#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৭
উষির রাশার সম্পর্ক দিনদিন অবনতিই হচ্ছে। উষির যত কাছাকাছি যেতে চাইছে, রাশা তত পিছু হাঁটছে। উজান আর নোঙরের রিসেপশনের তিন চার দিন আগে থেকে তো উষিরও কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রাতেও ঠিকমতো বাড়িতে আসে না। আর যখন ফেরে তখন রাশা ঘুমিয়ে কাদা। তবে ঘরে ফেরার পর স্ত্রীর মুখটা দেখেই সে শান্তি পায়৷ স্ত্রী যতই অভিমান করুক, যাই করুক, শুধু তার কাছে থাকলেই হতো। এটাই তার থিউরি।
রাশা স্ত্রীসুলভ আচরণ করবে কিংবা তার খেয়াল রাখবে, এটা তো সে কখনও চিন্তাও করেনি। উষির নিজে নিজে ভালোবেসেই খুশি থাকে, আনন্দে থাকে। আর মন তো আছেই৷ সে সবসময় তাকে বোঝায়, রাশা যেটা প্রকাশ করে ও সেটা একদমই না। এটা তার লোক দেখানো ব্যবহার। নিজেকে এমনভাবে জাহির করেই সে আনন্দ পায়। আর যেটা যে ভেতরে রেখেছে, ওটা খুব ভাঙুর আর কষ্টে জর্জরিত। ভেতরের সত্তা অল্পতেই যখন ভেঙে পরে ঠিক তখনই বাইরের সত্তাটা জাগ্রত হয়। উষির রাশার কোন সত্তাকেই কষ্ট দিতে চায় না। ও যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক৷ তবুও তার থাকুক। তার এটুকুতেই চলবে। প্রতিটা মানুষই আলাদা হয়। রাশাও তেমনই আলাদা। আর ওকে সেভাবেই গ্রহণ করেছে সে। না বদলাতে চায় আর না ছাড়তে চায়৷ রাশার ব্যবহার যেমন মাঝে মাঝে কষ্ট দেয় তেমনই আনন্দও দেয়। একজন মানুষের শুধুমাত্র মন জুগিয়ে চলা তো সম্ভব নয়। ভালো খারাপ দুটোই তো মানুষের অংশ। তাহলে তার থেকে সারাক্ষণ ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। উষির বোঝে সব। আর বোঝে বলেই স্ত্রীর রাগ তার মনভুলানো হাসিতে উড়িয়ে দেয়৷
রিসেপশনের জন্য রাশা লাল রঙের জামদানি শাড়ি পরেছে। শাড়িটা উষির গিফট করেছে৷ কিনে এনে বিছানায় রেখে তার দিকে আড় চোখে একবার তাকিয়েছিলো শুধু৷ তারপর নিজের অ্যাক্টিং স্কিল জাহির করতে বলেছিলো,
–কি কান্ড দেখেছো! একজনের থেকে টাকা পেতাম। দুই বছর পর ফেরত দিলো তো দিলো, তাও কিভাবে দিলো? সেই টাকার বিনিময়ে শাড়ি হাতে ধরিয়ে দিলো। এখন এটা পরে পরে নষ্ট হবে শুধু। তার থেকে ভালো, শাড়িটা তুমিই ব্যবহার করো।
সব শুনে এবং সত্যিটা বুঝে মুখ লুকিয়ে হেসেছিলো রাশা। তারপর বুঝতে পারেনি এমনভাবে কৌতুহলী গলায় বলেছিলো,
–কত টাকা ধার নিয়েছিলো?
–দেখো রাশা, এইসব ছোটখাটো ব্যাপার আমার মনে রাখার কোন কারণ নেই৷ কত দ্বায়িত্ব আমার! এরমাঝে কে কত টাকা নিলো, দিলো সেই হিসাব আমি রেখে কি করবো৷ পেয়েছি, এনেছি। ব্যাস হয়ে গেলো।
–হয়ে গেলো?
রাশা গালে হাত দিয়ে কৌতুহলী গলায় প্রশ্ন করেছিলো। উত্তরে উষির কাঁধ নাচিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে শিষ বাজিয়ে গাছাড়া ভাবে ঘর থেকে চলে যায়। এতে রাশা উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। কোন এক কাজে উষিরকে নারায়নগঞ্জ যেতে হয়েছিলো। সেখান থেকেই এনেছে হয়তো। সরাসরি দিলেই হতো৷ সে কি না করতো নাকি! খানিক সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিলো রাশা৷ নিতো না হয়তো৷ নিলেও পরে সেটা কাউকে না কাউকে অবশ্যই দিয়ে দিতো। এখন তা দেবে না হয়তো। হয়তো কি! সে দেবেই না কাউকে। এটা তার কাছেই থাকবে৷ আর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর শাড়িটা আর পরা হয়নি। আজকে যখন সুযোগ এসেছে তখন পরার জন্য আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি।
শাড়ি পরার পর সাজার জন্য ড্রেসিং টেবিলে বসে মেকাপ নিয়ে টুকটাক সাজছিলো সে। উষির ধীর পায়ে এসে রাশার সামনে হাঁটু মুড়ে বাবু দিয়ে বসে তার একটা পা নিজের হাতে নিয়ে নিজের উরুর উপর রাখতেই চমকে উঠে রাশা। পা সরিয়ে নিতে চাইলেও উষির শক্ত হাতে ধরে আলতার কৌটা থেকে তুলির সাহায্য আলতা নিয়ে পায়ে পরিয়ে দিতে লাগলো। ঠান্ডায় আর সুরসুরিতে পা কেঁপে উঠলো সে। অস্বস্তি মাখানো স্বরে বললো,
–কি করছো তুমি? আমি কি আলতা পরিয়ে দিতে বলেছি নাকি পরতে চেয়েছি?
উষির কথা বললো না। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ আলতা পরানোর দিকে। মনোযোগ দিয়ে আলতা পরানো শেষে পকেট থেকে নুপুর বের করে পায়ে পরিয়ে দিলো। পরানো শেষে হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে নুপুরের স্লাইড করে মোলায়েম স্বরে বললো,
–এটা খুলবে না৷ আওয়াজ হয় না, তাই সমস্যা হবে না।
–হারিয়ে গেলে?
রাশা হাঁটুতে কনুই রেখে গালে দিয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করলো। উত্তরে উষিরও তার দিকে নির্নিমেষ চোখে চেয়ে লহু গলায় বললো,
–আবার কিনে দেবো।
–উষির।
রাশা খানিক রাগ করতে মেকি গলায় ডেকে উঠলো। উষির বুকে হাত দিয়ে হাঁসফাঁস করে বললো,
–ইসস রাশা! বুকের মধ্যে কেমন একটা করে উঠলো। আরেকবার ডাকো তো?
রাশা চোখ বুজে শ্বাস ফেললো। বোধহয় রাগতে চেয়েছিলো কিন্তু ভুলে হেসে ফেললো। এবং সেটা বোঝার সাথে সাথেই লজ্জা পেয়ে উষিরের কাছ থেকে পা সরিয়ে দ্রুত রুম ত্যাগ করলো। উষির হেসে ফেলে বিড়বিড় করলো,
–রাশা চৌধুরী তাহলে লজ্জাও পায়! সুন্দর তো!
অন্যদিকে ম্যারেজ হলের কাহিনী অনেকটা অন্যরকম। ক্যামেরাম্যান উজান আর নোঙরের ছবি তোলার অনেক কসরত করে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তিনি কিছুক্ষণ পর পর উজানের দিকে তাকিয়ে বলছেন,
–আপনি একটু ব্রাইডের দিকে রোম্যান্টিক চোখে তাকান।
উজান নোঙরের পেছনে দাঁড়িয়ে কোমড় চেপে একটু রোম্যান্টিকভাবে তাকানোর চেষ্টা করলো। নোঙরও পেছন থেকে মিটিমিটি হাসি নিয়ে তার দিকে তাকালো। তক্ষুনি আবার তিনি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন,
–হচ্ছে না তো। মনে হচ্ছে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। ভ্রু কুঁচকে আছে তো। সোজা করুন। কোমড়ে সুন্দর করে হাত রাখুন। সুন্দর ছবি আসবে।
নোঙর কুইক রিঅ্যাকশন দিলো। মুখ ভেঙচে বললো,
–উহু! উনি নাকি তাকাবেন রোম্যান্টিক চোখে! রোম্যান্সের আর ও জানে না। আসছে রোম্যান্টিক মানুষ সাজতে!
কুইক রিঅ্যাকশনের এই এক সমস্যা। রিঅ্যাকশন বোঝার চেষ্টা করতে করতেই ঘটনা ঘটে যায়। হলোও সেটা। উজান শুনে ফেলে চোখ গরম করে তাকালো। নোঙর কি হয়েছে জানতে ভ্রু নাচাতেই ক্যামেরাম্যান আবার বিরক্ত হলো,
–দুইজন দুইজনের দিকে এমন মারকুটে চোখে তাকিয়ে আছেন কেন? সবগুলো ছবিই তো এমন এসেছে। একটু সুন্দর করে তাকান। আজকের মেইন ফোকাস তো আপনারাই। আপনাদের ছবি ভালো না আসলে আমার এসে কি লাভ!
উজান বিরক্ত হলো। মহা মহা মহা বিরক্ত। সাথে রেগেও গেলো। সটান সোজা হয়ে হাত ঝেড়ে রাগত গলায় বললো,
–রিডিকিউলাস! আপনি বরং ব্রাইডের ছবি দিয়েই ক্যামেরার ফিল্ম ভরে ফেলুন। আ’ম নট ইন্টারেস্টেড।
বলেই দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো। ক্যামেরাম্যানকে কিছু বলার সুযোগটা পর্যন্ত দিলো না। নোঙর ফিক করে হাসতে নিয়েও হাসলো না। সুন্দর সুন্দর পোজের ছবি তুলতে লাগলো। মিসেস ফ্লোরা লেহেঙ্গাটা দারুন বানিয়েছে। ঐশ্বরিয়া রায়ের লেগেঙ্গার মতোই কিন্তু এতে নিজের মতো ছোঁয়া দিয়েছে। রঙ দিয়েছেন জলপাই রঙের। এটা কি জলপাই রঙ সেটা নিয়ে মতভেদ আছে। এক দল, যার মধ্যে আছে অন্তু নিহান। তাদের মতে এটা পাকা জলপাই৷ আর অপলা, নোঙরের মতে এটা সিদ্ধ জলপাই। মতভেদ যাই থাকুক, রঙটা তাকে খুব মানিয়েছে। আর পরিবর্তন এসেছে ওড়নায়। পাতলা ওড়নার বদলে ব্রাইডাল ভারি ওড়না ডিজাইন করেছিলেন। অপলার জন্য অবশ্য অন্যরকম ডিজাইন করেছেন। ওর লেহেঙ্গা স্কাই ব্লু রঙের। শুধু বদল বলতে এইটুকুই। বাদবাকি সব সমান। দুটো লেহেঙ্গাই অসাধারণ হয়েছে। যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি পরেও মানিয়েছে দারুন।
নোঙরের জুয়েলারি বলতে দুটো বড় কানের দুল আর নাকে ছোট টানা নথ। আর গলায় উজানের দেওয়া সেই লকেট। সেটা সে প্রায় মারামারি করেই তার থেকে ফেরত কম ছিনিয়ে নিয়েছে বেশি। সে যেভাবেই নিক, সেটা বিষয়বস্তু নয়। নিতে পেরেছে, এটাই যথেষ্ট।
অনুষ্ঠানের কোন এক ফাঁকে নোঙর উজানের হাত চেপে ধরে বললো,
–চলো পালাই।
উজান হতভম্ব হয়ে গেলো। একবার ধরে রাখা হাতের দিকে আর একবার নোঙরের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত স্বরে বললো,
–কোথায় যাবো?
নোঙর উজানের এক হাত চেপে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–তুমি যাব ইউ মেট ফিল্ম দেখোনি?
–না।
–রসকষহীন পুরুষ মানুষ কোথাকার!
বিড়বিড় করে বললো নোঙর। উজান তীক্ষ্ণ চোখে সেটা দেখলো। নোঙর উজানের চাহনি দেখে হাসার চেষ্টা করে দাঁড়িয়ে পরে বললো,
–ওখানে না কারিনা কাপুর আর শহীদ কাপুর পালিয়ে যায়। ট্রেনে করে পালায়। কি অ্যাডভেঞ্চারাস একটা মোমেন্ট! একদম ডিডিএলজে আর চেন্নাই এক্সপ্রেসের মতো দৌঁড়ে ট্রেনে উঠে ট্রেন যেখানে যায় আমরাও সেখানেই যাবো। আগে তুমি উঠবে আর পরে আমাকে হাত ধরে উঠাবে। ওই শাহরুখ খান যেমন দীপিকাকে তুলেছিলো, তেমন। তারপর যাব ইউ মেটের মতো আমরা যদি ট্রেন ফেল করি তো মজাই মজা।
বলতে বলতে চোখ চকচক করে উঠলো তার। উজান কি করবে আর কি ভাববে কিছুই বুঝতে পারলো না। হাঁটতে হাঁটতে তারা ততক্ষণে গেটের বাইরে চলে এলো। গেটের বাইরে অন্তু আর অপলা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো। তারা যেতেই উজানের হাতে ব্যাগ গুছিয়ে দিলো।
–শোনো, অনেক জামাকাপড় নিয়ে তো আর পালানো যাবে না৷ তাই এই ব্যাগ নিয়েছি। এই ব্যাগেই কিছু কিছু জিনিস তুলেছি। তোমারটাও তুলেছি৷ এখান থেকেই একটা শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে ওই গাড়ির মধ্যে থেকে চেঞ্জ করে আসো।
উজান একপলক নিজের ড্রেসের দিকে তাকালো। নোঙরের ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে ডিপ কালারের শেরওয়ানি, পায়জামা আর লং কটি পরা সে। সব ডিজাইন মিসেস ফ্লোরার করা। পরা সেট করতে আধ ঘন্টা লেগেছে। এখন আবার চেঞ্জ করতে হবে শুনেই চোখ কপালে তুলে বললো,
–চেঞ্জ করতে হবে কেন?
–তো কি এই শেরওয়ানি পরে পালাবে নাকি?
–তুমি কি এই লেহেঙ্গা পরে পালাবে নাকি?
ভ্রু উঁচিয়ে পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন করলো উজান। নোঙর দাঁত বের করে হেসে মাথা নেড়ে বললো,
–হ্যাঁ, নাহলে লেহেঙ্গা এক পাশে ধরে দৌঁড়াবো কিভাবে? লেহেঙ্গা একপাশে ধরে দৌঁড়ালে তবেই সিনেম্যাটিক ব্যাপারটা হবে।
উজান ডান ভ্রু উঁচিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
–আচ্ছা তো তোমার সিনেম্যাটিক ব্যাপার চাই!
নোঙর গম্ভীরমুখে মাথা নাড়লো। চোখেমুখে যথাসম্ভব সিরিয়াসনেস এনে বললো,
–দ্রুত চেঞ্জ করে এসো। হাতে সময় নেই। আমি ট্রেনের সময়সূচি দেখেছি৷ আর আধঘন্টা পর ট্রেন আসবে। আর ভাইয়া আর আপু আসছে না কেনো এখানে? ফোন দাও তো একটু।
–কোন ভাইয়া?
–উষির ভাইয়া আর রাশা আপু।
–ওরাও যাবে নাকি?
উজানের মুখে বিষ্ময় খেলে গেলো। বিয়ের পর প্রথম ঘুরতে যাচ্ছে ওরা। হিসাবমতে এটা ওদের হানিমুন। আর হানিমুনে কেউ ফ্যামিলি নিয়ে যায়!
–তোমার সাথে একা গিয়ে আমি বোর হতে পারবো না। সরি।
নোঙর নাক দিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো। উজান ঠোঁট চেপে নিজের কথাকে আটকে নোঙরের দেওয়া জামাকাপড় নিয়ে গাড়ির মধ্যে থেকে চেঞ্জ করে আসলো। ফিরে এসে দেখলো, উষির আর রাশা তো এসে গেছে কিন্তু নোঙর অন্তুর সাথে ঝগড়ায় ব্যস্ত। বিষয়বস্তু, জুতা।
নোঙর অন্তুকে অনুরোধ করে জুতা দিতে বলছে,
–আমি বলছি আমাকে দে। কিচ্ছু হবে না। যেখানে যাবো সেখানে নতুন জুতা কিনে এটা কুরিয়ার করে দেবো।’
অন্তু সজোরে মাথা নাড়লো,
–অপু আপুর জুতা তুমি ছিড়ে ফেলেছিলে। আমি আর তোমাকে বিশ্বাস করি না। একটুও না।
নোঙর আর অন্তুর কথায় উজান হেসে ফেললো।
–এইটা পরে পালাতে পারবো না তো। বুঝতে হবে তো। তাই তো এই স্নিকার্সটাই আমার লাগবেই লাগবে।
নোঙর কোমড়ে হাত দিয়ে অন্তুর থেকে জুতা নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে৷ কথায় না পেরে রাস্তায় বসে অন্তুর পা থেকে জুতা নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। অবশেষে যখন অন্তু নিজের জুতা দিলো তখন নোঙরের মোবাইল অন্তুর হাতে। নাক মুখ লাল করে সাবধানি স্বরে বললো,
–আমার ফোনের যদি কিছু হয় তাইলে পিঠে বস্তা বেঁধে রাখিস।
অন্তু দাঁত বের করে হাসলো৷ রাশা হাসি থামিয়ে বিচলিত গলায় বললো,
–কিন্তু তোমরা যাবে কোথায়?
–ওরা ঘুরতে যাবে। আর আমরা দুইজন ওদের ট্রেনে তুলে দিতে যাবো।
উষির নোঙরকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে নিজেই প্রশ্নের উত্তর দিলো। এর অর্থ স্পষ্ট, রাশা প্ল্যান সম্পর্কে কিছুই জানে না।
নোঙর ঠোঁট টিপে হেসে উজানকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললো,
–তোমার এই বডিগার্ডগুলো এভাবে পিছে পিছে থাকলে আমরা পালাবো কিভাবে?’
উজান পিছন ঘুরে ইশারায় সবাইকে চলে যেতে বললো। জায়গা ফাঁকা হতেই নোঙর এক হাত দিয়ে লেহেঙ্গা ধরে আরেক হাত দিয়ে উজানের হাত চেপে দৌঁড়াতে শুরু করলো।আচমকা এমন কান্ডে সবাই হকচকিয়ে গেলো। পেছনে উষিরও রাশার হাত ধরে দৌঁড়ানো শুরু করলো। রাশা থতমত খেয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই চেঁচিয়ে বললো,
–ওরা দৌঁড়াচ্ছো কেনো? আর আমরাই বা দৌঁড়াচ্ছি কেনো?
–ওরা দৌঁড়াচ্ছে কারন ওরা পালাচ্ছে। আর আমরা দৌঁড়াচ্ছি কারন ওদের সাথে আমরাও যাচ্ছি।
এবারে ঝটকা লাগলো রাশার। উষির হাত ধরে রাখায় অজানা কারনে সে থেমে গেলো না। শুধু সিএনজিতে ওঠার পর রাগে লাল হয়ে বললো,
–নিউলি ম্যারেড কাপলদের সাথে ঘুরতে যাওয়া কোন ধরনের আক্কেলের কাজ হয় বলতে পারো?
উষির বুক ফুলিয়ে বড় বড় করে শ্বাস ফেলে বললো,
–সমস্যা নেই তো। ওরা এক হোটেলে উঠবে, আমরা আরেক হোটেলে উঠবো।
উষিরের এই বুদ্ধিমান উত্তরে রাশা ঠোঁট চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে মুখ বন্ধ রাখলো। ম্যারেজ হল থেকে বড় রাস্তায় উঠার পর নোঙর উজানকে বললো,
–ফোন বন্ধ করে দাও৷ যাতে আমাদের ট্র্যাক করতে না পারে।
উজান হেসে ফোন বন্ধ করে ফেললো। উজানের ফোন যখন ব্যাগের মধ্যে বন্ধ হয়ে পরেছিলো তখন তাদের দুই সিএনজির পিছনে দুটো বড় গাড়ি পিছু নিয়েছে। নোঙর টের পেয়ে আঁতকে উঠলো,
–তোমার গার্ডদের ফোন দাও তাড়াতাড়ি। দুইটা গাড়ি আমাদের পিছু নিয়েছে।
উজান একপলক পিছনে তাকিয়ে পা টান করে সিটে হেলান দিয়ে বসে বললো,
–আসতে দাও। তোমার ভয়ে বেশিদূর আগাতে পারবে না।
প্লাটফর্মে যখন পৌঁছালো তখন ট্রেনে হুলসেল বেজে উঠেছে। আস্তে আস্তে চলতে শুরু করবে এখন। উজান নোঙরের হাত ধরে দৌঁড় দিলো। পেছনে উষিরও রাশার হাত ধরে দৌঁড়ালো।
নোঙর নিজের স্বপ্নের মতো লেহেঙ্গা এক হাত দিয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে উজানের হাত চেপে পিছন পিছন দৌঁড়াতে লাগলো। তারপর যখন উজান ব্যাগ কাঁধে ট্রেনে উঠে গেলো তখন হেসে নোঙরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। নোঙর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার পিছনে তাকিয়ে উজানের দিকে হাত বাড়িয়ে ধরে টান দিয়ে ট্রেনে তুললো। নোঙরকে ভেতরে ঢুকিয়ে উজান উষিরকে টেনে তুললো। উষির রাশার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো৷ ট্রেন আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে৷ রাশার এক পাও চলছে না। স্থীর দাঁড়িয়ে আছে। উষির তার থমথমে মুখ দেখে থমকে গেলো। হাস্যজ্বল মুখ মুহূর্তেই আঁধারে ঢেকে গেলো। মাথা নেড়ে রাশাকে আসতে বলতেই দুই দিকে মাথা নেড়ে না বুঝালো সে। উষিরের সাথে আর কোন পথ সে পাড়ি দেবে না। আর না কোন স্মৃতি তৈরি করবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো উষিরের। এমন মনে হচ্ছে, ট্রেন যত সামনে এগোচ্ছে, রাশার সাথে তার দূরত্ব ততই বেড়ে যাচ্ছে৷ বাড়ানো হাতটা আস্তে আস্তে নামিয়ে ফেললো। উষিরের পেছন থেকে উজান আর নোঙর একসাথে চেঁচিয়ে রাশাকে উঠতে বলছে। উষির না দরজা ছাড়ছে আর না উজানকে নামতে দিচ্ছে। একদম বরফের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
ট্রেনের গতি আরেকটু বাড়তেই পরিবারের সকলে এসে উপস্থিত হলো৷ রাশা তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। একদম কাঠ পুতুলের মতো। পরিবারের সকলেই রাশার এমন ব্যবহারে খুব অবাক হলো। তারাও চেঁচিয়ে উঠলো,
–দৌঁড়াও রাশা, দৌঁড়াও।
রাশা চমকে উঠে তাদের দিকে তাকালো। তার চোখে পানি টলমল করছে। বুক চিড়ে যাচ্ছে। তারপর তার কি হলো সে জানে না! শুধু দেখলো শাহিদা এগিয়ে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে দিয়ে দৌঁড়াতে বলছে। আর সেও সম্মোহনের মতো দৌঁড় দিলো। শাড়ি পরার অভ্যাস তার আছে। শাড়ি পরে দৌঁড়ানোর অভ্যাসও আছে। তাই কোন সমস্যাই হলো না। উষির পুনরায় হাত বাড়িয়ে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হাত আকড়েও ধরলো রাশা। এরপর সবার বুক দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস পরলো। রাশা উষিরের হাতের টানে ট্রেনে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে, কতকাল পর আজ তাদের দেখা হলো। কত জনমের দূরত্ব ঘুচে গেলো তাদের। ঘটনাটা ঘটতে মিনিটের মতোই লেগেছিলো। কিন্তু তাদের কাছে এটা ছিলো এক জনম পাড়ি দেওয়ার সমান।
নোঙরের পুরো সিন দেখে হাত তালি দিয়ে হেসে ফেলে বললো, –ফিল্মে তো এই ক্লাইমেক্সও থাকে তাই না? পালানোতে যদি থ্রিল না থাকে তাহলে সেটা পালানো হলো নাকি?
নিহান মলম বিক্রেতার কাছ থেকে মাইক এনে মাইকে জোরে জোরে বললো,
–যা সিমরান, জি লে আপনি জিন্দেগী।
নোঙর সহ সবাই হেসে ফেললো। তারপর হাতের ইশারায় সবাইকে বিদায় দিতে দিতেই ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দূরে চলে গেলো।
চলবে…
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৮
টিকিট ছাড়া ট্রেন ভ্রমণের জন্য তাদের বেশ মোটা অংকের জরিমানা গুণতে হলো। কয়েক স্টেশন যাওয়ার পরেই তাদের পাকড়াও করা হলো৷ টিটি ভীষণ কড়া। কিছুতেই ছাড়বে না। পরিচয় দিলে আরো বেজ্জতি হবে জন্য পরিচয়ও দিতে পারলো না। পরের স্টেশনে নামার পর মাস্ক আর ক্যাপের জন্য স্টেশন মাস্টার তাদের স’ন্ত্রা’সী ভাবতে লাগলো। রেস্টরুমে দুই ঘন্টা বসিয়ে রেখে পুলিশ ডেকে কথাবার্তা বলে তবেই তারা ছাড়া পেলো। রাত তখন একটা। গন্তব্য তাদের এখনও ঠিক হয়নি তবে ট্রেন চলে গেছে। পরের ট্রেন কখন আসবে তারা জানে না। সেসব আলোচনার আগে উষিরের দুঃখ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। সব জায়গায় প্রাধান্য পাওয়া ছেলেটিকে স্টেশন মাস্টার চিনলোই না। আর চিনলো না তো চিনলো না। সরাসরি স’ন্ত্রা’সী ভাবলো। মেয়ে ভাগিয়ে নেওয়া স’ন্ত্রা’সী। এই দুঃখ তার সহজে যাবার নয়।। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেকিং এর জন্য খুলে ফেলা মাস্ক পরতে পরতে বিষ্ময়ভরা স্বরে বললো,
–আজব! আমাকে চেনেনি!
–স্যোশাল মিডিয়ার পলিটিসিয়ানকে শুধু স্যোশাল মিডিয়ার মানুষই চেনে।
রাশার টিটকারি দিয়ে কথাটা কানে যেতেই উষির চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো। কথাটা যে এতো জোরে বলা হবে সেটা রাশা নিজেও বুঝতে পারেনি তাই হাসার চেষ্টা করে ঠোঁট চেপে অন্যদিকে মুখ নিলো। নোঙর ঘুমঘুম স্বরে বললো,
–আমরা কোথায় ঘুরতে যাবো?
–সিলেট, সেন্টমার্টিন, রাঙামাটি, নিঝুম দ্বীপ..
উষিরের লিস্ট লম্বা। তবে লিস্টের বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন পরলো না। তার আগেই উজান টিপ্পনি কেটে বললো,
–সুন্দরবন যাওয়া যায়। নোঙরের সঙ্গী সাথীদের সাথেও একটু মোলাকাত হয়ে যাবে।
রাগে নোঙরের চোখ জ্বলে উঠলো। রাশা তাকে সামলে নিয়ে বললো,
–খাগড়াছড়ি যাবো। আমটিলাতে একটা অরফানেজ আছে। আমার পরিচিত। সেখানেই আমরা থাকবো।
খাগড়াছড়ির কথা মনে হতেই উষিরের নিজেদের রিসোর্টের কথা মনে পরে গেলো। পাহাড়ের উপর বানানো সেই রিসোর্ট থেকে পুরো খাগড়াছড়ি দেখা যায়। সানসেট আর সানরাইজের মনোরম দৃশ্যও নজরকাড়ে। তৈরি হয়েছে তিন চার বছর হলো। রিসোর্টটা তৈরির সময় আফসার সাহেব পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছিলো। সেইজন্যই তার ওটার কথা মনে আছে। উজানকে জিজ্ঞাসাও করলো,
–ওখানে তো আমাদের একটা রিসোর্ট ছিলো।
–ছিলো কিন্তু..
উজান আমতা-আমতা করলো। রাশার ফ্যামিলি যে কিভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সেটা জলের দরে কিনে নিয়েছে সেটা তার সামনে বলতে অস্বস্তিতে পরে গেলো। তবে রাশা তাকে সেটা থেকে উদ্দ্বার করলো,
–ওটা এখন বুক। তাই ওখানে যাওয়া যাবে না।
–তুমি কিভাবে জানলে?
উষির ভ্রু বেকিয়ে জানতে চাইলো। রাশাও তেমনই তেড়ছা ভাবে বললো,
–আমি মোবাইলের জগতে থাকি না। তাই জানি।
উষির জোরে শ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে প্লাটফর্মে রাখা বেঞ্চিতে বসলো। নোঙরও বসে বসে ঝুমতে লাগলো। উজান তাদের দিক থেকে নজর সরিয়ে চিন্তিত গলায় চাপা স্বরে রাশাকে প্রশ্ন করলো,
–রাশা, ওটা তো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
–হয়েছিলো। বড় বাবা রিসোর্টটা আমার নামে লিখে দিয়েছিলো। আর আমি ওটা আংকেলকে ফেরত দিয়েছি। আংকেল জানে সেটা।
উজান কেমন থতমত খেয়ে গেলো। এসব কাহিনী হলো কবে? এতো বড় একটা ঘটনা বড় বাবা তাকে জানায়নি! এটা তাদের বেশ বড় আর লং টার্ম প্রজেক্ট ছিলো৷ দীর্ঘ সময় ধরে রিসোর্টটা তৈরি করা হয়েছে৷ লাভাংশ প্রায় কয়েক কোটি টাকা৷ সেটা ফিরে এসেছে অথচ সে জানেই না!
খাগড়াছড়ির ট্রেন সেখানে আসে না৷ এতো রাতে গাড়িও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই নিরব স্টেশনেই রাত কাঁটানোর সিদ্ধান্ত হলো। বসে থেকে অপেক্ষা করতে করতে একসময় নোঙর পেট চেপে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
–ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে৷ মনে হচ্ছে কতকাল হলো খাই না।
নোঙরের কথায় বাকিদেরও বেশ ক্ষিদে পেলো৷ পালানোর চক্করে তাদের কিছুই খাওয়া হয়নি। এসে পরেছে শহরের বাইরের কোন এক অপরিচিত এলাকায়। স্টেশনে একটা চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছুই নেই। উষির আর উজান সেদিকেই গেলো। চায়ের খোলা দোকানের ভেতরে বেঞ্চির উপর চাদরমুড়ি দিয়ে একটা লোক ঘুমিয়ে আছে। তাকেই ডেকে তোলা হলো। তার কাছেও খাবার নেই৷ উপায় বাতলে দিলো নোঙর। তার ব্যাগে নুডলসের প্যাকেট আছে৷ সবাই বিষ্মিত হলো খুব। উজান হাত ভাজ করে কপাল কুঁচকে বললো,
–তুমি নুডলসের প্যাকেট নিয়ে ট্রাভেল করো?
–না না৷ এটা তো অপশনাল ছিলো। হঠাৎ যদি দরকার পরে, তাই এই ব্যবস্থা।
–তাহলে কেক, ব্রেড বা বিস্কিট আনতে। নুডলসের প্যাকেট নিয়ে এসে কি লাভ? রান্না করতে কোথায়?
–আমার তো ওগুলোর থেকে নুডলসই বেশি ভালো লাগে। তাই নুডলসই এনেছি। এটা এমনিতেই খাওয়া যায় আবার রান্না করেও খাওয়া যায়।
উজান কপাল চাপড়ে বেঞ্চিতে বসে পরলো। নোঙর কাধ নাচিয়ে ঠোঁট উলটে একে একে বারো প্যাকেটের ইন্সট্যান্ট নুডলস বের করলো।
–এতো নুডলস নিয়ে ট্রাভেল করতে?
রাশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো। নোঙর হাসার চেষ্টা করলো। সবার রিঅ্যাকশন দেখে মনে হচ্ছে, সবাই খুব অবাক হয়েছে৷ কিন্তু অবাক হওয়ার মতো কিছু হয়েছে বলে তার মনে হচ্ছে না৷ সে তো ভালো মনেই এনেছিলো৷ এখন তো অস্বস্তি হচ্ছে খুব।
রান্নার দ্বায়িত্ব নোঙর আর রাশা নিলো৷ রান্না হবে, চা বানানোর পাতিলে। চায়ের দোকানদার বেশ সাহায্য করতে লাগলো তাদের৷ উজান আর উষির রক্তশূণ্য মুখে বসে রান্না দেখতে লাগলো। উষির বেশ ভয়ার্ত গলায় বললো,
–কি যে রান্না করছে! আমাকে তো ধারের কাছেও ঘেঁষতে দিলো না।
উজানও দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
–নোঙরের রান্নায় আমার কোন ভরসা নেই।
উষির চমকে উঠে তার দিকে তাকালো৷ তারপর মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বললো,
–রাশার রান্নায়ও না। মনে হচ্ছে, আজকে না খেয়েই থাকতে হবে।
দুই ভাই-ই বেশ বড় আর গভীর শ্বাস নিলো৷ ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ লাস্ট ইম্প্রেশন। তাদের দুইজনেরই অর্ধাঙ্গিনীর হাতের রান্না খাওয়ার অভিজ্ঞতা এতোই খারাপ যে দ্বিতীয়বার টেস্ট করার কথা কল্পনাও করতে পারে না।
মিনিটখানেকের মধ্যেই নুডলস রান্না করে তারা ফিরে আসলো। বেঞ্চের মাঝখানে বাটি রাখতে রাখতে নোঙর উৎফুল্ল হয়ে বললো,
–নোঙর স্পেশাল গরম গরম নুডলস।
বেঞ্চের দুইদিকে দুই ভাই আর সামনে একটা বেঞ্চ এনে তাতে রাশা আর নোঙর বসলো। উজান আর উষির বাটির দিকে তাকিয়েই ঢোক গিললো। উজান রান্না খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে উষিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–বড় ভাইদের আগে টেস্ট করা উচিৎ। আগে তুই খা, তারপর আমি।
–ছোটদের রেখে বড়রা কীভাবে খাবে? একটা দ্বায়িত্ব আছে না?
উষির সেটা আবার তার দিয়ে বাড়িয়ে দিলো। উজান আবার তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দরাজ গলায় বললো,
–বড়রা আগে।
–বড়দের কথা শুনতে হয়। আগে ছোটরা খাবে।
তাদের এই লড়াই দীর্ঘক্ষণ চলতো। রাশা তাদের মাঝে সমঝোতা করে বললো,
–তোমাদের খেতে হবে না। আমি আগে খাচ্ছি।
বাটিটা চাওয়ালার টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি। স্টিলের চার বাটিওয়ালা টিফিন ক্যারিয়ারের দুটোতে তারা খাবার নিয়েছে আর একটাতে লোকটার সকালের হালকা খাবার হিসেবে রুটি রাখা৷ আর একটাতে তাকে নুডলস দেওয়া হয়েছে। চামচ হিসেবে চায়ে চিনি মেশানোর চামচ ব্যবহার করা হচ্ছে। নুডলস ছোট ছোট করে রান্না করায় খেতে কোন সমস্যাই হয়নি। রাশা একবার খেয়ে চোখ বুজে স্বাদ নিলো। তারপর বারবার করে খেতে লাগলো। প্রশংসা করতেও ভুললো না। নোঙর উজান আর উষিরের ব্যবহারে যে কষ্ট পেয়েছিলো, রাশার প্রশংসায় সেটা ভুলে গেলো।
তাদের খাওয়া দেখে দুই ভাই ভরসা পেলো। উষির এক চামচ মুখে তুলে চোখ বুজে স্বাদ নিলো। তারপর উৎফুল্ল মেজাজে বললো,
–ওয়াও নোঙর! এটা তো ভীষণ টেস্টি৷ কি দিয়ে রান্না করেছো?
–তেমন কিছুই না। পুরোটাই রান্নার কারিশমা।
নোঙর কানের পিঠে চুল গুজে লাজুক হেসে উত্তর দিলো৷ উষির আরেক চামচ মুখে তুলে বললো,
–আমাকে অবশ্যই শিখাবে৷ এটা অনেক টেস্টি৷ স্বাদে চোখ বুজে আসছে।
নোঙর লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে সায় জানালো। অন্যদিকে উজান কড়া চোখে তার দিকে তাকালো৷ তার মানে, ইচ্ছে করে তাকে বাজে রান্না খাওয়ানো হয়েছিলো! ভালো! খুব ভালো! তার জন্য আজ সবাইকে এতো অপদস্ত হতে হলো। সেটাও মেনে নিয়েছিলো সে৷ আর এখন এতো বড় একটা ঘটনা সামনে আসায় আর সহ্য হলো না। তার আর কোন মনমনানি সে সহ্য করবে না৷ যথেষ্ট হয়েছে। মনে মনে নোঙরকে ভুল বুঝে শক্ত সিদ্ধান্ত নিলো৷
খাওয়া দাওয়া শেষে রাশা আর নোঙর প্লাটফর্মেরই একটু দূরে ট্রেনে ওঠার রাস্তায় পা ঝুলিয়ে বসে প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখতে লাগলো আর গল্প করতে লাগলো। কিছুটা সময় যাওয়ার পর নোঙর খুশিতে লাফিয়ে উঠে রাশার হাত ঝাঁকিয়ে বললো,
–আপু দেখো তারা খসে পরছে। চলো, কিছু উইস করি।
–এসব কুসংস্কার নোঙর৷ তারা আদোতে তো পাথর৷ পৃথিবীর অ্যাটমোস্ফেয়ারে ঢোকার সময় একটা সংঘর্ষ হয়। সেটাই আলো ক্রিয়েট করে৷ আর এটাই তারা খসা নামে পরিচিত। বুঝেছো?
–বুঝেছি বুঝেছি।
নোঙর গাল ফুলিয়ে বললো। তারপর আবার উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললো,
–কুসংস্কার তো আমিও মানি না। কিন্তু এটা করতে আমার ভালো লাগে। বিশ্বাস করা আর ভালো লাগা তো এক না তাই না?
বলেই রাশার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর অনুরোধের সুরে বললো,
–প্লিজ আপু, মেক আ উইস।
নোঙরের জোড়াজুড়িতে রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো কি উইস করা যায়। মনের গহীন কোনে বলা কথাটা মাথায় আসলো। তারপর চোখ বুজে মনে মনে উইস করলো,
–একটু শান্তি।
মনে মনে বলা কথাটা উইস হিসেবে চাইতেই ঝট করে চোখ খুলে ফেললো। তক্ষুনি পেছন থেকে উষির বললো,
–হেই গার্লস, হোয়াট আর ইউ গাইস ডুয়িং?
দূর থেকে উষির আর উজান এসে দুইজনের পাশে বসলো। রাশার মুখে অজান্তেই হাসি চলে আসলো৷ পাশে বসা উষিরের হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখলো। তারপর চোখ বুজে একটা প্রশান্তির শ্বাস ফেলতেই উষির মুচকি হেসে রাশার মাথার উপর ঠোঁট ছুইয়ে মাথায় গাল ঠেকিয়ে চোখ বুজলো।
উজানের চোয়াল রাগে এখনও শক্ত হয়েই আছে৷ নোঙরের পাশে বসতেই নোঙর উচ্ছ্বসিত গলায় উজানের হাত চেপে বললো,
–এইমাত্র তারা খসে পরলো৷ উইস করো একটা। আমিও করেছি।
উজান শক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললো,
–তোমার মাথার সবগুলা তার জোরা লেগে যাক৷ আমিন।
নোঙর ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ক্ষোভের সাথে ঝটকা দিয়ে উজানের হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে পরলো৷ তারপর রাগে বড় বড় পা ফেলে হাঁটতে লাগলো৷ বাধ্য হয়ে উজানও তার পিছু নিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের গাড়ি চলে আসলো৷ উজান তখন তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো। গাড়ির ড্রাইভারকে সেই আসতে বলেছে। খাগড়াছড়ি তাদের যাওয়া হচ্ছে না। শুধু খাগড়াছড়ি কেনো, কোন জায়গায়ই যাওয়া হবে না। পেন্ডিংএ রাখা কাজ ফেলে তার পক্ষে ঘুরতে যাওয়া সম্ভব না। নোঙর অভিমানে আর একটা কথাও বললো না। চুপচাপ গাড়িতে বসে পরলো। রাশা আর উষির একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে উজানকে কিছু বলতে চাইলে উজান স্পষ্ট গলায় বললো,
–সরি উষির৷ তোরা ঘুরতে যা। আমি এখন যেতে পারবো না৷ পরে একদিন যাবো।
উষির রাগী গলায় বললো,
–তাহলে আসলি কেনো?
উত্তরে উজান কিছুক্ষণ নিরব থেকে গাড়িতে উঠে বসলো। রাশা নোঙরকে কিছু বলার আগেই নোঙর কান্নাভেজা গলায় তীব্র অভিমানী স্বরে বললো,
–আমার আর এখন যেতে ইচ্ছা করছে না আপু। তোমরা ঘুরতে যাও৷ আমি যাবো না।
নোঙরের গলার স্বরে রাশার প্রচন্ড মন খারাপ হলো৷ উজানের খারাপ লাগলেও সে নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল রইলো। অনেক বুঝানোর পরেও জেদি দুইজনের একজনও যখন রাজি হলো না তখন বাধ্য হয়ে উষির আর রাশাও গাড়িতে উঠে বসলো। ট্রেন যেমন তাদের নিয়ে অনেকদূর চলে এসেছিলো, তেমনই গাড়িও তাদের গন্তব্য পালটে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। মন খারাপ থাকা নোঙরের বঁধুবরণও সাদামাটা ভাবেই হলো৷ কেউ-ই প্রস্তুত ছিলো না৷ আর নোঙরেরও আনন্দ উচ্ছ্বাস চলে গিয়েছে৷ তাই ছবিগুলোও তার মন খারাপের সাক্ষী থাকলো।
চলবে…