তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-২৭+২৮

0
63

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৭

উষির তার বউকে ছাড়া থাকবে, সেটা তো হতেই পারে না৷ তাই বনে বাদারে ঘুরে সন্ন্যাসী হওয়া ক্যান্সেল করে রাত আটটার মধ্যে কাজ টাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আসলো। আর আসবে নাই বা কেন! বউয়ের টান বলেও তো একটা কথা আছে৷ ঘরে বউ রেখে কি আর বাইরে মন বসে!
উষির বউয়ের টানে ফিরলেও রাশা বরের টানে মোটেও তার মুখোমুখি হলো না। উষির ঘরে থাকলে রাশা লিভিংরুমে বসে শাশুড়িদের সাথে টিভি দেখে, আবার উষির সেখানে হাজির হলে সে উঠে যায় বন্যা বৃষ্টিকে পড়ায় সাহায্য করতে৷ এখন ছোট বোনদের মাঝে গিয়ে তো বউকে আনা যায় না৷ চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে। তাই মুখ গুজে নিজের ঘরেই পরে রইলো। ঘরে থেকেও চুপ করে রইলো না। একজন কর্তব্যপরায়ণ স্বামী হিসেবে বউকে রোম্যান্টিসিজম শেখানোটা তার মৌলিক দ্বায়িত্ব। তাই খুঁজে খুঁজে বলিউডের বেশ কয়েকটা নতুন পুরাতন রোম্যান্টিক মুভির লিস্ট তৈরি করলো। হলিউডের মুভি সেই লিস্টে জায়গা পায়নি৷ সে অতি লজ্জাশীল পুরুষ৷ বউয়ের সাথে হলিউডের মুভি দেখতে লজ্জা লাগবে৷ তাই ওটা ক্যান্সেল। মুভির লিস্ট তৈরি করার পর বেশ উৎসাহ নিয়ে রাশার অপেক্ষা করলো। ঘড়িতে তখন সারে দশটা বাজে। উষিরের মুভি দেখার আয়োজন করা শেষ। সুন্দর দেখে একটা পাতলা কম্ফোর্টার আর বেশ কয়েকটা রঙিন কুশন সোফাতে সাজিয়ে রেখেছে। কিছু আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার এলোমেলো ভাবে সোফা টেবিলের উপর রেখেছে। সব শেষে খাবার এনে ওখানে রাখবে। লিস্টের কোন মুভি আগে দেখবে সেটাও লিস্ট করে রেখেছে। রাশা আসলো রাতের খাওয়ার পর। এসে এসব সাজগোছ দেখে ভ্রু বেঁকিয়ে উষিরের দিকে তাকালো। উষিরের ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা থাকলেও বাইরে খুব গম্ভীর হয়ে রইলো। রাশার তাকানো দেখেও ভাবান্তর হলো না। আগের মতোই সোফার দুই পাশে দুই হাত উঁচু করে রেখে আর্টিফিশিয়াল ফুল রাখা টেবিলের উপর দুই পা তুলে বসে রইলো। রাশা শব্দ করে শ্বাস ফেলে উষিরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো,

–তোমার যদি লেট নাইট টিভি দেখার প্ল্যান থাকে তাহলে আগেই বলে দাও, আমি বন্যা বৃষ্টির রুমে যাচ্ছি।

উষির পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলো। শার্টের কলার ঠিক করে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

–ইতিহাস বলেছে, মিসেস আদনান একদম রোম্যান্টিক না। তাই তাকে রোম্যান্টিক বানানোর দ্বায়িত্ব মিস্টার আদনানের। সো, আজ সারারাত আমরা দুইজন রোম্যান্টিক মুভি দেখে তোমাকে রোম্যান্টিসিজম শেখাবো৷

রাশা ভ্রু বেঁকিয়ে তাকিয়ে হাত ভাজ করে বললো,

–তা এর মাঝে কোন কোন অ্যাডাল্ট মুভির জায়গা হয়েছে?

উষিরের মুখ রাঙা হয়ে উঠলেও প্রকাশ করলো না। ধমক দিয়ে বললো,

–মাথার মধ্যে সবসময় উল্টাপাল্টা চিন্তা ঘুরঘুর করে নাকি? আমি সুশীল, সামাজিক, ফ্যামিলি পার্সোন। আমার বউ আমার সম্পর্কে এমন ধারণা রাখে, সেটা বাইরের মানুষ জানলে কি ভাববে? কথাবার্তা, পরিস্থিতি, আচার-আচরণের মধ্যেও রোম্যান্টিসিজম আছে। সেটা ভুললে চলবে না। এই ভদ্র উষির তার বউয়ের সাথে বসে অ্যাডাল্ট মুভি দেখবে! ছি ছি ছি!

বেশ নাটকীয় ভাবে বললো উষির। রাশা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

–তাহলে কি একা একা দেখবে?

উষিরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। তারপর আগের থেকেও জোরে ধমক দিয়ে বললো,

–কিচেন থেকে স্ন্যাকস নিয়ে এসো। আমি এতো কাজ করে ক্লান্ত। বাকি কাজ তোমার।

রাশা হাই তুললো। অলস পায়ে উষিরের স্টাডি টেবিল পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে একটা মোটা বই হাতে নিয়ে আবার তার কাছে ফিরে বই বাড়িয়ে দিয়ে ধরলো। উষির ভ্রু কুঁচকে বইয়ের দিকে তাকালো। বইয়ের নাম,

“আইকিউ বাড়ানোর নিঞ্জা টেকনিক।”

উষির সাংঘাতিক রেগে গেলো। আবার! আবার সেই একই কাজ! তার অ্যাবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন! চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ক্রোধ মিশ্রিত স্বরে বললো,

–তুমি আমার রেজাল্ট জানো? সবসময় টপ করতাম আমি। গ্র‍্যাজুয়েশনেও কয়েক পয়েন্টের জন্য টপ করতে পারিনি। পুরো গোল্ডেন সার্টিফিকেট আমার।

রাশা মোটা বইটা উষিরের হাতে তুলে দিয়ে বললো,

–আউট নলেজ না থাকলে ওইসব সার্টিফিকেটের বড়াই করে লাভ নাই। প্রতিদিন দশ পৃষ্ঠা করে পড়বে।

উষির বইটা শক্ত হাতে ধরে চোখ মুখ লাল করে বললো,

–তুমি আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করছো রাশা?

ক্রোধে জর্জরিত ভয়ংকর কণ্ঠস্বর ছিলো তার। রাশা পাত্তাই দিলো না। হাই তুলে বললো,

–আরেকটা রিডল বলছি। দেখি পারো নাকি! এক বাড়িতে পাঁচটা বোন ছিলো। পাঁচ বোনের মধ্যে হিয়া রান্না করছিল, মনা ইস্ত্রি করছিল, টিয়া দাবা খেলছিল, প্রিয়া হোমওয়ার্ক করছিল, তাহলে শুভা কি করছিল?

উষির উত্তর দিলো না। থমথমে মুখে শক্ত হয়ে সোফায় বসে পরলো। রাশা ঠোঁট টিপে হাসলো। সারাদিন দৌড়ঝাঁপ পারায় প্রচন্ড ক্লান্ত সে। নরম বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিতেই শান্তিতে চোখ বুজে আসলো৷ উষিরের মনে হলো বইটা ছুড়ে ফেলে দিক। কিন্তু পরক্ষণেই বুকে জড়িয়ে ধরলো। বউয়ের থেকে পাওয়া প্রথম উপহার এটা। যা খুশি না হয় হোক, তাতে কিই বা যায় আসে। তবে রাশার শান্তি তার সহ্য হলো না। তাকে সেই সকাল থেকে অপমানের উপর অপমান করে এখন শান্তিতে শুয়ে পরেছে! একজন সফল নেতা হিসেবে বিরোধীদলীয় কাউকে শান্তিতে রাখলে সফল নেতার ঘুম কিছুতেই আসবে না। তাই গলা উঁচিয়ে বললো,

–তোমার সৌরভ তো এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত মুখ।

রাশা চট করে চোখ খুলে ধপ করে উঠে বসে তার দিকে তাকালো। চোখে বিষ্ময় আর প্রশ্ন একসাথে খেলা করছে। উষির শয়তানি হেসে ফোন আর বই হাতে রাশার পাশাপাশি বসে নিজের ফোন তার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। ফোনে নিউজটা দেখেই রাশার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো। শকিং নিউজটা হলো, সৌরভ এখন বিবাহিত। আর কিভাবে বিবাহিত হলো, সেটা আরো বড় শকিং নিউজ। শহরের ভদ্র একটা এলাকায় গোপনে একটা কুখ্যাত নাইটক্লাব তৈরি হয়েছিলো। কথাটা জানাজানি হওয়ায় সেখানকার ভদ্র এলাকাবাসীরা প্রচন্ড খেপে প্রতি জোড়ায় জোড়ায় বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, তাদের মধ্যে সৌরভও ছিলো।

নিউজ পরে বেশ রেগে গেলো রাশা। তেঁতে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–সৌরভ অনেক ভালো আর ভদ্র ছেলে৷ নাইট ক্লাব কি, ও তো কোনদিন কোন ক্লাবেও যায়নি। আর এই কাজটা! এমন কাজ কোন বিবেকবান কেউ করতেই পারে না। এসব আবার কি ধরনের কথা হলো! নাইটক্লাবে দেখলাম আর বিয়ে পরিয়ে দিলাম। মানে বিয়ে হলেই মানুষ ভদ্র হয়ে যায়! তারপর আর কিছুই করে না! এসব ইচ্ছে করে করা। দে যাস্ট ডিড ইট টু মেক আ জোক। রিডিকিউলাস!

উষির ভ্রু কুঁচকে রাগী গলায় বললো,

–জেলাসি হচ্ছে নাকি?

রাশা রেগে উষিরের দিকে তাকালো। কিছু বলতে চাইলো কিন্তু ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

–এসব তুমি করেছো তাই না? একজন মানুষের সম্মান কতটা ইম্পর্ট্যান্ট তা জানো তুমি? তুমি ওর সম্মান নিয়ে খেলেছো উষির। হ্যাভ ইউ এনি আইডিয়া, তুমি কি করেছো? হাউ কুড ইউ ডু দ্যাট উষির!

রাশা দুই হাত দিয়ে নিজের কপাল চেপে ধরলো। উষিরের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। নিজের চুলে হাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করে আড়াম করে বসে বললো,

–আর ও যে আমার সম্মানের দিকে হাত বাড়িয়েছিলো? আমার সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেললো, তার বেলা?

–তোমার কি সম্মান নিলো?

–আমার বউ নিতে চেয়েছিলো। বউ তো সম্মানই তাই না?

রাশা থমথমে মুখে উষিরের দিকে তাকালো। বইয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া উষিরকে দেখে মনে হলো, তার আর অন্য কোনদিনে নজর দেওয়ার সময় নেই। আর না দেবে৷ দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে ধাপ করে শুয়ে পরলো। কম্ফোর্টার দিকে মাথা ঢেকে শক্ত গলায় বললো,

–লাইট অফ করো?

উষির বইয়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই শান্ত গলায় বললো,

–পড়বো আমি। সো, লাইট জ্বলবে।

রাশা কম্ফোর্টার মাথা থেকে সরিয়ে চোখ গরম করে উষিরের দিকে তাকালো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে তার থেকে মনোযোগী স্টুডেন্ট আর একটাও নেই৷ রাশা বড় করে শ্বাস ফেলে ধমকের সুরে বললো,

–ওকে। বেস্ট উইসেস!

বলেই বেড সাইট ড্রয়ার থেকে স্লিপিং আই ক্যাপ বের করে চোখে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। উষির থমথমে মুখে সেদিকে তাকিয়ে বইটা ঠাস করে বন্ধ করে লাইট বন্ধ করলো। তার বেলায়, বিয়ে করে নিয়ে আসো আর সৌরভের বেলায়, বিয়ে করলো কেন! সাংঘাতিক হিপোক্রিট এই বউয়ের উপর সে প্রচন্ড রেগে আছে। গিজগিজ করতে করতে পণ করল, আজকে আসুক কাছে৷ একদম ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেবে। কিন্তু উষির কি আর সেটা পারে! শুয়ে পরার ঘন্টাখানেক পর রাশাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজেও ঘুমিয়ে পরলো। উষিরের রাগ গেলো নদীতে পরে গেলো৷ একমাত্র এখানে এসেই যে তার রাগ নাই হয়ে যায়। কি এক সমস্যা!

*****
উজান আসলো আরো দুইদিন পর৷ ততদিনে নোঙরের হাল বেহাল। রুপচর্চা করতে মন চায় না, খেয়ে মন চায় না, কথা বলতে মন চায় না, সাজতে মন চায় না ইত্যাদি ইত্যাদি! এই এতোদিনে একটাবারের জন্যেও উজান তার খোঁজ নিলো না! কি পাষা’ণ, নি’ষ্ঠুর! মনে মনে রেগেও ছিলো এই নিয়ে। তবে তাকে অফিসে দেখেই মন প্রফুল্ল হয়ে গেলো। সেদিন পুর্বের সকল রেকর্ড ভেঙে সারে নয়টার মধ্যে অফিসে এসেছিলো সে। আর সেদিনই পরে এসেছিলো তার সব থেকে অপছন্দের ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের লং শার্ট। গলায় ছিলো সব থেকে অপছন্দের বাহারি রঙের স্কার্ফ। নিজের কাজের প্রতি নিজেই রেগে গেলো। কি দরকার ছিলো এমন পোশাক পরার৷ নিজের শোককে জাহির করার কি কোন দরকার আছে! কেউ কি আর তার শোক নিয়ে ভাবে!

উজান এসেই তাহেরকে দিয়ে নোঙরকে ফাইলসমেত ডেকে পাঠালো। সেখানে যাওয়ার আগে তার তো একটু ঠিকঠাক হওয়া দরকার। তাই তার সাতশো টাকার লেদারের হোবো হ্যান্ডব্যাগ থেকে প্রথমে আয়না তারপর লিপিস্টিক আর কমপ্যাক্ট পাউডার বের করলো। আয়না মুখের সামনে ধরেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আজ কতদিন হলো রুপচর্চা করে না! এই অবস্থায় এখন উজানের কাছে যাবে! তার সম্মান কই থাকবে! মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো। তবে নোঙর খন্দকারকে তো আর অসম্মান করা যায় না। তাই তাকে সম্মানিত করতে মুখে পাউডার মেখে একটু লিপস্টিক লাগালো। এমন ভাবে লাগালো যাতে বোঝা না যায়৷ তারপর কাজলের কথা মনে পরলো। ব্যাগ হাতরে কাজল না পেয়ে পাশের ডেস্কে বসা মমোর দিকে উঁকি দিলো। মমো তখন মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। কাজলের কথায় ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বললো,

–কাজল তো নেই৷ তুমি কি করবা?’

মনে মনে বিরক্ত হলো নোঙর৷ কাজল দিয়ে মানুষ করেটা কি!

–আঁকাবো। একটা ইম্পর্ট্যান্ট ড্রয়িং করছিলাম। কাজলের অভাবে কমপ্লিট হচ্ছে না।

–কি ড্রয়িং? দেখবো।

উঁকি দিতে চাইলো মমো। নোঙর দুই হাত দিয়ে টেবিল আড়াল করে বললো,

–কাজল দিয়ে কমপ্লিট করে তারপর দেখাবো। এখন না।

হতাশ হয়ে মাথা নাড়লো মমো। তারপর নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। অপরদিকে নোঙরের প্রচন্ড মন খারাপ হলো। কাজল ছাড়া আবার সাজ কমপ্লিট হয় নাকি! তার উপর ড্রেস! আজ বাড়িতে গিয়েই ড্রেসটা পুড়িয়ে ফেলবে!
ঝুঁটি করা চুলগুলো খুলে ব্যাগ খুঁজে ক্ল্যাচার বের করে অর্ধেক চুল বেঁধে ফেললো৷ তারপর সব জিনিস ব্যাগে পুরে বড় করে শ্বাস নিয়ে ফাইল হাতে চললো উজানের কেবিনে।
উজানকে দেখে নোঙরের চোখ জুরিয়ে গেলো। কালো ব্লেজারে কি অসাধারণই না দেখাচ্ছে৷ তার চোখে তো অসাধারণই লাগছে৷ বাকিদের খবর জেনে তার কি লাভ! ইচ্ছে হলো, একবার কেমন আছে জিজ্ঞাসা করুক। আমার মন বাঁধা দিলো। বললো, আগে সামনের জনকে বলতে দে। তারপর তুই বল।

উজান জমে থাকা ফাইল দেখছিলো। নোঙরের আগমন টের পেয়ে মাথা তুলে তাকালো। পাঁচটা ফাইল হাতে ভ্যাবলার মতো তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছোট ছোট চোখগুলো কুঁচকে বললো,

–হোয়াট হ্যাপেন্ড? এমন স্টাক হয়ে গেছো কেনো? আজ কি বসার জন্য ইনভিটেশন কার্ড পাঠাতে হবে?

অন্য সময় হলে নোঙর মুখের উপর জবাব দিয়ে বসতো। কিন্তু এখন সে তার তীব্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে৷ এমন সুখ সুখ অনুভূতির সময় কারো সাথে তর্কে জড়াতে ইচ্ছে হয় না৷ তাই চুপচাপ হজম করে নিলো। যদিও হজম করতে কষ্ট হয়েছে খুব, তাও হজম করে চেয়ার টেনে বসে পরলো। আর যেনো কষ্ট না হয় কিংবা আগের কষ্টটা খানিক লাঘব যাতে হয় তাই টেবিলের উপর ধপ করে ফাইল রেখে দিলো৷ উজান শব্দ শুনে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার ফাইলে মনোযোগ দিলো। নোঙরের ভারি মন খারাপ হলো৷ এতো কষ্ট করে সেজে গুজে এসেছে অথচ তার কয়েকদিনের পুরোনো বর একবারও চোখ তুলে তাকালো পর্যন্ত না! এখনও গা দিয়ে বিয়ে বিয়ে গন্ধ যায়নি। আর এই কয়েকদিনেই এতো বিতৃষ্ণা! সামনের দিনগুলো তো পরেই আছে! আহারে! বিবাহিত জীবন কি কষ্টের!

অনেকক্ষণ পরেও যখন উজান কিছু বললো না তখন নোঙর গলা খাঁকারি দিয়ে ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললো,

–এইযে তোমার গুপ্তধন। অনেক কষ্টে সব কমপ্লিট করেছি।

–আর ইউ সিওর এটা তোমারই কমপ্লিট করা?

ফাইলে চোখ রেখেই উজান প্রশ্ন করলো। নোঙর পুরো কনফিডেন্সের সাথে উত্তর দিলো,

–এক হাজার পার্সেন্ট সিওর। আকাশ বাতাস সাক্ষী।

–তোমার আকাশ বাতাস তোমার মতোই মিথ্যা কথা বলে। আই হ্যাভ এনাফ প্রুভ। তুমি এগুলো কমপ্লিট করোনি।

নোঙর নাকে কেঁদে বললো,

–মিথ্যা অভিযোগ দেবে না বলছি!

উজান কিছু না বলে স্থির দৃষ্টিতে নোঙরের দিকে তাকিয়ে টেবিলে রাখা মনটর তার দিকে ঘুরিয়ে দিলো। মনিটরে দৃষ্টি দিয়েই নোঙরের শরীর বেয়ে শিহরণ খেলে গেলো৷ তার মানে তার সাজগোছও দেখেছে! কি ভয়ংকর!

–তুমি আমাদের উপর নজর রাখো?

–তোমার মতো অফিসচোর থাকলে নজর তো রাখতেই হয়। কিছু করার নেই।

নোঙরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। উজান ঠোঁট টিপে হাসি আটকে অত্যান্ত সিরিয়াস ভাবে বললো,

–তুমি না চাকরি ছেড়ে দিলে?

ফুঁসে উঠলো নোঙর। পুরোনো ঘায়ে খোঁচা পরলে যে কেউ ফুঁসে উঠবে। এতে তার কোন দোষ নেই। সুখ সুখ অনুভূতিরা কোথায় যে মিলিয়ে গেলো! হয়তো ভয় পেলে পালিয়ে গেলো। হাজার হলেও নোঙর খন্দকারের ফার্স্ট প্রায়োরিটি প্রতিশোধ নেওয়া।

–তুমি…তুমি এক নম্বরের দুই নাম্বারি করা লোক। লোকের টাকা মেরে খাওয়া তোমার স্বভাব।

উজানের চোখ কপালে উঠে গেলো,

–এসব কথা কোথা থেকে শিখেছো?

–তোমার মাথা থেকে।

নোঙর ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলেই উঠে চলে গেলো৷ আজ এখানে তার কতো অপমান হলো! এতো অপমান সহ্য করা যায় নাকি! দুই পা যাওয়ার পর উজান পিছু ডাকলো৷ নোঙর অভিমানী চোখে পিছু ফিরলো। মনে মনে ভাবলো হয়তো বলবে, আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে নোঙর। কিন্তু তার আশার গুড়ে বালি পরতে সময় লাগল না৷ তার গায়ের জ্বালা আর অপমানের পারদ বাড়িয়ে উজান নিজের কপালের ডান সাইডে আঙুল দেখিয়ে বললো,

–এখানে পাউডার লেগে আছে। মুছে নাও৷

নোঙর এবারে কেঁদেই ফেললো। চোখের পানি গাল বেয়ে পরার সাথে সাথে চোখের পানি মুছে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যেতে যেতে কপালের পাউডার তো মুছলো। সাথে উজানকে হাজার কথা শুনাতে আর খট করে সর্ব শক্তি দিয়ে দরজা লাগাতে ভুললো না।

নোঙর আর উজানের আবার দেখা হলো অফিস ক্যাফেতে। নোঙর তার নিজের জন্য কফি বানাতে এসেছিলো। সে যাওয়ার পরপরই উজানও সেখানে আসলো৷ নোঙরের রাগ তখন একদম নেই। কোন এক অজানা অনুভূতি উজানের উপর হওয়া রাগ গ্রাস করে নিয়েছে। বরং তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হলো খুব।

–তুমি এখানে! কফি খেতে এসেছো নাকি?

উজান বিরক্ত হয়ে ব্যাজার মুখে বললো,

–না তোমাকে দেখতে এসেছি।

–আগে বলবে না? আজকে তো ফেসিয়ালও করিনি।

বলতে বলতে পিছন ঘুরে আয়নার মতো ঝকঝকে কিন্তু ঝাপসা টাইলসের দেওয়ালে নিজের চেহারা দেখতে লাগলো। মনে মনে বললো, কতদিন হলোই তো করি না!

–এমনিতেই তো বাদুরের মতো উড়ে উড়ে চলো। ওসব লাগালে তো প্যাঁচার মতো মুখ ভোতা করে বসে থাকতে।

উজানের কথায় না রেগে আরো খুশি মনে বললো,

–আচ্ছা যাই হোক, আজ আমার মুড অনেক ভালো। তাই ঝগড়া ঝাটিতে আমি যাচ্ছি না। কফি খাবে তো? আমি বানিয়ে দিচ্ছি।

–আমার এতো উপকার তোমাকে করতে হবে না। আমি নিজের কাজ নিজেই করতে পারি।

নোঙর সজোরে মাথা নেড়ে কাউন্টার আড়াল করে দাঁড়িয়ে পরলো,

–বললাম না আমি বানিয়ে দিচ্ছি। এমনিতেও আমি নিজের জন্য কফি বানাচ্ছিলাম।

উজান এগিয়ে যেতে নিয়েও থেমে গেলো। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললো,

–তোমার কফির জন্য পানি গরম করার কি দরকার? খাও তো সেই ঠান্ডা করেই। ঠান্ডা পানিতেই কফি গুলিয়ে খাও।

নোঙরের কপাল কুঁচকে গেলো। কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,

–আমার যতদূর মনে পরে, তোমার সামনে তো কখনোই চা কফি খাইনি। তাহলে তুমি কিভাবে জানলে, আমি ঠান্ডা করে কফি খাই?

–তোমার মতো উদ্ভট মানুষের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যায় না। কফি বানাতে আর কয় ঘন্টা লাগবে?

সে প্রথমটায় থতমত খেলেও কৌশলে নিজেকে বের করে আনলো। হাজার হলেও নোঙর খন্দকারকে তো আর বলা যায় না, মনিটরে তার গতিবিধির নজর খুব তীক্ষ্ণভাবেই রাখা হয়!

–পানি অলমোস্ট গরম হয়ে গেছে। আচ্ছা তুমি বেশি কফি খাও নাকি কম কফি? মানে অনেকে আছে, বড় মগে কফি খায়। আবার অনেকে দুই চুমুকে কফি শেষ, এমন কাপে খায়। তুমি কোন টাইপের মানুষ?

উজান কেবিনেট থেকে নিজের কফি কাপ বের করে নোঙরের সামনে শব্দ করে রাখল,

–এইটাতে।

নোঙর কাপ নাড়াচাড়া করে বললো,

–ওহ! বেশ বড়সড় আছে। ওকে তো স্ট্রং কফি খাও নাকি লাইট কফি খাও?

–এক্সপ্রেসো। কফিমেকারে বানায়। এটাতে হবে না।

নোঙর বিরক্তিকর শব্দ করে বললো,

–ওসব বিদেশি কফি বিদেশেই রেখে আসতে হয়৷ তোমাকে খাঁটি দেশি উপায়ে কফি বানিয়ে খাওয়াচ্ছি৷ একবার খাবে আর দশবার ঢেঁকুর তুলবে।

উজান কিছুই বললো না। হাত ভাজ করে কিচেন কাউন্টারে হেলান দিয়ে এক পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পানি গরম হলে নোঙর আমতা-আমতা করে বললো,

–আমি এক্সপ্রেসো বানাতে পারি না। শুধু গরম পানিতে কফি গুলিয়ে দিলে হবে না?

–হ্যাঁ হবে। একটু স্ট্রং বানাও। তাহলেই হবে।

উজানের কথা শুনে তার মন হালকা হয়ে গেলো। দ্বিগুণ উৎসাহে বললো,

–কেমন স্ট্রং? মানে এই কাপে কয় চামচ কফি দেবো? দুই নাকি তিন?

–তিন।

নোঙর ভাবুক গলায় ঠোঁট উলটে বললো,

–হুম,ভালোই স্টং কফি খাও তাইলে! দুধ কফি নাকি ব্ল্যাক কফি?

–তোমার বানাতে হবে না। সরো, আমি বানাচ্ছি।

উজান বিরক্ত হয়ে এগিয়ে আসছিলো। নোঙর দুই হাত আগলে দাঁড়ালো,

–না, আমি বানাবো। তুমি বলো?

উজান তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

–ব্ল্যাক কফি।

–চিনি খাও? নাকি পিওর ব্ল্যাক? মানে চিনির কোন ঝমেলা নাই?

–চিনি খাই না আমি।

উজান দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর করলো।

কফি বানানো শেষে উজানকে কাপ দিতে দিতে বললো,

–নাও হয়ে গেছে। খেয়ে বলো আমি কেমন শেফ?

উজান টিটকারি দেবার ভঙ্গিতে বললো,

–শেফ! পুরোটা আমি বলে দিয়েছি।

–সেটা না হয় বলেছো কিন্তু পানি গরম করার মধ্যেও টেকনিক আছে। বেশি গরম করলে কফি সিদ্ধ সিদ্ধ লাগে। আবার কম গরম করলে একদম ভালো লাগে না। পানি পারফেক্ট গরম করলে তবেই কফির আসল স্বাদ পাবে।

নোঙর মাথা নেড়ে প্রতি উত্তর করলো। তারপর বেশ মন খারাপের ভঙ্গিতে বললো,

–বলো না কেমন হয়েছে?

–হুম ভালো।

নোঙর দাঁত বের করে হাসলো। তারপর এগিয়ে এসে উজানের সামনে হাত পেতে বললো,

–তাহলে গিফট দাও।

উজানের কপাল কুঁচকে গেলো,

–কিসের গিফট?

–বিয়ের পর প্রথম রান্না করে খাওয়ালাম। তার গিফট।

–এটা রান্না ছিলো?

নোঙর মাথা উপর নিচ করে ঝাঁকিয়ে বললো,

–আগুনের তাপে যে খাবার জিনিসই তৈরি করা হয়, সেটাই রান্না।

উজাম নোঙরের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে গেলো। নোঙর মুখ ভেঙচে বললো,

–অকৃতজ্ঞ মানুষ থাকেই আলাদা।

বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে উঠতেই উজান নোঙরের দিকে একটা গিফট বক্স এগিয়ে দিলো। মৃদুস্বরে বললো,

–তোমার গিফট।

উজানের কথা শুনে নোঙরের চোখ খুশিতে ঝকমক করে উঠলো। গিফট খুলে দেখলো, সিলভার কালার চেইনের সাথে ল্যাভেন্ডার স্যাফায়ারের একটা ছোট পেন্ডেন্ড। সাথে ম্যাচিং ছোট কানের দুল। খুশিতে নোঙরের চোখ চকচক করে উঠলো। উজান বলতে পারলো না, তার জন্যই স্পেশাল অর্ডার দিয়ে এই জুয়েলারি বানানো হয়েছে। আর এই ছোট জুয়েলারি বানানোর জন্যই তার ফিরতে এতো দেরি হলো।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৮

একবার কফি বানিয়েই নোঙরের কনফিডেন্স লেভেল এখন আকাশ চূড়ায়। বর্তমানে তার প্রধান ইচ্ছে, উজানকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে। আফটার অল, সে কত ভালো একজন শেফ! এতোদিন অন্য সবাইকে রান্না খাইয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এবারে বরের পালা! প্রশংসা তো আর এমনি এমনি আসে না। একটু কষ্ট করলে, একটু খাটনি করলে তবেই না সেটি পাওয়া যায়।
নোঙর বরাবরই নিজের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এবারে দিলো। সকালে উঠে বহুদিন পর মুখে শসা আর মধুর ফেসপ্যাক লাগালো। তারপর ঘুরে ঘুরে একে একে সবাইকে জানাতে লাগলো, আজ সে রান্না করবে। তবে সেটা সবার জন্য নয়। শুধুমাত্র উজানের জন্য। যদিও উজানের কথাটা শুধু মা আর বড় মাকে জানিয়েছে। বাকিদের বলেছে, আজ সে নিজে খাবার বানিয়ে সেই খাবার অফিসে নিয়ে যাবে। নোঙরের রান্নার খবরে সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিলো অন্তু। সেই তার রান্নার সব থেকে বড় ফ্যান। কিন্তু যখন শুনলো, রান্না করে কাউকে খেতে দেবে না, সবটা নিয়ে অফিসে যাবে তখন মুখ ফুলিয়ে হুলোর কাছে গিয়ে বসে রইলো। হুলো গোলগাল লম্বা চুলওয়ালা অন্তুর দিকে গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

নোঙরের আজকের মেন্যুতে খাবার একটাই। সুজির হালুয়া। তার পরিবারের ধারণা, যে একবার ওই হালুয়া খেয়েছে সে আর সেটার টেস্ট সহজে ভুলতে পারবে না। খারাপের দিক থেকে না, ভালোর দিক থেকে। এতোটাই অসাধারণ হালুয়া সে বানায়। বহুবার বানানোতে খুব ভালো এক্সপেরিয়েন্সও আছে। হাজার হলেও বরের জন্য দ্বিতীয়বার রান্না করছে। যেটাতে এক্সপার্ট, সেটাই তো করতে হবে। তাই হালুয়াই রান্না করতে চাইলো। নোঙরের যে কোন রান্নার ফুড টেস্টার হলো অপলা। রান্নার মাঝে দুধে চিনির পরিমাণ ঠিক আছে নাকি চেক করার জন্য চামচে অল্প দুধ নিয়ে তার কাছে গেলো। ভাগ্য খারাপ ছিলো তার। ঠিক ওই সময়ই তার বড় বাবা রান্নাঘরে আসলো। নোঙরের রান্না করা হালুয়া তারও সব থেকে বেশি পছন্দের। তাই একবার চেক করতে চাইলো। চামচে করে মুখে পুরতেই মুখ কুঁচকে ফেললেন তিনি। হালুয়ায় চিনি, লবন কিচ্ছু ঠিকঠাক হয়নি। তাই চামচ ভর্তি করে লবন আর চিনি দিয়ে দিলেন। নোঙরের রান্নার হাত যেমনই ভালো, তার বড় বাবার রান্নার হাত তেমনই খারাপ। যদিও তিনি সেটা মানতে নারাজ। তার রান্না কেউ খেতে পারে না সেটা তো তার দোষের না। যারা তার রান্না খেতে পারেনা তাদের সবার টেস্টবার নষ্ট। এমনটাই তার বক্তব্য। তিনি নিজের কাজে কোনদিন গাফিলতি করে না। আজও করলেন না৷ নিজ দ্বায়িত্বে ভাতিজির রান্না আরো সুস্বাদু করে বুক ফুলিয়ে চলে গেলেন তিনি। তিনি যাওয়ার পর অন্তুর আগমন ঘটলো। বাড়িতে নতুন কিছু রান্না হবে আর সে তা পাবে না, এটা তো হতেই পারে না। হালুয়া কিভাবে খাওয়া যায়, এটা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ হুলোর সাথে আলোচনা করে এরপর খাবার চুরি করতে এসেছে।
চুলার আঁচ বন্ধ ছিলো। অন্তু ভাবলো রান্না হয়ে গেছে। আবার টলটলে দুধ দেখে মনে করলো পাতলা হালুয়া রান্না হয়েছে। সুতরাং ওটা এখন খাওয়াই যায়। বড় তরকারির চামচে দুধ তুলে মুখে দিতেই থুথু করে ফেলে দিলো। এতো জঘন্য রান্না একমাত্র বড় বাবাই করতে পারে। তার বোন করেছে সেটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হলো। ভাবলো, ঠিক করতে হবে। খাওয়ার ভিডিওর মধ্যেও একদা এক ভিডিওতে সে দেখেছিলো তরকারিতে ঝাল বা লবন অতিরিক্ত হলে আলু কেঁটে দিলে ঠিক হয়ে যায়। সাজেশন ফলো করতে চাইলো। রান্নাঘর খুঁজে আলু বের করলো। গোল আলুর বদলে সবুজ সবুজ গাছ আলু গ্রেটারে গ্রেট করে দুধের সাথে মিশিয়ে দিলো। তারপর বড় বাবার মতোই বোনকে হেল্প করার গর্বে বুক ফুলিয়ে রান্নাঘর থেকে বিদায় নিলো৷ ঘন দুধের মাঝে আলুও সুন্দরমতো মিশে গেলো।

অপলাকে দিয়ে টেস্ট করিয়ে নোঙর বুঝলো লবন, চিনি সব কম হয়েছে। পানসে লাগছে খুব। এখন আবার লবন, চিনি দিয়ে জ্বাল দিতে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। ফেসপ্যাকটা আগে তুলতে হবে। তাই আগে ঘষে ঘষে আড়ামসে ফেসপ্যাক তুলে গোসল দিয়ে রান্নাঘরে গেলো। এরপর বন্ধ চুলা জ্বালিয়ে হাফ চামচ লবন, তিন চামচ চিনি দিয়ে সুজি দিয়ে তারপর চামচ হাতে তুলে নাড়াচাড়া শুরু করলো। রান্না শেষে নামানোর আগে কিসমিস দিয়ে নামিয়ে ফেললো৷ লবণ, চিনি আর আলুর কেরামতি একবারও নজরে পারলো না তার। এমনকি একবার টেস্ট করারও প্রয়োজন মনে করলো না। ওই যে, নোঙর খন্দকারের হাই লেভেলের কনফিডেন্স!

উজান যখন অফিসে পৌঁছালো তখন ঘড়িয়ে এগারোটা বেজে গেছে। তাকে এগারোটায় ঢুকতে দেখেই নোঙর মুখ ভেঙচে বিড়বিড় করে বললো,

–নিজে লেট করলে কিছুই না। আর অন্য কেউ লেট করলেই চাকরি খাওয়ার ভয় দেখায়। দুই নাম্বার মানুষ থাকেই আলাদা!

এইদিকে যে সে কত সকালে উঠে রান্না করে কত আগে এসে বসে আছে, সেইদিকে কারো কোন খেয়ালই নেই৷ “ফালতু মানুষ” বলে আবারও বিড়বিড় করে বললো সে৷ তারপর উজানের কেবিনে গেলো। সেখানে যেতেও আবার আরেক বাঁধা। তাহের মিয়া!

স্যার সবে এসেছে, এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ইত্যাদি বলে বলে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিলো। সেও তাহেরের দিকে একটু ঝুঁকে চোখ সরু করে শাসানি দিয়ে বললো,

–স্যারের মা আমার ফুপি হয়। স্যার আমার ফুপির ছেলে। একটা কল দেবো ফুপিকে৷ তারপর দেখবো আপনার চাকরি আপনার স্যার বাঁচাতে পারে নাকি।

তাহেরের মুখ ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। হম্বিতম্বি বন্ধ হলেও নিজের ইগো ধরে রেখে বললো,

–আগে স্যারের অনুমতি নিতে হবে। তারপর যেতে দেবো।

–তো যান।

বলেই রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ালো৷ তাহের মিয়ার যেতে যত সময় না লাগলো তার থেকেও তাড়াতাড়ি ফিরে এসে চোখ মুখ গম্ভীর করে বললো,

–যান।

নোঙর বিজয়ের হাসি হাসলো৷ তারপর বীরদর্পে কেবিনে প্রবেশ করলো। উজান তখন কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলো। তাকে দেখে ইশারায় বসতে বলে উঠে অন্যদিকে চলে গেলো। নোঙর চেয়ার টেনে বসে ব্যাগ থেকে হালুয়ার বাটি বের করলো। ততক্ষণে উজান কথা শেষ করে নিজের বরাদ্দ করা চেয়ারে এসে বসেছে। নোঙর উচ্ছ্বসিত চোখে বাটি আর চামচ তার দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,

–তোমার জন্য রান্না করেছি। নিজের হাতে৷

নিজের হাতে কথাটার উপর বেশ জোর দিলো। তারও তো জানা উচিৎ, তার বউয়ের কত্তো ট্যালেন্ট! আর সে কত ভালো রান্না করে সেটা খাবার খেলে এমনিতেই বুঝে যাবে। এটা আর বলার কি আছে! নোঙরের কথা শুনে একপলক তার দিকে তাকালো উজান৷ তার গলায় ল্যাভেন্ডার স্যাফায়ারের পেন্ডেন্ট জ্বলজ্বল করছে। মুচকি হেসে বাটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললো,

–কি রান্না করেছো?

–সুজির হালুয়া।

উত্তেজনায় নোঙরের গলার স্বর কেঁপে কেঁপে উঠছে। উজান আলতো হেসে বাটি থেকে এক চামচ হালুয়া নিয়ে মুখে পুরলো। সাথে সাথেই হাস্যজ্বল মুখটা বিকৃত করে টিস্যু হাতে নিলো। মুখের ওই অল্প সুজিটুকুও গলার মধ্যে গেলো না। টিস্যুর মধ্যে ফেলে পানি খেলো আগে৷ তারপর আরেকটা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,

–এতো বাজে রান্না কিভাবে করো? মুখ পুড়ে গেলো একদম।

নোঙর প্রথমটায় হতভম্ব হলো। তারপর ভাবলো উজান তার রান্না খাবে না জন্য এমন করছে। রেগে উঠলো। বাটি টেনে নিজের কাছে নিয়ে বললো,

–খেতে হবে না তোমার৷ জীবনেও আর তোমার জন্য রান্না করবো না।

শেষটায় কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো সে। উজানের মুখ এখনও সাংঘাতিক কুঁচকে আছে। ওভাবেই শক্ত গলায় বললো,

–করো না প্লিজ। এই রান্না দ্বিতীয়বার খেতে হলে আ’ত্মহ’নন ছাড়া আর পথ খোলা থাকবে না।

নোঙরর মুখ অপমানে থমথমে হয়ে গেলো। তার রান্নার এতো নিন্দা! এতোটা নিন্দা! অপমান সইতে না পেরে নাক টেনে সব গোছাতে লাগলো। উজান ভাবলো, নোঙর তাকে ইচ্ছে করে এমন খাবার খাইয়েছে। খাবারটা তারও খাওয়া উচিৎ। তাই বাঁধা দিয়ে বললো,

–কেমন রান্না করেছো সেটা আগে টেস্ট করো।

কথাটা মন্দ লাগলো না নোঙরের। রান্না টেস্ট করলেই না কথা শুনাতে ইজি হবে। নাহলে তো খোঁটা শুনতে শুনতে জীবন তামাতামা হয়ে যাবে। স্ব-গর্বে চামচ ভর্তি করে হালুয়া মুখে পুরলো সে। মিলি সেকেন্ডও গড়ালো না, তার আগেই বমির উপক্রম হলো তার। নোঙর এক কথায় রাজী হবে সেটা উজান ভাবেনি। খানিক অবাকই হয়েছিলো। এখন তার এই অবস্থা দেখে হাসি আটকে হাত দিয়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে বললো,

–ওয়াশরুম ওইদিকে।

নোঙর সেদিকে ফিরেও তাকালো না। বাটিতেই মুখের সুজি ফেলে দিলো। তারপর পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করলো। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো, উজান মিটিমিটি হাসছে। মূহুর্তেই মুখ শক্ত হয়ে গেলো। নিজের অপমান সহ্য করা যায় না। কিছু একটা দিয়ে ধামাচাপা দিতেই হবে। তাই নিজের ডান হাত বাড়িয়ে ধরলো। তারপর হাতের তালু দেখিয়ে বললো,

–ডান হাতের তালুতে তিল থাকলে নাকি রান্না ভালো হয়। আমার হাতেও ছিলো৷ যতদিন ছিলো ততদিন রান্না ভালো হতো৷ এখন আস্তে আস্তে তিল মুছে যাচ্ছে আর আস্তে আস্তে রান্নার কোয়ালিটিও খারাপ হচ্ছে।

তার কথায় উজানের হাসি আরো চওড়া হলো। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা মনে করে হুহা করে হেসে উঠলো। নোঙর রেগে বো’ম হয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর শক্তি দিয়ে চেয়ার সরাতে গিয়ে চেয়ার ফেলে দিলো। দরজাটাও ভাঙতে চেয়েছিলে, কিন্তু পারেনি। ব্যাগ, বাটি আর হাস্যরত উজানকে পিছনে ফেলে চলে গেলো কেবিন ত্যাগ করলো।

সেদিনের ঘটনা সেখানেই সমাপ্ত হয়নি। উজানের কেবিন থেকে বেরিয়ে বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু ব্যাগটা ওখানেই ফেলে এসেছে। এখন আবার গিয়ে ব্যাগ আনা মানে আবার অপমানের মুখোমুখি হওয়া। তাই নিজের ডেস্কে বসে লাঞ্চ ব্রেকের অপেক্ষা করতে লাগলো। তবে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সেখানে আসলো উজানের নোটিশ। ইমার্জেন্সি মিটিং হবে এখন। গোটা দশজনের নাম বলা হলো। সেখানে নোঙর, অমি, শামীম আর মমোর নামও ছিলো। যদিও নোঙরের মিনিংএ যাওয়ার এক ফোঁটা ইচ্ছাও ছিলো কিন্তু বাধ্য হয়ে যেতেই হলো।

সকালে হওয়া ছোট একটা মিনিংএ কোম্পানি একটা ছোট প্রজেক্ট পেয়েছে। উজান প্রজেক্টটা নিয়েছে নোঙরের জন্য। তাকে দিয়েই প্রজেক্ট কমপ্লিট করাবে। ইচ্ছেটা এমনই। তাই এই মিনিং ডেকেছে। কনফারেন্স রুমের ওই বদ্ধ ঘরে নোঙর চুপচাপ বসে রইলো। মন ভীষণ খারাপ। কারো দিকে না তাকিয়ে অভিমানে মাথা নিচু করে টেবিলে আঙুল খুঁটতে লাগলো৷ নাটকে সিনেমায় কত দেখায়, বউয়ের খারাপ রান্নাও হাজবেন্ড কি সুন্দর করে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নেয়। তার রান্না অমন করে খেলে কি এমন হতো! কি এমন খারাপ রান্নাই বা হয়েছে? একটু লবন বেশি হয়েছে আর কেমন একটা অদ্ভুত টেস্ট। আর লবনের জন্য চিনি বোঝা না গেলেও চিনি বোধহয় ঠিকি ছিলো। এতোটা খারাপ রান্নাও তো সে করেনি৷ ধুর! একটু কেয়ারও নেই তার উপর৷ সারাক্ষণ শুধু হৃদয়ভাঙা কাজ করতে থাকে!

মিটিং এ উজান এক দীর্ঘ বক্তৃতায় প্রজেক্টের কাজ বুঝিয়ে, গুরুত্ব বুঝিয়ে দ্বায়িত্ব দেওয়ার সময় নোঙরের দিকে তাকিয়ে বললো,

–আজকের প্রজেক্টের দ্বায়িত্ব নেবেন মিসেস নোঙর খন্দকার।

তারপর গভীর অথচ ক্রুর চোখে নোঙরের দিকে তাকালো উজান। চোখে চাপা শয়তানি হাসি। দ্বিতীয় হৃদয়ভাঙা ঘটনা ঘটার পর পর নোঙরের শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো৷ আড়চোখে অমির দিকে তাকালো। অমির ফ্লাটিং বেশ ইঞ্জয় করছিলো সে৷ সব ভেস্তে গেলো! সব! চোখ বুজে আফসোসে মাথা নাড়লো।
মিটিং শেষে মিসেস বলার রহস্য সমাধানে সবাই ঝেঁকে ধরলে আমতা-আমতা করে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলো সে। উজানের জন্য অপেক্ষাও করেনি। মিসেস বলার কি এমন দরকার ছিলো? সে কি সবাইকে বলে বলে বেরাচ্ছিলো নাকি যে তার সাথেই ওর বিয়ে হয়েছে। তাও মাত্র কয়েকদিন আগেই৷ চুপচাপই তো ছিলো। আসলে কারোর ভালো কেউ সহ্য করে না। তার ভালোও বদখত উজানের সহ্য হচ্ছে না। হুলোকে কানপড়া দিতে হবে আবার। দুই একবার দিলোও বটে। এনার্জি পেলো না বেশি। অনেকদিন হলো হেয়ারপ্যাক লাগায় না। তাই হয়তো এনার্জি পাচ্ছে না। হেয়ারপ্যাক লাগাতেও যখন উৎসাহ পেলো না তখন সব ছেড়ে ছুড়ে ঘুমিয়ে পরলো। তখন সত্যি সত্যি রাত নয়টা বেজেছিলো।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে