#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০২
–এই বিয়ে আমি কিছুতেই মানি না। আমার ভালো মানুষ ছেলেকে ধোকা দিয়ে বিয়ে করানো হয়েছে। তোমার ফ্যামিলিকে আসতে বলো দ্রুত। এর ফয়সালা আজকেই হবে।
রাশা বড়সড় হাই তুললো। নব্য শাশুড়ি মাকে একদম ঠিক চিনে নিয়েছে। তার জহুরির চোখ! এতো সহজে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না।
–সেটা আর সম্ভব না আন্টি। তারা আমাকে চিরতরেই বিদায় দিয়েছে৷ বলেছে, এখন আর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তাই এখন আমিই আমার অবিভাবক। যা বলার আমাকেই বলুন।
শাহিদা চিৎকার করে উঠলো। মাথার উপর রাখা আইসব্যাগ ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে রাশার দিকে তেড়ে এসে বললো,
–আমার সাথে মশকরা হচ্ছে? চেনো আমাকে?
রাশা চোখ পিটপিট করে শাহিদাকে দেখলো৷ তারপর নিরীহ গলায় বললো,
–আপনিই তো আমার শাশুড়ি আম্মা। চিনবো না! আপনাকে কি তাই এতো বড় অপমান করতে পারি?
শাহিদা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলো৷ মাঝরাস্তায় থেমে পরা পা-টা আবার চালিয়ে রাশার দিকে তেড়ে গেলেন। আফসার সাহেব ধমক দিয়ে হাত টেনে ধরে আটকালেন,
–এসব কি শুরু করেছো তুমি? এখন কি মারামারি করবে নাকি?
শাহিদা দাঁতে দাঁত চেপে রাগী গলায় বললো,
–এই মেয়েকে আগে বিদায় করো, তারপর আমার সাথে কথা বলতে এসো। এই মেয়েকে আমার সহ্য হচ্ছে না।
আসফার সাহেব চড়া গলায় আবার ধমক দিলেন,
–পাগল হলে নাকি? আগে মাথা ঠান্ডা করো।
লিভিংরুমের সোফার কাছে এতোক্ষণ উষিরের চাচী মাহফুজা দাঁড়িয়ে ছিলো। আফসার সাহেবের কথায় সায় জানিয়ে তিনিও বললো,
–ভাবী আগে একটু ঠান্ডা হন। ওদের বিয়ে কিভাবে হলো সেটাও তো জানা জরুরি। বিয়ে তো ছেলেখেলা না।
মাহফুজার কথায় শাহেদার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগলো। ফুঁসে উঠে ঝটকা মেরে আফসার সাহেবের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর হিসহিসিয়ে বললো,
–ছেলেকে কোন কানপড়া দিয়ে বিয়েতে রাজী করালে?
রাশা চুপ থাকতে পারলো না। এতোক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখন অনেকটা এগিয়ে এসে বললো,
–কোন কানপরা দেওয়া হয় নাই আন্টি৷ একটু মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছিলো যাস্ট। তাতেই কখন যে বিয়ে হয়ে গেলো, টেরই পেলাম না।
আফসার সাহেব বিপদ আঁচ করতে পারলেন। সত্যিটা বললে যে কি ভয়ংকর পরিস্থিতি হবে, বুঝতে পেরে নিজেই তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন,
–সেরকম কিছুই হয়নি। লাস্ট মোমেন্টে বরপক্ষ বিয়েতে না করে দিয়েছিলো। উপায় না পেয়ে উষিরের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
শাহেদা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–তোমায় এতো দিল দরদী হতে কে বলেছে শুনি?
রাশা হতাশার শ্বাস ফেলে বললো,
–আংকেল! সেখানে সত্যি বললে ঝামেলা কম সেখানে মিথ্যা বলে ঝামেলা বাড়ানোর কি দরকার বলুন? বরপক্ষ বিয়েতে মানা করেনি। মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা অন্য জায়গায় হয়েছে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি যে রুমে ঘুমিয়েছি তোমাদের ছেলেও একই রুমে ঘুমিয়ে আছে। আর একটু ডিটেইলসে বললে একই বেডে ঘুমিয়ে ছিলো মানে ছিলাম।
ঘরে ছোটখাটো ককটেল বিস্ফোরণ হলো। কিছুক্ষণ থমথমে পরিবেশ বজায় থেকে আচমকা শাহেদা কেঁদে উঠলো। কাছে থাকা সোফায় বসে কপাল চাপড়ে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে আহাজারি করতে লাগলো,
–তুমি এই চরিত্রহীন বাজে মেয়েকে আমার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে! ছি ছি ছি! লজ্জা করে না তোমার? কি সর্বনাশ করে ফেলে তুমি! হায় হায় রে!
রাশা রেগে গেলো। দু’কদম এগিয়ে শক্ত গলায় বললো,
–আমার চরিত্র নিয়ে কোন কথা বলবে না। সবাই যে অভিযোগ তুলেছে, তার পুরোটা মিথ্যা, ইলজিক্যাল! ছোট একটা মিস্টেকে এমনটা হয়েছে। এতে কারোরই কোন দোষ নেই। একটা সাধারণ ব্যাপারকে এতো প্যাঁচানোর কি আছে?
শাহেদা অগ্নিলাল চোখে চিড়বিড়িয়ে উঠলো,
–একটা বেয়াদব, লাজ লজ্জাহীন আর চরিত্রহীন মেয়ের মুখ থেকে আর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি। বের হও এক্ষুনি?
–আমার ক্যারেক্টার নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, প্রশ্ন কিন্তু তোমাদের ছেলের ক্যারেক্টারেও প্রশ্ন ওঠে৷ আর যদি তোমার ছেলে ইনোসেন্ট হয় তাহলে আমার বেলায় দোষ কেনো? ওই রুমে যখন আমি যাই তখন তোমার ছেলে কিছু বলে নাই কেনো?সারাবছর বন্ধ থাকা একটা ঘরে যে কেউ ঘুমিয়ে আছে সেটা তো আমার জানার কথা ছিলো না। তাহলে এখানে আমার কি দোষ!
মাহফুজা বললো,
–সেসব কথা আমাদের কেনো বলছো? তোমার ফ্যামিলির তোমাকে ভালো চেনার কথা৷ তারা যখন তোমাকে ত্যাগ করেছে তখন আমাদের আর কিছু বোঝার বাকি নেই। এখন তুমি সেখানে খুশি যেতে পারো। আমারও দুইটা মেয়ে আছে। তোমাকে এখানে রেখে তাদের ভবিষ্যত নষ্ট করতে চাই না। বড় ভাই যদি তোমাকে রাখে তাহলে বাধ্য হয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে আমার চলে যেতে হবে।
আফসার সাহেব চেঁচিয়ে ধমকে উঠলেন,
— কেউ কোত্থাও যাবে না। ছেলেখেলা হচ্ছে নাকি এখানে? রাশাও কোথাও যাবে না আর না তুমি মেয়েদের নিয়ে কোথাও যাবে।
শাহেদা চোখ মুখে মুছে উঠে দাঁড়ালো,
–হ্যাঁ, কারোর যাওয়ার দরকার নেই। আমিই চলে যাই এখান থেকে। তোমরা সবাই শান্তিতে থাকো।
আফসার সাহেব কঠিন গলায় বললেন,
–ওকে ছেলের বউ এর সম্মান দিয়ে ঘরে তোলো শাহিদা। তারপর যেখানে খুশি চলে যেও। আমার কথার নড়চড় যেনো না হয় বলছি।
–ওই মেয়েকে আমি বউ হিসেবে মানিই না। বরণ করে ঘরে তোলা তো দুঃস্বপ্ন!
রাশা তপ্ত শ্বাস ফেললো। ছোট সমাধান মাথায় এসেছে। সেটাই হাসিমুখে প্রকাশ করতে চাইলো,
–আচ্ছা ঠিক আছে। অনেক ঝামেলা হয়েছে। বউ হিসেবে না মানলে মানবে না। কোন চাপ নেই। কেউ জোর করছে না।
শাহেদা নাক টেনে আবার বসে পরলো। অনেকক্ষণ পর একটু শান্তি লাগছে। প্রসন্ন মুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,
–দেখেছো, তোমার নিয়ে আসা মেয়েটাও একই কথা বলছে। নিজেই নিজের যোগ্যতাটা বুঝে গেছে।
আফসার সাহেব হতাশ হয়ে স্ত্রীর পাশের সিটে বসে পরলেন। রাশাও মুখের হাসি চওড়া করে আরেকটা সোফায় বসে পরলো। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যাথা হয়ে গেছে। পায়ের হিল জুতা খুলে ক্লান্ত পা জোড়া ঠান্ডা মেঝেতে রেখে বললো,
–একদম ঠিক কথা বলেছো। এখন তাহলে আমি এই বাড়ির অতিথি। তোমাদের দেখে খুব অতিথি পরায়ণ মনে হচ্ছে। সকাল থেকে কফি খাইনি। এককাপ কফি দাও আগে। মাথা হ্যাং হয়ে আছে। কফি খেয়ে বাকি আলোচনা করছি।
ঘরের সবাই তব্দা খেয়ে গেলো। মাহফুজার দুই জমজ মেয়ে বন্যা আর বৃষ্টির রাশার প্রতি আগ্রহ ব্যাপক। এই আগ্রহের বশেই বন্যা বললো,
–তুমি অতিথি হলে কেমন করে?
রাশা ঠোঁট উঠে বললো,
–বা…রে! বউও না আবার অতিথিও না, এটা তো মানা যায় না। একটা তো মানতেই হবে।
শাহিদা রেগে উঠে দাঁড়ালো। হাত উঁচিয়ে দরজা নির্দেশ করে বললো,
–তুমি এই বাড়ির কেউ না। এক্ষুনি চলে যাবে তুমি। গেট আউট!
রাশা পাত্তা না নিয়ে সোফায় পিঠ এলিয়ে আড়াম করে বসলো,
–আহ! কি যে বলো তুমি আন্টি! আমি তো এখান থেকে বের হলে সোজা পুলিশ স্টেশনে যাবো। তখন আমাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য থাকবে। যেভাবেই হোক, বিয়ে তো হয়েছে। অস্বীকার তো কেউ করতে পারবে না। আই হ্যাভ এনাফ প্রুফ। তার থেকে বেটার হয় যে কোন একটা চুজ করা। হয় বউ হিসেবে মেনে নিতে হবে আর নাহলে গেস্ট হিসেবে মেনে নিতে হবে। অবশ্য বউ হিসেবে মেনে নিলে একটা সমস্যা আছে। ছেলে তো আগেই পগারপার হয়ে বসে আছে। ছেলেকে ধরে বেঁধে আনতে হবে আগে। তারপর আমাকে মেনে নিয়ে সারাজীবন চলতে হবে।
বৃষ্টি অনেকক্ষণ হলো কিছু চিন্তা করছিলো। সারাদিন বড় মা অর্থাৎ শাহিদার সাথে সিরিয়াল আর সিনেমা দেখতে দেখতে নিজেরও এমন কিছুই করতে মন চাইলো। তাই এগিয়ে এসে শাহিদার কানে কানে কিছু বলতেই কুটিল হেসে উঠলো শাহিদা,
–ওকে তোমার শর্ত মানলাম। তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। তবে তুমি বউ বা গেস্ট হিসেবে না, মেড হিসেবে থাকবে। বাড়ির সমস্ত কাজ করতে হবে তোমাকে।
রাশা আগ পিছ চিন্তা না করেই বললো,
–আমি রাজী।
আফসার সাহেবের নিজেকে পুতুলের মতো মনে হচ্ছে। বাড়ির কর্তা হয়েও কেউ তার কথা না শুনছে আর না পাত্তা দিচ্ছে। ভেতরে ভেতরে সাংঘাতিক চটে যাচ্ছে আর ভাবছে আর একটু বাড়াবাড়ি করলেই নিজের আরেকটা রুপ দেখিয়ে দেবে।
ময়না এতোক্ষণ সব কাজ ফেলে ঘরোয়া ড্রামা দেখছিলো। শেষেরদিকে দেখলো তার নিজের পেটেই এখন লাথি পরতে চলেছে। তাই আর চুপ থাকতে পারলো না। ডাইনিংরুমের দেয়ালের আড়াল থেকে বের হয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো,
–আমার কি হইবে ম্যাডাম? আমার চাকরি গেলে খামু কি?
বৃষ্টি ময়নাকে আশ্বাস দিলো,
–তোমার কেনো চাকরি যাবে? তোমরা দুজনই থাকবে।
ময়না হাসিমুখে ধন্যবাদ দেওয়ার আগেই রাশা ফস করে তাকে বলে উঠলো,
–তোমার বেতন কত?
ময়না হকচকিয়ে গেলেও সামনে উঠে দ্বিধান্বিত স্বরে বললো,
–পনেরো হাজার।
রাশা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু ভাবলো। তারপর শাহিদার দিকে তাকিয়ে বললো,
–ওকে, আমি তাহলে বিশ হাজারে ডান করছি।
শাহিদা বেগম বিষ্মিত হলেন,
–বিশ হাজার!
রাশা দায়সারা ভাবে বললো,
–আমার বেতন। রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, বাসন মাজা, ঘর মোছা সব কাজ করবো। শুধু বাজারটা পারবো না। রোদে ঘুরলে ট্যান পরে যাবে। আর জামাকাপড় ধুতে পারবো না। ওটা আমার একদম ভালো লাগে না।
ময়না দেখলো, আবারও তার পেটে লাথি পরতে চলেছে। তাই আবারও কথার মাঝে ফোড়ন কাটলো,
–নতুন বউয়ের বেতন বিশ হাজার হলে আমি কিন্তু পনেরোতে কাজ করমু না। আমারেও বিশ হাজার বেতর দেওয়া লাগবে।
আফসার সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। রাগী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
–তোমাদের নাটক আর কতক্ষণ চলবে?
রাশা শান্তনা দিয়ে বললো,
–আর একটুখানি আছে আংকেল। আপনি আমার একমাত্র সাক্ষী। একমাত্র আপনাকেই ভরসা করতে পারি। একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ।
তারপর শাহিদার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
–হ্যাঁ তো আন্টি, আমি তাহলে ডিল ডান করছি?
শাহিদা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–মগের মুল্লুক পেয়েছো? কোন বেতন পাবে না।
–এটা তো আইন বিরুদ্ধ আন্টি। চাকরি করবো আর বেতন পাবো না, এমনটা তো হতেই পারে না। এখন তো আপনার কাছে তিনটা অপশন আছে। ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিয়ে বধূবরণ করে সসম্মানে ঘরে তুলবেন। অথবা অতিথি হিসেবে অতিথিপরায়ণতা করবেন। আর না হলে চাকরি দেবেন। বেতন বিশ হাজারের এক টাকাও কম না। বেশি হলে আমার সমস্যা নেই কিন্তু একদম কম না।
মাহফুজা শাহিদাকে শান্ত করতে চাইলো। না মানার মতো চরম সত্যটা অবশেষে প্রকাশ করলো,
–ভাবী, এই মেয়ের সাথে পারবেন না। শেষে সম্মান নিয়ে টানাটানি পরে যাবে৷
রাশা এক গাল হেসে মাহফুজার দিকে তাকিয়ে বললো,
–হাউ সুইট আন্টি। তোমার পরিচয় কি?
মাহফুজা গম্ভীরমুখে বললো,
–তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। ভাই আর ভাবির সাথেই কথা শেষ করো।
রাশা কাঁধ নাচিয়ে বললো,
–ওকে
শাহিদা উঠে দাঁড়াতে চাইলো৷ ক্লান্ত স্বরে বললো,
–আমার মাথা ঘুরছে। ঘরে যাচ্ছি আমি।
রাশা তড়িঘড়ি করে বললো,
–আন্টি, অ্যাগ্রিমেন্টে সাইন করে তারপর যাও।
উঠতে নিয়ে আবার ধপ করে বসে পরলো শাহিদা,
–আবার কিসের অ্যাগ্রিমেন্ট?
–কিসের আবার? চাকরি করবো আর কিছু শর্ত রাখবো না? তোমার কিছু শর্ত থাকবে, আমার কিছু থাকবে। এসব নিয়েই না চুক্তিপত্র তৈরি হয়। আমি আবার মুখের কথায় একদম বিশ্বাসী না।
নিজের কথা শেষে সোফা টেবিলের উপর রাখা বন্যার খাতা আর কলম তুলে খাতার একটা ফাঁকা পেজ খুললো৷ তারপর কলমের আঁচড় টেনে লিখতে শুরু করলো,
শর্তসমূহঃ
১. ছয় মাসের আগে চাকরিচ্যুত করা যাবে না৷ যদি করা হয় তাহলে যুক্তিপূর্ণ কারন দেখাতে হবে।
২. কাজের সময়, সকাল আটটা হতে রাত আটটা পর্যন্ত। এর অতিরিক্ত সময় চাকরির অভার টাইম হিসেবেন গণ্য হবে এবং সে মোতাবেক বেতনের টাকা যুক্ত হবে।
৩. মাসের এক থেকে তিন তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় কর্মী যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
৪. কাজের লিস্ট – রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা, বাসন মাজা আর ঘর মোছা। এর অতিরিক্ত কাজ হলে অতিরিক্ত বেতন গুণতে হবে।
এই চারটা শর্ত লিখে কাগজ শাহিদার দিকে এগিয়ে দিলো। হাসিমুখে বললো,
–এবারে তোমাদের শর্ত লেখো।
শর্তগুলো পরে শাহিদা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো৷ চোখ গোল গোল করে একবার রাশার দিকে তো একবার কাগজের দিকে দেখতে লাগলো। বিষ্ময়ের পরিমাণ এতো ছিলো যে নিজের শর্তের কথা বেমালুম ভুলে আচ্ছন্নের মতো সাইন করে দিলো। রাশা হাসিমুখে কাগজ নিয়ে নিজেও সাইন করে সাক্ষী হিসেবে ময়না আর আবসার সাহেবের সাইন নিলো। তারপর কাগজটার গোটা কয়েক ছবি তুলে আবসার সাহেবের কাছে গচ্ছিত রাখলো। ময়না সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের বেতনের কথা মুখেও আনতে পারলো না। ভগ্ন মন নিয়ে রাশাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। যদিও সেটা এখন রাশার সাথে ভাগ করে থাকতে হবে।
চলবে..
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৩
ঘরটা বেশ ছোট। তাও রাশা বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো সবটা। ছোট সিঙ্গেল বেড, একটা কাপর রাখার আলনা, একটা মাঝারি সাইজের আয়না আর একটা টেবিল আছে শুধু। টেবিলে জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই। রাশা বড় করে শ্বাস ফেলে নিজের লাগেজের দিকে তাকালো। লার্জ সাইজের তিন তিনটে লাগেজ যে এখানে কোথায় আটাবে বুঝতে পারছে না। চিন্তায় চিন্তায় মাথা চুলকাতে চাইলো। মাথায় হাত দেওয়ার পর বুঝলো, এখনও সে বধূবেশেই আছে। চেঞ্জ করা দরকার। আয়নার সামনে গিয়ে একে একে গহনাগুলো খুলতে লাগলো। ময়না ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে ছিলো। মুগ্ধ চোখে রাশার গহনা খোলা দেখছিলো। গহনার বহর শেষ হয় না দেখে অবাক বিষ্ময়ে বললো,
–এতো গয়না আফনার! সব সোনার?
ময়নার অবাক হওয়া গলার স্বরে রাশা হেসে ফেললো।
–সব সোনার না। ডায়মন্ডেরও আছে। আর কিছু স্টোনেরও আছে।
ডায়মন্ডের কথায় ময়নার মুখ হা হয়ে গেলো।
–আফনে তো দেহি হেব্বি বড়লুক! বাপরে!
রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসলো। গহনাগুলো গোছাতে গোছাতে বললো,
–কোথায় আর বড়লোক হলাম! বাবা তো ত্যাজ্য করে দিয়েছে। এখন আমি দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ গরীর। না আছে বাড়ি আর না আছে পরিবার। শুধু আছে একটা চাকরি। তাও জোর করে পাওয়া।
রাশা মোটেও মন খারাপ করে কথাটা বলেনি৷ কিন্তু ময়নার খুব মন খারাপ হলো। সম্পর্কছেদের ব্যাথায় মন হুহু করে উঠলো। চোখের পানি সামলে রাশাকে শান্তনা দিলো,
–মন খারাপ কইরেন না৷ বাপ মায়ের রাগ দুই মিনিটের। দুই মিনিট পরে সব ঠিক হয় যাবি।
রাশার মন হঠাৎ করে খুব ভালো হয়ে উঠলো। মনে হলো, তার দুঃখেও তাহলে কেউ দুখী হয়! উৎফুল্ল মন নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
–তোমার নাম কি?
–ময়না।
রাশা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ময়নার কাছে গেলো। তারপর হাত টেনে হ্যান্ডশেক করে বললো,
–আমার নাম রাশা। তোমার সহকর্মী৷ আপনি ডাকটা আমার একদম পছন্দ না৷ আমাকে একদম আপনি বলবে না।
ময়না হকচকিয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বললো,
–আচ্ছা। তুম-তুমি সত্যি কাম করবা?
রাশা আবার আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চুলে হাত দিলো। পার্লারের মেয়েরা চুলে এক গাদা ক্লিপ দিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছে। বিয়েতে গন্ডগোল হলেও বড় চাচা কিছুই নষ্ট হতে দেননি। পার্লারে অগ্রিম বুকিং দেওয়ায় দুপুরের বদলে ভোরবেলাতেই তাদের নিয়ে আসা হয়েছিলো। ঠিক যেমন সাজানোর কথা ছিলো, ঠিক তেমনই সাজিয়ে দিয়েছে। শুধু খাবারে মুশকিল হয়েছিলো। বড় চাচা বুদ্ধিমান মানুষ। ম্যারেজ হলের বুকিং নিয়েও কোন না কোন প্ল্যান নিশ্চয় করে ফেলেছেন। রাশার ধারণা, তিনি তার পার্টির লোকজনকে দিয়ে ম্যারেজ হল ভর্তি করেছেন আর বাড়তি খাবার গরীব দুঃখীদের দিয়ে নিজের স্ট্যাটাসের আরেকটু উপরে উঠে গিয়েছে। বলা যায় না, হয়তো এতোক্ষণে খবরের কাগজে কিংবা সোশ্যালমিডিয়াতে তার দানশীলতা ছড়েও পরেছে। এসব তো ওনার ওয়ান টু-র ব্যাপার।
ক্লিপ চুলে আটকে বসে আসে৷ জোরে খোলার চেষ্টা করতেই চুলে টান লাগলো। চোখ কুঁচকে জোরে টান দিলো রাশা। ক্লিপের সাথে গোলাপ ফুল আর কিছু চুলও উঠে এসেছে। অবহেলায় সেটা ফেলে দিলো৷ তারপর আড়াম করে বসে ময়নার প্রশ্নের উত্তর দিলো,
–হ্যাঁ, পেট চালাতে হবে তো। মাসে বিশ হাজার এমনি এমনি আসবে নাকি?
তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলো, এখানে এটাচ বাথরুম নেই৷ চেঞ্জ করা অতি জরুরি হয়ে পরেছে। শাড়িটা প্রচন্ড ভারি৷ ইন্ডিয়া থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনা হয়েছে৷ হাত দিয়ে শাড়ির সেপটি পিন খুলতে লাগলো৷ গায়ের জোরে খুলতে নিয়ে শাড়িও ছিড়ে গেলো। ছিড়ুক শাড়ি। সৌরভ নিজে গিয়ে শাড়ি পছন্দ করে নিয়ে এসেছে৷ তাই এটা পুড়িয়ে ফেললেও রাশার কিচ্ছু যায় আসবে না।
–তোমার ঘরের দরজা তো একটাই। তাহলে ওয়াশরুম কোথায়?
সুন্দর শাড়ি আর চুলের বেহাল অবস্থা দেখে ময়নার খুব আফসোস হলো৷ কেউ চেয়েও পায় না আর কেউ হেলায় ফেলে দেয়!
–বাইরে বাগানের দিকে। রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়া যায়।
এই প্রথমবার রাশা অবাক হলো,
–এতোদূর! কাছে কোন ওয়াশরুম বা চেঞ্জিং রুম নেই?
ময়না দীর্ঘশ্বাস ফেললো। উদাস মনে বললো,
–মাথার উপর ছাদ আছে এই অনেক। আমার নিজের বাড়িত তো টয়লেটও নাই। চার পাঁচ ঘর মিলায়া একখান টয়লেট।
রাশা কেমন করে একটা হাসলো। তারপর বললো,
–এইজন্যই বলে, দুনিয়া দেখতে হলে ঘরের বাইরে বের হতে হয়।
ময়নার দেখানো পথে গিয়ে আরেক ধফায় অবাক হলো। পাশাপাশি দুটো ছোট ঘর৷ একটা টয়লেট আর একটা গোসলখানা৷ গোসলখানায় একটা ট্যাপ আর একটা লাল বালতি, লাল মগ করেছে৷ সাবান রাখার জায়গাটাও কেমন নোংরা। আবার জামা কাপড় রাখার জন্য দড়ি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। আর কি ভীষণ দুর্গন্ধ! রাশা নাকে কাপড় চেপে কোনরমকে চেঞ্জ করে বাইরে বের হয়ে বাঁচলো। বড় করে শ্বাস ফেলে নিজেই নিজেকে বললো,
–রিলিফ! শান্তির জীবনে ওয়েলকাম রাশা।
নিজেই নিজেকে তাচ্ছিল্য করলো। তারপর দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরে গেলো৷ হাতের ভারি শাড়ি বিছানায় ফেলে দিলো আগে৷ ভারি শাড়িটা এতোক্ষণ হাতে ধরে রাখায় হাত ব্যাথা হয়ে আছে। রাশার পরনে টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়াটার ট্রাউজার। ফর্সা পায়ের অনেকাংশই উন্মুক্ত। শরীরে আর কোন গহনাও নেই। বিয়ের চিহ্নস্বরূপ রয়েছে শুধু হাতের মেহেদী। সেটাও যদি না থাকতো তাহলে নিশ্চিন্তে নিজেকে অবিবাহিত দাবি করা যেতো। সৌরভের নাম হাতে কিছুতেই লেখতে দেয়নি। এটা বেশ বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে।
রাশার প্রায় ছুড়ে ফেলা শাড়ি দেখে ময়না আঁতকে উঠলো,
–এতো সুন্দর শাড়ি এমনে ফেলাইলা? আমার হলে তো আমি মাথায় করে রাখতাম।
রাশা ময়নার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বিছানা থেকে শাড়ি গুছিয়ে ময়নার হাতে দিয়ে বললো,
–তুমিই নাও তাহলে। আমার এটার কোন দরকার নেই।
শাড়ির ভারে ময়নার হাত ঝুঁকে পরলো। অবাক দৃষ্টিতে রাশাকে দেখে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
–তুমি…তুমি..
রাশা তাকে আরেক দফায় অবাক করে গহনাগুলোও গুছিয়ে বিছানায় সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলো,
–তুমি এই জুয়েলারিগুলোও নাও। এগুলোরও কোন দরকার নেই।
ময়নার মাথা ঘুরতে লাগলো। রাশা তার সাহায্যে শাড়ি সুন্দর করে ভাজ করে রাখলো। তারপর লাগেজ থেকে জুয়েলারি বক্স বের করে সব জুয়েলারি সুন্দর করে গুছিয়ে ময়নার হাতে তুলে দিলো। ময়না বিষ্ময়ে কথা বলতেই ভুলে গেছে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রাশা চুটকি দিয়ে ময়নার ধ্যান ভেঙে বললো,
–জুয়েলারিগুলো এভাবে ফেলে রাখবে না। লকারে রাখতে পারো। চুরি হওয়ার ভয় থাকবে না। অথবা সেল করে দিতে পারো। আমার কাছে বিল আছে। সেল করতে সুবিধা হবে। সেই টাকা দিয়ে বিজনেস স্টার্ট করতে পারো। আই হ্যাভ হিউজ আইডিয়া। একে একে সব বলবো। আপাতত এখন একটু শান্ত হও আর আমাকে তুমি এখানকার ঠিকানাটা বলো। আমি কিছু জিনিস অর্ডার করবো।
ময়না ঢোক গিলে চোখ পিটপিট করে বললো,
–কি অডার করবা?
–বেশি কিছু না৷ এখানে থাকার জন্য যেসব জিনিস জরুরি, সেসব আনতে হবে। যেমন, এসি, ম্যাট্রেস, ড্রেসিং টেবিল, ক্লোজেট এটসেট্রা এটসেট্রা।
ময়নার চোয়াল আবার ঝুলে পরলো,
–এসি আনবা!
–হুম, গরম আমার একদম সহ্য হয় না। এখানে একটা মাত্র ফ্যান আছে। তাও ঘটঘট করে বিশ্রী আওয়াজ করে। আর তোমার বেড তো অনেক শক্ত। ঘুম তো নাইটমেয়ার হয়ে যাবে। তুমি ঘুমাও কিভাবে?
ময়না ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
–তুমি অনেক আদরে মানুষ হইছো, তাই না?
রাশা ময়নার দিকে ঝুঁকে চোখ টিপে বললো,
–আমি ক্ষমতার প্রাচুর্যে মানুষ হয়েছি। পাওয়ারও বলতে পারো।
ময়না আর্তনাদ করে উঠলো,
–পাওয়ার! তোমরা কি জ্বিন পরী?
যে নির্দ্বিধায় নিজের দামী গহনা আর শাড়ি দিয়ে দিতে পারে, সে যে মানুষ হতেই পারে না সে ব্যাপারে ময়না একশো পার্সেন্ট সিওর। তাই কথাটা বলে ফেলেছে। রাশা হাসিতে ফেটে পরলো৷ অনেক কষ্টে হাসি আটকে বললো,
–তুমি ঠিকানাটা দাও আগে। এগজ্যাক্ট লোকেশন চাই।
–আমি তো জানি না। আপারা জানে। আমি লিখে নিয়ে আসি।
–যাও তাড়াতাড়ি। গরমে আমার নাজেহাল অবস্থা।
এক দৌড়ে চলে গেলো ময়না। ফিরেও এলো দ্রুত। উৎফুল্ল মুখে বললো,
–এইযে ঠিকানা নাও। একেবারে ঠিকঠাক লিখা আনছি। আপারা তো তোমার লিস্ট শুনে হা হয়ে গেছে।
বলেই আবার হেসে ফেললো। রাশা ঠিকানার কাগজ হাতে তুলে ট্রাউজারের পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বললো,
–ঠিকানা নিয়ে আর লাভ নেই ময়না। আমার অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিয়েছে।
ময়না বুঝতে না পেরে বললো,
–মানে?
রাশা হেসে ফেললো। মজা করে সুর ধরে বললো,
–মানে আমি পার্মানেন্টলি তোমার মতো বাথরুম ছাড়া গরীব হয়ে গেছি।
ময়নার মুখ ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলো৷ একপলক রাশার দেওয়া জিনিসগুলোর দিকে তাকালো। ভাবলো, হয়তো এগুলো নিয়ে নেবে। মন খারাপ হলেও সামলে নিলো দ্রুত। সে তো এগুলোর লোভ করেনি। যেভাবে এসেছিলো, সেভাবেই চলে যাবে। এতে তারই বা কি করার আছে। কিন্তু রাশার অবস্থায় খুব কষ্ট পেলো। এইটুকু সময়ে এটা তো বুঝেছে, রাশা মোটেও তার মতো করে মানুষ হয়নি। এই পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে না জানি কি কষ্টই না হবে!
— কষ্টে এতো হাসতিছো তাই না? কষ্ট পাইও না। সব ঠিক হয়ে যাবি।
রাশা কোন উত্তর দিলো না। মাথা সাংঘাতিক চুলকাচ্ছে৷ সবে অর্ধেক খোলা হয়েছে৷ বাকি অর্ধেক তাড়াতাড়ি খুলতে হবে। তাই ময়নাকে সাহায্য করতে বললো,
–তুমি আমাকে চুল খুলতে হেল্প করো একটু। মাথা ব্যাথায় মাথা ফেটে যাচ্ছে।
ময়না তাড়াতাড়ি রাশাকে সাহায্য করতে ছুটে আসলো। আলতো হাতে ক্লিপ খুলতে খুলতে বললো,
–তুমি যে বললা, ওইভাবেই কি তোমাদের বিয়ে হইছে?
রাশা মাথা ঘুরিয়ে ময়নার দিকে মুখ করে আস্তে আস্তে বললো,
–তোমাকে একটা সিক্রেট বলি। আমি না বিয়েটা করতাম না। পালিয়ে যেতে নিয়েছিলাম। আর দেখি বড় চাচা করিডরে পাইচারি করছে। আমার তো ভয়ে মাথা খারাপ। যেজন্য রাত তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম তাও যদি পালাতে না পারি তাহলে তো মুশকিল। তাই করলাম কি, পাশে থাকা একটা রুমে ঢুকে গেলাম। নিলয় ভাইয়ার রুম ছিলো ওটা। ভাইয়া তো দেশেই থাকে না। যখন আসে তখন ওটা তার রুম হয়ে যায়। আর ভাইয়া তো বিয়েতে আসেইনি। তাই নিশ্চিন্তে ভেতরে ঢুকে পরেছিলাম। তারপর দেখি বড় চাচা রুমের সামনে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো ভয়ে এক লাফে খাটে উঠে ব্ল্যাংকেট দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পরেছিলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়েছি, টেরই পাইনি। এবারে বলো, এখানে আমার দোষ কোথায়?
ময়না অনাক বিষ্ময়ে বললো,
–তুমি পালাইতে চাইছিলা কেন?
–কেনো আবার! বিয়ে করবো না তাই। ওই ছেলেকে বিয়ে করা যায় নাকি? এতো গায়ে পরা আর এতো বিরক্তিকর। উফফ!
ময়না সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে খোশমেজাজে বললো,
–উষির ভাই কিন্তু হেব্বি সুইট৷ তোমরা অনেক হ্যাপ্পি হবে। তোমারে অনেক ভালোও বাসবে। এখন একটু রেগে আছে মনে হয়। কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবি।
উষিরের কথা ওঠায় রাশার আরেকটা ব্যাপার মনে আসলো। সেটাও খোলসা করা জরুরি,
–উষিরের কি কোন পছন্দ টছন্দ ছিলো?
ময়না তড়িৎ মাথা দুইদিকে নেড়ে বললো,
–না না, ভাই একদম সলিড।
রাশা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রাগত গলায় বললো,
–আমি জানতাম! চেহারা ছাড়া ওর আর কোন গুনই নাই। ধ্যাত!
ময়না হকচকিয়ে গেলো,
–বরের আগের কোন চক্কর না থাকলে বউ খুশি হয় আর তুমি রাগলা!
রাশা উদাস হয়ে গেলো,
–তুমি বুঝবে না।
চুল খোলা শেষ হতেই রাশার স্টাইল করে কাটা ডিপ ব্রাউন চুলগুলো পিঠে এলিয়ে পরলো। ময়না তুলোর মতো চুলে হাত বুলিয়ে মুগ্ধ হয়ে বললো,
–তোমার চুলগুলা পুরা হাওয়াই মিঠাই। কি সুন্দর!
রাশা হেসে ফেললো৷ হাসির আওয়াজ ঘন্টার আওয়াজে ঢাকা পরে গেলো। ময়লা লাফিয়ে উঠে বললো,
–তাড়াতাড়ি চলো, ডাকতিছে আমাদের।
রাশা বিরক্ত হয়ে গেলো। এই ঘন্টা দিয়ে সে এতোদিন শুধু ডেকেই গেছে। এর আওয়াজ যে এতোটা বাজে, তা কে জানতো!
–এটার আওয়াজ এতো বিদঘুটে কেনো!
ময়না রাশার কথা শোনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো না। দ্রুত পায়ে চলে গেলো৷ বাধ্য হয়ে রাশাকেও ছুটতে হলো।
লিভিংরুমের সোফায় শাহিদা আর মাহফুজা বসে আছে। মুখ গম্ভীর, থমথমে। রাশা আর ময়না গিয়ে দাঁড়াতেই শাহিদা গম্ভীরমুখে রাশার দিকে তাকিয়েই চোখ বড় বড় করে ফেললো। তারপর ধমকে উঠে বললো,
–এসব কি পরেছো? নতুন বউ বিয়ের দিন এইসব পরে? বাড়ি থেকে এইসব শিখে এসেছো?
রাশা অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
–আমি কোন বাড়ির নতুন বউ?
মাহফুজা রাগী গলার বললো,
–মজা করার জায়গা পাও নাই? জানো না কিছু?
–জানি জন্যেই তো বলছি আন্টি৷ যদি আমি নতুন বউ হই তাহলে তো আমি কোন একটা বাড়ির কোন একটা ছেলের নতুন বউ। নতুন বউ তো আর একা একা হওয়া যায় না।
শাহিদা রাগে গিজগিজ করতে লাগলো,
–বেয়াদপ মেয়ে একটা। বাড়িতে এসে একেবারে ঘাটি গেঁড়ে বসে পরেছে।
বলেই আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা করলো না। উঠে চলে যেতে নিতেই রাশা পথ আটকে দিলো,
–আরে আন্টি যাচ্ছো কেনো? ডেকেছো কেনো সেটা তো বলে যাও?
শাহিদা আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো,
–আমাকে আন্টি ডাকবে না, খবরদার।
–তো কি ডাকবো? শাশুড়িমা? শাশুড়ি আম্মা? মা? ম্যাডাম?
একনাগাড়ে বলে চললো রাশা। শাহিদা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। রাশা উপায় না পেয়ে মাহফুজার দিকে তাকিয়ে বললো,
–আন্টির নাম কি?
মাহফুজা থতমত খেয়ে গেলো,
–শাহিদা।
রাশা এরপর চিৎকার করে বলে উঠলো,
–শাহিদা খালাম্মা?
শাহিদা এক মূহুর্ত থমকে দাঁড়িয়ে রাশার দিকে তেড়ে আসলো,
–কি ডাকলে?
রাশা এক দৌড়ে সোফার পেছনের নিরাপদ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর দাঁত বের করে হেসে বললো,
–পছন্দ হয়েছে না? ডাকটা আমারও দারুন লেগেছে। এই ডাকেই ডাকবো তোমায়। কেমন?
শাহিদা হুংকার দিয়ে উঠলো,
–বেয়াদব..
রাশা কানে আঙুল চেপে বিরক্তিকর সুরে বললো,
–আর কতবার বলবে আন্টি? এতোবার ডাকলে তো শব্দটার উপর অভক্তি চলে আসবে। ট্রাই নিউ সামথিং, প্লিজ। ইউ ক্যাম ডু ইট।
শাহিদা আর কিছুই বললো না। তার এই মেয়ের সাথে কথা বলাই ভুল হয়েছে। বলে নিজেই নিজেকে ধমক দিলো। তারপর হনহনিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। মাহফুজার কোন এক অজানা কারণে রাশাকে খুন ভয় লাগে। সেও আর এক মূহুর্ত থাকলো না। পেছন থেকে রাশা অবশ্য অনেকবার ডেকেছিলো কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিজেকে বাঁচানো জরুরি।
চলবে..