তুমি রবে ৬

0
2416
তুমি রবে ৬ . . সিটে বসিয়ে দেওয়ার পর মাহিকে একদম শান্ত মেজাজে দেখে হালকা অবাক হলো আশফি। ভেবেছিল হয়তো সিনক্রিয়েট করে করে পুরো পথ যেতে হবে তার সঙ্গে। কিন্তু সে এখন সিটের এক কিনারায় গুটিসুটি মেরে চুপটি হয়ে বসে আছে। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পূর্বে আশফি তাকে সিট বেল্টটা বেঁধে নিতে বলল। কিন্তু সে গাড়ির জানালার কাচের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে রইল। চোখদুটো একবার খুলছে আবার বুজছে। বুঝতে আর বাকি রইল না আশফির, হাল খুব বেশি মন্দ ছাড়া ভালো নয়। নিজ দায়িত্বে আশফি এই কাজটিও সম্পূর্ণ করে দিলো তার। সিট বেল্ট বাঁধার সময়ও মাহি টু শব্দ করেনি। হালকা ভিজে হয়েও রয়েছে তার শরীর। হয়তো এই মুহূর্তে হাতের কাছে তার তোয়ালে থাকলে মাহির মাথাটাও মুছে দিতে আপত্তি করত না সে। গায়ের স্যুটটা খুলে আলগাভাবে মাহির গায়ে জড়িয়ে দিল। এবার মাহি তার অ্যাটিটিউডে ফিরে আসলো। সে আলতোভাবে স্যুটটা গা থেকে নামিয়ে রাখল। আশফি আর জোর করল না। কারণ সেও নিজ পোশাক ছাড়া অন্য কারো পোশাক গায়ে জড়াতে পারে না। এটা তার রুচিশীলতা। কিন্তু মাহির ব্যাপারে যেটা প্রকাশ পাচ্ছে তা কি তার রুচিশীলতা নাকি তার রাগ আর ইগো সেটা এ মুহূর্তে বোঝা কষ্টকর। তার জন্যই আশফি দ্বিতীয়বার আর এগিয়ে দেয়নি স্যুটটা। গাড়ি চলাকালীন আশফির শোনার পূর্বে ভাঙা কণ্ঠে মাহি তাকে নিজের ঠিকানা জানিয়ে দিলো। পাক্কা দেড় ঘন্টা সময় লাগল তাদের পৌঁছাতে। এই দেড় ঘন্টার মধ্যে আশফি কতবার মাহিকে আড়চোখে দেখেছে তা হিসাবহীন। গলির মোড়ে আসার পর মাহি বলল, – “এখানেই নেমে যাব আমি।” আশফি বাহিরটা একবার দেখে বলল, – “কিন্তু এখানে তো কোনো বাড়ি দেখছি না।” গম্ভীর কণ্ঠে মাহির জবাব, – “কিছুটা সামনে।” চকিতে প্রশ্ন করল আশফি, – “কতটা সামনে?” মাহি কপাল কুচকে তাকালে আশফি বলল, – “বৃষ্টি নামছে এখনো। তাই বাসার গেট অবধি পৌঁছে দিতে চাচ্ছি।” তারপর গাড়ি স্টার্ট করে গলির মধ্যে ঢুকে গেল। – “আপনার বাসার সামনে এলে আমাকে বলবেন আমি থেমে যাব।” তিন মিনিট লাগল মাহির বাসার গেট অবধি পৌঁছাতে। মাহি তাকে থেমে যেতে বলল। গাড়ি থেকে নেমে একটু দ্রুত পায়ে মাহি বাসার ভেতর চলে গেল। কিছুটা বিস্ময় চোখে আশফি চেয়ে রইল মাহির গমন পথে। ধন্যবাদ সে আশা করেনি, তাই বলে বাইও কি বলা যেত না? নাকি বাই বললে আশফি বাসায় যেতে চাইত? প্রচন্ড অদ্ভুত চরিত্রের মেয়েটা। গাড়িটা ব্যাক করার পূর্বে আশফি মাহির বাড়িটা একবার তাকিয়ে দেখল। একটু পুরোনো ধরনের এই দোতলা বাড়িটা। বাড়ির সামনে গেট অবধি বেশ ভালোই ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে একটা বাইক ভিজতে দেখল আশফি। আর কিছু জায়গা জুড়ে কয়েকরকম ফুল গাছ। .
. লিফ্টের ডোর বন্ধ হওয়ার আগে হুড়মুড়িয়ে একটি মেয়ে এসে ঢুকল। হাতে তার অনেকগুলো ব্যাগ। বোধহয় শপিং করে ফিরল। দিশান তার পা থেকে মাথা অবধি একবার চোখ বুলিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এক হাত দিয়ে মেয়েটি বারবার চোখের চশমা ঠিক করছে আবার চুল ঠিক করছে। চার মিনিটের মধ্যে মিনিমাম বিশবার তার চুল আর চশমা ঠিক করতে দেখল দিশান। তবুও সে দৃষ্টি তার দিকে ঘোরাল না। তবে চাপা একটা হাসি তার ঠোঁটের কোণে। কারণ মনের মধ্যে যখন তার দুষ্টু ফন্দি চলে তখনই তার এই চাপা হাসি বেরিয়ে আসে। লিফ্ট থেকে মেয়েটা বের হতেই দিশান তার পিছে এসে বলল, – “চুল আর চশমা ঠিক করলেই বুঝি ইমপ্রেস করা যায়?” এটুকু বলেই দিশান আবার লিফ্টে ঢুকে পড়ল। দিয়া পুরো আহাম্মক বনে দাঁড়িয়ে রইল। এমনভাবে কেউ কাউকে অপমান করে তা দিয়ার জানা ছিল না। দুঃখের বিষয় সে এর শোধ নিতে পারবে না। কারণ ছেলেটা আদৌ এই ফ্লাটে থাকে কীনা আর থাকলেও কত নাম্বার ফ্লাটে থাকে সেটা তো তার আর জানা নেই। ড্রয়িংরুমে ঢুকে আশফিকে টিভি দেখতে দেখে দিশান সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কারণ তার ভাইকে সে আজ অবধি বিকাল টাইমে কখনো টিভি দেখতে দেখেনি। এ সময় হয় সে বাহিরে থাকে কিংবা বেলকনিতে বসে অফিসিয়াল কাজ করে কিংবা ঘুমিয়েও থাকে। – “ভাই! তুমি ঠিক আছ না?” বিস্ময়পূর্ণ কণ্ঠে দিশানের প্রশ্ন। আশফি তার কথার জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে বসল, – “অফিস থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?” – “ক্যাচআপ করতে। তারপর সেই খুশিতে একটু জেন্টেল পার্লার গিয়েছিলাম। আশফি তখন মৃদু হেসে উঠল। আশফি যত বেশিই উদাসীন থাকুক বা চিন্তিত থাকুক, তখন একমাত্র দিশানের কথা শুনলেই তার মুড ওকে হয়ে যায়। দিশানও ভাইয়ের সঙ্গে হেসে উঠল। বলল, – “আমি জানতাম তোমার মুড ঠিক ছিল না। তাই একটু মজা করলাম। মূলত ব্রেকআপ করে এলাম। সেই খুশিতে একটু ফ্রেন্ডদের সঙ্গে খুশিটা শেয়ার করলাম। তোমার কী খবর বলো তো?” – “নাথিং স্পেশাল। যেমন দেখছো তেমনই।” – “কিন্তু আমার মন বলছে, অনেক বেশিই স্পেশাল কিছু ঘটেছে তোমার সঙ্গে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার ভাইয়ের মুড চেঞ্জড হচ্ছে ধীরে ধীরে।” – “এত কথা না বলে রুমে যা। ফ্রেশ হয়ে নে, বাসায় যেতে হবে।” – “হঠাৎ!” – “দাদা ফোন করেছিল।” – “হ্যাঁ তাহলে তো যেতেই হবে। কিন্তু থাকব না আমি ওখানে, বলে দিলাম।” . . রাত প্রায় নয়টা বাজতে চলল সোম সেই যে বিকালে এসে বসে রয়েছে মাহির বাসায়, মাহির ঘুম না ভাঙা অবধি সে যাবে না বলে ঠিক করেছে। বিকালে সোম মাহির চাচাত ভাই লিমনের রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখেছিল মাহিকে কারো গাড়ি থেকে নামতে। দু’দিনের জন্য সোম ঢাকার বাহিরে গিয়েছিল। এর মাঝে মাহি হঠাৎ করে কারো সঙ্গে পরিচিত হয়ে পড়েছে সেটা ভাবতেই সোমের হাত নিশপিশ করে উঠল। ছোটবেলা থেকেই মাহির ছেলে ফ্রেন্ড খুব কম। মাহি নিজেই তেমন একটা ছেলে ফ্রেন্ড পছন্দ করতো না। যদিওবা দু একটা হলো কলেজে যাওয়ার পর, কিন্তু সোমের জন্য কেউ আর মাহির সঙ্গে মিশতে পারেনি। সোমের থেকে বকা খাওয়ার পর মাহিও আর কোনো ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেনি। সোম কখনোই মাহিকে অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে মিশতে দেখা সহ্য করতে পারে না। সে শুধু বসে আছে মাহির ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়। মাহির পরিবারের প্রত্যেকে খুব অনুরোধ করল তাকে রাতে খাওয়ার জন্য। কিন্তু তার একটাই কথা, মাহির ঘুম ভাঙলে ওর সাথে কথা বলে তারপর খাবে। লিমনের রুমেই বসে থাকল সে। মাহির পরিবারে আছে মাহির দাদা আলহাজ শেখ, মাহির বাবা-মা মমিন আর মুমু, মাহির, মাহির চাচা-চাচি মিলন আর শিখা, মাহির চাচাত ভাই-বোন লিমন আর মিমি আর লিমনের বউ নীলা। এদের মধ্যে মিমি বাদে প্রায় সবাই সোমকে খুব পছন্দ করে মাহির জন্য। তাদের ইচ্ছা খুব জলদিই মাহি আর সোমের হাত মিলিয়ে দেবে তারা। আর সেই অধিকারেই সোম যে কোনো সময় এ বাড়িতে যাতায়াত করতে পারে। সাড়ে নয়টার সময় মাহির ঘুম ভাঙে। সে খবর সোমের কানে পৌঁছাতেই সোম মাহির রুমের দিকে ছুটে। তখন পেছন থেকে মিমি তাকে ডেকে ওঠে। – “সোম ভাই! কোথায় যাচ্ছ?” সোম দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়, – “মাহির রুমে।” – “কিছু মনে করো না, আপুর রুমে তোমাকে এভাবে যাওয়াটা ঠিক শোভ পায় না। কারণটা কী তা নিশ্চয় বুঝতে পারছো?” সোম বিরক্তি মুখ করে তাকাল মিমির দিকে। তাকে কিছু বলতে যাবে তখন মাহির রুম থেকে মুমু বের হলো। সোমকে মাহির রুমের সামনে দেখে বলল, – “তুমি কি মাহির রুমে আসছিলে?” – “জি আন্টি। ওর অবস্থা এখন কেমন একটু দেখতে চাচ্ছিলাম।” – “আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি বসার ঘরে যাও, আমি মাহিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।” – “ও তো অসুস্থ। ওকে উঠতে হবে না, আমিই যাচ্ছি।” মুমু স্মিত হেসে বলল, – “টেনশনের কিছু নেই বাবা, ও ঠিক আছে এখন। কাল যে ওর জ্বর এসেছে তা ও আমাদের বলেইনি। যার জন্য সারাদিন কোনো মেডিসিন না নেওয়ার ফল এটা। আর তোমরা এখনো অবিবাহিত। এভাবে ওর রুমে যাওয়াটা ওর বাবা দাদু কেউই পছন্দ করবে না। আমরা জানি তুমি কতটা কেয়ারফুল ওর প্রতি। তাও বলছি আর কী!” – “কোনো সমস্যা নেই আন্টি। আসলে একটু বেশিই টেনশনে ছিলাম ওকে নিয়ে। আমি গিয়ে বসছি, ওকে পাঠিয়ে দিন।” মাহি বসার ঘরে আসার পর সোম সৌজন্যমূলক কথা ছাড়া আর তেমন কিছুই বলতে পারেনি। কিন্তু তার ভেতরটা জ্বলছিল মাহিকে কিছু বলার জন্য। বিকালের দৃশ্যটা সে কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। আবার এদিকে মাহিকে সামনে পেয়েও তেমন কোনো কথাও বলতে পারছে ন। তাই দশ মিনিটের মতো কথা বলে সে বিদায় নিয়ে চলে গেল। সোম যাওয়ার পর যেন মাহি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রুমে ফিরে আসার পর ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠল তার। ফোনটা তখন মিমির হাতে। মিমি মাহির রুমেই বসে ছিল। মেসেজটা সেই ওপেন করল। সোম লিখেছে, – “অফিস গেলে আমার বাইকে যেতে হবে আর ফিরতে হলেও আমার বাইকেই ফিরতে হবে। এ কথার নড়চড় হলে কী ঘটতে পারে তা তো বুঝতে পারছিস।” মেসেজটা মিমি জোরে জোরেই পড়ল। রাগে তার দু কান থেকে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। মাহি তখন বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে। রাগে সে দাঁত কটমট করে মাহিকে বলল, – “তুই কি ওর কেনা দাস হয়ে গেছিস? এখনই তোর ওপর ও নিজের জোর দাবি চাপিয়ে দিতে চায়, না জানি বিয়েটা হলে কী করবে! আর আমি অবাক ওর কার্যকলাপে। রাতে ছাদে এসে চুমু খেতে চায় আবার বিয়ের আগেই রুমে ঢুকতে চায়। এত বেশি অধিকার ওর কোথা থেকে আসে? আমার তো ওর আচরণ নিয়ে রীতিমতো ডাউট হয়। ও তোকে বিয়ের আগেই…” মাহি তার কথা থামিয়ে দিয়ে বলল, – “বাদ দে তো ওর কথা। ও তো এমনই। সেই ছোট থেকেই তো দেখে আসছি। আর সব থেকে বড় কথা ও এই অধিকারবোধ দেখানোর সুযোগ পেয়েছে যখন থেকে ও জেনেছে আমিই ওর বউ হবো। তো এখানে কি ওর অধিকার দেখানো সাজে না?” – “তাই বলে এত বেশি না। ও তোকে ওর জিম্মিতে রাখতে চায় সবসময়। যেখানে তোর কোনো মতামত থাকবে না। ও যা বলবে তাই। যাক গে, তোর ভাবীবরকে নিয়ে এত কিছু বলার রাইট আমারও নেই। তোর খারাপ লাগলে স্যরি।” – “হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক। আমি নিজেও ভাবি ওর এই ব্যাপারগুলো নিয়ে। এখন একটু বন্ধ কর এই প্যাচাল! আমার ভালো লাগছে না।” – “আমার তো মনে হচ্ছে তোর শরীরের সঙ্গে মনটাও খারাপ। অবশ্য শরীর খারাপ থাকলে মনও এমনিতেই খারাপ থাকে। আচ্ছা ভালো কথা, তোকে নাকি আজ তোর অফিসের বস পৌঁছে দিয়ে গেছে শুনলাম। এত উদার মনও হয় আজ কালকার অফিসের মালিকদের?” মাহি মিমির মুখের আশফির উদারতার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, – “উদারতা না অসভ্যতা তা কি তুই জানিস? ও কে জানিস?” মিমি বোবা বনে মাথা এপাশ ওপাশ নাড়াল। মাহি তখন বলল, – “ও সেই অসভ্য মানুষ যে আমাকে বাজেভাবে অপমান করেছিল, যেদিন দিয়ার বাসাতে গিয়েছিলাম। কপাল করে তার অফিসেই আমাকে কাজ করতে হচ্ছে। আর সেই দিনের কথা মনে রেখে ও আমাকে কীভাবে অপমান করেছে, আমাকে বকেছে আজ জানিস? আমি নাকি ওর সামনে বসে নিজের সাজগোজ আর ড্রেস মেইন্টেইনে ব্যস্ত থাকি। তাহলে কাজ করতে এসেছি কেন? আমি তো শুধু ওড়নাই ঠিক করছিলাম। সাজগোজ কখন ঠিক করলাম ওর সামনে? ফালতু লোক একটা!” – “তুই তো সাজগোজের ব্যাপারে একেবারেই অলস। তোকে এমন কথা কেন বলল?” মাহি পুরো গল্পটা মিমিকে শোনাল। মিমি তখন মুচকি হেসে বলল, – “তুই আমার থেকে চার বছরের সিনিয়র হলেও তোর বুদ্ধি আমার থেকে চারগুণ কম। তুই এটা বুঝতে পারলি না! তুই বারবার ওড়না ঠিক রাখতে ব্যস্ত ছিলি ওনার সামনে। আর সিম্পল, কোনো ছেলের সামনে বারবার ওড়না ঠিক করতে থাকলে তার অ্যাটেনশন সেদিকেই আসবে। তোর স্যারেরও তাই হয়েছিল। আর সে যেহেতু কাজের মাঝে ছিল তাই সে বিরক্তবোধ করছিল। তোকে সে ডিরেক্টলি ওড়নার কথা না বলে সাজগোজ আর ড্রেসকে মেনশন করেছে। তার উপর তুমি আবার তার সামনে ওড়না উড়িয়ে ফেলেছিলে। তাই সে সরাসরি ওড়নাকে মেনশন করেনি। কারণ ওড়না একটা মেয়ের লজ্জার হাত থেকে বাঁচার পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেখানে সরাসরি ওড়না মেনশন করা এটা তোর জন্যই লজ্জার ব্যাপার হতো। আর তোকে সে সরাসরি এই লজ্জাটা দিতে চায়নি বলেই কথাগুলো ঘুরিয়ে বলেছে। আর তুই এখানেও তাকে অসভ্য ভাবলি? আমি তো দেখছি তার যথেষ্ট ম্যানার আছে। এতটা ম্যানার কোনো অফিস বসের হয়? এরা তো আরও সুন্দরী স্টাফদের থেকে নিজের কামনার ফায়দা লুটতে চায়। এই কাহিনী শোনার পর আমার তার প্রতি আরও রেসপেক্ট বেড়ে গেছে আপু। আর সেদিনের ঘটনার কথা ভুলে সে তোকে যে জোর করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল এটা শোনার পর তো আমার মনে হচ্ছে তার মন সত্যিই খুব বড়। তুই শুধু তাকে তার ক্লিয়ারকাট কথার জন্য অসভ্য ভাবছিস। তুই জানিস তোর অবস্থা কতটা বেহাল ছিল? পাক্কা দুই ঘন্টা তোর হাত পায়ের তালু মালিশ করতে হয়েছে। এত পরিমাণ ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে গিয়েছিল তোর হাত পা। কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম আমরা! উনি যদি তোকে ওই সময় জোর করে গাড়িতে না উঠিয়ে আনতো, তোকে তো বোধহয় হসপিটাল দেখতে যেতে হতো আমাদের। বেচারাকে তখন থেকে অসভ্য অভদ্র বলে যাচ্ছিস। একটা ধন্যবাদ কাম্য তার তোর থেকে। বাট সেটাও কম হবে তার জন্য। দাদু তো খুশি হয়ে তার বন্ধুকে ফোন করেছিল। নাতিকে ধন্যবাদ জানাতে পারেনি বলে তার কাছে সাধুবাদ জানিয়েছে ওনার জন্য।” মিমির কথাগুলো শুনে মাহি কিছুক্ষণ নীরব হয়ে বসে রইল। আজকের ছুটির পরের ঘটনা মাহির বারবার মনে পড়তে থাকল। তখন যেভাবে আশফি ওকে টেনে গাড়িতে ওঠাল, তা দেখে মাহির মনে হয়েছিল ওই মানুষটা ওর খুব কাছের ব্যক্তি। যে ওকে নিয়ে খুব ভাবে। আর সেই জোরেই সে তাকে ওভাবে টেনে গাড়িতে উঠিয়েছিল। গাড়িতে বসে ঠিক এই ভাবনাগুলোই মাহির মনে চলছিল। তাই সে নিস্তব্ধ ছিল। আর এখন মিমির ব্যাখ্যা থেকে সে সকালের কেবিনের ঘটনার ব্যাপারটাও ক্লিয়ার হলো। প্রচন্ড অনুতপ্ত বোধ হচ্ছে মাহির। ইচ্ছে তো করছে তার এখনি ফোন করে আশফিকে ধন্যবাদ জানাতে। – “কিরে কী ভাবতে বসলি? খেতে যাবি না?” মাহি চকিতে বলল, – “হ্যাঁ হ্যাঁ যাব, কী পরিমাণ যে বকবক করতে পারিস তুই!” . . তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করে দিয়েছে আশফি। সব থেকে অবাক করা বিষয় মাহি যেখানে নিজে থেকে ফোন করে ছুটি চাইবে সেখানে তার আগেই অ্যাসিস্ট্যান্ট আনোয়ারকে দিয়ে আশফি মাহিকে ফোন করায়। এরপর সে মাহির কাছে তার শরীরের কন্ডিশন জেনে তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করে দেয়। যেটা আজও অবধি কোনো বস তার এমপ্লয়ির জন্য করে থাকে না। সেটা আশফিকে করতে দেখে মাহির ভাবনা এখন তাকে নিয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই। তিনটা দিন মাহি অনবরত আশফির সাথে শুরু হওয়ার দিন থেকে বর্তমান সময় অবধি সেগুলো ভেবে চলেছে। যখন আশফির সবটা একত্র করে মাহি ভাবছিল তাকে নিয়ে, তখন সে উপলব্ধি করল আশফির মাঝে অসভ্যতা আর নির্লজ্জতার বদলে আছে মেয়েদের প্রতি অসীম সম্মান আর মানুষের প্রতি উদারতা। হয়তো তার কথাগুলো কিছুটা বেসালাম। তবে সে যাকে যা বলে তার নেচার বিবেচনা করেই সে বলে। তিনদিন পার করেই মাহি অফিসের জন্য প্রস্তুত হলো সকালে। ঠিক তখন সোম এসে হাজির বাসাতে। অগত্যা মাহি তার বাইকে চড়েই অফিসের উদ্দেশে গেল। অফিসের সামনে এসে মাহি মুখোমুখি হলো আশফির গাড়ির। গাড়ি থেকে আশফি আর দিশান এক সঙ্গে নামল। মাহিও তার কিছুক্ষণ পর সোমকে বিদায় জানিয়ে চলে আসে। অফিসের ভেতরে না যাওয়া অবধি সোম তখনো ওখানে দাঁড়িয়ে থাকল। সে স্পষ্ট দেখল এবং শুনল দিশান মাহির কাছে এসে তাকে হাই হ্যালো করে তার সুস্থতার খোঁজ নিচ্ছে। আর তার থেকে একটু দূরে আশফি পকেটে হাত পুরে উল্টোদিক হয়ে দাঁড়িয়ে। তারপর তিনজন এক সাথে লিফ্টে ঢুকে গেল। এটুকু দেখেই সোম সেখান থেকে বিদায় নিলো। . চরম বিরক্তি জড়িয়ে আছে আশফির চোখে মুখে। একদম নীরব আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার নজর বারবার অস্থির হয়ে দেখছে দিশান আর মাহিকে। লিফ্টের মধ্যে তারা এমনভাবে গল্প জুড়ে নিয়েছে যেন জিগারের মানুষ তারা একে অপরের। এই ব্যাপারটায় সে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। তার উপর আবার একটা ছেলের বাইক থেকে মাহিকে নামতে দেখে যতটা না অস্বস্তি লেগেছে তার থেকে বেশি অস্বস্তি লেগেছে যখন ছেলেটা নিজে মাহির মাথা থেকে হেলমেট খুলে দিয়ে তার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। তারপর বেশ আদেশের বাণীও ছাড়ে কিছুক্ষণ মাহিকে। মোদ্দা কথা মাহির হালচাল আর তার দৃষ্টিভঙ্গী কোনোটাই আশফির বুঝে আসছে না। অফিসের দিনের শুরুটা শুরু হলো বেশ গম্ভীরচিত্তেই তার। এর মাঝে মাহি দু একবার তার কেবিনে যায় দরকারে। খুব আশা নিয়ে মাহি যখন তাকে জানাল, – “সেদিনের ব্যবহারের জন্য স্যরি আমি। আর অনেক ধন্যবাদও আপনাকে।” আশফি ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকাল মাহির দিকে। মাহির ওষ্ঠকোণে হাসিটা বেশ টান টান। আজ সে আগের দিনের তুলনায় বেশ গোছগাছ আর সেজেগুজে এসেছে। আজ গলায় ওড়নার বদলে স্কার্ফ ঝোলানো। আর সেলোয়ার কামিজের বদলে লং কূর্তি। বেশ ভালোই লাগছে তাকে। আশফি এক মিনিটের মতো তার সোজ-সোজ্জা দেখে তাকে শান্ত সুরে বলল, – “এটা আমার অফিস। আর ওটা ছিল পাবলিক রোড। এখানে আপনি আমার এমপ্লয়ি আর ওখানে আপনি আমজনতার মতো একজন ছিলেন। তাই মানবিকতার খাতিরে আমি হেল্পটা করেছিলাম। সেটার জন্য ধন্যবাদ আপনি আমাকে তখন জানাতে পারেন যখন আপনার সঙ্গে আমার অফিস আওয়ারের বাহিরে সাক্ষাৎ হবে। আমি যা বোঝাতে চেয়েছি তা নিশ্চয় ক্লিয়ার?” কথার মধ্যে মাহি বেশ রাগের আভাসও পেল। কিন্তু তার থেকেও বেশি অপমানবোধ করল আশফির আচরণে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে আসে সে কেবিন থেকে। …………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে