#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৩
–আমার দুই লাখ টাকার ব্যাগ!
আর্তচিৎকার করে উঠলো পাখি। নোঙর টাকার অ্যামাউন্ড শুনে দ্বিগুণ আঁতকে উঠলো৷ তারপর নষ্ট হওয়া ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আফসোসে বললো,
–এই ব্যাগ এতো টাকা দিয়ে কিনতে হবে! আমাকে তো ফ্রীতে দিলেও নেবো না।
তারপর পাখিকে নিজের ব্রাউন লেদারের চিকন ফিতার হোবো হ্যান্ডব্যাগ দেখিয়ে বললো,
–গুলিস্তান থেকে সাতশো টাকায় কিনেছি৷ পনেরো-শো দাম চেয়েছিলো। আমার ট্যালেন্টের জোরে সাতশো টাকায় কিনেছি। ওই দুই লাখ টাকার ব্যাগ, এই সাতশো টাকার ব্যাগের কাছে কিছুই না।’
নোঙরের চোখে মুখে দরদাম জেতার দম্ভ ফুটে উঠেছে। মিসেস ফ্লোরা কপাল কুঁচকে নোঙরের ব্যাগ উলটে পালটে দেখতে লাগলেন। সেও মহা উৎসাহে নিজের ব্যাগ দেখাতে লাগলো। পাখি এসব দেখে আরো রেগে গেলো৷ আগুন চোখে নোঙরের দিকে তেড়ে আসতে নিতেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে পরে গেলো। নোঙর দ্বিতীয়বারের মতো আঁতকে উঠলো। এবারে আগেরটার থেকেও বেশি তীব্র ছিলো,
–আমার জুতা!
চিৎকার এতো জোরে ছিলো যে শুটিংএ থাকা সবাই পাখির দিকে না তাকিয়ে ড্যাবড্যাব করে নোঙরকে দেখতে লাগলো। নোঙরের তো কান্না করার মতো অবস্থা হয়ে গেলো। অপলার জুতা! না জানি তাকে কি দিয়ে কি করে ফেলে!
নোঙরের এমন জুতার আহাজারি শুনে খানিক বিষ্ময়ে, খানিক রেগে চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো উজান। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেও উজানের দিকে সে এক ফোঁটা নজরও দেয়নি। ফলস্বরুপ উজানের চোখ গরম সম্পূর্ণ বৃথা গেলো। নোঙর আফসোস নিয়ে বললো,
–হিলটা বোধহয় আর বাঁচানো গেলো না!
উজান চাপা গলায় মৃদু ধমকের সুরে বললো,
–এমন ছোটলোকের মতো বিহেভ করছো কেনো? সামান্য জুতাই তো। একটা মানুষ পরে গেছে, সেটাতে সামান্য রিগ্রেট নেই?
নোঙর চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
–তোমার পাখি পরেছে তাই তুমি দুঃখ করো। আমার পাখি পরলে আমিও দুঃখ করতাম। আমার জুতার যদি কিছু হচ্ছে, আমি কিন্তু একদম ওই পাখা ছাটা পাখিকে ছাড়বো না। শুধু তাই না, তোমার কোম্পানিকে বয়কট করবো। কোনদিন কোন ড্রেস কেনবো না৷ চাকরিও ছেড়ে দেবো। এই তিনদিনের হিসাব আমাকে বুঝিয়ে দেবে। এই তিনদিনের টাকা যদি আমাকে বুঝিয়ে না দিয়েছো তো টাকা মেরে দেওয়ার কেস করবো বলে দিলাম।
নোঙরের সতর্কবাণী আর হুম’কিকে উজান পাত্তাও দিলো না। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করতে করতে বললো,
–তিন হাজার তো? এখনই দিচ্ছি। কিন্তু তারপর আর দ্বিতীয়বার অফিসে মুখও দেখাবে না।’
অপমানে নোঙরের মুখ থমথম করে উঠলো৷ উজান তাকে তিন হাজারের বদলে পাঁচ হাজার দিলো৷ নোঙর থমথমে মুখেই টাকা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো৷ তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে মডেল পাখির চিৎকার চেঁচামেচি দেখতে লাগলো।
অপলার হিল সত্যি সত্যি ছিড়ে গেছে৷ পাখির ডান পা এমন বেকায়দায় পরেছিলো যে, সে একেবারে মুখ থুবড়ে মাটিতে শুয়ে পরেছিলো। সবুজ রঙের গাউনটা সম্পূর্ণ মাটি মাটি হয়ে নষ্ট হয়ে গেলো। তার উপর তার চিৎকারে সবার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে৷ জুতা খুলে যতক্ষণ না হসপিটালে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠলো ততক্ষণ পর্যন্ত হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে থেকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো নোঙর। গাড়িতে উঠতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। উজান নোঙরের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো৷ তীক্ষ্ণ চোখে তার পরবর্তী গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছিলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। নোঙর জুতার কাছে গিয়ে ছেড়া জুতা হাতে তুলে ছেড়া অংশটুকু পরিক্ষা করতে লাগলো।
–এটা নিয়ে আর কি করবে। ফেলে দাও এখানেই। আমি নতুন জুতা আনতে বলছি।
হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠলো নোঙর। উজানের উপস্থিতির কথা তার খেয়ালই ছিলো না। সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিলো জুতার দিকে। বাড়ি ফিরে অপলাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে সেটাও ভেবে পাচ্ছিলো না।
এখন উজানের কথা আমলে না নিয়ে জুতার ভালো পাটিটাও হাতে তুলে নিলো। তার পায়ে ছিলো শুটিং স্পটে থাকা একটা আধা পুরাতন স্যান্ডেল। স্যান্ডেলটা যে বহু পা ঘুরে যে তার পায়ে উঠেছে, সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দুই পাটি জুতা বাম হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললো,
–ফেলে দেবো! সেলাই করে আড়ামসে পরা যাবে।
উজান কড়া গলায় আদেশের সুরে বললো,
–সেলাই করতে হবে না৷ ফেলে দাও বলছি।
নোঙর একটু কাচুমাচু করে বললো,
—দিতে পারবো না।
উজান কিছুক্ষণ নোঙরের দিকে তাকিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর নোঙরের হাত থেকে জুতা নিজের হাতে নিয়ে নিলো৷ নোঙর আঁতকে উঠে বললো,
–ফেলবে না প্লিজ। অপু মেরেই ফেলবে আমাকে৷ এটা ওর জুতা।
সহসাই ভ্রু দুটো কুঁচকে গেলো উজানের। হাতে ধরা কালো রঙের হিলের দিকে তাকিয়ে নোঙরের দিকে দৃষ্টি দিলো,
–তোমার জুতা নেই?
নোঙর উশখুশ করে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বললো,
–ছিলো কিন্তু এই জামার সাথে এটাই ভালো মানাচ্ছিলো।
বলতে বলতে নোঙর লজ্জিত হলো৷ জামাটা উজানের জন্য শখ করে পরেছিলো। উজান একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখবে, এই আশায় পুরোটা দিন বসে ছিলো।
–তুমি লজ্জা পাচ্ছো নাকি? ব্লাশ করছো মনে হচ্ছে।
নোঙরের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো উজান। নোঙর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–লজ্জা আর আমি! কিসব পাগলের প্রলাপ বকছো!
বলে আরেকটু লজ্জা পেলো সে। উজান দাঁড়িয়ে নোঙরের দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আঙুল উঁচিয়ে বললো,
–সেটা অবশ্য ঠিকি বলেছো কিন্তু এই চোখ.. তোমার বড় বড় চোখগুলো কেমন একটা হয়ে গেছে৷ তাকানোটা কেমন কেমন মনে হচ্ছে।
নোঙর চট করে নিজের চোখে হাত দিলো,
–কই, কিছু হয়নি তো৷ ভুল দেখেছো হয়তো।
উজাম মাথা নাড়লো,
–উহু, আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না।
নোঙর চোখ বুজে ঠোঁট চেপে জবাব দেওয়ার জন্য কথা ভাবলো৷ অনেক ভেবেও কিছুই পেলো না৷ উজান হিল উঁচু করে ধরে বললো,
–এটা ফেলে দেই। অপলাকে নতুন জুতা কিনে দিচ্ছি।’
নোঙর প্রবলবেগে মাথা নাড়লো,
–এটা ও নিজে টাকা জমিয়ে কিনেছিলো। শুধু টাকা দেখলে হয় না৷ ইমোশনটাও ম্যাটার করে।’
উজানের গাড়ি বড় রাস্তায় পার্ক করা ছিলো। এখনও কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। সন্ধ্যাও পরে যাবে একটু পর। হাঁটা পুনরায় চালু করে উজান বললো,
–ইমোশন! তুমি কিছুক্ষণ আগে যে ব্যাগটা নষ্ট করলে, সেটাও কারো প্রিয় ব্যাগ ছিলো।
নোঙর মুখ ভেঙচে বিড়বিড় করে পাখি আর উজান, দুজনকেই আচ্ছামত বকলো। উজান নোঙরের বিড়বিড় বুঝতে পারলো। কিন্তু কি বললো সেটা বুঝলো না। এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই নোঙর উজানের শার্টের হাতা টেনে কানের কাছে মুখ এনে পিছনে আঙুল দেখিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–এরা আমাদের পিছে আসছে কেন?
নোঙর শার্ট টানায় একটু ঝুঁকে এসেছিলো উজান। মুখ নোঙরের মাথার কাছে চলে এসেছিলো। এতোটা কাছে যে তার সাবধানি নিশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট পেলো। মূহুর্তেই হার্টবিট বিদ্রো’হ করে উঠে নিজের ইচ্ছামতো ছোটাছুটি করতে লাগলো। ঢোক গিললো উজান। মাথাটা আরেকটু নিচু করলেই নোঙরের মুখোমুখি হয়ে যাবে। হঠাৎই গলার কণ্ঠনালীর কাছে ওই উঁচু হাড়টা নড়ে উঠলো। ছোটাছুটি করা হার্টবিটের সাথে সাথে সেও বোধহয় বিদ্রোহ করে উঠলো। ইংরেজিতে অ্যাডামস অ্যাপেল আর বাংলাতে কণ্ঠমণি নাম হলেও আজ উজানের জন্য অন্য নামকরণের সূচনা তৈরি করছে সে। তার অলক্ষে, অবাধ্যে। নোঙরের আবার ডাকে টনক নড়লো তার। সোজা হয়ে গলা খাঁকারি দিলো। তারপর পিছনে এক পলক তাকিয়ে বললো,
–ওরা গার্ড, তাই আসছে।
নোঙরের চোখ কপালে উঠলো,
–তুমি গার্ড নিয়ে ঘোরো?
বলেই আবার পিছনে তাকালো। তাদের থেকে গার্ডদের দূরত্ব ফুট কয়েক দূরে। পাশাপাশি চলা পাঁচ ছয়টা গার্ড একই পোশাকে একই ভাবে হেঁটে আসছে। দুজনের হাতে আবার লম্বা নলওয়ালা বন্দু’কও আছে।
নোঙরের বারবার তাকানোতে বিরক্ত হলো উজান। কর্কশ গলায় বললো,
–এভাবে বারবার তাকাচ্ছো কেনো? বাজে দেখায়। সামনে তাকাও।
নোঙর সামনে তাকালো বটে কিন্তু থমকে দাঁড়ালো৷ আরেকবার পিছনে তাকিয়ে বললো,
–এদের তো আগে দেখিনি।’
উজান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–সারা রাস্তা ঘুমিয়ে কাঁটালে আর গাড়ি থেকে নেমে পিছন ফিরে না তাকালে দেখবে কিভাবে?
নোঙর আবার অবাক হলো। তাদের সাথে সাথে পিছনের গার্ডরাও দাঁড়িয়ে পরেছে৷ আবার তাকালো সেদিকে৷ তাজ্জব বনে যাওয়া মুখে বিষ্ময়ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে,
–শুরু থেকেই ছিলো?
রাগে মুখ থমথমে হয়ে গেলো উজানের৷ কঠিন গলায় দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
–জ্বি, অনেক আগে থেকেই ছিলো।
–বিয়ের দিনও?
নেহাতই বাচ্চাসুলভ প্রশ্ন। তাতেও উজানের রাগ উঠে গেলো। প্রায় ধমকে উঠে বললো,
–হ্যাঁ ছিলো। তাকে কি হয়েছে? এখন কি যাবে নাকি সারারাত এখানেই কাঁটানোর ইচ্ছা আছে?
নোঙর এপর্যন্ত উজানের রাগকে না এক ফোঁটা গুরুত্ব দিয়েছে, আর না ভয় পেয়েছে৷ উলটে আরো উৎফুল্ল হয়েছে। এবারেও তাই হলো। পিঠে লেপ্টে থাকা বিনুনি সামনে এনে একটু ভেবে বললো,
–কোথায় ছিলো?
–বাইরে ছিলো।
কপট রাগে উত্তর দিলো সাদী। হা-হুতাশ করে উঠলো শীতল,
–ইসস! আগে কেন দেখলাম না!
রাগে, বিরক্তিতে উজানের কপাল আগে থেকেই কুঁচকে ছিলো। আরো কুঁচকে গেলো। ছোট ছোট চোখগুলো আরো কুঁচকে যাওয়াতে মোটা ভ্রুর নিচে থাকা চোখগুলো প্রায় দেখাই গেলো না। সেভাবেই ঠান্ডা স্বরে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো,
–দেখলে কি হতো?
নোঙএ উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
–সালমান খানের বডিগার্ড ফিল্ম দেখেছো?
–না, আমি ফিল্ম দেখি না। টাইম ওয়েস্ট।
নোঙর মুখ ভেঙচে বললো,
–রসকষহীন মানুষ হলে যা হয় আরকি। যদি দেখতে তাহলে এইসব ছেড়েছুড়ে বডিগার্ড হতে চাইতে। আমার কত শখ ছিলো, সালমান খানের মতো বডিগার্ডকে বিয়ে করবো। তোমার বডিগার্ডের মধ্যে ওই মাঝেরটাকে আমার সেই লেগেছে। দেখতেও সালমান খানের কাছাকাছি বলা চলে। ও হলে সেই হতো৷ এখন আর কোন উপায় নেই না?
নোঙরের শেষের কথাগুলোতে ভীষণ আফসোস মেশানো ছিলো। উজানের চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। পিছনে তাকিয়ে অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললো,
–কোনটা?
–ওইতো, ডান থেকে দুই নাম্বারটা। ছোট চুল, কানে ব্লুটুথ ইয়ারফোনের মতো লম্বা কি জানি আছে। ড্রেসাপ চেঞ্জ করে স্যুট পরতে বলবে তো। এইরকম হাফ হাতার শার্টে কেমন লাগছে। স্যুট পরলে অস্থির লাগতো। ইসস! কত কাজ করাও এদের দিয়ে? রোদের তাপে চামড়া পু’ড়ে গেছে। টমেটোর একটা প্যাক আছে। আমি বানিয়ে দেবো। টানা কিছুদিন ব্যবহার করলেই ঠিক হয়ে যাবে।
মহা উৎসাহে বর্ণনা দিয়ে গল্প করলো নোঙর। উজান চিনলো তাকে। লম্বা চওড়া, স্বাস্থ্যবান গার্ডটির জয়েন তিন চারমাস আগেই হয়েছে৷ চাকরিতে বেশ সিনসিয়ারই বলা চলে। ছেলেটার একাগ্রতা বেশ পছন্দ করে সে। পছন্দের এই ছেলেটি অপছন্দের হয়ে উঠতে সময় নিলো না। উজানের মুখের রাগত ভাব সন্ধ্যার অন্ধকারে অনেকটাই ঢেকে গেছে। তবে মনে ঢাকলো না। সময়ের সাথে সাথে পারদ স্কেলে আরো বাড়তেই লাগলো।
উজান তড়িৎগতিতে নোঙরের হাত চেপে ধরলো। এক হাতে নোঙরের ছিড়ে যাওয়া হিল আরেক হাতে নোঙরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। উজানের এই ব্যবহারের সাথে নোঙর ভীষণ অপরিচিত। বিয়ের পর প্রথমবার নিজে থেকে হাত ধরলো সে। কোথায় মনে একটু অন্যরকম অনূভুতি লুটোপুটি খাবে, তা না। উলটো আরো হাত ব্যাথা করছে। সেটা নিয়েও মনে মনে এক প্রস্থ বকে নিলো।
পুরো রাস্তা প্রথমদিনের মতোই ঘুমিয়ে থাকলো নোঙর। বাড়ির কাছে পৌঁছে তাকে ডেকে দিতে চাইলো উজান। তবে ভালোভাবে ডাকলে তো আর সে নোঙর খন্দকারের অর্ধাঙ্গ হতো না।
উজান গাড়ির স্টোরেজ খুলে ভেতর থেকে সেফটি পিন হাতে নিলো। প্রথমদিন নোঙরই স্কার্ফের ঝুলের সাথে সেফটিপিনও গাড়িতে ফেলে গেছিলো। সেদিন জিম শেষে এটার সাথেই আচ্ছতো ঘা খেয়েছিলো সে। আজকে নোঙরের পালা। আর অপেক্ষা করালো না তাকে। নোঙরের কোলের উপর রাখা হাতে খুব সাবধানে সেফটিপিনের সূঁ’চা’লো অংশ দিয়ে খোঁচা দিলো। মূহুর্তেই ধরফরিয়ে উঠলো সে। উজানের কুটিল হাসি বুঝতে পেরে হাত ডলতে ডলতে ভ’ষ্ম করে দেওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে হড়বড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো৷ তবে গাড়ির দরজার সাথে নিজের শক্তিপরীক্ষা করতে ভুললো না। সশব্দে দরজা বন্ধ করে হনহনিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
রাস্তায় জ্যামে বসে সিটের ফাঁকে নোঙরের রাবারব্যান্ড নজরে পরতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। গাড়ির স্টোরেজে সেটা রাখতে রাখতে ঝুলিতে রাখা ইংরেজি ভাষার ভদ্র সভ্য গালিগুলো নিজের উদ্দেশ্যেই ছুড়ে দিলো। ঠিক এইগুলো আর কতদিন চলবে কে জানে!
****
অপলা তার শখের হিল ছিড়ে যাওয়ার ধাক্কাটা পাওয়ার আগেই উজানের অফিস থেকে পাওয়া অফিসিয়াল মেইলের ধাক্কাটা পেয়েছিলো। জুতা ছিড়ে যাওয়ায় অফিসিয়ালি তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে তারা। সাথে ক্ষতিপূরণও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে পুরো পাঁচ হাজার টাকা। মেইলে টাকার নোটের নাম্বারগুলো পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। আবার ক্ষতিপূরণটা যে নোঙর খন্দকারের কাছেই দিয়েছে, সেটাও স্পেশাল ভাবে উল্লেখ করা আছে। একদম বড় বড় ফন্টে লেখা ছিলো,
“ক্ষতিপূরণের টাকা মিসেস নোঙর খন্দকারের কাছ থেকে বুঝে নেবেন।”
শেষে সাইন হিসেবে ছিলো কোম্পানির এমডি আজলান কায়সার এর সাইন।
উজানের পুরো নামটা সাবার জানা ছিলো। বাড়িতে উঠতে বসতে মাহফুজা আর তার পুরো পরিবারের নাম উচ্চারণ করা হয়। তাও প্রতিবারই পুরো নামটা উচ্চারণ করে। ফুপার নাম নেয় বাবা, কাকা আর দুলাভাইয়ের নাম নিচ্ছে তার সদ্য বিবাহিত বউ। মেইল পাওয়ার পর পরই পুরো বাড়ি জুতা ছেড়ার ঘটনা আর ক্ষতিপূরণের ঘটনা ছড়াতেও দেরি করলো না সে। দেরি করলে আবার যদি টাকা ফেরত না পায়!
নোঙর পৌঁছানোর আগেই অপলার মেইল এসে গিয়েছিলো। তাই নোঙর বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই অপলা ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিয়েছে,
–আমার টাকা ফেরত দাও আপু।
প্রথম দিকে তো নোঙর কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু ঘটনা জানতে পারার সাথে সাথেই মুখ থমথমে হয়ে গেছে৷ বরের দেওয়া প্রথম টাকা, উপহার যেটাই বলা হয়, সেটা হলো ওই পাঁচ হাজার টাকা। সেটা কিছুতেই সে হাতছাড়া করবে না।
এরমাঝে সব থেকে বেশি রাগ হলো উজানের প্রতি। নিজে যেচে টাকা দিয়ে আবার সেই টাকাকেই কি কৌশলে ব্যবহার করতে চাচ্ছে! একেই বলে ব্যবসায়ী! নোঙর খুব ভালো করে ব্যাপারটা শিখে নিলো। অন্য সময় কাজে লাগানো যাবে। তবে যাই হোক, টাকাটা তো হাত ছাড়া করা যাবেই না। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,
–আর একবার টাকার জন্য আসবি তো এই টাকা দিয়ে তোর চল্লিশা করবো।
অপলা যে কথাটাতে খুব ভয় পেয়েছিলো তেমনটা না। কিন্তু আর কিছু বলেওনি। আবার থেমেও থাকেনি। রাতে নোঙরের বাবা ফিরতেই অভিযোগের খাতা নিয়ে বসেছিলো সে। টাকা তার ফেরত চাই-ই চাই। তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে নোঙরকে বলে উঠেছিলো,
–তুমি যদি আমার টাকা ফেরত না দাও তাইলে কিন্তু আমি দুলাভাইকে কল করে বলবো, আমার টাকা তুমি মে’রে দিছো।
নোঙর দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলো,
–যা কর৷ তাও দেবো না।’
নোঙরের বাবা পাশ থেকে ধমকে উঠে বললেন,
–নোঙর, তুমি টাকা ফেরত দাও। খন্দকারদের একটা মানসম্মান আছে। এই ঘটনা ওরা জানতে পারলে কি হবে বুঝতে পারছো? মাহফুজার শ্বশুরবাড়ির সামনে আমাদের মুখ ছোট করতে পারবো না। ‘
নোঙর টাকা কিছুতেই ফেরত দেবে না। কিছুতেই না মানে কিছুতেই না। আবার বাবার কথা ফেলাও যায় না। তাই মিনমিন করে বললো,
–ওইটা আমার বেতনের টাকা ছিলো।’
এবারে কথা বললো নোঙরের মা। ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলেন,
–তুই কি দিনমজুরির কাজ করতিছিস নাকি যে ডেইলি বেজ টাকা দিয়েছে। তিনদিন অফিস করার টাকা কোন অফিস দেয়?
–শ্বশুরবাড়ির অফিসে হাজবেন্ড দেয়।
এবারেও নোঙর বেশ আস্তে করে বিড়বিড়িয়ে উত্তর দিলো। কথাটা নিহানের কানে গেলো৷ ভ্রু কুঁচকে ফিসফিস করে নোঙরকে জিজ্ঞাসা করলো,
–শ্বশুরবাড়ির অফিসে সব লিগ্যাল? মানে সব কাজ করা যায়? যা মন চায় সব?
কণ্ঠে তুমুল উত্তেজনা আর অবিশ্বাস। নোঙর আড় চোখে নিহানের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। ফিসফিস করে বললো,
–অফিসে কোন কাজ না করেও থাকা যায়৷ সারাদিন পুরো ফ্লোর ঘুরলেও কেউ কিছু বলে না। আবার দেরি করে গেলেও অফিসে ঢুকতে দেয়। কিচ্ছু বলে না। কোন কাজেই কারো টু শব্দ করার সাহস হয় না। যখন ইচ্ছা ঢোকা যায় আর বের হওয়া যায়।
সত্য মিথ্যা মিশিয়ে বেশ রসালো গল্প তৈরি করলো সে। মনে মনে ফুপির কথা মনে করে নিজেকে শান্তনা দিলো, নিজেদের অফিস। যখন ইচ্ছা যাবো যখন ইচ্ছা বের হবো!
–ওর টাকা ফেরত দিয়ে দাও। খন্দকারদের নাক কেঁটো না।
নোঙরের বাবা গম্ভীর গলায় বললেন। নোঙর তখন নিহানের সাথে কথা শেষ করে আপন মনে কিছু সত্য মিথ্যা কথা সাজাচ্ছিলো। বাবার কথায় বেশ রাগই করলো। মুখ কালো করে অপলাকে প্রশ্ন করলো,
–তোর হিলের দাম কত?
অপলা উশখুশ করে বললো,
–নয়শো। কিন্তু আমার ক্ষতিপূরণের পুরা টাকাটাই চাই। মেইলে টাকার নাম্বারগুলোও দিয়েছে।
রাগে নোঙরের মাথায় আগু’ন জ্ব’লে উঠলো। অ’গ্নি বর্ষণ করা চোখে তাকিয়ে বললো,
–ঘরে চল, দিচ্ছি।
অন্তু চেঁচিয়ে উঠে বললো,
–যেও না আপু৷ টাকা ফেরত কিন্তু পাবা না।
অপলা সজোরে মাথা নেড়ে অন্তুর কথায় স্বায় দিলো। ঘরে গেলে যে তার টাকা কত ফেরত পাবে, তা তার ভালো করেই জানা আছে! শীতলের অ’গ্নি দৃষ্টি উপেক্ষা করে স্পষ্ট গলায় বললো,
–এখানেই এনে দাও৷ আমি ঘরে যাবো না।’
নোঙর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
–জীবনে কি ঘরে ফিরবি না?
–নোঙর!
মা ধমকে উঠে বললেন। নোঙর মনে মনে জেঠা, জেঠিকে মিস করলো। তারা দুজনেই আজ বাড়িতে নেই। আর সেই সুযোগটা অপলা খুব ভালোমতো কাজে লাগিয়েছে।
থমথমে মুখে যখন টাকা ফেরত দিলো তখন অপলা অত্যান্ত অবিশ্বাসী মুখে টাকার নোটের নাম্বার মিলাতে লাগলো। মিলাতে না পেরে চিৎকার দিয়ে উঠে বললো,
–এইগুলা তো আমাকে দেওয়া টাকা না। তুমি আমার টাকা রেখে দিছো!
নোঙর কটমট করে তাকিয়ে বললো,
–টাকার মান তো বদলে যায় নাই। তাহলে সমস্যা কি?
–তোমার নীতির ঠিক নাই আপু। তোমাকে আর বিশ্বাস করবো না।
মাথা নেড়ে আফসোসে কথাটা বললো অপলা। তারপর টাকা নিয়ে নিজের ঘরে গেলো। নিহান মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বললো,
–খন্দকারদের নাক কেঁটে দিলি রে!
তারপর এক পিস মুরগী কেনার লোভে নিহান আর এলাকায় খোলা নতুন বার্গারের দোকানের বার্গার খাওয়ার লোভে অন্তু অপলার পিছু নিলো।
চলবে…
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৪
উষিরের জ্বর এক রাতেই সেরে গেলো। কিন্তু দুর্বলতার বাহানায় পরেরদিন বিছানা থেকে একফোঁটাও উঠলো না। খাওয়া নিয়েও ঝামেলা পাকালো। সেসব অবশ্য শাহিদাই সামলালো। পুরোটা দিন রাশা মুখ থমথমে রেখেছিলো। মা ছেলের এহেন ভালোবাসার নমুনা তার কাছে বহু পুরোনো। ছেলে খেতে চাইবে না আর মা খাবার নিয়ে পিছে পিছে ঘুরবে। তার বাড়িতে এসব নিত্যদিন চলতো৷
সারাদিন এমন বাহানা করার পর রাত্রেবেলা তেতো মুখের অযুহাতে কিচ্ছু খেলো না। উষিরের এমন নখরামি সারাদিন সহ্য হলেই রাত-বিরেতের নখরামি রাশার আর সহ্য হলো না। উষিরের ক্ষিদে পেয়েছে ভীষণ। ক্ষিদের জ্বালায় ঘুমোতে পারছে না। একটার সময় তাকে গভীর ঘুম থেকে জাগিয়ে বাহনা ধরেছে। এখন গরম গরম কিছু খেতেই হবে। অসুস্থ মানুষের উপর রাগতে হয় না। রাগটা সে গিলে ফেললো। মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখে উষিরকে জিজ্ঞাসা করলো,
–কি খাবে?
রাশা ফোনে রেস্টুরেন্ট খুঁজছিলো। সচরাচর এতো রাতে সব রেস্টুরেন্টই বন্ধ থাকে। আবার খোলা থাকলেও হোম ডেলিভারি দেয় না। এতো রাতে আদুরে বাচ্চাদের মতো বাচ্চাসুলভ ন্যাকামির অভ্যাস তার নেই। তাই জানেও না, কোন কোন রেস্টুরেন্ট রাতেও হোম ডেলিভারি দেয়। তবে তার বরের বোধহয় আছে। সেইজন্যই এতো রাতে গরম গরম খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। উষিরের ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হলো না। মোবাইল নেওয়া দেখেই শোয়া থেকে উঠে বসলো। কপালে ভাজ ফেলে জিজ্ঞাসা করলো,
–খাবার বাইরে থেকে অর্ডার করবে?
রাশার ভ্রু জোড়া কুঁচকে তির্যক মন্তব্য করলো,
–তা নয়তো কি করবো? এখন আন্টিদের জাগিয়ে তো রান্নার কথা বলতে পারি না। ময়নাকেও তো জাগানো ঠিক হবে না। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত সবাই। তাহলে রান্নাটা কে করবে?
–অসুস্থ মানুষের বাইরের খাবার খেতে হয় না। এক কাজ করো, তুমি রান্না করো।
উষির বেশ একটা সমাধানে আসলো। রাশার ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে গেলো। কপট বিষ্ময়ে নিজের দিকে আঙুল উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,
–তুমি আমার রান্না খাবে?
উষির বাবু দিয়ে বসে মাথা উপর নিচ করে গদগদ স্বরে বললো,
–গবেষণা বলে, বউয়ের হাতের রান্না খেলে বর সুস্থ হয়ে ওঠে। এখন ঝটপট আমার জন্য স্যুপ করে নিয়ে আসো।
রাশার চোখে মুখে এবারে দুষ্টুমি খেলা করলো। হাসি আটকে ভ্রু নাচিয়ে আবার প্রশ্ন করলো,
–আর ইউ সিওর?
উষির ফুল কনফিডেন্সে মাথা উপর নিচ করে ঝাকালো। আহ্লাদে রাশাকে একবার জড়িয়েও ধরতে চাইলো কিন্তু রাশা তো রাশাই। হাতের ফোন উষিরের মুখের উপর ছুড়ে ফেলে হনহন করে চলে গেলো। উষির নাকে আর কপালে ব্যাথা পেয়েছিলো। বউয়ের দেওয়া এই এই ব্যাথাটাও হাসিমুখে হজম করে দিলো।
রাশা প্রায় দের ঘন্টা পর ক্লান্ত, ঘামাক্ত শরীরে ঘরে ফিরলো। দেখে মনে হলো, রান্না কম করেছে, যুদ্ধ বেশি করেছে। উষিরের মায়া হলো খুব। ইসস! বউটা বোধহয় এর আগে রান্নাবান্না কিছু করেনি। আজকে কত ভালোবেসে তার জন্য রান্না করলো। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। রাশা ছোট ল্যাপটপ টেবিলটা উষিরের সামনে রেখে তার উপর স্যুপের বাটি রাখলো। টলটলে স্যুপ দেখে উষিরের মুখের হাসি হাওয়া হয়ে গেলো। বড়সর ঢোক গিলে প্রশ্ন করলো,
–এটা কি স্যুপ নাকি স্টু?
–স্যুপ।
রাশার গম্ভীর গলার উত্তর৷ উষির কি বলবে ভেবে পেলো না।
–কিসের স্যুপ এটা?
–মিট স্যুপ।
–কিসের মাংস?
–জানি না। ফ্রিজে যেটা সামনে পেয়েছি সেটাই নিয়েছি।
উষির ঢোক গিললো,
–ইন্সট্যান্ট স্যুপ বানিয়েছো তো?
রাশার মাথা ঘুরে উঠলো। মুখের ঘাম মোছা বাদ দিয়ে চোখ বড় বড় করে উষিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–রান্নাঘরে ইন্সট্যান্ট স্যুপ ছিলো? তাহলে আমি এতোক্ষণ এতো কষ্ট করলাম কেনো!
উষির হাল ছেড়ে দিলো। মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো। দেখতে যেমনই হোক, খেতে মজা হলেই হলো। ভয়ে ভয়ে এক চামচ মুখে তুলতেই মুখের রঙ গায়েব হয়ে গেলো। কোনমতে মুখের টুকু গিলে পুরো এক গ্লাস পানি খেলো। রাশার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,
–তুমি এর আগে কখনও রান্না করেছো?
রাশা কৌতুহলী দৃষ্টিতে উষিরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। খাওয়ার সময় তার মুখের অবস্থা দেখেই যা বোঝার বুঝে গেছে। রান্নার সময় এই ভয়েই সে টেস্ট করেনি।
–হ্যাঁ।
–সেগুলো খাওয়া গেছে?
–না।
রাশা নির্লিপ্ত স্বরে বলে উষিরকে হতভম্ব করে দিয়ে বিছানা ছাড়লো। ক্লোজেট থেকে জামাকাপড় নিয়ে গোসলে গেলো। এতোক্ষণ কষ্ট করে রান্না করেছে, গোসল না করলে হয় নাকি! উষির কি করবে ভেবে পেলো না। স্যুপের বাটি রান্নাঘরে রাখতে গেলো। রান্নাঘর দেখে মনে হলো, সত্যিই সেখানে একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে। এক স্যুপ বানাতে যে কয়টা হাড়ি ব্যবহার করেছে, তার ইয়াত্তা নেই। এক এক করে সবগুলো মশলাই যে ব্যবহার করা হয়েছে সেটা রান্নাঘর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো উষির। রাশা এসব ইচ্ছে করে করেছে নাকি অনিচ্ছাকৃত হয়ে গেছে, ঠিক বুঝলো না। কিন্তু এই অগোছালো রান্নাঘর দেখে মা, ছোট মা আর ময়নার উপর বেশ করুনা হলো। করুনা করেই হোক আর বউয়ের কীর্তি ঢাকতেই হোক, ঘন্টা নিয়ে সব পরিষ্কার করে তবেই ঘরে ফিরলো। রাশা ততক্ষণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমন্ত রাশাকে দেখে মুচকি হাসলো উষির। দরজা, লাইট বন্ধ করে রাশার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পরলো। এখনও প্রথমদিনের মতোই তার বউ ঘুমের ঘোরে অজান্তেই তার কাছে চলে আসে। তবে সে প্রথমদিনের মতো বিরক্ত হয় না। এমনকি এখন যে তার বউ তারই টি-শার্ট পরেছে, সেটা নিয়েও বিরক্ত হলো না। তবে উজান দেখলে হয়তো ভড়কে যেতো। এই টি-শার্ট জোড়া ধরে কেনা হয়েছিলো। একটা উজানের আর একটা তার। এবং পছন্দটা উজানেরই ছিলো। পছন্দের টি-শার্ট রাশাকে পরা দেখার পরের রিঅ্যাকশনটা ভেবেই হেসে ফেললো।
উষিরের আশংকা সত্যি হয়েছিলো। উজান রাশাকে দেখেই কাশতে কাশতে নাকে পানি উঠে গেছিলো। বেচারা খেতে বসেছিলো। খাওয়াটাও হয়ে উঠলো না। প্লেটে আধ খাওয়া রুটি অমনি পরে রইলো। শুধু কফিটা মন দিয়ে শেষ করতে লাগলো। রাশাকে দেখে শাহিদার গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পরলো। আবার রাগটাও পরেনি। তাই বৃষ্টি আর বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–অনুষ্ঠানের বেশি দেরি নেই। শপিং যা করার করে ফেল। কার কি লাগবে না লাগবে, তার লিস্ট করতে হবে। যার অনুষ্ঠান সে যেনো রিসেপশনের ড্রেস অর্ডার করে ফেলে। আর বাদ বাকি যা যা লাগবে তাও যেনো তাড়াতাড়ি কিনে ফেলে।
রাশা ভ্রু কুঁচকে শাহিদার দিকে তাকালো। কথাটা সরাসরি তাকে বললে বোধহয় সে কিছু মনে করতো না। এমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছে কেনো? কিছু কি হয়েছে নাকি?
মাহফুজা রাশার ভাবনার সুতা কাঁটলো। বৃষ্টি বন্যার পরীক্ষা চলছে। তারা খেতে বসে পরছে আর মাহফুজা খাইয়ে দিচ্ছে। তাদের খাওয়াতে খাওয়াতেই বললো,
–নোঙরকে নিয়ে শপিংএ যেও। দুই বউয়ের মধ্যে ভাবসাব হতে হবে তো। নাহলে শুরুতেই একে অপরকে হিংসা করা শুরু করবে। আজকালকার মেয়েদের বোঝা মুশকিল!
রাশা চোখ মুখ কুঁচকে এবারে মাহফুজার দিকে তাকালো। তার সাথে এসব হচ্ছেটা কি! মাথা নেড়ে কথাগুলো ঝেড়ে ফেললো। প্লেটে রুটি নিয়ে কি দিয়ে খাবে সেটা দেখতে দেখতেই উজানের কথা কানে আসলো,
–নো ওয়ে মা। এতো বারবার অফিস টাইমে ছুটি দিলে বাকি স্টাফদের মনে কি প্রভাব পরবে? সবাই তো এটাই ভাববে যে বসের ফ্যামিলি মেম্বার জন্য তাকে আলাদা ফ্যাসিলিটিস দেওয়া হচ্ছে, তার জন্য আলাদা রুল ক্রিয়েট করা হচ্ছে।
রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরা এমন ভাবে কথা বলছে যে মনে হচ্ছে কালকেই অনুষ্ঠান আর আজকেই সব শপিং শেষ করতে হবে। অন্যদিকে মেয়েদের খাওয়ানো রেখে মাহফুজা ক্ষোভ প্রকাশ করলো,
–তুইও তো অফিস টাইমেই বের হয়ে চলে আসিস। তখন কিছু হয় না?
–আমি বস আর ওরা এমপ্লয়ি। বোথ আর নট সেম। আর আমি কাজের জন্য বের হই। ওর মতো মন ইচ্ছা বের হই না। আত্মীয় জন্য যা খুশি করলে তখন বাকিরা একে একে অফিস থেকে চলে যাবে। কেউ কাজ করতে চাইবে না।
এবারে শাহিদা নিজের কাজ ফেলে রান্নাঘর থেকেই গলা তুলে পালটা জবাব দিলো,
–আত্মীয় তো ঘরের মানুষই তাই না?
রাশা চট করে শাহিদার দিকে তাকালো। ওপেন কিচেনের বদৌলতে ডাইনিং এড়িয়া থেকে কিচেনের সবটাই দেখা যায়। শাহিদাকে সরাসরিই দেখা গেলো। প্রতিবাদি হয়ে উঠলো রাশা। তেজি স্বরে বললো,
–একদমই না। এখন কি মেহজাবিনকে ঘরের মানুষ ভাবতে হবে নাকি?
রাশার প্রতি শাহিদার মন গলতে শুরু করেছিলো। এই কথায় এক লাফে আবার আগের অবস্থায় চলে আসলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে হাতের সবজি সর্বচ্চ শক্তিতে ঝুড়িতে রাখলো। মাহফুজা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঝটপট বললো,
–একদিনই তো আসবে। নিজেদের অফিস, যদি এইটুকু সুযোগ না পায় তাহলে নিজেদের অফিস হয়ে লাভ কি হলো!
সাথে কান্না ফ্রী ছিলো। বৃষ্টি আর বন্যার চোখ বইয়ে থাকলেও কান শপিং এর আলোচনায় ছিলো। আচমকা মায়ের কান্নায় তারা থতমত খেয়ে তাকালো। শাহিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–উজান, মাকে কাঁদাচ্ছিস কেন?
–ওকে, যা ইচ্ছা করো।
বলেই উজান রেগে উঠে চলে গেলো। মাহফুজা চোখ মুছে আবার বৃষ্টি আর বন্যাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। শাহিদা রান্নাঘরে সবজি আলাদা করে রাখছিলো। হঠাৎ রাশার দিকে নজর পরতেই দেখে রাশা আড়চোখে মাহফুজার খাইয়ে দেওয়া দেখছিলো আর মুখে মলিন হাসি নিয়ে নিজের খাবার খাচ্ছিলো। শাহিদার বুকটা কেমন একটা করে উঠলো। সেও বাড়ির আদরের মেয়ে ছিলো। মায়ের আঁচলের তলায় থেকেই মানুষ। শ্বশুরবাড়ি এসেই পরিবারের দ্বায়িত্ব মাথায় চেপে বসে। একটা মেয়ে যে নিজের পরিবার থেকে অন্য একটা পরিবারে এসেছে, সেখানে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটা কেউ বুঝতেই চাইতো না। সবসময় পরপর করেই রেখেছিলো সবাই। মাহফুজাকে তিনি এই কষ্টটা বুঝতে দেয়নি। শ্বশুর শাশুড়ি তখন গত হয়েছেন। বড় সংসার ভেঙে ছোট হয়েছে। সেই ছোট সংসারের রাশ তখন তার হাতে। বড় বোনের মতো আগলে রেখেছিলো তাকে। নিজে যে কষ্টটা পেয়েছিলো সেটা আর কেউকে পেতে দিতে চায় না। রাশাও কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো মায়ের কথা খুব মনে পরছে। বাড়িতে হয়তো তার মা-ও এমন তুলে খাইয়ে দিতো৷ শাহিদার বুকটা হুহু করে উঠলো। মেয়েটার উপর রাগ করে আছে ঠিক আছে৷ কিন্তু তাকে এমন মানুষিক পিড়া দেওয়ার অধিকার তার নেই। রাশার বাড়ির খবর তিনি জানে না। কিন্তু তিনি রাশাকে দেখলো, কষ্ট পেলো। নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভাব বজায় রেখে ধমকেও উঠলো,
–কি পাখির মতো টুকুর টুকুর করে খাচ্ছো? ভালো করে খেতে পারো না?
রাশা থতমত খেয়ে শাহিদার দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলো। বন্যা পাশ থেকে আস্তে করে শিখিয়ে দিলো,
–বড় করে হা করে পুরো রুটিটা মুখে পুরে নাও।
রাশা ঢোক গিলে সায় জানালো। আচমকা ধমকে রাশা সত্যিই ভয় পেয়েছে। বুক এখনও কাঁপছে৷ শাহিদা নিজের কাজ ফেলে এগিয়ে এসে রাশার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। তারপর প্লেট থেকে এক টুকরো রুটি ছিড়তে ছিড়তে বকবক করতে লাগলো,
–বাড়ি থেকে কি শুধু ঝামেলা পাকানো শিখে এসেছো?
রাশা তাজ্জব বনে শাহিদার কর্মকান্ড দেখতে লাগলো। মুখের কাছে খাবার এলেও রাশা হকচকিয়ে বসে রইলো। তাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শাহিদা ধমকে উঠলো,
–তাড়াতাড়ি খাও। আমার অনেক কাজ আছে।
রাশাকে লাস্ট কবে কে খাইয়ে দিয়েছিলো, তার মনে নেই। বোধহয় হাত দিয়ে খাওয়া শেখার পর আর কেউ খাইয়ে দেয়নি। কোনদিন যে কেউ তাকে খাইয়ে দেবে সেটাও ভাবেনি। চোখ ভিজলো, গলা কেঁপে উঠলো। একসময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠে দুই হাতে শাহিদার কোমড় জড়িয়ে ধরলো।
চলবে…