#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩১
বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে রাশার পরিপাটি সাজগোছ দেখে বাড়ির সকলে হা হয়ে গেলো। লম্বা ঢোলাঢালা কামিজ তো সে অনেক পরেছে, তবে এমন পরিপাটি ওড়না কোনকালেই নেয়নি। আজকে মাথায় খুব ভালো করে ঘোমটা টেনে একেবারে নতুন বউ সেজেছে৷ দুই হাতে দুইটা চিকন বালা পরতেও ভোলেনি৷ গলায় আর কানেও গহনা। তার সাজগোছ দেখে ময়না বিষ্ময়ে বলেই বসলো,
–ভাবি, তুমি বাপের বাড়িই যাবা তো?
রাশা উত্তর না দিয়ে থমথমে মুখে গাড়িতে গিয়ে বসলো৷ বড় লাগেজের পরিবর্তে ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে বসলো উজান৷ আর তারপরই বরাবরের মতোই রাশার হাত নিজের হাতের মাঝে আটকে নিলো। গাড়ি তো ড্রাইভার চালাচ্ছে। এখান বউয়ের সাথে সময় কাঁটানো ছাড়া তার আর কি কাজই বা আছে!
রাস্তায় উষির হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু বলছিলো৷ তক্ষুনি রাশার সম্পূর্ণ মনোযোগ তার ঘড়ির দিকে পরলো৷ আর সাথে সাথেই তীক্ষ্ণ চোখে স্ক্যান করে সন্দেহী গলায় প্রশ্ন করলো,
–তোমার ঘড়িতে কি লেগে আছে?
উষির একনজর রাশার বলা জায়গাটা দেখে ঘড়ি খুলে প্যান্টের পকেটে রাখতে রাখতে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
–র’ক্ত।
এই ঘড়িটা সেই ঘড়িই৷ লোকটাকে মারার সব চিহ্ন মিটিয়ে ফেললেও ঘড়িতে চিহ্ন লেগেই আছে। এইজন্যই বোধহয় বলে, অপরাধ তার প্রমান রেখে যায়। উষির যত স্বাভাবিক স্বরে কথাটা বললো, রাশা ততটাই বিচলিত হলো। তার আঘাত লাগলো নাকি সেটা সব থেকে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো।
–রক্ত! তোমার কোথাও লেগেছে নাকি?
উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷ রাশার তাকে নিয়ে এই বিচলিত ভাব অন্য কোনসময় হলে তার খুব ভালো লাগতো৷ কিন্তু এখন লাগছে না। মনটা বিষন্ন হয়ে রইলো। চোখ মুদে রাশার কাঁধে মাথা রেখে বললো,
–একজন অ্যা’ক্সিডে’ন্ট করেছিলো৷ তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো কোনভাবে লেগে গেছে।
–তোমার টিম এটা নিউজ করেনি কেনো? উষির কখন ঘুম থেকে উঠলো, কি খেলো, কি পরলো, এখন কোথায়, সবই তো নিউজ করে। তাহলে এতো বড় একটা ঘটনা সম্পর্কে কিছু বললো না! ইন্টারেস্টিং!
উষির কিছু বললো না। রাশার মজাটা তার কাছে তাচ্ছিল্য করা মনে হলো৷ চোখ জোর করে বন্ধ করে ঘুমানোর ভাণ ধরলো। এই প্রশ্নের থেকে রেহাই পাওয়ার এই একটা উপায়ই তার জানা আছে।
***
নোঙরের দ্বিতীয় টাস্ক অ্যাকাউন্টেন্স সম্পর্কিত ছিলো। ফাইল দেখেই তার মাথা ঘুরে উঠলো। উজানের সামনে বসে নিরীহ গলায় বললো,
–আমার গ্র্যাজুয়েট বিএ নিয়ে, বিবিএ নিয়ে না। এসব পারবো কিভাবে?
সামনে বসা মেয়েটির সামনে কিছু বলে কোন লাভ নেই, সেটা তার জানা আছে৷ তাই কিছু না বলে চুপচাপ ফাইলগুলো ফেরত নিলো৷ এরপর নোঙর নিশ্চিন্তে নিজের ডেস্কে ফেরত গেলো। ভাবলো, তার কাজ আপাতত শেষ।
বড় যে প্রজেক্টটা হাতে এসেছে, তার একটা শ্যুট ছিলো আজকে। শ্যুট সাধারণ অন্য একজনই করে তবে যে যে প্ল্যান উজানের করা থাকে, সেই সেই শ্যুটের দ্বায়িত্ব সেই নেয়। আজকের শ্যুটের প্ল্যান উজানের করা। সুতরাং সময় বাঁচাতে শহরের বাইরে যে আউটডোর শ্যুট হওয়ার কথা সেটা অফিসের কাছাকাছিই একটা ফাঁকা খোলা জায়গায় করা হবে। এখন সেখানে সেটারই সেটাপ করা হচ্ছে।
অফিসে নোঙরকে একা রাখার ভরসা উজানের নেই। তাই মিস পাখির সেক্রেটারি করেই তাকে রাখা হলো৷ আর এই মিস পাখিরই তো তার উপর ভয়ংকর রাগ আছে। রাগ ঝাড়লোও আচ্ছামতো। কথায় কথায় ঝাড়ি দেওয়া, তার মাঝে অন্যতম। এই কান্ডে মডেল পাখির উপর নোঙরের যতটা না রাগ হলো, তার থেকে দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি অভিমান হলো উজানের উপর।
ভীষণ রোদ ছিলো। রোদের তেজে তাকানো মুশকিল। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে একবার সুর্যের দিকে তাকালো নোঙর। তারপর হাতের আড়ালে চোখ রেখেই চোখ ছোট ছোট করে আরেক হাতে পানির বোতল আর ছোট একটা ব্রুজ ধরে শুটিংয়ের দিকে নজর দিলো। ব্রুজটা ড্রেসের সাথে খুবই দরকারী। বলা চলে, ড্রেসের মেইন আকর্ষণই সেটা। মডেল পাখি মেকাপ করার বাহানায় সেটা খুলে নোঙরের হাতে রেখে দিয়েছে। উজান বড় ছাতার নিচে চেয়ারে বসে শুটিংয়ের ডিরেকশন দিচ্ছিলো। নোঙরকে তীব্র রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছাতার নিচে বসতে বলার জন্য একজনকে পাঠালো। নোঙর ঝাঁঝালো কণ্ঠে নাকচ করে দিলো। উজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে একপলক জেদি নোঙরের দিকে তাকিয়ে উঠে পরলো। সাথে সাথেই আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা গার্ড সমবেত হয়ে তার পেছনে এসে দাঁড়ালো। উজান তপ্ত শ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে ছোট করে বললো,
–ছাতা?
সাথে সাথেই একজন গার্ড ছুটে গিয়ে ছাতা এনে তার হাতে দিলো। উজান ইশারায় গার্ডদের সেখানে থাকতে বলে ছাতা ফুটিয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে নোঙরের পাশে এসে দাঁড়ালো। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেখানেই তার মাথায় ছাতা ধরে শুটিংয়ের ডিরেকশন দিতে লাগলো। নোঙর কিছু বললো না৷ তার মন এখন অভিমানে পরিপূর্ণ। তাই সরে আসতে চাইলো৷ উজান শক্ত হাতে তার হাত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যাপারটা সকলেই দেখলো৷ বোন বলে আলোচনা বেশিদূর আগালো না। তার উপর দুজনেই বিবাহিত। তাদের স্যার আর যাই হোক, বিবাহবহির্ভূত কোন সম্পর্কে যে জড়াবে না সেই বিশ্বাস তাদের আছে। তবে চোখে পরলো মিস পাখির৷ শক্ত চোখে সবটা দেখলো। শ্যুটিং করার ইচ্ছেটাই তার মরে গেলো৷ কিন্তু কন্ট্যাক্ট মোতাবেক যদি অকারণ শ্যুটিং বন্ধ করে তাহলে তাকে ভারি জরিমানা দিতে হবে। যদিও তার কাছে হাজার অযুহাত আছে তবে সেগুলো উজানের কাছে টিকতে পারে না। এর আগে চেষ্টা করেছিলো দুই একবার। পরিনাম খুব একটা ভালো হয়নি৷ সামনে তার একটা সিনেমা করার কথা আছে। এই সময় কোন স্ক্যান্ডেল সে অ্যাফোর্ড করতে পারবে না। তাই চুপচাপ হজম করে নিলো।
নোঙরের হাতে ব্রুজ দেখে উজান কপাল কুঁচকে বিরক্তিকর স্বরে বললো,
–তোমার কাজ মিস পাখিকে অ্যাসিস্ট করা। তার জিনিসপত্র হাতে ধরে রাখা না। আর ব্রুজটা হাতে দিয়েছে কে? আমার কাছে দাও। হাতে থাকলে পরে যাবে।
নোঙর হাতের মুঠো শক্ত করে কঠিন স্বরে বললো,
–আমার হাত থেকে কখনও কিছু হারায় না।
উজান তাকে আর কিছুই বললো না৷ তবে বাকিদের ছাড়লো না। নোঙরকে এসব কাজ দেওয়ার জন্য একটা স্টাফকে বেশ জোরে ধমক দিলো। স্টাফটা কাচুমাচু ভঙ্গিতে বোতল আর ব্রুজ নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছিলো। নোঙর অবাক হয়ে দেখলো, তার হাতে বোতল থাকলেও ব্রুজটা নেই। সেটা নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নোঙর অস্বস্তিতে পরে গেলো। সহজ ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বললো,
–এমা! এটা এমন পিচ্ছিল কেনো? সাবধানে ধরে রাখবেন, নাহলে আপনার হাত থেকেও পরে যেতে পারে।
নিজের দোষ যে ঢাকতে চাচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। উজান নোঙরের বোকামিতে হাসি আটকে ইশারায় স্টাফকে চলে যেতে বললো৷ শ্যুটিং শুরু হলে নোঙরের খোঁজ পরলো৷ উজান দেখলো, সে নোঙরের ওড়নার উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চটজলদি সরে ওড়নার কোনা হাত দিয়ে ধরে বললো,
–তোমার ওড়নাতে তো..
ওড়নায় কাদা লেগে গেছিলো। উজান সেটা বলতেও পারলো না৷ নোঙর তার আগেই খপ করে ওড়না ধরলো,
–লজ্জা করে না তোমার? ইজ্জত লুটতে চাচ্ছো!
উজান কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো৷ তারপর কিছু না বলে ছাতা হাতেই চলে গেলো। আর নোঙর ছুটলো মডেল পাখির কাছে৷ এইমাত্র যে উজানকে অপমান করলো তার ধারণা বিন্দুমাত্র হলো না। নিজের অভিমান আর অপমান দেখতে গিয়ে সামনের জনের কথা বেমালুম ভুলে গেলো৷
মডেল পাখি স্থির দৃষ্টিতে নোঙরের পেন্ডেন্টের দিকে তাকিয়ে একসময় বলে উঠলো,
–হাউ মাচ ইজ ইয়োর স্যালারি?
ছাতার নিচে বসে মেকাপম্যান মডেল পাখির মেকাপ ঠিক করছিলো৷ নোঙর জুসের গ্লাস হাতে বিরক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো৷ তার কথায় কপাল কুঁচলে বিরক্তিকর শ্বাস ফেললো,
–অ্যাকোর্ডিং টু মাই রুল, স্যালারি কাউকে বলতে হয় না।
পাখি হাতের ইশারায় মেকাপ বন্ধ করতে বলে নোঙরের দিকে ঘুরে বসলো। পায়ের উপর পা তুলে বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে বললো,
–লেটমি গেস, টুয়েন্টি টু টুয়েন্টি ফাইভ কে। রাইট?
–আমি এখনও আমার আগের বাক্যে স্থির আছি।
নোঙরও নিজের অ্যাটিটিউড বজায় রেখে পাখির চোখে চোখ রেখে বললো। পাখি মাথা নিচু করে হালকা হাসলো৷ তারপর ঠোঁটের কোনে আঙুল রেখে ভাবুক গলায় বললো,
–ম্যারেড?
–ইয়েস।
ফুল কনফিডেন্স নিয়ে উত্তর দিলো। পাখি ভ্রু নাচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
–হাজবেন্ড কি করে?
–বিজনেস।
–ওহ! ছোটখাটো কোন গ্লোসারি স্টোর অর হকার হবে হয়তো। তোমরা তো নিজেদের অনেক বড় বড় বিজনেসম্যানদের সাথে কম্প্যায়ার করে খুব রিলিফ পাও। হোয়াট এভার! তুমি একটা শপের ওয়াইফ হয়ে আর একজন সামান্য স্টাফ হয়ে স্যাফায়ার পরছো! তাও ল্যাভেন্ডার স্যাফায়ার! আ’ম ইম্প্রেস! এতো টাকা পেলে কোথায়? চুরির জিনিস নয়তো?
ব্যাঙ্গ করে উত্তর দিলো পাখি৷ নোঙরের এই মেকাপ সুন্দরীকে আরো বেশি খারাপ মনে হলো। মনে মনে দোয়াও করলো,
–এ আজকে আবার আছাড় খাবে, আছাড় খেয়ে দাঁত পরে যাবে, নাক থেতলে যাবে, মুখের মধ্যে পোকা ঢুকবে, চোখের পাপড়িতে আঠা লেগে আটকে যাবে, আজকেই পেট খারাপ করে বাথরুমে বসে থাকবে..
এমন আরো হাজারখানেক বদদোয়া তার মনে ছিলো। সবগুলো একসাথে দিলো না। মানুষভেদে সেগুলো আলাদা আলাদা৷ এইসব বদ দোয়া নিজের পেন্ডেন্টে হাত দিয়েই করছিলো৷ বলা চলে সেটা পাখির নজর থেকে বাঁচানোর জন্যই করছিলো৷ সে তো এটাকে পাঁচ দশ হাজারের টোপাজ স্টোন ভেবেছিলো৷ এটা যে লাখ টাকার স্যাফায়ার, সেটা কে জানতো! স্যাফায়ার! সেতো অনেক দামী পাথর৷ তার থেকেও বড় কথা, তার সব সোনার গহনা এক জায়গায় আর উজানের দেওয়া এই গিফট আরেক জায়গায়৷ দুনিয়ার কোন কিছু দিয়েই এর মূল্য ধারণ করা যাবে না। আবার আরেকটা কথা মাথায় আসলো, তার নাহয় গহনার ব্যাপারে ধারণা কম। কিন্তু পাখির মতো চিল শকুন, চোরদের তো ধারণা আছে। তারা তো তাকে এই পেন্ডেন্টের জন্য কিডন্যাপ করতে পারতো। তারপর গলা কেঁ’টে…!
নোঙর মাথা নেড়ে খারাপ চিন্তা দূর করতে চাইলো৷ পাখির দিক থেকে ভয়ংকর দৃষ্টি সরিয়ে উজানের দিকে সেই দৃষ্টি দিলো। এর মনে তাহলে এই ছিলো! ম’রে গেলে তো ঝামেলা চুকে বুকে যাবে! এইজন্যই এমন চিন্তা করেছে! কি চালাক! গলার কাছে কান্নারা দলা পাকিয়ে রইলো। মনে হলো কেউ টু শব্দ করলেই সে কান্না করে দেবে। এতো জ্বালা যন্ত্রনা তার ভাগ্যেই থাকতে হলো! উজান দূর থেকে দেখে কিছই বুঝতে পারলো না। বাড়ি আসার পর গাড়ি থেকে নামার সময় নোঙর উজানের হাতে পেন্ডেন্ট গুজে দিয়ে আঙুল উঁচিয়ে তিরিক্ষি স্বরে বললো,
–নোঙর খন্দকারকে ফাঁদে ফেলা এতো সহজ না। তোমার সব চালাকি আমি ধরে ফেলেছি। সব এতো সোজা না বুঝেছো? আমি কালকেই থানায় জিডি করে রাখবো। আমি ম’রলে তোমাকে নিয়েই ম’র’বো, হুহ!
বলেই উজানকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে শরীরের সব শক্তি দিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে গটগট করে চলে গেলো।
চলবে..
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩২
রাশার বাড়িতে ঢুকলে আধুনিক যুগের রঙিন আলো ধপ করে নিভে পুরোনো আমলের সাদাকালো আলো জ্বলে ওঠে। দেখে মনে হয়, বিংশ-শতাব্দীর কোন জমিদার বাড়িতে ঢোকা হয়েছে৷ উষির সেখানে এসেছিলো এক রাত্রের জন্য। জমকালো লাইটে সাজানো বাড়িতে কাটানো সেই এক রাত্রেই তার জীবনের মোড় পালটে যায়। আজ আবার এসেছে সেই পালটানো মোড়ের জের ধরে। রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানো সে এখন অস্বস্তিতে গাট হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর আশপাশ দিয়ে নতুন নতুন মুখ চলাফেরা করছে। আসলেই কোন বাড়িতে এতোজন মানুষই থাকে! কে কে যে আছে তার হিসাব নেই। তবে বলা যায়, অর্ধেক বাড়ির সদস্য আর অর্ধেক বাড়ির কর্মচারী।
নতুন জামাই হিসেবে আপ্যায়ন জোরদার চলছে। বিশাল বড় লিভিংরুম কম হলরুমের পুরোনো ডিজাইনের সোফায় বসে আছে উষির। সামনে বসে আছে হাসান চৌধুরী, হামিদ চৌধুরী আর খলিল চৌধুরী। দুই তিনজন লম্বা মোটাসোটা বলিষ্ঠ দেহধারী তাদের পেছনে বড় লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে৷ মুখে গামা পালোয়ানের মতো গোঁফ। উষির আড়চোখে বারবার সেদিকে তাকাচ্ছিলো৷ একসময় সেখানে রাশা আসলো। হাতে ট্রে ভর্তি শরবতের গ্লাস৷ মাথায় এক হাত ঘোমটা দেওয়া। তাকে দেখে উষিরের চোখে কপালে উঠে গেলো। রাশা নিজের হাতে শরবতের গ্লাস সবার হাতে তুলে দিলো। উষির অবাক চোখে তাকিয়ে বিবাহিত জীবনে প্রথমবারের মতো স্ত্রীর হাত থেকে শরবতের গ্লাস নিলো। রাশার পেছনে আরো তিনজন কাজের মহিলা এসেছিলো। তাদের হাতের ট্রে-তেও বিভিন্নরকমের খাবার ছিলো। হাসান চৌধুরী মৃদু হেসে রাশাকে বললেন,
–রাশা মা, ওগুলোও জামাইকে দাও। বাড়িতে এখন একটাই জামাই উপস্থিত আছে। আদরের কোন কমতি রাখবে না। মনে রাখবে, স্বামীই মেয়েদের জীবন।
বেশ জ্ঞানপূর্ণ কথা। রাশা বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে মৃদু স্বরে বললো,
–জ্বি।
উষিরের মনে হলো সে ভুল শুনছে৷ এটা তার বউয়ের গলা কিছুতেই হতে পারে না। সবসময় হম্বিতম্বি করা মেয়েটা এখন একেবারে ভেজা বিড়াল হয়ে গেলো! হাউ ইজ দিস পসিবল! রাশা আবার যখন তাকে মিষ্টির প্লেট দিতে নিলো তখন দুজনের চোখে চোখ পড়ল। উষিরের চোখে বিষ্ময় ছিলো আর রাশার চোখে বিরক্ত, রাগ। তার চোখে দেখা বিরক্ত দেখে সে খুব শান্তি পেলো। এতোক্ষণ পর বউয়ের পুরোনো রুপ দেখে তার নিজের নিজের মনে হলো। রাশা খাবার সার্ভ করা শেষে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলে আবার উষির একা হয়ে পরলো। খলিল চৌধুরী নিরবতা ভেঙে কথা বললেন,
–কতবছর হলো এই প্রফেশনে আছো?
–দুই বছর।
–দুই বছরে আর কি ইনকাম করতে পারলে! এর থেকে তো ভালো বাবার বিজনেসে হাত লাগাতে। নাহলে তোমার ওই চাচাতো ভাই সব দখল করে নেবে। ভবিষ্যতে সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে।
উষিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো,
–আমাদের এভাবে মানুষ করা হয়নি। আর প্রপার্টির উপর আমার আগ্রহও নেই।
উষির বলতে চেয়েছিলো, তাহলে কি আপনিও এমন কিছু করবেন? কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বললো না। হাসান চৌধুরী কাষ্ঠ হেসে বললেন,
–নিজের প্রপার্টির লোভ নেই অথচ শ্বশুরবাড়ির প্রপার্টি থেকে নজর সরছে না।
উষিরের চোখ টেবিলে রাখা শরবতের গ্লাসের উপর ছিলো৷ গুরুজনের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয় না বলেই সে জানতো। কিন্তু এই কথায় নজর না তুলে পারলো না। বিষ্ময়ে বলে উঠলো,
–সরি বুঝতে পারিনি, কিসের প্রপার্টি?
হাসান চৌধুরী দুইটা উত্তপ্ত মানুষকে শান্ত করতে হাত তুলে নিজের ভাইকে থামালেন। তারপর বললেন,
–ওসব পরে দেখা যাবে। কিন্তু বাবা তুমি যে কাজটা করেছো সেটা কি ঠিক হয়েছে?
উষির বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো,
–কি কাজ?
–স্ত্রী হচ্ছে স্বামীর সম্মান। তাদের আড়ালে রাখা মানে নিজেদের সম্মান হেফাজতে রাখা। যেসব পলিটিশিয়ানরা নিজেদের পরিবারকে সামনে এনে ইলেকশন জিততে চায় তাদের আমি কাপুরুষ বলে মনে করি। আশা রাখি, তুমি আর রাশাকে নিয়ে সামনে আসবে না।
উষির রাগে হাত মুঠো করে ফেললো। চোয়াল শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,
–রাশা আমার স্ত্রী। আর আমার স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করতে আমি অ্যাবল।
হাসান চৌধুরী আর হামিদ চৌধুরী একে অপরের দিকে চোখাচোখি করলেন। গোপনে কোন বৈঠক হয়ে গেলো বলে মনে হলো। খলিল চৌধুরী হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর একজন কাজের লোককে ডেকে উষিরকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। হাসান চৌধুরী আর হামিদ চৌধুরীও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়াতে হলো উষিরকেও। হাসান চৌধুরী নিজের গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন,
–অনেক দূর থেকে এসেছো বাবা। ক্লান্ত নিশ্চয়? ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। বাকি কথা রাতে খাবারের পর বলা যাবে।
উষির গম্ভীরমুখে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে কাজের লোকের সাথে ঘরে গেলো।
রান্নাঘরে রাতের খাবারের প্রস্তুতি চলছিলো৷ রাশা বিরক্তিমুখে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পেয়ারা খাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর রাশার ফুপু রান্নাঘরে এসে তাকে দেখেই বলে উঠলো,
–তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে এসব কি কাপড় দিয়েছে রে রাশা? এসব জামা তো আমরা দান করি।
রাশা মুখ বেঁকিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
–তাহলে তোমার শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিও। তারা পরবে।
তিনি ফুঁসে উঠলেন,
–এতো বড় কথা তুই বলতে পারলি?
–নিজের ইউজ করা ড্রেস পাঠাতে পারো আর যে ড্রেস তুমি দান করো তা পাঠাতে পারবে না? দিস ইজ নট ফেয়ার ফুপু!
রাশার ফুপুর নাম আঞ্জুয়ারা। রাশার থেকে খুব বেশি বড় নয় ৷ বড়জোর বছর দশেকের বড়। তবে তাদের বাড়ির নীতি মেনে তিনি বাড়ির কোন মেয়েকেই দেখতে পারেন না। বিশেষ করে রাশাকে তো একদমই না। এতোদিন পর তাকে দেখে কিসের ক্ষোভ ঝাড়বে বুঝতে না পেরে ড্রেস নিয়েই বলে উঠলো। তবে রাশার প্রতি-উত্তরে চিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
–শোন রাশা, অতো দেমাগ ভালো না। তোর যে কান্ডে বিয়ে হয়েছে না, ওমন কান্ডে আমার বিয়ে হলে দ্বিতীয়বার এ বাড়ি মুখ দেখাতাম না।
রাশা টিটকারি দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
–সেইজন্য বোধহয় শ্বশুরবাড়িতে যাও-ই না, তাই না?
মূহুর্তকালের জন্য থমকালো সে। তারপর তাচ্ছিল্যভরে হেসে বললো,
–শোন, অন্তত আমার বরের চরিত্র ভালো আছে। কারো ঘরে ঢুকে ধরা তো পরেনি।
রাশা ফিক করে হেসে দিয়ে বুকে হাত রেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,
–হায় ফুপু! কি কথা মনে করে দিলে! আমি প্রে করি, তেমনটা তোমার জীবনে কখনও না হোক। তুমি যেমন ফুলের মতো চরিত্রের অধিকারী, ফুপাও যেনো তেমনই ফুলের মতো চরিত্রেরই হয়৷
রাশার ফুপুর অতীতে পালিয়ে যাওয়ার একটা রেকর্ড আছে৷ ছয় দিন পর বয়ফ্রেন্ডসহ ধরে এনেছিলো। সেই ছেলেটির জীবন সেখানে সমাপ্ত হলেও তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তিনি ভাবলেন, তাকে সেটা নিয়েই কথা শুনানো হচ্ছে। আরো বেশি রেগে কিছু বলতে চাইলেই রাশার বড় মা ধমক দিয়ে উঠলেন,
–আহ! এসব কি হচ্ছে? আঞ্জু, তুমি কি বাচ্চা? আর রাশা, ফুপুর সাথে কেউ এসব কথা বলে? ক্ষমা চাও?
রাশা হাসি আটকে আবার বেশ নাটকীয় সুরে বললো,
–আ’ম সো সরি ফুপু৷ দোয়া করি, আমার মধুনিঃসৃত বানী তোমাকে আর শুনতে না হোক। আমিন বলো?
আঞ্জুমান মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলো,
–তোর এই দেমাগ একদিন এমন ভাবে ভাঙবে যে আর উঠে দাঁড়াতে পারবি না।
–সেম হেয়ার।
বিড়বিড় করে বলেছিলো রাশা৷ তবে ফুপু নিজের কথা শেষ করে চলে যাওয়ায় কথাটা শুনতে পায়নি। ফুপুর যাওয়ার দিক থেকে নজর সরিয়ে সোজা হলো৷ তারপর কিছুটা চিন্তিত স্বরে বললো,
–মেজো বাবা কোথায়?
তার উত্তর দিলো ছোট মা,
–জানি না। দুইদিন আগেই বাড়ি ছেড়েছে। বলে তো আর যায় না।
রাশার তাকে খুব দরকার ছিলো। আফসার সাহেবের সাথে গভীর বন্ধুত্ব করার কারণটা জানার খুব ইচ্ছে তার। তার জানামতে, স্বার্থ ছাড়া এরা কোন কাজ করে না। এই স্বার্থ শুধু সেই রিসোর্টই ছিলো নাকি অন্য কিছু তা জানা খুব দরকার।
–তুই নাকি সম্পত্তি চাচ্ছিস?
ছোট মায়ের কথায় চিন্তার জাল ছিন্ন হলো। এতোক্ষণ নিরব থাকা তার বড় বোন এবারে কথা বলে উঠলো,
–সম্পত্তি? কিসের সম্পত্তি?
রাশা বিরক্ত হলো। এতোক্ষণ তার লাভের কথা হচ্ছিলো না জন্য নিরবে শুধু শুনেই গেছে৷ আর যখনই সম্পত্তির কথা উঠেছে তখনই মুখে বুলি ফুটেছে। এরা যে কবে এসব থেকে বেড়িয়ে আসবে!
–আমার ভাগের সম্পত্তি।
রাশার বড়বোন প্রায় চিৎকার করে উঠলো,
–মেজোর সাথে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটনোর পরেও ওকে সম্পত্তি দেবে? শুধুমাত্র ওর জন্য মেজোকে এখানে আসতে দেয় না। উঠতে বসতে কথা শুনায়। তারপরও এসব চিন্তা করছো! একে তো ত্যাজ্য করার পরেও ওকে বাড়িতে এনেছো, তারপর আবার প্রপার্টি দেবে? ওকে যদি দাও তাহলে আমাকেও দিতে হবে। এক চুলও ছাড়বো না।
তার চিৎকারে এতোক্ষণ ধরে মাথা নিচু করে কাজ করতে থাকা কাজের মেয়েরা চমকে উঠে মাথা তুলে তাকে দেখলো। তারপর আবার নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। রাশার ফুপু আবার কি কারণে ফেরত এসেছিলো। প্রপার্টি ভাগের কথা উঠতেই সেও বলে উঠলো,
–আর আমি কি পানিতে ভেসে এসেছি নাকি? একমাত্র বোন আমি। আমার ভাগ তো আরো বেশি।
এসে গেছে আরেকজন! একজন কি কমতি পরেছিলো নাকি! বিরক্ত ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে মাথায় ওড়না টেনে রাশা বললো,
–তোমাদের এই কামড়াকামড়ি আমি খুব মিস করবো, সত্যি!
বলেই বাইরে যাওয়ার জন্য পা ফেললেও কোন কারণে দাঁড়িয়ে পরলো। তারপর ছোট মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–দিয়া কোথা ছোট মা?
–বাড়ি নেই। নানাবাড়ি গেছে।
–শাহরিয়ার ভাই, সুলতান ভাই এরা নেই? বাকিদেরও তো দেখছি না।
–না, কেউ নেই।
রাশা তাচ্ছিল্যভরে হাসলো,
–মানে সবাইকে সরিয়ে তারপর আমাকে এনেছো?
–স্বাভাবিক। তোমার ছায়া ওদের উপর পরলে ওদের বিয়েও তোমার মতো করেই হবে। তাই দূরে দূরে থাকাই ভালো।
রাশা উত্তেজিত হয়ে বললো,
–তোমাদের ভদ্র বিয়েতেই বা কি সুখ পেলে? বড় দুলাভাই তো আরেকটা বিয়ে করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে। উঠতে বসতে আরেকটা বিয়ে করার ভয় দেখায়। কারন হিসেবে জানায়, পাঁচ বছরেও বাচ্চা হয়নি। এটা কোন কথা! বাচ্চা কি একজনের দোষে হয় না? আর বাচ্চা নাহলেই আরেকটা বিয়ে করতে হবে! হাউ ক্রিঞ্জ! আমি কতবার বললাম ডিভোর্সটা নিয়ে নে। কিছুতেই কানে তুলে না। এখনও বলছি তোকে, আমার পরিচিত বেস্ট ডিভোর্স ল’ইয়ার আছে। ডিভোর্সের সাথে দুলাভাইকে এমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে না! বেচারা আর…
জোরদার চড় রাশার গালে এসে পরলো। রাশা গালে হাত দিয়ে সেকেন্ডের জন্য থমকালেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। এইবাড়িতে এসব নিত্যদিনের ব্যাপার৷ সবারই মুখের থেকে হাত বেশি চলে। স্বামীরা বউকে মারে আর বড়রা ছোটদের। এই মার খু’ন পর্যন্ত যে যায়না এই অনেক!
–তোর যখন বাচ্চা হবে না তখন ওই উকিল দিয়েই ডিভোর্সটা করিয়ে নিস।
রাশার বড়বোন দাঁত কিড়মিড়িয়ে কথাটা বলেই নিজের কাজ ফেলে রান্নাঘর থেকে চলে গেলো। রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও ঘরে গেলো।
উষির রাশার ঘরে বেড ক্রাউনের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলো। হাতে ছিলো রাশার ডাইরি। নিজের রাগ থামাতে সেটা উল্টেপাল্টে দেখছিলো। রাশা এসে সর্বপ্রথম তার হাত থেকে ডাইরি ছিনিয়ে নিলো৷ তাকে দেখে উষিরের মন এতোক্ষণ পর একটু ভালো হলো। এক গাল হেসে বললো,
–ডাইরিতে সাংকেতিক ভাষায় এসব লিখে রেখেছো? সোজা ভাষায় কিছু লিখতে পারো না? শিখিয়ে দেবো?
রাশা উত্তর দিয়ে খেয়ে ফেলা নজরে তাকালো। উষির গলা খাঁকারি দিয়ে প্রসঙ্গ পালটে কৌতুহলী গলায় বললো,
–তোমার কি এমন মনে হচ্ছে না যে তুমি এখানে যেভাবে থাকো, সেভাবে অন্যরা শ্বশুরবাড়িতে থাকে।
রাশা এবারেও কিছু না বলে ঘরে থাকা বিশাল বইয়ের সেল্ফ থেকে বই নামিয়ে রাখতে লাগলো। উষির উঠে বসে বললো,
–রাগ করো না৷ কিন্তু দেখো, এখানে তুমি এক মূহুর্তের জন্যেও মাথা থেকে ঘোমটা সরাচ্ছো না আর ওখানে তুমি আমার টি-শার্ট পরে ঘোরাঘুরি করো। না, তোমার ড্রেসও পরো কিন্তু সেগুলোর সাথে এটা মানে টোটাল ডিফারেন্ট! আবার খাবার সার্ভ করছো! আমি আসলে তোমাকে সত্যিই চিনতে পারছি না। বাই এনি চান্স, তুমি কি এখানকার হাওয়া বাতাসে উলটে গেছো?
–এই বাড়ির সব মেয়েরা এভাবেই থাকে। আমি ছুটিতে যখন এখানে আসতাম তখন আমারও বাধ্য হয়ে এভাবেই থাকতে হতো। যেহেতু আমার পড়াশোনা বাইরে সেহেতু আমি নিজের মতো করেই চলাফেরা করেছি অ্যান্ড করি।
উষির হাসি আটকে গালে হাত রেখে বসে বললো,
–রাশাও বাধ্য হয় তাহলে! তুমি কি ভয় পাও? তোমার বড় বাবাকে?
রাশার হাতের বই শব্দ করে রেখে কটমট করে তাকালো৷ দরজায় কাজের মেয়ের নক পরায় রাগ গিলে তাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলো। মেয়েটি এক গাদা কার্টুন বক্স এনে ফ্লোরে রাখে চলে গেলো। রাশা সেগুলোর ভেতর নিজের জিনিসপত্র ভরতে লাগলো। তাকে একা কাজ করতে দেখে উষির হাত লাগালো৷ একসময় হাপিয়ে উঠে পুরো ঘরে নজর বুলালো। মোটামুটি পুরো ফ্লোর ভর্তি হয়ে গেছে৷ তাও অর্ধেক জিনিসও ভরা হয়নি। উষির বিষ্মিত হয়ে বললো,
–এই এতো জিনিস তোমার?
–হ্যাঁ তো ত্রিশ বছর ধরে জমানো জিনিস বলে কথা। এতো তো হবেই।
উষির চমকে উঠে রাশার দিকে তাকালো,
–ত্রিশ বছর! তোমার বয়স ত্রিশ?
রাশা কাজ ফেলে কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
–ত্রিশ! সেতো পার হয়ে এসেছি আরো আগে। আমার তো তেত্রিশ বছর বয়স!
–তেত্রিশ! তুমি তো মাত্রই ত্রিশ বললে?
–ছত্রিশ বলেছি। মন কই থাকে?
রাশা প্রায় ধমকের সুরে বললো। উষির রাশার ত্যাড়া কথা বুঝতে পেরে থমথমে মুখে চুপ করে গেলো। রাশা বুঝানোর ভঙ্গিতে বললো,
–আরে বাবা, বাইশ বছরের একটা তরুনিকে কেউ ত্রিশ বছরের মহিলা বানিয়ে দেয় নাকি?
রাশার বয়স ত্রিশ না। সেইজন্যই হয়তো গর্ব নিয়ে মহিলা বলতে পারলো। নাহলে কোন মেয়ে নিজেকে মহিলা বলে জাহির করবে, সেটা তো হতেই পারে না।
–বাইশ বছর!
উষির দাঁতে দাঁত চেপে বললো। রাশা খেঁকিয়ে উঠলো,
–কেমন মানুষ তুমি? মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করতে হয় না সেটা জানো না? আমি কি তোমার স্যালারি জিজ্ঞাসা করছি? আমি যখন রুল মেইনটেইন করছি তখন তোমারও করতে হবে। এখন বলো তোমার স্যালারি কত?
উষির থমথমে মুখে বসে রইলো। রাশা তেঁতে উঠলো,
–দেখেছো দেখেছো? নিজের স্যালারি বলতে প্রবলেম আর আমাকে বয়স জিজ্ঞাসা করছো? লজ্জা করে না?
উষির আর একটা কথাও বললো না। থম মেরে বসে রইল। আর রাশা কিছুক্ষণ গজগজ করে নিজের কাজ করতে লাগলো।
***
রাতে শোয়ার আগে রাশার ডাক পরলো বড় বাবার অফিস ঘরে৷ ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো তার। কাঁপা পায়ে সেখানে হাজির হয়ে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো৷ এইজীবনে বড় বাবার থেকে বেশি ভয় আর কাউকে পায় না সে। যতটা সম্ভব তার থেকে দূরে দূরেই থাকে৷
–তুমি নাকি প্রপার্টি চাচ্ছো?
হাসান চৌধুরীর গুরুগম্ভীর আওয়াজে রাশার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো। উত্তর দিতে পারলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। হাসান চৌধুরী কিছুক্ষণ তার অবনত মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
–এটা কি তোমার চাওয়া নাকি তোমার শ্বশুরবাড়ির চাওয়া?
রাশা এবারেও কিছু বললো না। ভয়ার্ত ঢোক গিলে ফ্লোরে নখ খুঁটতে লাগলো।
–ঠিক আছে৷ পেয়ে যাবে সবকিছু। তোমার বাকি বোনদেরও যথেষ্ট যৌতুক দেওয়া হয়েছে। তোমাকে তার বদলে প্রপার্টি দিচ্ছি৷ এরপর তোমার আর কোন দাবিদাবা থাকবে না। মনে থাকবে?
ঘাড় কাঁত করে সায় জানালো সে। তারপর মিনমিন করে বললো,
–খাগড়াছড়ির রিসোর্টটা..
–পেয়ে যাবে। কাল দুপুরের মধ্যে রেজিস্ট্রিও হয়ে যাবে। প্রপার্টি নিয়ে তারপর শ্বশুরবাড়ি যাবে। আমি চাইনা ওখানে আমাদের মুখ ছোট হোক।
রাশা ঘাড় কাত করে সায় জানালো শুধু। হাসান চৌধুরী কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
–তুমি আমাদের বাড়ির কালচার জানার পরেও যেসব কাজ করে বেড়াও, সেটা কি ঠিক করো? আমাদের উপর তোমার রাগ আছে জানি, কিন্তু কারনটা জানি না। যদিও এই বংশের মেয়ে হয়ে তোমার গর্ববোধ করা উচিৎ। সে যাই হোক, সেসব সবার নিজস্ব ব্যাপার। তোমার এখন বিয়ে হয়েছে, তবুও এখনও যা করবে সেটার সাথে আমাদের পরিবারের নাম যুক্ত থাকবেই। তাই এরপর থেকে যা করবে সাবধানে করবে। সম্মানে আঘাত লাগলে আমি কিন্তু কাউকে ছাড়ি না। এখন যাও।
এতো বড় বড় জ্ঞানের বাক্য শোনার পর ত্যাক্ত বিরক্ত রাশা অবশেষে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে আর এক মূহুর্তও থাকলো না। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো।
চলবে…