#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১১
লিভিংরুমের দেয়ালে বেশ কয়েকটা পেইন্টিং ঝুলানো আছে। রাশা সেগুলো বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। বৃষ্টি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। রাশা থামালো৷ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
— মেজো বাবার একেকটা ছবির দাম তো লাখের উপর। এগুলো তো অনেক এক্সপেন্সিভ। তার এই ছবিগুলো ফ্রীতে দিয়ে দিয়েছে?
বৃষ্টি ছবিগুলোতে চোখ বুলালো৷ তার হাতে একটা খোলা বিস্কুটের প্যাকেট। চোখে জিরো পাওয়ারের চশমা। চশমা চোখ থেকে একটু সরে এসেছিলো। বাম হাত দিয়ে চশমা ঠিক করে বললো,
–না না, ফ্রীতে কেনো দেবে? খাগড়াছড়িতে বড় আব্বুর একটা বড় রিসোর্ট ছিলো৷ সেটার বদলেই দিয়েছে। মানে আগে পেইন্টিং দিয়েছে তারপর বলেছে তার ওই রিসোর্ট চাই। এখন পেইন্টিং তো ফেরত দেওয়া যায় না৷ তাই বাধ্য হয়ে রিসোর্টটাই দিয়েছে৷
রাশা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। বৃষ্টির বিস্কুটে ভাগ বসিয়ে ব্যাঙ্গোক্তি করলো,
–তাই তো বলি! ফ্রেন্ডস অফ বেনেফিট। ওটা তাহলে তোমাদের রিসোর্ট! রিসোর্টটা বড় বাবার আদেশ অনুসারে মেজো বাবা নিয়েছে। এখন সেখান থেকে ডেইলি লাখ টাকা ইনকাম হয়। প্রতিটা জিনিসের মূল্য ধরা৷ রিসোর্টে নিঃশ্বাস নিলে সেটারও ভাড়া দিতে হয়। সোনা দিয়ে বানানো নাকি কে জানে!
রাশার কথায় বৃষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে মাস শেষে হওয়া লাভের পরিমাণটা হিসাব করলো। রাশা আরেকটা বিস্কুট মুখে পুড়লো। বিস্কুট নেওয়াতে কিছু মনে করলো না সে৷ তার এখনকার দুঃখ একটু বেশিই বড়৷ সেটাই রাশার সাথে শেয়ার করতে চাইলো। মুখ কালো করে বললো,
–জানো তো, ওই রিসোর্ট বড় আব্বুর অনেক পছন্দের। ড্রিম হাউজ বলতে পারো৷ বানানোর পর আমরা একদিনও যাইনি৷ তার আগেই হাতছাড়া হয়ে গেলো।
রাশা উত্তর করলো না। বৃষ্টি বলার পরপরই বিচলিত স্বরে বললো,
–এটা কাউকে বলো না প্লিজ? কেউ একথা জানে না। আমি লুকিয়ে শুনেছিলাম। আজ প্রথম তোমাকে বললাম।
রাশা ভ্রু কুঁচকালো৷ আরেকটা বিস্কুট মুখে পুরে চিবাতে চিবাতে সন্দেহী গলায় বললো,
–এতোদিন পর আমাকে কেনো বলছো?
বৃষ্টি হকচকিয়ে গেলো। ইতস্তত করে কাঁধ নাচিয়ে বললো,
— এমনি।
রাশা হাসলো। চোর ধরার মতো হাসি। বৃষ্টির গালে টোকা দিয়ে বললো,
–আমি কারনটা বলি। কারন তুমি চাচ্ছো, আমি যাতে ওই রিসোর্ট তোমাদের ফিরিয়ে দেই। তাই তো?
বৃষ্টির মুখ ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলো৷ রাশা হেসে ফেলে বললো,
–ভয় কেনো পাচ্ছো?
বৃষ্টি ভয়ার্ত গলায় বললো,
–তুমি..তুমি সত্যি খুব ড্যাঞ্জারাস।
বলেই এক ছুটে চলে গেলো। রাশা ফিক করে হেসে ফেললো। ঘাড় উঁচু করে একবার সিঁড়ির উপর নজর দিলো। ততক্ষণে বৃষ্টি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
ঘড়িতে সকাল সারে নয়টা দেখাচ্ছে। নিজের ভাগের সমস্ত কাজ মাত্র দশ মিনিটে সম্পন্ন করেছে রাশা। এখন এসেছে উষিরের সাথে গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনা করতে। উষির ল্যাপটপে কিছু করছে৷ সামনে টিভিতে নিউজ চলছে। সেদিকে তাকালো রাশা। টিভিতে কোন এক এমপির মা’র্ডার সম্পর্কে বলা হচ্ছে। অনেক পুরোনো নিউজ। ইউটিউব থেকে দেখছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে উষিরের পাশে গিয়ে বসলো। নজর তুলে রাশার দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত। নিজের কাজেই মগ্ন রইলো। রাশা কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–কাল তোমার একটা কাজ করে দিয়েছিলাম। মনে আছে?
কি-বোর্ডে দ্রুততার সাথে হাত চলছে তার। ল্যাপটপ স্ক্রিনে নজর রেখেই গুরুগম্ভীর উত্তর দিলো,
–আমার স্মৃতি এতোটাও খারাপ না।
রাশা খানিক শান্তনা পেলো বলে মনে হলো। নিজের কাজ হাসিলের খানিক আশার আলো দেখতেই অনুরোধ করলো,
–ভেরি গুড৷ এখন আমার একটা উপকার করো প্লিজ?
ল্যাপটপ থেকে মুখ তুললো উষির। রাশার দিক তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো। রাশার মনটা কেমন জানি করে উঠলো। উষির সবে গোসল করে এসেছে। চুলের পানি গড়িয়ে পরছে। কপালের একাংশ ভিজে রয়েছে। ঢোক গিললো রাশা। একটু পিছিয়ে বসে বললো,
–আমার একটা ডকুমেন্টে তোমার একটা সাইন চাই। শুধু একটাই সাইন। আর তোমার এনআইডি কার্ডটা চাই। যাস্ট ফর নাম্বার।
উষির আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় বললো,
–এটা তো দুইটা কাজ হলো৷ একটা তো না।
–দুইটা জিনিসই একটা কাজেই লাগবে। তাই টেকনিকালি একটাই কাজ হলো।
রাশা বুঝানোর ভঙ্গিতে বললো। উষির বুঝেছে এমন ভাবে মাথা নেড়ে বললো,
–নিয়ে এসো।
এবারে রাশা একদম মিইয়ে গেলো। টুইস্টটা তো এখানেই। ফাইল সাইন করা যাবে কিন্ত দেখা যাবে না। এখন ল্যাপটপে মুখ গুজে থাকা মানুষটা সেটা মানবে নাকি সেটাই দেখার বিষয়। বেশ ইতস্তত করলো রাশা। দোনোমনা করে বললো,
–কিন্তু একটা কন্ডিশন আছে। তুমি ফাইলে শুধু সাইন করবে। কিছু পড়তে পারবে না।
উষির খানিক অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে রাশার দিকে একপলক তাকালো। তার কাজ শেষ। ল্যাপটপ বন্ধ করে রাশার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
–না পড়ে সাইন করতে পারবো না। তার উপর এনআইডি কার্ড চাচ্ছো৷ ব্যাংক ডাকা’তি করে আমাকে ফাঁসিয়ে দিলে তখন!
রাশার মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো,
–এনআইডির সাথে ব্যাংক ডাকাতির কি সম্পর্ক?
উষির কাঁধ নাচিয়ে ঠোঁট উলটে বললো,
–ফেক পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে গিয়ে ব্যাংক ডাকা’তি করা যায়। আবার সিম তুলে সেই সিম দিয়ে কিড’ন্যা’পিংও ইজিলি করা যায়। কত কিছুই তো করা যায়।
রাশার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। বিড়বিড় করে বললো,
–খুব এক্সপেরিয়েন্স আছে মনে হচ্ছে?
উষির কথাটা শুনতে পায়নি। সে এখনও ভ্রু কুঁচকে রাশার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে স্পষ্ট সন্দেহ। রাশা বড় করে শ্বাস নিয়ে পুনরায় বুঝাতে চাইলো,
–ওসব কিছুই না। ভালো কাজের জন্যই সাইন লাগবে। আমার একটা স্কলারশিপের জন্য অ্যাজ আ গার্ডিয়ান, তোমার সাইন আর একই কারনে এনআইডি নাম্বারও দরকার।
–আমি তো জানতাম তোমার স্টাডি শেষ। তাহলে এখন কিসের স্কলারশিপ?
রাশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে পালটা প্রশ্ন করলো,
–তুমি আমার স্টাডির ব্যাপারে আর কি কি জানো?
–নাথিং।
–তাহলে? পড়ার কোন বয়স হয় না বুঝেছো? আর এতো প্রশ্নই বা কেনো করছো? আমি কি তোমার লোন সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলাম? নতুন একটা কোম্পানি এতো টাকার লোন দিয়ে কি করবে? কিংবা সেটা কিসের কোম্পানি ছিলো? আমি একটাও কথা না বলে সাইন করিয়ে এনে দিয়েছিলাম।
উষির কপাল চুলকে দায়সারা ভাবে বললো,
–তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে। আমি বলিনি।
রাশা থতমত খেয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বললো,
–তাহলে আমাকে কেনো জিজ্ঞাসা করছো? একটাই তো সাইন। করে দাও, ঝামেলা চুকে বুকে যাবে। প্লিজ?
রাশা কাতর গলায় বললো। উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বার কয়েক চোখের পলক ফেলে বললো,
–নিয়ে এসো।
রাশা ভীষণ উচ্ছ্বসিত হলো। এক দৌড়ে ফাইল নিয়ে আসলো। নীল রঙের ফাইলের উপর সাদা পৃষ্ঠার একটা কাগজ দিয়ে সম্পূর্ণ লেখা ঢাকা। নিচের দিকে শুধু সাইন করার জায়গাটা ফাঁকা রয়েছে। একপলক রাশার দিকে তাকালো উষির। তারপর কলম চালিয়ে সাইন করে দিলো। রাশা এনআইডি কার্ডটা নিতেও ভুললো না। সব কিছু খুব সাবধানে ব্যাগে রেখে দিলো। উষিরের সামনে রাখলো না। সে বাইরে যেতেই খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখলো।
উষির, উজান দুজনেই সারে নয়টার মধ্যে বাড়ি থেকে বের হলো৷ রাশা এই অপেক্ষাতেই ছিলো। ওরা বেড়িয়ে যেতেই সেও তৈরি হয়ে নিলো। আগেরদিনের মতোই পোশাক-পরিচ্ছদ৷ সফেদ সালোয়ার সুট, পনিটেল করা চুল। বাম হাতে কালো ফিতার ঘড়ি আর ডান হাতে ব্রেসলেট। হাতের ব্রেসলেটটা সব পোশাকের সাথেই ভীষণ মানিয়ে যায়। প্রতিবারই তৈরি হওয়ার পরে ব্রেসলেটের দিকে তার নজর যাবেই যাবে। কিজন্য যায় আর কিজন্যই বা প্রতিবার দেখার পর মন ভরে ওঠে, সেটা বুঝতে পারে না। শুধু বোঝে, ব্রেসলেটটা হারানো যাবে না৷ তার কোটি টাকার গহনারগুলোও এই ব্রেসলেটের কাছে এসে মূল্যহীন হয়ে পরেছিলো।
সিঁড়ি ভেঙে লিভিংরুমে আসতেই শাহিদার সামনে পরলো সে। তাকে পরিপাটি পোশাকে আর ব্যাগ কাঁধে দেখেই কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
–কোথায় যাচ্ছো?
রাশা চটপট উত্তর দিলো,
–বাইরে।
কুঁচকানো কপাল সোজা হলো শাহিদার। নরম গলায় বললো,
–অযথা বাইরে ঘোরাঘুরির কোন দরকার নেই।
রাশা এগিয়ে গেলো৷ শাহিদা ডাইনিংরুমে যাচ্ছিলো। রাশা তার পিছু পিছু যেতে যেতে বললো,
–কি বলছো তুমি খালাম্মা? অযথা কেনো হতে যাবে? আমি তো রিসেন্টলি ডেইলি ভ্লগ শুরু করেছি। তাই ভাবলাম বাইরেটা একটু এক্সপ্লোর করে আসি৷ বিশ হাজার বেতনের চাকরি করে তো সংসার চলবে না। একটা আউটসোর্সিং থাকলে বেশ ভালো হবে। ঘরে বসে ইনকাম।
পা থমকে গেলো তার। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রাশার দিকে দিরে ধমকে উঠলো,
–জাহান্নামে যাও।
বলেই হনহন করে সামনে এগিয়ে গেলো। প্রথমটায় রাশা মুখ টিপে হাসলো। পেছন লাগার লোভ সামলাতে পারলো না। দ্রুত পায়ে শাহিদার পিছু নিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো,
–ভালো দোয়াও তো করতে পারো। এরপর থেকে দোয়ার উপর ট্যাক্স বসাবো। প্রতি খারাপ দোয়াতে এক হাজার করে ট্যাক্স। আর ভালো দোয়াতে একশো৷ এই নিয়ে একটা অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার তৈরি করে রাখবো৷ এতে সবার সাইন চাই।
কথা বলতে বলতেই ডাইনিংরুমে পা ফেললো সে৷ আর সাথে সাথেই থমকে গেলো। আবসার সাহেব টেবিলে বসে খাচ্ছেন। রাশাকে দেখেই আলতো হেসে বললেন,
–তোমার কোথায় যেতে হবে আমাকে বলো৷ আমি পৌঁছে দিচ্ছি।
রাশা নিজেকে চট করে সামলে নিলো। একগাল হেসে চেয়ার টেনে বসে বললো,
–কোর্টে যাবো আংকেল। তাড়াতাড়ি করো।
রান্নাঘর আর ডাইনিংস্পেস একদম সাথে। মাহফুজা রান্নাঘরে ছিলো। রাশার কথা শুনতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
–প্রতিদিন কোর্টে যেতে হবে কেনো?
রাশা পানি খেয়ে গলা ভেজালো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে মাহফুজার দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হেসে বললো,
–টাকার বিনিময়ে সাক্ষী হিসেবে কাজ করি আন্টি। পার্ট টাইম জব বলতে পারো। ভালো ইনকাম হয়। লাইফে টাকা ভীষণ জরুরি৷ তোমাদের কারো এই চাকরির প্রয়োজন হলে আমার সাথে কন্ট্যাক করতে পারো। আমি কাজ জোগাড় করে দেবো।
ময়নার চোখ চকচক করে উঠলো৷ হাতের কাজ ফেলে এগিয়ে এসে বললো,
–কেমন টাকা পাওন যায় ভাবি?
রাশা ঠোঁট উল্টালো। তারপর কপাল কুঁচকে চিন্তা ভাবনা করে বললো,
–বেশ ভালোই ইনকাম হয়। প্রতি সাক্ষীতে দুই তিন হাজার। ডেইলি দশ বারো হাজার ইনকাম হয়ে যায়। তবে একটু রিস্কি আছে। ধরা পরলে সোজা হাজত। তারপর মাথায় গোটা কয়েক কেস ঝুলিয়ে দেবে।
দমে গেলো সে। মুখ গোমড়া করে বললো,
–তাইলে তুমি এরম কাম করো কেন?
–আমি একটা জজের কাছে একটা সাক্ষ্যই দেই। তারপর তার সাথে আগামী এক মাস আর দেখা করি না৷ জজ তো আর একটা না। তবুও যদি কথার মারপ্যাঁচে পরে যাই তাহলে চালাকি করে ছুটে আসি।
শাহিদা সোজা রান্নাঘরে ঢুকেছিলো। রাশার কথা শেষ হতে না হতেই হাতের চামচ নিয়েই তেড়ে এসে রাগী গলায় আবসার সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,
–এই মেয়েকে কোথা থেকে ধরে এনে আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছো?
আফসার সাহেব রাশার কথায় এমনিতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলো। স্ত্রীর কথায় আরো নার্ভাস হয়ে গেলো। রাশা তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে বললো,
–একটু ভুল হয়ে গেলো খালাম্মা। আংকেল আমাকে সিলেক্ট করেনি। আমিই আংকেল আর তোমার ছেলেকে সিলেক্ট করে ঝুলে পরেছি। ওইযে, কি জানি একটা গল্প টল্প আছে না? গাছে ভুত পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। নিচ দিয়ে যাওয়া পথচারীদের পছন্দ হলে লাফ দিয়ে গলায় ঝুলে পরে, ব্যাপারটা অনেকটা ওমন।
শাহিদা চামচ উঁচিয়ে রাশাকে শাসিয়ে বললো,
–তুমি সারাদিন বাড়ি ফিরবে না। প্রতিদিন সকালে বের হবে আর সন্ধ্যার পর ফিরবে। যদি এমন করো তাহলে তোমার বেতন ত্রিশ হাজার হবে। আর যদি সন্ধ্যার আগে ফেরো তাহলে বিশ হাজারের পাঁচ হাজার কাঁটা।
রাশা মাথা নেড়ে সায় জানালো। নড়ে চড়ে আড়াম করে বসে পা নাচিয়ে বললো,
–টাকার ব্যাপারে আমি খুব সেনসিটিভ। তোমার কথা আমার কাছে বেদবাক্য। তবে বেদবাক্যে আমার বিশ্বাস নেই। নতুন অ্যাগ্রিমেন্ট তৈরি না করা পর্যন্ত এটা কার্যকর করতে পারছি না। আজকে ফিরে এসে অ্যাগ্রিমেন্ট নিয়ে বসবো।
ওপাশ থেকে ময়না আবার প্রশ্ন করলো,
–ম্যাডাম? আমার জন্নে এমুন ব্যবস্তা নাই?
মাহফুজা আর শাহিদা দুজনেই চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো। দমে গেলো ময়না। দুই পা পিছিয়ে নিজের কাজে হাত লাগালো। রাশা আফসোস মেশানো গলায় বললো,
–তুমি বরাবরই এতো লেট কেনো করো ময়না? এরপর আমার সাথে আগে কথা বলবে৷ আমার মাথায় এর থেকেই বেটার বেটার আইডিয়া আছে।
মাহফুজা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–হ্যাঁ হ্যাঁ, কুবুদ্ধি দিয়ে মাথা ভরা। কোচিং সেন্টার খুলে ফেলো। এখানেও ভালো ইনকাম হবে।
রাশা মুগ্ধ হয়ে বললো,
–ওয়াও আন্টি! আমার সংস্পর্শে একসপ্তাহ থাকলে কি থাকলে না, আমার মতো বুদ্ধি পেয়ে গেলে! হ্যাটস অফ ইউ আন্টি! তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে পারো। ভালো স্যালারি দেবো।
মাহফুজা ধমকে উঠলো,
–তোমার দেরি হচ্ছে না?
রাশা ঠোঁট উলটে বললো,
–হচ্ছে তো। আংকেলের খাওয়াই তো শেষ হচ্ছে না।
শাহিদা থমথমে গলায় বললো,
–না খেয়ে বাইরে যাওয়া আমার একদম পছন্দ না।
কথাটা রাশার উদ্দেশ্যে বলা সেটা স্পষ্ট বোঝা গেলো। ময়না এসে রাশার সামনে খাবারের প্লেট রাখলো। রাশা নিজের চোখের পানি সামলাতে ঢোক গিললো। তাতেও কাজ না হওয়াতে পানি খেলো। ইসস! বারবার সে এতো ইমোশনাল কেনো হচ্ছে!
চলবে…
#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১২
মোড়ের রাস্তায় সাংঘাতিক মারামারি লেগেছে। তার তেজ সবজায়গায় বোঝা যাচ্ছে। রাস্তায় মানুষের ছুটাছুটি, চিৎকার, সব মিলিয়ে অবস্থা বেশ করুন। তবে তার তেজ কফিশপের মধ্যে আসছে না। এসির জন্য চারিদিকে বন্ধ করে রাখা রয়েছে। রাশা সেই কফিশপেই বসে আছে৷ সামনে বসে আছে মধ্যবয়সী মাঝারি আকৃতির এক ভদ্রলোক। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় টাক পরেছে। পেছনের দিকের চুলগুলো প্রায় সবগুলোই কাঁচা। পরনে স্যুট-বুট৷ বেশ অনেকক্ষণ হলোই তারা বসে আছে। নানান আলোচনা করেছে। আলোচনার শেষে এসে ভদ্রলোকটি নিজের কফিমগে এক চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলো,
–তুমি তোমার ডিসিশনে সিওর?
রাশা মুচকি হাসলো। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ বোঝা যাচ্ছে। গোছানো পনিটেল করা চুলগুলো হালকা এলোমেলো। কিছু চুল কানের পিঠে গুজে আলতো ভাবে বললো,
–ইয়েস স্যার। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন এটা। পিছু হাঁটার আর কোন ওয়ে নেই।
রাশার সামনে বসে থাকা লোকটার নাম সুবোধ দত্ত। পেশায় সিনিয়র আইনজীবী, রাশার শিক্ষক। মাঝবয়সী সুবোধ বাবু হাসিখুশি মানুষ। সিরিয়াস ব্যাপারেও একটু মজা না করে পারেন না। তবে আলোচনার এখন অব্দি বেশ শান্ত ভাবেই কথাবার্তা বলে চলেছেন।
–ইউ আর নিউলি ম্যারেড ব্রাইড। তোমার বিবাহিত জীবনে এর কোন প্রভাব পরবে না তো?
রাশার হাসিমুখে হালকা মলিনতার ছাপ ফুটে উঠলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। সামনে রাখা কফিমগে হালকা করে সিপ নিলো। ক্যাপাচিনো কফির কিছুটা ঠোঁট লেগে ছিলো। আলতো হাতে টিস্যু দিয়ে মুছে বললো,
–নো স্যার। আওয়ার ম্যারেজ ইজ আ অ্যাক্সি’ডেন্ট। আর অ্যাক্সি’ডেন্টের মেমোরি কেউ ধরে রাখতে চায় না। হি ইজ আ জেন্টালম্যান অ্যান্ড ভেরি ইন্টেলিজেন্ট। হোপ করছি, খুশি খুশি সবটা মেনে নেবে।
–তবুও একবার কথা বলে দেখতে।
সুবোধ বাবুর গলায় উদ্ধিগ্নতার ছাপ। রাশা হাসলো। চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস ফুঁটে উঠেছে। টেবিলে আঙুল দিয়ে দুই একবার টোকা দিলো। আনমনে, উদাসীন হয়ে। তারপর নিজেকে সামলে বললো,
–সেটা করতেই তো এসেছি স্যার। আপনার সাথে আলোচনা করাই এনাফ। এখন আমিই আমার ডিসিশন মেক করার স্বাধীনতা পেয়েছি। আ’ম এক্সট্রেমলি এঞ্জয়িং দিস চ্যাপ্টার।
সুবোধ বাবু খুব করে হাসলো। তার কফি শেষের পথে। চেয়ারে আড়াম করে বসে মাঝারি আকৃতির উঁচু পেটে হাত রেখে মৃদুস্বরে ব্যাঙ্গক্তি করলেন,
–তুমি যতটা ম্যাচিউর নিজেকে মনে করো ততটা ম্যাচিউর তুমি না।
রাশার আত্মবিশ্বাস প্রচুর। নিজের সিদ্ধান্তকে প্রচন্ড সম্মান করে। সেই বিশ্বাস থেকেই বললো,
–স্যার, ম্যাচিউর হলে মাঝপথেই কাজটা ছেড়েছুড়ে পালাতাম। ম্যারিউর মানুষরা স্বাভাবিক মানুষ হয়। আর স্বাভাবিক মানুষরা মৃ’ত্যুকে ভয় পায়।
–ফিলোসফিক্যাল কথাবার্তা বেশ ভালোই বলছো দেখছি।
রাশা বাঁকা হাসলো। বললো,
–যেটাই হোক স্যার, শেষপর্যন্ত জয় আমারই হয়।
সুবোধ বাবু সোজা হয়ে বসলো। অমায়িক হেসে বললেন,
-ইট’স ট্রু অ্যাকচুয়েলি!
তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
–ঠিক আছে, কাজের কথা থাক। এখন আমি তোমার পারসোনাল কথা শোনায় আগ্রহী।
–সবটাই তো জানেন স্যার। নতুন আর কিছুই নেই।
–নো রাশা, তোমার লাইফের এই নতুন চ্যাপ্টার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সেটাই জানতে চাই। তোমার হাজবেন্ড সম্পর্কে, তোমার শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে। আ’ম কিউরিয়াস!
রাশার বুকটা কেমন একটা করে উঠলো। ক্ষণকালের মধ্যে সেটা ঠিক হলেও রয়ে গেলো রেশ। ওয়েটার বিল নিয়ে এসেছে। সুবোধ বাবু বিল পেমেন্ট করলো। রাশা সেদিকে তাকিয়ে খানিক ইতস্তত করে বললো,
–আমার হাজবেন্ডের নাম আদনান কায়সার।
সুবোধ বাবুর হাত খানিক থামলো। তারপর কপাল কুঁচকে সন্দেহি গলায় প্রশ্ন করলো,
–ওয়েট আ মিনিট, পলিটিশিয়ান আদনান কায়সার?
রাশা মাথা নাড়লো,
–জ্বি স্যার।
সুবোধ বাবু বিল পেমেন্ট করে হেসে ফেললেন। ওয়েটার চলে যেতেই হাসতে হাসতেই নিজের ব্যাগ গোছাতে লাগলেন। রাশা বিহ্বল হলো। কিছু বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচেকা খাওয়া গলায় প্রশ্ন করলো,
–স্যার, আপনি হাসছেন?
–আ’ম সরি রাশা বাট তোমার ভাগ্যে পলিটিশিয়ান থাকবে সেটা আমি কল্পনাও করিনি। বাই দা ওয়ে, তোমার হাজবেন্ডকে আমি খুব ভালো করেই চিনি আর তোমার হাজবেন্ডও আমাকে ভালো করেই চেনে।
–ওকে চেনা অস্বাভাবিক না। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব অ্যাক্টিভ। আপনারই মতো। আবার পাবলিক ফিগারও। সেটাও আপনার সাথে খুব মেলে।
–হুম, দ্যাটস রাইট বাট আমি অন্যভাবে চিনি। আবসার কায়সার মানে তোমার শ্বশুর আমার ক্লায়েন্ট। রেগুলার কাস্টমার যাকে বলে।
কথা বলতে বলতে তারা কফিশপের বাইরে এসে দাঁড়ালো। কফিশপের বাইরেটা একদম সাদামাটা। কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে আসলেই রোড দেখা যায়। একপাশে গাড়ি পার্ক করার জায়গা ছাড়া অতিরিক্ত আর কোন জায়গা নেই। তারা বসেছিলো দরজার দিকের একটি টেবিলে। বের হতে খুব একটা সময় লাগেনি। তবে যতটুকু সময় লেগেছে ততটুকু সময়ই কৌতুহলী রাশার ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
–বাট স্যার, হাউ ইজ দিস পসিবল?
–হোয়াই নট? যাস্ট কনসালটেন্ট হিসেবে ওদের হয়ে কাজ করি। কাগজপত্রের যত কাজকর্ম থাকে সব আমার ওয়াইফ দেখে। ভরসা থেকেই কনসালটেন্ট হিসেবে ওদের অফিসে পার্ট টাইম জব করছি।
রাশা আফসোসে মাথা নাড়লো। একজন ক্রি’মি’লান ল’ইয়ার যদি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্ট হিসেবে যায় তাহলে ব্যবসা যে কিভাবে আর কতভাবে সোজাভাবে নিজের কাজ করবে সেটা আর তার বোঝার বাকি নেই।
–স্যার, একই অঙ্গে বহুরুপ কথাটা আপনার সাথে খুব যায়।
সুবোধ বাবু হাসলেন। বাঙালিদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করার এক আলাদা ট্যালেন্ট আছে। সেই ট্যালেন্টটা তারা দু’জন বেশ করে খাটাচ্ছেন।
-তুমি সুপর্ণাকে দিয়ে কিসের ফাইল সাইন করিয়েছো? দেখতে পর্যন্ত দাওনি। একেবারে বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছো।
সুবোধ বাবুর প্রশ্নে খানিক ইতস্তত করলো রাশা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললো,
–একটা লোন ফাইল স্যার। কিসের লোন সেটা বলতে পারবো না। শুধু জানি লোন ফাইল।
–পরে প্রবলেম হবে না তো?
রাশা হাসলো, বাঁকা হাসি। কোন বাচ্চা দুষ্টমি করার পর যেভাবে হাসে ঠিক তেমন হেসেই বললো,
–লোন অ্যাপ্রুভালের ফাইল আর প্রবলেম ফাইলের মধ্যে পার্থক্য আছে নাকি স্যার?
তারপর কি মনে হতেই মুখশ্রী গম্ভীর করে অনুরোধ করে বললো,
–স্যার, একটা রিকুয়েষ্ট ছিলো। আমার কাজ সম্পর্কে আমার শ্বশুরবাড়ির কাউকে কিছু জানাতে চাই না। মানে এখনই চাই না। সব আগে গুছিয়ে নেই তারপর জানাবো। এই রিকুয়েষ্টটা রাখবেন স্যার? প্লিজ?
–ওকে ওকে! এটাতে রিকুয়েষ্ট করে বলার মতো কিছুই হয়নি। আমি তো তোমাকে চিনিও না।
সুবোধ বাবু ভরসা দিলেন। কিন্তু রাশা ভরসা পেলো না। মুখমণ্ডল চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকলো। গোলমালের আওয়াজ এখন তাদের দিকে আসছে। সুবোধ বাবু চিন্তিত স্বরে বললেন,
–এতো আওয়াজ হচ্ছে কেন? কেউ মা’র্ডা’র হলো নাকি?
রাশা তপ্ত শ্বাস ফেললো। সুবোধ বাবুর কাছে কিছু হওয়া মানেই হয় মা’র্ডা’র হওয়া আর নয়তো বড় কোন ক্রা’ইম করা। এছাড়া তার মুখে চিন্তার অন্য কোন কারণ আজ পর্যন্ত সে দেখেনি।
অন্য কিছু রাশা দেখলো তবে সেটা সুবোধ বাবুর থেকে নয়। রাস্তায় এক পাল লোকের সাথে হেঁটে হেঁটে উষির আসছে। তার হাতে মোটা একটা লাঠি৷ ঘামে শরীর ভিজে উঠেছে। হাঁটার মধ্যে দাম্ভিকতা ফুটে উঠছে। মুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। এমন উষিরের সাথে রাশার পরিচয় ছিলো না। এই উষির কাজের প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল আর সিরিয়াস। রাশার কেমন ঘোর লেগে আসলো। কানে আসলো সুবোধ বাবুর বিষ্মিত বাক্য,
–উষির! তোমার হাজবেন্ড এখানে কি করছে?
–ডোন্ট নো স্যার।
রাশা আচ্ছন্নের মতো উত্তর দিলো। সেকেন্ডের মধ্যে উষির লাঠি অন্যের কাছে হস্তান্তর করে ভিড় ছেড়ে তাদের কাছে আসলো। রাশার ঘোর তখনও কাঁটেনি। উষির হেঁটে হেঁটে আসলো, তার সামনে দাঁড়ালো, সবটাই কেমন একটা ঘোর লাগার মতো লাগলো তার কাছে। উষির ভ্রু বাঁকিয়ে দাম্ভিকতার সুরে রাশাকে প্রশ্ন করলো,
–তুমি এখানে কি করছো?
চমকে উঠলো সে। ঘোর কাঁটতেই আমতা-আমতা করলো। বললো,
–ক-কফি খেতে এসেছিলাম।
উষির রাশার মুখে একবার চোখ বুলালো। জহুরি নজরে কিছু পর্যবেক্ষণ করলো বোধহয়৷ তারপর নজর ঘুরিয়ে সুবোধ বাবুর দিকে তাকালো। মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–সুবোধ আংকেল! আপনি এখানে?
সুবোধ বাবু হ্যান্ডশেক করলো। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য খানিক ভেবে উত্তর দিলো,
–হ্যাঁ, ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিলো। তোমাকে লাঠিসোঁটা হাতে দেখে এগিয়ে আসলাম। জানোই তো এসব আমি কত পছন্দ করি।
বলেই তিনি বোকার মতো হাসলেন। উকিলদের সবসময় সব প্রশ্নের উত্তর তৈরি থাকতে হয়। হয় সত্যি কিংবা মিথ্যা। তবে উত্তর তাকে করতেই হয়। উষির কিছু না বলে অল্প হাসলো। রাশার হাতের মধ্যে হাত রেখে টেনে নিজের পাশে দাঁড় করালো। তারপর হাতের বাঁধন শক্ত করে বললো,
–আংকেল, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আমার ওয়াইফ, দিলওয়ারা জামান চৌধুরী। আর রাশা, ইনি আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড প্লাস ফ্যামিলি ল’ইয়ার, সুবোধ দত্ত।
রাশা অপ্রস্তুত হাসলো। সুবোধ বাবু অমায়িক হেসে প্রশ্ন করলেন,
–হ্যালো গার্ল! হাউ অ্যাবাউট ইউ?
–ফাইন আংকেল। থ্যাঙ্কিউ!
–সো, ডু ইউ ওয়ার্ক? আমার আবার সবার কাজকর্ম জানতে বড়ই ইচ্ছে হয়।
রাশার মুখটা থমথমে হয়ে গেলো৷ রাশা বেশ জানতো, স্যার এমন কিছু অবশ্য অবশ্যই করবে। সেও ছাড় দিলো না। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললো,
–হাউজ হেল্পারের কাজ করি আংকেল। বিশ হাজার টাকা বেতনের। খুব ইজি কাজ৷ দশ মিনিটে ম্যাজিকের মতো কাজ শেষ হয়। আপনার বাড়িতে দরকার হলে বলবেন।
সুবোধ বাবু হকচকিয়ে গেলেন। উষির অপ্রস্তুত হয়ে রাশার হাতে খানিক চাপ দিলো। চোখের ইশারায় বললো, এসব কি উল্টাপাল্টা বলছো!
উষির পরিস্থিতি সামাল দিয়ে হেসে বললো,
–মজা করছে আংকেল। ও আবার মজা করতে খুব পছন্দ করে। বাদ দিন ওর কথা। আপনার ইনভিটেশন রইলো। বাড়িতে অবশ্যই আসবেন।
সুবোধ বাবুও হকচকানো ভাব সামাল দিয়ে উচ্চস্বরে হাসলেন। বললেন,
–সিওর সিওর। তোমাকেও খুব শীগ্রই আমার বাড়িতে ডিনারের ইনভাইট করবো। শুধু তোমার আন্টি বাড়ি ফিরুক। হলিডে-তে আবার ঘুরতে গেছে তার সিঙ্গেল ফ্রেন্ডদের সাথে।
–আপনারও যাওয়া উচিৎ ছিলো আংকেল। সিঙ্গেল বয় সোসাইটি থেকে খুব ভালো টুর প্ল্যান করেছে। আমিও যেতাম বাট আমাকে ওই ক্লাব থেকে বাতিল ঘোষণা করে দিয়েছে।
ভীষণ মজার কোন কথা শুনেছেন, এমন ভাবে সুবোধ বাবু আবারও উচ্চশব্দে হাসলেন। তারপর কি মনে করে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়েই তাড়াহুড়ো করে বললেন,
–আমার একটা কাজ আছে৷ আজকে আসছি৷ বায় বায় হ্যাপি কাপল।
উষির মুচকি হেসে মাথা হেলিয়ে সায় জানালো,
–বায় আংকেল।
সুবোধ বাবু চলে যেতেই রাশার হাতে টান পরলো। উষিরের হাসিখুশি মুখশ্রীতে আবার গাম্ভীর্য চলে এসেছে। সামনের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে থমথমে গলায় বললো,
–ভেতরে চলো।
রাশা নিজের ইচ্ছায় গেলো না। উষির একপ্রকার জোর করেই ভেতরের একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। সামনের চেয়ারে রাশা বসে আছে। একফাঁকে ফোন বের করে স্যারকে মেসেজ পাঠাতেও ভুললো না,
“আপনার নামটাই শুধু সুবোধ স্যার। আপনি কাজে মোটেও সুবোধ না। কাল যে দুই প্লেট বিরিয়ানি আর চিকেন কাবাব খেলেন, সাথে এক প্লেট গোলাপজাম। সবটা ভিডিও করে রেখেছি৷ ম্যামকে পাঠিয়ে দেবো। উইথ বিল। আপনিই তো বলেন স্যার, উকিলদের কিচ্ছু ভুলতে হয় না।”
ফিরতি মেসেজও প্রায় সাথে সাথেই আসলো,
“তোমার সকল ডকুমেন্টের কপি, আইডিকার্ড, কেস ফাইল, সবকিছু কুরিয়ার করে তোমার শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেবো।”
কি সাংঘাতিক, কি মারাত্মক! রাশার বিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে উষির প্রশ্ন ছুড়লো,
–তুমি আংকেলকে চেনো?
রাশা হকচকানো ভাব দমিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
–কেনো?
–একসাথে বসে কফি খাচ্ছিলে দেখলাম।
রাশা খানিক ভাবলো৷ তারপর হাসার চেষ্টা করে বললো,
–উনি একা বসে কফি খাচ্ছিলেন। আমিও একা বসে কফি খাচ্ছিলাম। আমাকে দেখে বললো তুমিও একা, আমিও একা। চলো একসাথে কফি খাই।
উষির অদ্ভুত দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকালো। রাশা কথা ঘুরানোর চেষ্টায় বললো,
–তুমি কিভাবে জানলে?
–বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যায়। সেটা খেয়াল রেখে বসা উচিৎ ছিলো।
রাশা চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে কফিশপের বাইরের দিকে তাকালো। আয়নার মতো সাদা ঝকঝকে গ্লাস দিয়ে দেয়াল বানানো। কাপলদের জন্য একদম উপযুক্ত নয় জায়গাটা। বিড়বিড় করলো সে,
–এইজন্যই কফিশপটা এতো ফাঁকা।
পরক্ষণেই আরেকটা প্রশ্ন করলো,
–তুমি এখানে কি করছো? মানে কেনো এসেছো?
–দুই দলের মারামারি লেগেছিলো। সেটা থামাতেই এসেছিলাম। গাড়ি এই কফিশপের পার্কিং এড়িয়াতেই রেখে গিয়েছিলাম।
রাশা ব্যাঙ্গ করে বললো,
–লাঠি হাতে মারামারি থামাতে এসেছো?
–তোমাকে মারতে লাঠি এনেছিলাম।
রাশা চমকে উঠলো। উষির নির্বিকার, নিস্প্রভ। রাশা নিজের চমকানো ভাব সরিয়ে কৌতুহলী গলায় বললো,
–আমাকে মারতে কেনো?
–কারো সাথে বসে কফি খাচ্ছিলে কেনো? সুবোধ আংকেলের জায়গায় অন্য কেউ হলে লাঠিটা আর ফেরত পাঠাতাম না।
রাশা বিস্ফোরিত নয়নে উষিরের দিকে তাকালো। উষির চেয়ারে সোজা হয়ে বসে তার দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাত ভাজ করে বুকের কাছে বাঁধা। রাশা উদ্ধিগ্ন স্বরে বললো,
–লুক অ্যাট ইউ উষির, এটা কি তোমার বাচ্চামো করার বয়স? বি ম্যাচিউর।
উষির স্থির গলায় বললো,
–তো কি এটা আমার মিথ্যা বলার বয়স?
রাশা হকচকিয়ে গেলো,
–মিথ্যা?
–একসাথে এক ঘন্টা বসে গল্পগুজব করার পর আমার সামনে অচেনার ভাণ করাটা মিথ্যা না?
রাশা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। উত্তর দিতে পারলো না। ওয়েটার আসলো অর্ডার নিতে। উষির মেন্যুকার্ড ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখলো না। রাশার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে টানটান গলায় বললো,
–এখানে যত রকমের কফি আছে সবগুলোই একটা করে আনুন।
রাশার মুখ হয়ে গেলো,
–এতো কফি কে খাবে?
–তুমি।
রাশা উত্তেজিত হলো,
–আমি? পাগল হয়েছো নাকি?
উষির উত্তর দিলো না। পালটা প্রশ্ন করলো,
–আংকেলের সাথে এতোক্ষণ কি কথা বললে?
রাশা দমে গেলো। থমথমে গলায় বললো,
–ইট’স গেটিং পারসোনাল।
উষির কিছুই বললো না। মুখ দেখে তার চিন্তাভাবনা বোঝার উপায় নেই। রাশা হাল ছেড়ে দিয়ে ফ্যাকাসে গলায় বললো,
–শুধু শুধু খাবার নষ্ট করো না প্লিজ। আমি কফি খেয়েছি। আর খেতে পারবো না।
উষির এবারেও কোন উত্তর দিলো না। রাশা হাঁপ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–এখন যদি আমি সেট মেনু খেতাম তাহলে কি সব ধরনের সেট মেনু অর্ডার করতে?
উষির সোজা হয়ে হাত টেবিলের উপর রাখলো। একটু ঝুঁকে বললো,
–সেট মেনু খেতে ইচ্ছে করছে? ওয়েট!
রাশা না না করতে করতেই উষির ওয়েটারকে ডাক দিলো। ওয়েটার আসলো বড় ট্রে ভর্তি সাত আট মগ কফি নিয়ে। রাশা হা হয়ে গেলো। উষির সেদিকে ফিরেও তাকালো না। ওয়েটারকে বললো,
–আপনাদের এখানে সেট মেনু আছে?
ওয়েটার বিনীতভাবে উত্তর দিলো,
–সরি স্যার। আমাদের এখানে কোন সেট মেনু নেই। এখানে আপনি যাবতীয় সফট ড্রিংকস, চা, কফি পাবেন। আর কিছু চাই স্যার?
রাশা উত্তর দিলো৷ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–হ্যাঁ চাই। আরো দশ বারো রকমের কফি এখানে মিসিং। দ্রুত সেগুলোও অ্যাড করুন।
–সিওর ম্যাম। এনিথিং ইলস?
উষির চাপা হাসলো। ওয়েটার চলে যেতে রাশা বড় বড় শ্বাস ফেলে বললো,
–কফিশপে সেট মেন্যু কে খোঁজে?
–তুমিই তো বললে, আমি পাগল। পাগলরা সব পারে। বইয়ের দোকানে গিয়ে জামাকাপড়ও খুঁজতে পারে।
রাশা কপাল চাপড়ালো। বিড়বিড় করে বললো,
–আনবিলিভেবল!
রাশা বাড়ি ফিরলো, সাথে করে নিয়ে আসলো মাথা ভর্তি চিন্তা। চিন্তার শুরুটা উষিরকে দিয়েই শুরু আবার শেষটাও তাকে দিয়েই শেষ। উষির কি সন্দেহ করলো, তার কথা বিশ্বাস করেছে নাকি, তার পেছনে এখন ইনভেস্টিগ করবে নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। চিন্তা চিন্তাই ঘুমাতেও পারলো না ভালো করে। কিছুক্ষণ পর পর ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। উষির না পেরে কপালে হাত দিয়ে শান্ত করলো তাকে। কিছুটা শান্ত হলো আবার কিছুটা অশান্তি লেগেই থাকলো। সারারাত উষিরের ঘুম হলো না। শিউরে বসে রইলো। রাশার ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখশ্রী থেকে চোখ সরাতে পারলো না। ড্রিম লাইটের হালকা সবুজ আলোতে রাশার হালকা লালচে মুখের চিন্তিত ভাবটা তার নজরে পরলো।
–এই পিচ্চি মেয়েটার এতো কিসের চিন্তা!
পরক্ষণেই কথাব পালটে ফেললো,
–পিচ্চি তো না। উড়নচণ্ডী মেয়ে একটা! এক মূহুর্ত শান্ত থাকে না। তার আবার এতো কিসের চিন্তা থাকতে পারে?
চলবে…