তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৩৩+৩৪

0
59

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৩

নোঙর সব কাজে ফেল করার পর তার বস হয়ে গেলো মিসেস ফ্লোরা। সেখানে ট্রান্সফার হওয়ার পরে তাকে সর্বপ্রথম একটা গাউন ডিজাইনের টাস্ক করতে দেওয়া হলো। নোঙর ঠোঁট কামড়ে ভেবে চিন্তে সারাদিন সময় নিয়ে ডিজাইন কমপ্লিট করলো। মিসেস ফ্লোরা সেই ডিজাইন দেখার পর থমথমে মুখে একবার ডিজাইন, একবার নোঙরকে দেখলো। তারপর কাগজটা তার হাতে ধরিয়ে বললো,

–মিস্টার আজলানের থেকে এটার অ্যাপ্রুভাল নিয়ে এসো, যাও।

নোঙর ঠোঁট উলটে উজানের কেবিনে আসলো। উজান দীর্ঘক্ষণ ডিজাইনটা দেখে বোঝার চেষ্টা করলো, ওটা আসলে কিসের ডিজাইন। বুঝতে না পেরে টেবিলে ধপ করে কাগজটা রেখে বললো,

–এসব কি?

–একটা গাউন ডিজাইন করেছি। কেমন হয়েছে? সুন্দর না?

নোঙরকে বেশ উচ্ছ্বাসিত বলে মনে হলো। উজান তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,

–কেমন ডিজাইন করেছো সেটা দেখতেই পারছি!

উজানের মুখোভঙ্গী দেখে নোঙর দমে গেলো। খানিক মন খারাপ করে বললো,

–এভাবে বলছো কেন? কথা বলার ইচ্ছা না হলে না বলবে। তাও এভাবে কথা বলে মনে দুঃখ দেবে না প্লিজ। তুমি জানো, এই ডিজাইন করতে আমার কতোগুলো পেপার নষ্ট হয়েছে? চারটা পেন্সিল আর অর্ধেক ইরেজারও শেষ। দুটো শার্পনারও হারিয়েছে।’

কথা বলতে বলতে চেয়ার টেনে বসে পরলো সে। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যাথা হয়ে গেছে৷ উজান তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বললো,

–তার পরেও ভালো ডিজাইন হয়নি।

–আমি কি ডিজাইনার নাকি যে এসব পারবো?

নোঙর ক্ষোভ নিয়ে বলে টেবিলের উপর হাত রেখে উদাস হয়ে গেলো৷ উজান চোখ মুখ শক্ত করে ধমকের সুরে বললো,

–যদি ডিজাইন না পারো, অ্যাকাউন্টিন্স না পারো, ব্যবসায়ীক কোন জ্ঞান না থাকে তো এখানে কি করছো?

–জব করছি। আ’ম আ ওয়ার্কিং ওমেন।

নোঙর একজন গর্বিত চাকরিজীবী নারী। উজানের সামনে সেটাই জাহির করতে চাইলো। উজান ব্যাঙ্গ করে বললো,

–হ্যাঁ, সেটা তো দেখতেই পারছি।

নোঙর কিছু না বলে চোখ পিটপিট করে তার দিকে তাকালো। উজান সেদিকে ফিরেও দেখলো না। তার এতো কষ্ট করে করা আর্ট মুচড়ে ফেলে বললো,

–যেহেতু তুমি কোন কাজ পারো না আর শিখছোও না তাই কাল থেকে অফিসে আসার দরকার নেই।

নোঙর এবারে সোজা হয়ে বসে উজানের কথায় মনোযোগ দিলো,

–মানে?

–ইউ আর ফায়ার্ড।

–এক্সকিউজমি ডিয়ার হাজবেন্ড, অফিসটা আমার শ্বশুরবাড়ির। চাকরিটাও কাকা শ্বশুর দিয়েছেন। তাই তুমি আমাকে কিছুতেই ফায়ার করতে পারো না।

নোঙর এসব বলে বাঁকা হেসে হাত ভাজ করে আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। উজানকে আচ্ছামত শায়েস্তা করতে পেরে তার মন শান্তিতে ভরে উঠলো। উজান কপাল কুঁচকে কিছু ভেবে বললো,

–ওকে! ফায়ার করতে না পারি, পদ থেকে তো সরাতেই পারি।

–বলতে?

–বলতে তোমার ডিমশন হবে। এবার থেকে সবার জন্য চা কফি বানাবে তুমি।

–আমি চা কফি বানাবো!

বিষ্ময়ে নোঙরের চোয়াল ঝুলে পরলো। উজান বিরক্ত হয়ে রাগী গলায় বললো,

–তাছাড়া আর কি পদ দেবো তোমাকে?

–এমডি বানিয়ে দাও। ভালো সামলাতে পারবো।

–হ্যাঁ, এটাই বেস্ট ওয়ে। গলাবাজি তো ভালোই পারো।

–তাহলে স্বীকার করলে, তুমি গলাবাজি করেন।

নোঙর অজান্তেই কথাটা বলে ঠোঁট চেপে ধরলো। উজান কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

–আউট!

নোঙর রেগে উঠে দাঁড়ালো। যথেষ্ট হয়েছে অপমান। আর সে সহ্য করবে না। মুড়ে রাখা কাগজ হাতে নিয়ে তেজি গলায় বললো,

–হ্যাঁ যাচ্ছি। আমি নিজে আসিনি৷ আমাকে পাঠানো হয়েছিলো। নাহলে তোমার মুখ দেখার কোন শখ আমার নেই। আর রইলো তোমার চাকরি! ওটা তুমিই করো। রেজিগনেশন লেটার দিয়ে কালই চলে যাবো৷ তোমার চাকরি তুমিই খাও আর তোমার আদরের স্টাফদেরই খাওয়াও।

রাগ ঝেড়ে আর এক মূহুর্তও থাকলো না৷ হাতে ধরা মুড়ে রাখা কাগজটা দেয়ালে টাঙানো উজানের প্রাইজ ধরা ছবিতে ছুড়ে দিলো৷ ফ্রেম বাঁধানো ছবিতে বাড়ি খেয়ে নিচে পরে গেলো সেটা। সেদিকে নজরও দিলো না নোঙর। হনহন করে চলে গেলো। উজান তার বাচ্চামোতে বিরক্ত হলো খুব। তার উপর এখন কাজের প্রচুর প্রেসার পরেছে। এরমাঝে অন্যকিছু হ্যান্ডেল করার এনার্জি তার নাই৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে এক হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরলো। নোঙর রাগ করেছে৷ করলে করুক। দিনের মধ্যে চোদ্দবার এমনিতেই ফোঁস ফোঁস করে৷ এ আর নতুন কি!

নেটওয়ার্ক গোলযোগের কারনে অফিস তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। সমস্যা হলো, গোলযোগ হয়েছে বৃষ্টির কারনে। এখন যখন ছুটি হয়েছে তখন বাড়ি ফিরতে হবে। সমস্যা সেখানে না। সমস্যা বৃষ্টিই তবে সেটা অন্য কারনে। নোঙর ভুল করে বাবার পুরোনো ছেড়া ছাতা নিয়ে চলে এসেছে। ইগো দেখাতে গিয়ে উজানের সাথে কিছুতেই বাড়ি যাবে না। আবার ছেড়া ছাতা ফুঁটানোও যাবে না। ছাতা ছাড়া এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে বেরও হওয়া যাবে না৷ অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃষ্টি দেখতে লাগলো সে। একটু দূরেই উজান গাড়ির মধ্যে বসে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মুখে বিরক্তের ছাপ থাকলেও নোঙর কি করে দেখার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করে আছে। কিছু সময় পরে সেখানে অমি এসে পড়লো। সাথে একটা সিএনজি। অমিকে দেখেই উজানের মুখ শক্ত হয়ে গেলো। দ্রুত হাতে গাড়ি চালু করে সাঁই করে সেখান থেকে চলে গেলো। চমকে উঠলো নোঙর, অমি।

অমি জোরাজুরিতে তার সাথে নোঙর সিএনজিতে উঠতে নিতেই তিনজন গার্ড তাদের দিকে এগিয়ে আসলো। বিনীতভাবে বললো,

–ম্যাম, স্যার আপনাকে গাড়িতে যেতে বলেছেন।

নোঙর গার্ডদের দেখিয়ে দেওয়া গাড়ির দিকে তাকালো। উজানের গাড়ি না সেটা। কালো অ্যাম্বাসেডর গাড়িটা অমিরও অপরিচিত। কিন্তু গার্ডগুলো পরিচিত। উজানের আশেপাশে অহরহ দেখেছে। ভ্রু কুঁচকে একটু ইতস্তত করে বললো,

–আপনারা উজান স্যারের গার্ড না?

–ইয়েস।

তিনজন গার্ডের মধ্যে একজন মাথা নেড়ে উত্তর দিলো। তাদের মাঝে একটা রোবোটিক ভাব রয়েছে। অতিরিক্ত আর একটা কাজও তারা করে না। তাদের এই সংক্ষিপ্ত কাঠখোট্টা জবাবের বিপরীতে অমি কৌতুহল জরিত স্বরে বললো,

–বোনের জন্য কি দরদ! আজকাল তো মায়ের পেটের বোনেরও কেউ এতো খেয়াল রাখে না। বলছিলাম কি, আমাকেও কি লিফট দেওয়া যায়? তাহলে ভাড়া বেঁচে যেতো। মাসের শেষ তো। বুঝতেই তো পারছেন।

–সরি, স্যার কোন ভুড়িওয়ালা মানুষকে গাড়িতে তুলতে মানা করেছেন। ম্যাম বললেও না।

নোঙরের সামনে এমন বলায় অমি কেশে উঠলো। নোঙর ঠোঁট টিপে হাসি আটকালো। তারপর গার্ডদের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,

–আমি আপনাদের স্যারের দেওয়া গাড়িতে যাবো না। বুঝেছেন? বুঝলে এখন রাস্তা থেকে সরুন।

–সরি ম্যাম, স্যার বলেছেন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিলে তবেই আমাদের ছুটি। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে হসপিটালে যেতে হবে। ওখানে আমার ওয়াইফ রয়েছে।

এবারেও অতিরিক্ত কিছুই বলেনি। এসব কথা বলতে উজানই শিখিয়ে দিয়েছিলো। আবার মিথ্যাও বলেনি। যে গার্ড এটা বলেছে তার স্ত্রী একজন নার্স। আর নার্স তো হসপিটালেই থাকে। সুতরাং মিথ্যা একদমই হয়নি। নোঙর ইমোশনাল মানুষ। গার্ডের কথায় গলে গেলো। তারপর অমি সিএনজিতে চলে গেলো আর নোঙর গাড়িতে। দূরে উজান গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। স্ত্রী যেমনই হোক, তার উপর যত রাগই হোক, তার দ্বায়িত্ব পালন করা একজন স্বামীর কর্তব্য বলেই সে জানে এবং মানে।

****

প্রপার্টি দেখে রাশা তাচ্ছিল্যভরে হেসেছিলো তাকে সেইসব প্রপার্টি দেওয়া হয়েছে, যেগুলোতে নিজেরা কব্জা করতে পারেনি। দুই মালিকানায় ঝুলে রয়েছে। বক্র হেসে মনে মনে স্বগোতক্তি করলো রাশা,

–চালাক বড়বাবা! আপনি এখনও রাশাকে চেনেননি। দিলওয়ারা জামান চৌধুরীর শরীরে আপনার জিনও আছে। ভুলে কেনো যান বারবার!

দুপুরের আগেই রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ায় দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরপরই পুরো এক ট্রাক ভর্তি জিনিস নিয়ে বাড়ি ছাড়লো তারা। গাড়িতে বসার পর উষির গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

–আমাদের এতো অপমান না করলেও পারতে রাশা।

রাশার কপাল কুঁচকে গেলো,

–অপমান! কিসের অপমান করলাম?

–তোমাকে প্রপার্টি দাবী করতে কে বলেছে? আমরা কি কিছু চেয়েছিলাম? বাবা মা জানলে কতটা কষ্ট পাবে সেটা একবার ভেবেছো?

উষির রুষ্ঠ কণ্ঠে বললো। রাশা যেমন বিষ্মিত হলো তেমনই রেগেও গেলো,

–এক্সকিউজ মি মিস্টার উষির, তোমাদের জন্য প্রপার্টি নিয়েছি সেটা কে বলেছে? এটা আমার প্রপার্টি। শুধুই আমার৷

উষির দাঁতে দাঁত চেপে ধারালো স্বরে বললো,

–হ্যাঁ তোমার। আমরা তো চাইনি। তাহলে আমাদের নাম কেনো যুক্ত হলো?

–ট্রাস্ট মি, যেভাবে যুক্ত হয়েছে সেভাবে চলেও যাবে।

রাশা তাকে আস্বস্ত করে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো৷ উষির কিছুই বললো না। চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর নিরবতা ভেঙে বললো,

–তুমি হংকং ছিলে?

রাশা চোখ বুজে বড় করে শ্বাস ফেললো। রাত্রে উষির যে ডাইরি দেখেছিলো সেটা হংকং স্কুলের ডাইরি ছিলো। সেটা দেখার পর এমন প্রশ্ন যে করবে তা সে আন্দাজ করেছিলো। তাই অবাক না হয়ে ছোট করে উত্তর দিলো,

–হুম।

–পড়াশোনা?

–সব ওখানেই কমপ্লিট করেছিলাম।

–তাহলে এখানে চলে আসলে যে?

প্রশ্নটা তার জন্য অনেক কঠিন ছিলো। তাকে ল পড়ানোর ইচ্ছে তার বাবার ছিলো না। কিন্তু সে ল-তে ভর্তি হয়েছিলো। তার বাবা অত্যান্ত রেগে খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। রাশা ছোট একটা চাকরি নিয়ে খরচ চালানো শুরু করলে তার বাবা আরো রেগে ক্ষমতা খাটিয়ে বাংলাদেশের একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে তাকে ট্রান্সফার করিয়ে দেয়। যতক্ষণে সে জানতে পারে ততক্ষনে আর কিছুই করার ছিলো না। সেসব কথা বাইরের কারো সামনে প্রকাশ করতে চায় না। উষির তার কাছে এখনও বাইরের মানুষই৷ তাই সেটা প্রকাশ না করে মিথ্যা বললো,

–এমনিতেই, থাকতে ইচ্ছে হলো না। তাই ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড সেমিস্টারেই ট্রান্সফার হয়ে চলে এসেছিলাম।

উষির মৃদু হাসলো। রাশা মিথ্যে বলছে তা ওর ব্যথাতুর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ তাই আর সেটা নিয়ে কথা বাড়ালো না। কথা ঘুরিয়ে বললো,

–তোমার ফ্যামিলি তো খুব রেস্ট্রিকটেড। মেয়েকে এতোদূর যেতে দিলো?

রাশা মলিন হেসে বললো,

–মেজো বাবার খুব নেওটা ছিলাম। মেজো বাবাও আমার সব কথা মানতো৷ প্রাইমারি লেভেল শেষ করে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর দেখি ভাইয়ারা সবাই পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে। তাই দেখে আমারও শখ জেগেছিলো। তাই আমিও জেদ ধরেছিলাম। মেজো বাবা জেদ পূরণ করে নিজ দ্বায়িত্বে আমাকে হংকং নিয়ে গেলো। সেখানে এক বছর আমার সাথে থেকে আমাকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বোর্ডিং স্কুলে রেখে ফিরে এসেছিলো।

রাশা এবারেও মিথ্যা বললো। রাশা জেদ ধরেছিলো সত্যি তবে সেটা হংকং যাওয়ার না, হংকং থাকার। ঘটনাটা ওর প্রাইমারি স্কুল শেষেরই ছিলো। ওর মা তখন পঞ্চম সন্তান জন্ম দিয়েছিলো। তাদের চার বোনের এক ভাই ছিলো সে। দূর্ভাগ্যবশতঃ জন্মের পনেরো দিনের মাথায় শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মা’রা যায়৷ শোকের ছায়ায় কেউ বুঝতেই পারেনি সদ্য সন্তান হারা মা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের স্বীকার হয়ে পরেছে। অন্য সকল ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক মাস এই রোগের স্থায়িত্বকাল থাকলেও রাশার মায়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ছিলো। পঞ্চম শিশুর জন্ম তার শরীরকে এমনিতেই অনেক দুর্বল করে ফেলেছিলো তার উপর শিশুর মৃ’ত্যু মায়ের মনে খুব খারাপ প্রভাব ফেলেছিলো। চার মেয়েদের বয়স প্রায় কাছাকাছি হলেও মায়ের বেশি কাছাকাছি ছিলো ছোট মেয়ে রাশা। মায়ের শারীরিক ও মানুষিক অবনতি ছোট রাশা বুঝতে পারেনি। বারবার শুধু মায়ের কাছে যেতে চেয়েছে আর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে এসেছে। মাঝে মাঝে মা নিজেই ডাকতো, তারপর কি যে হয়ে যেতো, হাতের কাছে যাই থাকতো তাই দিয়ে তাকে আঘাত করতো। শেষবারের আঘাত চূড়ান্ত ছিলো। রাশাকে কোলে তুলে দোতলার বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিলো। ভাগ্য ভালো থাকায় সোফার উপর পরেছিলো৷ এর জন্যেই বোধহয় মাথায় তেমন আঘাত লাগেনি৷ তবে মাথায় তেমন আঘাত না লাগলেও বেকায়দায় পরে হাত আর পায়ের হাড় ভেঙে যায়। পায়ের আর হাতের হার ভেঙে যাওয়ায় বেশ কয়েকদিন হসপিটালে অ্যাডমিট থাকতে হয়েছিলো৷ এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে হংকং নিয়ে যাওয়া হয়৷ তার মেজো বাবা ছাড়া বাকিদের এতো ফাঁকা সময় ছিলো না। স্পষ্ট করে সেটা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। যার ফলে তিনি বাধ্য হয়ে সেখানে ছিলেন। তবে তার লাভ হয়েছিলো প্রচুর। রাশা যতদিন ওখানে ছিলো ততদিন তিনি সেখানে নিজের আর্টের পসার জমিয়ে ফেলেছিলেন। সুস্থ হওয়ার পরেও যখন রাশা মায়ের ভয়ে ফিরতে চাইলো না তখন নিজের লাভের কারনেই তিনি বাড়ির সবাইকে রাজী করিয়ে সেখানেই তাকে ভর্তি করে দেয়। না বাড়ির সকলের রাশার উপর টান ছিলো আর না রাশার বাড়ির সকলের উপর টান ছিলো৷ তার মা-ও সুস্থ হয়ে ওঠার পর অসুস্থ থাকাকালীন করা সমস্থ ঘটনা ভুলে গেলো। এতোদিনের সাধনা করে পাওয়া ছেলে সন্তানের শোকের কাছে ছোট মেয়ের শোক ফিকে পরে হারিয়ে গেলো। তার মেয়ের সাথে কি হয়েছিলো, কেনো সে এভাবে দেশের বাইরে পরে রইলো তার কিছুই জানার আগ্রহ তার ছিলো না আর জানলোও না। অন্যদিকে রাশার মেজো বাবার কাজ শেষ হলে তার উড়ুউড়ু মন সেখানে আর থাকতে চাইলো না। বিলাসবহুল বাড়ির বিলাসিতা ভুলে তিনি ফিরে এলেন আর রাশাকে রেখে আসলেন বোর্ডিং স্কুলে।
উষিরের কাছ থেকে তার জীবনের এতো বড় ঘটনাটাও গোপন করে গেলো রাশা। যেটা বললো তার প্রেক্ষিতেই উষির হেসে বললো,

–তোমার মেজো বাবা তো তাহলে তোমাকে খুব ভালোবাসে।

রাশা বিদ্রুপ হাসি হাসলো৷ পরিবারের সকলের স্বার্থপরতা আর অভিনয়ের ভালোবাসা দেখতে দেখতে ভালবাসার উপর থেকে তার বিশ্বাস উঠে গেছে। মেজো বাবার থেকে দূরে থাকতে থাকতে তার স্বার্থের ভালোবাসাও বুঝে ফেলেছে। স্বার্থ ছাড়া যে মানুষ আর কিছুই বোঝে না সেটা সে জানে এবং মানে। এইযে উষির আর তার পরিবারের এতো কেয়ার, সেসব নিশ্চয় এমনি এমনি না। যেভাবে তাদের বিয়েটা হয়েছে সেভাবে এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। সম্পত্তির জন্য স্ত্রীকে বিয়ে করে সম্পত্তি হাতিয়ে স্ত্রীকে খুন করার বহু কেস সে স্টাডি করেছে৷ সেইজন্যই বিয়ের পরপরই তার গহনা সব ডোনেট করে দিয়েছে৷ এখন শুধু প্রপার্টি আছে৷ এই প্রপার্টি যখন নাই হয়ে যাবে তখন তার সাথেও নিশ্চয় এমনই করতে চাইবে। তবে সে সেটা হতে দেবে না। আগে থেকে সতর্ক হয়ে থাকবে।

শহরে ঢুকতে ঢুকতেই ঝুম বৃষ্টি থেমে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরতে লাগলো। বাড়ি পৌঁছাতে আরো দুই আড়াই ঘন্টা লাগবে। কিন্তু মাঝরাস্তায় রাশা গাড়ি থামিয়ে নেমে পরলো। উষিরও নেমে বিচলিত হয়ে বললো,

–কি হলো?

রাশা কোমড়ে হাত হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,

–এখানে তোমার চ্যালারা নেই?

–মানে?

–ছবি তুলতে হবে। সবাইকে দ্রুত আসতে বলো।

আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা উষিরের লোকবলের আসতে ঘন্টা দুয়েকের মত সময় লাগলো। ততক্ষণে চারিপাশ রাতের আঁধারে ঢেকে পরেছে। উষির আর রাশা তখন একটা দাতব্য সংস্থার ভেতর বসে আছে৷ সবাই চলে আসার পর রাশা তার কার্যক্রম শুরু করলো। উষির আর তার হাত দিয়ে বাড়ি থেকে আনা বই ছাড়া বাকি সব জিনিসপত্র একটা বড় দাতব্য সংস্থাতে দান করে দিলো। ঘটাঘট ছবিও উঠলো আর মূহুর্তে ভাইরালও হয়ে গেলো সেটা। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসার ঝড় উঠলো। উষিরের পেজের ফলোয়ার হুহু করে বাড়তে লাগলো। রাশা উষিরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললো,

–শ্বশুরবাড়ির জিনিসের ফায়দা এভাবেই নিতে হয় বুঝেছো?

উষির ক্লান্ত স্বরে বললো,

–এসব কেনো করছো রাশা? কি লাভ এতে? শুধু শুধু তোমার বড় বাবাকে রাগীয়ে দেওয়া।

রাশা চোখ ছোট ছোট করে কোমড়ে হাত রেখে বললো,

–একেই বলে, যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! শোনো, আনলিমিটেড আম খাচ্ছো খাও। কোথাকার আম সেটা জেনে কি লাভ? মজা যেটা আছে সেটাতে ইঞ্জয় করো। মজা পাবে।

উষির আফসোসে মাথা নাড়লো। এমন বউ ঘরে ঘরে থাকলে তো সব বাড়ির কপাল খুলে যাবে কিন্তু এমন মেয়ে সে ঘরে থাকবে সেই ঘরের সর্বনাশ কেউ আটকাতে পারবে না।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৪

উষিরের গু’লি লেগেছে কথাটা শুনেই রাশার হাত কেঁপে উঠলো৷ দাঁড়িয়ে থাকা দুস্কর হয়ে পরায় চেয়ারে বসেও পরলো৷ হার্টবিট খুব জোরে জোরে বাজছে। যে হাতে মোবাইল ধরেছিলো সেই হাত তো ঢিলা হয়েছেই, যে হাতে কাগজ ধরা ছিলো সেটাও আলগা হলো৷ কাগজটা ছিলো তার ভিসা অ্যাপ্রুভালের। মাত্রই সুবোধ বাবুর অফিস থেকে প্রিন্ট আউট করেছে৷ পড়ে দেখারও সুযোগ হয়নি, তার আগেই বাড়ি থেকে কল দিয়ে বলছে, উষিরের গু’লি লেগেছে। কোন এক আলোচনা সভায় গন্ডগোলের জের ধরে গো’লাগু’লি হয় আর সেখানেই তার গু’লি লাগে। টেবিলের উপর থেকে গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। তারপর কাগজ আর ফোন ব্যাগে তুলে সুবোধ বাবুকে না বলেই বেড়িয়ে পরলো। রাস্তায় আসতে আসতে নিজেকে আরো খানিকটা ধাতস্থ করলো। টিভি নিউজ, সোশ্যালমিডিয়াসহ সব জায়গায় বি’স্ফো’রণের মতো খবরটা ছড়িয়ে পরেছে। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ মিছিলের জন্য রাস্তায় জ্যামও হয়ে গেলো৷ রাশার কেমন একটা খটকা লাগলো৷ প্রায় জায়গায়ই “কে গু”লি করেছে” এর জায়গায় “বিরোধীদলের লোক গুলি করেছে” বলেই দেখাচ্ছে। সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনো দলের লোককে যেই জখম করুক, দোষ বিরোধীদলেরই হয়। তবুও রাশার মনে কেমন খটকা লাগছিলো৷ হসপিটালের সামনে পুলিশের গাড়ি দেখে মন কেমন আনচান করে উঠলো৷ দুশ্চিন্তাগুলো মনের মাঝে তিরতিরিয়ে উঠলো। শুধু মনে হতে লাগলো, বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে গেলো না তো! এই দুশ্চিন্তায় মনের মাঝে থাকা খটকা আড়াল হলো তবে সেটা সম্পূর্ণ দমে গেলো না।

হসপিটালের করিডরে দলের লোকে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে৷ এরমাঝে বাড়ির লোক তেমন দেখা যাচ্ছে না। রাশা খানিক সময়ের জন্য বিভ্রান্ত হলেও উষির কোন কেবিনে আছে, তা লোকগুলোর চলাফেরা দেখে আন্দাজ করে কেবিনে ঢুকলো আর পেয়েও গেলো।
অসারের তর্জন গর্জন সার বাগধারাটি উষিরের গুলি লাগার ঘটনার সাথে খুব ভালো যাচ্ছে। তার তেমন কিছুই হয়নি। গু’লির ব্যান্ডেজ বলতে পেশিবহুল বাহুতে শুধু একটা ফার্স্টএইড ব্যান্ডেজ লাগানো৷ ব্যাস! এতেই পুরো দেশ তোলপাড় হয়ে গেছে আর হসপিটালের করিডোর লোকে লোকারণ্য হয়ে পরেছে!
পুরো কেবিন আত্মীয়স্বজনে ভর্তি৷ বাড়ি থেকে সবাই এসেছে৷ আবার নোঙরের বাড়ি থেকেও সবাই এসেছে৷ উষিরের মামা বাড়ি থেকেও তারা আসতে চেয়েছিলো কিন্তু শহরের গরম গরম পরিবেশ আর উষিরের অল্প ইঞ্জুরির কথা শুনে প্ল্যান ক্যান্সেল করে দিয়েছে। তারা শুধু ফোনে যোগাযোগ করছে। মাহফুজা আর শাহিদা উষিরের পাশে বসে এখনও কান্নাকাটি করছে। আর রোগী তাদের শান্ত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বেডে হেলান দিয়ে কপালে হাত রেখে বসে আছে৷ রাশা এসে থেকে সবার এতো কাহিনী দেখে একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো৷ তার কপালে চিন্তার ভাজ। হসপিটাল অথোরিটি এতো মানুষকে হসপিটালে অ্যালাও করলো কিভাবে! আর ডক্টরই বা রোগীর রুমে এতো মানুষ একসাথে থাকতে দিলো কেনো!

কিছুক্ষণ পর সেখানে উজান উপস্থিত হলো। নোঙর রাশার মতোই এক কোনে দাঁড়িয়ে ছিলো। উজানকে একপলক দেখে অভিমানে চোখ ফিরিয়ে নিলো। উজানও তার দিকে তাকিয়েছিলো। তার চোখ ফেরানো দেখে কপাল কুঁচকে রাগের এই কারন খুঁজলো। নোঙর সাধারণ একদিনের রাগ আরেকদিন পুষে রাখে না৷ এই কয়েকদিনে এমনটাই তো সে দেখে এসেছে। সকালে রাগ করলে, সেই রাগ বিকাল পর্যন্ত আসে না আর বিকালে রাগ করলে পরেরদিন সব ঠিক। যদিও প্রতিদিনই কোন না কোন কারনে রাগ করতেই থাকে তবুও সেটা ক্ষনস্থায়ীই হয়৷ গতকাল সরকারি ছুটি ছিলো আর আজ অফিসিয়াল ছুটি৷ সেই দুই দিন আগের রাগ এই দুইদিনেও মেটেনি, এটা বিশ্বাস করতে একটু কষ্টই হচ্ছে। উজান এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আর সময় নষ্ট করতে চাইলো না। সবাইকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়া এখন তার দ্বায়িত্বের মধ্যে পরেছে। সেটাই করলো।
কেবিন থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় নোঙর উজানের পাশ ঘেঁষে নিরবে মাথা নিচু করে চলে গেলো। মুখ দেখে রাগ রাগ মনে হচ্ছে না। তার চাপা অভিমান বোঝার সাধ্য উজানের নেই। বুঝতে পারলোও না। শুধু কপাল কুঁচকে একবার চিন্তা করলো, নোঙরের ব্যবহার রাগের ছিলো নাকি ইচ্ছে করে তাকে এড়িয়ে গেলো! চিন্তার দৌড় এই পর্যন্তই ছিলো৷ ওখান থেকে সবাইকে নিয়ে হসপিটালের বাইরে এসে দেখলো, নোঙর আগেই গাড়িতে উঠে বসে আছে। আত্মীয়তার খাতিরে এগিয়ে এসে শ্বশুরবাড়ি আর মামার বাড়ির লোকের সাথে কথা বলার ফাঁকে একবার জানালার গ্লাস দিয়ে ভেতরে তাকিয়েছিলো৷ নোঙর থমথমে মুখে মাথা নিচু করে বসে আছে। নীরব, নিস্প্রভ ভঙ্গি তার। একসময় উজানের চরম বিরক্ত লাগলো৷ নোঙরের এই ব্যবহার-আচার একেকসময় বিরক্তির উর্ধ্বে চলে যায়। তার বাড়িতে এতো বড় একটা ক্রাইসিস গেলো আর ইনি এখন ড্রামা করতে ব্যস্ত! কাল আসুক অফিসে৷ তখন ভালোমতো ক্লাস নেওয়া যাবে।

সবাই চলে যাওয়ায় তাদের সাথে রাশাও চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু উষির তাকে দেখে ফেলায় আর যেতে পারেনি। তাই সবাই চলে যাওয়ার পর রাশা গিয়ে বেডের পাশের টুলে বসলো। উষির নিজে শহরের বড় প্রাইভেট হসপিটালের এসিরুমের কেবিনে বসে আড়াম করছে। আর তারজন্য সাধারণ মানুষ রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল করছে। রাশার খুব হাসি পেলো। এই হাসিটা আসলে কিসের জন্য লাগছে সেটা বড়ই রহস্যময়। তাচ্ছিল্যভরা এই হাসি আসলে কিসের জন্য? উষিরের ব্যবহারে, সাধারণ মানুষের বোকামিতে নাকি নিজের ভাগ্যে! ভাগ্য হবে হয়তো৷ যে ভাগ্য থেকে পালাতে সৌরভের মতো ছেলেকে জীবন থেকে তাড়ালো, সেই ভাগ্যের কবরেই আজ সে সায়িত!

রাশা বসতেই উষির তার হাত টেনে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁট ছুইয়ে বললো,

–আমি তো আরো ভাবলাম, তুমি আসবেই না।

রাশা হাত টেনে নিতে চাইলে শক্ত করে ধরলো উষির৷ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের শক্ত করে ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে তেছড়া ভাবে বললো,

–কেনো? তোমার সাথে কি আমার কোন শত্রুতা আছে নাকি যে আসবো না?

উষির ক্লান্ত স্বরে বললো,

–তুমি এমন ত্যাড়া কথা বলো কেনো বলোতো? একটু সুন্দর করে কথা বললে কি হয়?

রাশা উত্তর দিলো না। তার দৃষ্টি উষিরের ছোট ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজের দিকে। স্থীর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপ করে দেখে এক টানে সেটা তুলে ফেললো। উষির ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো৷ রাশা একনজর আঘাতের দিকে তাকিয়ে তারপর ব্যান্ডেজের দিকে তাকালো। ব্যান্ডেজ হাতে তাচ্ছিল্যভরা সুরে বললো,

–এই সামান্য আঁচরে ব্যান্ডেজ! নাইস ওয়ার্ক!

উষির একবার হাতের কাঁটা জায়গায় দেখে আঙুল দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরলো। টান দিয়ে তোলায় সামান্য র’ক্ত গড়িয়ে পরছিলো। রাশা ব্যান্ডেজ মুড়ে ঝুড়ির দিকে ঢিল দিলো। পরলো না অবশ্য। নিশানা সামান্য বাঁকা হয়ে দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেলো। সেদিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বললো,

–কিভাবে করলে এটা?

উষির কাঁটা জায়গায় আঙুল চেপে হেসে ফেললো। তারপর টিস্যুর সাহায্যে রক্ত মাখা আঙুল পরিষ্কার করে বললো,

–এগুলো তো সিমপল কাজ৷ আগে থেকেই লোক সেট করা ছিলো৷ তারা ইশারায় ফাঁকা গু’লি ছুড়েছে আর পাশ থেকে একজন ধারালো ব্লে’ড দিয়ে একটু আঁচর দিয়েছে। ব্যাস!

–ধরা পরলে?

রাশা কৌতুহলী হলো। উষির মৃদু হেসে বললো,

–এতোই সোজা নাকি? আর তাছাড়া কিছুক্ষণ পর প্রেস কনফারেন্সে বলে দেওয়া হবে, আমি আউট অফ ডেঞ্জার। গু’লি পাশ ঘেঁষে বের হয়ে গেছে।

–এতো প্রোটেকশন থাকতেও এমন ঘটনা ঘটলো, এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না?

উষির সজোরে মাথা নাড়লো,

–উহু! কেউ এসব চিন্তাই করবে না। এটাকে মাইন্ড গেম বলা হয়। বুঝেছো?

উষিরের গর্ব নিয়ে বলআ কথায় তার মধ্যে বড় বাবার ছায়া দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো রাশা৷

–মাইন্ড গেম! মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলে কি মজা পাও তোমরা? তাদের ইমোশনের কোন দাম নেই তোমাদের কাছে?

–তোমার কাছে আছে? আমার ইমোশনের দাম?

উষির আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো৷ রাশা রেগে গেলো৷ তার সামনে অসুস্থতার নাটক করে বসে থাকা মানুষটার সাধারণ মানুষের আবেগের কোন দাম নেই? এটা শুধুই একটা খেলা! এতো সস্তা সব কিছু!

–যে অন্য লোকের ইমোশন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, সে নিজের ইমোশনের দাম চাচ্ছে? সাউন্ড ইন্টারেস্টিং! তোমার হিরো হওয়া উচিত। অসাধারণ অ্যাক্টিং স্কিল। এটা কি বাই বর্ন নাকি প্র‍্যাক্টিস করে আর্ন করেছো?

উষিরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। শক্ত গলায় বললো,

–তুমি এখন যাও রাশা। এই মূহুর্তে আমার তর্ক করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

রাশা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে উষিরকে দেখলো৷ তার মনে হলো, বর্তমানে তার সামনে দ্বিতীয় হাসান চৌধুরী বসে আছে। যাকে সে মনে প্রাণে ঘৃণা করে৷ উষিরের উপরও আসলো সেই ঘৃণা, রাগ৷ কোলের উপর রাখা ব্যাগ রাগের সাথে কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত পায়ে হসপিটাল ত্যাগ করলো। উষিরকে তার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপের উত্তির্ন হওয়ার সুখবরটা জানানো হলো না৷ সিদ্ধান্ত নিলো, জানাবেই না৷ যে সম্পর্কটাই টিকবে না, সেই সম্পর্কে এতো আলগা কথাবার্তার কোন মানেই হয় না৷ কোন মানে না!

***
নোঙর নিজের বিছানায় বসে উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখছিলো। অপলা, নিহান আর অন্তু তার মন খারাপ দেখে ছোট ছোট পায়ে এসে তাকে ঘিরে ধরলো। অপলা নোঙরকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

–তোমার কি মন খারাপ আপু?

নোঙরের চোখে পানি চলে আসলো। নাক টেনে বললো,

–কিছু হয়নি।

নিহান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আলতো স্বরে বললো,

–মিথ্যা বলছিস কেন? কেউ কি কিছু বলেছে?

ড্রিম লাইটের অল্প আলোতে নোঙরের গড়িয়ে পরা চোখের পানি দেখা গেলো না। সে ক্লান্ত। ভীষণ রকমের ক্লান্ত৷ উজানের ভালোবাসায় ক্লান্ত, তার অবহেলায়ও ক্লান্ত। এই ক্লান্তের মাঝে নিজেকে সে হারিয়ে বসেছে। কয়েকদিনেই হাল ছেড়ে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে মাথা নেড়ে বললো,

–আমাদের বাড়িতে দুইটা বড় ভুল হয়ে গেছে।

অন্তু কৌতুহলী হলো,

–কে কি ভুল করেছে আপু?

–প্রথম ভুল করেছে ফুপি ফুপাকে বিয়ে করে। আর দ্বিতীয় ভুল করেছে আমাদের পরিবার। ফুপার আপারক্লাস ছেলের সাথে তাদের মিডলক্লাস মেয়ের বিয়ে দিয়ে।

নোঙর উদাস গলায় উত্তর দিলো। অপলা বিচলিত হয়ে বললো,

–এসব কি বলছো আপু? ভাইয়া কত ভালো।

–সমস্যা তো সেটাই৷ আপারক্লাস মানুষ মিডলক্লাস মানুষদের আত্মীয় হিসেবে খুব ভালো হয়। কিন্তু জীবনসঙ্গী না।

–কেনো আপু? হলে কি হয়?

অন্তু কৌতুহলি গলায় প্রশ্ন করলো। তার কৌতুহল এতো পরিমাণে হলো যে, হাতের আইসক্রিম গলে গলে পরছে কিন্তু সেদিকে তার খেয়ালও গেলো না। নোঙর বিষন্ন হেসে বললো,

–ওরা অনেক উঁচু রে। তাকাতে হয় মাথা উঁচু করে৷ এতে আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু ওরা তো সামনে তাকাতে ভালোবাসে। আমাদের জন্য ঝুঁকবে কেন?

–তা ঠিক বলেছো৷ ভাইয়া সত্যি অনেক লম্বা।

অন্তু ঠোঁট উলটে বলে আইসক্রিমে কামড় দিলো৷ নোঙর অন্তুর কথায় তার দিকে তাকিয়ে নিস্প্রান হাসলো৷ অপলা আর নিহান দুই দিক থেকে দুইজন অন্তুর পিঠে কিল বসিয়ে দিলো। ব্যথায় উহু করে উঠল সে। অপলা ধমক দিলো,

–চুপ কর তুই। আপুকে বলতে দে।

নোঙর ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর আবার উদাস হয়ে বললো,

–জীবনসঙ্গী হতে হয় সমানে সমানে। আর তাছাড়া আমাদের কিচ্ছু মিল নেই। বিয়ের আগে আমাদের অন্তত একটু সময় দিলে ব্যাপারটা এতো খারাপ হতো না হয়তো। সম্পর্ক টেকাতে এমন হুটহাট বিয়ের কোন মানে হয় বল? বড়রা যদি বাচ্চামো করে তাহলে ছোটদের তো মন ভাঙবেই তাই না?

এই কথায় নোঙরের উদাসি মন খারাপ বাকি তিনজনের মধ্যেও ছেয়ে গেলো। বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই যদি এমন মনে হয় তাহলে সারাটা জীবন তো পরেই আছে। তখন কি করবে! সেপারেশন তো সমাধান না। মানিয়ে নিয়ে চলা বলেও তো একটা কথা আছে। এই কথাটা অপলা বোনকে বলতে চাইলো কিন্তু সাহস করে উঠলো না। থাকুক কিছুক্ষণ মন খারাপ। সকালে বোঝানোর চেষ্টা করবে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে