Monday, October 6, 2025







তুমি রবে ৫৮

তুমি রবে ৫৮
.
.
আশফি দিশানের দিকে ফিরে তাকিয়ে কৃত্রিম হাসি প্রদান করল মাত্র। এরপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে সে দিশানকে বলল,
– “আমি ওকে।”
মাহি এতগুলো বছর পর ভাইটাকে হঠাৎ চোখের সামনে দেখে খুশিতে আত্মহারা অবস্থা। কিন্তু তখন মাহতীম তাকে গাড়িতে তোলার পূর্বেই মাহি আরও একবার বমি করেছিল রাস্তাতে। মাহতীম তাকে দ্রুত বাসায় নিয়ে এসে বুঝতে পারে তার বোনটার গায়ে জ্বর লেগে গেছে। তার উপর তার মাইগ্রেন ব্যথার অসুখটাও মাহতীম আজ নতুন জানল। সব মিলিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তার মাঝে সে বোনটাকে বিছানাতে না, সর্বক্ষণ বুকের মাঝে জাপটে ধরে বসেছিল। কিছুক্ষণ আগেই মাহির খিদে পায়। তখনই সে ঝটপট কিচেন থেকে খাবার গরম করে এই মুহূর্তে বোনকে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত ছিল।

আশফিকে দেখে মাহি সোজা হয়ে বসলো। একবারের পর আর দু’বার তার দিকে তাকাল না সে। মাহতীম উঠে এসে আশফির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে বলল,
– “মাহতীম শেখ।”
আশফি তার হাতে হাত মিলিয়ে মৃদু হেসে নিজের পরিচয় প্রদান করল। দিশানের সঙ্গেও পরিচিত হলো সে। ফয়সালও এসে পরিচিত হলো তাদের সাথে। আশফি আর দিশান সোফাতে বসতেই মাহতীম কিচেনে গেল কফি করতে। এর ফাঁকে ফয়সাল মাহতীম আর মাহির সম্পর্কের বিবরণ দিয়ে দিলো। মাহির একটি ভাই আছে তাও আবার নিজের, এ বিষয়ে আশফি বা দিশান কেউই অবগত নয়। ব্যাপারটাতে দুজনেই অবাক হলেও কেউ তা চেহারাতে প্রকাশ করল না। খুব সহজভাবে মাহতীমের বাহিরে থাকার গল্পটা শুনতে থাকল তারা। দেশে আসার কারণটাও তাদেরকে জানাল ফয়সাল। এর মাঝে মাহি উঠে কিচেনে চলে এলো ভাইয়ের কাছে। মাহতীম মগগুলোতে কফি ঢেলে নিতে নিতে বোনকে দেখে বলল,
– “উঠে এলি কেন? যা ওখানে গিয়ে বস নয়তো রুমে গিয়ে শুয়ে থাক।”
ভাইয়ের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে মাহি আবদারের সুরে বলল,
– “আমি যাব না ভাইয়া। থাকব আমি তোমার কাছে।”
কিচেন আর লিভিংরুম পাশাপাশি হওয়াই আশফি দেখতে পেলো তাদের ভাই-বোনকে এক সঙ্গে। এর মাঝে আশফি আর মাহির চোখাচোখিও হলো। মাহি দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই আশফিও স্বাভাবিকভাবে নজর ফেরাল। মাহতীম বোনের গায়ে চাদরটা ভালোভাবে জড়িয়ে দিয়ে বলল,
– “অবশ্যই থাকবি। কিন্তু আজ ফিরে যাবি। কারণ বাড়িতে নিশ্চয়ই জেনেছে সবাই তুই বাসা ছেড়ে চলে এসেছিস। এখন কোথায় আছিস এটা কেউ জানুক তা আমি চাচ্ছি না। আজ যা। আমি আজ রাতে কিংবা কাল সকালেই তোকে গিয়ে নিয়ে আসব।”
– “তো তখনো তো জানবে সবাই আমি কার সঙ্গে কোথায় যাচ্ছি।”
– “সেটা আমি দেখব রে বাবু। ওকে দেখে বুঝতে পারছিস কী পরিমাণ চিন্তার মাঝে ছিল সে এত সময়! এই শীতেও তার টি-শার্ট ভেজা ঘামে।”

মাহিকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে মাহতীম এসে বসলো সবার সঙ্গে। তাদের চেনা-জানা, আলাপ আলোচনা চলল অনেক সময় ধরে। মাহতীম পেশাতে একজন ডেন্টিস। মাত্র দু’মাসের জন্য সে এসেছে দেশে। সব কথার মাঝে মাহতীম আশফির সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য তাকে নিয়ে চলে এলো নিজের রুমের ব্যালকনিতে। রুমে ঢুকে তারা দেখল মাহি এসে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ মাহতীম রুমের এসিটা অফ করে ফ্যানটা চালিয়ে বোনের গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে চলে এলো ব্যালকনিতে। আশফি মাত্র এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে বুঝে গেল তাদের দুই ভাই-বোনের সম্পর্কের গভীরতা কতখানি। তবে আশফি আন্দাজ করতে পারল না মাহতীমের বয়সটা। কারণ তার উচ্চতার সঙ্গে তার সুঠাম দেহ আর তার সুদর্শন বৈশিষ্ট্যের জন্য তার বয়স পরিমাপ করা কষ্টকর। আদৌ সে আশফির থেকে বয়সে বড় নাকি ছোট অথবা সমবয়সী কিনা, তা আর আন্দাজ হলো না। আশফি তার হাতে আবারও দুই মগ কফি দেখে একটু হাসলো। মাহতীম তার হাসিতে হাসি প্রদান করে বলল,
– “ভুল না হলে এটা তোমার অভ্যাসও হওয়ার কথা।”
আশফি কফিটা হাতে নিয়ে বলল,
– “বৃটিশরা শুধু কফি প্রেমী বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানোর মুহূর্তে নয়, একা মুহূর্তেও।”
মাহতীম হেসে বলল,
– “যদিও বৃটিশ নই আমরা। তো তোমার কোন মুহূর্তের জন্য বেশি প্রিয়।”
– “একা মুহূর্তের জন্য।”
মাহতীম আপাতত চুপচাপ। আশফি কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল,
– “আপনি সম্বোধনে আপনি বিব্রত নন তো?”
– “আমার আর মাহির বয়সের পার্থক্য আট বছর।”
আশফি হেসে উঠতেই মাহতীমও হেসে বলল,
– “এই সামান্য ডিফারেন্সে আপনিটা আমার ভালো লাগবে না।”
– “জেনে শুনে খারাপ লাগাটা দিতে চাই না। তোমার ওয়াইফ?”
– “আমি আজ দু’বছর যাবৎ ডিভোর্সড।”
আশফির বিব্রত মুখটা দেখে মাহতীম হেসে বলল,
– “স্যরি বলতে হবে না।”
এরপর দুজনে শুধু কফিতে চুমুক দেওয়া ছাড়া আর কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ পরই আশফি আবার বলল,
– “ও যদি থাকতে চায় তো আমার আপত্তি নেই। আমি আসলে বুঝতে পারিনি ও বেরিয়ে আসতে পারে।”
– “বিব্রত হতে হবে না এ নিয়ে। ভুলটা ও করেছে।”
– “আমি আসলে আপসেট হয়ে পড়েছিলাম কিছু ব্যাপারে। আর আপসেট থাকার কারণে ওর ব্যাপারটা পুরো মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ও যে খুব ইমোশনাল তা আমি…! আসলে আমার আরও বেশি খেয়াল রাখা উচিত ছিল। আমি সত্যিই খুব অপরাধবোধ করছি।”
– “হুঁ, খেয়াল একটু রাখা উচিত ছিল। ও মানুষটা হুটহাট রেগে যায়, কিন্তু সে রাগ বেশি স্থায়ী না। নিজের মানুষের ব্যাপারে ও খুব কনসার্ন আর পজেজিভ।”
– “জানি।”
– “ও অপরাধবোধে ভুগছিল। তুমি ওকে যথেষ্ট বুঝতে পারো। ধরতে গেলে পুরোটাই বুঝো।”
– “হ্যাঁ আমি আসলে ওই মুহূর্তে আমাকে নিয়ে ওর ওই ভাবনাগুলো নিতে পারিনি। আমি সত্যিই খুব লজ্জিত।”
– “ও নিজেও লজ্জিত। এভাবে ওর বাসা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত হয়নি তা ও বুঝতে পেরেছে।”
মাহতীম ঘড়িতে টাইম দেখল। সকাল ছয়টা বাজে। আশফিকে মাহির পাশে বসতে বলে সে মেহরিনকে নিতে ঐন্দ্রীর অ্যাপার্টমেন্টে গেল। ঐন্দ্রী মাত্রই তখন ঘুম থেকে উঠেছে। দরজা খুলে মাহতীমকে দেখে বলল,
– “সব ঠিক আছে তো?”
– “হ্যাঁ সব ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি কি মেহরিনকে নিতে আসতে পারি?”
– “হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। ভেতরে আসুন।”
মাহতীম ভেতরে আসতেই ঐন্দ্রী দ্রুত এক মগ কফি নিয়ে মাহতীমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– “আমি মাত্রই কফিটা বানিয়েছি।”
মাহতীত হেসে বলল,
– “আমিও মাত্রই দু’মগ কফি শেষ করে এসেছি।”
ঐন্দ্রীও হাসি বিনিময় করল। মাহতীম বলল,
– “আমি আসলে স্যরি অনেক লেট করে এসেছি। ও বিরক্ত করেছিল নিশ্চয়ই?”
– “বিরক্ত করেছিল রাত একটা পর্যন্ত। তাকে বশে আনতে আমি আজ ন্যানির ওপর পিএচডি করে ফেলেছি।”
কথাটা বলেই ঐন্দ্রী হেসে উঠল। মাহতীমও হাসলো। মাহতীম বলল,
– “ভবিষ্যতে কাজে দেবে।”
– “কীভাবে?”
– “সত্যিই বুঝতে পারেননি!”
ঐন্দ্রী মাহতীমের প্রশ্নের ভঙ্গিতে মাহতীমের কথার ইঙ্গিত ধরতে পেরে হেসে উঠল। তারপর নিজের রুমটা দেখিয়ে দিলো মাহতীমকে। মাহতীম ঘুমন্ত মেহরিনকে কোলে নিয়ে ঐন্দ্রীকে বলল,
– “আমার হাতের এক মগ কফি পানের জন্য আমন্ত্রণ রইল। আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করব।”
– “চেষ্টা করব।”
– “চেষ্টার মাত্রা যেন একটু সিরিয়াস হয়।”
ঐন্দ্রী হেসে সম্মতি জানাল মাহতীমকে।
.
মাহতীম রুমে এসে মেহরিনকে খুব ধীরে মাহির পাশে শুইয়ে দিলো। এই দৃশ্যটা দেখার বড্ড সাধ ছিল মাহতীমের। তার জীবনের দুটো প্রদীপকে এক সঙ্গে এভাবে নিজের কাছে রাখার প্রবল ইচ্ছা তার।

আশফি লিভিংরুমে দিশান আর ফয়সালের সঙ্গে বসে কথা বলছিল সোম আর মাহির ব্যাপারগুলো নিয়ে। মাহতীম বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে ওদের সঙ্গে এসে বসলো। সোমের মতো এমন একটা বিষ এতগুলো দিন মাহির জীবনে ছিল তা জানতেই মাহতীমের হাত নিশপিশ করে উঠল। এ বিষয়ে অনেক কিছু আলোচনা করে আশফি মাহতীমকে বলল,
– “ও থাক এখানে আজকের দিনটা। আমি সন্ধ্যার পর নিতে আসব। বাসায় সবার সঙ্গে দেখা করে তারপর আগামীকাল ওকে দিয়ে যাব। ওর যতদিন ইচ্ছা ও এখানে থাকবে।”
– “আশফি! আমি আসলে চাইছি না আমার আসার ব্যাপারটা আমার বাড়ির কেউ জানুক।”
একটু সময় নিয়ে মাহতীম তার জীবনের পুরো ঘটনা খুলে বলল আশফিকে। কিন্তু আশফির কষ্ট হলো এ কথা শুনে যাকে ভালোবেসে সে নিজের পরিবার আর নিজের দেশ ছাড়ল, শেষ অবধি সে তার হাতটা ছেড়ে চলে গেল। আশফি জিজ্ঞেস করল মাহতীমকে,
– “ন্যানিও তো দেখাশোনা করতে পারতো মেহরিনকে।”
– “মেহরিন বড় হতে পারতো ন্যানির কাছে। কিন্তু বয়স চৌদ্দ পনেরো হওয়ার পরই যখন মেহরিন বাউন্ডুলে, রুঢ় হয়ে পড়তো সেভাবে আমি ওকে বড় করতে চাই না। বাবা-মায়ের পূর্ণ স্নেহ ভালোবাসা আর আদুরে শাসন দিয়ে আমি ওকে বড় করতে চাই৷ বড় হওয়ার পর ও যেন বাবা-মায়ের সান্নিধ্যের অভাববোধ না করে। আর মেহরিন মা ভক্ত কম।মেহরিনের এক বছর বয়সের মাঝেই শাহরিন ওর স্বাধীনচেতা মন, ক্যারিয়ার এসবের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। মেহরিন সব থেকে বেশি সময় পায় আমাকে। এই চার বয়সে মা ছাড়া ও থাকতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমি ছাড়া না।”
– “তাহলে শেষ অবধি উনি নিজের স্বাধীন জীবন যাপনকে বেছে নেন? মেহরিনকে উনি চান না?”
– “না চায় না। মেহরিন না এলে আজ আমাদের সম্পর্ক খুব সুন্দর থাকত।”
মাহতীম অনেকটা বিমর্ষ হয়ে পড়ল। আশফি আর কিছু জিজ্ঞেস করল না তাকে। নাস্তা করে, কথা-বার্তা শেষ করে দিশান আর সে বেরিয়ে এলো।

শায়খকে নিয়ে সাইবার আইনের সহায়তায় সোশ্যাল সাইটে মূল ভিডিও আর ছবিগুলো আপলোডকারীকে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করল। আর পত্রিকাগুলোর নামে মানহানি কেস নিয়ে এলো আশফি। ছবি আর ভিডিও থেকে শায়খ প্রমাণ করে দিয়েছে মাহিকে মলেস্টের চেষ্টা করেছিল সোম। পুরো একদিনের মাঝে আশফি সব কিছু সমাধান করে আগামীকাল প্রেস মিডিয়ার সঙ্গে একটি কনফারেন্সের ব্যবস্থা করল। সারাদিনের কাজ শেষ করে ঠিক সন্ধ্যার পরই আশফি চলে এলো মাহতীমের বাসায়। এসে দেখল মাহতীম, মাহি আর মেহরিন এক সঙ্গে রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল।
– “ভুল সময়ে এসে পড়লাম বোধহয়।”
মাহতীম হাতটা ন্যাপকিনে মুছে নিয়ে বলল,
– “একদম সঠিক সময়ে এসেছো। মেহরিন এই প্রথম কারো সঙ্গে পুরো একদিনের মাঝে বন্ধুত্ব করেছে। মাহির মাঝে ও আমার গন্ধ পায়। তাই মাহিকে সে এক দন্ডও একা থাকতে দেয়নি। আর যখন থেকে শুনেছে একটা আঙ্কেলও থাকে তার ফুপির সঙ্গে, তখন থেকেই সে তোমাকে দেখার জন্য মাথা নষ্ট করে ফেলছে মাহির।

মাহি রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে বারবার দেখতে থাকল আশফিকে। মেহরিনকে বলল,
– “মাম্মাম তোমার আঙ্কেল এসেছে। ওটাই তোমার আঙ্কেল।”
মেহরিন বলল,
– “দ্যান আই উইল মিট হিম?”
– “হ্যাঁ অবশ্যই।”
.
বেশ ভালো সময় কাটাল আশফি সবার সঙ্গে। আড্ডার মুহূর্তে আশফি শুধু মাহির চোখজোড়ার ভাষা বুঝতে চেষ্টা করছিল। মাহি প্রচন্ডভাবে আশফির কাছে থাকতে চায়। এদিকে ভাইকে এতগুলো বছর পর পেয়ে একটা মুহূর্তের জন্যও তার কাছ ছাড়া হতে চাইছে না। রাত আটটা বাজলে আশফি মাহিকে নিয়ে আজকের জন্য বিদায় নিয়ে চলে এলো। কাল সকালেই আবার মাহিকে রেখে যাবে সে এখানে। এমন সিদ্ধান্তে মাহি খুব খুশি হলো। কিন্তু আশফিকে ছাড়া তাহলে তাকে বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। এমনটা ভাবতেই তার মনটা খারাপ হয়ে আছে। আশফি গাড়িটা দ্রুত ড্রাইভ করছে। কোনো কথা বলল না সে মাহির সঙ্গে। তবে মাহি তাকে বলল,
– “আমার দাদা আর দাদীবুকে ফেস করতে খুব লজ্জা করছে।”
– “আমার ওপর ক্ষেপে আছে তাঁরা।”
মাহি কোনো কথা বলল না এরপর। আশফি বলল,
– “আমার আচরণের মাঝে তাঁরা আমার বাবার আচরণ খুঁজে পেয়েছে। তাই তাঁরা কেউ কথা বলছে না আমার সঙ্গে। আমার বাড়ি ফেরাও নিষেধ ছিল যদি আপনাকে না খুঁজে পেতাম।”
– “আমি খুবই দুঃখিত। মাফ করবেন আমাকে।”
– “কষ্ট পাবেন না। কাল সকালেই আমি আপনাকে আপনার ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিস যাব।”
.
বাসায় এসে মাহি প্রথমেই ক্ষমা চাইল সবার কাছে। সবাই বেশ স্বাভাবিক আচরণ করল মাহির সঙ্গে। দিশান আর শায়খ তার সঙ্গে কিছুক্ষণ হাসি ঠাট্টা করল আশফির ব্যাপার নিয়ে। মাহতীমের মুখোমুখি হয়ে আশফির মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল তার সবকিছুই শেয়ার করেছে দিশান শায়খের সঙ্গে। দিশানের মজাগুলো রীতিমতো আশফিকে প্রচন্ড লজ্জা দিচ্ছিল বলে সে রুমে চলে গেল। দিশান বলল মাহিকে,
– “ডিয়ার তোমার ভাই যদি পুলিশ হতো তবে হয়তো প্রতিদিনই গণহারে কিছু সংখ্যক মেয়ে অন্তত রুলস ব্রেক করে হলেও গ্রেপ্তার হতো। যা চেহারা আর যা গম্ভীর দৃষ্টি তার!”
শায়খ বলল,
– “শুনলাম ভাইয়ার নাকি পিলে চমকে উঠেছিল!”
কথাটা বলতেই দিশান কনুই দিয়ে শায়খের পেটে আঘাত করে থামতে ইশারা করল। মাহি এ কথা শুনে জিজ্ঞেস করল,
– “পিলে চমকে উঠেছিল মানে?”
দিশান জবাব দিলো,
– “তোমাকে অসুস্থ দেখে। তবে তোমার ভাইয়ের গম্ভীর দৃষ্টি দেখে আমি আর ভাই ভেবেছিলাম কত জেরার মুখে না পড়তে হবে আমাদের!”
মাহি বুঝতে পারল আজ আবারও তার জন্য কতটা লজ্জার মাঝে পড়েছিল আশফি! মনটা তার খারাপ হয়ে গেল। তার ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ফল সব সময় আশফিকেই ভোগ করতে হয়! মাহির মুখটা হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে যেতে দেখে দিশান বলল,
– “এই! তবে আমি আর ভাইয়া কিন্তু ইমপ্রেসড তোমার ভাইয়ের আচরণে। সে দারুণ একজন মানুষ। আর তোমাকে কী পরিমাণ ভালোবাসে তা দেখে ভাইয়া সত্যিই মুগ্ধ।”
.
মাহি সবার সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে বাড়িতে ফোন করে অনেক সময় কথা বলে তারপর রুমে গেল। রুমে আসার পর আশফিকে শুধু একটা প্যান্ট পরা অবস্থাতে বাথরুম থেকে বের হতে দেখল। আশফির খোলা শরীরটাতে নজর পড়তেই চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে থাকল মাহিকে। আজ হঠাৎ কেন যেন তার খুব ইচ্ছা করল ঠিক সেই দিনের মতো একই ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে তার বুকের মাঝটাতে তাকে জাপটে ধরে থাকতে। কিন্তু সে যা আচরণ দিয়েছে তাকে, এরপর তার সাথে খোলাখুলি কথা বলতেও মাহির খারাপ লাগছে।

দুজনে দুজনের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। আশফি ল্যাপটপে যেন খুব মনোযোগের সঙ্গে কিছু দেখতে ব্যস্ত। এতটাই ব্যস্ত যে সে টি শার্টটা হাতে নিয়ে আছে। অথচ পরতে ভুলে গেছে। মাহি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো খুলে চিরুনি করছে। আশফি তার কাজের মাঝে মাহিকে জিজ্ঞেস করল,
– “তোমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট কবে থেকে ডিঅ্যাক্টিভেট?”
– “বিয়ের আগে থেকে।”
– “খুব ভালো। ভাগ্যিস ডিঅ্যাক্টিভেট ছিল।”
মাহি বুঝতে পারল তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অ্যাক্টিভেট থাকলে সোশ্যাল সাইট থেকে ছবি আর ভিডিওটি রিমুভ করতে বড্ড কষ্ট হয়ে পড়ত। কারণ তাতে তার প্রফাইলও শেয়ার হতো প্রচুর। আর সঙ্গে প্রফাইলের ছবিগুলোও।

কাজ সেড়ে আশফি আবার ওয়াশরুমে গেল। মাহি তা খেয়াল না করে চুলগুলো বেঁধে সেও ঢুকল ওয়াশরুমে। আশফি তখন প্যান্ট খুলে ট্রাওজার পরেছে। ঠিক সে সময়েই মাহি ঢুকে। তাকে ট্রাওজারের জিপার আটকাতে দেখে চরম লজ্জাতে মাহি দ্রুত বেরিয়ে এলো। আশফি তাকে হুড়মুড় করে বের হতে দেখে একটু অবাক হলো। ধরতে পারল না সে কেন এভাবে বেরিয়ে গেল! ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে সে দেখল মাহি কোমরে এক হাত দিয়ে আর মাথার পিছে এক হাত রেখে কেমন বিব্রত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আশফি তার পিছে এসে দাঁড়িয়েছে তা মাহি টের পায়নি। পিছু ফিরতেই আশফির সঙ্গে ধাক্কা খেলো সে। আশফি তখনো খালি গায়ে। মাহির নজর পড়ল সরাসরি আশফির বুকের নিচে বাঁ পাশের সেই লাল তিলটির দিকে। এরপর তার নাভির নিচের কাটা দাগটাতেও সে ইচ্ছা করেই নজর ফেলল। মাহি জানে না, এই দুটো জিনিস তার কেন বারবার দেখতে ইচ্ছা করে। তা কি ভালো লাগার না কি মন্দ লাগার তা মাহি বুঝতে পারে না।

মাহি কোনো কথা না বলে আশফিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে আশফি তার পথ আগলে ধরল। আশফির চোখের দিকে তাকাতেই কেমন হৃদপিণ্ডের গতিবেগ বেড়ে গেল তার। হঠাৎ করে আজ এমন কেন হচ্ছে তা সে মোটেও বুঝতে পারছে না। সেই আগের সময়গুলোর পুরোনো অনুভূতি আজ নতুনভাবে জেগে উঠছে তার। মাহি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তার চোখ জোড়ার পানে চেয়ে রইল কত সময়। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেতেই সে আমতা সুরে বলল,
– “ওয়াশরুমে….”
আশফি তার আঙুল দুটো মাহির ঠোঁটজোড়ার ওপর রেখে তার কথা সম্পূর্ণ হতে দিলো না। এগিয়ে এলো মাহির খুব কাছে। মাহির কানেকানে ফিসফিসিয়ে বলল,
– “বেহায়া নজরে শুধু দেখার থেকে ছুঁয়ে দেখা ভালো।”
কথাগুলো বলেই মাহির গলার পাশটাতে সে নাক ডুবিয়ে রাখল কয়েক মুহূর্ত। তার শরীরের সুগন্ধি টেনে নিয়ে বলল,
– “আমি খুশি হয়েছি যে এটা শুধু আপনি আমার জন্য আর আমার ঘরেতেই ব্যবহার করেন।”
মাহি নিশ্চুপ। তার লাজুক নজর জোড়া অস্থির হয়ে আছে। নজর জোড়া নিজেদেরকে কোথায় স্থির করবে তা তারা ভেবে পাচ্ছে না। আশফি মৃদুস্বরে বলল,
– “ছুঁয়ে দেখতে চান?”
মাহি নিমিষে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল। আশফি ঈষৎ হেসে মাহির কোমরের দু পাশ ধরে তাকে কাছে টেনে নিলো। তারপর মাহির ডান হাতটা টেনে নিয়ে তার বুকের নিচের সেই তিলটাতে ছোঁয়াল। মাহিকে বলল,
– “না দেখলে তো উপলব্ধি করতে পারবেন না।”
কয়েক মুহূর্ত পর মাহি চোখদুটো খুলে তাকাল সেই জায়গাটিতে, যেখানে সে স্পর্শ করে আছে। আশফি তার হাতটা ছাড়েনি। মাহির হাতের ওপর তার হাত। আর আঙুলের নিচেই সেই লাল তিলটি। আশফি এবারও মৃদুস্বরে বলল,
– “চাইলে ওষ্ঠদুটোও ছোঁয়াতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।”
আশফির ঠোঁটে দৃষ্টুমির হাসি। কথাটা শুনতেই মাহি লজ্জাতে হাতটা টেনে নিয়ে চলে আসতে চাইল। কিন্তু আশফি তাকে টেনে আবার কাছে আনল। আর এবার তার শরীরের সঙ্গে মাহিকে জড়িয়ে রেখে তার হাতটা ধরে বলল,
– “ওই জায়গাটির কাটা দাগটির পেছনে বিশেষ কোনো গল্প নেই। তবে তাকে ঘিরে আজ একটা গল্প তৈরি হলে মন্দ হয় না।”
এটুকু বলে আশফি মাহির হাতটা তার নাভির নিচের সেই কাটা স্থানে ছোঁয়াতে চাইলে মাহি ছুটে এলো তার কাছ থেকে। তারপর ওয়াশরুমে চলে গেল। আশফি দাঁড়িয়ে হাসতে থাকল নিঃশব্দে। মাহি বেরিয়ে এসে দেখল আশফি রুমে নেই, ব্যালকনিতেও নেই। রুমের মধ্যে কত সময় হাঁটাহাঁটি করল সে। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে মাহি দ্রুত বিছানায় গিয়ে বসে বালিশ সাজাতে থাকল। আশফি হঠাৎ বলল,
– “রুমের লাইট অফ করে শুয়ে পড়ো। আমি ব্যালকনিতে আছি।”
মাহি চকিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
– “ব্যালকনিতে কেন? আপনি ঘুমাবেন না?”
– “ব্যালকিনতে থাকতে ইচ্ছা করছে আজ।”
কথাটা শুনে যেন অনেক বড় স্রোত বয়ে গেল মাহির বুকের মাঝে৷ কিছু বলতে পারল না তাকে। আশফিও আর কিছু না বলে চলে গেল ব্যালকনিতে।
.
বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে পড়ে রইল মাহি। নীরব কান্না ছাড়া আর কেউ জানে না সে জেগে আছে। অনেক বড় আঘাত করে ফেলেছে সে আশফিকে। মানুষটা এখনো ভুলতে পারেনি তার বলা সেই তিক্তপূর্ণ কথাগুলো। এভাবে কতগুলো দিন যাবে তাদের মাঝে? সে তো আজ রাতটাই পার করতে পারছে না। এভাবে যদি প্রতিদিন চলতে থাকে, তবে সে থাকতে পারবে না। চোখদুটো মুছে সে উঠে বসলো। ফিরে তাকাল ব্যালকনিতে৷ উঠে সে চলে এলো সেখানে। আশফি বুকের ওপর একটা বই রেখে হেলে শুয়ে আছে। হয়তো গভীর ঘুমে। মাহি কতক্ষণ তার মুখটার দিকে চেয়ে থেকে ফিরে আসতে গেল রুমে।
– “মাহি!”
হঠাৎ এই ডাকটি শুনে সে ফিরে তাকানোর সময় অবধি পেলো না। ঝরের গতিতে তার বুকের মাঝে এসে পড়ল সে। আর এরপর কিছু বলা আর তার মুখটার দিকে তাকানোর আগেই আশফি তাকে নিজের ব্ল্যাঙ্কেটের মাঝে ঢুকিয়ে নিলো।

………………………………
(চলবে)
– Israt Jahan Sobrin

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ