তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-১৭+১৮

0
80

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৭

সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর পরিবার সম্পর্কে জানার আগ্রহ সবারই প্রবল। যেখানে রাজনীতিবিদেরা নিজেদের আসন ধরে রাখতে পরিবারকে ক্যামেরার সামনে হাজির করে, সেখানে হাসান চৌধুরী নিজের পরিবারের সকল সদস্যদের সুকৌশলে ক্যামেরার আড়ালে রাখে৷ পারিবারিক ব্যবসা সেজো ভাই হামিদ চৌধুরি এবং ছোট ভাই খলিল চৌধুরি দেখভাল করলেও শোনা যায়, চৌধুরী পরিবারের আর কোন পুরুষ ব্যবসার কাজে যোগ দেয়নি। যদিও সব শোনা কথা। আসল ঘটনা শুধুমাত্র তাদের পরিবার ছাড়া বাইরের কেউ জানে না। চৌধুরী পরিবারের এক ছেলে শাহরিয়ার চৌধুরী বাবার পথ অনুসরণ করে রাজনীতিতে আসলেও তিনিও খুব একটা ক্যামেরার সামনে আসে না৷ আর বাকি তিন ছেলের খবর কেউ জানে না। মোট কথা, পুরো পরিবার নিজেদের আড়ালেই রেখেছে। সেই আড়ালে থাকা পরিবারের মেয়ের বিয়ে হয়েছে রাজনীতিবিদ আদনান কায়সারের সাথে৷ তাও প্রেমের বিয়ে। চৌধুরী পরিবারের সেই মেয়ে দিলওয়ারা জামানের প্রেমের বিয়ে তার পরিবার মেনে নেয়নি। পরিবারের অমতে বিয়ে করায় তার সাথে তারা সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। খবরটা চাউর হতেই লোকজন ফেঁটে পরলো। সব জায়গায় এটা নিয়ে আলোচনা হতে লাগলো৷ উষিরের বাড়ির সামনে মানুষের ঢল পরে গেলো। গার্ডরা অতি কষ্টে লোকদের আটকাতে লাগলো।

রাশা তখন ছিলো কোর্টের বাইরে এক আইসক্রিম পার্লারের সামনে। ম্যাঙ্গো ফ্লেভারের আইসক্রিমটা গলে গলে পরছে। বেশ আয়েশ করে খাচ্ছিলো সে। হঠাৎই ক্লিক করে ফ্ল্যাশ জ্বলার শব্দ পেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। দশ বারোজন সাংবাদিক ক্যামেরা তার দিকে তাক করে ধরে রেখেছে। আর বেশ কয়েকজন মাইকও নিয়ে এসেছে। রাশা এতো অবাক হলো যে কখন টুক করে আইসক্রিমটা সম্পূর্ণ গলে পরে গেলো, সেটা টেরও পেলো না। চোখের পলক ফেলতেই যেনো ভুলে গেলো। ধ্যান ভাঙলো, এক গাদা প্রশ্নের ভীড়ে। একজোগে সব সাংবাদিক প্রশ্ন করতে শুরু করলো,

“ম্যাম, আপনি কি সত্যি হামিদ চৌধুরীর মেয়ে?”
“পলিটিশিয়ান আদনান কায়সারের সাথে আপনার আলাপ হলো কিভাবে?”
“আপনার পরিবার আপনাদের বিয়ে কেনো মেনে নেয়নি?”
“আপনার পরিবার তো আড়ালে থাকে। তাহলে আপনি প্রকাশ্যে আসলেন কেনো?”
“আপনার বিয়ে নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরী কি বলছেন?”
“আপনাদের বর্তমান পরিস্থিতি কি?”
“আপনাকে কি সত্যি গুম করে রাখা হয়েছিলো? সেখান থেকে আদনান সাহেব আপনাকে উদ্ধার করেছে?”
“আপনার পরিবারই কি এই গুমের সাথে জড়িত?”
“আপনাকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো?”
“আপনার পরিবার কি সত্যিই আপনার উপর অত্যাচার করতো?”

নানান উদ্ভট প্রশ্ন শুনে রাশার মাথা ঘুরতে লাগলো। মুখ খুলতে চাইলো। কিন্তু খেয়াল করলো, তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগলো। উৎসুক জনতারাও ভীড় করলো। মিনিটের মধ্যে সেখানে বড় বড় তিনটা গাড়ি এসে হাজির হলো। সামনের গাড়ি এবং পেছনের গাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন কালো পোশাক পরা গার্ড এসে রাশাকে আড়াল করে দাঁড়ালো।

–ম্যাম, আপনি আমাদের সাথে চলুন। আমাদের উষির স্যার পাঠিয়েছেন।

রাশা শুনলো। গার্ডের আড়ালে নিজেকে ঢেকে মাঝের গাড়িতে গিয়ে বসলো। সামনে আর পেছনের গাড়ি ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হলো৷
গাড়িতে ওঠার পরপরই রাশার ফোনে উষিরের কল আসলো। গতরাতের ব্যবহারের পর উষিরের উপর প্রচন্ড রেগে আছে সে। তার অনুমতি ছাড়া তাকে ছোঁয়ার সাহস হলো কিভাবে! এখন আবার কল দিচ্ছে! রাগে লাল হয়ে গেলো রাশা। ফোন কেঁটে দিয়ে নাম্বার ব্লক করে দিলো। তারপর সামনে বসা গার্ডকে বললো,

–এতো জার্নালিস্ট এসেছে কেনো?

গার্ডদের সাথে রাশার ব্যবহার খুব স্বাভাবিক। সামনে বসা গার্ড মোবাইলে কিছু করছিলো। রাশার প্রশ্নে বিনয়ের সাথে জবাব দিলো,

–আপনার দেওয়া ইন্টারভিউ পাবলিশড হয়েছে। তাই সবাই আপনার সাথে সরাসরি কথা বলতে চাইছে।

রাশার ভ্রু কুঁচকে গেলো। ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। তারপর সপ্তাহ দুই আগে দেওয়া ইন্টারভিউয়ের কথা মনে পরে গেলো। সাথে সাথে মোবাইলে ইন্টারভিউ খুঁজতে লাগলো। খুঁজে পেতে একদমই কষ্ট করতে হলো না। নিউজপেপার তাদের তোলা সেই ছবি দিয়েই তাদের ওয়েবসাইট আর ফেসবুক পেজে বড় করে একটা আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। রাশার বলা কিছু কথা নিয়ে আর নিজেদের মাল-মশলা মিশিয়ে এক রসালো নিউজ বের করেছে। ক্যাপশন দিয়েছে, “হাসান চৌধুরীর ভাতিজির প্রেমের বিয়ে তার পরিবার মেনে নেয়নি।”
এই ক্যাপশন এখানেই শেষ। এই নিউজটাই সবাই বিভিন্ন ক্যাপশনে শেয়ার দিচ্ছে।
“তরুন পলিটিশিয়ান আদনান কায়সার ও সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর ভাতিজির সম্পর্ক মেনে নেয়নি তার পরিবার।”

“অবশেষে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর পরিবারের গোপন তথ্য ফাঁস করলেন তারই ভাজিতি দিলওয়ারা জামান চৌধুরী।”

“পরিবারের শত অত্যাচারেও সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর ভাতিজি দিলওয়ারা জামান চৌধুরী নিজের প্রেমের সম্পর্ক ভাঙেননি।”

“প্রেমের এক দৃষ্টান্ত উদাহরণ সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর ভাতিজি দিলওয়ারা জামান চৌধুরী।”

বাকি ক্যাপশনগুলো পড়ার ধৈর্য আর তার নেই। ভেতরের নিউজ আরো ভয়াবহ। তার বলা কথাগুলো অর্ধেক রেখে বাকি অর্ধেক নিজেরা যোগ করেছে।
–প্রেমের সম্পর্ক মেনে না নেওয়ার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। মেয়েকে আটকাতে তাকে কিছুদিনের জন্য গুম করে ফেলেন। উদ্ধার করেন তার বর্তমান স্বামী তরুন রাজনীতিবিদ আদনান কায়সার। এমনকি দিলওয়ারা জামানকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়। সেখান থেকে স্বামীর হাত ধরে পালিয়ে আসেন। অতঃপর তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দিলওয়ারা জামান নিজের মুখে বলে বলেছেন, ওই কয়েকদিন তার উপর মানুষিক ও শারিরীক অত্যাচার করা হয়। এমনকি তাকে শাস্তি দিতে জানালাবিহীন এক বদ্ধ ঘরে কয়েকদিন বন্দী করে রাখা হয়। তিনি আরো বলেন, “আমি এখন অনেক সুখে আছি। আমার স্বামী এবং তার পরিবার আমাকে অনেক ভালোবাসে৷ সেদিন যদি না পালাতাম তাহলে জীবনে অনেক বড় একটা ভুল হতো।”

রাগে রাশার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। সবাই বলে, উকিলরা নাকি মিথ্যা বলে। তাদের তো সাংবাদিকদের দেখা উচিত। বদ সাংবাদিক! রাশা চিৎকার করে উঠলো,

–গাড়ি পুলিশ স্টেশনে নিন।

ড্রাইভার, গার্ড দুজনেই চমকে উঠলো। কিন্তু যাদের চাকরি করে তাদের মুখের উপর কিছু বলতে পারলো না। নিজের গতিতেই গাড়ি চলতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামতেই রাশা ভাবলো থানাতে চলে এসেছে। আশেপাশে নজর বুলাতে লাগলো। পরক্ষণেই পাশে এসে কেউ বসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, উষির পাশে এসে বসেছে। সামনের ড্রাইভার আর গার্ড নেমে পরেছে। রাশার পুরোনো মনে পরে গেলো। রেগে কিছু বলতে চাইলো। ততক্ষণে উষিরের হাতে রাশার ফোন চলে গেছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু করছে। ফোনে দৃষ্টিতে রেখেই মৃদু স্বরে বললো,

–হাজবেন্ডকে কেউ ব্লক করে নাকি?

রাশা তেঁতে উঠলো। পুরোনো রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই ফেঁটে পরলো। চেঁচিয়ে উঠে বললো,

–তোমার এখানে আসার সাহস কিভাবে হলো? কি চাও তুমি? কাল রাতে এতো বড় কাহিনী করেও লজ্জা হয়নি? নির্লজ্জের মতো আবার এখানে চলে এসেছো? হাউ কুড ইউ ডু দ্যাট? তুমি যে এখনও বেঁচে আছো, সেটা তোমার শত জনমের ভাগ্য মিস্টার আদনান কায়সার।

চিবিয়ে চিবিয়ে বললো রাশা। উষিরের কাজ শেষ। সিটের উপরিভাগে হাত রেখে মিটিমিটি হেসে রাশার কথা শুনছিলো৷ কাল রাত থেকে রাশার মুখ বন্ধ ছিলো। শত চেষ্টাতেও মুখ খোলেনি। আজ এই দুপুরের পর এসে তার গলার আওয়াজ শুনে উষিরের হৃদয় ঠান্ডা হলো।
উষির মৃদু হেসে রাশার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে লাগলো৷ ছিটকে হাত সরিয়ে দিতে চাইলো রাশা। উষিরের শক্তিশালী হাতের সামনে পেরে উঠলো না। নিজেই সরে বসলো। উষির চওড়া হাসলো৷ রাশার দিকে সরে বসে আলতো স্বরে বললো,

–স্বামী স্ত্রীর মাঝে ওসব ছোট বড় ম্যাটার করে না।

রাশা পালটা জবাব দিলো না৷ রাগে সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো,

–তুমি যাও এখান থেকে৷ তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি তোমার গার্ডদের সাথে এক্ষুনি বিদায় হবে। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। রাইট নাও।’

এই পরিস্থিতিতেও উষির মজা করার লোভ সামলালো না। হাসি চেপে বললো,

–ওরা তো আমার গার্ড না। ওরা তো তোমার গার্ড। শুরু থেকেই আছে।

রাশা জানতো, নিজের রাগ প্রকাশ করতে নেই। রাগ প্রকাশ করা দুর্বলতা। সামনের মানুষ সেই দুর্বলতা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে৷ সে ঠিক জানতো। আবার সেটার প্রমাণ পেলো৷ কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো৷ উষির পরিস্থিতি আন্দাজ করলো। ফোন বের করে ড্রাইভারকে কল দিয়ে গাড়িতে আসতে বললো। উষির আসার পরপরই গার্ডরা চলে গেছে। তাই ড্রাইভার শুধু উষির আর রাশাকে নিয়ে তাকে বলা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলো। রাশার ফোন উষির কোথায় রাখলো সেটা সেই জানে। যার ফোন সে নিজেই ফোন খুঁজলো না। মুখ ফুলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে লাগলো। এমনকি উষির যখন তার হাত নিজের হাতের মধ্যে রাখলো, তখনও কিছু বললো না। নিজের হাত ছাড়িয়ে পর্যন্ত নিলো না। উষির সবটা বুঝলো। আবারও রাশার রাগকে নিজের হাতিয়ার বানানো। এক হাতে রাশার কোমর চেপে কাঁধে মাথা রাখলো। আরেক হাত তার হাতের মাঝে বন্দী। রাশার মনে হলো, এক বাঁধন থেকে বের হওয়া খুব মুশকিল৷ বিয়ে করে সত্যিই ভুল হয়ে গেছে।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছালো, তখন আকাশ ফুঁড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। উষির জানে, রাশা গাড়ি চালাতে পারে। তাই গাড়ি রাখার রিস্ক নিলো না। নির্জন জায়গায় তাদের এই ফার্মহাউজ৷ চারিধারে বড় বড় গাছ আর একপাশে বড় একটা নদী। নদীর ওপারে গ্রাম শুরু৷ ফার্ম হাউজ থেকে বের হতে, হয় দীর্ঘ পথ হেঁটে মেইন রাস্তায় উঠতে হবে আর নাহলে নদী সাঁতরে গ্রামে যেতে হবে৷ কিন্তু এই তীব্র স্রোতের নদী সাঁতরে পার হওয়া কম কথা নয়। তবুও একমাত্র গ্রামবাসীর ভরসায় ড্রাইভারকে বিদায় দিলো। বড় একটা লাগেজ সমেত ফার্মফাউজে প্রবেশ করলো। রাশা চুপচাপ উষিরকে অনুসরণ করলো। অনুসরণ না করেও উপায় ছিলো না। এক মূহুর্তের জন্যেও তার হাত সে ছাড়েনি। হাত ছাড়াতে হয় কথা বলতে হতো আর নাহলে জোর জবরদস্তি করতে হতো। জোর করলে আবার কিছু না কিছু বলতে হতো আর নয়তো রাগ প্রকাশ করতে হতো। সেসবের কিচ্ছু সে চায় না। তাই চুপচাপ উষিরকে অনুসরণ করতে লাগলো।

এক তলার এই ফার্মহাউসটার মেঝে কাঠের। দেয়ালটার বেশিরভাগ অংশই কাঁচের৷ কাঁচের দেওয়াল দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখা যায়। বড় বড় দুটো ঘর আর বিশাল বড় লিভিংরুম। লিভিংরুমের সাথেই লাগোয়া ওপেন কিচেন৷ উষির এসে থেকে কিচেনেই কাজ করছে। আর রাশা বসে আছে লিভিংরুমে রাখা বড় গোল মতোন সোফাতে। এই এক সোফাতেই আট দশজন অনায়াসে বসতে পারবে। বোধহয় এখানে সবাই গল্প করতেই আসে।
সুর্য ডোবার সাথে সাথে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বাইরের আলো এখনও যায়নি। মেইন সুইচ অন করায় ঘরে অটোমেটিক লাইট জ্বলে উঠেছে।
উষির বৃষ্টির তেজ দেখে বাইরে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে উচ্ছ্বসিত স্বরে বললো,

–বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। চলো ভিজি।

রাশার কোলে হলুদ কভারের একটা কুশন ছিলো। কাজ না থাকায় মনোযোগ দিয়ে কুশনের কাপড়ের ডিজাইন দেখছিলো। উষিরের কথা শুনে কুশনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে গম্ভীরমুখে উত্তর দিলো,

–আমার এসব পছন্দ না।

উষির কপাল কুঁচকে রাশাকে দেখলো। তারপর আলতো হেসে ন্যাপকিনে হাত মুছে বললো,

–কোনদিন ভিজেছো?

–না।

উষির রাশার দিকে এগিয়ে আসলো। মূহুর্তের মধ্যে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে চোখে চোখ রেখে বললো,

–তাহলে কিভাবে মজা বুঝবে!

রাশা হকচকিয়ে গেলো। পলক ফেলতে না ফেলতেই মুখে বৃষ্টির ফোঁটা পরলো। চিৎকার করে উঠলো সে। উষির ছেড়ে দিতেই রাশা এক দৌড়ে ঘরে যেতে চাইলো। উষির ছাড়লো না। জাপটে নিজের সাথে ধরে রাখলো। কিছুক্ষণ জোরাজুরির পর হাল ছেড়ে দিলো৷ স্থির দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে কাকভেজা হওয়ার পর যখন উষির আচ্ছন্নের মতো রাশার কাছাকাছি আসলো তখন রাশা ধীর স্বরে বললো,

–বাড়ি ফিরবো কখন?

উষির রাশার ঘাড়ে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলো। নাকে নাক ঘষে আচ্ছন্নের মতো বললো,

–যখন তোমার রাগ কমবে।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৮

বৃষ্টি থামলো শেষ রাতের দিকে। সকালে প্রতিদিনের মতোই সূর্য তার তেজ ছড়িয়ে বৃষ্টির ভাব দূর করে দিলো৷ রাশা ঘুমিয়ে ছিলো। ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদারে কম্ফোর্টার গায়ে জড়িয়ে বেশ আড়াম করেই শুয়ে ছিলো। উষিরের আড়াম সহ্য হলো না। ভোর ভোর উঠেই কাঁচের দেয়ালের পর্দা সরিয়ে দিয়েছে৷ ফলস্বরূপ, সকালের আলো দিয়ে পুরো ঘর ভরে গেলো৷ অলস্য ভঙ্গিতে উঠে পরলো সে৷ নজর ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলো, উষির ঘরে নেই৷ পুরো ঘরে শুধু বেড, বেড সাইট টেবিল আর কাঠের ক্লোজেট ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। রাশা উঠলো বেশ কষ্ট করেই। মাথা ভার হয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস তার নেই। একদিন ভিজেই কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। লাগোয়া ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিলো। পুরো বাড়িতে উষির নেই। সেটা নিয়ে রাশার ভাবনাও ছিলো না। সে তো নিজের ফোন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ফোন যে উষির লুকিয়েছে সে ব্যাপারে সে একশো পার্সেন্ট সিওর। ফোন না পেলেও হতাশ হলো না। ফোন ছাড়াই সে ফিরে যাবে।

উষির ছিলো লনে। কোত্থেকে কাঠ জোগাড় করে সেগুলো কাঁটছে। খালি গায়ে থাকায় কাঠ কাঁটার সময় ফুলে ফুলে ওঠা পেশিগুলো বেশ ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। ঘামাক্ত শরীরটা বেশ আকর্ষনীয় লাগছে। অবস্থা দেখে রাশা নাক মুখ কুঁচকে ফেললো। ধীর পায়ে উষিরের পেছনে এসে হাত ভাজ করে দাঁড়ালো। উঁচু গলায় বললো,

–যাবে কখন?

ক্ষণকালের জন্য উষিরের হাত থামলো। তারপর কুড়াল দিয়ে কাঠে সজোরে একটা বাড়ি দিয়ে বললো,

–ম্যাডামের রাগ কমেছে?

রাশা কথা বললো না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মুখ ঘুরিয়ে থাকলো। উষির কাঠ কাঁটা থামিয়ে চেয়ারের উপর ফেলে রাখা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে বললো,

–সকালে রান্নার সময় দেখি গ্যাস শেষ। কাঠ ছাড়া উপায় নেই। এখন তুমি আমাকে এগুলো নিয়ে যেতে হেল্প করো।

রাশা তপ্ত শ্বাস ফেললো। সাহায্য না করে উলটে বললো,

–আমি এক্ষুনি ফিরবো।

–সাত দিনের আগে না।

উষির ঠোঁট টিপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বললো। রাশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–আমি একাই যাচ্ছি। তুমি তোমার হলিডে ইঞ্জয় করো।

বলেই হাঁটা শুরু করলো। উষির গলা উঁচিয়ে বললো,

–গাড়ি নেই।

–পায়ে হেঁটে যাবো।

–জঙ্গল কিন্তু।

–রাশা ভিতু না।

রাশা মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিলো। উষির ভ্রু উঁচিয়ে সাবধানি গলায় বললো,

–জঙ্গলে জোঁক আছে।

রাশা শুনলো না। সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। উষির পেঁছন থেকে চিল্লিয়ে উঠলো,

-সাপ, বাঘ, ভাল্লুক, উল্লুক, শিয়াল সব আছে।

রাশা মুখ ঘুরিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

–মানুষের থেকে বড় হিং’স্র প্রাণী আর একটাও নেই।

উষির খানিক থমকে ঠোঁট কামড়ে ভাবলো। তারপর বাঁকা হেসে আবার গলা উঁচিয়ে বললো,

–নর’খাদ’ক আছে।

কথা কাজে লাগলো৷ পা থমকে গেলো রাশার৷ তারপর দ্রুত পায়ে তার দিকে আসতে লাগলো৷ উষিরের মনে হলো, রাশা তেড়ে আসছে৷ প্যান্টে হাত মুছে জাপটে ধরার জন্য রেডি হয়ে থাকলো৷ রাশা ঠিক মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে দাঁড়ালো। বললো,

–বাইরে নর’খাদ’ক আছে আর ভেতরে নারী খাদ’ক আছে। আনফচুনেটলি আমি নর না, নারী। তাই নারী খাদ’কের থেকে বাঁচাই উত্তম।

উষির রাঙা হয়ে উঠলো। ফর্সা গালে লালচে আভা পরলো৷ লাজুক হেসে বললো,

–ছিহ বউ, এমন করে কেউ বলে নাকি!

রাশা লাজুক গলার আওয়াজে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর মাথা নেড়ে অবিশ্বাসের সুরে বললো,

–মাই গুডনেস!

বলে আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না৷ রাগে নাকি ভয়ে বোঝা গেলো না কিন্তু গটগট করে হেঁটে দ্রুত পায়ে চলে গেলো। উষির পাত্তা দিলো না। তার কেঁটে রাখা কাঠগুলো গুছিয়ে বাড়ির পেছনে রাখা মাটির চুলার রান্নাঘরে নিয়ে যেতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাশা ফিরে আসলো। রাগে রীতিমতো ফুঁসছে। বিরাট বড় লোহার গেইটে বিরাট বড় তালা ঝুলছে। উষির কাঠ রেখে ফিরে আসতেই রাশার মুখোমুখি হলো। রাশা বেগ রেগে আঙুল উঁচিয়ে বললো,

–যে পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়ে বিয়েছে তাতে আমি যদি হাসান চৌধুরীর পরিবারের অংশ আর হামিদ চৌধুরীর মেয়ে না হতাম তাহলে আমাকে কি মেনে নিতে?

উষিরের হাস্যজ্বল মুখ মূহুর্তের আঁধারে ঢেকে গেলো। তারপর বাঁকা হেসে একটু ঝুঁকে রাশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

–আমি আসার সময় আমার ব্রেইন রেখে আসিনি। সাথে নিয়েই এসেছি। আর আমার অনেক গুনের আর একটা গুন হলো, আমি রাগের মাথায় হুটহাট ডিসিশন নেই না।

বলেই কুটিল হেসে সামনে আগালো উষির। রাশা পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

–তুমি হাসান চৌধুরীর থেকে কিচ্ছু এক্সপেক্ট করো না৷ তার ভাতিজিকে বিয়ে করার জন্য তুমি ইজিলি তোমার ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাবে, এটা যদি ভেবে থাকো তাহলে খুব বড় ভুল করছো৷ আবারও ওয়ার্ন করছি৷ খুব বড় ভুল করছো তুমি।

উষির থমকালো, কথা ঘুরালো৷ গতকাল নিউজ প্রকাশের পর যে তার ক্যারিয়ারের অলরেডি চল্লিশ শতাংশ ডুবে গেছে এবং বাকি ষাট শতাংশ যে হাসান চৌধুরী নিজ দ্বায়িত্বে ডুবিয়ে দেবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এগিয়ে এসে রাশার হাত মুঠিয়ে বন্দি করে সামনে এগোতে এগোতে বললো,

–আমি একা কষ্ট করবো আর পার্টনার বসে থাকবে, এটা আমার সহ্য হবে না। চলো, কাঠ আনতে সাহায্য করবে।

রাশার লম্বা হালকা গোলাপি টপটা ভেজা কাঠ নেওয়াতে নষ্ট হয়ে গেলো। উষিরের উপর জমা সব রাগ কাঠের উপর ঝাড়তে লাগলো। রাগ কিছুতেই আয়ত্তে আসছে না। কতো উপায় ভেবেছে, কত ভাবে দেখেছে। কিচ্ছু কাজে আসছে না। এই রাগে রাগটা আরো বেড়ে যাচ্ছে।

***
ঘুম থেকে উঠেই নোঙর এক বিশাল অনশনে বসলো। বসার আগে অবশ্য খেয়ে নিতে ভোলেনি৷ অনশনে বসার মূল কারণ হলো চাকরি৷ বিয়ের একদিন পরেই তার মনে হলো একটা চাকরি তাকে করতেই হবে৷ বেকার থাকলে বিয়ের দিনের মতো প্রতিদিনই তার বর তাকে ছেড়ে চলে যাবে। তাই বিস্তর গবেষণা করে এবং দীর্ঘক্ষণ বান্ধবীদের সাথে আলোচনা করে এই অনশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
অনশনে বোধহয় কলা খেতে মানা নেই। অন্তু এক ছড়ি কলা এনে দিয়েছিলো৷ এখন আর চারটা বাকি আছে। নোঙরের অনশন দেখে কিছুক্ষণ উশখুশ করে নিহান এসে তার ফার্মে একটা চাকরি নিতে বললো। তিনটে মুরগী দিয়ে সবেই একটা ফার্ম দিয়েছে সে। এখনও দুটো মুরগী আসা বাকি আছে। টোটাল হবে পাঁচটা। শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো নোঙর৷ তার শখ করে ভর্তি হওয়া এমবিএ-র ডিগ্রী কি না মুরগী খাবে! মেনে নিতে পারল না কিছুতেই। বাকি কলা চারটে শেষ করে সোজা বিছানায় শুয়ে পরলো। অপলা এসে এক বোতল শরবত এনে দিলো। ছড়িয়ে পরলো, নোঙর তীব্র অনশনে অসুস্থ হয়ে শয্যা নিয়েছে৷ খবর চলে গেলো এতোদিনের পুরোনো ফুপুর বাড়ি আর সদ্য হওয়া শ্বশুরবাড়ি। ঘন্টাখানেক পরেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার চলে আসলো। সাথে নতুন কাকা শ্বশুরের সতর্ক বানী৷ নতুন বৌমাকে দুই ঘন্টার মধ্যে চাকরিতে জয়েন করতে হবে। দুই ঘন্টা পরে গেলে ইন্টারভিউ দিতে হবে। আর দুই ঘন্টার মধ্যে গেলে সরাসরি পাবে একটা গোছালো ডেস্ক।

কিছুক্ষণ তালবাহানা করে, গাঁইগুঁই করে রেডি হতে লাগলো সে। বেছে বেছে বের করলো সব থেকে পছন্দের একটা কুর্তি৷ সাদা, কালো আর হলুদ মিশেলের জামাটা কয়েকদিন আগে নিউমার্কেট থেকে অনেক দরদাম করে কিনেছিলো৷ এর আগে মাত্র একদিন পরেছে৷ অফিসের প্রথম দিনে এই জামার থেকে ভালো আর কোন জামা হয় না৷ চুল পনিটেল করে বেঁধে গলায় স্কার্ফ ঝুলিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিলো সম্পূর্ণরুপে তৈরি হয়ে গেলো।

বেরোনোর আগে পোষা কাকাতুয়া পাখির কাছে গেলো। সুন্দর ঝুঁটিওয়ালা, আকর্ষণীয় পালক আর বাঁকানো ঠোঁটের সাদা রঙের কাকাতুয়াটা নতুন কেনা হয়েছে। কথাবার্তা তেমন বলে না৷ বাচ্চা কাকাতুয়া পাখিটির চেনাপরিচয় এখনও তেমন একটা হয়নি। শুধু নোঙরকে দেখলে শান্ত থাকে। আর বাকিদের দেখলে রুক্ষ স্বরে ডেকে ওঠে, চেঁচামেচি করে৷ তাই তাকেই খাবার দিতে যেতে হয়। অফিস থেকে কখন ফেরে না ফেরে, তাই এখনই বেশি করে খাবার দিতে চাইলো। রান্নাঘর থেকে কিছু সূর্যমুখী বীজ নিয়ে খাঁচার কাছে গেলো৷ তখনই ফোন বেঁজে উঠলো। আননোন নাম্বার। রিসিভ করে ফোন কান আর কাঁধে দিয়ে আটকে খাঁচার দরজা খুলে খাবার দিতে দিতে ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে প্রশ্ন করলো,

–কে বলছেন? কাকে চাই?

–মিসেস নোঙরকে চাই।

ভ্রু কুঁচকে গেলো নোঙরের। তার মিস থেকে মিসেস হওয়ার খবর পরিবার ছাড়া বাইরে কোথাও যায়নি। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি কিভাবে জানলো সেটা জানা দরকার। রুক্ষ স্বরে রাগী গলায় বললো,

–তাকে দিয়ে কি দরকার? ও বাড়ি নেই৷ ওর হাজবেন্ড আছে, কথা বলবেন?

–আমি ওর হাজবেন্ডই বলছি।

নোঙর থতমত খেয়ে গেলো। সেই সাথে একটা ঠান্ডা বাতাস শরীরে অনুভব করলো। হাজবেন্ড! এতো অধিকার! এতো জোড়! নিজেকে সামলালো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

–বলো, কি বলবে?

উজান তাড়াতাড়িই অফিসে এসেছে৷ কাজ জমে ছিলো অনেক। বিয়ের ব্যাপারটা মাথা থেকে একদম বেড়িয়ে গিয়েছিলো। একটু আগে যখন তার বড় বাবা আবসার কায়সার ফোন দিয়ে বললেন, নোঙরও আজ থেকে অফিসে আসবে তখন থেকেই তার হাসফাস লাগছে। এই বিয়ে ব্যাপারটা এখনও ঠিক হজম হচ্ছে না৷ বিয়ে জিনিসটা মানার আগেই নিউজ লিক করতে চায় না সে। সময় নিতে চাচ্ছে। ভাবতে চাচ্ছে। সম্পর্কটাতে থাকবে কি না সেটা নিয়েও কনফিউজড। বড় বাবাকে বললো সেটা। তিনি উত্তরও দিলেন। কিছুই আর করার নেই, তিনি বাধ্য। কথা শুনে প্রথমে রাগ উঠেছিলো। পরক্ষণেই মাথা ঠান্ডা করে নোঙরের সাথে সরাসরি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো৷ সেই ভাবনায় ফোনও করে ফেলেছে৷ কল রিসিভ করায় আর একটুও সময় নিলো না উজান৷ প্রশ্ন করলো,

–চাকরি করতে চাইছো কেন?

–নোঙর খন্দকার কি তোমাকে বলে বলে চাকরি করবে?

নিতান্তই অভদ্রমার্কা উত্তর। রেগে গেলো উজান। দাঁতে দাঁত পিষলো। ক্রোধ মিশ্রিত স্বরে বললো,

–আমার অফিসেই তোমার সেই চাকরিটা নিতে হবে?

হতচকিত হলো নোঙর। এই খবরটা তার কাছে নতুন। শ্বশুরবাড়ির নিজস্ব অফিস মানে যে সেখানে উজান নামক হাজবেন্ডও থাকবে সেটা মাথাতেই আসেনি! রাজী হয়েছে, এখন মানাও করা যাবে না। নাক চুলকে কিছু ভাবলো৷ তারপর ক্রুর হেসে বললো,

–সেটা শ্বশুরবাড়ির ডিপার্টমেন্ট। আমার না৷ আমি যেচে চাকরি নেইনি। আমাকে যেচে দেওয়া হয়েছে, বাড়ি বয়ে এসে।

শেষের বাক্যটা বেশ জোরের সাথে বললো৷ উজান তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

–তুমি মানা করে দাও। বলো এখানে জব করবে না। আমি তোমাকে অন্য জায়গায় জব নিয়ে দিচ্ছি৷ ভালো বেতনের, ভালো চাকরি।

উজান মানা করছে মানে নোঙরকে চাকরিটা করতেই হবে। জেদ চেপে গেলো। মাথা নেড়ে বললো,

–উঁহু। শ্বশুরবাড়ির অফিসের মজাই আলাদা। আমি অন্য চাকরি করবোই না। এইটাই করবো।

নোঙরের জেদি সুরে বলা কথাগুলো শুনে রাগে টেবিলে কিল বসিয়ে দিলো উজান। টেবিলের কিছুই হলো না, কিন্তু হাতে ব্যাথা পেলো। হাত ঝাড়া দিতে দিতে বললো,

–ফাইন! তাহলে আমাদের বিয়ের কথা তুমি অফিসের কাউকে বলবে না। বুঝেছো?

উজান বুঝে গেছে, আর যাই হোক নোঙর এখানেই চাকরি করবে। তাই মনের কথাটাই বলে দিলো। ফোনের ওপাশ থেকে নোঙর ভেঙচি কাঁটলো৷ ঠোঁট বেঁকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বললো,

–তুমি কাউকে বলবে না।

অবাক হলো উজান। বিষ্মিত স্বরে বললো,

–আমি কেনো খামোখা কাউকে বলতে যাবো?

নোঙর রেগে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠে বললো,

–তাহলে আমিও কেনো খামোখা কাউকে বলতে যাবো? তোমার কি মনে হয়, আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য ম’রে যাচ্ছিলাম যে এখন জনে জনে ডেকে ডেকে বলবো, তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।

বিরক্ত হল উজান। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

–এমন অসভ্যের মতো কথা বলছো কেন? ভদ্র আচরণ করতে শেখোনি?

–ভদ্র আচরণ কেমন করে করে? শিখিয়ে দেবেন একটু?

নোঙর চোখ পিটপিট করে গলার স্বরে মাধুরী মিশিয়ে জবাব দিলো। ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি খেলা করছে।

–গো টু হেল। জাহান্নামে যাও!

রাগে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো উজান। বলেই ফোন রাখতে চাইলো৷ নোঙর ছাড়লো না।

–আমি গো টু হেলের বাংলা জানি। আপনাকে ট্রান্সলেট করতে হবে না। আর আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? আমি কি আপনাকে তুমি করে বলছি? আমাকে আপনি করে বলবেন।

–তুমি বয়সে আমার থেকে যথেষ্ট ছোট। আর..’

উজান বলতে চাইলো, সেও ওকে তুমি করেই বলছে। মাত্র দুই তিনটা বাক্য আপনি বলেছে। কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই ওপাশ থেকে কড়া গলায় বললো,

–আপনি যদি আমাকে আপনি করে না বলেন তাহলে আমিও আপনাকে তুই করে বলবো।

নোঙর একরোখা জবাব দিলো৷ ততক্ষণে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অটোতেও উঠে গেছে।

–তুই করে বলবে!

উজান মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো। বাক্যটা তার কাছে নতুন। নোঙর কপাল কুঁচকে মাথা নাড়লো। নির্লিপ্ত স্বরে বললো,

–হ্যাঁ, এই আজকে তুই কোন কালার ড্রেস পরে অফিসে যাবি? ব্লুটা একদম পরবি না। ওইটা পরলে তোকে একদম অফিসিয়াল জোকারদের মতো লাগে।

নোঙর উজানের সোশ্যাল সাইটও ভিজিট করেছিলো৷ কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টালে ছবিও দেখেছে৷ সেখানেই কোন একটা জায়গায় নীল স্যুট আর সাদা শার্টের উজানকে দেখে তার মাথা গরম হয়ে গেছে। নীল রঙ তার একদম পছন্দ হয় না৷ নোঙরের বিশ্বাস, নীল অশান্তি ছড়ায়। তাই সে নীল থেকে দূরেই থাকে।

উজান দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। চট করে নিজের পোশাকের দিকে তাকালো৷ গ্রে কালার শার্ট পরে আছে৷ সাথে ব্ল্যাক কালার স্যুট৷ নীল না পরায় রাগ গলো খুব। সাথে নোঙরের অভদ্র আচরণ। রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে বললো,

–অসভ্য!

নোঙরের বেশ মজা লাগতে লাগলো৷ মেইন রোড দিয়ে চলা গাড়িগুলো একটার পর একটা তাকে ক্রস করে চলে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে কণ্ঠ যথাসম্ভব সিরিয়াস করে বললো,

–তোকে আমি ইমপ্রেস করতে চাই না। তাহলে খামোখা তোর সামনে আমি ভদ্র সাজতে যাবো কেন?

–অসভ্য, অসহ্য, বেয়াদব মেয়ে!

রেগে কল কেঁটে দিলো উজান৷ নোঙরকে কল দেওয়ার জন্য মনে মনে নিজেকে বকতে লাগলো। চটপট নাম্বার ব্লক লিস্টে রেখে নিজেকে শান্তি দিতে ভুললো না৷ নিজেকে বোঝাতে চাইলো, পুরো কনভারসেশনটাই কল্পনা। বাস্তবে এমন কিছুই হয়নি। পরক্ষণেই মনে হলো, আপনি করে বলেই যদি এতো সম্মান দেয় তাহলে কোন সম্মোধন ছাড়া কথা বলাই ভালো।

***
প্রথমদিন নোঙরের কোন কাজ ছিলো না। আবসার কায়সারের সাথে ম্যানেজারের আগেই কথা হয়েছিলো। তবে নোঙরের আসল পরিচয়টা তাকে বলা হয়নি৷ তিনি শুধু জানতেন, নোঙর খন্দকার তার স্যারের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়। সবার সাথে সেভাবেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো৷ স্যারের আত্মীয় বলে সবাই আলাদা খাতির করলো। জ্যামের কারনে অফিসে আসতে আসতে প্রায় ছুটির সময়ই হয়ে এসেছিলো। তেমন পরিচয় হলো না কারো সাথে। সব থেকে খুশির ব্যাপার হলো, তাকে কোন ইন্টারভিউও দিতে হয়নি। এমনিতেই একটা সাজানো গোছানো ডেস্ক পেয়ে গেছে।

ছুটির পর উজান হন্যে হয়ে নোঙরকে খুঁজতে লাগলো। তাকে যেনো নিজ দ্বায়িত্বে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে, সেটা বলে মা, বড় মা, এমনকি বড় বাবাও বারংবার ফোন দিয়ে বলেছে। এই ফোনের চক্করে মিটিংটাও শান্তিতে করতে পারেনি। একটা ঝামেলা ঘাড়ে এসে জুটে গেছে। অসহ্য!

নোঙরকে পাওয়া গেলো গেটের মুখে। গ্যারেজের দারোয়ানের সাথে খোশগল্প করতে দেখা গেলো। উজানকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো। দেখেই শরীর জ্বলে উঠলো তার একটা কথাও বললো না। সোজা গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে নোঙরের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো৷ নোঙর দারোয়ানের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। আরামদায়ক সিটে পা তুলে বাবু দিয়ে বসলো। মূলত উজানকে জ্বালানোর জন্যই এমনটা করেছিলো। উজান দেখেও দেখলো না। বলা চলে পাত্তা দিলো না। ওই মেয়ের সাথে কথা বলা মানে নিজেই নিজের মাথায় বাড়ি দেওয়া। নিজেকে বুঝালো উজান। কোন কথা না বলে এক মনে গাড়ি চালিয়ে সোজা বাড়ির সামনে গাড়ি দাড় করালো৷ নোঙর ঘুমিয়ে পরেছিলো। জোরে হর্নের আওয়াজে ধরফরিয়ে উঠে পরলো। বাড়ি ফিরেছে দেখে গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো। ভ্রু কুঁচকে উজান বিড়বিড় করলো, ‘যেমন অভদ্র ব্যবহার, তেমন অভদ্র চালচলন! একবার বায় পর্যন্ত দিলো না! অসহ্য!’

গাড়ি চালানোর মূহুর্তে দেখলো সিটের উপর নোঙরের স্কার্ফের একটা ঝুল পরে আছে। ফেলে দিতে চাইলো সে। কি মনে করে সামনের স্টোরেজে রেখে গাড়ির মুখ ফেরালো। উদ্দেশ্য এখন বাড়ি।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে