তুমি রবে ৬০
.
.
আশফি আর কোনো কথা বাড়াল না। চুপচাপ রুমে ফিরে গেল। কাউচে গিয়ে বসে নীরব সময় কাটানোর মাঝে সে যেন কখন ঘুমিয়ে যায়। আর তার ঘুমের মাঝেই তাকে রুমে নিয়ে আসে আশফি।
মাহির একদমই উঠতে ইচ্ছা করল না। কপালের ওপর হাত ফেলে চোখদুটো বন্ধ করে রইল সে। বাড়ি থেকে আর কোনো ফোন আসেনি তার কাছে। নিজে ফোন করবে বলে উঠে বসতেই রুমে আশফি এলো। মাহিকে জেগে উঠতে দেখে তার কাছে এগিয়ে এসে তার মুখের দিকে বেশ কিছু সময় এক নজরে তাকিয়ে থেকে বলল,
– “ফোলা চোখের জন্য তো তোমার চেহারায় বদলে গেছে।”
– “খারাপ লাগছে না কি দেখতে?”
– “বুঝতে পারছি না। আচ্ছা পরে বুঝব। শায়খ এসেছে, দেখা করতে আসবে তোমার সঙ্গে। উঠে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাও।”
শায়খের আসার সংবাদ শুনে মাহি একটু বিস্মিত নজরে তাকাল আশফির দিকে। আশফি আর কিছু বলল না। রুমের বাইরে চলে গেল। মাহি দ্রুত হয়ে ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পাল্টে নিলো। বেশ ভালোভাবেই পরিপাটিই হলো সে। কারণ আশফি অগোছালো কোনো কিছুই পছন্দ করে না। আর মাহির নিজেরও কখনোই এলোমেলো থাকতে ভালো লাগে না, সে যতই সময় খারাপ যাক তার।
শায়খ দরজাতে কড়া নাড়তেই মাহি বুঝতে পারল তার আগমন।
– “ভেতরে এসো ভাইয়া।”
শায়খ রুমে ঢুকতেই মাহি প্রশস্ত এক হাসি হাসলো। শায়খও তার সঙ্গে হাসি বিনিময় করল।
– “দেখে তো মনে হচ্ছে না সুস্থ আছেন।”
– “না না। খারাপও নেই। বসো, নাস্তা করেছো তো?”
– “হ্যাঁ, আপনার জন্য অপেক্ষা করতে চাইলাম। ভাইয়া বলল কাল রাতে ঘুমিয়েছেন অনেক দেরিতে। তাই আর ডাকেনি।”
মাহির মুখোমুখিই বসলো সে। প্রচন্ড জড়তা কাজ করছে তার মাহির সঙ্গে কথা বলতে। পরোক্ষভাবে মাহিকে সে অনেকরকম কথায় শুনিয়েছে। এরপর আর ফোন করে স্যরিও বলা হয়নি তাকে।
মাহি বোধহয় বুঝতে পারল শায়খের অবস্থা। সে নিজেও কোনো ভনিতা ছাড়া জিজ্ঞেস করল শায়খকে,
– “শাওন কেমন আছে এখন?”
– “ভালোই আছে। ওর সব বন্ধুরা এসে অনেক সময় দেয় ওকে। ঘুরতেও নিয়ে যায় ওকে ওদের সঙ্গে। অনেক দ্রুত রিকভার করে উঠতে পারবে ইন শা আল্লাহ।”
– “আর ওই ছেলেটার পরিবার কি আর এসেছিল বাড়িতে?”
– “ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এসেছিল আরও দু’বার।”
শায়খ মাহির পরনের শাড়িটার দিকে লক্ষ্য করল। সেদিন রাতে এই শাড়ি কেনার উদ্দেশেই তার বোন বেরিয়েছিল মাহির সঙ্গে। মাহির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে শায়খ আর দেরি করল না। বিদায় জানিয়ে চলে এলো। শায়খের চোখের ভাষা বুঝতে কষ্ট হয়নি মাহির। শায়খ চলে যাওয়ার ঠিক পরদিনই আবরার সাহেব নিজে আসে নাতবউকে নিতে। সঙ্গে আসে আশফির চাচা শিহাবও। আশফি আর না করতে পারে না। তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে মাহিকে পাঠিয়ে দিয়ে সে রাতে আসে। ও বাড়িতে ফিরে আগে সে শাওনের রুমে যায়। রুমে গিয়ে দেখে মাহি শাওনের ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে বসে কাঁদছে। আশফি ভাবতে থাকে, মাহি যদি সেদিন একটিবারও বুঝতে পারতো!
মাহতীমের কাছ থেকে মাহিকে নিয়ে আসার ঠিক পরদিন বিকালেই আশফি আবার মাহিকে রেখে আসে মাহতীমের বাসায়। প্রায় পনেরো দিন মাহি সেখানেই থাকে ভাইয়ের সঙ্গে। আর এর মাঝে আশফি, দিশান, শায়খ, দিয়া, হিমু সবাই-ই সময় কাটিয়ে যেতো মাহি আর মাহতীমের সঙ্গে। ঐন্দ্রীর সঙ্গে মেহরিনের মাধ্যমে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয় মাহতীমের। কিন্তু যেদিন সে জানতে পারে মাহতীমের সঙ্গে মাহি আর আশফির সম্পর্ক, সেদিন থেকে ঐন্দ্রী আর মেহরিনের কাছেও আসেনি। মাহতীম ডাকলেও ঐন্দ্রী তাকে এড়িয়ে চলতো। একদিন শায়খ, দিশান আর আশফির সঙ্গে শাওনও আসে মাহির সাথে দেখা করতে। প্রায় দু’দিন শাওন থেকে যায় মাহির কাছে। ওই দু’দিনে মাহি লক্ষ্য করে শাওনের নতুন কিছু আচরণ, যা সে বাড়িতে থাকা অবস্থাতে কখনো পায়নি তার মাঝে। শাওনের সঙ্গে মাহির খুব ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে মাহি তার কাছে জিজ্ঞেস করে এ ব্যাপারে। শাওন জানায় তাকে,
– “একটা ছেলের সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ হয়েছে আমার ভাবি।”
মাহি তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই শাওন বলে,
– “ল’তে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে ও। এখন লাস্ট সেমিস্টারে। মাস্টার্স কমপ্লিট করে লন্ডন চলে যাবে।”
মাহিকে দেখায় তার ফেসবুক প্রফাইল। মাহি সব কিছু দেখার পর জিজ্ঞেস করে,
– “তোমরা কি সাধারণভাবে আলাপ-সালাপ করো না কি বিশেষ কিছু আছে শাওন?”
শাওন প্রথম অবস্থাতে কথা ঘোরাতে চাইলেও পরবর্তীতে স্বীকার করে ছেলেটার প্রতি সে ভীষণভাবে আকৃষ্ট আর ছেলেটাও শাওনের প্রতি। কিন্তু তারা কেউই কাউকে সেভাবে কিছু বলেনি। সব কিছু শুনে মাহি শাওনকে কিছুই বলল না। মাহির মনে হলো, এসব ব্যাপারে এখন যদি সে শাওনকে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তবে শাওন এরপর আর কিছুই শেয়ার করবে না তার সাথে। ওর সঙ্গে তাকে বন্ধুর মতো থেকেই ধীরে ধীরে বোঝাতে হবে। যার জন্য শাওনের ব্যাপারটা আপাতত সে চেপে রাখল। শাওন চলে যাওয়ার পরই আশফি মাহিকে নিতে আসতে চাইল। কিন্তু মাহতীমের মন খারাপ দেখে আশফি আর জোর করল না। এদিকে মাহতীম এক মাসের মাথাতেই অ্যামেরিকা ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে। কারণ তার প্রাক্তন স্ত্রী হঠাৎ করেই কোর্টে আপিল করেছে মেহরিনকে তার কাছে নিয়ে নেওয়ার জন্য।
মাহতীমের দ্রুত চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য আশফি আর দিশান পরিকল্পনা করল তারা সবাই দূরে কোথাও এক সপ্তাহের ট্যুরে যাবে। আর এক দিক থেকে এটা হবে মাহতীম আর মাহি দুজনের জন্যই একটি চমক। ট্যুরে যাওয়ার ঠিক আগের দিন রাতে যখন আশফি এসে মাহিকে বলে,
– “কিছু কেনাকাটার থাকলে আজ রাতেই করে ফেলো।”
– “কীসের কেনাকাটা? আমার তো কিছু লাগবে না।”
– “কাল সকালে উঠে আমার এটা নেই আমার ওটা নেই এমন ঘ্যানঘ্যান করল তো কাজ হবে না। শাওনও কিছু কেনাকাটা করবে। ওকে নিয়ে গাড়ি সাথে করে শপিং করে এসো।”
– “মানে কোথাও কি যাচ্ছি আমরা?”
আশফি আর মাহি তখন মাহতীমের রুমের ব্যালকনিতে। আশফি বেতের সোফাতে বসেছিল। মাহি প্রশ্নটা করতেই আশফি কিছুক্ষণ নীরবে তার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ ঝট করে মাহিকে টেনে তার কোলের ওপর বসিয়ে নেয়। মাহির কোমর এক হাতে জড়িয়ে রেখে আর অন্য হাতে মাহির লম্বা চুলগুলো আঙুলে পেচিয়ে খেলতে খেলতে তাকে জানায়,
– “এক সপ্তাহের জন্য আমরা ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। সঙ্গে যাচ্ছে মেহরিন আর মাহতীমও।”
এমন একটি সংবাদ শুনে মাহি প্রচন্ড খুশি হলেও খুশিটা সেভাবে প্রকাশ করল না আশফির কাছে। হাসি চেপে রেখে মুখটা গম্ভীর করে বলল,
– “দারুণ কথা।”
আশফি কপালের মাঝে ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
– “শুধুই দারুণ?”
– “শুধুই দারুণ।”
আশফি কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ মাহির দিকে। তারপরই আচমকা চুমু খেয়ে বসলো মাহির ঠোঁটে। মৃদু হেসে আশফি তাকে বলল,
– “এটাও দারুণ না?”
মাহি চোখ মুখ কুচকে জবাব দিলো,
– “খুবই জঘন্য।”
.
সেদিন রাতেই মাহি শাওনকে নিয়ে বেরিয়ে যায় শপিংয়ের উদ্দেশে। প্রথমে মাহি শাওনের কেনাকাটা শেষ করে। মাহির শপিং শুরু হলে শাওন মাহিকে বলে,
– “ভাবি, এখানেই না আমার কিছু ফ্রেন্ড এসেছে। ওরা থার্ড ফ্লোরে আছে মলের। তুমি যদি কিছু মনে না করো আমি একটু দেখা করে আসি ওদের সঙ্গে?”
– “ওদেরকে বলো এখানে আসুক।”
– “ওরা আমার একার জন্য কষ্ট করে ওপরে আসবে। তার থেকে আমিই যাই।”
মাহি একটু চিন্তার মাঝে পড়ে ব্যাপারটা নিয়ে। প্রথম কারণ মাহির মনে হলো শাওন সেই ছেলে বন্ধুটিকে এখানে কোথাও আসতে বলেছে। হয়তো তার সঙ্গেই দেখা করবে। আর দ্বিতীয় কারণ, শাওনকে কখনোই ওর পরিবার একা কোথাও ছাড়ে না।
মাহির দ্বিধাগ্রস্ত মুখভঙ্গি দেখে শাওন নাছোড়বান্দার মতো করে অনুরোধ করতে শুরু করে তাকে। শেষমেশ মাহি তাকে পারমিশন দেয়, তবে খুব দ্রুত ফিরে আসতে বলে। শাওন যেতেই মাহির কাছে আশফির ফোন আসে। কথা বলার মাঝে আশফি তাকে জিজ্ঞেস করে,
– “আমাকে কি আসতে হবে?”
মাহি বলে,
– “আমি কি বলেছি আসতে?”
– “তুমি তো কিছুই বলো না। কিন্তু কিছু দিতে এলে আবার ছেড়েও দাও না।”
মাহি আশফির কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কপট রাগের সুরে বলে,
– “কী ছেড়ে দেয় না আমি?”
আশফি হেসে উঠে৷ প্রায় পনেরো মিনিট তাদের কথা চলে। এরপর আশফি ভিডিও কলে আসে মাহির শাড়ি পছন্দ করার জন্য। আর শাড়ি পছন্দ করতে গিয়েই তারা সময়ের দিক ভুলে প্রায় আধা ঘন্টা ব্যয় করে শাড়ি পছন্দ করতে। এই এতখানি সময়ের মাঝে আশফি শাওনের কোনো আওয়াজ না পেয়ে মাহিকে জিজ্ঞেস করে,
– “শাওনটা কোথায়? ওকে যে পাচ্ছি না? এত শান্ত হলো কবে থেকে?”
শাওনের প্রশ্ন উঠতেই মাহি চমকে উঠে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে যায় শাওন নিচের ফ্লোরের গেছে। অথচ তার ফিরে আসার কথা ছিল দশ মিনিটের মাঝে। মাহি জানায় আশফিকে শাওনের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার কথা। আশফির ফোনটা কেটে মাহি কল করে শাওনকে। রিং বাজে কিছুক্ষণ। কিন্তু রিসিভ হয় না। তার পরিবর্তে কেটে দেওয়া হয় কল। মাহি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে আবার কল করে। কিন্তু তখন ফোন অফ। মাহি দ্রুত থার্ড ফ্লোরে আসে। এতগুলো দোকানের মাঝে তাকে খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টদায়ক। মাহি আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করে। এই দশ মিনিটে প্রায় ত্রিশবার কল করে সে শাওনকে। কেন যেন তার খুব বাজে বাজে চিন্তা আসতে থাকে শাওনকে নিয়ে। উপায় না পেয়ে সে আশফিকে ফোন করে জানায়। মলে পৌঁছাতে আশফির প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লেগে যায়। এই চল্লিশ মিনিটে মাহি থার্ড ফ্লোরে যতগুলো দোকান আছে সব জায়গাতে উঁকি দেয়। আশফি আসার পথে শায়খ, দিশান দুজনকেই জানিয়ে আসে। শাওন কখনোই একা একা বা রাত করে বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরে বেড়ানোর মেয়ে নয়। তাই চিন্তাটা হুট করেই বেড়ে যায় তাদের।
আশফি মলে পৌঁছে দেখে মাহি ফ্লোরের মাঝে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আশফি দ্রুত তার কাছে আসতেই মাহি তাকে দেখে ছুটে আশফির বাহু জড়িয়ে ধরে বলে,
– “ভুলটা আমিই করেছি আশফি। ওর কথা আমার বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। একা ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি আমার।”
আশফি মাহিকে নিয়ে একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে গিয়ে বসে। ঠান্ডা পানি খাইয়ে মাহিকে সে জিজ্ঞেস করে,
– “ও মূলত কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে?”
– “আমাকে বলেছে ওর ফ্রেন্ডস। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ও যে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে, তাকে আসতে বলেছে ও এখানে।”
– “কোন ছেলে?”
মাহি এরপর সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলে। এর মধ্যে টেনশনে শায়খ থানা থেকে দ্রুত ছুটে আসে মলে। আশফি তাকে সবটা জানায়। শায়খ তার ডিপার্টমেন্ট থেকে কিছু কনস্টেবলকে আসতে বলে। আর থার্ড ফ্লোরের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করার নির্দেশ জানায় শায়খ। অনেকক্ষণ চেক করার পর তারা দেখে সেই ছেলেটার সঙ্গে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে শাওন কথা বলছে। এরপরই তারা বেরিয়ে যায় মল থেকে। শায়খ মলের বাইরের সিসিটিভি ফুটেজও চেক করে। সেখানে দেখে শাওন মুখটা বিমর্ষ করে কথা বলছে তার সঙ্গে। বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দুজনে কথা বলে। ফুটেজ দেখে যা বোঝা যায়, শাওনকে কোনো কিছুতে রাজি করানোর চেষ্টা করছে সে। শেষ পর্যন্ত শাওন রাজিও হয়ে যায় তার কথাতে। ছেলেটার সঙ্গে বাইকে উঠে যায় সে। পুরো ঘটনা দেখে আশফি, শায়খ দুজনেই ভীষণ চিন্তার মাঝে পড়ে যায়। মাহিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে শাওনকে খুঁজতে। পুলিশ ফোর্স, ব্যক্তিগত কিছু মাধ্যম সবকিছু কাজে লাগিয়ে শাওনের অবস্থান পায় পুরোন ঢাকার মধ্যে একটি মফস্বলের কাঁচা-পাকা দোতলা বাড়িতে। ছেলেটির সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ার পর জানতে পারে সে সোমের বন্ধুর ছোটভাই। এরপর আর তাদের বুঝতে বাদ থাকে না সোম এর সঙ্গে জড়িত। শাওনের সঙ্গে কী হতে পারে তা নিয়ে তারা তিনভাই-ই আতংকে শিউরে উঠে।
শাওনকে যেখানে রাখা হয় সেখানে সোম এসে পৌঁছায় রাত বারোটাতে। সোমের সঙ্গে থাকে আরও কয়েকজন তার বয়সী ছেলে। যারা রাজনীতিবিদ শিশিরের ছেলেপুলে বলে পরিচিত। শিশির এখন দেশে না থাকলেও তার ব্যবসায় চলে এ দেশে সোমের মাধ্যমে। খুব দ্রুতই মোটামুটি বেশ টাকার মালিকও বনে গেছে সোম। পাড়া মহল্লার মাস্তান টাইপ সব ছেলেই তার ইশারাতে চলা ফেরা করে।
শাওনকে যে ঘরে রাখা হয়েছে চেতনাহীন অবস্থাতে, সে ঘরে গিয়ে সোম একবার দেখে আসে তাকে। তারপর বেরিয়ে এসে দুজন লোককে বলে,
– “কামাল তুই রুমের ভেতরের বন্দোবস্ত কর দ্রুত। আর রফিক নিচে দুজনকে পাঠা টহল দিতে।”
এ কথা বলেই সে অন্য রুমে চলে যায়। কামাল নামের ছেলেটি রুমের মধ্যে ক্যামেরা রেডি করে সোমকে খবর পাঠায়। আর সোম পাঠায় সেই ছেলেটিকে যে তার বন্ধু ইমরানের ভাই। দুজনের নোংরা ভিডিও তৈরি করা তার উদ্দেশ্য। ছেলেটিকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সে চলে যায় বাসার ছাদে। ছাদে গিয়ে ফোনে কথা বলার মাঝে সে দূর থেকে লক্ষ্য করে তিনটা গাড়ি পরপর সিরিয়ালে ঢুকছে এই মহল্লাতে। দৃষ্টি সেদিকে রেখে সোম লক্ষ্য করতে থাকে গাড়ি তিনটাকে। তার বাসার গলিতে ঢোকার পূর্বেই সে টের পেয়ে যায় পুলিশ খোঁজ পেয়ে গেছে। সোম দ্রুত নিচে গিয়ে তার সব জিনিসপত্র নিয়ে আবার ছাদে চলে আসে। আর বাকিদেরও দ্রুত পালাতে বলে সে। ছাদে আসতেই পুলিশের গাড়ি ঢুকে পড়ে গলিতে। সে ছাদের পিছে লম্বা পাইপ ধরে নিচে নামতে গিয়ে পড়ে যায়। আর ভাঙা পায়ে সে আবারও আঘাত পায়। তবুও সে বহুকষ্টে পালিয়ে আসে সেখান থেকে। ওরা তিনভাই দ্রুত উঠে আসে দোতলায়। কিন্তু সেখানকার ছেলেগুলোর একজনকেও তখন ধরতে পারেনি তারা। আশফি আর দিশান সব রুমে খুঁজতে খুঁজতে শাওনের রুমে ঢুকে দেখে তাদের বোনটা অর্ধনগ্ন অবস্থাতে পড়ে আছে। গালদু্টোতে মারের চোটে দাগ পড়ে গেছে পাঁচ আঙুলের। পায়ের গিড়াতেও নীলচে হয়ে আছে। বোঝা যায় তাকে প্রচন্ডভাবে মারধোর করে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে।
শাওনকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেও শাওনের এই অবস্থার জন্য সব দায় পড়ে মাহির। আর এই দোষ তাকে দেয় শাওনের বাবা-মা। শায়খও তার ওপর রেগে উঠে বলে,
– “আপনার কি উচিত ছিল না শাওনের ওই ব্যাপারটা ভাইয়া অথবা মা’কে জানানো? আপনি কী হিসাব করে কথাগুলো চেপে রেখেছিলের নিজের মাঝে? আর ওকেও কেন কিছু বোঝাননি?”
এমন বহুরকম কথার সম্মুখীন হয় মাহি। আশফি তাদের এমন আচরণ দেখে আর মাহিকে বিরতিহীন কাঁদতে দেখে প্রচন্ডভাবে রেগে যায় সবার উপর। এই রাগ তারা কেউ নিতে না পেরে বেশ বড়-সড় ঝামেলা তৈরি করে ফেলে আশফির সঙ্গে শায়খ তারা। শায়খের মা জেবা মাহিকে দোষারোপ করে এ কথা বলে,
– “আজ কাল তোমাদের মতো ভাবিদের সহায়তার জন্যই এইটুকু মেয়েরা আরও বেশি সাহস পেয়ে যায়। তুমি তো ওকে নিষেধ করোইনি উল্টে ওর সুরে সুর মিলিয়েছো নিশ্চয়! প্রেম করতে যেন ভয় না পায় তাই আরও সঙ্গ দিয়েছো ওকে এসব বিষয়ে।”
আশফি চেঁচিয়ে উঠে চাচির ওপর। তাকে বলে,
– “রাগের মাথায় আপনি ওকে কী বলছেন চাচি তা কি ভেবেছেন? ও এই ধরনের মেয়ে বলে আপনার মনে হয়?”
তখন চাচা শিহাব বলে উঠে,
– “ও কোন হিসেবে আমার মেয়েকে একা ছাড়ল? ও দেখে না কীভাবে বড় করছি আমরা আমাদের মেয়েকে? আমার মেয়ে তো অশিক্ষিক থার্ড ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে না যে যেমন খুশি তেমনভাবে, নিজের মন মর্জি মতো চলা ফেরা করে বেড়ায়! তাহলে ও কেন বলল না এসব আমাদের? আর কেনই বা ওকে একা ছাড়ল?”
এমন আরও বহু কথা বলে তারা মাহিকে। হীরা, আবরার কেউ-ই কাউকে থামাতে পারে না। দিশানও তাদের কিছু বোঝাতে পারে না। রেগে গিয়ে আশফি তাদের বলে,
– “এসব ধরনের আর একটা কথাও যদি ওকে বলো কেউ, আমিও সম্পর্ক ভুলে যা খুশি বলে বসব কিন্তু।”
এ কথার পর সবাই থেমে যায়। মাহিকে নিয়ে আশফি চলে যায় রুমে। এরপর প্রতিদিন কোনো না কোনো সময়ে জেবা কথা শুনাতে থাকে মাহিকে। মাহি কয়েকবার চুপ থাকলেও পরে সে কথা বলতে বাধ্য হয়। এভাবেই একদিন খুব খারাপভাবে তাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। আশফিও খুব রাগী সুরে চাচিকে কথা শোনায়। বাড়ির মধ্যে ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে পড়ে। আর শাওন তখনো অসুস্থ। সেদিন শায়খ রেগে গিয়ে জানায় তারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে আর নয়তো মাহি আর আশফিকে যেতে হবে। থাকবে না তাদের সঙ্গে এক বাড়িতে। আর সেদিনই চলে আসে আশফি মাহিকে নিয়ে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর মাহি খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। সবকিছু মিলিয়ে সে নিজেকে খুব অপরাধী ভাবতে থাকে। সোমের ওপর প্রচন্ড ঘৃণা আর রাগ হয় তার। সোমের নাম্বারে কলও করে বসে সে। কিন্তু তার ফোন অফ থাকে। ঠিক তার দু’দিন পরই সোম সিম ওপেন করলে মিসড কল অ্যালার্টে মাহির নতুন নাম্বার দেখে অনেক ভেবেচিন্তে সে বাইরের একটি দোকান থেকে কল করে মাহিকে। মাহি রিসিভ করতে ওপাশ থেকে সোমের কণ্ঠস্বর শুনে তার উপর চিল্লিয়ে ওঠে। সোম তাকে বলে,
– “তুই চাইলেই সব ঠিক করতে পারিস মাহি। আর তুই জানিস না, তোর ননদের ওইটুকু সময়ের ভিডিও আমার কাছে আছে। আমি তোকে সিনেমার ভিলেইনদের মতো ব্ল্যাকমেইল করব তা নয় কিন্তু। এসব ভিডিও আমি এমনিতেই ডিলিট করে দেবো। একটা রাগ কাজ করছিল তোর ওপর আমার। সেই রাগের বশে কাজটা করে ফেলেছি। কিন্তু এখন তোর সাথে কথা বলার পর আমার একটুও রাগ নেই। আর তুই পারলে নিজে এসে আমার কাছ থেকে ভিডিওটা ডিলিট করে দিয়ে যাস। একবার দেখা কর প্লিজ আমার সঙ্গে।”
এসব কথা শুনে মাহি আরও রেগে যায়। ফোন কেটে দেয় সে। তারপর আশফিকে কল করে কিন্তু আশফি তখন ব্যস্ত থাকায় ফোন ধরতে পারে না। সন্ধ্যার সময় সোম আবারও মাহিকে ফোন করে। আর সেই একই কথা বলে। নিজের ঠিকানাও দিয়ে দেয় সে মাহিকে। মাহি ঠিকানাটা শুনে ভাবে তাদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয় সোমের অবস্থান। মাহি তার সঙ্গে দেখা করবে বলে সম্মতি জানিয়ে ফোন কাটে। এরপর আশফিকে সে কল করে না পেয়ে মেসেজে জানিয়ে দেয় সবটা আর ঠিকানাও পাঠিয়ে দেয়। আশফি প্রায় এক ঘন্টা পর মেসেজ সিন করে। দ্রুত সে মাহিকে কল করে বলে,
– “আমি ছাড়া তুমি একদমই কোথাও বের হবে না। আর তোমাকে যেতে হবে না ওখানে।”
মাহি তখন বলে,
– “ওর আজ রাত আটটায় ফ্লাইট। এখন অলরেডি সাড়ে সাতটা বাজে। আমি বেরিয়ে পড়েছি। প্রায় কাছাকাছি আমি। তুমি দ্রুত চলে আসো। আর জায়গাটাও বেশি দূরে না।”
আশফি চেঁচিয়ে উঠে বলে,
– “এক্ষুনি ফিরে যাও বাসায়।”
– “তুমি কি বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা? ওকে ধরে নেওয়ার সুযোগ আর কীভাবে পাবে?”
– “ওকে ধরার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই নেই। ওই ছেলেটাও কিছু স্বীকার যায়নি।”
– “আরে ওর কাছে ভিডিও আছে। ওটার মাধ্যমেও তো প্রমাণ করা যাবে। আশফি আমি পৌঁছে গেছি, তুমি দ্রুত চলে আসো।”
আশফি ভীষণ চেঁচামেচি করে মাহির ওপর। যা মাহির একদমই অযৌক্তিক মনে হয়। আর ভীষণ রাগও হয় আশফির ওপর তার। সে রাগ করে ফোনটা কেটে দিয়ে মেসেজ করে বলে,
– “যদি আসো তাহলে মেসেজ করবে। কোনো ফোন করবে না আমাকে।”
আশফি যখন পৌঁছায় তখন সে জায়গাতে কাউকেই পায় না সে। আশফির কোনোভাবে বিশ্বাস হয় না যে সোম তার বাসার এত নিকটতম স্থানে দেখা করবে মাহির সাথে। আর সোমকে সে যতটুকু চিনেছে তাতে সে এই মুহূর্তে কখনোই মাহির সাথে দেখা করবে না। কিন্তু এত সহজ সামান্য হিসাব যে কোনোভাবেই মাহির মাথাতে এলো না, সেটা ভেবেই আশফি রাগে কাঁপতে থাকে। মাহিকে কয়েকবার ফোন করে সে। কিন্তু মাহি রিসিভ করে না। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আশফির। তারপর মেসেজও করে সে। প্রায় দশ মিনিট ধরে সে ফোন করতে থাকে মাহিকে। রাগে আর ভয়ে সে দিশেহারা হয়ে যায়। দিশানকে ফোন করে দ্রুত সব জানায় সে। দিশান তার কিছু বন্ধু সঙ্গে নিয়ে এসে আশফির সঙ্গে তন্নতন্ন করে জায়গাটিতে খুঁজতে থাকে মাহিকে। কোনোভাবে না পেয়ে আশফি হঠাৎ সব অন্ধকার দেখতে থাকে চোখের সামনে। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগেই দিশান ভাইকে ধরে গাড়িতে গিয়ে বসায়। এরপর চোখে মুখে পানি দেয় তার। আশফিকে প্রচন্ড ঘামতে দেখে দিশান একটু নার্ভাস হয়ে পড়ে। জোর করে সে আশফিকে ধরে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। পুলিশের কাছে জিডি করলে তারাও খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে মাহিকে। মাহির ফোন ট্র্যাপ করে করে ওই জায়গাটিকেই ট্রেস করতে পারে তারা। তাতে বুঝতে পারে মাহির ফোনটা ওখানে কোথাও পড়ে আছে। আশফির শরীরের অবস্থা খু্ব খারাপ হয়ে যায়। বিপিও লো হয়ে যায় তার। আশফি কোনোভাবেই মাহিকে না খুঁজে বাসায় ফিরতেও রাজি হয় না। রাত যখন বারোটা বাজে ঠিক তখন একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে আশফির নাম্বারে। আশফির ফোন দিশানের কাছে থাকায় দিশান রিসিভ করে। ওপাশ থেকে মাহি কান্না করতে করতে বলে উঠে,
– “আশফি আমাকে নিয়ে যাও প্লিজ।”
একই কথা বারবার বলতে থাকে সে। দিশান উতলা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– “মাহি তুমি কোথায়? শান্ত হও ডিয়ার। একদম ভয় পেও না। শুধু কোথায় সেটা বলো।”
দিশানের কথা শুনতেই আশফি ছোঁ মেরে ফোনটা কেড়ে নেয় দিশানের থেকে। সেও প্রচন্ড উতলা সুরে জিজ্ঞেস করে,
– “তুমি কোথায় আছো আমাকে দ্রুত বলো। আর একদম ভয় পেও না। আমি জলদি আসব।”
মাহি কাঁদতে কাঁদতে তার বর্তমান অবস্থান জানায়। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগে যায় তাদের সেখানে পৌঁছাতে। পৌঁছে দেখে একটা চায়ের দোকানে বসে আছে মাহি। আর তার পাশে চায়ের বৃদ্ধ দোকানদার বসে আছে। আশফি গাড়ি থেকে নেমেই ছুটে যায় মাহির কাছে। মাহি তাকে দেখে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আশফিও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। কিন্তু হঠাৎ করে মাহিকে ছেড়ে দিয়ে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে আশফি তাকে গাড়িতে ওঠায়। গাড়ি ড্রাইভ করে দিশান। দিশান সবকিছু শোনে মাহির থেকে। ওখানে সে দাঁড়ানোর পাঁচ মিনিট পরই কয়েকটা বখাটে ধরনের ছেলে এগিয়ে আসে মাহির কাছে। তাদের হাবভাব দেখে মাহি যা বুঝতে পারে তা হলো ছেলেগুলোকে পরিকল্পনা করেই পাঠানো হয়েছে। তাদের মাঝ থেকে একজন এগিয়ে এসে মাহিকে বলে,
– “আপনি যদি খারাপ আচরণ না চান আমাদের থেকে তাহলে চুপচাপ চলেন আমাদের সাথে।”
এ কথা শুনে মাহি দৌঁড়ে চলে আসতে গেলে দু’জন এসে দ্রুত ধরে নেয় মাহিকে। বহু কষ্টে মাহি তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে ছুটে আসে। সেই চায়ের দোকানের পিছে মাহি অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকে।
তাদের বাসায় ফেরার পর যেটা হয় তা ছিল মাহির জন্য খুব অভাবনীয়। প্রচন্ডভাবে রাগারাগি করে আশফি মাহিকে। রাগের বশে সে মাহিকে বলে বসে,
– “প্রত্যেকটা মানুষকে তুমি অশান্তির মাঝে রাখো। তোমার ভুলের মাশুল সবাইকে গুণতে হয়। কী পেয়েছো তুমি, হ্যাঁ? তোমার এসব অনাচার আমি সব সময় সহ্য করব? এক ফোঁটা শান্তি পাই না কখনো তোমার জন্য। মানে হচ্ছে আমাকে তুমি শেষ করবে তারপর নিজে শান্তি পাবে তাই না?”
কথাগুলো বলে আশফি রুমে ঢুকে রুমের দরজা আটকিয়ে দেয়। মাহি শেষ রাত অবধি লিভিংরুমে বসে কাঁদতে থাকে। আশফির প্রথম কথাগুলোতে তার কষ্ট না লাগলেও আশফির শেষ দুটো কথা মাহি সহ্য করতে পারে না। সে মানতে পারে না আশফি তাকে এমনভাবে কথাগুলো বলতে পারে। আশফির রুমের দরজাতে কড়া নাড়লেও আশফি দরজা খুলে না। আশফির এই প্রতিটা আচরণ মাহির কাছে কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা দিতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে রাত পার করে দেয় সে। ভোর হতেই আবার যায় সে আশফির রুমের সামনে। কয়েকবার ডাকেও তাকে। আশফি তখনো দরজা খুলে না। শেষ পর্যন্ত মাহি আর একটা সেকেন্ডও দেরি করে না আশফির বাসা ছাড়তে। সেই সকালেই সে চলে আসে বাবার বাড়িতে। বেলা হলে আশফি যখন জানতে পারে মাহি চলে গেছে, আশফির ধৈর্যের সীমা অতিক্রম হয়ে যায় যেন। রাগের চোটে রুমের মধ্যে সে কিছুক্ষন ভাংচুর করে। আর তখনই মাহির বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় সে,
– “সজ্ঞানে যেন আপনার মেয়ে আমার বাসার ত্রিসীমানাতেও আর না আসে।”
এটুকু বলেই সে ফোন কেটে দেয়। ও বাড়িতে থেকে আসা একটা ফোনও আশফি আর রিসিভ করে না। এমনকি মাহির ফোনও নয়। এর মাঝে মাহতীমও যোগাযোগ করতে পারে না আশফির সঙ্গে। তবে মাহতীমের যাওয়ার আগের দিন রাতে আশফি দেখা করে তার সঙ্গে। আর মাহিকে নিয়ে তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তও তাকে জানিয়ে আসে। সেখানে মাহতীম নীরবে সমর্থন জানায় আশফির সিদ্ধান্তকে।
.
.
– “আমাদের ফ্লাইট কি তবে আগামীকালই?”
মাহি বিছানাতে বসে প্রশ্নটা করল আশফিকে। আশফি তখন গোছগাছ করতে ব্যস্ত। আশফি জবাব দিলো,
– “এই এক সপ্তাহ ধরে কী শুনলে এতদিন?”
মাহি আর কোনো কথা বলল না। আশফি বলল,
– “নিচে যাও। সবার সঙ্গে গিয়ে কথা বলো।”
মাহি চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর উঠে দাঁড়াতেই কল এলো আশফির ফোনে। মাহির বাবার নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে আশফি মাহিকে বলল,
– “তুমি রিসিভ করবে না কি আমিই করব? তাঁরা তো আমার সাথে কথা বলে না।”
– “কে ফোন করেছে?”
– “তোমার বাবা।”
মাহি বলল,
– “তুমিই ধরো।”
আশফি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মাহির বাবা বেশ উদ্বিগ্ন সুরে বলল,
– “মাহিকে নিয়ে জলদি একবার মেডিকেলে চলে এসো।”
আশফি চিন্তাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “কী হয়েছে?”
আশফির মুখভঙ্গি দেখে মাহিও ভয় পেয়ে যায়। মাহির বাবা বলল আশফিকে,
– “আব্বার শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না। কাল থেকেই খারাপ। কিন্তু আজ একদমই কথা বলতে পারছেন না। তাই দ্রুত হসপিটাল নিয়ে এসেছি।”
কথাগুলো শুনে আশফি আর দেরি করল না। মাহিকে শুধু বলল,
– “হসপিটাল যেতে হবে আমাদের।”
বাসার সবাইকেও জানাল আলহাজ সাহেবের অসুস্থতার কথা। সারাটা রাস্তা মাহি কাঁদতে কাঁদতে যায়। হসপিটাল পৌঁছাতেই মাহি শুনতে পায় ব্রেন স্ট্রোক করেছে তার দাদা। রাত প্রায় একটার পর আলহাজ খানিকটা সুস্থ হন। এ যাত্রায় তিনি আবারও বেঁচে যান। কথা বলার সময় কথাগুলো জড়িয়ে আসে তাঁর। ডাক্তার জানায় আস্তে আস্তে ঠিক হবেন তিনি। সারাটা রাত মাহি আর তার মা, চাচি বসে থাকে তাঁর পাশে। আশফিও এসে দেখা করে যায় তাঁর সঙ্গে। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে সেও। কিন্তু তারপরই কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে সে সোজা হসপিটাল থেকেও বেরিয়ে আসে। আশেপাশের এই পরিস্থিতিগুলো সে আর নিতে পারছে না। এদিকে মাহিকে ছাড়া তার পক্ষে এখন টিকে থাকাও অসম্ভব। তাই যত যা-ই হোক, তার সিদ্ধান্তে সে অটল থাকবে।
পরদিন প্রায় দুপুর অবধি মাহি থাকে তার দাদার কাছে। দুপুর পার হলেই আশফি সবাইকে জানায় তাদের ফ্লাইটের আর মাত্র পাঁচ ঘন্টা বাকি। আশফির কথা শুনে প্রত্যেকেই কেমন অদ্ভুত চাহনিতে তাকায় তার দিকে। মাহিও প্রচন্ড অবাক হয়। এই অবস্থার পরও আশফি তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়বে না! তার দাদার এমন অবস্থাতে তাঁর পাশেও থাকতে দেবে না তাকে! মাহির পরিবার রেগে কোনো কথা বলে না আশফির সঙ্গে। মাহিকে আশফি বলে,
– “আমি কথা বলে আসছি দাদার সঙ্গে। উনি এখন তো অনেকটাই সুস্থ। কিছু কথা বলব ওনার সঙ্গে।”
মাহি নিশ্চুপ থাকে একদম। আশফি দাদা আলহাজের কেবিনে আসে। প্রথমেই আশফি তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। এরপর সে ধীরে ধীরে তার আর মাহির ভবিষ্যত, তাদের পরিস্থিতি, সবাইকে চিন্তামুক্ত রাখা আর আসল কথা মাহিকে নিরাপদে রাখা এসব কারণে সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে তা বোঝায় তাঁকে। আলহাজ কিছু সময় নীরব থেকে ম্লান হেসে আশফির হাতটা ধরে বলে,
– “আমি ভালো দেখতে চায় আমার নাতনিকে। তাছাড়া আর কিছুই না।”
এরপর আশফি তাঁর থেকে বিদায় নেয় মাহিকে সঙ্গে করে। একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে সে। সন্ধ্যা ছয়টার সময়ে মাহিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। সঙ্গে আরও দুটো গাড়ি। একটাতে আশফির পরিবার আর অন্যটিতে মাহির পরিবার, মাহির কাছের বন্ধু দিয়া, হিমু।। আশফির গাড়িতে শায়খ, দিশান, আশফি আর মাহি। সারাটা পথ মাহি নিস্তব্ধ। খু্ব দরকার ছাড়া সে আশফির সঙ্গে কথা বলছে না। আর আশফিও তেমন কোনো দরকার ছাড়া কথা বলছে না মাহির সঙ্গে। এয়ারপোর্ট পৌঁছাতেই মাহির বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। এবার তার অজান্তেই চোখের নোনা পানি ঝরতে থাকে। তার কাছের মানুষের মুখগুলো সে ভেজা চোখে দেখতে থাকে। আর কবে এভাবে এত কাছ থেকে তাদের দেখতে পাবে তার তো ঠিক নেই। প্রাণ ভরে সবাইকে দেখে সে। শেষবারের মতো দাদার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে, সবার থেকে বিদায় নিয়ে তারা ভেতরে ঢুকে যায়। পিছু তাকিয়ে যতক্ষণ অবধি সবাইকে দেখা যায়, ঠিক ততক্ষণ অবধি মাহি দেখতে থাকে সবাইকে।
.
প্লেনে উঠে তাদের আসনে বসতেই আশফি মাহির দিকে খুব চিন্তাগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে। রীতিমতো শরীর কাঁপছে মাহির। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। হঠাৎ করেই মাহির শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন দেখে প্রচন্ড ঘাবড়ে যায় আশফি। আশফি তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে মৃদু আওয়াজে বলে,
– “একবার তাকাও আমার দিকে মাহি।”
মাহি কেমন নিস্তেজ চাহনিতে তার দিকে তাকালে আশফি সেই মৃদুস্বরে বলে,
– “যদি তুমি নিঃশেষ হতে চাও তো তার পূর্ব মুহূর্তে দেখবে, তোমার পূর্বেই আমি নিঃশেষ।”
এ কথাটি শোনার পর মাহি চমকে উঠে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে সে। নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য শেষ মুহূর্তে সে আশ্রয় নেয় আশফির বুকের মাঝে। তারপর ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে স্বাভাবিক গতিতে। তা দেখে আশফি চোখদুটো বন্ধ করে মাহিকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে আল্লাহ পাকের উদ্দেশে শুকরিয়া জানায়। তারপর মাহিকে ডেকে বলে,
– “মাহি? সম্ভব নয় আমাকে ফেলে তোমাকে চলে যেতে দেওয়া। মৃত্যুর শেষ দিন অবধি ঠিক এইখানেই তুমি রবে।
………………………………
(প্রথম খন্ডের সমাপ্তি)
– Israt Jahan Sobrin
ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। আর খুব দ্রুতই আসছে ফালাক এবং মেহের।
Ai ta kaomn ending holo??
please season 2 din na please hurry up ?? story ta really khub valo ?
Apu plz ending den