#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৫
বিয়ে ভাগ্য উজান আর উষিরের প্রায় একই। বাবা অথবা মায়ের সাথে ঘুরতে যাও আর বিবাহিতের ট্যাগ লাগিয়ে বাড়ি ফেরো।
উষির আর রাশার রিসেপশন পার্টির আলোচনা চলছিলো৷ অনুষ্ঠানের বাহানায় পুরোনো ভাঙাচোরা আত্মীয়ের সাথে নিজেদের সম্পর্ক উন্নতি হয়। মাহফুজা আর আসিফ কায়সারের প্রেমের বিয়ে ছিলো। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন হওয়ায় মাহফুজার আদরটা একটু বেশিই ছিলো৷ অপরদিকে ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ায় তার বাড়িতে তুলকালাম বেঁধে গেলো। আসিফ কায়সার সম্পর্কে মাহফুজার ভাইয়ের বন্ধু ছিলো৷ ভাইয়েরা বোনকে কিছুতেই আসিফ কায়সারের সাথে দেবে না। তবে আদরের বোনের ভালোবাসার সামনে তা ধোপে টিকলো না৷ মাহফুজার অনুরোধে আর কান্নার তোড়ে বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হলেও কনে বিদায়ের সময় মাহফুজাকে তার বড় ভাই কঠিন গলায় বলেছিলো, সে যেনো আর কোনদিন ওই বাড়িতে না যায়। বোন তাদের জন্য মৃ’ত। তীব্র অভিমান হয়েছিলো তার। অভিমানে সত্যি সত্যি আর কোন যোগাযোগ করেনি। ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে ভাইদের আদরে মানুষ হওয়া বোন অভিমান ভাঙতে পারেনি। এতো বছর পর সম্পর্ক ঠিক করার উছিলায় আর অসু’স্থ ভাইয়ের অনুরোধে অভিমান ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো। তক্ষুনি তক্ষুনি কান্নাকাটি করে অফিস থেকে ছেলেকে বগলদাবা করে বাবার বাড়ি ছুটলেন।
মান অভিমানের পালা চুকে যেতেই সম্পর্ক মজবুত করতে উজানের সাথে ছোট মামার মেয়ের বিয়ের কথা উঠলো। তটস্থ হলো উজান। আবার খানিক ভরসাও পেলো। বাড়িতে দুটোই ছেলে। একজনের বিয়ে আচানক হলেও অপরজনের বিয়ে তো এমন আচানক হওয়ার প্রশ্ন আসে না। বিয়ে নিয়ে সবার কত শখ আহ্লাদ থাকে। তাছাড়া উজানের বয়সই বা কত! মাত্র আঠাশ চলছে। এই বয়সে কেউ বিয়ে করে নাকি! আর হলেও এভাবে নাকি!
উজানের সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবং সকল আশা পায়ে মাড়িয়ে বিয়েতে সবাই রাজি হলো। এমনকি তার বাড়ি থেকে শাহিদা আর ময়না রওনাও হয়ে গেলো।
মায়ের ইমোশনাল কান্নাকাটি নামক এক রোগ আছে। কথায় কথায় ইমোশনাল হয়ে যায়। মায়ের পরিবারেরও সেম রোগই আছে৷ বোনকে এতোদিন পর কাছে পেয়ে এক প্রস্ত, বোন জামাই বেঁ’চে না থাকায় এক প্রস্ত, বোনের ছেলেকে পেয়ে এক প্রস্ত এবং পরিশেষে বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে জন্য এক প্রস্ত করে কয়েক দফায় কান্নাকাটি হয়ে গেছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে উজান কিছুতেই বিয়েতে মানা করার সাহস পাচ্ছে না। ভাবলো, উষির আসলে তার সাথে গোপনে কোন না কোন আলোচনা করা যাবে।
শাহিদা আসলো ঘন্টা দুই তিনের মধ্যেই। সাথে করে নিয়ে আসলো এক গাদা মিষ্টি। উজানের সাথে দেখা করতেই উজান প্রশ্ন করলো,
–উষির আসবে না বড় মা?
–না, মিটিং পরে গেছে। বন্যা আর বৃষ্টি তো স্কুলে।
উজানের শেষ আশার পথটাও বন্ধ হয়ে গেলো। উজানকে কয়েকবার কল দিলেও ফোন বন্ধ পাওয়া গেলো৷ মিটিংএ সবসময় ফোন অফ করেই রাখে৷ উজানের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো৷ আর একটা ভরসা হলো রাশা। তাই এবারে রাশার কথা জিজ্ঞাসা করলো,
–আর রাশা?
মেহজাবিন সে রাতের ঘটনার পরেরদিন সকালেই চলে গেছিলো। সেই থেকে শাহিদা রাশার উপর রেগে আছে। তার ধারণা, রাশাই ওকে তাড়িয়ে ছেড়েছে৷ মেহজাবিন যাওয়ার পরপরই বেশ গম্ভীরমুখে একটা ডায়লগ বলেছিলো,
–বাড়ি আসা অতিথিকে অপমান করাকে প্রতিবাদ বলে না৷ তুমি যেটাকে প্রতিবাদ বলছো সেটাকে আমি অসভ্যতামো বলি।
আর এটাতেই রাশা হেসে ফেলেছিলো। ও ভেবেছিলো, শাশুড়ী মজা করে বলছে৷ কিন্তু এতেই শাহিদা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে। এখন সেই রাশার কথা উঠতেই গম্ভীরমুখে বললো,
–কোর্টে গেছে।
ব্যাস, এইটুকুই। বড় মায়ের এই গম্ভীরপনা দেখে নিজের বিয়ে নিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না। মেয়ে হলে তাও না হয় হাত পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি করে কিছু করা যেতো। ছেলে হয়ে কান্না করলে লোকে কি বলবে!
–বড় মা, বিয়েটা?
শাহিদা উজানের জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে। সেগুলোই গোছাচ্ছিলো। মাঝে উজানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো,
–হ্যাঁ, বিয়েটা কি?
–আম-আমার মতামত কেউ নিলে না?
উজান আমতা-আমতা করে উত্তর দিলো। শাহিদা খানিক থমকালো৷ তারপর হেসে ফেলে বললো,
— মতামত! আচ্ছা বল তোর মতামত কি?
–আমি বিয়ে করবো না?
উজান বেশ ইতস্তত করে বলার সাহস করলো। শাহিদা সব শুনে দায়সারা ভাবে বললো,
–কেনো? কোন পছন্দ আছে?
উজান সজোরে মাথা দুই দিকে নাড়লো। শাহিদা কপাল কুঁচকে পালটা প্রশ্ন করলো,
–তাহলে?
–আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই না।
–তোর বয়সে তোর বাবা আর বড় বাবা ছেলেদের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতো। আর তুই বলছিস এতো তাড়াতাড়ি! মেয়েকে দেখেছিস? একদম পরীর মতো দেখা যায়। আমার তো এক দেখায় পছন্দ হয়েছে। তোরও খুব পছন্দ হবে।
–তাই বলে এভাবে বিয়ে?
–বিয়ে আর কি? আল্লাহ যখন ভাগ্যে লিখে রাখেন তখনই হয়। তোর আর উষিরের ভাগ্যে যেমন বিয়ে লেখা ছিলো তেমন ভাবেই হচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই। বড় করে অনুষ্ঠান করে কনে বিদায় হবে। নোঙরের লাস্ট সেমিস্টার চলছে। শেষ হলেই অনুষ্ঠান হবে। ততদিন তোদের মধ্যে একটু চেনাপরিচিতিও হয়ে যাবে।
উজান শাহিদার কথার উপরে কোন কালেই কোন কথা বলতে পারে না। এবারেও বলতে পারলো না। তার বদলে নিজেকে বোঝাতে চাইলো। শাহিদা যাওয়ার খানিক পরে ময়না প্রায় উড়তে উড়তে উজানের কাছে আসলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
–ভাই, নয়া ভাবিরে এত্তো সুন্দর দেহা যাই! ভাবিরে দেখছেন? দেখবেন? কথা কইবেন? ছবি তুইল্যা আনমু? আফনের ফোন দেন, ছবি তুইল্যা আনি? না নাম্বার আনমু? ফোন নাম্বার আনতাছি।
ময়নার পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। সেই সাথে লাল লিপস্টিক আর রাশার দেওয়া গহনা পরায় লাল টুকটুকে লাগছিলো৷ একমাত্র তাকে দেখেই মনে হচ্ছিলো, সে বিয়ে বাড়িতে এসেছে। উজান তার সাজ দেখে প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেলো৷ পরক্ষণেই কথাবার্তায় রেগে উঠলো। কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু ময়না শুনলে তো। যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিলো, সেভাবেই ঝড়ের গতিতে চলে গেলো।
বিয়ে হলো পরের আধঘন্টার মধ্যেই। তখন আবার কান্নার রোল পরে গেলো। মনে হলো বাড়িতে কোন শোক সভা চলছে। সদ্য সদ্যই কেউ মা’রা গেছে। উজানের এক ছুটে বাইরে চলে যেতে মন চাইলো। কিন্তু অদৃশ্য সুতায় হাত পা বাঁধা। অফিস থেকে পরে আসা স্যুট খুলে ধবধবে সাদা পায়জামা পাঞ্চাবি পরতে হয়েছে। সদ্য পরিচিত হওয়া বড় মামা এসে আতর লাগিয়ে দিয়ে গেছে। আতরের কড়া মিষ্টি ঘ্রাণে তার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগলো।
বিয়ে পরানোর পর বেশ লম্বা মোনাজাত করা হলো৷ এরপরই ভেতর বাড়ি থেকে লাল টুকটুকে বেনারসি পরা একটা মেয়েকে তার পাশে এসে বসানো হলো। কড়া আতরের ঘ্রাণের মাঝেও মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এসে নাকে বাড়ি খেলো। উজান শক্ত হয়ে বসে রইলো। কাছাকাছি বসানো হলেও নিজেকে এমন শক্ত করেছিলো যে স্পর্শ পর্যন্ত লাগেনি। এরপর নিয়ম অনুযায়ী একে অপরকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে৷ উজানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আর যাই হোক, এই মেয়েকে কিছুতেই মিষ্টি খাওবে না। কিন্তু এবারেও তার সিদ্ধান্ত ধোপে টিকলো না। বাহারি রকমের মিষ্টান্ন সাজানো প্লেট সামনে এনে রাখা হলো। উজান ঠায় বসে রইলো। না নড়লো আর না টু শব্দ করলো। এবং হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলো, তার সামনে চামচে করে কেউ মিষ্টি ধরে আছে। হকচকিয়ে গেলো ভীষণ। স্বর্ণের নানান ডিজাইনের কয়েক গাছি চুড়ি পরা হাতে কেউ তার দিকে মিষ্টি বাড়িয়ে ধরেছে। হাতে মেহেদি নেই তবে আলতা দিয়ে সুন্দর করে হাত রাঙানো। উজান অস্বস্তি নিয়ে সামান্য একটু মিষ্টি খেলো। তাকে মিষ্টি খাওয়ানো হয়েছে মানে এখন তারও খাওয়াতে হবে৷ মনে আসা শত বাঁধা উপেক্ষা করে হাতটা নিজের কাজ করলো। প্লেট থেকে ছোট একটা মিষ্টি নিয়ে সাইড ঘুরতেই বিষ্ময়ে হাত কেঁপে উঠলো। সামনে বসা তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে, মিষ্টির সাথে উজান নামক মানুষটাকে মিশিয়ে দিলে বেশ আড়াম করে কড়মড় করে খেয়ে ফেলতো। উজান বারকয়েক চোখের পলক ফেলে দেখতে চাইলো, সে ভুল দেখছে নাকি ঠিক! যখন দেখলো, সামনের মেয়েটি সত্যি সত্যি তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে তখন সাংঘাতিক চটে গেলো। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি অফিসে পর্যন্ত তার পেছনে মেয়েদের লাইন লেগে যেতো আর এখানে একটা মেয়ে যে কিনা তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, সে তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে! এতো সাহস! শাহিদা বলেছিলো, পরীর মতো মেয়ে। উজানের মনে হলো, এর থেকে অসভ্য মেয়ে আর দুটো হয় না। সম্মানে লাগলো খুব। সিদ্ধান্ত নিলো, এই মেয়ের সাথে কোন সংসার নয়। যেভাবে বিয়েটা হয়েছিলো, সেভাবেই বিয়েটা ভাঙতে হবে।
চলবে…
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৬
হুটহাট বিয়ে হলেও মানিয়ে নিয়ে চললে সবই ভালো হয়। অন্তত প্রথম দেখা কিংবা প্রথম কথোপকথন তো ভালো হয়ই হয়। তবে উজান আর নোঙরের প্রথম দেখাতেই দা কুমড়ার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলো। বলা হয়, ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ লাস্ট ইম্প্রেশন। উজান সেটা মনে প্রাণে বিশ্বাসও করে। আরেকটা কথা আছে। যারে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা। এর একটা মিনিং হলো, যাকে পছন্দ হয় না তার কিছুই পছন্দ হয় না। উজানের ক্ষেত্রে সেটা খুব করে হচ্ছে। নোঙরের বাহ্যিক সৌন্দর্য সুন্দর, পরীর মতো বাকি সবার কাছে। কিন্তু উজানের চোখ সব কিছুর ধরা ছোয়ার বাইরে৷ সে পরে আছে সেই প্রথম দেখা নিয়ে। কি ভয়ংকর ভাবে কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো!
কিছুক্ষণ পর যখন তাকে নোঙরের সাথে কথা বলতে কিংবা সময় কাঁটাতে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো তখন উজান বেশ বিরক্ত হয়েছিলো৷ বিরক্ত ভাবটা কিছুতেই কমছে না। ফলস্বরূপ তাদের কথোপকথন শুরু হলো খুবই আজব বাক্য দিয়ে।
–ফ্লোর কি বসার জায়গা নাকি? ফ্লোরে বসে আছো কেনো?
কথাটা উজান নোঙরের উদ্দেশ্যে বলেছিলো। বিয়েটা এমন ভাবে হওয়ায় তার মাথা এমনিতেই প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। তার উপর নতুন বউয়ের ব্যবহার। আর তার উপর নানাবাড়ি প্রথমবার ঘুরতে এসে সম্পূর্ণ অচেনা একজন গলায় ঝুলে পরলো। বলা চলে, ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। বিরক্তিকর, অসহ্য, অভদ্র। শেষের শব্দটা নোঙরের জন্য ছিলো। গহনা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উজানের পায়ের নিচেও একটা চুড়ি পরেছিলো। সমস্ত রাগ চুড়ির উপর ঝাড়তে ফুটবলের মতো শট দিয়ে না জানি কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
নোঙর এখনও ঠায় বসে আছে। দুই পা ভাজ করে হাত দুটো হাটুর উপর দিয়ে পদ্মাসনে বসে আছে। মনে হচ্ছে ধ্যান করছে। মাথার ওড়না, চুল, শাড়ি সব এলোমেলো। উজান চোখ ছোট ছোট করে গলায় আরো জোর বাড়িয়ে আরো রেগে বললো,
–কিছু জিজ্ঞাসা করেছি আমি?
নোঙর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর উজানের থেকেও দ্বিগুণ তেঁতে উঠে বললো,
–খন্দকার বাড়ির কেউ, কখনও কাউকে কৈফিয়ত দেয় না।
খন্দকার! হ্যাঁ, এসেছে থেকে এই খন্দকার শব্দটা অগুনতিবার শুনেছে। মায়ের থেকেও বহুবার শুনেছে। বলা চলে, শুনে শুনেই বড় হয়েছে। এটা বোধহয় তাদের পারিবারিক ডায়লগ! উজানের শরীর জ্বলে পুড়ে উঠলো। খন্দকার বাড়ির মানুষ এটা করে না, ওটা করে না, এরা এমন, তেমন এমন হাজার কথা তার প্রায় মুখস্ত। শুনতে শুনতে তার কান রীতিমতো পঁচে গেছে। এতোদিন মা একাই বলতো। এখন আরেকজন এসে জুটেছে। ভয়াবহ কিছু ধমক ঠোঁটের আগায় আসলেও গিলে হজম করে ফেললো। খন্দকার বাড়ির সবাই আর কি পারে না পারে সেটা সে জানে না। তবে এটা জেনে গেছে, এরা খুব ভালো কাঁদতে পারে। এই যেমন, বিয়ে পরানোর সময় ছোট থেকে বড়, এমন কেউ নেই যে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করেনি। বিশেষণটা উজান কলেজে শিখেছিলো। আজকের আগে তেমন কাজে লাগেনি। বাড়িতে একজনের কথায় কথায় ইমোশনাল কান্না দেখা আর পুরো বাড়ি মিলে সবার মরা কান্না দেখার মাঝে হিউজ ডিফারেন্স! উজান তপ্ত শ্বাস ফেললো৷ ঘরটা তার মায়ের পুরোনো ঘর৷ অর্থাৎ বিয়ের আগের ঘর। তার বর্তমান বউ নাকি অনেক বছর আগেই এটা দখল নিয়ে নিয়েছিলো। উজান আশেপাশে নজর ঘুরাতে ঘুরাতে বিছানার দিকে গেলো। বিছানায় ভারি মোটা মখমলের গোলাপি চাদর বিছানো আছে। দুটো বালিশ আর একটা পাশবালিশ। ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। এখনও কেউ পাশবালিশ ইউজ করে! বেডসাইট টেবিলে পানি ভর্তি জগ আর গ্লাস ভর্তি দুধ। উজান দুধ খায় না৷ অর্থাৎ যদি পানি খেতে চায় তো জগ ধরে পানি খেতে হবে! কি একটা অবস্থা! রিডিকিউলাস!
বিছানা থেকে নোঙরের একপাশ দেখা যাচ্ছে। এখনও সে সেভাবেই বসে আছে আর কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। ফর্সা মুখটা মেকাপের কারনে পুরো গোলাপি হয়ে গেছে। বড় বড় হরিণী চোখদুটো স্থির৷ দীর্ঘশ্বাস ফেললো উজান। সফল তরুন বিজনেসম্যান হিসেবে প্রায় প্রতিদিনই নানান ইন্টারভিউ তাকে দিতে হয়। আজকে সকালেও সাংবাদিকদের ইন্টারভিউ দিয়েছিলো। সেখানে বেশ ফলাও করে বলেছে, তার বিয়ের এখন অনেক দেরি আছে। আপাতত বিয়ে নিয়ে তার কোন প্ল্যান নেই।
উজানের আরেকবার মনে হলো, আঠাশে কেউ বিয়ে করে নাকি! লাইফ তো শুরুতেই শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া বিয়ের প্ল্যান তার কখনো ছিলোও না। পারিবারিক বিজনেস আরো বড় করাই তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো। এখনও আছে। সাথে আজ আরেকটা উদ্দেশ্য যোগ হলো। এই মেয়ের থেকে মুক্তি পাওয়া। এই মেয়ের থেকে পাওয়া জঘন্য ইম্প্রেশন নিয়ে দুইদিনও সে টিকতে পারবে না৷ নো নেভার!
নোঙর এখনও সব গহনা খোলেনি। দুই হাতে ডজনখানেক চুড়ি পরা ছিলো। এতোগুলা খোলার পর এখনও বোধহয় আধ ডজন আছেই৷ গহনা পরে তার সত্যি খুব বিরক্ত লাগছিলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো টান দিয়ে দিয়ে সব গহনা খুলে ঢিল দিয়ে ফেলে দিক। যদিও একটু আগে তাই করেছিলো। ইচ্ছেটাকে দমন করলো না। হাতের চুড়ি বালা সব এক এক করে খুলতে লাগলো আর চারদিকে ঢিল দিয়ে ছিটাতে লাগলো। চুড়ি শেষ করে কানের দুল, টিকলি, মালা। সবশেষে হাতের আংটি খুলে ফেললো। আংটির ঢিলটা সরাসরি উজানের কপালের ঠিক মাঝে গিয়ে লাগলো। উজান নোঙরের কর্মকান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে পরেছিলো। এতোগুলো গহনা কোন মানুষ পরে! তার উপর এমন ঢিল ছুড়ছে! সবশেষে আংটি উজানের কপালে লাগায় তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। হুঙ্কার দিয়ে উঠলো,
–এসব হচ্ছেটা কি?
নোঙর আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভয় পেলো না একফোঁটাও। কিন্তু বসেও থাকলো না। বিষ্মিত হলো উজান। পুরো অফিস, সাথে হাজার খানেক কর্মী যেখানে তার কথায় ওঠে বসে, সেখানে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী তার কথাকে পাত্তাই দিলো না! যাস্ট তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো!
নোঙর উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির কুচি অর্ধেকটা খুলে গেছে৷ হাঁটতে নিলে পায়ে বাজছে৷ ঠিক করলো না একটুও। সেভাবেই হেলতে দুলতে এসে উজানের ঠিক পাশে হাত পা ছেড়ে বসে পরলো। উজানের মনে হলো এখনই মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু অজ্ঞান হলো না। বিছানার দুই পাশে হাত দিয়ে শক্ত করে বিছানার চাদর খাঁমচে ধরলো। তারপর মাথা বাঁকা করে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
–তোমার নাম কি?
উজান প্রথমটায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো৷ পরক্ষণেই রেগে গেলো৷ কোন উত্তর করলো না। যার সাথে কিছুক্ষণ আগে বিয়ে হলো, সে নাকি তার নিজের হাজবেন্ডের নামই জানে না! তার থেকেও বড় কথা, মেয়েটা উজানকে চেনেই না! যেখানে পুরো দেশ, এমনকি বাইরের দেশের মেয়েরা পর্যন্ত তার জন্য পাগল সেখানে তাকে সে চেনেই না! আত্মসম্মানে লাগলো খুব। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সরে বসলো। নোঙর ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর আবার বললো,
–নোঙরের কার সাথে বিয়ে হলো সেটা তো জানতে হবে।
উজান চোখ গরম করে রুষ্ট স্বরে বললো,
–বিয়ের সময় নাম শোনোনি?
নোঙর ঠোঁট উলটে বললো,
–মনে নাই।
উজানের চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো৷ তারপর ঝাঁজালো সুরে বললো,
–উজান
নোঙর মুখ বেঁকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বললো। অন্যদিকে মুখ থাকায় উজান সেটা দেখতে পারলো না। নোঙর আবার জানতে চাইলো,
–পুরো নাম?
উজান হাটুর উপর হাত রেখে কপাল ঘষতে লাগলো৷ রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে৷ চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে রীতিমতো।অত্যাধিক শান্ত স্বরে বললো,
–আজলান কায়সার।
–তাহলে উজান বললে কেনো?
উজান দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো,
–নিকনেম নামক ওয়ার্ডের সাথে কি পরিচয় নেই?
নোঙর ঠোঁট উল্টালো। পালটা জবাব না দিয়ে হিসাব করতে বসলো,
–হুম! আজলান কায়সার, হাজবেন্ড অফ নোঙর খন্দকার। ছ্যাঁহ! কি বিশ্রী শোনা যায়!’
নোঙরের মুখ করল্লা খাওয়ার পরের অবস্থার মতো হয়ে গেলো। উজান আর সহ্য করতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো। পাঞ্জাবির হাতা ভাজ করতে করতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো৷ আর নোঙর বিছানায় পা তুলে পাশ বালিশ আঁকড়ে সেভাবেই শুয়ে পরলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও গেলো। দরজা হাট করে খোলা রইলো।
রাশা বিয়ের খবরটা জানার পর আর কাজে মন বসাতে পারেনি। উষির, বৃষ্টি আর বন্যাকে নিয়ে উজানের সদ্য পরিচিত হওয়া নানাবাড়ি আর সদ্য হওয়া শ্বশুরবাড়ি চলে আসলো। রাশার পরনে ঢোলাঢালা কালো জিন্স আর সাদা কালো মিশেলের কুর্তি। কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে। উষির বরাবরের মতোই সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। তবে মারাত্মক ড্রেসাপ ছিলো, বন্যা আর বৃষ্টির। স্কুলড্রেস পরে হয়তো এই প্রথম কোন বোনরা তার ভাইয়ের বিয়েতে আসলো। আর তারা আসার পরই আবার কান্নার রোল পরে গেলো। বন্যা আর বৃষ্টিকে আকড়ে ধরে যা একটা কান্না হলো, সেটা শোকবাড়িকেও ছাড়িয়ে যায়। তারা দুইজন হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে পরিচিত কাউকে খুঁজলো। না পেয়ে হতাশ হলো খুব।
উজান বাইরের ঘরে আসতেই উষিরকে দেখল, সোফায় বসে তার মামাদের সাথে কথা বলছে। উজান গিয়ে সেখানে বসলো। দেখলো মামাদের চোখে হালকা পানি। কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো তার। খানিক উশখুশ করার পর যখন মামারা উঠে গেলো তখন উষির উজানকে টিটকারি দিতে ভুললো না। হাত দিয়ে উজানের পেটে মৃদু হাতে ঘুষি দিয়ে চোখ টিপে বললো,
–কংগ্রাচুলেশনস ভাই! মশা তো দেখি এখন তোর ঘরেও যাতায়াত করবে। বি কেয়ারফুল।
উজান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। ক্ষিপ্ত হয়ে উষিরকে হামলা করার প্রস্তুতি নিতেই উষিরকে বাঁচাতে রাশা আসলো সেখানে। একদম নাচতে নাচতে এসে উজানের হাত ঝাঁকিয়ে বললো,
–কংগ্রাচুলেশনস ভাইয়া! নোঙরকে কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি চলো তো, দুজনকে একসাথে ছবি তুলবো।
উজান খানিক অবাক হয়ে বললো,
–ও না ঘুমালো?
–ওওও..
বেশ সুর ধরে উষির বললো। বলেই মুখ টিপে হাসলো। উজান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–এইরকম চিপ বিহেভ কিছু মেয়ে ফ্রেন্ড, ভাবি এরা করে। রাশা করলেও মানাতো। লজ্জা করে না, ভাসুর হয়ে এমন করিস?
–আমাকে বড় ভাই কে মানে?
উজান ভীষণ পস্তালো। নিজের ছোড়া তীর নিজের দিকেই ফিরে আসলো। সেখানে তখন অন্তুর আগমন ঘটলো। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলের নাদুস-নুদুস ছেলেটি নোঙরের ভাই হয়। এসেই বেশ লাজুক স্বরে মিটিমিটি হেসে রাশাকে বললো,
–আপনাকে ডাকে?
রাশা মিষ্টি করে হেসে অন্তর গাল টিপে দিলো। তাতে করে সে আরো লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। একদম হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিউয়ে যেচে চাইলো। উষির কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কর্কশ গলায় বললো,
–কে ডাকে?
অন্ত বিরক্ত হয়ে উষিরের দিকে তাকালো। উষিরকে সে চেনে। খুব ভালোমতোই চেনে। কিন্তু এখানে তাদের দুইজনের মাঝে কথা বলায় তার উপর খুব রাগ উঠলো। বড় মানুষের মতো গম্ভীর স্বরে বললো,
–ফুপ্পি ডাকে।
বলেই আবার লাজুক ভঙ্গিতে রাশার দিকে তাকিয়ে বললো,
–তাড়াতাড়ি চলুন।
উষিরের আর সহ্য হলো না। লাফিয়ে উঠে চোখ পাকিয়ে ধমক দিলো,
–এই পিচ্চি, এদিকে আসো?
উষিরের মেজাজ দেখেই অন্তু এক ছুটে ভেতরে চলে গেলো৷
বাড়ি ফেরার পর রাশার মুখে শুধু ওই বাড়ির কথাই ছিলো৷ বিশেষ করে নোঙরের কথা। রাতে ঘুমানোর সময় উষিরকে নানান কথা বলতে লাগলো। সাথে চললো, বেহিসাবি প্রশ্ন। আর সেও ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও সব কথা শুনতে থাকলো,
–নতুন বউকে কবে আনবে? উজান ভাইয়ার আজকে ওখানে থাকা উচিত ছিলো৷ দুইজনকে খুব সুন্দর মানাবে। তাই না? আন্টির ফ্যামিলি খুব ভালো। তাই না? রান্নাগুলো কিন্তু খুব টেস্টি ছিলো। আন্টির রান্নার হাত বোধহয় জেনেটিক্যালি এসেছে। অন্তুও খুব কিউট তাই না? একেবারে গুলুমুলু।
উষিরের ধৈর্য এখানেই সমাপ্ত হলো। এক লাফে রাশার হাত বিছানায় চেপে ধরলো। রাশা হকচকিয়ে গেলো। উজান আক্রোশ মেশানো গলায় বললো,
–ওই পিচ্চিটা তোমাকে দেখে লজ্জা কেনো পাচ্ছিলো সেটা বোঝো না? আর ও বাচ্চা? বৃষ্টি, বন্যার সমবয়সী।
রাশা চটজলদি নিজেকে সামলে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
–তুমি এতো পজিসিভ হয়ে যাচ্ছো কেনো?
উষির থমকালো। তারপর ভ্রু দুটো কুঁচকে বাঁকা হেসে বললো,
–আমি পজিসিভ হলে তুমি মেহজাবিনের সাথে এমন বিহেভ করলে কেনো?
প্রথমবারের মতো রাশা উত্তর দিতে পারলো না। ময়নাকে যে ব্যাখা দিয়েছিলো, সেই ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া সম্ভব না। তাই কথা ঘুরালো,
–হাত ছাড়ো, ব্যাথা লাগছে।
উষির হাত ছাড়লো না৷ আর চোখ অন্য কিছু বলছে। রাশার হাত আরো শক্ত করে চেপে আরো কাছাকাছি গেলো। ফিসফিস করে বললো,
–লাগুক ব্যাথা। তুমিও তো আমাকে ব্যাথা দাও। তখন কিছু হয় না?
রাশা নার্ভাস হলো খুব। উষিরের এলোমেলো স্পর্শে রাশার অবস্থা নাজেহাল। নিস্তেজ গলায় বললো,
–আই হেইট ইউ!
উষির আরো কাছাকাছি আসলো। রাশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–আই হেইট ইউ টু ডিয়ার ওয়াইফ।
রাশা চোখ বুজে ফেললো। চোখ খোলার সাধ্য আর তার নেই। মধুর রাতকে আরো মধুর করতে কোথা থেকে গান ভেসে আসলো,
এই মন জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে
এসো না গল্প করি৷
দেখৌ ঐ ঝিলিমিলি চাঁদ
সারারাত আকাশে শলমা জরি।
চলবে…