#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৯(প্রথমাংশ)
সকাল সকাল দুই জা মিলে রাশার ব্যাপারে আলোচনা করতে বসেছে। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। মেয়েটা প্রতিদিন কোথায় যায়, কি করা, ফেরেও এতো দেরি করে। সারাদিন না জানি কোথায় কোথায় ঘোরে। ব্যাপারটা নিয়ে শাহিদার থেকে মাহফুজা বেশি চিন্তিত।
–খারাপ মানুষের খপ্পরে পরলে তো জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে ভাবি। মেয়েটার গায়ের রঙটাও কেমন মলিন হয়ে যাচ্ছে। না জানি কি দিয়ে কি করছে! বলে তো কোর্টে যায়, মিথ্যা সাক্ষী দেয়। আমার তো একদমই বিশ্বাস হয় না।
লিভিংরুমের বড় সোফায় দুই জা বসে এই আলোচনা করছে। আলোচনা কানে যাচ্ছে ডাইনিং টেবিলে বসা উষির আর উজানেরও। দুজনেই কান খাড়া করে শুনছে। মাহফুজার কথায় তাল মিলিয়ে শাহিদা বললো,
–বিশ্বাস যে আমারও হয়, তা না৷ তবে ভদ্র বাড়ির মেয়ে। খারাপ কিছু কিংবা উল্টাপাল্টা কিছু করবে না মনে হয়। আর ওই মেয়ের সাথে এই ব্যাপারে কথা কে বলবে? যে ত্যাড়া! একটা কথার ঠিকঠাক উত্তর দেয় না।
কথা সত্য। মাহিফুজা এক কথায় ব্যাপারটা স্বীকার করলো। স্বীকার করলো উজান, উষিরও। এরপর মাহফুজা বেশ উৎসাহিত হয়ে নিজের প্রস্তাব পেশ করলো,
–আমি তো বলি জিজ্ঞাসা করারই দরকার নেই। সরাসরি অফিসে বসার কথা বললেই হয়ে যায়। এখনকার প্রায় সব মেয়েই কিছু না কিছু করেই। নোঙরও অফিস জয়েন করলো। উষির তো অফিসের নামই নেয় না। ছেলে, ছেলের বউরা মিলেই কাজ করলে সবারই সুবিধা হবে। আর কারোর তো হাল ধরতে হবে। উজান একাই বা অতো বড় অফিস কিভাবে সামলাবে! সবাই মিলে হাতে হাত রেখে আগালে তবে না বড় করা যাবে।
উজানের মাথায় বজ্রপাত হলো বলে মনে হলো। চমকে উঠে মায়ের দিকে সরাসরি তাকালো। তারা নিজেদের গল্পে মশগুল। তাদের দিকে কেউ নজরই দিলো না। উজান আফসোসে মাথা নেড়ে বললো,
–এক নোঙরকে নিয়েই পারি না, আবার রাশা! আমি অফিসে যাওয়া বাদ দিয়ে দেবো।
উষির তাকে আশ্বস্ত করলো,
–কুল ব্রো! ও জীবনেও অফিসমুখো হবে না। নিশ্চিন্ত থাক।
উষিরের সাথে তাল মিলালো শাহিদা। সেও একদম নিশ্চিত হয়ে বললো,
–ওই মেয়ে অফিসে যাবে! জিজ্ঞাসা করে দেখো? জীবনেও যাবে না। আমি লিখে দিতে পারি।
রাশা বের হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে একদম রেডি হয়ে নিচে এসেছিলো৷ ভাগ্যগুণে শাহিদা আর মাহফুজার কথার মাঝে পরে গেলো। মাহফুজা তাকে দেখেই বেশ গম্ভীর গলায় বললো,
–রাশা, আমি আর ভাবি মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
রাশার পা থমকে গেলো। খাবার টেবিলে যাওয়ার আগে কথা শুনে যেতো চাইলো। তাই সেখানে দাঁড়িয়েই ভাবুক গলায় বললো,
–আচ্ছা! সিদ্ধান্তটা কি আমার জানা উচিৎ জন্য আমাকে বলছো আন্টি?
মাহফুজা আড় চোখে শাহিদার দিকে তাকালো। শাহিদা নির্লিপ্ত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মাহফুজাও চায়ের কাপ টেবিলে রেখে নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,
–হ্যাঁ জানা উচিৎ। সিদ্ধান্তটা তোমাকে নিয়েই। তুমি আজ থেকে আমাদের অফিসে জয়েন করবে।
রাশা আতকে উঠল,
–অফিসে যাবো! আমি!
–হ্যাঁ তুমি। সারাদিন না জানি কই টইটই করে ঘুরে বেড়াও! বিজনেসে হাত লাগালে তাও বিজনেস আগাবে। বাড়ির মানুষই যদি বাড়ির ব্যবসার কাজে ইন্টারেস্ট না দেখায় তাহলে বাইরের মানুষ কি কাজ করবে! তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমি এখন থেকে অফিসে বসবে।
–সরি আন্টি৷ আমার বিজনেসে কোন আগ্রহ নেই। স্টিল, একটা কাজে আছি। সেটা তো হুট করে বাদ দেওয়া যায় না।
–কোর্টে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া একটা কাজ হলো! কেউ যখন আমাদের জিজ্ঞাসা করবে, তোমাদের বাড়ির বড় বউ কি কাজ করে তখন আমরা কি জবাব দেবো? না, আমাদের বাড়ির বড় বউ মামলায় মিথ্যা অ্যালিবি হয়। এসব বলবো?
ধমক দিলো মাহফুজা। উষির আফসোসে মাথা নাড়লো৷ হাতের স্যান্ডউইচ প্লেটে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–ভাই, এই বউ শাশুড়ির ঝামেলাটা সত্যি ভীষণ ভয়ংকর হয়। সেই বউয়ের হাজবেন্ড হিসেবে তো আমার এখন ভয় লাগছে। না জানি কখন আমাকে নিয়ে শুরু হয়!
উজান আড় চোখে লিভিংরুমে চলা আলোচনায় নজর দিয়েছিলো। উষিরের আহাজারি শুনে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–ঝামেলাটা আমার মায়ের সাথে লেগেছে ষ্টুপিড। তুই বসে বসে জুস খা।
বলে সত্যি সত্যি জুসের গ্লাস উষিরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। তারপর চিন্তিত গলায় বললো,
–সত্যি সত্যি কি রাশা মিথ্যা অ্যালিবি হিসেবে কাজ করে?
–উহু, মিথ্যা অ্যালিবি জোগাড় করে তাদের দিয়ে কোর্টে কথা বলায়।
–মানে?
উজান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। উষির স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে বললো,
–মানে ও উকিল।
–কি!
উজানের দেওয়া চিৎকারটা জোরে ছিলো৷ সবাই তার দিকে অবাক চোখে তাকালো। যখন বুঝলো, তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা হচ্ছে তখন আবার নিজেদের আলোচনায় ফিরে গেলো। উজানের চিৎকারে উষির বেশ বিরক্ত হলো,
–চিৎকার দেওয়ার মতো কি বলেছি? কেউ কি উকিল হয় না নাকি?
–চিৎকার দেইনি, অবাক হয়েছি। রাশাকে দেখে উকিল উকিল মনে হয় না। কিন্তু ও কথাটা কোন কারনে লুকাচ্ছে নাকি ইচ্ছে করে বলছে না?
–কি জানি! কিছু কিছু মানুষের প্রফেশন লুকাতে ভালো লাগে। ওরও হয়তো সেম প্রবলেম আছে।
উষির কাধ নাচিয়ে বললে রাশার দিকে তাকালো৷ রাশার পরনে প্রতিদিনের মতো সাদা পোশাক, এক হাতে ব্রেসলেট, আরেক হাতে ঘড়ি। উষির মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘক্ষণ তর্কবিতর্কের পর রাশা অনুরোধের সুরে বলো,
–আমার প্রবলেম আছে আন্টি। বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ? আমি একটা অ্যাগ্রিমেন্টে আছি। অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী আমি অন্য কারো হয়ে কাজ করতে পারবো না আর অন্য কোন কাজ করতে পারবো না। অ্যাগ্রিমেন্ট ভাঙলে এক বছরের জেল।
মাহফুজা সব শুনে শাহিদার দিকে তাকালো। শাহিদা কাঁধ নাচিয়ে হাত উঠালো। যেনো বলতে চাইছে, আমি আগেই বারণ করেছিলাম। এখন সামলাও! মাহফুজা এরপর আর একটা কথাও বললো না। থমথমে মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। রাশার মন খারাপ হয়ে গেলো। সত্যিটা সে বলতে চায় না আবার বিজনেসেও হাত লাগাতে চায় না। হাতে অনেক অপশন থাকলে সত্যিই ভীষণ বিপদে পরতে হয়। সব থেকে বড় বিপদ তো মানুষের মন রক্ষা করে চলা। কাজটা যেমন বিপদের, তেমনই কঠিনও। তার প্রফেশনে এমন করে চলতে হয় না। কিন্তু এই বিবাহিত জীবনে এটা খুবই জরুরি একটা কাজ বলেই বুঝলো সে। পরিশেষে মাহফুজাকে মন খারাপ করতে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো।
****
অনুষ্ঠানের আর খুব বেশি দেরি নেই। পুরো শপিং এখনও শেষ হয়নি। রাশা বুঝে পায় না, এক বেলার একটা অনুষ্ঠানে এতো শপিং করতে হবে কেন! অনুষ্ঠানের ড্রেস তো অর্ডার দেওয়াই আছে। শেষ! আর কি? এখন কি অনুষ্ঠানে মিনিটে মিনিটে ড্রেস চেঞ্জ করবে! একই অনুষ্ঠানে আবার শপিং করতে হবে৷ আর শপিংএ সাথে নিতে হবে নোঙরকে। প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা তার খুব খারাপ। আজকে ভয়ে ভয়ে তাকে নিতে এসেছে। অফিস ছুটির পর নোঙর আসলো মলিন মুখে। মুখ থেকে চিন্তার ভাজ কিছুতেই যাচ্ছে না। রাশা ভেবেছিলো, আজকে যদি ওমন ঘোরায় তাহলে ধমক দেবে তাকে। কিন্তু তার এমন মুখশ্রী দেখে নিজের ধমক হজম করে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো,
–কি হয়েছে নোঙর? এনি প্রবলেম?
নোঙর গাড়িতে বসে বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–বিরাট বড় প্রবলেমে পরেছি আপু। একটু হেল্প করবে প্লিজ?
দীর্ঘশ্বাসের শব্দে রাশা হকচকিয়ে গেলো৷ একটু আমতা-আমতা করে বললো,
–আচ্ছা! কি প্রবলেম?
রাশাকে কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হচ্ছে৷ আসল কথা হচ্ছে, নোঙরের ব্যবহারে সে প্রচন্ড ভয় পায়। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের মুখের উপর কথা বলা যায় না। তারা যা বলে তাই করতে হয়। রাশার জন্য নোঙরও তেমনই মানুষ। মেয়েটাকে কষ্ট দিতে মন চায় না। তাই যা বলে তাই মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। কথাবার্তাও বলতে হয় সাবধানে। না জানি কোন কথায় কি মনে করে ফেলে!
–অফিসের প্রবলেম।
–কেউ কিছু বলেছে? মারতে হবে কাউকে? নাকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে? ভাইয়াকে আমি বলবো সমস্যা নেই। শুধু বলো কে কি বলেছে?
বেশ উতলা হলো সে৷ নোঙর সেদিকে তাকিয়ে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। উদাস গলায় বললো,
–তোমার ভাইয়াই বলেছে মানে দিয়েছে। একটা প্রজেক্টের দ্বায়িত্ব দিয়েছে। আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। ফাইল খুললেই তার সব লেখা চোখের উপর ভাসছে।
রাশার উতলা ভাব চলে গিয়ে উত্তেজনা খানিক দমে গেলো,
–অফিসের প্রজেক্ট! আমি কি সাহায্য করতে পারবো!
নোঙর চটপট নিজের রুপে ফেরত আসলো৷ অতি উৎসাহিত হয়ে বললো,
–অবশ্যই পারবে। সেইজন্য আমি ফাইল সাথে করে নিয়েও এসেছি।
এরমাঝে একটা লুকানো কথা আছে। সেটা হলো, সারাটা দিন সে ফাইল হাতে অফিসের সবাইকে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করেছিলো, কেউ কাজটা করে দিতে পারবে নাকি। কিন্তু অফিসের সবাই নাকচ করে দিয়েছে। উজানের কড়া আদেশ, কেউ নোঙরকে সাহায্য করবে না। তাই কেউ করলোই না। এখন রাশা শেষ ভরসা৷ তাই কথা শেষ করতে না করতেই ফাইল বের করে রাশার হাতে দিলো। রাশা চোখ মুখ গম্ভীর করে ফাইলের কাগজপত্র দেখতে লাগলো। একসময় মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
–এটা তো অনেক ইজি। তোমাকে একটা ফুল প্ল্যান বানাতে হবে। তাহলেই হয়ে যাবে। এমবিএ তে তো এগুলো আছে। তুমি শেখোনি?
নোঙর ঠোঁট উলটে দায়সারা ভাবে বললো,
–নাহ! ক্লাসেই যাই না। শুধু শুধু ভর্তি হয়েছি। প্লেন মাস্টার্স করবো ভাবছি। ওইসব এমবিএ টেমবিএ আমার দ্ব্বারা সম্ভব হবে না।
রাশা উৎসাহ দিতে চাইলো,
–তুমি যেটাতে ভালো, তোমার সেটাই করা উচিৎ। মন যেখানে টানে সেখানেই যাও। তবে এমবিএ তে যখন ভর্তি হয়েছো তখন সার্টিফিকেটটা নিয়েই নাও। কখন কোনটা দরকার হয় বলা তো যায় না।
–ওটা তো এখনই দরকার ছিলো কিন্তু হচ্ছে তো না।
নোঙর উদাসভাবে বললো। রাশার উৎসাহ ধামাচাপা পরে গেলো। বুঝলো, পাশের মেয়েটিকে উৎসাহ দিয়ে কোন লাভ নেই। সে সেটাই করবে যেটা সে বুঝবে। তাই ওপথে আর পা বাড়ালো না। ফাইল নাড়াচাড়া করে বললো,
–আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি ভালো করে। মনে করো তুমি একটা গান সার্চ করবে। ইউটিউব, গুগোল বা আদার সাইট, যেখান থেকে সার্চ করবে সেখানে গানের একটু অংশ লিখে সার্চ করলেই কেমন চলে আসে রাইট? এটার পেছনে কিওয়ার্ড রিসার্চ এক্সপার্টরা কাজ করে। ওদের কাজ হচ্ছে, কেউ একটা ছোট বাক্য বা সিমিলার কিছু দিয়ে সার্চ করলেই যাতে ওই গানটা একদম প্রথমে চলে আসে। তোমার কাজও তাদের মতোই। যে কোম্পানির সাথে কাজ করছো, তাদের বিশ্বাস করাতে হবে যে, তোমাদের মেটারিয়াল ইউজে তাদের ব্যান্ডটা এমন টপে চলে আসবে। বুঝেছো?
নোঙর করুন চোখে মাথা নাড়লো৷ রাশা তপ্ত শ্বাস ফেলে বোতল থেকে পানি খেলো। এনার্জি ফিরে পাওয়ার পরেই আবার বলা শুরু করলো,
–তোমাদের মেটারিয়ালে তৈরি কাপড় ওদের ব্র্যান্ড ইউজ করবে। এখন ওদের যত ভালো কাপড় তোমরা দিতে করতে পারবে ওদের ড্রেস তত বেটার হবে। এখন তাদের এটা বিশ্বাস করাতে হবে যে তুমি ওদের বেস্ট কাপড় দিলে ওরা ওই কাপড়ে বেটার কোয়াটিলির ড্রেস বানাতে হবে আর সবাই খুব পছন্দ করবে। এখন এই পুরো প্রসেসটার ধাপ তোমাকে তৈরি করতে হবে৷ তুমি ওই কাপড়ে কি মেটারিয়াল ইউজ করবে, কেমন কালারের কাপড় তৈরি করবে এক্সেট্রা এক্সেট্রা তোমাকে ধাপে ধাপে প্লান তৈরি করতে হবে। দেন কোম্পানিকে সেটা প্রেজেন্ট করবে। ওরা অ্যাপ্রুভ করলে সেটা ওরা ওই কোম্পানিকে দেবে। ওরা অ্যাপ্রুভ করে ডিল ফাইনাল করবে। ব্যাস কাজ শেষ।
নোঙরের মাথা ভনভন করে ঘুড়তে লাগলো। রাশার সব উৎসাহে পানি ফেলে দিয়ে হতাশ গলায় বললো,
-আমার পক্ষে সম্ভব না। আই কুইট!
রাশা আরো হতাশ হলো। তবে সে নিজেকে ভালো টিচার হিসেবেই জানে। বৃষ্টি বন্যা তার বুঝিয়ে দেওয়া পড়া খুব ভালো করেই বোঝে। আবার জজ কিংবা ক্লায়েন্টকেও সে খুব ভালো ঘোল খাওয়াতে পারে৷ এইজন্যই দুই বছরের ইন্টার্নশিপ খুব সফলতার সাথে শেষ করতে যাচ্ছে। বুঝিয়ে দেওয়ার একটা টেকনিক আছে। সেটা হচ্ছে, যাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, সে কিভাবে বুঝালে বুঝবে সেটা ধরে ফেলা। রাশাও ধরে ফেলছে। তাই এর সমাধানও বের করে ফেললো,
–তো কে বলেছে তুমিই কাজটা কমপ্লিট করো? তোমার বর তো এসবে এক্সপার্ট। তাকেই বলো কমপ্লিট করে দিতে।
নোঙর আসলে কাজটা করতেই চায় না। আর যে করতে চায় না সে খামোখা বুঝবেই বা কেনো! কথাটা রাশা খুব ভালোমতো বুঝে ফেলেছে। তাই এর সুন্দর একটা সমাধান বলে দিলো। তার কথাটা নোঙরেরও মনে ধরলো। ভাবুক হলো৷ আসলেই ব্যাপারটা ভেবে দেখা যায়।
চলবে…
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৯(শেষাংশ)
উষির মিছিল থেকে সরাসরি উজানের গাড়িতে চেপে বসলো। ক্লান্ত ঘর্মাক্ত দেহ সিটে এলিয়ে চোখ বুজে রইলো। বাড়ি থেকে কঠিন আদেশ এসেছে, বাড়ির দুই বউয়ের সাথে শপিংএ তাদেরও যেতে হবে। যতই কাজ থাকুক আর যাই থাকুক। এই আদেশে উজান বাধ্য হয়ে আসলেও উষির নিজের ইচ্ছায় এসেছে। তাকে ছুটি দিতে বাধ্য করেছে পার্টি অফিসের লোকদের। তার কাছে সব কাজ একদিকে আর তার বউ আরেকদিকে। দাঁড়িপাল্লায় রাশার ভাগের ওজন বেশিই পরে সবসময়। অন্যদিকে উজান বিপরীত। সবে সবে বড় একটা প্রজেক্টের কাজ হাতে নিয়েছে। এইসময় এইরকম ছুটিছাটা তার একদম পছন্দ হচ্ছে না। তার দাঁড়িপাল্লায় আবার কাজের ভারটা অতিরিক্ত বলা যায়।
গাড়িতে ছোট একটা পানির বোতলে অল্প একটু পানি ছিলো। উষির এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দিয়ে শরীর ঠান্ডা করলো। তারপর বোতলের অবশিষ্ট পানি গলায় ঢেলে আবার সিটে গা এলিয়ে দিলো৷ চোখ বুজে খুশি খুশি মনে বললো,
–মাঝে মাঝে বাড়ির লোকজন খুব সুন্দর সুন্দর কাজ দেয়। মনটা একদম প্রফুল্ল করে ফেলে।
উজান ড্রাইভ করছিলো। উষিরের কথা কানে যেতেই বিরক্ত নিয়ে বললো,
–এইটা তোর সুন্দর কাজ মনে হলো? কত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি৷ এইসময় এইসব কি সহ্য করা যায়! কত টাইম ওয়েস্ট হচ্ছে।
উষির তেঁতে উঠলো। হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
–তোর কি মনে হয়, আমি বসে বসে খাই? আমার কাজ নাই? দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা খাটতে হয়। তবে গিয়ে মানুষের মন জয় করতে পারি। আর মানুষের মন জয় করলে তবেই ভোট পাবো।
উজান তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে অবজ্ঞার সুরে বললো,
–এতোদিনে বউয়ের মন জয় করতে পারলি না, আর মানুষের মন জয় করার চিন্তা করছিস? ব্রাভো ব্রো!
–এতোদিন কোথায়! কয়েকদিন হলোই তো মাত্র বিয়ে হয়েছে। একমাসও হয়নি! এক মিনিট, এক মিনিট! মআস বোধহয় হয়ে গেছে। কয় তারিখে যেনো বিয়ে করেছিলাম?
উষির বেশ চিন্তিত হলো। উজান আড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে আফসোসে মাথা নাড়লো। একেই বলে, যার বিয়ে তার হুশ নাই আর পাড়াপড়শির ঘুম নাই!
–সেকেন্ড অগস্ট। আর এটা ফিফটিন সেপ্টেম্বর! মাস শেষ অনেক আগে।
উষির বুকে হাত দিয়ে আহাজারি করে উঠলো,
–ইসস ভাই! বউকে একটা গিফট পর্যন্ত দিতে পারলাম না! ইসস রে!
উজান বাঁকা হাসলো। টিটকারি দেবার ভঙ্গিতে বললো,
–আমি তো আমার বউকে দিয়েছি৷ এক্সপেন্সিভ গিফট!
যেনো একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা হচ্ছে। উজানের চোখেমুখে শয়তানি হাসি ঝিলিক দিয়ে দিয়ে উঠছে। মিছিলে থাকার কারণে উষিরের সাদা পাঞ্চাবি খানিক ময়লা হয়ে গেছে৷ বিশেষ করে হাতের দিকের অংশ। হাতার ময়লা লাগা অংশটুকু গুটিয়ে ভাজ করতে করতে আনমনে বললো,
–আচ্ছা! কি দিলি?
উষিরের কন্ঠস্বর নির্লিপ্ত। বউকে কি গিফট দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন।
–ল্যাভেন্ডার স্যাফায়ারের পেন্ডেন্ট।
উষির বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকালো। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বললো,
–তুই একা একা তোর বউয়ের জন্য গিফট কিনে আনলি? আমার বউ কি বন্যায় ভেসে এসেছে? তুই আমাকে একবারও বললি না যে গিফট আনবি? তোর আগে আমি বিয়ে করেছি, ভুলে যাস না। গিফট আগে আমার দেওয়ার কথা। আর তুই আমাকে টপকে গিফট দিয়ে দিলি?
–এতোদিন দিস নাই কেন?
–গিফট যে দিতে হয় তাই তো জানতাম না।
হঠাৎই উদাস হয়ে পরলো সে। উজান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
–জানতি না?
–মনে ছিলো না রে ভাই। বউকে মানাতে মানাতেই তো দিন যায়। অন্য চিন্তা কখন করবো!
উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভাইয়ের বউপাগলা রুপ দেখে বিরক্ত হলো উজান,
–আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। পঁচিশ লাখ দিয়ে আমার কাছ থেকে গিফটটা নিয়ে নিস।
–কত বললি?
টাকার অ্যামাউন্ট শুনে ভ্রু বেঁকিয়ে প্রশ্ন করলো উষির। উজান চুলে ব্র্যাক ব্রাশ করে স্টাইল করে বললো,
–পঁচিশ লাখ।
উষির দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
–তোকে যদি গাড়ি থেকে বের করে ঠিক এই জায়গায়ই আমি আচ্ছামতো পিটানি দেই তাহলে কি বড় ভাই হিসেবে আমার কোন দোষ হবে? বেয়াদপ ছেলে। এতোদিন তোর পেছনে আমার যত টাকা গেছে সব টাকা দিয়ে অমন পঁচিশ লাখের স্যাফায়ার কতগুলা কেনা যাবে জানিস? দে তাড়াতাড়ি। বউকে গিফট না দেওয়া পর্যন্ত আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
ধমক দিলো উষির। ধমকে কাজ হলো৷ উজান মুখ ব্যাজার করে গাড়ির স্টোরেজ থেকে পেন্ডেন্ট বক্স বের করে দিলো। উষির বক্স উল্টেপাল্টে দেখে ভেতরের পেন্ডেন্টটাও চেক করে নিলো। তারপর পাঞ্চাবির পকেটে পুরে বললো,
–ভালো করে শুনে রাখ। রাশা আসলে তুই ড্রাইভ করবি আর তোর বউকে তোর পাশের সিটে বসাবি। আমি আর তোর ভাবি পেছন সিটে বসবো। আর নয়তো তুই আর নোঙর পেছন সিটে বসবি আর আমি আর রাশা সামনের সিটে৷ বুঝেছিস?
–পারবো না।
থমথমে মুখে উত্তর দিলো উজান। উষির তাচ্ছিল্যভরে হাসলো৷ দেখা যাবে, কে কি পারে!
****
রাশা আর নোঙর শপিংমলের বাইরে দাঁড়িয়ে উষির আর উজানের অপেক্ষা করছিলো। তারা আসলো, গাড়ি থেকে নামলোও বটে তবে তাদের কাছাকাছি আসার আগেই কয়েকটা মেয়েদের দল তাদের ঝেঁকে ধরলো। উজান আর উষিরের চেহারার গড়ন, উচ্চতা, ব্যবহার, সব প্রায় সেমই বলা চলে। সেইজন্য তাদের জমজ ভেবে অনেকে ভুল করে৷ মেয়েদের দলের সবাই তাই করলো। সেইজন্যই বোধহয়, উজান আর উষির তাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। একে একে দুইজনের সাথেই কথাবার্তা বলে ছবিও তুলতে লাগলো। আর এসব দেখে নোঙর রেগে আগুন। রাশাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–দেখেছো আপু, ছেলেদের আসলেই বিশ্বাস করতে হয় না৷ আমরা সাথে নেই আর সেই সুযোগে এরা এতোগুলা মেয়ের ভিড়ে বসে আছে। লেপ্টে লেপ্টে ছবিও তুলছে। জীবনে আমার সাথে হেসে কথা বললো না আর দেখো, মুখ থেকে হাসি সরছে না।
রাশা রোদ চশমার ফাঁকে তাদের দিকে তাকালো। এরপর বেশ বিরক্ত হয়ে বললো,
–ওরা তো ফ্যান গার্ল। এরা এমনই করে।
নোঙর অবাক হয়ে গেলো। তীব্র রোদের মাঝেও নিজের রোদ চশমা খুলে হাতে নিয়ে বিষ্ময়মাখা গলায় বললো,
–তোমার জেলাসি হচ্ছে না?
–তা কেনো হবে? এটা তো নরমাল ব্যাপার৷ পাবলিক ফিগার হলে এসব ফেস করতেই হবে। বি নরমাল নোঙর।
–নরমাল! এমন ঢেকেঢুকে আসার পরও মানুষ চিনবে কিভাবে? কোন ছেলে তো আসে নাই৷ সবগুলা মেয়ে৷
উষিরের মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ আর চোখে সানগ্লাস ছিলো। উষির সাথে থাকায় উজানও তেমনই মাস্ক, ক্যাপ আর সানগ্লাস পরেছিলো। তবুও মেয়েগুলো তাদের চিনে ফেলেছে। এই কথাটা রাশার মাথায় আসতেই ভাবুক হলো সে। চিন্তিত গলায় বললো,
–জেলাস হওয়া দরকার বলছো তাহলে?
–একশো পার্সেন্ট।
রাশা গম্ভীরমুখে মাথা ঝাকিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাদের দিকে তাকালো। মেয়েগুলো চলে যেতেই ওরা দুইজন তাদের দিকে আসলো। কাছাকাছি এসেই উষির পকেট থেকে রুমাল বের করে রাশার কপালের ঘাম মুছে বিচলিত গলায় বললো,
–শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে গিয়ে বসলেই তো হতো?
উষিরের বিচলিত মনোভাব দেখে নোঙর মুগ্ধ হয়ে বললো,
–আপনার মতো মানুষ ঘরে ঘরে জন্ম নিক ভাইয়া। কিছু কিছু মানুষ তো বউকে কষ্ট দিয়েই শান্তি পায়।
শেষের কথাটা উজানের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললো। উজান পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়েছিলো৷ এই কথায় ভ্রু কুঁচকে নোঙরের দিকে তাকালো। উষির হেসে ফেলে বললো,
–ছোটরা একটু ঘাড় ত্যাঁড়া হয় নোঙর। মনে নিও না কিছু। তুমিও বড় আর আমিও বড়। তাই দুইজনই দুইজনের কষ্ট বুঝতে পেরেছি৷ আর এরা দুইজনই ছোট। মানে বুঝতেই পারছো আমার আর তোমার অবস্থা!
নোঙর আফসোসে মাথা নেড়ে সায় জানালো। তারপর উজানের দিকে ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনে হাঁটা ধরলো। উষির চোখের ইশারায় উজানকেও তার সাথে যেতে বললো। উজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটা ধরলো। বউ পেয়ে ভাই যে নিজের ভাইকে ভুলে যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মিস্টার আদনান কায়সার। ব্যাপারটা দুঃখজনক!
ওরা চলে যেতে রাশা ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বললো,
–মেয়েগুলো সুন্দর ছিলো তাই না?
উষির রেগে তাকালো। তারপর আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বললো,
–খবরদার বলছি! আর একটা শব্দও মুখ থেকে বের করবে না।
বলেই সে গটগট করে সামনে হাঁটা ধরলো। এই ব্যাপারে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা খুব খারাপ৷ অন্তত এই ব্যাপারে বউকে তার একদম পছন্দ না! রাশা ঠোঁট উল্টে কাঁধ নাচিয়ে বিড়বিড় করলো,
–মনমতো কথাই বলতে চাচ্ছিলাম। আসলেই, সবার সবকিছু সহ্য হয় না!
***
শপিং করার পুরোটা সময় নোঙর মুখ ব্যাজার করে ছিলো। প্রতিটা জিনিসের প্রাইস দেখেছে আর আফসোস করে রেখে দিয়েছে। শান্তিতে কিছুই কিনতে পারেনি। তবে উজান কিনেছে। বলা ভালো, কিনে দিয়েছে। নোঙরকে কয়েক জোড়া হিল কিনে দিয়েছে যাতে আর কারো জুতা পরে অফিসে আসতে না হয়। নোঙর সেটা দেখে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলেছিলো শুধু। এরপর পুরোনো মামার বাড়ি আর নতুন শ্বশুরবাড়ির সবার জন্যেও শপিং করেছে৷ উজান কিনেছে জন্য উষিরকেও শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য শপিং করতে হলো। আবার বাড়ির সবার জন্যেও করতে হয়েছিলো। এই এতো এতো শপিং শেষে সবাই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে গেলো। আলাদা গাড়িতে সেগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে তারা নিজেরা উজানের গাড়ির কাছে আসলো। গাড়ির কাছাকাছি আসতেই উষির উজানকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিলো৷ রাশা আগেই উঠে বসেছিলো। নোঙর রাশার পাশে উঠতে নিতেই উজান তার হাত টেনে আটকালো। থমথমে গলায় বললো,
–সামনে বসো, কথা আছে৷
নোঙরের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো। বড় বড় চোখ দুটোতে বিষ্ময় খেলে গেলেও কিছু না বলে সামনেই বসে পরলো। উষির উজানের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে রাশার পাশে বসে পরলো। রাশা চোখ বুজে সিটে মাথা এলিয়ে বসে ছিলো৷ উষির পাশে বসতেই চোখ খুলে অবাক হয়ে গেলো৷ উষির ফিসফিস করে বললো,
–নতুন কাপলদের একটু প্রাইভেসি দিতে হয়। সবে সবে বিয়ে হয়েছে ওদের। তাই ওদের একটু প্রাইভেসির ব্যবস্থা করলাম। বড় ভাই হিসেবে তো এটা আমার কর্তব্য!
রাশা কিছু না বলে চোখ বুজে উষিরের কাধে মাথা দিলো৷ উষির আলতো হেসে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। প্রকৃতিতে আঁধার নেমে এসেছে অনেক আগে। গাড়ির ভেতর থেকে থেকে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পরছে। জ্যামে বসে সেই মৃদু মন্দ আলোতে নোঙরের দিকে তাকালো উজান। নোঙরের এনার্জির কমতি নেই। দুই আড়াই ঘন্টা শপিং করেও ক্লান্তির রেশমাত্র তার মধ্যে নেই। উলটে মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। বড় করে শ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো সে। মনটা কেমন কেমন করছে! হঠাৎ পেছন সিট থেকে উষির গলা উঁচিয়ে বললো,
–একটা মুভি দেখা যাক। এতে সময়টা অন্তত কাঁটবে।
নোঙর মোবাইল রেখে ভারি উৎসাহিত গলায় বললো,
–কি মুভি ভাইয়া?
রাশা জানালার কাঁচে মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে ছিলো৷ উষিরের কথাই চটপট তার কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বললো,
–ছোট ভাই-বউদের সামনে রোম্যান্টিক শব্দটা উচ্চারণ করবে না খবরদার? তোমার লজ্জা নাই থাকতে পারে, বাকিদের আছে।
মনে হলো, একজন লজ্জাবতী নারী একজন লজ্জাহীন পুরুষকে বলছে, লজ্জা করো! লজ্জা করো! লজ্জা যে কার নেই, সেটা তো সে ভালো করেই জানে। প্রথমবার কাছাকাছি আসার পর পুরো দুই ঘন্টা সে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলো। রাশার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারেনি। সেই মানুষকে লজ্জা শিখাচ্ছে! চরম হারে অপমান করে ফেললো তাকে। উষির ব্যাজার মুখে কুলুপ এটে বসে রইলো।৷ রাশা তার হয়ে বললো,
–কি মুভি দেখবে? হরর? কমেডি? অ্যাকশন?
–কুংফু পান্ডা দেখি? কলেজে একবার দেখেছিলাম। এত্তো কিউট ছিলো! আবার দেখতে ইচ্ছে করছে।
উচ্ছ্বসিত মুখে বলো নোঙর। মুভি দেখায় তার উৎসাহের সীমা রইলো না। উষির আফসোসে মাথা নাড়লো। উজানকে ছোট করে টেক্সট দিলো,
“উজান, তুই কখনও ভেবেছিলি, বউ নিয়ে কুংফু পান্ডা মুভি দেখবি?”
“মুভি যে দেখবো, তাই তো ভাবিনি। কত টাইম ওয়েস্ট হচ্ছে। কত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে পেয়েছিলাম। ধ্যাত!”
চটপট উত্তরও এলো। গাড়ির মনিটর স্ক্রিনে এখন কুংফু পান্ডা মুভি চলছে। নোঙর আর রাশা বেশ মনযোগ দিয়ে সেটা দেখছে। উষির এবারে রাশাকে টেক্সট করলো,
“বেগম জায়ায়ায়ায়ান? তোমার জন্য গিফট এনেছি সুদূর বিলেত থেকে।”
রাশা মেসেজের নোটিফিকেশন পেয়ে মেসে চেক করে কটমট করে উষিরের দিকে তাকালো। উষিরের নজর মুভির দিকে ছিলো। রাশা দ্রুত হাতে টাইপ করলো,
“বাই এনি চান্স, তুমি কি সৌরভের থেকে কোন ট্রেনিং নিয়েছো?”
“গিফট লাগবে নাকি সেটা বলো?”
খানিক রেগেই রিপ্লাই দিলো উষির। ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বেড়িয়ে বাস্তবে আসলো রাশা। হাত পেতে ইশারায় গিফট দিতে বললো। উষির মাথা নেড়ে মেসেজ টাইপ করলো,
“উহু, পরিয়ে দেবো। তুমি চোখ বন্ধ করে ঘুরে বসো?”
রাশা বিরক্ত হয়ে ঘুরে বসলো। উষির পকেট থেকে বক্স বের করে পেন্ডেন্ট হাতে দিলো। তারপর রাশার চুল সরিয়ে ঘাড়ের এক পাশে রেখে আলো-আঁধারিতেই সেটা পরিয়ে ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো। চকিতে ঘুরে বসলো রাশা। তার মেজাজ নেওয়ার জন্য উষির পুরোদমে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু রাশা কিছু না বলে শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
–থ্যাঙ্কিউ!
****
টানা তিনদিনের প্রচেষ্টায় মোটামুটি একটা প্ন্যান দাঁড় করিয়েছে নোঙর। সেদিন শপিং শেষে উজানকে একটু সাহায্যের জন্য বলেছিলো৷ গম্ভীরমুখে এক কথায় মানা করে দিয়েছিলো। এতেই তার জেদ চেপে গিয়েছিলো৷ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, একা একাই সব চেয়ে বেস্ট প্ল্যান তৈরি করবে৷ প্লানমাফিক প্রজেক্ট তৈরি করে এখন উজানের কেবিনে গেলো৷ চেয়ার টেনে বসে উজানের দিকে তার এতো কষ্ট করে করা ফাইলটা এগিয়ে দিলো সে। উজান ফাইল চেক করতে লাগলো মনোযোগ দিয়ে। জীবনের প্রথম টাস্ক করে নোঙর ভীষণ উচ্ছ্বসিত। উৎফুল্ল মনে বললো,
–ডকুমেন্ট হারানোর কোন ভয় নেই। আমি অনেক জায়গায় কপি করে রেখেছি৷ ফোন মেমোরি, এসডিকার্ড, কম্পিউটারের ওয়ার্ড ফাইলে, গুগোল ডকুমেন্টে। ছবিও তুলে রেখেছি। আবার একটা ডিস্কেও রেখে দিয়েছি৷ একটা ক্রাশ করলেও আরেকটা থাকবে৷
উজান ফাইল চেক করা শেষে ধপ করে সেটা টেবিলের উপর রেখে বললো,
–আপনার এতো কষ্ট বৃথা গেলো মিসেস নোঙর খন্দকার। ফাইল রিজেক্টেড।
নোঙরের মুখের উজ্জ্বল্যভাব মূহুর্তেই চলে গিয়ে আঁধারে ঢেকে গেলো। এরপর একটা কথাও না বলে তক্ষুনি বাড়ি ফিরে গেলো৷ ছুটির আগে বাড়ি ফিরে যাওয়ায় উজান কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভেবেছিলো একবার। কিন্তু নোঙরের মলিন মুখ মনে পরায় সেটা আর করেনি। অন্যদিকে নোঙর বাড়ি ফিরেই বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে। উজানের সাথে সে কিছুতেই থাকবে না। মাকে কঠিন করে বলো,
–শোনো মা, আমার ওর কিছুই ভালো লাগে না৷ সংসার করবো কিভাবে? মগ ভর্তি করে কফি খায়। মগ ভর্তি করে কে কফি খায়? টেবিল এলোমেলো থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। সব সময় সব বিষয়ে খুঁতখুঁত করে। সব জিনিস নীট অ্যান্ড ক্লিন চাই। একটু নোংরা, একটু অগোছালো পছন্দ না। পুরো টেবিল সাফসুতরা চাই। চেয়ার এলোমেলো চলবে না। ফাইল অগোছালো থাকলে নিজেই নেমে পরে সব ঠিক করতে। উইকেন্ডে তো মাথায় গামছা বেঁধে অফিসের ঝুল পরিষ্কার করতে নেমে পরেছিলো। অফিসেই এমন করে তাহলে বাড়িতে কি করে চিন্তা করো একবার! পরিষ্কার করারও একটা লিমিট থাকে। পুরো পরিচ্ছন্নতাকর্মী একটা। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিৎ!
অফিসের ঝুল পরিষ্কার করার কথাটা সম্পূর্ণ বানোয়াট৷ পরিষ্কার সে করেনি। পরিষ্কার করার লোকগুলোই ওগুলো করেছে। আর তদারকি করেছে তাহের মিয়া। বাকিগুলো খানিক খানিক করে সত্যি৷ বড় কোন পদক্ষেপ নিতে গেলে এমন ছোটখাটো মিথ্যা বলতে হয়। সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। আর অপমান নয়, যথেষ্ট হয়েছে! এবার এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে!
চলবে…
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩০
রাশার রিসেপশন ড্রেসে মিসেস ফ্লোরা বাঙালীয়ানাকে খুব ভালোভাবে ধরে রেখেছেন। শাড়ির ডিজাইনও করেছেন নিজের মতো৷ হালকা গোলাপি রঙের সফট বেনারসি শাড়ির উপর সোনালি সুতার কাজ করা। এক দেখায় পছন্দ করার মতো শাড়ি। পছন্দ করলোও সবাই। রাশার সাজগোছও শুদ্ধ বাঙালিয়ানা স্টাইলের হলো। আটপৌরে পদ্ধতিতে শাড়ি পরে চুলগুলো খোপা করেছে। খোপা আবার জিপসি ফুল আর সাদা গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। গহনার মধ্যে চিকন লম্বা টিকলি, দুই হাতে চুর আর দুইটা পাতলা হার। সবশেষে শাড়ির সাথে মাচিং ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিয়েছে। ওড়নার এক কোনা হাতের সাথে বেধে দেওয়ায় এই হালকা সাজেও রাশাকে রানীর থেকে কম মনে হচ্ছে না। ছবিও আসলো দারুন দারুন৷
ম্যারেজ হলের লনে হচ্ছিলো এই অনুষ্ঠান। পায়ের নিচের নরম ঘাসে খালি পায়ে হাঁটার নিদারুন ইচ্ছেটা ধামাচাপা দিয়ে অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে স্টেজে বসে আছে রাশা। তার বাড়ি থেকে এখনও কেউ আসেনি। হয়তো রাস্তায় আছে৷ সে অবশ্য চাচ্ছে তারা রাস্তা থেকেই ফিরে যাক৷ কিন্তু জানে যে এমনটা হবে না৷ মাঝে মাঝে উষির এসে ঘুরে যাচ্ছে। তার পরনে ঘিয়ে রঙের পাঞ্চাবি৷ সেটাও মিসেস ফ্লোরাই ডিজাইন করেছে। মিসেস ফ্লোরাকে অবশ্য এখনও দেখা যাচ্ছে না। এসেছে নাকি, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। স্টেজে বসে বসে এসব দেখা ছাড়া রাশার আর কোন কাজ নেই। গালে হাত দিয়ে আড়াম করে যে বসবে, সে ভাগ্যও তার হচ্ছে না৷ সব থেকে বিরক্তিকর ব্যাপারটা হচ্ছে, সেকেন্ডে দুই তিনবার করে ক্যামেরার ক্লিকের আওয়াজ আসছে। একটা অনুষ্ঠানে একটা ক্যামেরাই যথেষ্ট। কিন্তু তার সামনেই তিন চারজন আছে। আসেপাশে ছড়িয়ে আছে আরো কয়েকজন। এর থেকে পুরো অনুষ্ঠানে সিসিক্যামেরা লাগালে বেশি ভালো হতো। খরচও কম আবার যখন যে মোমেন্টের প্রয়োজন, সেই মোমেন্ট ক্যাপচার করে রাখা যাবে। এইটুকু বুদ্ধিও কারো নেই! আফসোসে মাথা নাড়লো রাশা। কেউ অন্তত তার কাছে এসে পরামর্শ করতে পারতো। কতো আইডিয়া আছে তার কাছে।
সুবোধ বাবুর সাথে রাশার বাবার একটা অঘোষিত শত্রুতা আছে। রাশার বাবার ধারণা, সেই রাশার মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা ঢুকিয়েছে। এইসব বড় বড় ক্ষমতাধর মানুষের শত্রুতা ভয়ংকর হয়৷ তাই তিনি রিস্ক নিতে চাননি। নিয়ম রক্ষা করে এসেছেন, দেখা করেছেন, গিফট দিয়ে খেয়ে দেয়ে বিদায়ও নিয়েছে। অনুষ্ঠানের বাকি সদস্যরা নিজেদের মাঝে ব্যস্ত। নোঙরকে আনতে উষির পার্লারে চলে গেছে। তার সাজগোছ কমপ্লিট হয়েছে একটু দেরিতে। তাই পরিবারের সবাই চলে গেলেও সে যেতে পারেনি। উজান এসে তাকে পিক করলো৷ গাড়িতে বসেই নোঙর নিজের বরের দিকে নজর দিলো। ছাই রঙা পাঞ্চাবিতে তাকে ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছিলো। পাঞ্চাবি পরা এর আগেই দেখেছে৷ বিয়ের দিন। তখন পৃথিবীর সব থেকে খারাপ মানুষ মনে হলেও আজ সেই পাঞ্চাবিতেই তাকে পৃথিবীর সব থেকে হ্যান্ডসাম পুরুষ লাগছে। কি অদ্ভুত! মনের গোপন কথা গোপন না রেখে একসময় সেই অদ্ভুত কথাটা মুখেও প্রকাশ করলো,
–তোমাকে খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে।
যদিও কথাটা হিসাবমতে উজানেরই তার উদ্দেশ্যে বলার কথা ছিলো। কিন্তু হিসাবের গরমিল হলো। উজান আড়ালে মুচকি হাসলো৷ পরক্ষণেই চুলে আঙুল চালিয়ে বললো,
–আই নো। সবাই তাই বলে।
নোঙরের মুখ হা হয়ে গেলো। কি খারাপ মানুষ! একে তো সমাজের নিয়মের বাইরে গিয়ে তার প্রশংসা করেছে, উত্তরে কোথায় সে তার প্রশংসা করবে তা না করে অহংকার করছে তাও নিজের রুপ নিয়ে! মেকাপ করা মুখটা মূহুর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলো। থমথমে মুখে বাইরের দিকে দেখতে লাগলো। ঘুমিয়েও পরলো না আর কথাও বললো না। উজানের কাছে এটা নোঙরের ভদ্রতার লক্ষন। তাই জিজ্ঞাসা না করে পারলো না,
–আজ হঠাৎ এতো ভদ্র হয়ে গেলে কেন? এতো ভালো করে কথা বলছো!
–বোধহয় তোমাকে ইমপ্রেস করতে চাচ্ছি।
কথাটা মনে মনে বললেও মুখে কিছুই বললো না৷ মাথাটা যথাসম্ভব ঘুরিয়ে রাখলো৷ উজান আড় চোখে সেটা দেখলো। নোঙরকে সে দেখেছে৷ খুব ভালো করেই দেখেছে। পার্লারের গেট থেকে গাড়ির কাছে আসার আগ পর্যন্ত এক দৃষ্টিতে তাকে দেখেই গেছে। বেগুনি রঙের সিল্ক শাড়িতে অসাধারণ লাগছে। গলায় তার দেওয়া পেন্ডেন্ট। শাড়ির সাথে মিলেছে জন্য পেন্ডেন্ট পরেছে নাকি পেন্ডেন্টের সাথে মিলিয়ে শাড়ি পরেছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। এই একই মেয়েকে বিয়ের দিন তার আধ পাগল মনে হচ্ছিলো। এরপর প্রতিদিনই তাই। তারপর আর তেমন মনে হয়নি৷ প্রতিবারই প্রতিদিনের থেকে দ্বিগুণ ভালো লেগেছে। আর আজ তো বুকের ধুকপুকের আওয়াজে কথাই বলতে পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে, তার এই নার্ভাসনেস পাশের মেয়েটি জেনে যাবে। আর জেনে গেলেই তার ভয়ংকর অপমান হবে। সেটা করা যাবে না৷ তাই আড়চোখে তাকাতে লাগলো৷ এমন আড়চোখের খেলা খেলতে খেলতে ম্যারেজহলে পৌঁছে গেলো তারা৷ উজান নিজের গাড়ি নিজেই পার্ক করে। শখের গাড়ির ক্ষেত্রে অন্য কাউকে একটুও ভরসা করে না৷ তাই নোঙর নামলেও সে না নেমে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছিলো। নোঙর গাড়ি থেকে নেমে আবার ফিরে আসলো। তাকে ফিরে আসতে দেখেই মুচকি হেসে চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করলো। নোঙর একপলক পেছনে থাকা গার্ডের গাড়ির দিকে তাকিয়ে একটু ঝুকে জানালায় ঠকঠক করে আওয়াজ দিলো৷ উজান জানালা খুলতেই নোঙর বিচলিত গলায় প্রশ্ন করলো,
–আমার ক্রাশ কোথায়?
উজানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো,
–ক্রাশ?
–হ্যাঁ, ওই বডিগার্ডটা। সে কোথায়?
উজানের মুখ থমথমে হতে এক মূহুর্তকাল সময়ও লাগেনি। গম্ভীরমুখে বললো,
–তার চাকরি চলে গেছে।
নোঙর ভীষণ গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলো,
–কেনো?
–পরনারীর নজর পরেছিলো তার দিকে। তাই তার বউ এই চাকরি করতে দেয়নি।
বলেই সুইচ টিপে জানালা বন্ধ করে দিলো। নোঙরকে আর একটা কথাও বলতে না দিয়েই থমথকে মুখেই গাড়ি স্টার্ট করে সাঁই করে চলে গেলো। গেলো! এতোক্ষণের এতো ভালো লাগা মূহুর্তেই ধুলোয় মিশে একাকার হয়ে গেলো। আর সেটা আরো অনেক রাস্তা যাওয়ার পর উজানের বোধগম্য হলো। সব থেকে বেশি বোধগম্য হলো, সে গাড়ি পার্ক করার বদলে গাড়ি ছুটিয়ে না জানি কোথায় চলে যাচ্ছিলো!
নোঙর মনে মনে সাংঘাতিক শান্তি পেলো। তার প্রশংসা করার সময় মুখ দিয়ে কথা বের হয় না আর নিজের প্রশংসা শুনতে খুব ভালো লাগে! নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি আর পরের বেলায় চিমটি কাঁটি! এখন দেখো কেমন লাগে! হুহ!
প্রশংসার ব্যাপারটা উজান আর নোঙরের বেলায় শেষ হলেও রাশা আর উষিরের তো বাকিই ছিলো৷ আর সেটা বাকি থাকলে চলবে নাকি! উষির তো এটা একদম সহ্য করবে না। অনুষ্ঠানের ব্যস্ততার এক ফাঁকে কাপল ফটোশ্যুটের বাহানায় রাশার কাছে আসলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললো,
–ইউ’র লুকিং সো প্রিটি।
–থ্যাঙ্কিউ।
নোঙরের মতো উষির নিজের প্রশংসার প্রত্যাশা করেনি, তাই এমন কাটখোট্টা জবাবে আশাহত হলো না। উলটে আরো উৎসাহিত হয়ে বললো,
–তোমাকে দেখে একটা গান মনে আসলো।
–আচ্ছা! কি গান?
রাশা তার দিকে ফিরে ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলো। উষির মিষ্টি করে হেসে গলা খাঁকারি দিয়ে নিচু স্বরে গাইলো,
“তোর কাজল কালো চোখ, তোর ঝুমকো কানের দুল
ঢাকাই শাড়ী পড়ে তোকে লাগছে বিউটিফুল”
উষিরের গলার স্বর বেশ ভালো৷ কণ্ঠে মানালোও ভালো৷ রাশার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো৷ তারপর বেশ নাটকীয় সুরে বললো,
–পরের কলিটা বলো?
উষিরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো৷ আর একটা কথাও না বলে মূহুর্তেই পা ঘুরিয়ে অনুষ্ঠানে মিশে গেলো। একটু পর আবার আসলো সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে৷ তাদের দেখেই রাশা ফিসফিস করে বললো,
–এগুলো তোমার চ্যালা নাকি? চামচাদেরও চামচা আছে তাহলে।
উষির ভয়ংকর দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকালো। বউ হয়েছে তো কি হয়েছে! তার মানে এটা তো না যে তার পলিটিক্স সম্পর্কে যা খুশি বলবে! রেগে গেলেও সবার সামনে বউকে কিছু বললো না। আবার রেখে চলেও গেলো না। বিয়ের পর থেকে কোন পুরুষমানুষকেই তার বিশ্বাস হয় না। অবশ্য তার নিজের উপর খুব বিশ্বাস আছে৷ তাই বউকে কাছ ছাড়া করতে চায় না। থমথমে মুখে তার সঙ্গীদের মধু ঢালা কথা সহ্য করে তাদের নিয়ে তবেই সেখান থেকে চলে গেলো। রাশা আবার একা হয়ে গেলো। মাঝখানে নোঙর এসেছিলো। সাথে ছিলো অন্তু। অন্তুর হাতে কাবাবের প্লেট। রাশাকে দেখে গোলগাল মুখটা মূহুর্তেই লাল হয়ে উঠলো৷ ছবি ওঠার সময় লজ্জার কারনে মুখ তুলতে পারলো না। এরপর আবার একা!
উজান রিসেপশনের অনুষ্ঠানে ঢুকেই এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে নোঙরকে খুঁজতে লাগলো। পেছন থেকে উষির বলে উঠলো,
–বাড়িতে একটু বেশিই মশার আনাগোনা বেড়েছে দেখছি।
উজান মুখ বেঁকিয়ে পাল্টা জবাব দিলো,
–এখন তো তোমার ঘরেও মশার নিয়মিত যাতায়াত চলে।
–যে মানুষ চুমু আর মশার পার্থক্য বোঝে না তার পিছে ঘুরঘুর করতে বয়েই গেছে!
উষিরের কিছুক্ষণ আগের রাগগুলো মনে পরে গেলো। সেইসাথে বহু আগের রাগগুলোও৷ উজান শয়তানি হেসে দুই পা এগিয়ে গেলো,
–আয় তোকে একটা চুমু দেই। দেখি তুই বুঝিস নাকি।
–উজান!
উষির এক লাফে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ধমক দিলো৷ জায়গাটা মোটামুটি ফাঁকাই ছিলো। নাহলে দুইজনেরই মানসম্মান আজকে শেষ। উজান উচ্চশব্দে হেসে বললো,
–একটু কাছাকাছি থাক। তাহলে রাশা পার্থক্যটা বুঝে যাবে।
উজানের কথাটা উষিরের বেশ পছন্দ হলো৷ দ্বায়িত্ববান স্বামী হয়ে তার স্ত্রীকে এপর্যন্ত মশা আর চুমুর পার্থক্য বোঝাতে পারেনি, কথাটা মনে খুব আঘাত দেয়। পার্থক্য বোঝাতে কাছাকাছি থাকার থেকে উত্তম উপায় আর নেই। কিন্তু উষির বড়ই লাজুক ছেলে। সবার সামনে বউয়ের সাথে থাকতে তার লজ্জা করবে। তাই প্ল্যানটা আপাতত ক্যান্সেল করে পার্টি অফিসের লোকজনের ভিড়ে চলে গেলো। তার মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরঘুর করছে। মন্ত্রীর আসার কথা। মন্ত্রীর সাথে আবার তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের জমিজমা নিয়ে সমস্যা। ব্যাপারটা সে জানে। এদের মুখোমুখি করলে যে গো’লাগু’লি একটা হবেই হবে সেটা তো জানা কথা! সেই গো’লাগু’লি কিভাবে আটকানো যায়, চিন্তা এখন সেটাই।
নোঙর পুরো হলটা সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে ক্লান্ত হয়ে পরেছে৷ একসময় একটা ফাঁকা টেবিল খুঁজে চেয়ার টেনে বসে পরলো। হাতে সবুজ রঙের কোন একটা জুস। অনেক টেস্টি। দুই গ্লাস খাওয়ার পরেও মন ভরছে না৷ তাই আরেক গ্লাস এনেছে।
–এক্সকিউজ মি?
পেছন থেকে বলা কথায় নোঙরের আড়ামে ব্যাঘাত ঘটালো। বিরক্তি মুখে পেছনে ফিরলো। পেছনের বেঁটেখাটো মোটাসোটা ছেলেকে দেখে বিরক্তি মুখেই বললো,
–জ্বি?
–এখানে বসতে পারি?
ছেলেটি হেসে বললো৷ নোঙর খেয়াল করে দেখলো, ছেলেটির দাঁতে কালো কালো ছোপ। চোখও লাল লাল। ক্রমাগত নেশা করলে এমন হয়। গা শিউরে উঠলো তার। তারপরও মৃদু মাথা নেড়ে বললো,
–অবশ্যই।
অবশ্যই কথার সাথে সাথেই ছেলেটি তার পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো। নোঙরও তক্ষুনি উঠে পরলো৷ ছেলেটি বিষ্মিত হলো খুব,
–আপনি উঠছেন যে?
–আমার কি বসে থাকার কথা ছিলো?
বিষ্মিত হলো নোঙরও। ছেলেটি চটপট উঠে পরলো,
–না সেটা না। কিন্তু আমি তো অনুমতি নিয়েই বসলাম। আপনার যদি অসুবিধা থাকে তাহলে আমি যাচ্ছি।
–দেখুন, এটা তো আমার পারসোনাল প্রপার্টি না তাই এখানে যে কেউ বসতে পারবে। কিন্ত আমি যে সেখানেই বসে থাকবো সেটা তো বলিনি। আপনি বসেছেন, বসুন। আমার সময় শেষ, তারজন্য আমি যাচ্ছি।
এই লম্বা লেকচারের পরই পা ঘুরিয়ে চলে গেলো। মুখোমুখি পরলো উজানের। উজান দূর থেকে দুইজনকে একসাথে কথা বলতে দেখেছিলো। ছেলেটি আসলেই ভালো না। আত্মীয় জন্য বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছে। আর চলেও এসেছে। আর এসেই তার বউয়ের দিকে নজর! কি সাহস!
নোঙরের সাথে তার ছোটখাটো একটা ধাক্কা লেগেছিলো৷ ফলস্বরূপ জুস ছিটকে নোঙরের শাড়িতে পরেছে। দোষটা তারই ছিলো বেশি। কোনদিকে না তাকিয়ে প্রায় দৌড়েই জায়গা ত্যাগ করতে গেছিলো আর তাতেই এই কান্ড হলো৷ তবে নিজের দোষ স্বীকার করলে তো হয়েই গেলো! গাড়ির রাগ আর ছেলেটির উপর হওয়া রাগ উজানের উপরই ঝাড়লো,
–তোমার কি আমাকে দেখে হিংসা হচ্ছে?
উজান বিষ্মিত হলো আবার রেগেও গেলো। কোমড়ে হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
–হিংসা! তাও তোমাকে দেখে? তোমাকে হিংসা করার একটা রিজন বলো শুনি?
–অনেক রিজন আছে। যেমন ধরো, আমাকে তোমার থেকে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। দেখো, সবাই কেমন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে আমার দিকে। হিংসা করবে না বুঝেছো। আমার মতো সুন্দর বউ পেয়ে তোমার আরো গর্ববোধ করা উচিৎ।
একেই বলে, নিজের ঢোল নিজেই পিটানো৷ বর হয়ে প্রশংসা করলো না তো কি এমন হয়ে গেলো! সে নিজের প্রশংসা নিজেই করে ফেললো। কথাটা বলে বুকের ভার মুক্ত করে গটগট করে চলে গেলো। উজান রাগতে গিয়েও হেসে ফেললো। মেহজাবিন হাসিটা দেখে ফেললো। তার বিয়ের খবর সে জানে না। উষির চলে গেলেও উজান আছে ভেবে নাচতে নাচতে তার কাছে এসে একবারে গায়ের উপর পরে গেলো। দৃশ্যটা দেখলো নোঙর৷ রাগের থেকে দুঃখ পেলো বেশি। কাজলরাঙা চোখ পানিতে ভরে গেলো। বার কয়েক নাক টেনে পানি আটকানোর চেষ্টা করেও যখন পারলো না তখন অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো। সাথে অপলা আর অন্তুকে নিতে ভুললো না।
রাশার বাড়ি থেকে লোকজন আসলো অনুষ্ঠানের শেষের দিকে। কয়েক গাড়ি ভর্তি শুধু মানুষই। যার তিন ভাগের দুই ভাগ গার্ড৷ সেই দুই ভাগের এক ভাগের হাতে ব’ন্দুক, আরেকভাগের হাতে ডালা সাজানো। বাড়ি থেকে কোন মেয়ে আসেনি৷ শুধু ছেলেরা এসেছে৷ তাও মাত্র চার পাঁচজন। তারা আসার পরপরই সমস্ত ক্যামেরা বন্ধ করিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিলো। ক্যামেরার প্রতিটি ক্লিক এখন তাদের অনুমতি নিয়ে হচ্ছে। উষিরের ভাগ্য ভালো ছিলো তাই মন্ত্রী আর সাংবাদিক, সকলেই তার শ্বশুরবাড়ির মানুষজন আসার আগেই চলে গেছে। নাহলে সত্যি সত্যি একটা হাঙ্গামা হওয়ার আশঙ্কা ছিলো। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসার পরপরই অবাক হয়ে দেখলো, ছটফট আর বিরক্ত নিয়ে চলা রাশা একদম চুপ করে গেলো। একটু সোজা করে বলতে গেলে, হুলো বিড়াল থেকে মেনি বিড়াল হয়ে গেলো। যে যা বলছে তাতেই মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছে। উষির অবাক হলেও হেসে ফেললো। রাশার এই রুপটা তার দারুন পছন্দ হয়েছে।
রাশার বাড়ির লোকজন যেই গতিতে এসেছিলো, সেই গতিতেই ফিরে গেলো। মাঝে থাকলো বড়জোর পনেরো মিনিট। কিছু খেলো না পর্যন্ত রেখে গেলো একটা লম্বা বিলাসবহুল গাড়ি। সকালে নব্য পতিপত্নীদের নিয়ে এই গাড়ির ফিরে যাবে নিয়ম রক্ষা করতে। আবসার সাহেব, শাহিদা আর মাহফুজা নতুন আত্মীয়র ব্যবহারে দারুন অপ্রস্তুত হয়েছিলো। তাদের আত্মীয়ের সামনে একেবারে নাক কেঁটে গেলো। অনুষ্ঠানের বাকি সময়টুকু তাদের কেমন গেলো, তা শুধু তারাই বলতে পারবে।
উষির আর রাশার জন্য বাসরঘর সাজানো হয়েছে কাঁচা রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুল দিয়ে। লেট করে হলেও সাজানো বাসরঘর থেকে বেশ উৎফুল্ল হলো উষির, আর বিরক্ত হলো রাশা। তার প্রচন্ড মাথা ধরেছে। এখন একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে একটা লম্বা ঘুম দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। সাজগোজ খুলে লম্বা শাওয়ার নিলো তো বটে কিন্তু ঘুমানোর আগেই উষির এসে হাজির৷ বেচারা বউকে একটু শান্তিতে দেখতে পর্যন্ত পারেনি। দেখার আশায়ই এসেছিলো৷ সাজগোছ খুলে ফেলেছে সেখে আশাহত হলো। বেশ হম্বিতম্বি করে বললো,
–তুমি চেঞ্জ করলে কেনো? জানো না, স্বামীকে না দেখানো পর্যন্ত সাজগোছ খুলতে হয় না।
–হাজারখানেক যে ছবি তোলা হলো, ওর মধ্যে থেকে একটা নিয়ে বসে বসে দেখো যাও।
প্রচন্ড এই মাথা ব্যাথায় কথা বলতেও বিরক্ত লাগছে। ঝগড়া করা তো দূরের কথা। উষির রাশার অবস্থা দেখে অসুস্থতার কথাটা আন্দাজ করলো৷ কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
–মাথা ব্যাথা করছে?
রাশা চোখ বুজে মাথা নাড়লো। উষির দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাজানো গোছানো বাসরঘরের দিকে তাকালো। সুগন্ধি মোমের জন্য বেশি মাথা ব্যথা করছে মনে করে সেগুলো সরিয়ে ফেললো। রাশা ততক্ষণে শুয়ে পরেছে। উষির নিজের কাজ শেষে রাশার পাশ ঘেঁষে শুয়ে তার পাশ ফিরে রাখা মাথার উপর নিজের মাথা রেখে চোখ বুজলো। অল্প অল্প কষ্টও পাচ্ছে সে। সাজানো গোছানো বাসরে আজ তার বাসরই হলো না। বউ অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে। মাথায় চাপ লাগায় খানিক আড়াম পেলো রাশা। উষিরের হাতের উপর হাত রেখে মৃদুস্বরে বললো,
–ঘুমিয়ে পরো। কাল নর’কের ভেতর যেতে হবে।
উষির চমকে উঠে রাশার দিকে তাকালো। রাশার নিঃস্বাস ভারি হয়ে গেছে। অর্থাৎ সে ঘুমিয়ে পরেছে। নিজের বাড়িকে নরক বললো কেনো! একটু নাহয় রক্ষণশীল, নাহয় একটু বেশিই রক্ষণশীল। তাই বলে নিজের বাড়িকে নরক হয়! হয় হয়। উষির জানে সেটা। অনেক সময় নিজের বাড়িও নরক হয় যখন সেখানে জীবনের সব থেকে বেশি কষ্টটা পাওয়া হয়। তাহলে কত কষ্টই না সে পেয়েছে। মায়া হলো তার। রাশার নরম গালে কয়েকটা চুমু খেয়ে সিদ্ধান্ত নিলো, কোনদিন সে রাশাকে কষ্ট দেবে না। তার কষ্ট হলেও কষ্ট দেবে না।
চলবে…