তুমি রবে ৫০

1
1868
তুমি রবে ৫০ . . শহুরে পরিবেশে এত সুন্দর সবুজের সমারোহের মাঝে বাসস্থান গড়ে তোলা সত্যিই কষ্টদায়ক। আশফি আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তার এই বাড়িটার চারপাশে সবুজ প্রকৃতির স্পর্শ রাখার। অনেক বড় একটা ট্যারেসের ডান পাশটাতে একটা বিশাল গাছের ঝাপটানো ডালগুলো বড় হয়ে নেতিয়ে পড়ছে। ট্যারেসের ওই ডান পাশটা সূর্যের পত্নী(ছায়া) নিজের দখলে নিয়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। শীতের তীব্রত বোঝা যায় শুধু ওই বিশাল গাছটার ছায়াতলে ট্যারেসের ডান পাশটাতে আশ্রয় নিলে। ছোট ছোট নাম না জানা আর দেখতে না পাওয়া কিছু সংখ্যক পাখির কোলাহলধ্বনি, সুক্ষ্ম জলবিন্দুর পুঞ্জ ধোঁয়া আর প্রভাতের জন্ম; আশফির তন্দ্রাভাব কাটাতে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছে এই তিনটি স্বর্গীয় সৌন্দর্য। চোখ দুটো খুলে প্রকৃতির এই শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য সে হারিয়ে গিয়েছিল এর মাঝে। এরপরই মাহির অবস্থান দেখতে পেয়ে আশফির মনে হলো, তাদের মধুচন্দ্রিমার জন্য উপযুক্ত একটি সময় ছিল। বউয়ের তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখটা দেখে এক স্মরণীয় বিশেষ রাতের মুহূর্ত মনে পড়ে গেল আশফির। মাহি আজও ঘুমিয়ে আছে আশফির শরীরের সাথে ঠিক বুকের মাঝটাতে। যেমনটা সেই রাতে ছিল, যে রাতে এক মস্ত বড় ভুলে ডুব দিতে যাচ্ছিল তারা। তবে আজ এই ভুলটা হলে একেবারেই ক্ষতি নেই। শুধু সমস্যা এক জায়গায়। সেদিনের মাহি আর আজ তার স্ত্রী মাহির মাঝে বিস্তর দূরত্ব এবং সেদিন ছিল তারা একটি আবদ্ধ জায়গাতে। আর আজ তারা খোলা ট্যারেসে। সম্ভব হলে বউটাকে কোলে তুলেই নিয়ে যাওয়া যায় ঘরটাতে। কিন্তু সে এখন একটা ছোট বিড়ালছানার মতো আশফির বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে আর তার পায়ের মধ্যে পা জড়িয়ে প্রচন্ড আরামে ঘুমোচ্ছে। আশফির ইচ্ছে করছে না তার বউয়ের এত আরাম বিনষ্ট করতে। গতকাল সেই আকস্মিক চুমুর পর মাহি আরও একটি আকস্মিক ঘটনা ঘটিয়েছিল। আদেশের সুরে সে আশফিকে নিজের পাশে বসিয়ে খুব নির্বিকার ভঙ্গিতে সকলের সঙ্গে বসে আড্ডা দিয়েছে। তার এই নতুন আচরণ সকলের কাছেই খুব বিস্ময়পূর্ণ ছিল। রাত প্রায় দুটো অবধি তাদের সেই আড্ডার আসর ছিল। তাদের মাঝে মাহিই সবার আগে আশফির কাঁধে মাথা পেতে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর দিশান হিমু আর অনিককে এত রাতে যেতে না দিয়ে হিমু আর দিয়াকে একটা রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। এরপর দিশান আর অনিক আশফির রুমে চলে যায়। শায়খ নিচে গিয়ে কাউচে ঘুমিয়ে পড়ে। আশফি মাহির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না এমন বাহানা দিয়ে থেকে যায় ট্যারেসে। একটি ব্ল্যাঙ্কেটে এই তো বেশ আয়েশে দুজন রাতের শেষ ভাগটা ঘুমিয়েছে। তাকে বিরক্ত করল না আশফি। ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে মাহিকে আরও ভালোভাবে ঢুকিয়ে নিলো আশফি। কুয়াশার জলবিন্দু হালকা হালকা মাথা আর মুখের মাঝে পড়ছে। এত আরামের মাঝে মাহি মৃদুস্বরে আয়েশি সুরে এক অদ্ভুত শব্দ করল। কিছু সময় পর সূর্যের উদয় হলে মাহি হঠাৎ চোখ খুলে। চোখ খুলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে নেয় ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে নিজেকে মুড়ি দেওয়া অবস্থায়। খুব কোমল একটি জায়গা। শরীরের ঘ্রাণে মাহির বুঝতে সময় লাগল না সে এখন তার স্বামীর বুকের মাঝে।
ব্ল্যাঙ্কেটের এক কোণা উঁচু করে তার মধ্যে থেকে মাহি এমনভাবে উঁকি দিলো, সেই দৃশ্যটা যেন প্রচন্ড অদ্ভুত লাগল আশফির। হাতে সে মাত্রই ফোনটা নিয়েছিল সময় দেখার জন্য। এমন একটা মুহূর্ত দেখা মাত্রই আশফির হঠাৎ নিতে ইচ্ছা হলো সেই অদ্ভুত লাগাটা ধরে রাখতে। টুপ করে ফোন ক্যামরাতে ছবি তুলে নিলো মাহির কম্বলের ফাঁক থেকে উঁকি দেওয়া মুহূর্তটা। ফোন ক্যামেরার আওয়াজ শুনে মাহি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, – “কী করলেন?” ফোনটা আশফির মুখের সামনে ছিল। ফোনের এক পাশ থেকে মাথা এগিয়ে প্রশ্নবিধ চোখে তাকাল সে। – “কী?” – “কীসের ছবি তুলেন?” – “কোথায় কীসের ছবি তুললাম?” – “শব্দ পেলাম যে।” – “কী জানি কী শুনেছো!” এরপর আশফি আবার ছবিতে ধ্যান দিলো। ছবিটা একটু এডিটও করে নিলো। এডিট শেষে তার ফোনের স্ক্রিনেও সেভ করে ফেলল। তাকে ফোনের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকতে দেখে মাহি মাথাটা পুরোপুরি বের করে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, – “ফোনের মধ্যে এত কী দেখেন?” আশফি দৃষ্টি স্ক্রিনে রেখে নির্বিকারভাবে উত্তর দিলো, – “কিট্টি।” মুখটা প্রশ্নবিধ করে মাহি বলল, – “কিট্টি!” – “হুঁ, বিড়ালছানা।” মাহির কপালের মাঝভাগ কুঞ্চিত করে দেখতে থাকল আশফিকে। ফোনটা রেখে দেওয়ার সময় মাহিকে অমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আশফি জিজ্ঞেস করল, – “কী হয়েছে? অমন কুচকিয়ে রেখেছো কেন মুখ?” মাহি কোনো উত্তর দিলো না। মিষ্টি রোদে সকালের মুখটা দেখতে রইল সে। আশফি তাকে জিজ্ঞেস করল, – “কী? উঠতে হবে না?” মাহি তাকাল আশফির দিকে। তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারল খুব তাড়া তার। একটু বিরক্ত হলো মাহি। শীতের বেলাগুলোতে দ্রুত ওঠার অভ্যাস খুব কম তার। তার উপর আশফির শরীরের উষ্ণতায় আরাম যেন আরও বেশি জেঁকে ধরেছে তাকে। আর এই লোকটাই বা কেন এত তাড়া দেখাচ্ছে? কী এমন মহাবিশ্ব উদ্ধারে যাবে সে যে এই শীতের বেলার বউয়ের উষ্ণতা ভরা কোমল স্পর্শ ছেড়ে উঠতে হবে তাকে? উঠবে না সে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার উঠতে না ইচ্ছা হয় ততক্ষণ সে আশফিকেও উঠতে দেবে না। মনে মনে জিদ ধরে শুয়ে রইল মাহি। আরও বেশি জড়সড়ভাবে শুলো সে। – “ছয়টা বাজে। বাসায় তো না জানিয়েই এসেছি। দ্রুত গেলে ভালো হয়।” এবার মাহির বিরক্তির সাথে প্রচন্ড রাগও হলো। এ মুহূর্তে মাহির ভাবনাগুলো এমন, “আরে ব্যাটা বাসায় গিয়েই তো তুই অফিসের জন্য দৌঁড়াবি। এখানে কত সুন্দর সময়গুলো কাটাতে পারছি এক সঙ্গে। তাতে যেন লোকটার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই! শুধু দুমদাম চুমুই দিতে জানে অসভ্য লোকটা। এ ছাড়া বোধহয় শরীরে সুড়সুড়ি নেই। না হলে এমন একটা মুহূর্ত ফেলে কোনো স্বামী উঠতে চায় বউকে ছেড়ে! ফাজিল লোক একটা!’ – ” কী হলো উঠবে না?” মাহি চকিতে ঝারি দিয়ে উত্তর দিলো, – “না উঠব না।” এই বলেই সে মুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে। তাদের দুজনের অবস্থানটা এমন যে একজন না উঠলে অন্যজনও উঠতে পারবে না। বিশেষ করে মাহি না উঠলে আশফির ওঠার কোনো সুযোগ নেই। আশফি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে চেয়ে থাকল। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, – “তুমি তো দেখি খুব অলস! আরাম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করে না, না?” – “হ্যাঁ আমি অলস। তাতে আপনার কী?” উত্তরগুলো সে ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে থেকেই দিলো। তার রাগী কণ্ঠ শুনে আশফি বলল, – “আচ্ছা না উঠলে। তো এত রেগে যাচ্ছো কেন? রাগ করার মতো কী বললাম?” – “কিছুই বলেননি। রাগ করতে আমার অনেক ভালো লাগে তো তাই এমনি এমনিই রাগ করি। পানসে মানুষ কোথাকার!” – “কী বললে? কী মানুষ?” আশফি অস্পষ্টভাবে মাহির শেষ কথাটা শুনতে পেলো। কারণ শেষ কথাটা মাহি বিড়বিড় করে বলেছিল। আশফির প্রশ্নে সে টেনে টেনে বলল, – “কিছু না!” আশফি বুঝতে পারল না মাহির রাগের কারণ। আর তার কোনো কিছু যদি বুঝে না আসে তবে সে অস্থির পড়ে তা তার মস্তিষ্কে ধারণ করার জন্য। আর এখানে তো তার বউয়ের বিষয়। এই ক্ষেত্রে তো তাকে বুঝতেই হবে তার বউয়ের হঠাৎ রাগের কারণ। আশফি একটু নড়েচড়ে উঠতেই এদিকে মাহি আবার চিল্লিয়ে উঠে বলল, – “উফ্! এত্ত নড়চড় করেন কেন?” – “সেই রাত থেকে এক কাত হয়ে শুয়ে আছি। নড়তেও পারব না?” – “না পারবেন না। আমার বিরক্ত লাগে। ঘুমের ডিস্টার্ব হয়।” – “বাবা তাই নাকি! তো আপনার আরামদায়ক ঘুমের ব্যবস্থা করার দায় যেন আমার? কোন রাজ্যের রানী আপনি শুনি?” মাহি এবার মুখ বের করে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকাল আশফির দিকে। – “আপনার কথা এত বাজে কেন?” আশফি বিস্ময় চোখে চেয়ে বলল, – “বাজে কথা বললাম কোথায়?” – “বাজে কথায় তো। ঝগড়াটে গ্রামের মেয়েদের মতো খোঁচা দিয়ে কথা বলেন। আমি উঠব না। আপনার উঠতে হলে আপনি উঠে যান।” আশফি নিশ্চুপ হয়ে গেল মাহির কথাতে। তাকে কিনা তার বউ গ্রামের ঝগড়াটে মেয়েদের সাথে তুলনা করল! কী এমন খোঁচা দেওয়া কথা বলল সে! – “আচ্ছা বুঝলাম। তো বললেই হয় আপনি আরও ঘুমাতে চান।” – “বলতে হবে কেন? বুঝতে পারছেন না? আর আপনার এত তাড়া কেন শুনি? কী এমন তাড়া যে বউ ফেলে দৌঁড় দিতে হবে?” – “আমার তো কাজের শেষ নেই। তাড়া থাকতেই পারে।” কথাটা শুনতেই মাহি আবারও মুড়ি দিলো। তার ভাবে যা বুঝতে পারল আশফি, তার বউ অন্তত ঘন্টাখানেকের মধ্যে উঠছে না। এও বুঝতে পারল সে, তার বউ সব জড়তা ফেলে তার কাছে থাকতে চাইছে। কিন্তু রাগের কারণটা তো সে এখনো ধরতে পারল না। আচ্ছা তবে তার এই উঠতে বলার জন্যই তার বউটা রেগে গেছে না কি? আশফির কাছে তার রাগের কারণ এটাই মনে হলো। আর শুধু মনে হলো না, সে নিশ্চিতও হলো মাহিকে বারবার কম্বল মুড়ি দিতে দেখে। সে কোনোভাবেই আশফিকে ছাড়তে চাইছে না এই আলস্যপূর্ণ, আরামদায়ক শীতের সকালে। তবে এই আরামের বিনিময়ে তো আশফিও কিছু না আদায় করে থাকবে না। এই যে তাকে এত আরাম দিতে হচ্ছে তার বউকে। বিনিময়ে সেও কিছু পাবে তার থেকে। এক তরফা লাভ তো সে কখনোই দেবে না। আশফি তার হাতদুটো কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে বলল, – “হাতটা ব্যথা হয়ে আসছে উঁচু করে রাখতে রাখতে। একটু ওপরে উঠে এসে হাতের ওপর মাথা দাও।” মাহি এক নজর আশফিকে দেখে বুকের কাছ থেকে সরে ওপরে উঠে এসে আশফির বাহুর ওপর মাথাটা রাখল। তার মাথাটা ঠেকল এবার আশফির থুঁতনিতে। আশফি এবার তার অন্য হাত খুব সাধারণভাবে মাহির গায়ের ওপর রাখল। এত সময় বাইরে হাত বের করে রাখার জন্য হাত দুটো তার বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। মিনিট দুই সময় পর আশফি তার শীতল হাতটা মাহির পেটের ওপর ফেলল। মাহি তখনো কিছু বুঝতে পারল না আশফির মনোবাসনা। সে তখন ঘুম ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাতে। হাতটা ধীরে ধীরে শাড়ির আস্তরণ সরিয়ে পেটের মাঝভাগটা আলগা করে নিলো। শীতল হাতটা পেট স্পর্শ করতেই মাহি আঁতকে উঠল চোখদুটো মেলে। …………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin জি, ঠিকই বুঝেছেন। এখন থেকে পর্বের আকার এমনই হবে। অবশ্য অধিকাংশ নামি দামি লেখকদের পর্বের আয়তন এমনই হয়। তাদের পর্বগুলোতে সাড়াও অনেক। যদিও আমি সেই নামি দামি লেখকদের মতো কেউ নই। খুব সামান্য একজন বলেই কিছু সংখ্যক প্রকৃত পাঠকের ভালোবাসা ছাড়া বাকিদের থেকে কিছু পাওয়ার যোগ্যতা রাখি না। এখন থেকে আর মন্তব্যের ব্যাপারেও কিছু বলব না। আমার আচরণে কেউ কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত। কিন্তু কেউ দয়া করে এই বিষয়ে শান্তনামূলক বাণী অথবা জ্ঞান প্রদান করতে আসবেন না। অনেক ধন্যবাদ আর ভালোবাসা তাদের জন্য, যারা এই অধমনীর লেখার দোষ-গুণ বিচার করে সবসময় আমার লেখাকে ভালোবেসেছেন।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে