তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-১৩+১৪

0
70

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৩

উষিরের সামনে র’ক্তা’ক্ত দেহ নিয়ে একটা লোক পরে আছে। লোকটার জ্ঞান নেই কিছুক্ষণ হলোই। শেষবার যখন হাতের লাঠি দিয়ে সজোরে মাথায় বাড়ি দিয়েছিলো, লোকটা তখনই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরেছে৷ এখনও তার মাথা দিয়ে র’ক্ত ঝরছে। পা অস্বাভাবিক বাঁকানো। দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঁধন মাত্রই খোলা হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে অবদি বেশ চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি থাকলেও এখন পরিবেশ নীরব, শান্ত।
উষির হাতের লাঠি ফেলে দিলো৷ একটা ছেলে এক মগ পানি আর রুমাল নিয়ে এগিয়ে আসলো। হাতের গ্লাবস খুলে হাত বেশ করে পরিষ্কার করে ধুয়ে রুমাল দিয়ে হাত মুছলো সে। ঘাড় হালকা ম্যাসাজ করে বললো,

–আর কয়টার মুখ বন্ধ করতে হবে?

পাশে থাকা আরেকটা ছেলে এগিয়ে আসলো। ঠোঁটে কুটিল হাসি, মুখে প্রচ্ছন্নতা। রাতের আঁধার ল্যাম্পপোস্ট কিছুটা লাঘব করলেও পুরোটা করতে পারেনি।

–এইটাই শেষ ভাই৷ বাকিগুলারে আমরা দেখতিছি।

উষির ঘাড় নাড়লো। পাঞ্চাবিতে র’ক্তের দাগ লেগে আছে। কিছু র’ক্ত আবার জমাট বেঁধে চিপকে আছে। চেক করে বিরক্ত হলো সে৷ গাড়ির দিকে পা চালিয়ে পাশের ছেলেটিকে সাবধান করলো,

–কোন প্রমাণ যেনো না থাকে। সাবধান!

পাশের ছেলেটি সবিনয়ে ঘাড় নাড়লো। তটস্থ ভঙ্গিতে বুক টানটান করে বললো,

–জ্বি জ্বি ভাই। এটারে গুদামঘরে নিয়া যামু?

উষির একপলক পেছনে পরে থাকা লোকটার দিকে নজর দিলো। তারপর পকেট থেকে চাবি বের করে গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললো,

–না। এখানেই থাকুক। কুকুর বিড়াল এসে একটু টেস্ট করে যাক।

উষিরের বাম পাশে আরেকটা ছেলে ছিলো। ছেলেটা নতুন এসেছে। আপাতত তার ট্রায়াল ক্লাস চলছে৷ গভীরে যেতে এখনও অনেক দেরি। তবে আজকের এই ট্রায়াল ক্লাসেই ছেলেটার হাঁটু কাঁপা অবস্থা হয়ে গেছে। উষিরের দিকে তাকিয়ে বেশ কাঁপা গলায় বললো,

–ম’রে তো নাই ভাই।

উষির ছেলেটির দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে বাকা হাসলো। হাত দিয়ে তার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

–মাথার উপর শকুন উড়লে একাই ম’রে যাবে।

ছেলেটি বুঝতে পেরেছে, এমনভাবে মাথা নাড়লো। ভয়ে মুখ এখনও রক্তশূণ্য হয়ে আছে। উষির গাড়ির ভেতর রাখা ব্যাগ থেকে আরেকটা পাঞ্চাবি বের করে পরলো। গাড়ির লুকিং মিররের সামনে দাঁড়িয়ে পাঞ্চাবির বোতাম লাগিয়ে চুল ঠিক করতে লাগলো। ঘটনাস্থলে উষির সহ আরো চারজন ছেলে ছিলো। এতোক্ষণ নীরব থাকা ছেলেটি একটু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,

–ট্রেনের নিচে ফালাইলে ভালো হইবোনে। এক্কেরে খাল্লাছ!

উষির চুল ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পাঞ্চাবির হাতা ভাজ করতে করতে মাথা নেড়ে বললো,

–উহুম, ট্রেনের নিচে কাঁটা পরলে ময়নাতদন্ত হবে। ময়নাতদন্ত হলে ফাঁস হওয়ার চান্স আছে।

–মন্ত্রী সাহেব আছে তো ভাই।

ছেলেটির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো সে। চোয়াল শক্ত করে বললো,

–আমরা ফাঁসলে মন্ত্রীসাহেব কিচ্ছু করবে না। উলটো দল থেকে বহিষ্কার ঘোষণা করবে। যা বললাম সেটাই কর। এই রাস্তায় অনেক কুকুর ঘোরে। কুকুরের আ’ক্র’মণে মা’রা গেছে বলে চালানো যাবে। কেউ টেরও পাবে না। আর দড়ি, লাঠি, গ্লাবস পুড়িয়ে ফেলবি। গ্লাবস,দড়ি, লাঠি, কোনটাই ফেলে দিবি না। বুঝেছিস?

সবাই সজোরে মাথা নাড়লো। একজোগে বলে উঠলো,

–জ্বি ভাই।

উষিরের ব্যায়াম করা বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত হাতে পরা সিলভার রঙের ঘড়িতে রক্ত লেগে ছিলো। বিষয়টা সম্পূর্ণ তার দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলো৷ ফেলে রাখা পাঞ্চাবি আরেকটা ছেলের হাতে দিয়ে বললো,

–লাঠির সাথে এটাও পুড়িয়ে ফেলিস। কোন প্রমাণ যেনো না থাকে। আমি এখন যাচ্ছি। তোরা সব কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবি। বাড়ির মানুষ অপেক্ষা করে। বন্ধুদের জন্য সারাদিন আছে। রাতটা বাড়ির মানুষের সাথে কাঁটালে তারা আর তোদের কাজে বাঁধা দেবে না।

বলেই গাড়ির ডোর খুলে ড্রাইভিং সিটে বসে পরলো৷ নতুন ছেলেটা পাঞ্চাবি হাতে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,

–কু*ত্তা যদি না আসে?

–ওদের আনার দ্বায়িত্ব তোদের৷ মাংসের লোভ সব মাংসাশীদেরই থাকে।

উষির কঠিন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো৷ যাওয়ার আগে আরেকবার সাবধান করলো,

–যেভাবে বললাম, সেভাবেই কাজ করিস৷ মনে রাখিস, এই ঘটনা ফাঁস হলে আমি কিন্তু ফাঁসবো না। ফাঁসবি তোরা। নিজেদের জীবনের ভার নিজেদেরই নিতে হয়।

উষির বাড়ি ফিরলো একটার দিকে। রাশা ঘুমিয়ে ছিলো। উষির ঘরে ফিরে লাইট জ্বালালো না। ড্রিম লাইটের আলোতে জামাকাপড় নিলো। লম্বা হট শাওয়ার নিয়ে তারপর বাথরুম থেকে বের হলো। তারপর ধীর পায়ে রাশার শিউরে বসে মাথায় হাত রাখলো। মাথায় হাত বুলিয়ে ধীর স্বরে বললো,

–পরিবারের প্রতি কেউ এতো বিদ্বেষ রাখে, বোকা মেয়ে!

উষির আজকে সুবোধ দত্তের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। সুবোধ বাবু অফিসরুমে কাজ করছিলেন। দরজা খুলে উষিরকে দেখেই হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। উষির কঠিন চোখেমুখে হেসে কোন ভণিতা ছাড়াই প্রশ্ন করেছিলো,

–রাশার সাথে আপনার কি সম্পর্ক আংকেল?

সুবোধ বাবু জানতেন, এমন কিছু হবেই হবে। উষির ঘটনার শেষ না জানা পর্যন্ত পেছন ছাড়বে না। দ্রুতই নিজেকে সামলে বললেন,

–সেটাই যেটা একজন টিচারের তার প্রিয় স্টুডেন্টের সাথে থাকে।

উষিরের শক্ত মুখ কিছুটা নরম হলো। সুবোধ বাবু দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে উষিরকে জায়গা দিলেন,

— ভেতরে এসে বসো উষির। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।

উষির স্ব-প্রশ্নক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। সুবোধ বাবু ঠান্ডা স্বরে বললেন,

–রাশার ব্যাপারে কিছু জানাতে চাই।

উষির ভ্রু কুঁচকে অস্ফুটে বললো,

–রাশার ব্যাপারে?

সুবোধ বাবু কিছু না বলে ভেতরে সোফায় গিয়ে বসলেন। উষির তার সামনা-সামনি একটা সোফায় বসলো। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে তার কথা শুরু করলেন,

–কথাগুলো একটু অদ্ভুত কিন্তু সত্যি। তোমাদের বিয়ে একটা অ্যা’ক্সিডে’ন্টে হয়েছে৷ তাই ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে তেমন কিছু জানো না৷ আর রাশাও যে নিজে থেকে কিছু জানাবে না সেটা আমি শিওর। ওর সমস্যাটা আমি তোমাকে শুরু থেকে বলছি।

উষির কিছু না বলে মনোযোগী শ্রোতার মতো সুবোধ বাবুর কথা শুনে গেলো।

–তুমি হয়তো জানো যে ওর বাবা কাকারা চার ভাই। রাশার বড় কাকার তিন ছেলে। মেজো কাকা অবিবাহিত আর ওর বাবার চার মেয়ে। মানে ওরা চার বোন। ছোট কাকার এক মেয়ে আর এক ছেলে। এটা বলার কারন আছে। ওর ফ্যামিলি পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষতান্ত্রিক দুই ধরনের হয়। এক ধরনের মধ্যে পরে, যেখানে গার্ডিয়ান পুরুষ থাকে। যেটা আর সাধারণ ফ্যামিলিতে হয় আর কি। আর দ্বিতীয় ধরনটা রাশার ফ্যামিলিতে হয়। ছেলেরাই যেখানে সর্বেসর্বা হয়। মেয়েরা অবহেলায়, অনাদরে থাকে। ওর বাড়ির মেয়েরা সবাই ক্ষমতা দেখেছে, টাকা দেখেছে। যা খুশি তাই করতে পেরেছে। আসলে ওদের দিকে কখনও কেউ নজরই দিতো না।

সুবোধ বাবু পায়ের উপর পা তুলে কথাগুলো বলে চললেন। খানিক থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাকি কথা বললেন,

–রাশা ওর বাবা মায়ের চতুর্থ সন্তান। মানে বুঝতেই পারছো ওর অবস্থাটা৷ বাকি মেয়েদের নিজেদের মতো মানুষ করলেও রাশাকে পারেনি। কি জানি কেনো, ও শুরু থেকেই খুব বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো। বড় তিন মেয়েকে ঘরোয়া আর নিজেদের মনের মতো বড় করলেও রাশার ক্ষেত্রে সেটা পারেনি। কয়েকদিন চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে ওকে নিজের মতো ছেড়ে দিয়েছে। ছোট থেকে অবহেলা আর ক্ষমতা দেখে দেখে ওর মনে প্রচন্ড ক্ষোভের জন্ম নেয়। এখন ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ, ওর ফ্যামিলির পরে থাকা মুখোশ টেনে খুলে ফেলা।

সুবোধ বাবু থামলে বোঝা গেলো, ঘর নিরবতায় ছেয়ে আছে৷ অতিথির আগমন বুঝতে পেরে কাজের লোক চা দিয়ে গেলো৷ উষির চায়ে চুমুক দিয়ে আবার মনোযোগ দিলো। সুবোধ বাবু নিজেও চায়ের কাপ তুলে মলিন গলায় বললেন,

–যতটুকু তোমাকে বললাম, ততটুকুই আমি জানি। তুমি এখন ভাবতেই পারো, আমি এসব ঘরোয়া খবর কিভাবে জানলাম। এগুলো রাশাই বলেছে। তবে আমাকে না, আমার স্ত্রীকে। আমার সাথে ও যতটা খোলামেলা, আমার স্ত্রীর সাথে তার থেকেও বেশি খোলামেলা। সেখান থেকেই আমি এসব জেনেছি। এরমাঝের কিছু কথা রাশার আর কিছু কথা আমার ধারণার। উষির, ও কখনও ভালোবাসা পায়নি। ভালোবাসা কি সেটা হয়তো জানেই না। তুমিই এখন ওর সুখ দুঃখের ভাগিদার। ওকে কখনও সুখ দিতে না পারলেও দুঃখ দিও না প্লিজ৷ শী ইজ অ্যান আমেজিং গার্ল৷ তুমি চাইলে ওর সাথে খুব সুখী হতে পারবে।

শেষ কথাগুলো তিনি উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন। এরমাঝে কিছু কথা লুকিয়েও গেলেন। যেগুলো তিনি আর রাশা ছাড়া রাশার পরিচিত আর কেউ জানে না। সেই গুপ্ত কথা বলার অধিকার একমাত্র রাশারই আছে।
উষির চায়ের কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বললো,

–এখন আসছি আংকেল।

সুবোধ বাবু নিজেও উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে উষিরের সাথে হ্যান্ডশেক করে বললেন,

–এসব যে তোমাকে বললাম সেটা রাশাকে জানিও না। হুমকি দিয়েছে আমাকে। জানোই তো আমি খেতে কতটা ভালোবাসি। আর তোমার আন্টি আমার মুখের খাবার কেড়ে নিতে কতটা ভালোবাসে। এই সেনসিটিভ জিনিসটা নিয়েই রাশা হুমকি দিয়েছে।

উষিরের হাসি চওড়া হলো। বাঁকা হেসে বললো,

–ডোন্ট ওয়ারি আংকেল। রাশাকে বলবো না আমি।

–শুধু রাশা না। কাউকেই বলবে না।

–হ্যাঁ, যেভাবে আপনি কাউকে বলেননি সেভাবে আমিও কাউকে বলবো না। বায় আংকেল। হ্যাভ আ নাইস ডে।

সুবোধ বাবু পেছন থেকে কপাল চাপড়ালেন। উষির চলে যেতেই তিনি মনে মনে নিজেকে দুষলেন। বলে ভুল করলেন নাকি বুঝলেন না।

বর্তমানে, উষিরের নজর রাশার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে। তার মুখে হাসি বিদ্যমান। দেখে কেউ বলবে না, কয়েক ঘন্টা আগে একজনকে মা’রতে মা’রতে আধম’রা করে এসেছে। কি স্বাভাবিক, মোলায়েম ব্যবহার! তর্জনি দিয়ে রাশার গালে আলতো স্পর্শ আঁকলো। কিছুক্ষণ আঁকিবুঁকি একে গালে ঠোঁট ছোয়ালো।
উষির বাইরে থেকে কিছু খেয়ে আসেনি। বাড়ি ফিরতেই প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছিলো। জ্যামে আটকা পরে ফিরতে এতোটা লেট হয়েছে। সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। তাই রাশাকে ফেলে একাই রান্নাঘরে গেলো। খাওয়ার জন্য কিছু খুঁজলো।

–এতো রাতে তোমার শেফ হতে ইচ্ছে করছে নাকি?

রাশার গলার স্বর ছিলো। ঘুমন্ত অলসতায় ঘেরা। উষির ঘার ঘুরিয়ে মুচকি হাসলো,

–ঘুম ভাঙলো কিভাবে?

রাশা আড়মোড়া ভেঙে উষিরের দিকে এগিয়ে আসলো,

–এতো ভালো ঘুমিয়েছিলাম! তোমাদের এখানে এতো মশা। গালের উপর সুড়সুড়ি লাগছিলো৷ আবার একটু পর কাঁটা ফুটলো। তাতেই ঘুম ভেঙে গেলো। এতো জ্বালাতনে ঘুম ধরে নাকি! এর আগেও একদিন এমন ফিল হয়েছিলো। এতো মশার মধ্যে তোমরা থাকো কিভাবে?

উষির তাজ্জব বনে গেলো। হাতটা চট করে নিজের গালে চলে গেলো। আবার! আবার তার আদর করে দেওয়া চুমুটা মশার কামড় হয়ে গেলো! ও এতো খারাপ চুমু দেয়! এতোটা!

রাশা উষিরের উত্তরের অপেক্ষা করলো না। তাকে বাটিতে চামচ নাড়তে দেখে নিয়েছিলো। সেদিকে তাকিয়ে বললো,

–এই মাঝরাতে ঘুম ভাঙায় আমারও ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে৷ ঘুম ভাঙতেই দেখলাম তুমি রুম থেকে বের হচ্ছো। ইনভেস্টিগেট করতে এসেছিলাম। এসে দেখি অন্য কাহিনী। তা কি রান্না করছো?

–ব্রেড টোস্ট।

উষির ঢোক গিলে উত্তর দিলো। তার নেশাগ্রস্ত নজর, রাশার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে৷ রাশা আরো কাছে আসলো৷ একটু ঝুঁকে উপকরণ দেখতে লাগলো। উষিরের নাকে তার শ্যাম্পু করা চুলের সুগন্ধ এসে লাগলো। চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানলো। আচ্ছন্নের মতো ঝুঁকে রাশার চুলে নাক ডুবিয়ে দিলো৷

–উহুম উহুম, এখানে কি রোম্যান্স হচ্ছে? ভুল সময়ে এসে পরলাম নাকি?

উজান লেট নাইট পর্যন্ত অফিসের কাজ করছিলো। ক্ষিদে তারও প্রচুর পেয়েছে। ইচ্ছে ছিলো, এসে চট করে টু মিনিটস ম্যাগি রান্না করবে। কিন্তু রান্নাঘরে উষিরকে দেখে ভাবনা পালটে গেলো। আরেকটু এগিয়ে যেতেই রাশা আর উষিরকে কাছাকাছি দেখেই মুখ টিপে হেসে কেঁশে উঠলো। উষির চমকে উঠে ছিটকে এক হাত সরে গেলো। রাশা অবুঝের মতো উষিরের দিকে একপলক তাকিয়ে উজানের দিকে তাকালো। মিষ্টি হেসে বললো,

–এমপি মন্ত্রীদের চামচারা চামচামি ছাড়া আর শুধু রান্নাটা পারে। তোমার ভাই সেটাই করছে।

–চামচা! উষির?

উজানের মুখ হা হয়ে গেলো। রাশা মাথা নেড়ে গম্ভীরমুখে বললো,

–মন্ত্রীর পিছে পিছে ঘোরে। ওদের কাজ টাজ করে দেয়। এদের চামচা ছাড়া আর কি বলবে?

উজান মুখ লুকিয়ে হাসলো। মুখভঙ্গি গম্ভীর করে মাথা নেড়ে বললো,

–ভেরি ব্যাড উষির! তুই পলিটিক্সের নামে এসব করিস, তা তো জানতাম না!

রাশা ফোঁস করে শ্বাস ফেললো৷ উষির রাগে ফুসছিলো। কড়া চোখে উজানকে বারকয়েক শাসিয়েও দিলো। রান্নাঘরে শাসানোর কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই সেখানে বো’মা ফেললো রাশা। উজানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে বললো,

–তোমাদের এখানে এতো মশা কেনো? আমাকে ঠিকমতো ঘুমাতেই দেয় না।

উজানের কপালে ভাজ পরলো,

–এখানে তো মশা নেই। মেডিসিন স্পে করা হয় তো।

–তাহলে প্রতিদিন আমাকে কামড়ায় কি? মশা না থাকলেও কোন পোকা আছে নাকি?

উষির খুকখুক করে কেঁশে উঠলো। উজান উষিরের দিকে তাকিয়ে মশার হদিস পেলো। বুঝতে পেরেই হাসতে নিয়ে কেশে উঠলো। নিজেকে সামলে হাসি থামিয়ে বললো,

–মেবি এই পোকা অনেক স্পেশাল পোকা। শুধু ম্যারেডদের কামড়ায়। আমি তো আবার চির সিঙ্গেল। তাই আমার থেকে দূরে দূরেই থাকে।

উষির আগুন চোখে তার দিকে তাকালো৷ উজান আমতা-আমতা করে কথা ঘুরিয়ে বললো,

–ভাই, আমার জন্যেও রান্না করিস। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।

উষির খেঁকিয়ে উঠলো,

–আমি শুধু মন্ত্রীদের চামচা। তোদের মতো ডাফার, ইডিয়ট আর থার্ডক্লাস পাবলিকদের চামচা না।

–আমাদের গালি দিলো রাশা!

উজান থমথমে গলায় রাশাকে অভিযোগ করলো। রাশা মনোযোগ দিয়ে পাউরুটিগুলো গুণে দেখছিলো৷ উজানের কথায় উত্তর দেওয়ার আগেই বৃষ্টি আর বন্যা হাত ধরাধরি করে সেখানে এসে হাজির হলো৷ উষিরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–ভাইয়া, আমাদের জন্যেও রান্না করো। পড়তে পড়তে ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।

এক্সামের জন্য রাত করে পরতে হচ্ছে৷ যথারীতি রাত বেশি হওয়ায় ডিনারে খাওয়া সব খাবার হজম হয়ে ক্ষিদে পেয়ে গেছে। তারাও খাওয়ার জন্য রান্নাঘরে এসেছিলো। খাবার বানানোর আভাস পেয়েই নিজেদের আবদার করে বসলো। তাদের আবদার শুনে উষির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। ধমক দিয়ে বললো,

–বানিয়ে খা।

বৃষ্টি আর বন্যা থতমত খেয়ে গেলো। উষির চলে যেতে চাইলো। কিন্তু এতোজনের বাঁধা অতিক্রম করে যাওয়ার সাধ্য কারই বা আছে।
বৃষ্টি, বন্যা আর রাশা ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করতে লাগলো। উজান উষিরকে হেল্প করার একফাঁকে ফিসফিস করে বললো,

–ভাই সিঙ্গেলদের সামনে এতো খোলামেলা রোম্যান্স করে তাদের দিল জ্বলানোর কি মানে? ঘর আছে, দরজা আছে, সেটাতে আবার লকও আছে। ঘরে বসেই নাহয় এসব করলি। এতে তোরাও শান্তিতে থাকতে পারলি আর আমরাও।

উষির রেগে হাতে থাকা ডিম উজানের মাথায় ভাঙলো। সকালে বাড়িতে হইচই পরে গেলো। ফ্রিজে রাখা ডিম, পাউরুটি সব হাওয়া। তেলের জারে অর্ধেক তেল গায়েব। চিনিও অনেক কম। মধুর বয়াম প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। নিশ্চয়ই এটা জ্বিনের কারবার। মাহফুজা পুরো বাড়ি আয়াতুল কুরসি পরে ফুঁ দিলো। শাহিদা গিয়ে সাউন্ডবক্সে সুরা চালিয়ে দিলো। ময়না রসুন আর মরিচ নিয়ে পোড়াতে বসলো। সব কাজ পরে, আগে বাড়ি থেকে জ্বিন তাড়াতে হবে।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৪

–এমন দুর্নীতি তো দুর্নীতিবাজও করে না খালাম্মা! আমার বেতন ভালোয় ভালোয় দিয়ে দাও বলছি। আমি অনেক বড় একটা লিস্ট করে রেখেছি৷ এখন টাকা দেবে আর এখনই আমি শপিংএ যাবো।

রাশা করুন গলায় শাহিদাকে কথাগুলো বললো। গলার স্বরে করুনা, অনুরোধ, হুম’কি সব ছিলো। শাহিদা জবাব না দিয়ে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে রাশার কথা শুনতে লাগলো। রাশার করুন গলার অভিযোগ শুনে সোজা হয়ে বসে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,

–বাড়ির বাইরে একটা আম গাছ আছে। দেখেছো?

শাহিদার বলা কথায় রাশা খানিক হকচকিয়ে গেলো। হচ্ছিলো কথা বেতন নিয়ে আর চলে গেলো আম গাছে! রাশা তপ্ত শ্বাস ফেলে দায়সারা ভাবে বলল,

–গেটের সাথে যে আছে ওটা?

–হুম ওটাই। ওখানে আম ধরে না।

–আম না ধরলে রেখেছো কেনো? কেঁটে ফেলে নতুন গাছ লাগাও।

রাশা কাঁধ নাচিয়ে ঠোঁট উলটে বললো। শাহিদা চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিলো,

–ওখানে তো আম ধরে না। টাকা ধরে। আমাদের যখন মন চায়, ওখান থেকে টাকা পেরে নিয়ে খরচ করি। তুমি যাও, যত টাকা দরকার তুলে নিয়ে আসো।

স্পষ্ট অপমান ছিলো। রাশা বুঝলো, হকচকালো। এক সপ্তাহ পার হয়েছে। তার এখন অগ্রিম বেতন চাই-ই চাই। এখানে যখন বেতন নিয়ে এতো ঝামেলা হয় তখন সে এই চাকরি করবেই না।

–তোমার কাজে আমি আজকেই ইস্তফা দিলাম। করবো না কাজ৷

মাহফুজা ফোঁড়ন কাটলো,

–কবে করেছো?

রাশা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে গাল ফুলিয়ে বললো,

–বিট্রেয়ার ফ্যামিলি। হুহ।

তারপর গটগট পায়ে চলে গেলো। রাশার চাকরির ইস্তফা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সকালের খাবার টেবিলে সাজানো হলো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই খেতে আসলো। আবসার সাহেব বাড়ি নেই। কিছুদিনের জন্য ঘুরতে গেছেন। নাহলে রাশার গাল ফুলানোর কোন না কোন ব্যবস্থা অবশ্যই হতো। সে এখন শোকে দুঃখে কিচেন কেবিনেটের উপর বসে বসে কলা খাচ্ছিলো। আজ এখানেই ব্রেকফাস্ট করার ইচ্ছা আছে৷ কল্পনায় অলরেডি ব্রেকফাস্ট শেষ। আর বাস্তবে তিনটে কলা আর দুইটা আপেল শেষ। পাশে এক প্যাকেট ড্রাই কেক রেখে দিয়েছে। কলা শেষে ড্রাই কেক খাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো। তবে সেটা পরিকল্পনায়ই থেকে গেলো৷ ভেস্তে গেলো কলিংবেলের আওয়াজে। কেউ একনাগাড়ে বেল বাজিয়ে যাচ্ছিলো।

কলিংবেলের ননস্টপ আওয়াজে ময়না দৌড়ে দরজা খুললো। বাইরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। পরনে সী গ্রিন কালারের লং ককটেল ড্রেস। দেখে মনে হচ্ছিলো, বলিউড থেকে উঠে আসা কোন নায়িকা। বড় একটা লাগেজ নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে৷ রাশার বেশ কৌতুহল হলো৷ এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করতে চাইলো। মেয়েটা সেই সময়ই দিলো না। হিল পায়ে দৌড়ে এসে উষিরের গলায় ঝুলে পরলো। নাক কুঁচকালো রাশা। কারো চেহারা বলিউড নাইকার মতো হলেই কি তাদের মতো কথায় কথায় গলায় ঝুলে পরতে হবে! বিরক্ত হলো ভীষণ। রান্নাঘরে যেতে যেতে মেয়েটির ন্যাকা গলায় বলা কথা কানে আসলো,

–ওহ হানি! আই মিসড ইউ সো মাচ! আর এইদিকে তুমি বিয়ে করে ফেললে! আমার কথাটা একবার মনে পরলো না?

রাশা পুরো কথা কান খাড়া করে শুনলো। ওপেন কিচেন হওয়ায় কিচেন থেকেই ডাইনিংরুমের কার্যকলাপ দেখা যায়। উষিরের পরবর্তী ধাপ দেখার জন্য বেশ উৎসুক হয়ে রইলো। সেও রাশার মনমতো কার্যক্রম করলো। গলা থেকে মেয়েটির হাত হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বিরক্তিকর সুরে বললো,

–দূরে থেকে কথা বলো মেহজাবিন। কথায় কথায় ঝাপটে ধরা আমার একদম পছন্দ না।

রাশা ভ্রু উঁচু করলো। ও আচ্ছা! মেয়েটির নাম মেহজাবিন! নামটা তো সুন্দর, তাহলে কাজকর্ম এমন কেনো!
মেহজাবিন আরো গলে গেলো। গলার স্বর নাকের মধ্যে নিয়ে এক অদ্ভুত আওয়াজে বললো,

–আগেও তো এমন হাজারবার কাছাকাছি এসেছি। টাইম স্পেন্ড করেছি, হোল ডেট টু নাইট। আমরা একসাথে থাকলে তো আমাদের টাইম সেন্সই থাকতো না।

–লায়ার!

উজান বিড়বিড় করে বললো। আজকে তার পছন্দের ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ হয়েছে৷ সেটাও ঠিকমতো খেতে পারছে না। রাশা ময়নাকে আস্তে করে বললো,

–মেয়েটার সাথে কিন্তু উষিরকে ভীষণ মানাবে। দুইজনকে সেট করতে আমাকে হেল্প করবে?

ময়না বিদ্যুৎবেগে রাশার দিকে তাকালো। চোখে অবিশ্বাস ঢেলে বললো,

–এডি কি কও তুমি! নিজের সংসারে কেউ এমুন আগুন লাগায়! এডি কিন্তু পত্তেকদিন আসে। সাড়াডি সময় ভাইগোর গলায় ঝুইল্যা থাকে। এইসব মাথায়ও আইনো না।

রাশা পরিকল্পনা বদলালো। ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। তারপর মুখভঙ্গি সিরিয়াস করে বললো,

— এইটা বোধহয় সেই গাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা পেত্নি। যে পথচারীকে পছন্দ হয় সেই পথচারীর গলায় ঝুলে পরে। কোন ব্যাপার না। আমিও মরিচ পোড়ার টোটকা জানি।

ময়না মুখ টিপে হাসলো। রাশা দ্রুত পায়ে উষিরের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাতের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলো। ভাগ্যিস এখানে বড়রা কেউ নেই৷ এইটুকু লাজলজ্জা তো তার আছে।
মেহজাবিন উষিরের কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিলো৷ রাশাকে উষিরের এতো কাছে দেখে রেগে গিয়ে বললো,

–হু আর ইউ?

–তোমার পথচারীর একমাত্র বউ।

রাশা মুখটা যথাসম্ভব ইনোসেন্ট করে উত্তর দিলো। মেহজাবিন নিজের চুলে হাত চালিয়ে একটু স্টাইল করে দাঁড়ালো৷ কোমড়ে হাত দিয়ে চুল মাথা ঝাঁকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

–ডু ইউ নো, হু আই অ্যাম?

রাশা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললো,

–হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। খাওয়ার পরে এঁটো হাত যে টিস্যুতে মুছে ফেলে দেওয়া হয়, তুমি হচ্ছো সেই টিস্যু।

–মেহজাবিন! তুই কখন আসলি? কার সাথে এসেছিস?

পেছন থেকে শাহিদার গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো৷ রাশা ছিটকে দুই হাত দূরে দাঁড়ালো। মুখ লাল হয়ে গেছে তার। মেহজাবিনের মুখ থেকে রাগের ছায়া সরে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রাশার শেষের কথাটার অতোটা গভীরে গেলো না। হাইহিলের উচ্চ আওয়াজ তুলে হেঁটে শাহিদাকে জড়িয়ে ধরলো,

–ডোন্ট বি ব্যাকডেটেড ফুপ্পি। আমি আমার সৌন্দর্য নিয়ে একাই এসেছি।

মেহজাবিন বেশ ভাব নিয়ে কথাটা বললো। শাহিদা হেসে মেহজাবিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো৷ উজান দ্রুত উঠে দাঁড়ালো৷ উষিরের পর এবারে মেহজাবিনের টার্গেট সে৷ চিন্তা করলো, আজকে ফিরবেই না৷ উষিরেরও একই পরিকল্পনা। যদিও ঘরে এখন বউ আছে কিন্তু বউ এখনও এতোটা আদুরে হয়নি যে বউয়ের টানে এই বিপদেও বাড়ি ফিরতে হবে।

উষির ভুল ছিলো৷ কাজ শেষে মোটেও আর ফালতু সময় নষ্ট করতে মন চাইলো না৷ বারবার রাশার তুলতুলে গালের কথা মাথায় আসলো৷ ভাবলো, আজকেও তাকে একটা মশার কামড় খাওয়াবে। ভাবনার পরে আর কিছুতেই বাইরে থাকতে পারলো না৷ অদৃশ্য এক সুতার টানে উজানকে ধরে বেঁধে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।

উজান রাগে রীতিমতো ফুঁসছিলো৷ উষির ছিলো নির্বিকার৷ মেহজাবিনের আবদারে কাজিনরা সবাই সোফায় গোল হয়ে বসে ছিলো৷ রাশা আর ময়নাকেও বাধ্য হয়ে রাখতে হয়েছিলো৷ মেহজাবিন কিছুক্ষণ নিজের গুণগান করার পর বললো,

–চলো গেম খেলি। ট্রুথ অর ডেয়ার।

সবাই একজোগে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রাশা ভ্যাবাচেকা খেয়ে পাশে বসা বৃষ্টিকে প্রশ্ন করলো,

–কি হয়েছে?

–এই গেমে মেহজাবিন আপুর একটা নিজস্ব রুল আছে। সবাইকে ডেয়ার নিতে হয়। সবাইকে ডেয়ার আপুই দেয়। আর সেটা ডান্স করার ডেয়ার। বেশিরভাগ সময়ই কেউ পারেনা। তখন আপু তার হয়ে প্রক্সি দেয়।

তার পাশে বসা বন্যা মাথা নাড়িয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বললো,

–মেহজাবিন আপু নাচতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু জঘন্য নাচে৷ ডান্সের নামে শুধু ভাইয়াদের গায়ে ঢলে ঢলে পরে৷

রাশা মাথা নেড়ে কুটিল হাসলো,

–আচ্ছা!

মেহজাবিনের বোতল তার দিকেই প্রথমে আসলো৷ খুশিতে লাফিয়ে উঠলো সে। এরপর নিজের বানানো নিয়ম অনুসারে ডেয়ার হিসেবে ডান্স নিলো। মিউজিক বক্সে বলিউডের এক রগরগে আইটেম সং সিলেক্ট করে নাচতে শুরু করলো। তার পরমে ছিলো শর্ট ফ্রক। ঝুল হাটুর উপরে। ফর্সা লম্বা পায়ের অনেকাংশই উন্মুক্ত। সেই সাথে গলা এবং হাতেরও অনেকটা উন্মুক্ত। হাতার জায়গায় শুধু দড়ির মতো দুটো ফিতা দেওয়া। গানের সাথে একদম মানানসই পোশাক পরিহিত মেহজাবিনের নাচের তাল শুধু উষির আর উজানের সামনেই ছিলো। কখনও উষির আর উজানের পেছনে গিয়ে তাদের গায়ে হাত দিয়ে নাচে তো কখনও সামনে এসে প্রায় গায়ের উপর উঠেপরে নাচে। বৃষ্টি, বন্যা অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গেলো। ময়না শুধু আস্তাগফিরুল্লাহ পরতে লাগলো৷ উষির উজান নিজেদের হাত অনেক কষ্টে সামলে রেখেছিলো। মামার আদরের মেয়েকে কিছু বললে চোদ্দগুষ্টি মিলে তাদের হাল বেহাল করতে দেরি করবে না। এইসবের মধ্যে একমাত্র রাশা নাচটা ভীষণ ইঞ্জয় করলো। শিস বাজাতে না পারে না জন্য আফসোস হল খুব। একসময় এই নাচ শেষ হলো। সবাই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে, এমনভাবে শ্বাস ফেলে হাত তালি দিলো। রাশা বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো,

–আমার বাড়িতে একটা বাইজিমহল আছে৷ সেখানে আগে বাইজিরা থাকতো। নাচ দেখার মন চাইলেই সবাই বাইজিমহলে চলে যেতো। যদিও এখন সেটা পরিত্যক্ত কিন্তু তুমি চাইলে সেটা আবার ওপেন হতে পারে। ওদের ভালো খোরপোশ দেওয়া হয়।

মেহজাবিন প্রথমটায় অপমান বুঝলো না। মুখ বেকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো,

–নাচ একটা আর্ট। সেটা যে পারে না সে এইসব বলে নিজেকে শান্তনা দেয়।

রাশা হাসলো। বিদ্রুপের হাসি। তারপর মুখ শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,

–আ’ম সরি বাট, শরীরের বাঁক দেখিয়ে সিডিউস করে কোমর দুলানোকে আমি বাইজি নাচ হিসেবেই জানি৷ নাচের বিভিন্ন ধরন আছে। তারমধ্যে সব থেকে খারাপ ধরনটা হলো খ্যামটা নাচ। সেটা বাইজিরা নাচে৷ সরি টু সে, নাচের সময় তোমার ব্যবহারটা ওমনই ছিলো৷ ঠিক রেড লাইট এরিয়ার বাইজি মেয়েদের মতো খ্যামটা নাচ।

অপমানের চূড়ান্ত ছিলো এটা৷ মেহজাবিন ক্রোধে ফেঁটে পরে তেড়ে মারতে আসলো। রাশা চোখ মুখ শক্ত করে মেহজাবিনের হাত পিছমোড়া করে ধরলো। উষির কিছু বলতে চাইলো। উজান বাঁধা দিয়ে বললো,

–ইতিহাস বলে, দুই মেয়ের ঝগড়ার মধ্যে একটা শিল্প থাকে৷ শিল্পটা ইঞ্জয় করতে দে।

–কোন ইতিহাস বলে?

উষির দাঁতে দাঁত চেপে পালটা প্রশ্ন করলো। উজান ঠোঁট উলটে কাধ নাচিয়ে বললো,

–ভবিষ্যতের ইতিহাস বলবে।

উষির চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো৷ রাশা মেহজাবিনের হাত আরো শক্ত করে চেপে কিড়মিড়িয়ে বললো,

–সরি ডিয়ার! আমার হাজবেন্ডের দিকে নজর দেওয়ার অপরাধে এমন একটা কেস গলায় ঝুলিয়ে দেবো যে বিশ বছরের আগে জেল থেকে ছাড়া পাবে না।

উষির উজানের বাঁধা মানলো না। এগিয়ে এসে রাশার হাতের শক্ত বাঁধন খুলতে চাইলো,

–ওর হাত ছাড়ো?

রাশা হাত ছাড়লো। রাগে ওর ফর্সা মুখ গোলাপি হয়ে উঠেছে। মেহজাবিন হাতের ব্যাথায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তারপর এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর পরিবেশ শান্ত হতেই মাঝে একবার ময়না ফিসফিস করে বললো,

–ভাবি, তুমি না কইলা এই বেডির লগে ভাইয়ের লাইন লাগায়া দিবা? এহন একে ধরেই তো মারতিছো।

রাশা আরো ফিসফিস করে বললো,

–এই মেয়ের সাথে উষিরের মিল করিয়ে আমি নিজের সম্মান খোয়াবো নাকি? সবাই কি বলবে, এই মেয়ের জন্য রাশার সংসারটা হলো না! ছিহ!

ময়না মুখ টিপে আসলো৷ এতোদিন এই মেয়ের অত্যাচার সহ্য করার পর আজ একটা উচিৎ শিক্ষা দেওয়া গেছে। এক্কেরে উচিৎ জবাব!
এরপর আবার সব চুপ। উষির প্রচন্ড রেগে গেছে। রাশার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,

–ঘরে চলো?

রাশা পাত্তা দিলো না৷ বন্যা আর বৃষ্টির হাত চেপে সামনে এগোতে এগোতে বললো,

–আজকে আমি ননদিনীদের সাথে গল্প করবো৷ একাই ঘুমাও।

উষির রাগী চোখে তাদের যাওয়া দেখলো৷ এখন ছোট ভাই বোনদের সামনে বউকে তো আর জোর করে ঘরে নেওয়া যায় না। বড়ই যদি এমন নির্লজ্জ কাজ করে তাহলে ছোটরা কি শিখবে! উজান পরিস্থিতি বুঝে মুখ টিপে হাসলো৷ এগিয়ে এসে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে বললো,

–রাগ করেছিস ভাই?

উষির দাঁত মুখ খিচিয়ে উঠলো,

–প্রে করি যাতে খুব তাড়াতাড়ি তোর কপালে এর থেকেও ড্যাঞ্জারাস কেউ জোটে।

উজান দাঁতে জিভ কেঁটে মাথা নাড়লো। ভাইয়ের হয়ে তওবা পড়লো হয়তো৷ তারপর বাঁকা হেসে বললো,

–তোর বউ এক পিসই আছে৷ তাই আমি নিশ্চিন্ত!

উজানের ধারণা যে কতটা ভুল ছিলো আর উষিরের দোয়া যে কত শীগ্র ফলে যাবে সেটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। যদি টের পেতো তাহলে হয়তো জীবনে আর মায়ের সাথে ঘুরতে যেতো না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে