#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৫
প্রতিদিনের মতোই দেরি করে অফিসে যাওয়ায় উজানের যাওয়ার কথাটা জানতে পারলো না নোঙর। উজান অফিস থেকে ইমার্জেন্সিতে বিদেশ যাত্রা করেছে। এতোদিন কষ্ট করে করা প্রেজেন্টেশন সাবমিট করার ডেট একদিন এগিয়ে এসেছিলো। উজান সবসময় সময়ের কাজ সময়ে শেষ করায় তার জন্য কোন সমস্যাই হলো না৷ অফিসে যাওয়ার পর প্রেজেন্টেশন প্রেজেন্ট করার মেইল পাওয়ার সাথে সাথে ওখান থেকেই এয়ারপোর্ট গেলো। নোঙরের সমস্ত রাগ, অভিমান, ক্ষোভ কাঁধে নিয়েই উড়াল দিলো। উজান চলে যাওয়ার প্রায় এক ঘন্টা পর নোঙর অফিসে ঢুকলো। উজানের দেওয়া ফাইলগুলো অমিকে দিয়ে কমপ্লিট করিয়েছিলো। সেগুলো তাড়াতাড়ি ওর থেকে ফেরত নিয়ে নিজের ডেস্কে রেখে দিলো। তারপর ফাইলের সামনে চেয়ার টেনে বসে উজানের অপেক্ষা করতে লাগলো।
তারপর শুধুই অপেক্ষা আর অপেক্ষা। ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা যেতে যেতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেলেও উজানের দেখা পাওয়া গেলো না৷ নোঙর এদিক ওদিক ঘুরঘুর করে, ফাইল নাড়াচাড়া করে একসময় অধৈর্য হয়ে উজানকে কল দিলো। কিন্তু ফোন বন্ধ। লজ্জার মাথা খেয়ে, আত্মসম্মানের বলিদান দিয়ে তাহেরকেও জিজ্ঞাসা করলো। উত্তরে কিছু ত্যাড়া কথা শুনে টেবিলে মুখ গুজে পরে রইলো। বোধহয়, ফ্লোরে এমন কেউ ছিলো না, যাকে উজানের না আসার কারণ জিজ্ঞাসা করেনি। কিন্তু কোথাও মন মতো উত্তর পেলো না।
লাঞ্চের পরেও যখন তার দেখা পেলো না তখন নোঙরের বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করলো। শেষমেশ মাহফুজাকে কল দিয়ে জানতে পারলো, উজান ব্যবসার কাজে কয়েকদিনের জন্য দেশের বাইরে গেছে। কথাটা শুনে নোঙরের চোখে পানি চলে আসলো। দেশের বাইরে যাবে কথাটা একবার তাকে জানালে কি সে বাঁধা দিতো নাকি! একবার বলতে তো পারতো৷ এতে কি এমনই বা হতো!
সেদিন রাতে নোঙর ভগ্ন হৃদয়ে হুলোকে গিয়ে বললো,
–তোর দুলাভাইকে বদ দুলাভাই বলে ডাকার দরকার নাই। তুই বরং দেখলে বলবি, পঁচা দুলাভাই।
বলে চোখের পানি মুছে নাক টানতে লাগলো। হুলো গভীর মনোযোগে নোঙরকে দেখে তার নিজস্ব ভাষায় ডেকে উঠলো। পাশ থেকে অপলা মিনমিন করে বললো,
–তুমি না দুলাভাইয়ের সাথে থাকবা না আপু?
নোঙর চোখে পানি নিয়ে তেঁতে উঠে বললো,
–থাকবো না জন্য বলবে না নাকি? একসাথে তিনটা রিলেশনশীপ মেইনটেইন করছি৷ এইটুকু তো ডিজার্ভ করি।’
নোঙরের রাগ দেখে আর কিছুই বললো না সে। এমনিতেই টাকা নিয়ে যা শুরু হয়েছিলো, ভেবেছিলো তার আয়ু আর বেশিদিন নেই। তবে মাঝখানে দুলাভাই হাওয়া হয়ে যাওয়ায় সে খুব ভালোমতো বেঁচে গেলো!
নোঙর ওড়নায় চোখের পানি মুছে বললো,
–জানিস, নিজে এতোগুলা গার্ড নিয়ে ঘোরে৷ আর আমার বেলায় হেঁটে হেঁটে একা একা অফিস যেতে হয়। রাস্তায় যদি কেউ গু’লি টুলি মেরে দেয় তাহলে তো তোর দুলাভাই বউ হারা হয়ে যাবে। পরে আমাকে মিস করলেও আমি কিছুই করতে পারবো না।’
অপলার মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো,
–তোমাকে কেউ রাস্তায় গু’লি করবে কেন?
–যে জন্য তোর দুলাভাই গার্ড নিয়ে ঘোরে, সেই জন্য। আমি তো তার একমাত্র বউ নাকি?
–কেউ তো বিয়ের খবর জানেই না।
–যারা শত্রু তারা ঠিকই জেনে যাবে। এতো ইনসিকিউরিটিতে থাকলে দেখিস একদিন গু’লি খেয়ে মরে পরে থাকবো। তোরা কেউ জানতেও পারবি না। পৃথিবী থেকে নোঙর খন্দকার নামটা যাস্ট মুছে যাবে। মনে রাখার মতো কোন কাজও এখনও করে উঠতে পারি নাই।
গু’লিবিদ্ধ হয়ে পরে থাকা নোঙরকে কল্পনা করেও অপলার গা শিউরে উঠলো৷ মনটা হুহু করে উঠলো৷ অতি আবেগে বলে উঠলো,
–আমি তোমাকে টাকা ফেরত দিয়ে দেবো আপু। কষ্ট পেও না অতো।
নোঙর আড় চোখে তাকিয়ে নাক টেনে বললো,
–অর্ধেক দে বাকি অর্ধেক নিজের কাছেই রাখিস।
বলেই চোখের কোন মুছে অপলাকে তাড়া দিয়ে বললো,
–তাড়াতাড়ি দে। অফিসে কত কাজ করতে হয় আমার। খুব টায়ার্ড আমি। ঘুমাবো এখন।
নোঙর রাত নয়টার সময় কোনদিনও ঘুমায় না। সেটা জেনেও অপলা কিছু বললো না। বোনটা আর কয়দিনই বা বাঁচবে! কয়েকদিন পর তো গু’লি খেয়ে রাস্তায় পরে থাকবে। এই কয়েকদিন একটু শান্তিতে থাকুক। আবার হুহু করে উঠলো তার বুকের ভেতরটা৷ ঘরে গিয়ে টাকা দেওয়ার সময় আরো হুহু করে উঠলো। আপুর গোছানো টাকার হদিস জানলে ভালো হতো৷ টাকাগুলো ফেরত পাওয়া যেতো।
***
উজানকে ছাড়া অফিসের দ্বিতীয়দিন নোঙরের কাছে আরো বেশি অসহায়ের মতো লাগতে লাগলো। একদম কলেজের প্রথমদিনের মতো অসহায় ভাব৷ সেদিন মনে হচ্ছিলো পরিচিত কেউ কোথাও নেই৷ সে একেবারে অথৈ জলে পরে গেছে৷ যেদিকে তাকায়, সেই দিকেই শুধু পানি আর পানি। আজকেও তেমনই লাগছে।
অফিসে অমি, শামীম আর মমো ছাড়াও আরো বেশকিছু মানুষ পরিচিত হয়েছে৷ উজান ছাড়া তাদেরও কেমন অপরিচিতদের মতো লাগতে লাগলো। নিজের ডেস্কে বসে কাপের পর কাপ চা কফি খাওয়ায় লাঞ্চের সময় কিছুই খেতে পারলো না। লাঞ্চের পর শেষ কাপ খাওয়ার সময় তাহের এসে তাকে ডাকলো।
–স্যারের বাড়ি থেকে লোক এসেছে৷ আপনাকে ডাকে।
নোঙরের ভ্রু কুঁচকে গেলো। কে আসতে পারে, বুঝলো না। জিজ্ঞাসা করায় উত্তরও এলো,
–আমি জানি না। নিজে গিয়ে দেখেন। ফোর্থ ফ্লোরে মিসেস ফ্লোরার কাছে বসে আছে।
লাঞ্চের পর অফিসে বেশি ব্যস্ততা বাড়ে। সবার ব্যস্ততা দেখে এমনিতেও তার দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছিলো। শুধু মনে হচ্ছিলো একটু ঘোরাফেরা করলে ভালো লাগলেও লাগতে পারে। এখন সুযোগ পাওয়ায় তা আর হাত ছাড়া করলো না। ব্যাগ কাঁধে সোজা ফোর্থ ফ্লোরে চলে গেলো।
মিসেস ফ্লোরার সামনে অত্যাধিক সুন্দরী একটা রমনী বসে তার সাথে কথা বলছিলো। লম্বা সাদা শার্ট আর কালো রঙের ঢোলা প্যান্ট পরা মেয়েটাকে নোঙর চেনে। বিয়ের দিন পরিচয় হয়েছিলো। সম্পর্কে তার বড় জা হয়। প্রথম দেখায় তেমন কথাবার্তা হয়নি। সেইজন্যই বোধহয় খানিক অস্বস্তি হলো। মিসেস ফ্লোরার কথায় ধীর পায়ে তার পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো। কথাবার্তা শুনে মনে হলো, কোন একটা ড্রেস ডিজাইনের কথা উঠেছে। নোঙরকে নীরব দেখে রাশা মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
–রিসেপশন ড্রেস হিসেবে তোমার কোন পছন্দ আছে?
নোঙর হকচকিয়ে গেলো। তার দৃষ্টি মিসেস ফ্লোরার ডিজাইনের বইয়ে ছিলো। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে লাজুক হেসে মাথা নেড়ে বললো,
–না না আপু। আমার পছন্দ খুব বাজে। আপনারাই দেখুন না।
নোঙরের মনে পরেছে। তার বড় ভাসুর আর বড় জায়ের রিসেপশন হয়নি। ফুপি বলেছিলো, খুব শীগ্রই অনুষ্ঠান হবে। এইজন্যই হয়তো এসেছে।
মিসেস ফ্লোরা মৃদু হেসে বললো,
–রাশা, আগে তুমি ঠিক করো কি ড্রেস পরবে। শাড়ি, লেহেঙ্গা নাকি গাউন?
–আপনি লেহেঙ্গা বানান?
আচমকা নোঙরের বিষ্মিত স্বর শোনা গেলো। মিসেস ফ্লোরা তেঁতে উঠলেন,
–হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বানান? আমাকে কি তোমার লোকাল টেইলর মনে হচ্ছে?
নোঙর বিড়বিড় করলো,
–আধা-আধি তো টেইলারই।
রাশা থতমত খেয়ে গেছিলো। পরক্ষণেই পরিস্থিতি গরম দেখে নিজেকে সামলে নোঙরের হাতের উপর হাত রেখে নরম গলায় বললো,
–তুমি বলো নোঙর, কোনটা বেশি ভালো লাগবে? শাড়ি, লেহেঙ্গা নাকি গাউন?
নোঙর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। নতুন নতুন ভাবটা অনেকটা সামলে উঠেছে। নতুনদের সাথে খুব ভালো মিশে যায় সে। এবারেও তাই হলো। পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে বললো,
–এমনিতে তো শাড়িতেই নারী। তবে রিসেপশনের জন্য মনে হয় লেহেঙ্গা বেটার হবে।
–তোমার কোন আইডিয়া আছে, কেমন লেহেঙ্গা হলে ভালো হয়?
নোঙর রাশার দিকে ঘুরে বসলো,
–তার আগে দেখতে হবে, কেমন ধরনের লেহেঙ্গা চাই? মানে গর্জিয়াস নাকি সিম্পল?
মিসেস ফ্লোরা মাঝখান দিয়ে কথা বললেন,
–বিয়ের অনুষ্ঠানে অবশ্যই গর্জিয়াস হতে হবে।
–তাহলে দিপিকা পাড়ুকোনকে ফলো করতে পারেন। বিশেষ করে পদ্মাবতী লুকের লেহেঙ্গা। অসাম ডিজাইন ছিলো। বিশেষ করে আগুনে ঝাপ দেওয়ার সময়কার লুকটা! আর সিমপলের মধ্যে হলে আলিয়া ভাটের বিয়ের ড্রেসটা ট্রায় করতে পারেন। যদিও ওটা বোধহয় শাড়ি ছিলো।
মিসেস ফ্লোরা আবার রেগে গেলেন। এবারে বেশ ভালোই রাগলেন। রেগে টেবিলের উপর দুই হাত শব্দ করে রেখে ক্ষীপ্ত স্বরে বললেন,
–আমি কি ডিজাইন পারি না নাকি? আমার কাউকে কপি করতে হবে কেন? আমার ডিজাইনের কাছে সাব্যসাচিও ফেইল করবে বুঝেছো?
রাশা, নোঙর হকচকিয়ে তার দিকে তাকালো। নোঙর আমতা-আমতা করে বললো,
–রাগ করছেন কেনো ম্যাডাম? আমি কি আপনার মতো ক্রিয়েটিভ নাকি যে ডিজাইনের কথা উঠলেই নতুন নতুন ডিজাইন বলতে পারবো? আমি তো স্যাম্পল বললাম। বাকিটা আপনাদের দ্বায়িত্ব।
নেহায়েতই তেল মারা কথা। রাশা ঠোঁট টিপে হাসলো। নোঙরের কথায় কাজ হলো। মিসেস ফ্লোরার রাগ একদম চলে গেলো। নরম হয়ে বললেন,
–তাহলে কোনটা ফাইনাল করবো?
রাশা আড়চোখে নোঙরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–ওইতো সিমপলের মধ্যে। লাইক আলিয়া ভাটের ব্রাইডাল ড্রেস। আর একদম লাইট কালার রাখবেন।
নোঙরের কথা শোনা হয়েছে। তার মুখে প্রসন্ন হাসি খেলে গেলো। রাশা এবারে নোঙরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–এবারে তোমার ড্রেস অর্ডার দাও।
নোঙরের মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো,
–আমার ড্রেস?
–হ্যাঁ, বাড়ির সবার ড্রেস তো মিসেস ফ্লোরাই ডিজাইন করবে।
–আমরা নতুন নতুন ডিজাইনের ড্রেস ক্রিয়েট করি। যাস্ট লাইক, ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক।
কাঁধ নাচিয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে মিসেস ফ্লোরা জবাব দিলেন। যেনো নোঙরকে টেইলর আর তার মাঝের পার্থক্য বুঝিয়ে দিলেন। নোঙর ঠোঁট কামড়ে ভাবুক গলায় বললো,
–সেগুলো কি শুধু পেপারেই সীমাবদ্ধ?’
–তা হবে কেন? ড্রেস তো বানাতেই হয়। নাহলে বুঝবো কিভাবে, আমাদের ডিজাইন কেমন দেখা যাচ্ছে।
বেশ বিরক্ত হয়ে তিনি প্রতি উত্তর করলেন। নোঙর ভ্রু উঁচিয়ে টেবলে হাত রেখে আবার জিজ্ঞাসা করলো,
–টেইলরদের কাজ কি?
–ড্রেস বানানো।
–আপনারা কি তাহলে ঘুরে ফিরে টেইলরই হবেন না?
মিসেস ফ্লোরা রাগে ফুঁসে উঠলেন। নোঙর নিজের বাক্যে অটল। রাশা কপাল চাপড়ালো। সামনে দুইজন সমান তালে ঝগড়া করলে আর নিজে সেই ঝগড়ায় পৃষ্ঠ হলে যে এমন লাগে, সেটা আগে জানতো না। জজের কষ্টটা বুঝলো। আদালতে দুই উকিল এমন করেই তো ঝগড়াই। রাশা হাঁপ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–আমাদের কাজ আছে নোঙর। তুমি দ্রুত তোমার ডিজাইন বলে দাও।
নোঙর শান্ত হলো। মিসেস ফ্লোরাও দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করলেন। নোঙর দাঁতে ঠোঁট কেঁটে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
–হাম দিল দে চুকে সানাম ফিল্মে চান্দ ছুপা গানে ঐশ্বরিয়া যে ল্যাভেন্ডার কালারের লেহেঙ্গা পরেছিলো, আমাকে ওটা বানিয়ে দিতে হবে।
মিসেস ফ্লোরা ডিজাইন বুক বন্ধ করতে করতে বললেন,
–পসিবল না।
নোঙর অনুরোধের সুরে বললো,
–এমন করছেন কেন? প্লিজ বানিয়ে দেন। একই অফিসে আছি। এইটুকু কম্প্রোমাইজ তো করতেই পারেন। দুই দুইটা বানাবো তো। একটা ল্যাভেন্ডার কালার আর একটা সি গ্রীন কালার।
মধ্যবয়সী ফ্যাশন-সচেতন মিসেস ফ্লোরা নিজের বয়স খুব ভালোমতো ধরে রাখতে পেরেছেন। তাকে দেখে কেউ বয়স আন্দাজ করতে পারবে না। নোঙর রাশা কেউই পারছে না। বেশ অনেকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা চালালেও ত্রিশের উপর কিছুতেই উঠতে মন চাচ্ছে না। ভীষণ সুন্দরী ফ্যাশন ডিজাইনার মিসেস ফ্লোরা এখনও যদি মডেল হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তাহলে অনেক বড় বড় মডেলকে পিছনে ফেলে দেবেন, সেটা তারা এক বাক্যে স্বীকার করতে রাজী। নোঙর তো মনে মনে ভেবেও নিলো, সে একদিন না একদিন মিসেস ফ্লোরার বিউটি সিক্রেট জিজ্ঞাসা করবেই করবে৷ এমন এভারগ্রীন হওয়ার ইচ্ছা তারও আছে। যাতে উজান উঠতে বসতে তাকে মিস করতে পারে৷ হাজার হলেও আর কয়দিনই বাঁচবে! কবে না জানি গু’লি টু’লি খেয়ে রাস্তায় পরে থাকে!
মিসেস ফ্লোরা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভেবে বললেন,
–ওকে, বানিয়ে দিতে পারি বাট আগে হাফ পেমেন্ট করতে হবে।
–নো প্রবলেম। টোটাল বিল কত হবে?
নোঙর মহানন্দে জানতে চাইলো। সে ভেবেছে, তার বিল তার নিজেরই দিতে হবে। এই নিয়ে মনে মনে টাকার হিসাবও করে ফেলেছে
মিসেস ফ্লোরা গুরুগম্ভীর স্বরে বললো,
–অ্যারাউন্ড এইট্টি কে।
অ্যামাউন্ট শুনে নোঙর ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। অল্প হাসার চেষ্টা করে বললো,
–গোল্ডের থ্রেড দিয়ে বানাতে হবে না। নরমাল থ্রেড দিয়েই বানাবেন।
–আমার ফি-ই থার্টি কে পার ড্রেস। আর ড্রেস বানানোর অ্যাসেনশিয়াল ম্যাটেরিয়ালস মিলিয়ে টেন কে অনেক টেনে টুনে ফুলফিল করতে হবে। মোটমাট এই ড্রেস বানানোর পিছনে ফোরটি কে লাগবেই। দুইটা বানালে এইট্টি কে। তুমি কলিগ জন্য পার ড্রেস ফোরটি কে৷ নাহলে পার ড্রেস সেভেনটি কে-র নিচে কিছুতেই বানাতাম না।
বলতে বলতে নোটপ্যাডে ঘসঘস করে লিখে লিস্ট তৈরি করতে লাগলো। তারপর সেটা নোঙরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
–যদি মনে হয় টাকা বেশি নিচ্ছি তাহলে এইসব শপিং করে নিয়ে এসে জমা দিও৷ থার্টিতেই একটা তৈরি হয়ে যাবে।
লম্বা লিস্ট দেখে নোঙর শুকনা ঢোক গিললো৷ আমতা-আমতা করে বললো,
–তাহলে এক বছর পরে বানাচ্ছি ম্যাডাম। এতোদিন টাকা গোছাই।
বলেই রাশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–এতো টাকা দিয়ে এখানে ড্রেস বানাতে হবে না আপু। আমার পরিচিত একটা টেইলার্স আছে। কাপড়, লেস কিনে দিলে হাজার টাকার মুজুরিতে সেম টু সেম ড্রেস বানিয়ে দেবে।
রাশাও নোঙরের মতো ফিসফিস করে বললো,
–টাকা তো আমাদের দিতে হবে না। অফিস পে করবে।
–সেগুলোও তো আমাদেরই টাকা।
মিসেস ফ্লোরা তাদের ফিসফিস করা দেখে কেশে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলেন। রাশা সোজা হয়ে বসে নোঙরের হাত থেকে লিস্ট নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। তারপর নোঙরকে অসন্তুষ্ট করে মিসেস ফ্লোরাকে বললো,
–তাহলে ডিজাইন করে ফেলুন। আর নোঙরের দুইটা লেহেঙ্গা সেম বানানোর চেষ্টা করবেন প্লিজ। উই নো, শখ!
মিসেস ফ্লোরা শক্ত মুখে মাথা নাড়লেন। নোঙরের হাজার বারণ সত্ত্বেও মাপ দিয়ে তাকে নিয়ে গাড়িয়ে উঠে বসলো রাশা। গাড়ি থামলো, শহরের বড় শপিং মলের সামনে। শপিংমল দেখেই নোঙরের মুখ কালো হয়ে গেলো। মন খারাপ নিয়ে বললো,
–এখানে গলা কাঁটা দাম নেয় আপু৷ অন্য জায়গায় চলুন। এর তিন ভাগের আধ ভাগ দিয়ে শপিং করা যাবে।
নোঙর এটা বলতে পারলো না, দরদাম না করলে সে শপিং করে মজা পায় না। তাই একটু ঘুরিয়েই বললো। রাশা আপনি বলাতে খুব বিরক্ত হলো,
–তোমার কি আমাকে দেখে বেশি বয়স্ক লাগে নোঙর?
নোঙর ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো,
–না তো। কেনো?
–তাহলে আপনি বলছো কেনো?
নোঙর বুঝতে পেরেছে, এমন ভঙ্গিতে হাসলো।
–আচ্ছা সরি। কিন্তু এখানে যাবো না। এখানে তো বারগেনিং করা যায় না। নিউমার্কেট চলো। এর থেকে তিন গুণ কম দামে শপিং করা যাবে।
নোঙর নিজের খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসলো। রাশা একবার বলতে চাইলো, ফেব্রিক তো আলাদা হবে। কিন্তু কিছু বললো না। নোঙর তাকে টেনে নিউমার্কেট চলে গেলো। নিউমার্কেট ঘুরে একটা জামা রাশার বেশ পছন্দ হলো। ফেব্রিকও বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। দাম জিজ্ঞাসা করায় দোকানদার দামও বললো,
–দুই হাজার।
–আমাদের কি আদরের দুলালি মনে হচ্ছে আপনার? নাকি দেখে বেকুব মনে হচ্ছে যে, যা দাম বলবেন আমরা সেই দামেই নিয়ে নেবো। এগুলা নাড়াচাড়া করেই এতোদূর এসেছি। এক দাম তিনশো।
নোঙর ফুঁসে উঠে বললো। নোঙরের বলা দাম শুনে রাশার মাথায় বজ্রপাত হলো। দুইপা সরে নোঙরের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো, যাতে দেখে মনে হয়, সে আলাদা এসেছে। নোঙরকে চেনেই না।
নোঙরের দাম শুনে লোকটা একটু নিভলো,
–আচ্ছা আপা, লসে দিচ্ছি। সতেরোশো।
নোঙর কিছু না বলে তীক্ষ্ণ চোখে লোকটার দিকে তাকাতেই লোকটা আরেকটু দাম কমালো,
–আচ্ছা নেন, বারোশো।
নোঙর ঠান্ডা গলায় বললো,
–সারে তিনশো।
–কেনাই তো হাজার টাকা আপা। লসেই দিচ্ছি। নয়শো টাকায় দেন।
–আর পঞ্চাশ আগাচ্ছি৷ এক দাম চারশো।
–নেন আপা, ছয়শো।
নোঙর আবার ঠান্ডা চোখে তাকালো। লোকটা শব্দ করে শ্বাস ফেলে জামা ভাজ করতে করতে বললো,
–না আপনার, না আমার। একেবারে লসে দিচ্ছি৷ সারে চারশোতে নেন। ম্যালা কমাইছি। আর না আপা। এখন নিলে নেন না নিলে থাকুক। এর থেকে কমে আর দিমু না।
রাশাকে চরম হারে অবাক করে দিয়ে লোকটা সারে চারশোতে কেমন রাজি হয়ে গেলো। একটা জামা কিনেই নোঙর ক্ষান্ত হলো না। অপলার দেওয়া আড়াই হাজারের পুরোটা দিয়ে হাবিজাবি শপিং করে আর রাশাকে এক গাদা শপিং করিয়ে দিয়ে তবেই থামলো। এমন ঘুরে ঘুরে শপিং করে রাশার পা ব্যাথা হয়ে গেলো। ব্যাগ গাড়িতে তুলে কোমরে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। গাড়িতে বসে একটু ধাতস্থ হতেই নোঙর প্রশ্ন করলো,
–শপিং তো শেষ। এখন কোথায় যাবে?
নোঙরের এনার্জি দেখে রাশা ঢোক গিললো। ভাবলো, আর ঘোরাঘুরি না। এবারে বসে থাকা কোন জায়গায় যাবে। তাই বললো,
–পার্লারে যেতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে আর একটু রুপচর্চাও করতে হবে।
রাশা চোখ টিপলো। নোঙর আহাজারি করে উঠলো,
–কি বলছো আপু! পার্লারে! সব জিনিস তো ভ্যাজালে ভরা৷ স্কিন খারাপ হয়ে যাবে। দশ টাকার স্কিন কেয়ার করলে একশ টাকার মেডিসিন খেতে হবে। চলো, তোমাকে অর্গ্যানিক জিনিস কিনে দিচ্ছি। বাড়ি ফিরে একটু মিক্স আপ করলেই প্যাক রেডি।
রাশা নিজের ডিপ ব্রাউন চুলে হাত বুলালো। চুলের কালার খানিক ফ্যাকাসে হয়েছে। কালার করাটা জরুরি হয়ে পরেছে। স্কিনটাও খসখসে হয়ে রয়েছে। নোঙরকে বলবে নাকি বুঝলো না।
নোঙরের উৎসাহে গাড়ি একটা লোকাল মার্কেটের সামনে দাঁড়ালো। ভেতরে গাড়ি যাবে না। সুতরাং আবার হাঁটতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে কোন এক কবিরাজের দোকানের সামনে গিয়ে তারা দাঁড়ালো। ভেতর থেকে নোঙরের অর্গ্যানিক মাল-মশলা কিনে আরেকটা দোকানে গেলো। এভাবে তিন চারটা দোকান ঘুরে কেনাকাটা করে তবেই গাড়িতে উঠলো। রাশার পা ব্যাথা করতে শুরু করেছে। ঘোরাঘুরির অভ্যাস তার নেই। নোঙর পুরোটা রাস্তা কোনটা কেমন ভাবে আর কি কি মিশিয়ে প্যাক তৈরি করতে হবে, সেটা বুঝালো। রাশার কাছে আইনের মোটা মোটা বইয়ের শক্ত শক্ত আইনও নোঙরের বলা প্যাকের উপকরণ মনে রাখার থেকে সোজা মনে হলো।
রাতে রাশা টেবিলে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে নাম মনে রাখার চেষ্টা চালালো। একদম এ বি সি ডি মুখস্ত করার মতো করে মুখস্ত করতে শুরু করলো,
–এটা মেথি, এটা নিম পাতার পাউডার, এটা রিঠা, এটা গোলাপের পাপড়ির পাউডার, এটা চিয়া সিড…
এর মাঝেই নোঙর রাশাকে ভিডিও কল দিলো। এরপর পরিমাণ বুঝিয়ে দিয়ে মিক্স করাও শিখিয়ে দিলো। রাশা মহা উৎসাহে কাজ করতে লাগলো। নোঙরের বলা ঘনত্ব আনতে আনতে পরিমাণে এতো বেশি হয়ে গেলো যে রাশা, ময়না, মাহফুজা, শাহিদা আর আবসার সাহেব লাগানোর পরেও খানিক বেঁচে গেলো। রাশার প্রথমে বিরক্ত লাগলেও এখন খুব ইঞ্জয় করছে। উষির বাড়ি ফিরে হতভম্ব হয়ে গেলো। রাত দশটার সময় বাড়ির সবই মিলে মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে লিভিংরুমে চুপচাপ বসে টিভি দেখছে। উষির এসেছে দেখে রাশা উচ্ছ্বাসিত হয়ে বেঁচে যাওয়া ফেসপ্যাকটুকু তাকে লাগিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো। এখন মোটামুটি, বৃষ্টি আর বন্যা ছাড়া সবাই ফেসপ্যাক লাগিয়ে লিভিংরুমে টিভি দেখতে লাগলো। ফেসপ্যাক পুরো আধা ঘন্টা লাগিয়ে রাখতে হবে। নোঙর বারবার করে সতর্ক করে দিয়েছে, একদম কথা বলা যাবে না।
চলবে..
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৬
রাশা এসেছে একটা কেসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। কেসটা পানির মতো সোজা। কিন্তু সুবোধ দত্তের ভাষ্যমতে, কেস প্রথমে জটিল করতে হবে তারপর সোজা ভাবে সলভ করতে হবে। এটাই নাকি তার রুল। এক কেস একদিনে সলভ হলে সেটা আবার কেস হলো নাকি! কেস আগে ঘোলাটে বানাতে হবে তারপর সেখান থেকে ক্লু বের করে করে সলভ করতে হবে। একদম সরল অংকের মতো। এসব কথা রাশা যখন প্রথম শোনে তখন ক্লাসরুম ভরা স্টুডেন্ট। নাহলে নির্ঘাত বলে বসতো, স্যার, কারা যেনো পানি ঘোলা করে খায়?
কথাটা বলা হয়ে ওঠেনি৷ আর যে কথাটা প্রথমে বলা হয়ে ওঠেনি, সেই কথাটা যে আর বলা হবে না সেটা তো জানার কথা। সুতরাং সেও সুবোধ দত্তের একনিষ্ঠ ছাত্রী হিসেবে তারই পথই অনুসরণ করছে৷
একটা লোক খু’ন হয়েছে। লোকটা বেশ বড়লোক। রিসেন্টলি স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কোর্টে অ্যাপ্লাইও করেছিলো। শর্ত ছিলো একটাই। একটা টাকাও স্ত্রীকে দেবে না। অথচ স্ত্রী টাকা নেবেই নেবে। শেষমেশ লোকটা খু’ন হলো। উইল অনুযায়ী সম্পত্তির মালিক এখন ওনার স্ত্রী৷ টাকা পয়সাওয়ালা মানুষদের একটা সমস্যা আছে। সাংবাদিক কখনও পিছু ছাড়ে না। খু’ন হয়েছে, সেটা তো পাবলিক জেনে গেছে। এখন সেটার তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকরা কিছুতেই পিছু ছাড়বে না। পুরো কেস সাজালে স্পষ্ট বোঝা যায়, খু’নটা তার স্ত্রীই করেছে। যথেষ্ট প্রমানও আছে। কিন্তু নাহ! সেটা হলে তো এটা সুবোধ বাবুর কেস হতোই না। এখন কাজ একটাই। খু’ন হওয়া লোকটার আশেপাশে থাকা মানুষজনের বয়ান রেকর্ড করা। আর সুবোধ দত্তের অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে রাশার কাজ হচ্ছে, নিজ দ্বায়িত্বে সেটা করা। সেইজন্যই এখন এই ভাঙা বাড়িতে এসে বসে আছে। সাথে আছে সুবোধ স্যারের আরেকজন স্টুডেন্ট।
জায়গাটা বস্তি টাইপ। দুইটা নোংরা গলি পাড় হয়ে এসে একটা ভাঙাচোরা একতলা বাড়ি পরে। ইটগুলো বহু কষ্টে দেয়ালে গেথে রয়েছে৷ তারা অনেক খুঁজে খুঁজে বাড়িটা বের করেছে। বাড়িটা খু’ন হওয়া লোকটার ড্রাইভারের। খু’নটা বাড়িতে হয়েছে কিন্তু বয়ান ড্রাইভারের লাগছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে রাশার সাথে আসা ছেলেটা অনেকক্ষণ গিজগিজ করলো। ছেলেটা রাশার জুনিয়র কিন্তু নতুন। আর এটাই তার প্রথম কেসের প্রথম দিন। তাই তাকে প্রথমদিনই ধমক দিয়ে চুপ করাতে ইচ্ছে হলো না রাশার। মূলত ছেলেটি সমস্যা নয়৷ সমস্যা হচ্ছে, ড্রাইভার বাড়ি নেই। বাড়ি ফিরছে, রাস্তায় আছে। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
অপেক্ষার মাঝে রাশার ফোনে মেসেজের নোটিফিকেশন আসায় চুপচাপ নিজের মোবাইলে নজর দিলো। উষির মেসেজ করেছে,
“বউ, কি করছো?”
রাশার মুখে রাগের আভাস আগে থেকেই ছিলো। মেসেজ দেখার পর সেটা আরো বেশি হলো। দ্রুত হাতে পালটা মেসেজ লিখলো,
“তোমার জন্য রান্না করছি।”
রাশার জবাব পেয়ে খানিক সময়ের জন্য উষিরের ধুকপুক করা বুকটা বিট করা মিস করে ফেললো। ঢোক গিলে আসেপাশে তাকালো। বড় মাঠের এক কোনে ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। মাঠটা বিল্ডিং বানানোর জন্য খোদাই করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন বাঁধা দিচ্ছিলো জন্য নিজে এসেছে। এই মূহুর্তে বউয়ের রান্না করা প্রথম খাবার খাওয়ার কথা মনে করে মুখের রাগী ভাবটা সরালে চলবে না। তাই রাশাকে রাগিয়ে দিতে চাইলো৷ আঙুলের দ্রুত চাপে আরেকটা মেসেজ টাইপ করলো,
“এখানে অনেক সুন্দরী মেয়েরা আছে।”
“পছন্দ হলে বিয়ে করে নিয়ে এসো।”
রাশার তেড়ছা জবাবে উষিরের মুখ হা হয়ে গেলো। হতভম্ব মুখে আবার মেসেজ টাইপ করলো,
“তোমার জেলাসি হচ্ছে না।”
“একদমই না।”
একদম স্পষ্ট বাংলা অক্ষরের স্পষ্ট মেসেজ৷ কাগজে লিখলে হয়তো কাটাছেড়াটা দেখলে মনের কথা বোঝা যেতো৷ এখানে সে উপায় নেই। বুকটা কেমন হুহু করে উঠলো। তার বউয়ের জেলাসি নেই! এ কেমন ভালোবাসা! অথচ সে ভালোবাসায় পরে কি না কি করে ফেললো! উষির মনে মনে দুঃখবিলাস করতে লাগলো। চোখ বুজে মাথা নিচু করে দুই দুইবার নিজের মাথা ডান বাম করে নাড়ালো। তারপর মাথা তুলতেই জৈনক সৈনিক হিসেবে খ্যাত তার সর্বদা সঙ্গীদের একজনকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। তার চোখ খোলার সাথে সাথেই সামনের ছেলেটি উশখুশ করে বললো,
–ভাই একটা কাজ ছিলো।
উষির রাগে হাত মুঠো করে ধমকে উঠলো,
–কাজ! এখানে আমি বউ নিয়ে সমস্যায় আছি আর তোদের কাজ মনে পরলো? জানিস জীবনে বউ কত দরকার?
তার ধমকে আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা বাকি সৈনিকরাও এসে জড়ো হলো এবং শেষ প্রশ্নের উত্তর হিসেবে সবাই একজোগে মাথা নেড়ে না বুঝালো। এরপর উষির দ্বায়িত্ববান নেতার মতো বউ এর উপকারীতা নিয়ে একটা লম্বা বক্তৃতা দিলো৷ ওখানে যারা সিঙ্গেল সোসাইটি ক্লাবের মেম্বার ছিলো, সবাই নিজেদের সিঙ্গেল জীবনের কথা চিন্তা করে আর বউ না থাকার কষ্টে বরই ব্যাথিত হলো।
উষিরের কষ্ট এই লম্বা বক্তৃতাতেও না কমায় ভাইকে কল দিলো। উজান এক লম্বা মিটিং শেষে হোটেল রুমে এসে বিশ্রাম করছিলো। উষিরের ফোন পেয়ে বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলো। রিসিভ করার সাথে সাথেই উষির তাকেও ধমক দিয়ে উঠলো,
–কি সমস্যা?
উজান বিষ্মিত হয়ে পালটা প্রশ্ন করলো,
–কিসের কি সমস্যা?
তোর ভাবির কি সমস্যা সেটা জিজ্ঞাসা করছি?
–সেটা আমাকে কেনো জিজ্ঞাসা করছিস?
–তোর তো পাতানো বোন হয়, তাই তোকেই জিজ্ঞাসা করছি। আমার সাথে রাগ করে আছে। আমার সাথে কথা বলছে না, কল ধরছে না।
উজান কপাল কুঁচকে ব্যাপারটা শুনলো। তারপর রাগ করতে নিয়েও করলো না। একজন বিবাহিত পুরুষ হয়ে অপর একজন বিবাহিত পুরুষের বিপদে তার পাশে দাঁড়ানো দ্বায়িত্বের মাঝে পরে। সেই দ্বায়িত্বটা সে ভালোভাবে পালন করতে চায়। তাই চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
–কেনো?
–জানি না। তুই ফোন দিয়ে বল, আমার ফোন যেনো ধরে।
উজান তপ্ত শ্বাস ফেলে সময় দেখলো। বাংলাদেশের সময়ে এখন সকাল এগারোটা বাজে৷ এইসময় উষির ব্যস্ত থাকে। আর আজকে এইসময় রাশার রাগ নিয়ে কথা বলছে! কি অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে, বুঝলো না।
–আমার জানামতে তুই এই সময় খুব ব্যস্ত থাকিস।
–বউ রাগ করে থাকলে কাজে মন বসে নাকি? আমার সাথে সাথে টিমের বাকি সবারও মন খারাপ।
উষির বেশ মন খারাপ করেই কথাটা বললো। শেষের কথাটা অবশ্য একশো শতাংশ সত্যি৷ তার বক্তৃতার পর সিঙ্গেল সোসাইটি ক্লাবের সবাই ক্লাবটা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে৷ সেই সাথে নিজেদের সিঙ্গেল জীবন নিয়ে হা-হুতাশ করা শুরু করে দিয়েছে। সেসব আলোচনা অবশ্য গোপনে গোপনে আর মনে মনে চলছে।
উষিরের কথায় উজানও ভাইয়ের দুঃখে দুঃখী হলো। এখনই শুনবে বলে কল কেঁটে তক্ষুনি রাশাকে কল দিলো৷ রাশা তখন ড্রাইভারের সাথে কথা বলছিলো। ফোন আসায় ভীষণ বিরক্ত হলো। উজানের কল দেখে বাইরে এসে রিসিভ করলো। উজান বেশ চিন্তিত স্বরে তাকে প্রশ্ন করলো,
–তুমি উষিরের উপর কোন কারণে রাগ করে আছো?
–না তো। কেনো? কিছু হয়েছে?
রাশা কপাল কুঁচকে উত্তর দিলো। উজান আমতা-আমতা করতে লাগলো। কারো দাম্পত্য জীবনে ঢুকতে হয় না বলেই সে জানতো। এখনও ঢুকতো না যদি না উষির এতো করে তাকে বলতো। মনে মনে ভেবে নিলো, এই শেষ! আর এরুপ কাজ কদাপি নহে।
–উষির ফোন দিয়ে বললো, তুমি ওর ফোন ধরছো না৷ কথা বলছো না। রাগ করে আছো।
–আধ ঘন্টা আগেই তো কথা হলো। দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাচ্ছে। আমি অনুমতিও দিলাম।
উজানের মাথায় বজ্রপাত হলো বলে মনে হলো। এর উত্তর কি দেওয়া যায়, ভেবে না পেয়ে কল কেঁটে উষিরকে টেক্সট করলো,
“তুই দেশের হাল ধরতে চাস উষির। তোকে কি এসব মানায়? এমন বউ পাগলা হলি কিভাবে?”
পালটা উত্তর বেশ সাথে সাথেই আসলো,
“শোন শোন, এটা আমাদের বংশগত। তোর বাবা, কাকা, দাদা সবাই এইদিকেই ছিলো। বড় ছেলে হিসেবে বংশের গুণ রক্ষা করা আমার দ্বায়িত্ব। ছোট ছেলেরা তো অবাধ্য হয়। সেইজন্য আজ তোর এই হাল।”
রাশা একবার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো, ড্রাইভার ভেতরের ঘরে চলে গেছে। হয়তো খেতে গেছে। এমন কথাই ছিলো৷ তাই উষিরের সাথে কথা বলার চিন্তা করলো। ভাবনামতো কলও দিলো। উষির সাথে সাথে একদম রিসিভ করলো না। দুই তিনবার রিং বাজার পর রিসিভ করে ব্যস্ত স্বরে কথা বলতে লাগলো,
–কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো? আমার অনেক কাজ আছে। কাজের মাঝে এমন মেসেজ আর ফোন দিয়ে বিরক্ত করলে কি চলে? আমাকে তো খেটে খেতে হয়। তোমার মতো মিথ্যা সাক্ষী দিলেই আমাকে কেউ কাড়ি কাড়ি টাকা দেবে না।
একদমে বলে নিজের চেয়ারে বসলো উষির। ফ্যানের বাতাস সম্পূর্ণ তার গায়ে লাগছে। গা জুড়িয়ে যাচ্ছে একদম। রাশা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
–ভাবলাম একটু প্রেমালাপ করি। কিন্তু তুমি তো ব্যস্ত। ঠিক আছে, রাখছি তাহলে।
উষির লাফ দিয়ে উঠলো। ব্যাজার মুখ করে বললো,
–একনিষ্ঠ স্বামী হিসেবে নাহয় একটু কাজের ক্ষতিই করলাম৷ তুমি তোমার প্রেমালাপ করো, আমি শুনছি।
রাশা শুনলো, বুঝলো। তারপর হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,
–একটা হাতির সামনে ১২টি কলা রাখা ছিলো। হাতিটা ১১টা কলা খেলো কিন্ত ১টা কলা খেল না। কেন?
উষির তজ্জব বনে গেলো,
–এটা প্রেমালাপ?
–প্রেমালাপের প্রথম ধাপ হলো আইকিউ টেস্ট। তারপর আইকিউ হিসেবে অনুপাত বুঝে প্রেমালাপ করতে হয়। আন্সার জানো নাকি সেটা বলো?
উষির আমতা-আমতা করলো,
–বোধহয় ওই কলাটা পঁচা ছিলো৷
–ভুল। ওটা প্লাস্টিকের কলা ছিলো। আবার বলো, একটা হাতির সামনে ১২টি কলা রাখা হলো, কিন্তু সে একটা কলাও খেল না কেন?
উত্তর শুনে বিষ্ময়ে তার চোয়াল ঝুলে পরেছিলো। কিন্তু একই সিলেবাসের একই প্রশ্ন একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে করায় পুরোনো কনফিডেন্স ফেরত পেলো। বেশ উৎসাহের সাথে বললো,
— কারন ১২টা কলাই প্লাস্টিকের ছিল!
–না হাতিটাই প্লাস্টিকের ছিল।
উষিরের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়ে মূহুর্তেই আষাঢ়ের মেঘের মতো কালো হয়ে গেলো। অন্যদিকে রাশা থেমে নেই। ঝুলি থেকে আরেকটা প্রশ্ন বের করেছে,
–এক লোক মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টি নামল। লোকটির কাছে ছাতা নেই আবার চার পাশে কোথাও এমন কিছু নেই, যার তলায় দাঁড়ানো যেতে পারে। লোকটি ভিজে চুপচুপে হয়ে বাড়ি ফিরল। কিন্তু তার একটি চুলও ভিজল না। কেন?
–কেনো?
থমথমে মুখে পালটা প্রশ্ন করলো উষির৷ এবারে উত্তর দেওয়ার জন্য এক ফোঁটাও চিন্তা করলো না।
–কারন লোকটা টাক ছিলো৷
উষিরের মনে হলো, ফোনটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলুক। এ জীবনে তার প্রেমালাপের শখ ঘুচে গেছে। রাগে মাথার তালু জ্বলে গেলো৷ শক্ত গলায় বললো,
–আজকে এমন ধাঁধা ধাঁধা খেলছো কেনো?
–পেপারে রাশিফল দেখছিলাম। সেখানেই দেখেছি, আজকে ধাঁধা ধাঁধা খেললে জীবনে খুব উন্নতি করবো।
উষির বুঝলো, রাশার সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। উত্তরে ত্যাড়া কথা ছাড়া আর কিছুই বলবে না৷ তাই আর কষ্টও করলো না৷ আর কোন কথা না বলে মুখের উপর কল কেঁটে দিলো। ওর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে পাশে থাকা ছেলেটি চিন্তিত গলায় বললো,
–কিছু হইছে ভাই?
উষির ছেলেটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রাশার করা প্রশ্নটা তাকে করলো,
–মনে কর, একটা হাতির সামনে ১২টি কলা রাখা হলো। হাতিটা ১১টা কলা খেলো, কিন্ত ১টা কলা খেল না। কেন?
ছেলেটি দাঁত বের করে হাসলো,
–এতো খুব সোজা ভাই। ওই কলা প্লাস্টিকের আছিলো।
উষির বিষ্ময়ে ছেলেটির দিকে তাকাতেই ছেলেটির হাসি চওড়া হলো।
–এগ্লা তো পুরাতন জোকস ভাই৷ আপনে শোনেন নাই? গুগলে তো ম্যাল্লা আছে।
উষির সত্যি সত্যি গুগল করলো আর সাথে সাথে পেয়েও গেলো। রাশার করা বাকি প্রশ্নগুলোও গুগলে সুন্দর করে উত্তর সহ দেওয়া ছিলো। নিজের চরম গাধামিতে বরই মর্মাহত হলো সে। সিদ্ধান্ত নিল, আজকে বাড়িই ফিরবে না। মাঠে, ঘাটে, রাস্তায়, যেখানে খুশি রাত কাঁটাবে কিন্তু বাড়ি সে ফিরবেই না।
চলবে…