছানায় ছড়িয়ে রাখলো। শুধু থাকলো ব্রেসলেট, নুপুর আর মেকাপ। মেকাপটা সে ইচ্ছে করেই তুললো না। উষির আসুক, এসে দেখুক, সে তারজন্য আজ সেজেগুজে বসেছিলো। কিন্তু সে দেরি করেছে।
উষির আসলো আধঘন্টা পর। রাশা তখন মন খারাপ করে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। উষির গিয়ে রাশার সামনে হাটু গেড়ে বসলো। গালে হাত ছুইয়ে আলতো স্বরে বললো,
–মন খারাপ?

রাশা ঠোঁট উলটে আহ্লাদী ভাবে মাথা উপর নিচ করে নাড়ালো। উষির হাসলো। রাশার গাল দুই হাতে আজলা ভরে তুলে মোলায়েম স্বরে বললো,
–ঘুরতে যাবে?

–কোথায়?

–বাইরে। আজ সারারাত ঘুরবো।

–হেঁটে হেঁটে ঘুরবো।

রাশা নিজের ইচ্ছে বলতেই উষির হেসে উঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–চলো?

উষির টি-শার্টের উপর কালো জ্যাকেট পরে রাশার হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হলো। মিনিট খানেকের মধ্যে আকাশ কালো করে অক্টোবরের শীত পরার বৃষ্টি শুরু হলো। অক্টোবরের প্রথম রেইন। উষির উৎফুল্ল মনে গুনগুন করে রাশার হাত ধরে রাখা হাতটা জ্যাকেটের পকেটে রাখলো। গরম আভাসে রাশার মন ভরে উঠলো। উষিরের হাত জড়িয়ে বাহুতে গাল রেখে আলতো স্বরে বললো,
–কি গাইছো?

উষির মিষ্টি করে হাসলো। তারপর গলা তুলে সুর ধরে গাইলো,
ইচ্ছে করে একটা ঘরে থাকবো দু’জনায়
গড়বো ভিটে খুশির ইটে, সঙ্গী হবি আয়

রাশার হাত ধরে ঘুরিয়ে বাকি লাইন গাইলো,

কলের পাড়ে জলের ধারা, ঘরের পরে তুই
চারটে হাতে খেলনা পাতে একজোড়া চড়ুই
সে ভাবনারা চোখ খোলে না..

রাশা খিলখল করে হেসে উঠতেই উষির হাতের আঙুল দিয়ে তার নাক ছুঁইয়ে মিটিমিটি হেসে গানের শব্দ পরিবর্তন করলো,

ও রাশা বোঝে না, বোঝে না, বোঝে না
রাশা বোঝে না, বোঝে না

কেনো বোঝো না বলোতো?

শেষের বাক্যটা ঝুঁকে রাশার কপালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে কেমন অসহায় স্বরে বললো। রাশা কিছু বললো না। অক্টোবর রেইন তাদের ঝিরিঝিরি করে ভিজিয়ে তুলছিলো৷ তাদের সাথে সাথে নোঙরের মনকেও পুলকিত করছিলো সেই রেইন।
উজান বিছানায় ফাইল ছড়িয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। নোঙর বাইরের ঝিরিঝিরি করে পরা বৃষ্টি থেকে নজর সরিয়ে বিছানায় বসা উজানের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল মেজাজে বললো,
–ফানা মুভি দেখেছো?

তার রাগ আজ অব্দি একদিনের বেশি টেকেনি। পালিয়ে যাওয়ার শখ পূরণ না করার রাগটাও কয়েক ঘন্টাই মাত্র টিকেছিলো৷ তার পরপরই পূর্বের নোঙরে ফিরে এসেছিলো।

–আমি মুভি দেখি না। টাইম ওয়েস্ট!

উজানের বলা কথাটা তার কানে গেলেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছালো না৷ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে বেশ হাসিখুশি মেজাজে বললো,
–ওখানে একটা ডায়লগ ছিলো। ওই ডায়লগটা তোমার জন্য মুখস্থ করেছি।

–আচ্ছা! বলো শুনি?

উজান ল্যাপটপ রেখে নোঙরের দিকে মনোযোগ দিলো। নোঙর গলা খাঁকারি দিয়ে বলা শুরু করলো,
–তেরে ইস্ক কে লিয়ে…

মাথা নাড়লো নোঙর। শুরুটা এমন ছিলো না। আবার চেষ্টা করলো,
–তেরে দিল মে মেরি জান..

হতাশ হলো। ঠোঁট উলটে বললো,
–ভুলে গেছি মনে হয়। মোবাইলে লিখে রেখেছি।

উজান ভ্রু কুঁচকে বললো,
–একটা সিমপল ডায়লগ মনে রাখতে পারো না!

নোঙর গাল ফুলিয়ে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখতে মনোযোগী হলো৷ মূহুর্তকাল পরেই পেছনে উজানের অস্তিত্ব অনুভব করে পেছন ঘুরতে চাইলেই উজান তার কোমড় টেনে নিজের বুকের সাথে তার পিঠ ঠেকিয়ে কাছে নিয়ে আসলো। নোঙর ধুকপুক করা বুক নিয়ে মাথা পেছনে ঘুরাতেই উজান তার গালে লেপ্টে থাকা বৃষ্টির ছাঁটে ভেজা চুল সরিয়ে মৃদুস্বরে বললো,

–তেরে দিল মে মেরি সাসোকো পানা মিল যায়ে, তেরে ইস্ক মে মেরি জান ফানা হো যায়ে।

নোঙরের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। বিষ্ময়ে বললো,
–তুমি জানতে এটা?

উজান নোঙরের নাকের সাথে নাক ঘষে মৃদু হেসে বললো,
–উহু! গুগোল থেকে জেনেছি৷

নোঙর নাক ফুলিয়ে দুই হাতে উজানের বুকে ধাক্কা দিতেই উজান হোহো করে হেসে উঠলো৷ তারপর বেশ শক্ত একটা চুমু দিয়ে কোলে তুলে নিলো। নোঙর হায় হায় করে উঠলো,
–পরে যাবো আমি। নামাও বলছি। পরে গেলে কিন্তু তোমার খবর আছে।

উজান তাকে নামালো বটে তবে তাকে ফেলে দেওয়া বললে বেশি ভালো হয়। বিছানা পর্যন্ত নিয়ে ঠাস করে ফেলে দিয়েছিলো৷ তারপর নোঙরের উপর আধশোয়া হয়ে চোখ টিপে বললো,
–ইস্ক ইস্ক করছো আর ইস্কের ডেফিনেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না?

নোঙর মারকুটে চেহারা নিয়ে তাকাতেই উজান তার নাকে আলতো করে কা’মড় দিলো। নোঙর আতকে উঠে নাকে হাত দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উজানের হাতে কা’মড় দিলো। তারপর শাসিয়ে বললো,
–ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা আর কামড়ের বদলে কামড়।

উজান হাত ঝেড়ে উঠে বসে চোখ গরম করে বললো,
–ভালোবাসলে তো জীবনে ভালোবাসো না। তাহলে কা’মড়ে এমন বদলা কেনো?

নোঙর কিছু না বলে কম্ফোর্টার মাথার উপর জড়িয়ে শুয়ে পরলো। উজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাইল ল্যাপটপ সরিয়ে নোঙরের পাশ ঘেঁষে শুয়ে পরলো। তারপর কম্ফোর্টার জড়িয়ে শুয়ে থাকা নোঙরের কানের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–এরপর সবসময় একটা চাকু ক্যারি করবো। ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা না পেলে সোজা মা’র্ডা’র।

নোঙর কম্ফোর্টারের ভেতরে পেট চেপে হাসতে লাগলো। এরপর তাকে কা’মড় দিলে যে সে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা তো জানেই না৷ শীতকাল আসছে। মজা হবে বেশ ভেবে আরো হাসি পেলো।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৪০ (প্রথমাংশ)

সকালের ব্রেকফাস্টের সময় সেই ভয়ানক কান্ড ঘটে গেলো। টিভি সিরিয়ালে যেমন ফ্যামিলি মোমেন্টে ভয়ানক কান্ড হয়, তেমনই ভয়ানক কান্ড ছিলো সেটা। বাড়িতে পুলিশ এসেছে। আর পুলিশ এমনি এমনি কারো বাড়িতে যায় না। কিন্তু যখন যায় তখন কিছু না কিছু নিয়ে তবেই ফেরত যায়। এবারে নিতে গেছে উষিরকে। উষিরের নামে অভিযোগ উঠেছে। তার ভিত্তিতেই তাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। আধ খাওয়া খাবার রেখে সবাই যখন লিভিংরুমে হাজির হলো, তখনই উচ্চপদস্থ ফিটফাট একজন পুলিশ কর্মকর্তা উষিরের সামনে সটান দাঁড়িয়ে বো’মা ফাঁটানোর মতো করে কথাটা বললো,
–লু’টপা’ট আর খু’নের সন্দেহে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে মিস্টার আদনান কায়সার।

সবাই এতোই বিষ্মিত হয়েছে যে মিনিটখানেক হা করে কথাটা বোঝার চেষ্টা করলো। পরিস্থিতি বোঝার পর প্রথমে টনক নড়েলো রাশার। পুলিশের সামনে রুখে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
–আপনারা শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে কিভাবে অ্যারেস্ট করতে পারেন? আপনাদের কাছে কোন প্রুভ আছে? কোন উইটনেস, অ্যালিবি, কিছু কি আছে?

পুলিশ কর্মকর্তার হাতে হাতকড়া ছিলো। সেটাকেই আঙুলে ঘুরিয়ে বেশ কর্কশ গলায় বিদ্রুপের মতো করে বললো,
–আপনারা বরং উকিল নিয়ে থানায় আসুন। এইসব আইনের ব্যাপার স্যাপার আপনাদের মতো বেয়াইনি লোকজন বুঝবে না।

রাশা চাপা শ্বাস ফেলে বললো,
–অলরাইট! জাস্ট হোল্ড আ মিনিট। আ’ল কাম ফাস্ট।

বলেই এক দৌড়ে নিজের ঘরে গেলো। উজান সাইডে দাঁড়িয়ে উকিলকে কল দিলো৷ মাহফুজা ইতিমধ্যে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। শাহিদা যথেষ্ট বুদ্ধিমতি আর শক্ত। যে কোন পরিস্থিতিই শক্ত হাতে সামলানোর চেষ্টা করে। তবে আজকেও পুলিশ ছেলেকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে শুনে খুব অসহায় বোধ করছে। আফসার সাহেবও বাড়ি নেই। আর উপর মাহফুজার কান্নাকাটি। নিজেকে সামলে মাহফুজাকে সামলাতে চেষ্টা চালালো। অন্যদিকে নোঙর ময়নাকে আকড়ে ধরে ভয় কাঁটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তার চোখ দিয়েও টপাটপ পানি পরছে।

উষির নিজের মনে হিসাব চালানোর চেষ্টা চালালো৷ যে দুটো ঘটনার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে সেই দুটো ঘটনাতেই তার হাত দেওয়ার কথা ছিলো না। শেষ মূহুর্তে তার ডাক পরেছিলো। আর দুই মাস পর ভোট। এর আগে কোন নেতার নামে কোন স্ক্যান্ডেল বের হওয়া মানে তার ক্যারিয়ার শেষ। এই মূহুর্তে এমন অভিযোগ এর একটাই অর্থ। তুমি এখন পলিটিক্স থেকে বিদায় নাও! আর এই কাজটা যে তার জেঠা শ্বশুর বেশ নিশ্চিন্ত মনেই করিয়েছে সেটা একটা বাচ্চাও বুঝতে পারবে। তবে সেটা রাশা না বুঝলেই ভালো৷ এমনিতেও যা যা করেছে তাতে যথেষ্ট জল ঘোলা হয়েছে। আর দরকার নেই। তাকেই পরিস্থিতি সামলাতে হবে।
রাশা ফিরে আসলো একটা কার্ড হাতে। পুলিশের হাতে কার্ডটা দিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে,
–আমি…

একটু থেমে সবার দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস ফেললো। তারপর হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে নির্ভিক স্বরে বললো,
–আমি অ্যাডভোকেট দিলওয়ারা জামান চৌধুরী আপনাকে প্রশ্ন করছি, কোন আইনে আপনি শুধুমাত্র সন্দেহের বশে আমার ক্লায়েন্টকে অ্যারেস্ট করছেন? আইনের লোক হয়ে আইন ভঙ্গের শাস্তি জানেন না আপনি? উলটে আপনার নামে হ্যারেজমেন্টের কেস করে দিলে কি হবে বুঝতে পারছেন?

শেষেরদিকে রাশার গলায় বিদ্রুপের স্বর স্পষ্ট বোঝা গেলো। হম্বিতম্বি করা পুলিশের লোকটা বেশ নরম হলো। তাদের ইনফরমেশন মতে এই বাড়িতে কোন আইনের লোক নেই। ভেবেছিলো, উকিল আনতে আনতে এক চোট ধোলাই হয়েই যাবে। উপর মহলের আদেশ বলে কথা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নতুন করে প্ল্যান সাজাতে হবে। সেই সময়টা আর নেই। তাই মাথায় যা আসলো তাই বললো,
–আপনার কাছে আদনান স্যারের উকিল হওয়ার কোন অফিসিয়াল ডকুমেন্ট আছে?

–আপনার কাছে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে?

রাশা চোখে চোখ রেখে পালটা প্রশ্ন করলো। পুলিশের লোকটি হতাশ হয়ে বললো,
–দেখুন ম্যাডাম, আমরা অ্যারেস্ট করছি না। শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাচ্ছি।

–জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায়? আইনের ফাঁকফোকর খুঁজছেন স্যার? আপনি ভুলে গেছেন, আইনের ফাঁকফোকর আপনার থেকে আমি ভালো জানি। পাঁচ বছর মোটা মোটা আইনের বই আর দুই বছর হাইকোর্টে এমনি এমনি প্র‍্যাক্টিস করিনি। আপনি হাতখড়ি রেখে দেন আর অফিসিয়াল অনুমতি নিয়ে এসে ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিয়ে যান।

লোকটি বুঝলো, এখানে আর কিছুতেই কিছু করতে পারবে না। তাই দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় না করে ফিরে গেলো। সবাই এতোক্ষণ দম বন্ধ করে ছিলো। ওরা দলবল নিয়ে চলে যেতেই চাপা স্বাস ফেললো সকলে। তারপর শাহিদা বিষ্মিত গলায় বললো,
–তুমি অ্যাডভোকেট?

রাশা মুখ কাচুমাচু করে বললো,
–আনফচুনেটলি খালাম্মা! দুইবার সরকারী জজের এক্সাম দিয়েছি। প্রথমবারে টিকিনি। এবারেও বোধহয় টিকবো না।

বাকি সব উকিলের মতো রাশারও জজ হওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে টেকেনি। ঠিক সেইজন্যই অ্যাডভোকেট হওয়ার কথাটা কাউকে বলতে চাইছিলো না। কিন্তু কি আর করবে! না বলেও উপায় ছিলো না। শেষ মূহুর্তে বলতেই হলো৷ আর এখন তীব্র অস্বস্তি নিয়ে ঠোঁট কামড়ে নখ খুঁটতে লাগলো৷ তার এই অস্বস্তি সকলেই বুঝতে পেরে তাকে আর কিছুই না বলে আধ খাওয়া খাবার শেষ করতে গেলো৷

খাওয়া দাওয়ার পর রাশা বাইরে গিয়েছিলো। ফিরেছিলো সন্ধ্যার পর। তার হাতে আর অল্প কিছু সময় আছে। এর মাঝেই সবাইকে সব সত্যি বলে দিতে হবে। সবার আগে বলতে হবে উষিরকে। সে এখনও বাড়ি ফেরেনি। ফেরার অপেক্ষা করতে করতে দশটা পেরিয়ে গেলো।
এগারোটার দিকে চিন্তিত মুখে উষির ফিরলো৷ যে ঝামেলায় জড়িয়েছে, সেই ঝামেলা থেকে বের হওয়া মুশকিল। হয় রাজনীতি ছেড়ে নাও নাহলে স্ক্যান্ডেলে জড়িয়ে পড়ো টাইপের অবস্থা হয়ে পরেছে।
ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে রাশাকে দেখেই মন ভরে উঠলো তার। রাশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি হিসেবে নাইট ক্রিম লাগাচ্ছিলো। উষির গিয়ে রাশাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আনমনে দাঁড়িয়ে থাকা রাশা চমকে উঠে আয়নার তাকালো। তারপর উষিরকে দেখে তার মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো। বিষন্ন মনেই উষিরের থেকে নিজেকে সরিয়ে ব্যাগ থেকে তার দেওয়া ক্রেডিট কার্ড নিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–তোমার ক্রেডিট কার্ড। আমার আর এটার প্রয়োজন নেই?

–কেনো? মোটা অংকের বেতনের জব পেয়েছো নাকি? তাহলে আমার দ্বায়িত্বও নাও। আমি হাউজ হাজবেন্ড হয়ে যাই আর তুমি ওয়ার্কিং ওয়াইফ।

উষির হাসতে হাসতে বললো৷ তার সাথে রাশাও হাসার চেষ্টা করলো। তাতে মন সায় না দেওয়ায় ঢোক গিলে মলিন মুখে বললো,
–আমি ইউকে যাচ্ছি। পরশুদিন আমার ফ্লাইট।

উষিরের পুরো মনোযোগ হাতঘড়ি খোলার দিকে থাকায় কথাটা ভালো শুনতে পায়নি। তাই পালটা প্রশ্ন করলো,
–কোথায় যাচ্ছো?

–ইউকে।

রাশা মাথা নিচু করে হাত কচলাচ্ছিলো। হাত ঘেমে উঠছে বারবার। উষির কথা বলতে বলতেই পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো। তারপর যাওয়ার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাশার দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিরস গলায় বললো,
–আগে বলতে আমাকে। আমিও সাথে যেতাম। যদিও একটু সমস্যা হতো কিন্তু ম্যানেজ করে নিতাম। আচ্ছা যাই হোক, কবে আসবে?

–পড়াশোনার জন্য যাচ্ছি। কবে আসবো জানি না।

–এখানে থেকে পড়া যায় না?

–না।

–তাহলে কয়েকমাস পরে যাও। দুইমাস পরে ইলেকশন। তারপর আমি ফ্রী৷ তখন যেও, সামার সেশনে।

রাশা ভেজা চোখ তুলে উষিরের চোখে চোখ রাখলো। প্রসঙ্গ পালটে শক্ত গলায় বললো,
–তোমার নামে যে অভিযোগগুলো এসেছে, তার সবগুলোই সত্যি। তাই না?

রাশার হঠাৎ পরিবর্তনে উষির হকচকিয়ে গেলো। রাশার গালে হাত রেখে বিচলিত স্বরে বললো,
–হঠাৎ এসব বলছো কেনো? কেউ কিছু বলেছে?

রাশা তীব্র আক্রোশে উষিরের হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলো,
–আমার প্রশ্নের আন্সার দাও। সবগুলোই সত্যি ছিলো?

–না।

উষির চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিলো। একদিন থেকে সে সত্যিই বলেছে। নিজের হাতে এই কাজগুলো সত্যিই করেনি। তবে নিজে করিয়েছে।

–তোমার ঘড়িতে র’ক্ত লেগেছিলো। আমি দেখেছি৷

মিথ্যা উত্তরে রাশা চিৎকার করে উঠলো৷ উষির বিরক্ত হলো। ক্লান্ত গলায় দুই পা এগিয়ে বললো,
–রাশা, বি নরমাল। এতো হাইপার হচ্ছো কেনো?

রাশা নিজের ব্যবহার বুঝতে পেরে চুপ করলো। সেকেন্ডের মাথায় আবার বললো,
–উষির, তুমি তোমার জীবনের সব থেকে বড় কোন জিনিসটা হারিয়েছো?

উষির এগিয়ে রাশার গাল আলতো হাতে ধরে মাথায় চুমু দিলো৷ তারপর মৃদু হেসে বললো,
–কিছু না।

–রাজনীতি তোমার স্বপ্ন রাইট?

আবার রাশার গম্ভীর কণ্ঠে উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এক হাতে রাশার হাত ধরলো। অপর হাত দিয়ে গাল ধরে ঝুঁকে তার মাথায় মাথা ঠেকিয়ে আকুল হয়ে বললো,
–হ্যাঁ কিন্তু এসব বলছো কেনো রাশা? প্লিজ যাওয়া ক্যান্সেল করে দাও। আমি তোমাকে ছাড়া এক মূহুর্তও থাকতে পারবো না। প্লিজ রাশা!

রাশা চোখ বুজে কিছুক্ষণ বড় বড় শ্বাস নিলো৷ তারপর বো’মা ফাঁটানোর মতো করে বললো,
–তোমার হাতে দুইটা অপশন আছে। আমি আর রাজনীতি। আমাকে পেতে হলে তোমার রাজনীতিকে হারাতে হবে। আর রাজনীতি পেতে হলে আমাকে হারাতে হবে। নাও চয়েস ইজ ইয়োর।

অবাক বিষ্ময়ে উষিরের হাত খসে পরলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে আর্তনাদের মতো করে ডেকে উঠলো,
–রাশা!

রাশা ছলছল চোখে উষিরের পাঞ্চাবির হাত মুঠো করে ধরে আহত গলায় বললো,
–বড় কিছু না হারিয়ে বড় কিছু পাওয়া যায় না। একটা বলিদান তোমাকে দিতেই হবে। সেটা আমি কিংবা পলিটিক্স।

উষির রেগে রাশার হাত পিছমোড়া করে ধরে আরেক হাতে তার গলা টিপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
–যে কথাটা আজকে ভেবেছো সেটা দ্বিতীয়বার ভাবার চেষ্টাও করো না। খু’ন করে ফেলবো একদম। তারপর না থাকবে তুমি আর না থাকবো আমি৷

কথা শেষ করার সাথে সাথে রাশাকে প্রায় ছিটকে ফেলে দিলো। তার চোখ দিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে রাশাও জ্বলে উঠলো৷ চোখের সামনে তার বাড়ির মেয়েদের অপমান আর চুপচাপ মার খাওয়ার ঘটনা মনে পরতেই তীবে আক্রোশে ফেঁটে পরলো। উষির তার গলা বেশ শক্ত করেই চেপে ধরেছিলো৷ এখনও ব্যথা করছে৷ কিন্তু সেদিকে তার নজরও গেলো না৷ খ্যাপা ষাড়ের মতো তেড়ে এসে উষিরের গালে সপাট এক চড় দিয়ে আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,
–ডোন্ট ইউ ডেয়ার দিস। আমাকে টর্চার মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে ভাবলে খুব ভুল ভেবেছো। এই কাজটা দ্বিতীয়বার করার সাহস দেখাবে না।

রাশার মনে হয়েছিলো, আজকের এই প্রতিবাদটা না করলে নিজেকে সে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবে না। সেও তার মা, বড় মায়ের দলে সামিল হবে। এটা তো সে কখনই চায় না।
উষির গালে হাত দিয়ে আগুন চোখে রাশার দিকে তাকালো। তারপর রাশার ঘাড় এক হাতে শক্ত করে ধরে নিজের দিকে টেনে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
–যতদিন না মাথা থেকে এই ভুত বের হয় ততদিন থাকো এই রুমে বন্দী হয়ে।

বলেই আবার ছিটকে ফেলে বাইরে বের হয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাশা বন্ধ দরজার ওপাড় থেকে চিৎকার করতে করতে দরজা ধাক্কাতে লাগলো,
–উষির ওপেন দ্য ডোর?

উষির দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা ভাজ করে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। হাত দুটো ভাজ করা। ক্লান্ত শরীর এতো ধকল মেনে নিতে পারছে না। যেমন মাথা ব্যথা করছে, তেমনই শরীর দুর্বল লাগছে। একটু আগেও তার কাছে আগামীকাল সকাল একটা নিশ্চিন্ত সকাল ছিলো৷ কারন সেই সকালে রাশা থাকতো তার কাছে। এখন তো পরের মূহুর্তও তার কাছে দুর্বিষহ!

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৪০ (শেষাংশ)

রাশার চিৎকার চেঁচামেচিতে পরিবারের সবাই দৌঁড়ে আসলো৷ আর দরজার সামনে এসে উষিরকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে থমকে গেলো। ভেতর থেকে রাশার ক্রমাগত চিৎকার ভেসে আসছে। শাহিদা পরিস্থিতি বুঝে রেগে বললো,
–দরজা খোল উষির।

–তুমি, তোমরা কেউ আমাদের মাঝে ঢুকবে না। এটা আমার আর রাশার প্রবলেম। আমাদেরই সলভ করতে দাও।

উষির রেগে কিড়মিড়িয়ে তেতে উঠে শাসিয়ে বললো। শাহিদা দ্বিগুণ রেগে বললো,
–নিজেদের সমস্যা হলে এমন ব্যবহার না করে তোরা একা একাই সামলে নিতি৷ এভাবে তুই রাশাকে অপমান করছি।

–তুমি জানো ও কি বলছে? আমার সাথে বিচ্ছেদের কথা বলছে। কত বড় সাহস ওর।

উষিরের গলার স্বরে অসহায়ত্ব ফুটে উঠলেও শেষের কথাটা বলে রেগে দরজায় সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লাথি দিলো। দরজার ওপাশে থাকা রাশা ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো।
উষিরের ব্যবহার দেখে তেজি স্বরে শাহিদা বললো,
–তো কি জোর করে রাখবি?

–দরকার হলে তাই থাকবে৷ যতদিন না মাথা থেকে ভুত নামে ততদিন এভাবেই বন্দী থাকবে।

–কেনো বন্দী থাকবে? ও কি পশু পাখি যে জোর করে আটকে রেখে পোষ মানাবি? নাকি পাখা কেঁটে উড়া আটকাবি? দরজা খোল আর ঠান্ডা মাথায় কথা বল। শুধু শুধু পরিস্থিতি বিগড়ে দিস না৷

উষির ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলেও রাগ কমাতে না পেরে রেগে দেয়ালে ঘুষি দিয়ে বললো,
–যা খুশি করো।

বলেই তীব্র বেগে বাইরে চলে গেলো। শাহিদা দরজা খুলতেই ভেতরে থাকা বিধ্বস্ত রাশা বেড়িয়ে আসতেই নোঙর গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। রাশা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিলেও কারো কোন প্রশ্নের জবাব সে দিলো না। শুধু জানিয়ে রাখলো, আর দুইদিন পর সে ইউকে চলে যাচ্ছে। এতোদিনে সবাই এতোটুকু তো বুঝেছে যে রাশা না চাইলে জীবনেও আর কিছুই বলবে না।তাই আর জিজ্ঞাসাও করলো না।

পরের পুরো একটা দিন উষিরের কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না। ফিরলো মাঝরাতে। ফেরার পর নিজের ঘরে না গিয়ে মায়ের ঘরে গেলো। শাহিদা বিধ্বস্ত ছেলেকে দেখে চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না। মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। উষির ঢোক গিলে আহত পাখির মতো নিজেকে গুটিয়ে মায়ের কোলে শুয়ে পরলো। তারপর কাঁপা গলায় বললো,
–আমি এখন কি করবো মা? কোনটা বেছে নেবো? রাশাকে হারানোর কথা মনে আসলে দম বন্ধ হয়ে আসে। আর রাজনীতি আমার স্বপ্ন। স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট কি বেশি বড়, মা?

শাহিদা ছেলের মাথায় আঙুল চালিয়ে বিলি কাঁটতে কাঁটতে ভাবুক হলো। রাশা নিজের শর্তের কথাটা সবাইকে পরেরদিন সকালে বলেছিলো৷ তাই উষিরের অবস্থা বোঝার জন্য খুব বেশি পরিশ্রম তাকে করতে হয়নি। অবস্থা বুঝে তার ঔষধ হিসেবে ছেলেকে বুঝাতে চাইলো শাহিদা। তাই উষিরের কপালে হাত রেখে মৃদু হেসে বললো,
–মানুষের জীবনে তো কত স্বপ্নই পূরণ হয় না বাবা। রাজনীতিতে যাওয়ার স্বপ্ন তো তোর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হয়েছে। আগে তো আরো কত স্বপ্ন ছিলো। সেগুলো তো পূরণ হয়নি। তোর তো অ্যাস্ট্রোনট হওয়ারও ইচ্ছে ছিলো। তোর ঘরটা আকাশের মতো রঙ করেছিলি৷ ঘরজুড়ে প্লেন, রকেটের খেলনা ছিলো। সেটা যখন পূরণ হলো না তখন নতুন স্বপ্ন খোঁজা শুরু করলি। প্রিয় মানুষের সুখের জন্য স্বপ্ন কুরবানী করা যায়, আমার স্বপ্নের জন্য প্রিয় মানুষকে কুরবানির করা যায়। যখন স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায় তখন একসময় গিয়ে মনে হয়, এর পেছনে ছুটে আমি সুখ পেলাম না। আবার প্রিয় মানুষটাকে পেয়ে গেলে একসময় মনে হয়, মানুষটার পেছনে ছুটে আমি আমাকে হারিয়ে ফেললাম।

উষির ভেজা চোখেই হেসে ফেললো,
–তুমি তো আমাকে আরো কনফিউজড করে দিচ্ছো মা? আমি তো তোমার কাছে সমাধান নিতে এসেছিলাম।

–উষির বাবা শোন, মন দিয়ে শুনবি। ছোট থেকে কারো একটা স্বপ্ন থাকে না। কেউ ডক্টর হওয়ার পাশাপাশি সিঙ্গারও হতে চায়। একসময় দেখা যায়, সাকসেসফুল ডক্টর হয়েও আফসোস থেকে যায়৷ এই আফসোসটা সবার নিত্যসঙ্গী। কেউ একটাতে সন্তুষ্ট হতে পারে না। যে যা পায় না, তার সেটারই আফসোস থেকে যায়। তুই রাজনীতি চুজ করলে রাশার জন্য আফসোস করবি আর রাশাকে চুজ করলে রাজনীতির জন্য আফসোস করবি। এখন সিদ্ধান্ত তোর, তুই স্বপ্নের খোঁজে বের হবি নাকি প্রিয় মানুষের খোঁজে।

–তুমি হলে কি করতে মা?

ছেলের প্রশ্নে শাহিদা এক মূহুর্তের জন্য থমকালো৷ তারপর উদাস গলায় বললো,
–আমি হলে প্রিয় মানুষকে চুজ করতাম।

–আর স্বপ্ন?

–রাজনীতি ক্যারিয়ারে তুই শেষ বয়সে এসেও ঢুকতে পারবি। কে জানে, তখন রাশার ভীতি দূর হয়ে গেলো। আমি রাশার পরিবার সম্পর্কে কিছু জানি না। কিন্তু এইটুকু বুঝেছি, ওর পরিবার সম্পর্কে ভাবলে ওর কষ্ট হয়। ওর কষ্টটা তোর দূর করতে হবে। তোদের সম্পর্কটাও কতদিনের বল! এই কয়েকদিনে ওর হয়তো ঠিক করে ভালোবাসাও হয়ে ওঠেনি। কে বলতে পারে, হয়তো একদিন ও নিজেই তোর পাশে এসে দাঁড়ালো। তাছাড়া, তোর আরেকটা স্বপ্নও তো পূরণ করা বাকি তাই না?

উষির মাথা ঝুকিয়ে হাসলো, উত্তরে কিছু বললো না। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো,
–তাহলে কি রাশাকে চুজ করবো?

–সেটা তোর সিদ্ধান্ত। তবে কোন এক্সপেকটেশন ছাড়া ওর কাছে যেতে হবে। এমনও হতে পারে, ও কখনও পলিটিক্স সাপোর্টই করলো না। তোকে আবার বাঁধা দিলো।

উষির আর পালটা প্রশ্ন করলো না। শাহিদার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে রইলো। তার কাছে পুরো রাত পরে আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, ভাবার জন্য। এখন একটু শান্তি চায়। শুধুই শান্তি। এই শান্তির খোঁজে উষির মনে মনে গেয়ে উঠলো,

Someone stole the moon tonight
Took my light
Everything is black and white
Who’s the fool who told you boys don’t cry?

বয়েস অলসো ক্রাই। কান্না ছেলে মেয়ে দেখে হয় না। কান্না তো কান্নাই৷ কষ্ট পেলে, ব্যাথা পেলে চোখে পানি আসবেই। তার চোখেও আসলো৷ চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি গড়িয়ে পরলো৷ তারপর মায়ের চোখের আড়ালে চোখ মুছে চোখ খিচে বন্ধ করে রইলো।

রাশা মলিন মুখে ব্যাগ গোছাচ্ছিলো৷ নোঙর কথা বলতে এসে নিজেও হাত লাগালো৷ অনেক সময় চুপ করে থাকলেও একসময় আর না পেরে হাতের কাপড় রেখে মুখে হাত চেপে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
–প্লিজ আপু, যেও না। সবার মন খারাপ।

রাশা বিচলিত হয়ে নোঙরের গালে হাত রেখে চোখ মুছে দিয়ে বললো,
–কান্না করছো কেনো? কারো সামনে কান্না করা মানে নিজেকে দুর্বল ভাবা। বুঝেছো? কান্না করতে হয় একা একা।

–ভাইয়াকে ক্ষমা করে দাও আপু। প্লিজ?

রাশা নোঙরকে কিছু কিছু বলেছিলো৷ তাতেই সে বুঝেছে, উষিরের উপর রাগ করে রাশা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তাই এমন কথা বললো। রাশা তার কথা শুনে স্নান কণ্ঠে বললো,
–আমার একটা অযুহাতের প্রয়োজন ছিলো নোঙর। অযুহাত পেয়ে গেছি।

বলেই চোখ বুজে বড় করে শ্বাস ফেললো। নোঙরও নীরবে অশ্রু বিসর্জন ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না।

যাওয়ার সময় রাশা শাহিদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বললো,
–তোমাকে অনেক মিস করবো খালাম্মা। সময় নিয়ে ইউকে যাবে অবশ্যই৷ তোমারা গেলে আমার খুব ভালো লাগবে৷

শাহিদা কিছু না বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলো। ইমোশনাল ফুপু ও তার ইমোশনাল ভাতিজি রাশার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিলো। এয়ারপোর্টে তার সাথে গেলো উজান।
পুরোটা সময় বারবার করে চারিদিকে নজর বুলিয়েছিলো রাশা। একসময় বুঝতে পারলো, উষির নিজের ক্যারিয়ার চুজ করেছে৷ তারই মতো। মনে মনে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো সে৷ আসলেই দুনিয়ার সব মানুষই সেলফিস হয়। কেউ নিজেরটা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।
প্লেনে বসার আগ পর্যন্ত রাশার মনের কোনে আশার বাতি টিমটিম করে জ্বলছিলো। ইমিগ্রেশনের সময় বারবার পেছন ফিরে দেখছিলো উষির আসছে নাকি। একটা সময় তো মনেই হলো, আর একবার ডাকুক। কিছুতেই আর ফিরিয়ে দেবে না। শুধুমাত্র আর একবার ডাকুক!
বিচ্ছেদের অন্তিম মূহুর্তে তো এমনটাই হয়। পাশ থেকে ক্রমাগত ডাকলেও সারা দিতে ইচ্ছা করে না। আর যখন ওপাশের মানুষটা ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয় তখন মন বলে ওঠে, একবার ডাকুক। আর একবার৷ এইবার ফিরিয়ে দেবো না। অথচ এই ডাকটা তার পক্ষ থেকে আসলেও আসতে পারতো। কিন্তু জেদ বলেও একটা কথা আছে৷ জেদ, ইগো যে সবসময় ভালো বয়ে আনে তা তো না৷ যেমন এখন সেসবই তাদের বিচ্ছেদের কারন হলো। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে প্লেনে উঠে বসলো। এরপর রাশার এক বুক আশাকে নিরাশা বানিয়ে প্লেন উড়ে চললো তার নিজের গন্তব্যে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে