#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৯ (প্রথমাংশ)
একদিনের মধ্যেই অদ্ভুত ভাবে উষির আর রাশার খবরটা ধামাচাপা পরে গেলো। মিথ্যা খবর প্রচারের জন্য সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে কেস করা হলো, সাংবাদিকের চাকরি গেলো। উষিরের বাড়ির সামনে থেকে সব সাংবাদিক উধাও হওয়ার পর পুলিশ প্রটেকশনও চলে গেলো। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সবাই৷ শুধু বাঁচলো না রাশা তাও উষিরের হাত থেকে। উষির তাকে নিয়ে এলাকা ঘুরতে বের হয়েছে। না জানি কোত্থেকে একটা প্যাডেল চালিত ভ্যান এনে তাতে রাশাকে নিয়ে সফর করতে বের হলো।
জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঢুকতেই উঁচু নিচু কাচা রাস্তায় হাল বেহাল হয়ে গেলো। তার উপর গতরাতের ঝুম বৃষ্টিতে চারিদিকে শুধু কাদা আর কাদা। রাশা কপালে হাত দিয়ে বিরক্ত নিয়ে ভ্যানে বসে ছিলো৷ পরনে সাদা কামিজে কাদার ছিটা লাগছে৷ সেদিকে তার ধ্যান নেই৷ বিরক্ত, চরম হারে বিরক্ত সে। কিসের কি, কোথাকার কি! একটা বিয়ে মানুষের জীবনে কি পরিমাণে পরিবর্তন করে তার নমুনা সে নিজে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, রাগ কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে, বিরক্ত হতে হতে বিরক্তের উপরও বিরক্ত হয়ে উঠেছে।
উষির রাশার সামনের সিটে বসেছিলো। ভ্যান থামতেই চট করে নেমে পরে রাশাকেও নামালো। তারা গ্রামের বাজারে এসেছে। লোকজন তেমন নেই। গ্রাম্য বাজারে সাধারণ সকালবেলা লোকের ভীড় বেশি থাকে। দিন যত গড়াতে থাকে, লোক তত কমতে থাকে। এখন দুপুরই বলা চলে। এইসময় এখানে কেনো এসেছে সেটা রাশা জানে না। জানতে চাইলো। জিজ্ঞাসাও করলো৷ উত্তরও পেলো।
–আজকের লাঞ্চ এখানে করবো। আমি রান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। তুমি তো আর রান্না করে খাওয়াও না।
স্পষ্ট ঠেস ছিলো। রাশার মুখ শক্ত হয়ে গেলো। রান্না কে করতে বলেছে? চলে গেলেই তো হয়ে গেলো! শুধু শুধু ঝামেলা করা। মনে মনে এইসব বলে আচ্ছামত বকলো তবুও মনের ঝাঁজ মিটলো না। বুঝলো, খু’ন টুন না করা পর্যন্ত এই ঝাঁজ মিটবে না। রক্তও মাঝে মাঝে কথা বলে। রাশা বড় বড় করে শ্বাস ফেললো।
বাজারের ঠিক মধ্যিখানে একটা ছোট ভাতের হোটেল আছে। তিনটে বড় টেবিল আর দুই পাশে কাঠের বেঞ্চ পাতা। তারা গিয়ে একটাতে বসতেই একটা লোক ছুটে এসে উষিরের সাথে কথা বলতে লাগলো। রাশা বুঝলো, লোকটার সাথে আগে থেকেই কথাবার্তা বলে রেখেছে। কথাবার্তা শেষে লোকটা চলে যেতেই রাশা গালে হাত দিয়ে বললো,
–এতো নাটক কি রাজনীতিতে আসার পরে শিখেছো নাকি নাটক শিখে তারপর রাজনীতিতে নেমেছো?
উষির কিছু বললো না, শুধু হাসলো। একের পর এক প্লেট এনে টেবিল ভরে ফেললো লোকটা আর তার একজন সহকারি। রাশা নিঃশব্দে সবটা দেখলো। মেন্যুতে আছে, নানা রকমের ভর্তা আর ভাত। রাশা বিষ্ময়ে বললো,
–শুধু ভর্তা?
উষির মাথা নেড়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
–ইনি খুন ভালো ভর্তা বানায়। খেয়ে দেখো, মুখে এর স্বাদ লেগে থাকবে।
ভর্তা রাশার একদম পছন্দ না। অনেক মজা করে বানালেও কেমন কেমন লাগে। বিশেষ করে ভর্তা বানানোর প্রসেসটা। কিভাবে চটকে চটকে মাখে! দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে।
–আমি ভর্তা খাই না। অন্য কিছু অর্ডার দাও।
উষির অবাক হয়ে তাকালো,
–তাহলে কি খাবে?
প্রশ্নটা আচমকা মুখ থেকে বের হয়ে গেলো। রাশা ঝাঁজালো স্বরে বলল,
–সব প্ল্যান নিজে নিজে করলে এমনই হয়। আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলে?
–কেউ যে ভর্তাও খায় না সেটা আমি কিভাবে জানবো!
উষির কাঁধ নাচিয়ে বললো। তারপর চিন্তিত স্বরে লোকটাকে ডাকলো। লোকটা আসতেই কপালে ভাজ ফেলে জিজ্ঞাসা করলো,
–আপনার কাছে আর কিছু আছে?
–শৈল মাছের তরকারি আছে।
–নিয়ে আসুন।
রাশা আতকে ওঠা গলায় বললো,
–কি নিয়ে আসুন? আমি মাছ খাই না।
লোকটা সব শুনে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলো,
–আলু ভাইজা দিমু ভাবি?
–আলু না৷ আলুতে অনেক ক্যালরি।
–বেগুন?
রাশা মুখ কুঁচকে ফেললো,
–নাহ, বেগুন মানুষ খায় নাকি! জঘন্য টেস্ট।
–তাইলে কি খাইবেন ভাবি?
লোকটা হতাশ হলো। উষির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–ডিম ভেজে আনুন।
রাশা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললো,
–হ্যাঁ, বেটার হবে। দুইটা ডিমের ওয়াটার পোচ করবেন। আর কুসুমও দেবেন না। দুইটা ডিম খেলে আর ভাত খেতে হবেন না।
রাশা ভাতের প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো। লোকটা চিন্তিত হলো খুব। ডিমের ওয়াটার পোচের নাম তিনি শুনেছেন। কিন্তু কখনও যে বানাতেও হবে, সেটা তিনি জানতেন না। উষির খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে লোকটার উদ্দেশ্যে বললো,
–চলুন, আমি রান্না করে আনছি।
রাশা চোখ তুলে উষিরের দিকে তাকালো। মনে কেমন ভালো লাগা ছেয়ে গেলো৷ কিছু বললো না। উষির কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসলো৷ আটার রুটি আর ডিম একসাথে ভাজি করেছে৷ অনেকটা মোগলাইয়ের মতো হয়েছে। সাথে কিছু সবজি কুচি কুচি করে মিক্স করে দিয়েছে৷ খেতে খুব সুস্বাদু ছিলো৷ দুইটা রুটি এমন করে বানানো ছিলো। রাশা পেট পুরে গেলো৷ খাওয়া দাওয়া শেষে তারা হাঁটতে হাঁটতে বাজারের বাইরে চলে আসলো। ওখানে একটা টি-স্টল ছিলো। উজানের ভাষ্যমতে, সেখানে অনেক মজাদার দুধ চা পাওয়া যায়। সেটাই খাওয়া উদ্দেশ্য। উজানের পরিচিত একজনের সাথে দেখা হওয়ায় তার সাথে কিছু কথা বলছিলো। রাশা হেঁটে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো৷ সেখান থেকে নদী দেখা যায়৷ নদীর ওপারে বিশাল বড় চর। দেখতে খুব ভালো লাগছে৷ খুব যেতে ইচ্ছে করছে সেখানে।
-তোমাগোর দুইজনার চেহারায় কি মিল! তোমার ভাই নাকি?
রাশা নজর ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। পাশে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, তিনি পান খাওয়ায় সাংঘাতিক আসক্ত। রাশাকে চুপ দেখে মহিলাটা পুনরায় একই প্রশ্ন করলো,
–তোমার ভাই নাকি?
রাশার কেমন একটা লাগলো৷ তাকে দেখে কি উষিরের বউ বউ লাগে না! সাথে সাথে নজর ঘুরিয়ে উষিরের দিকে তাকালো। উষির কথা বলায় মশগুল। তাকে যে উষিরের বউ বউ লাগে না, ব্যাপারটা মনে হতেই কেমন মেজাজ গরম হলো। মুখ সাংঘাতিক কুঁচকে ফেললো। দেখে মনে হচ্ছে, ভুল করে নিম পাতা খেয়ে ফেলেছে৷ সেভাবেই বললো,
–এ আমার ভাই হলে আমি সেইদিনই সুই’সাই’ড করে ফেলতাম।
–তাইলে কেডা?
মহিলাটার গলায় চিন্তিত স্বর৷ মেয়েটাকে দেখে বিবাহিত মনে হচ্ছে না। সম্পর্ক নিয়ে বিরাট একটা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। রাশা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। তারপর দুষ্টু হেসে বললো,
–ভাই-ই কিন্তু কাজিন মানে কাকাতো ভাই।
কাকার ফ্রেন্ড কাকা হয়। সেই হিসেবে কাকার ছেলে কাকাতো ভাই হয়। রাশার হিসাব খুব সোজা। উষিরকে বর পরিচয় দেওয়ার থেকে এটাই তার কাছে সব থেকে বেশি সোজা লেগেছে। বৃদ্ধা তার পান খাওয়া মুখে হাসি আনলো। বেশ রসিয়ে কসিয়ে বসে কৌতুহলী গলায় বললো,
–ছাওয়ালের বিয়া হইছে?
রাশাও বেশ সিরিয়াস হলো। মুখভঙ্গী গম্ভীর করে মাথা নেড়ে বলল,
— এখনও হয়নি৷ পাত্রী খুঁজছি। ঘরোয়া, ভদ্র, শান্ত আর সুন্দরী পাত্রী চাই। আমাদের ছেলে খুব ভালো। সবার খুব খেয়াল রাখে। টাকা পয়সাও অনেক। কিন্তু কিছু করে টরে না। তবে পাত্র নেহায়েতই সুপাত্র।
টাকা পয়সার কথা আস্তে আস্তে বলতে হয়৷ রাশা সেই নিয়ম মানলো। সাথে ঘটকালির নিয়ম মেনে পাত্রের গুনগান গাইতে লাগলো। মহিলাটিও তাল মিলালো। উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো,
–আমার হাতে একখান মাইয়্যা আছে৷ আমার নাতনি৷ বহুত সুন্দুর। চাঁদের মতোন। দেখবা?
রাশা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লো। বললো,
–অবশ্যই। ছেলেকে সাথে নেওয়া যাবে?
–হা হা, আইসো আইসো। সামনেই বাড়ি। ওরে ডাইকা আনো। মাইয়্যার লগে মাইয়্যার ঘরবাড়িও তো দেখা লাগবো।
রাশা মাথা নেড়ে উষিরের কাছে গেলো৷ লোকটার সাথে তার কথা শেষ। এখন টি-স্টলের দোকানদারের সাথে কথা বলছে। রাশা গিয়ে তার পাশে দাঁড়াতেই নজর তুলে তার দিকে দেখলো। রাশা কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। কথা শেষ হতেই উষিরের হাত টেনে ধরে বললো,
–চলো।
–কোথায়?
–ঘুরতে এসে ঘুরবে না?
–ঘুরবো কিন্তু যাবো কোথায়?
–এই সামনেই। ওই বুড়ি দাদীর সাথে যাবো। যাবে কি না সেটা বলো?
উষির রাশার ইঙ্গিত করা মহিলাটির দিকে তাকালো। তারপর মাথা নেড়ে বললো,
–তোমাকে একা ছাড়া যাবে না। এক ফোঁটাও ভরসা করি না তোমাকে।
রাশা মুখ বাঁকালো। ভেঙচি কেঁটে বললো,
–আমি তো তোমাকে খুব বিশ্বাস করি!
বলেই সামনে গটগট করে হেঁটে গেলো৷ উষির পিছু নিলো। বৃদ্ধা তাদের নিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকলো। বাড়িটিতে মাটির মেঝের পরপর দুইটা ঘর। টিনগুলো জং ধরে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। ছোট উঠানের একপাশে একটা ভ্যান নীল পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা৷ রান্নাঘরটাও মাটির। রাশা এর আগে এমন বাড়িতে কখনও আসেনি। এসে বেশ মজা লাগছে। মাটির মেঝেতে সবাই কিভাবে চলাফেরা করে যেটা জানার ভীষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বললো না৷
একটা মাঝবয়েসী মহিলা এসে ছোট উঠানে দুটো কাঠের চেয়ার রেখে দিলো। বৃদ্ধা বিনয়ের সাথে তাদের বসতে বললো। রাশা আর উষির দুজনেই বসলো। উষিরের চোখে কৌতুহল আর রাশার চোখে উচ্ছ্বসিত ভাব।
–মেয়ে নিয়ে আসুন।
রাশার কথা শুনে উষির তড়িৎবেগে তার দিকে তাকালো৷ চোখ বড়বড় করে জিজ্ঞাসা করলো,
–কিসের মেয়ে?
রাশা আস্তে করে বললো,
–তোমার জন্য পাত্রী দেখতে এসেছি। চুপচাপ বসে থাকো। সিনক্রিয়েট করো না।
রাশার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। উষির শক্ত হয়ে বসে রইলো। অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলে রাখলো। একটা বাচ্চা ছেলে একটা প্লাস্টিকের টুল এনে তাদের সামনে রাখলো। এরপর দুইটা ছোট প্লেটে চানাচুর আর বিস্কুট এনে রাখলো। আবার ফিরে গিয়ে দুই গ্লাস পানি এনে রাখলো। রাশা একটা বিস্কুট নিয়ে হাসিমুখে খেলো। উষিরের গরম চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে খেতে বলার সাহস হলো না। মিনিট খানেকের মধ্যেই একটা মেয়েকে আনা হলো। পরনে লাল রঙের থ্রি-পিস। আরেকটা চেয়ার এনে সেই চেয়ারে তাকে বসিয়ে বৃদ্ধা নিজ উদ্যোগে মেয়েটির মাথা উঁচু করে রাশাকে দেখালো। রাশা মুগ্ধ হয়ে গেলো,
–মাশা-আল্লাহ! তোমার নাম কি?
–কবিতা খাতুন।
মেয়েটি অনেকবারই নিজে নাম বলেছিলো। কিন্তু এতো আস্তে বলেছিলো যে রাশা নামটাই শুনতে পায়নি। শেষ পর্যন্ত শুনে মাথা নেড়ে পরের প্রশ্ন করলো,
–পড়াশোনা করো?
মেয়েটি মাথা নেড়ে বললো,
–নাইনে পড়ি।
–নাইনে!
রাশা ছোটখাটো আর্তনাদ করে উঠলো। প্রচন্ড ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। বৃদ্ধার হাসি চওড়া হলো। বললো,
–মাইয়্যা সব কাম পারে। রান্নাবান্না, সেলাই সব। ম্যাল্লা খেতাও বানাইছে। ও কবিতার মা, যাইয়্যা নিয়া আসো খ্যাতাগুলান? দস্তরখানাও বানাইছে। নামাজ কালামও পড়ে। সব গুন আছে আমগোর মাইয়্যার।
রাশার গলা কেঁপে উঠলো। আড় চোখে উশিরের তীক্ষ্ণ ভষ্ম করে দেওয়া দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে নার্ভাস গলায় বললো,
–তোমার বয়স কতো?
–মাইয়্যারা তো দশ পারাইলেই বড় হয় যাই। সেই হিসাবে তোর বয়স কতো হইলো রে?
মেয়েটি আস্তে করে উত্তর দিলো,
–পনেরো।
রাশা পানি খেতে নিয়েছিলো। পানি নাকে মুখে উঠে কেঁশে উঠলো। উষির স্থির চোখে রাশাকে দেখছিলো। চোখে মুখে রাগের আভাস, চোয়াল শক্ত, কঠিন।
রাশা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো,
–এই বয়সে বিয়ে হলে তো বাল্যবিবাহ কেসে ফেঁসে যাবেন।
বৃদ্ধার সাথে সাথে মেয়েটি আর মেয়েটির মা-ও অবাক হলো। বৃদ্ধা বললো,
–ওমা! ফাসমু কেন? আমার তো ওর বয়সে তিনখান পোলা মাইয়্যা ছিলো। ওর মা-রেও তো এই বয়সেই বিয়া কইরা আনছিলাম।
রাশা বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। উষির উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে সেখান থেকে হাজার টাকার দুই তিনটা নোট বের করে বৃদ্ধার হাতে দিয়ে বললো,
–আমরা এখন আসছি। মেয়ের এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। অন্তত আঠারো বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।
বলেই আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না। রাশা প্রায় ছুটতে ছুটতে বাইরে আসলো। উষির বাইরে ভ্যান দাঁড় করিয়ে তার অপেক্ষায়ই ছিলো৷ রাশা আসতেই ভ্যানে উঠে বসলো। রাশাও উঠে পরলো। জমিয়ে রাখা কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো,
–টাকা দিলে কেনো?
–নিজের সম্মান বাঁচাতে। মেয়ে দেখতে গেলে তাকে সম্মানসরুপ কিছু দেওয়ার নিয়ম প্রচলিত আছে। না দিলে তাকে ছোটলোক বলা হয়। আমি ওই অপবাদটা চাই না। এমনিতেই যথেষ্ট অপমান করে ফেলেছো।
উষির রেগে আছে। রাশা রাস্তায় কিছু বললো না। বাড়ির রাস্তায় যেতেই উষির নেমে পরলো। বাকিটা পথ হেঁটে যাবে। উষির হাঁটছিলো নাকি দৌঁড়াচ্ছিলো, বোঝা গেলো না। তবে তাকে ধরতে রাশার দৌঁড়াতে হলো। উঁচু লম্বা হিল পরে দৌড়ানো মুশকিল। তবুও অনেক কষ্টে দৌড়ে উষিরকে আটকালো। কোমড়ে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–রাগ করছো কেনো? আমি তো মানুষের উপকার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এরা বাল্যবিবাহ দেবে সেটা আমি কিভাবে জানবো।
আকাশে মেঘ গুড়গুড় করছিলো। যে কোন সময় বর্ষন হয়ে ঝড়তে পারে৷ উষির সেদিকে তাকালো না। রাশার দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,
–বিয়ে নিয়ে সবাই তোমার মতো মজা করে না। এদের কাছে বিয়ে অনেক সেন্সিটিভ একটা ব্যাপার। ডোন্ট ডু দিস এগেইন।
রাশা বুঝলো, মাথা নেড়ে সম্মতিও দিলো৷ তারপর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে চিন্তিত স্বরে বললো,
–ওদের ব্যাপারটা বুঝানো উচিৎ। বাল্যবিবাহ মোটেও ভালো কাজ না।
উষির পকেট থেকে হাত বের করে পাশাপাশি চলা রাশার হাত ধরলো। তারপর নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
–আমরা এখানে সমাজ সেবা করতে আসিনি। ছুটি কাঁটাতে এসেছি। সেটা করলেই বেশি ভালো হয়।
–তুমি না রাজনীতি করো? তোমাদের প্রথম কথাই তো সমাজসেবা।
–পাকনামি করার ইচ্ছা আমার নেই। আর আমার সাথে যখন এসেছো তখন তোমাকেও করতে দেবো না।
উষিরের কথা একদম সুস্পষ্ট। রাশা রাগলো। রুঢ় স্বরে বললো,
–তুমি খুব হার্টলেস। একটা মেয়ের জীবনের প্রশ্ন এখানে।
উষির থমকে দাঁড়ালো। রাশার দিকে ফিরে দুই হাত কাঁধে রেখে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো,
–একটা মেয়ে না, লক্ষ লক্ষ মেয়ে। কতজনকে ঠিক করবে তুমি? তোমার চোখের সামনে একটা আছে জন্য তুমি একটা জানো। কিন্তু রাশা, তুমি বাস্তবতা জানো না? তুমি তোমার পরিবারকে দোষ দাও কিন্তু তুমি জানো না, বাইরের সমস্ত বিপদ থেকে তারা তোমাকে রক্ষা করেছে। এসব কিছু তোমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। ওরা মেয়ে অপছন্দ করে এমন না। ওরা মেয়েদের ঘরে রেখে আগলে রাখায় বিশ্বাসী।
ছোট ছোট ফোঁটায় বৃষ্টি পরা শুরু করেছে৷ রাশার চোখেও ওমন বৃষ্টি পরতে পরতে পরলো না। কঠিন গলায় প্রশ্ন করলো,
–এসব তোমাকে কে বলেছে? সুবোধ স্যার?
রাশার গলার স্বরের সাথে মিলিয়ে আকাশে মেঘ গর্জে উঠলো। বৃষ্টির ফোঁটা এখন বড় আকাড় ধারণ করেছে৷ উষির চিন্তিত মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
–বৃষ্টি পরছে। তাড়াতাড়ি চলো, নাহলে ভিজে যাবো।
রাশা শুনলো না। ক্ষিপ্ত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
–তুমি কিচ্ছু জানো না? তুমি ব্যবহার দেখেছো, কথা শোনোনি। আমি শুনেছি, জেনেছি সব কিছু৷ দ্বিতীয়বার ওদের নিয়ে আমাকে আর কিচ্ছু বলবে না।
–আচ্ছা সরি, আর বলবো না। এবার চলো?
উষির রাশার হাত টান দিয়ে বললো। রাশা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে আবার চিৎকার করে উঠলো,
–আই হেইট ইউ আদনান কায়সার।
উষির হেসে ফেললো৷ বৃষ্টির বড় ফোটা মূহুর্তেই ঝুম বৃষ্টিতে রুপ নিয়েছে৷ উষির তার আদুরে হাত রাশার দুই গালে রেখে মায়াবি স্বরে বললো,
–তুমি আমার। তোমার পরিবার তোমাকে আমার হাতে দিয়েছে৷ এইজন্য আমি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ রাশা। এরজন্য তাদের সাত খু’ন মাফ। কিন্তু তুমি আমাদের প্রথম ডেট খারাপ করেছো৷ ইউ হ্যাভ পানিশড ফর দিস।
–পানিশমেন্ট!
রাশা রাগ ভুলে অবাক হলো। উষির রাশার হাতে নিজের হাতে গুজে সামনে এগোতে এগোতে বললো,
–হুম, এখন থেকে আমি রান্না করবো আর তুমি বাসন মাজবে। সাথে কাপড় ধুয়ে মেলে দেবে। আর ঘরও পরিষ্কার করবে।
রাশা ঝগড়ার প্রস্তুতি নিলো৷ বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকে মেজাজ দেখিয়ে বললো,
–ইচ্ছে হলে কাজ করো, আর না হলে ফেলে রাখো। আমি তোমার কাজ করতে বাধ্য না।
বলেই ভেতরে চল গেলো৷ উষির কোমড়ে হাত রেখে মুচকি হাসলো। তারপর কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে বড় করে শ্বাস টানলো।
চলবে..
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৯ (শেষাংশ)
নতুন শ্বশুরবাড়িতে উজানের দাওয়াত ছিলো৷ ইম্পর্টেন্ট একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। দিন রাত এক করে কাজ করতে হচ্ছে। অযথা সময় নষ্ট করার মতো কোন সময় তার হাতে নেই। কিন্তু মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে ল্যাপটপ বগলদাবা করে শ্বশুরবাড়ি গেলো। পরনে নীল রঙা পাঞ্জাবি। অনেক ভেবেচিন্তে, অনেক খুঁজে তারপর পাঞ্চাবির রঙ পছন্দ করেছে। এরপর মায়ের আদেশ অনুসারে এক গাদা মিষ্টি কিনে শ্বশুরবাড়ি গেলো৷ নতুন সম্পর্ক তৈরি হলে নাকি পুরোনো সম্পর্ক সবাই ভুলে যায়। উজান সেটা আজকে হারে হারে টের পেলো৷ নানাবাড়িতে মামাদের ভাগ্নে আদর পাওয়ার আগেই জামাই আদর পেয়ে গেলো৷ ব্যাপারটা খুব কষ্টের। বাড়িতে যাওয়ার পরপরই তাকে নিয়ে নোঙরের ঘরে বসানো হলো।
কিছুক্ষণ পর নোঙর এসে বিছানার এক কোনে বসলো৷ তারপর থেকে বাম হাতের নখের সাথে ডান হাতের নখের ঘর্ষণ করছে আর দাঁতে ঠোঁট কাঁটছে। রাগে তার মাথায় আগুন জ্বলছে। উজান আসার পর মা আর বড় মা মিলে তাকে শাড়ি পরিয়ে জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে৷ নোঙর ভাবতেও পারছে না, নীল পোশাক পরা কারো কাছে সে বসে আছে। বিরক্ত লাগছে খুব। তার নিজের ঘরে নিজের মতো করে থাকতে পারছে না। লোকটা বিছানায় হেলান দিয়ে কোলে ল্যাপটপ নিজে কাজ করছে৷ নতুন বউকে পাশে বসিয়ে রেখে অফিসের কাজ করছে! এমনিতে প্রেমালাপ করার কোন ইচ্ছা তার নেই। অন্তত নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তো আলোচনা করাই যেতো। কবে নাগাদ সেপারেট হবে কিংবা সেপারেশনের সময় ফ্যামিলিকে কি বলে সামলাবে, এসব। এই বিয়েতে সে থাকবে না সে ব্যাপারে তার দিক থেকে অন্তত সে সিওর। মিনমিন করে একবার বলেও বসলো,
–ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভেবেছো?’
উজান প্রতিউত্তর করেনি। উল্টে ভ্রুগুলো আরো কুঁচকে গেলো। সে দরকারী একটা প্রজেক্টে কাজ করছে৷ তাড়াতাড়ি সেটা কমপ্লিট করে ক্লায়েন্টকে দিতে হবে। নাহলে ক্লায়েন্ট হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। নোঙর সেটা জানলো না, বুঝলো না। উলটে মুখ রাগে অপমানে আরো লাল হয়ে গেলো। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলতে লাগলো।
–আজকে কেনো অফিসে যাওনি?
নোঙর ভষ্ম করে দেওয়া দৃষ্টিতে উজানের দিকে তাকালো। উজানের নজর তখন ল্যাপটপ স্ক্রিনে। ঝাঁজালো গলায় সে উত্তর দিলো,
–ফুপি ছুটি দিয়েছে।
–এসব আমার অফিসে আমি অ্যালাও করবো না। নেক্সট সিক্স মান্থ, আর একবারও অফিস মিস করলে রেজিগনেশন লেটার হাতে ধরিয়ে দেবো।
নোঙর রাগে পা দিয়ে খাটের পায়াতে বাড়ি দিলো। খাট কেঁপে উঠলো। উজানের তাতে কোন হেলদোল নেই। সে কি ইচ্ছা করে ছুটি নিয়েছে নাকি? সকালেই তো ফুপি ফোন দিয়ে বললো, আজ তার অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। আর এখন এতো কথা শুনতে হচ্ছে! হটাৎ চমকে উঠলো নোঙর। তার মানে আগামী ছয় মাসে তাদের সেপারেশনের কোন লক্ষণ নেই!
আহত হলো খুব। অতি কষ্টে তক্ষুনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার আগে উজানের বসার জায়গা হয়েছিলো ড্রয়িংরুমে। ডেকে এনেছিলো তার বড় মামা। যার উপর অভিমান করে তার মা এতোদিন তার বাবার বাড়ি ফেরেনি। আবার তার অসুস্থতার দোহাই দিয়েই মাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ সেই তিনিই এখন ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে ডেকচি সামনে নিয়ে বসে আছেন। হাতে ডাল ঘুটনি। মহা উৎসাহে টক দই ভর্তি ডেকচির মধ্যে ডাল ঘুটনি দিয়ে ঘুটে চলেছে৷ চারপাশে ছড়িয়ে আছে ড্রাই ফ্রুটসের বয়াম, জগ, গ্লাস, চিনির বয়াম ইত্যাদি ইত্যাদি। চোখ দিয়ে কাউকে ভষ্ম করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে উজান সর্বপ্রথম বড় মামাকেই ভষ্ম করে দিতো। তিনি নাকি অসুস্থ! এই তার নমুনা! তারজন্যই আজ তার এই পরিস্থিতি! এই বয়সে বিয়ের তকমা গলায় ঝুলিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।
বড় মামার পাশে সদ্য মুরগীর বিজনেসে হাত দেওয়া নিহান বসে আছে। মুখ কাচুমাচু। কিছুক্ষণ উশখুশ করে বললো,
–বাবা হচ্ছে না। ভালো করে ঘুটতে হবে। মিক্সারে ইজি হবে।
হুংকার দিলেন বড় মামা। বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠে ধমক দিয়ে বললেন,
–তুই লাচ্চি বানাতে পারিস? আমার থেকে বড় রাধুনি হয়ে গেছিস নাকি? মুরগীর ব্যবসায়ী আছিস, মুরগী নিয়েই থাক। এখানে নাক গলাবি না।
মিইয়ে গেলো নিহান। নতুন বোন জামাইয়ের সামনে ধমক খাওয়ায় মুখ ছোট হয়ে গেলো। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো, নতুন বোন জামাই মনোযোগ দিয়ে লাচ্চি বানানো দেখছে। ভ্রু দুটো কুঁচকানো, চোখে বিরক্তির ছাপ।
পুরো বাড়ি খাবারের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে৷ মেন্যুতে আছে তেহারি, হাড়ি কাবাব, ফিশ ফ্রাই আর কাটলেট। অন্তু প্রতিবার রান্নাঘরে যাচ্ছে আর কিছু না কিছু নিয়ে ফিরে এসে উজানের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। অনেকক্ষণ হলই সে তার সাথে কথা বলতে চাইছে। স্কুলে যায়নি আজ। বোনের বিয়ে উপলক্ষে তিনদিনের ছুটি নিয়েছে৷ আজ ছুটির দ্বিতীয়দিন। গোলুমোলু চেহারার অন্তুকে দেখলে যে কেউ গাল টিপে দেয়। আর নয়তো বড় বড় সিল্কি চুল ধরে টান দেয়। বিরক্ত লাগে অন্তুর। নতুন দুলাভাই যাতে এমন না করে তাই বোনের ঘর থেকে চুল বেঁধে এসেছে। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে লাফিয়ে লাফিয়ে উজানের কাছে এসে পাশ ঘেঁষে বসে বললো,
–আমি কিন্তু আপুর ভাই। একেবারে নিজের মায়ের পেটের ভাই।
উজানের কুঁচকানো ভ্রু অন্তুর দিকে এসে স্থির হলো। এই পিচ্চিকে বিয়ের দিনও দেখেছিলো। দূরে দূরে দেখলেও আজ একদম কাছে এসে বসে পরেছে। বিরক্ত হলো উজান। বিরক্তের উপর বিরক্ত! কোন উত্তর দিলো না। অন্তু মাথার ঝুঁটি নাড়িয়ে বললো,
–তুমি কি ফোন ইউজ করো দুলাভাই?
উজান অন্তুর দিকে আড় চোখে তাকালো। মাথায় ঝুঁটি, ঢোলা ঢালা টিশার্ট পরা ছেলেটার মুখ বেশ মায়া মায়া। তবে কথাগুলো একদম মায়া মায়া না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। না জানি আর কতদিন এদের টর্চার সহ্য করতে হবে! বিরক্তিকর শ্বাস ফেলে ছোট করে উত্তর দিলো,
–স্যামসাং।
–কোন মডেলের?
প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। পাল্টা প্রশ্ন করলো,
–তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
–সেভেনে।
মাথার ঝুঁটি নাচিয়ে উত্তর দিলো অন্তু৷ ঝুঁটি নাচানোতে বিরক্ত হলো উজান। এই চার পাঁচ ইঞ্চি চুলের এতো বাহার! মেয়ে হলে না জানি কি করতো!
–সতেরোর ঘরের নামতা বলোতো?
এবারে বিরক্ত হলো অন্তু৷ মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করে বললো,
–দুলাভাই, তুমি তোমার ফোনের মডেলের নাম জানো না?
রাগ গোপন করে উত্তর দিলো উজান,
–এস টুয়েন্টি ফোর।
–ইসসস!
আহাজারি করে উঠলো অন্তু। চোখে মুখে বিমর্ষ, আহত ভাব৷ চোখ বুজে মুখের ভাব এমন করলো, মনে হলো তার অতি প্রিয় জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। খানিক অবাক হলো উজান। বললো,
–কি হলো?
–তুমি আইফোন ইউজ করো না? এ আবার কেমন বড়লোক তুমি! কিপটা দুলাভাই।
আবারও ঝুঁটি নাচিয়ে মাথা ঘুরিয়ে বললো৷ উজান কড়া গলায় বললো,
–আমাকে দুলাভাই বলে ডাকবে না। ভাইয়া ডাকবে। বুঝেছো?
অন্তু উত্তর দিলো না। বিমর্ষ গলায় আফসোস মিশিয়ে মাথা নাড়লো,
–মনটাই খারাপ করে দিলে দুলাভাই।
বলেই উঠে চলে গেলো। ”নোঙরে ভাই!” মনে মনে বিড়বিড় করলো উজান। একটু পর সেখানে অপলার আগমন হলো। মুখের সামনে ট্রে ধরে বললো,
–দুলাভাই, আপনার জন্য শরবত এনেছি। একদম টাটকা বেলের শরবত।
উজান নিজেকে শান্ত করে হাসার চেষ্টা করে বললো,
–আমাকে ভাইয়া বলে ডেকো৷ দুলাভাই ডাকটা আমার পছন্দ না।
অপলা উজানের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বললো,
–আচ্ছা দুলাভাই। আপনি শরবত খান।
বলেই চলে গেলো৷ উজানের একবার মনে হলো ঠাস করে গ্লাস ফেলে দিক। আবার মনে হলো বড় মামার বানানো লাচ্চির মধ্যে পুরো শরবত ঢেলে দিক৷ তবে তার কিছুই করতে হলো না। অন্তু এসেছিলো লাচ্চি টেস্ট করতে। এক হাতে শরবতের গ্লাস, আরেক হাতে ফাঁকা একটা গ্লাস। ফাঁকা গ্লাসে লাচ্চি তুলতে নিয়ে হাতে থাকা শরবত ভর্তি গ্লাসের পুরো শরবত লাচ্চির মধ্যে পরে গেলো। আশেপাশে উজান ছাড়া আর কেউ ছিলো না। অন্তু একপলক উজানের দিকে ভিতু চোখে তাকিয়ে এক দৌড়ে তার কাছে চলে আসলো। তার হাত থেকে শরবতের গ্লাস নিয়ে ফাঁকা গ্লাস ধরিয়ে দিলো৷ হতভম্ব উজানকে আরো হতভম্ব করে দিয়ে চিৎকার করে করে বলতে লাগলো,
–দুলাভাই লাচ্চির মধ্যে শরবত ফেলে দিয়েছে।
উজান ঘটনা বোঝার সময়ও পেলো না। কোন একসময় লাচ্চিতে শরবত ঢেলে দিতে চেয়েছিলো, কল্পনা করেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলো। বড় মামা কিছুক্ষণ উশখুশ করলেন। ভাগ্নে হলেও সে এখন নতুন জামাই। কিছুই বলতে পারলেন না। খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর উজান আর এক মূহুর্ত দেরী করেনি। যেমন বোন তার তেমন ভাই, বলে বকতে বকতে বাড়ি ফিরে গেলো।
*****
মাঝরাতে রাশা চিৎকার করে উঠলো। উষির ঘুম ভেঙে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। ঘরে সে নেই। চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরের বাইরে বের হতেই রাশার সাথে জোরে ধাক্কা লাগল৷ ফলস্বরূপ দুইজন দুই দিকে পরে গেলো। লম্বায় রাশা উষিরের গলা সমান। যার ফলে উষির গলায় আর রাশা কপালে দারুন ব্যাথা পেলো। উষির খানিক সময়ের জন্য নিঃশ্বাস নিতে পারলো না। গলা ব্যাথার ঢোক গিলতেও কষ্ট হতে লাগলো। অন্যদিকে রাশার মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। উষির নিজেকে সামলে রুক্ষ স্বরে বললো,
–হয়েছে কি?
–ভ্য-ভ্যাম্পায়ার!
রাশা নিজেকে সামলে উষিরের দিকে গুটিয়ে বসে তোতলাতে তোতলাতে উত্তর দিলো। উষিরের ভ্রু কুঁচকে গেলো,
–ভ্যাম্পায়ার! কোথায়?
–বাই-বাইরে বাইরে। দুই চোখ জ্বলজ্বল করছে। আর কি ভয়ংকর স্বরে ডেকে ডেকে উঠছে। তাড়াতাড়ি চলো, সব দরজা আর জানালায় রসুন ঝুলাতে হবে। ওরা রসুনের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। আর আর..আগুন জ্বালাতে হবে। পুরো বাড়িতে লাইটও জ্বালাতে হবে। অন্ধকারে থাকা যাবে না।
–কি পাগলের প্রলাপ বকছো?
তক্ষুনি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা শিয়াল ডেকে উঠলো। রাশা চমকে উঠে উষিরের হাত খামচে ধরলো,
–ওইযে আবার ডেকে উঠলো?
উষির বিরক্তও হলো আবার হাসিও পেলো। গলার কাছটা এখনও ব্যাথা করছে৷ তার উপর রাশা হাত খামচে ধরেছে। বড় বড় নখ হয়তো হাতে বসেই গেছে৷ সেদিকে তাকিয়ে বললো,
–ওটা শিয়ালের ডাক। আগে শোনোনি?
রাশা শোনামাত্র হাত ছেড়ে দিলো। সত্যিই নখ বসে গেছে। উষির হাত মুখের সামনে ধরে আফসোসে মাথা নাড়লো। রাশা দাঁতে দাঁত চেপে তেজি সুরে বললো,
–আমি তো শিয়ালের সাথেই এতোদিন থেকেছি। ডাক কেনো শুনবো না?
শিয়াল পুনরায় ডেকে ওঠায় আবার চমকে উঠে উষিরের খামচি দেওয়া হাত আবার খামচে ধরলো। ভয়ার্ত গলায় বললো,
–শিয়াল এতো গভীরভাবে ডাকে? কাল তো শুনলাম না।
–এটা সাউন্ডপ্রুফ কাঁচ৷ আজ হয়তো কোন জানালা খোলা আছে তাই শব্দ আসছে।
বিরক্তভাবে বলে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলো। রাশা ছাড়লো না। দুই হাত দিয়ে উষিরের হাত জাপটে ধরে কাঁপা গলায় বললো,
–কি? কোথায়? জানালা বন্ধ করতে হবে। চলো তাড়াতাড়ি, খোলা জানালা খুঁজতে হবে।
রাশা উষিরকে আঁকড়ে ধরে জানালা খুঁজতে বের হলো। ওইদিকে ক্রমাগত শিয়াল ডেকে চলেছে। আর প্রতিটা ডাকে রাশা কেঁপে কেঁপে উঠছে। রান্নাঘরের জানালা খোলা ছিলো। সেটা বন্ধ করতেই হাপ ছেড়ে বাঁচলো। উষিরের থেকে কয়েক হাত দূরে সরে দাঁড়িয়ে আবার চিৎকার করে উঠলো,
–ওইতো দেখো? ভেতরে আসলো কিভাবে?
উষির কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকালো। বেশ কয়েকটা লাইট জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। শিয়ালের চোখ হয়তো। উষির সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট উলটে বললো,
–হয়তো কোন দেয়ালে গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। এখন সেখান দিয়েই এসেছে।
–কি ভয়ংকর!
রাশা আনমনেই বলে বসলো। উষির মজা করার লোভ ছাড়তে পারলো না। হাসি চেপে বললো,
–এখনই বাড়ি যাবে? গাড়ি আসতে বলবো?
রাশা ভয়ংকর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। উষির রাগ পাত্তা না দিয়ে দুষ্টু হেসে বললো,
–তো রাশা বাঘ, ভাল্লুক, সাপ, নরখাদক, ভুত কিচ্ছুতে ভয় পায় না। শুধু ভ্যাম্পায়ার আর শিয়াল দেখে ভয় পায়।
রাশা কথা ঘুরালো। মুখ ফুলিয়ে গমগমে গলায় বললো,
–তোমার সাথে আমার আর থাকা সম্ভব না। চব্বিশ ঘন্টা তোমাকে টলারেট করা সম্ভব হচ্ছে না! এই দুই দিনেই আমার অসহ্য হয়ে উঠেছো। তোমার সাথে আর কয়েকদিন টানা থাকলে আমাকে মানুষিক চিকিৎসা নিতে হতে পারে।
–আচ্ছা! আমার সাথে থাকা সম্ভব না কেনো?
উষির ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলো। মুখের হাসি গায়ের হয়ে গেছে। রাশা বিরক্তির ভাব এনে বললো,
–তুমি প্রচন্ড ইরিটেটিং আর অ্যানয়িং! খুবই চিপকু টাইপ মানুষ। সবাই তোমাকে কিভাবে পছন্দ করে বুঝি না!
উষিরকে স্থির তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো,
–হা করে তাকিয়ে কি দেখছো?
উষির নিজে রাগলো না, রাশাকে রাগিয়ে দিতে চাইলো। দুই পা এগিয়ে গিয়ে বললো,
–রাগলে তোমাকে দারুন লাগে। একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। শিয়ালের মতো।
–কথার গুরুত্ব বোঝো। কি বলছি সেটা বোঝো? আমার লাইফে আমি দ্বিতীয় কোন সৌরভ চাই না বুঝেছো?
ক্ষিপ্ত গলায় বললো রাশা। উষির থমকালো। রাগী গলায় স্বগোতক্তি করলো,
–আবার সৌরভ!
রাশা মাথা চেপে ধরলো। হাত পা নেড়ে বিরক্তিকর স্বরে বিড়বিড় করতে লাগলো,
–উফফ! আর সম্ভব না! আর সম্ভব না!
রাশা বিড়বিড় করতে করতে ঘরে গেলো। উষির দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
–সৌরভ না! দেখাচ্ছি মজা।
বলেই রান্নাঘরে গেলো। রান্নাঘরের কেবিনেটের ড্রয়ারে ফোন রেখেছে। ফোন বের করে কাউকে টেক্সট করলো। তারপর ড্রাইভারকে সকাল সকাল গাড়ি আনতে বলে লিভিংরুমের সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো। রাশার উপর রাগ করে ঘরে গেলো না। চোখ বুজে শুয়ে থাকার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশে রাশার অস্তিত্ব টের পেলো। উষির ঘুমিয়েছে ভেবে কাছাকাছি লম্বা একটা সোফায় শুয়ে পরলো। উষির মুচকি হেসে রাশার ঘুমের অপেক্ষা করলো৷ ঘুমিয়ে যেতেই আলগোছে তার পাশে এসে শুয়ে ঘুমন্ত রাশাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। ঘর থেকে তার কাছে না এসে যাবে কোথায়! সব কটা জানালা হাট করে খুলে দিয়েছে। মিনিটে মিনিটে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। নির্জন জায়গায় গভীর রাতে এই ভয়ংকর ডাককে উপেক্ষা করার সাধ্য কারই বা আছে!
চলবে…
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২০
অফিস বিল্ডিং এর প্রথম তলার পুরোটা জুড়েই রিসেপশন ও ওয়েটিং এড়িয়া৷ রিসেপশনের ঠিক সামনে একটা বেশ বড় সোফা রাখা। ফ্লোর ডেকোরেশনের জন্য কিছু আর্টিফিশিয়াল ট্রি, ডিজাইনার পোষাক পরা ম্যানিকুইন রাখা আছে। এছাড়াও বিভিন্ন অ্যাচিভমেন্টের মোমেন্ট ক্যাপচার করে ফ্রেমে ভরে দেয়ালে টাঙানো আছে। বড় একটা সেল্ফে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড আর ফুলদানি সাজিয়ে রাখা রয়েছে৷ এই নিয়েই এক তলা সম্পূর্ণটা সাজানো। উপরতলা যাওয়ার জন্য লিফট এক কোনে পরে আছে। তার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে সিঁড়ি। পাঁচ তলার তৃতীয়তলাতে নোঙরের অফিস। সম্পূর্ণ বিপরীত দিকের সিঁড়িতে যাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। তাই লিফট দিয়েই অফিসে গেলো। অফিস ফ্লোর পুরোটাই কাঁচের দেয়ালে ঢাকা। দরজাটাও কাঁচের। বেশ আধুনিক ধাঁচের অফিস বলা চলে। অফিসে ঢুকতেই বড় হলরুম। সেখানেই প্রায় ত্রিশটার মতো ডেস্ক আছে। আশেপাশে ছড়িয়ে আছে চারটে কেবিন, একটা মিটিংরুম, আর একটা অফিস ক্যান্টিন। ক্যান্টিন ছাড়া সবগুলো রুমের দেয়ালই কাঁচের। ঝাঁপসা কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাইরে থেকে ভিতরটা মোটেও দেখা যায় না।
নোঙরের অফিসে যেতে যেতে এগারোটা বেজে গেলো। অফিস শুরু হয় দশটা নাগাদ। এক ঘন্টা লেট করে ঢুকেই দেখলো সবাই ব্যস্ত। কেউ ফাইলে মুখ গুজে আছে তো কেউ কম্পিউটার স্ক্রিনে মুখ গুজে আছে। তার ডেস্কটা মাঝের দিকে৷ আশেপাশের ডেস্কের মানুষজনকে সে প্রতিবেশী নাম দিয়েছে। ডান পাশের প্রতিবেশীর নাম মমো। বাম বাশের প্রতিবেশীর নাম অমি আর সামনের প্রতিবেশির নাম শামিম। আপাতত এই তিন প্রতিবেশির সাথেই প্রথমদিন পরিচয় হয়েছে৷ বাকিরা বসের আত্মীয় মেনে তাকে বেশ সমিহ করে চলে।
এখন অব্দি কোন কাজ তার কপালে এসে বসেনি। ডেস্কে থাকা কম্পিউটার সম্পূর্ণ অফিসের নিয়ন্ত্রাধীন। তাই অফিশিয়াল কিছু করা ছাড়া আর কিছুই করা যাবে না৷ তাছাড়া নোঙর খন্দকারের যথেষ্ট মানসম্মান আছে৷ এখন ইউটিউবে নাটক কিংবা ফিল্ম দেখলে সবাই বাঁকা চোখে তাকাবে। তাই ঘন্টা ধরে নিজের ডেস্কের এটা ওটা নাড়াচাড়া করে সময় কাঁটাচ্ছে। কখনও ড্রয়ার খুলে স্টিকি নোটস বের করে খুলে খুলে ডেস্কে লাগাচ্ছে। আবার কখনও কীবোর্ডের বাটন সংখ্যা গুনছে।
উজানের ডাক পরলো লাঞ্চের আগে। বিরক্ত হয়ে কেবিনে গেলো৷ কেবিন খুঁজে পেতে একটু জিজ্ঞাসা করতে হয়েছিলো অবশ্য কিন্তু খুব সহজেই পেয়ে গেলো। তার ডেস্কের নাক বরাবরই উজানের কেবিন দেখেই নোঙরের কপাল কুঁচকে গেলো। তার ডেস্ক পরার আর জায়গা পেলো না!
উজানের কেবিনের বাইরে তাহের নামের এক মাঝবয়েসী লোক টুল পেতে বসে থাকে। কেউ উজানের কেবিনে গেলে তিনি ভেতর থেকে অনুমতি নিয়ে এসে তারপর ভেতরে ঢুকতে দেয়। এই ব্যাপারটা নোঙরের জানা ছিলো না। ভেতরে যেতে বাঁধা পেতেই ভ্রু কুঁচকে তাহেরের দিকে তাকালো। ভ্রু নাচিয়ে যেতে না দেওয়ার কারন জানতে চাইলো। মধ্যবয়সী তাহেরের মেজাজ সবসময়ই খিটখিটে থাকে। অফিসের তার সম্মান অধিক। সবাই তাকে বেশ মান্যগণ্য করে চলে। কেউ তাকে বসের চাইতে কোন অংশে কম ভাবে না। কেউ কাজ ফাঁকি দিলে উজানের আগে তার মেজাজের সামনে পরতে হয়।
–আপনার কি স্যারের রুমে যাওয়ার পারমিশন আছে?
নোঙর কপাল কুঁচকে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
–আপনার স্যার নিজে ডেকেছে আমাকে, নিজে।
শেষের শব্দটা ভর দিয়ে বললো সে। নিজের গুরুত্বটা বোঝাতে চাইলো। তাহের মাথা নাড়লো। বললো,
–স্যার নিজে ডাকলেও প্রয়োজন না শুনলে আপনাকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
চটে গেলো নোঙর। বড় বড় হরিণী চোখ দুটো ছোট ছোট করে হাত নেড়ে নেড়ে বললো,
–আপনার স্যারের সাথে আমার কোন প্রয়োজন নাই। আমাকেই আপনার স্যারের প্রয়োজন। তাই আমাকে ডেকেছে।
তাহেরের সাথে অফিসের কেউ এভাবে কথা বলে না৷ তাই নতুন জয়েন করা মেয়েটার সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলো। ভাবলো, নিজের জায়গাটা তাকে বুঝাতে হবে। টুল থেকে সটান দাঁড়িয়ে বললো,
–একদিন হলো এসেছেন। এরমাঝেই বলছেন, বসের আপনাকে প্রয়োজন? নিজেকে ভাবেন কি আপনি? বসের আত্মীয় জন্য কি মাথা কিনে নিয়েছেন?
নোঙরের মাথায় আগুন ধরে গেলো। মূহুর্তেই ছোটখাটো গোলজোক বেঁধে গেলো। আশেপাশের সবাই কাজ ফেলে উৎসুক চোখে ঝগড়া দেখতে লাগলো। উজানের কেবিন সাউন্ডপ্রুফ৷ বাইরের কোন শব্দ ভেতরে যেতে কিংবা ভেতরের কোন শব্দ বাইরে বের হতে পারে না৷ তাই ঝগড়া তার কান অব্দি গেলো না। তবে অফিসের সিসিটিভি তার ল্যাপটপে সেট করা ছিলো জন্য ব্যাপারটা দেখলো। অবাক হলো, রেগে গেলো। তড়িৎগতিতে বাইরে বেরিয়ে আসলো। উজানকে আসতে দেখেই সবাই যে যার কাজে মনোযোগ দিলো। তাহের আর নোঙরের ঝগড়াও থেমে গেলো। উজান কড়া চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে নোঙরকে ভেতরে আসতে বললো। ঝগড়ায় তার জয় হয়েছে দেখে তাহেরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো নোঙর। তাহেরের ভয়ংকর দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে সোজা ভেতরে গিয়ে উজানের টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারগুলোর একটাতে বসে বলো। উজান নিজের চেয়ারে বসে স্থির দৃষ্টিতে নোঙরের দিকে তাকিয়ে রাগত গলায় বললো,
–কয়টা বাজে?
নোঙর এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুম দেখছিলো। উজানের কথায় দেয়াল ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো,
–বারোটা পঁচিশ। টাইম শোনার জন্য আমাকে ডেকেছো?
উজান দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
–অফিস শুরু হয় কয়টায়?
নোঙর নিরীহ মেয়ের মতো ঠোঁট উলটে বললো,
–দশটায়।
–এতো লেট হলো কেনো?
–এসেছি তো অনেক্ষন হলো। একটু দেরি অবশ্য হয়েছিলো। হুলোকে খাবার দিয়ে, নিজে খেয়ে, মুখে মধু আর মুলতানি মাটির ফেসপ্যাক লাগিয়ে, গোসল দিয়ে বের হতে হতে দেরি হয়ে গেলো। দেখো, চুলগুলো এখনও ভেজা।
হুলো নোঙরের পোষা কাকাতুয়ার নাম। উজানের সেটা জানার কথা না। জানতে ইচ্ছেও হলো না৷ একপলক নোঙরের পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া লম্বা কালো সিল্কি চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,
–মডেলিং করার আলাদা ডিপার্টমেন্ট আছে৷ এখানে সবাই মাথা খাটিয়ে অফিশিয়াল কাজ করে৷ মডেলিং করতে হলে চার তলাতে চলে যাও।
নোঙর ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
–এতো হিংসা করতে হয় না। তোমার থেকে আমি দেখতে বেশি সুন্দর, সেটা তো আর আমার দোষ না। এই চেহারা মেইনটেইন করতে আমার কত পরিশ্রম করতে হয় জানো?
উজান উত্তর দিলো না৷ স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
–তোমার অনার্সের রেজাল্ট কি?
থতমত খেয়ে গেলো নোঙর। ওই কথার পিঠে এই প্রশ্ন একদমই আশা করেনি। মিনমিন করে বললো,
–সিক্স ফোর।
–সিক্স ফোর হোয়াট? টু অর থ্রি?
–টু।
নোঙর মিনমিন করে উত্তর দিলো। উজান ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,
–এই অফিসের সর্বনিম্ন সিজি কতো জানো? ফাইভ জিরো। তাও থ্রি, টু না।’
নোঙর চোখ ছোট ছোট করে কাঁধ ঝাকিয়ে বললো,
–আমি তো চাকরি চাইনি। তোমার বড় বাবাই তো যেচে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিলো। আমি থরি না বলছিলাম, আমি আপনাদের নিষ্ঠুর, বদমেজাজী, বদখত, উটকো ঝামেলাওয়ালা ছেলের অফিসে চাকরি করবো।
রাগে উজানের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,
–তো আছো কেনো? চলে যাও।
নোঙর মাছি উড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বাঁকা হেসে বললো,
–ইহ! আমাকে কি এতোই বোকা মনে হয়? ফ্রীতে পাওয়া চাকরি এভাবে ছেড়ে দেবো?
উজান অবজ্ঞার স্বরে বললো,
–নিজের কোয়ালিফিকেশনের দিকেও একটু নজর দাও। কোন এক্সপেরিয়েন্স নেই, ভালো সিজি নেই, কিচ্ছু না। যাস্ট নাথিং! বাকি কলিগদের সামনে যেতে তোমার লজ্জা করবে না?’
নোঙর টেবিলে হাতের কনুই রেখে রেখে আড়াম করে বসে হাত নেড়ে নেড়ে বললো,
–কেনো লজ্জা করবে? আমি আমার যোগ্যতায় এসেছি আর ওরা ওদের যোগ্যতায় এসেছে৷ আমার যোগ্যতা, আমি আমার শ্বশুর শাশুড়ীর বদখত ছেলের বউ। আর ওদের যোগ্যতা, ওরা এক্সপেরিয়েন্সড, ভালো সিজিওয়ালা। সিমপল।
উজান মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বললো,
–সেমলেস মানুষ দেখেছি আমি। লিটারেলি, তোমার মতো দেখিনি।
–এটা আপনার ব্যর্থতা।
নোঙর ঠোঁট উলটে নির্লিপ্তস্বরে বললো। উজান ক্ষিপ্ত স্বরে ধমকে উঠে বললো,
–এখানে বকবক করার জন্য তোমাকে ডাকা হয়নি। ইন্টারভিউ দিতে হবে। বসে বসে এমনি এমনি থার্টি থাউজেন্ট স্যালারি নেওয়া যাবে না।
ত্রিশ হাজার স্যালারি শুনে নোঙরের চোখ চকচক করে উঠলো৷ খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো,
–ত্রিশ হাজার টাকা বেতন! কত কিছু কেনার আছে আমার৷ আচ্ছা, স্যালারি কি অগ্রীম দেওয়ার নিয়ম নেই? এই এক মাস আমার চলতে হবে তো৷ পরিচিত জন্য কি একটু বেনিফিট পাবো না?’
শেষের কথাটা বেশ ইমোশন নিয়ে বললো সে৷ করুন গলার ইমোশনাল কথায় চিড়ে ভিজলো না। উজান হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
–আগে ইন্টারভিউ, তারপর চাকরি আর তারপর বেতন। ইন্টারভিউ-এ না টিকলে চাকরির আজকেই শেষদিন।
নোঙরের মুখ ছোট হয়ে গেলো। মনে মনে নির্দয় উজান বলে বকতে ভুললো না। উজান অফিসের কড়া বস হয়ে নোঙরের ইন্টারভিউ শুরু করলো,
–তো নোঙর খন্দকার, ব্যবসা সম্পর্কে তোমার ধারনা কি?
নোঙর ঠোঁট উলটে কাধ নাচিয়ে বললো,
–ব্যবসা সম্পর্কে আবার কি ধারণা থাকবে? ব্যবসাতে একজন সেল করে আর একজন সেটা পারচেস করে। যে সেল করে যে যদি বুদ্ধিমান সেলার হয় তাহলে অল্প টাকায় ভালো লাভ করবে। আর যে পারচেস করবে সে যদি ভালো বারগেনার হয় তাহলে সেলারের ব্যবসায় রেড লাইট।
উজান ঠান্ডা চোখে নোঙরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নোঙরের দৃষ্টি টেবিলে রাখা কলমদানির দিকে৷ দেখে মনে হচ্ছে, এই মূহুর্তে কলমদানীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নয়। উজান নিজেকে সামলে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলো,
–তুমি কি জানো এটা কিসের কোম্পানি?’
–কিসের আবার, শ্বশুরবাড়ির কোম্পানি।
বলেই নোঙর জিভে কামড় দিলো। নজর কলমদানীর উপর থেকে সরিয়ে আড় চোখে উজানের দিকে তাকিয়ে দেখলো, উজান কলম শক্ত করে ধরে কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আসে। নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টায় আছে। নোঙর বিড়বিড় করলো,
–ছিঁচকে মেজাজের বাটি।
উজান আওয়াজ করে টেবিলের উপর দুই হাত ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো,
–এখান থেকে বিদায় হও।
নোঙর উঠলো না। চেয়ারে হেলা দিয়ে আড়াম করে বসে মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,
–একটু পর যাই। তোমার রুমের এসির বাতাসটা দারুন। আমাদের রুমের এসির বাতাস একদম ভালো না। একদিক থেকে এসি চলছে তো আরেকদিক দিয়ে ঘেমে যাচ্ছি। একমাত্র বৌ তোমার। এটুকু খেয়াল তো রাখতেই পারো।’
উজান এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। মূহুর্তেই গরম লাগতে লাগলো নোঙরের৷ দাঁতে দাঁত পিষে উঠে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় অবশ্য তাহেরের ফাঁকা টুলটা ফেলে দিতে ভুললো না। উজান তক্ষুনি সেক্রেটারিকে কল দিয়ে অফিসরুমের সবগুলো এসি খুলে ফেলতে বললো। এখন থেকে ওখানে শুধু ফ্যান চলবে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই নোটিশ আসলো, এসি নষ্ট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ এসেছে। তাই নতুন এসি না আসা পর্যন্ত শুধু ফ্যান চলবে। নোটিশ শুনে সবাই অভিযোগ কে দিয়েছে, সেটা খুঁজতে লাগলো আর হা-হুতাশ করতে লাগলো। নোঙর চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলো। ক্ষমতা থাকলে এখনই সে আজলান কায়সারকে গদিচ্যুত করে ফেলতো।
লাঞ্চের ব্রেকের মিনিট পাঁচেক আগে নোঙর মাহফুজাকে ফোন দিলো। ফোন ধরতেই কাঁদোকাঁদো মুখে তার ছেলের নামে অভিযোগ তুললো,
–তোমার ছেলে অফিসের সব এসি খুলে ফেলেছে ফুপি। জানোই তো কেমন গরম পরেছে৷ এই গরমে এতো কাজ করা যায় বলো?
আহ্লাদে তার ঠোঁট ফুলে উঠলো। ফোনের ওপাশে মাহফুজা আবেগে হাহাকার করে উঠলো,
–ওর এতো সাহস বেড়ে গেছে? তুই চিন্তা করিস না৷ কালকে সকালের মধ্যে যদি এসি না লাগায় তাহলে ওর রুমের এসিও হাওয়া হয়ে যাবে। বাড়িরটাও আর অফিসেরটাও।
দাঁত বের করে হাসলো নোঙর। কাজ এখনও শেষ হয়নি। আবারও ঠোঁট উলটে আহ্লাদী স্বরে বললো,
–আজকে অনেক কাজ করেছি ফুপি। এই ছোট মেয়েটাকে দিয়ে যে তোমার ছেলে এতো কাজ করাচ্ছে! কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি৷ ছুটির এখনও কত্তো সময় আছে। আরো কাজ করতে হলে আমাকে হসপিটালে দেখতে এসো।
নোঙরের গলার স্বরে করুন ভাব। মাহফুজা মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বললো,
–তুই এতো চাপ নিস না৷ ইচ্ছা হলে কাজ করবি, ইচ্ছা না হলে করবি না। ইচ্ছা হলে অফিস করবি, ইচ্ছা না হলে চলে যাবি। নিজেদের অফিসে কেউ এতো চাপ নেয় নাকি!
আদুরে স্বরে বললেন তিনি৷ নোঙর উৎফুল্ল মনে বললো,
–থ্যাঙ্কিউ ফুপি। আমি তাহলে চলে যাচ্ছি এখন। তুমি তোমার ছেলেকে ফোন দিয়ে একটু বলে দাও আমাকে যেনো যেতে দেয়। প্লিজ!
নোঙরের অনুরোধে কাজ হয়েছিলো। খানিকক্ষণ পর থমথমে মুখে তাহের এসে নোঙরের ছুটির কথা জানিয়ে দিলো৷ কিন্তু নোঙরের লাঞ্চের সময় বাড়ি ফেরা হয়নি। কারনটা বেশ বড়সড়। যখন বাড়ি ফেরার জন্য নিজের ব্যাগ গোছাচ্ছিলো তখনই হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো হাট করে অফিসরুমের দরজাটা খুলে গেলো। কালো পোশাকধারী দুইজন গার্ড দরজার দুইপাশে দাঁড়িয়ে একজনকে আসার জায়গা করে দিলো। একজন গার্ডের হাতে এয়ারফ্রেশনার ছিলো। লেমন ফ্লেভারের এয়ারফ্রেশনার স্পে করার পরই খয়েরী ক্রপ টপের উপরে কালো লেদার জ্যাকেট আর মিনি স্কার্ট পরা একটা মেয়ে ভেতরে এসে সরাসরি উজানের কেবিনে ঢুকে গেলো। বাতাসে মেয়েটির কড়া দামী পারফিউমের সুগন্ধ এয়ারফ্রেশনারকে ছাড়িয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পরলো। নোঙর এসব দেখে প্রথমে অবাক হলো। পরে রাগে মাথায় আগুন ধরে গেলো। তার উপর তাহেরের মুখ মেয়েটাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে দেখে তার দিকে ভষ্ম করে দেওয়া চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। মিনিট পনেরো পর মেয়েটা সহ উজান হাস্যজ্বল মুখে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো। আগুন চোখে এসব দেখে আর উঠতে পারেনি সে৷ কলম কামড়াতে কামড়াতে উজানের আসার অপেক্ষা করছিলো।
অফিস ছুটির আধ ঘন্টা পরেও যখন উজান ফিরলো না তখন বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে গেলো সে। বাড়ি ফিরে সরাসরি হুলোর খাঁচার কাছে গেলো। উজানের ছবি তার মুখের সামনে ধরে নাক টেঁনে টেঁনে বললো,
–এর সামনে তোকে ছেড়ে দিকে একে ঠোকর দিতে পারবি না? এই লোকটা হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে জঘন্য লোক, বুঝেছিস। একে ঠোকর দিতেই হবে। দেখলেই বলবি উজান গাধা। বজ্জাত উজানও মানানসই। ছুঁকছুঁক করা উজান বোধহয় বেটার হবে। শর্ট ড্রেস পরা মেয়েদের দেখলে মাথা আউলায়া যায়।
বলতে বলতেই নোঙর কেঁদে দিলো। অফিসের দ্বিতীয়দিন তার একদম ভালো যায়নি। খুব খারাপ লাগছে তার। মনে হচ্ছে উজানের মাথার সবগুলো চুল টেনে ছিড়ে ফেলুক। নাহলে কিছু একটা করুক যাতে দুপুরের ঘটনাটা মাথা থেকে চলে যাক। মনে মনে কয়েকবার নিজেকে শান্তনার বানী শুনালো। লাভ হলো না। শেষপর্যন্ত ঘরের দরজা বন্ধ করে কান্না করতে লাগলো।
চলবে…