তুমি রবে ৪৭

0
1878
তুমি রবে ৪৭ . . তবে আশফি গাড়ি ব্যাক করার আগেই সোম তার মা’কে নামিয়ে চলে গেল উল্টোদিকে। ভিউ মিরোরে তাকিয়ে সোমকে চলে যেতে দেখে আশফি কয়েক মুহূর্ত মাহির রুমের ব্যালকনিতে চোখ বুলিয়ে তারপর চলে গেল। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পর্দার ফাঁক থেকে মাহি সুক্ষ্ম নজরে খেয়াল করছিল তাকে। সে চলে যেতেই পর্দাটা সরিয়ে মাহি ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হলো মিমির। মিটিমিটি হাসছে সে বোনের দিকে তাকিয়ে। মাহি ভ্রু জোড়া কিঞ্চিত কুচকিয়ে জিজ্ঞেস করল, – “কী সমস্যা? হাসছিস কেন?” – “খুব তো বলে এলি তার আসা না আসায় কোনো যায় আসে না। এখন কী করছিলি?” মাহি তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে বিছানাতে গিয়ে বসে পড়ে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, – “দাদু কিছু বলেছেন?” মিমি তার কাছে এসে বসে জবাব দিলো, – “কিছুই বলেননি। আসলে এমনভাবে তোদের সম্পর্কটা হয়েছে কেউ কিছু বলবে আর কী-ই বা বলবে, সেটা কেউ ভেবে পাচ্ছে না। তবে সেদিন কাকু বলছিল দাদুকে, যদি কখনো জানতে পারে তাঁরা যে তুই ভালো নেই সেখানে সেদিনই তোকে তাঁরা ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। মানে তাঁদের ধারণা ভাইয়া তোকে মানতে পারবে না হয়তো।” – “সে কী মেনে নেবে? আমিই তো পারছি না ভুলতে।” – “তোদের তো কাল বাসর ছিল না রে?” মিমির মিটিমিটি হাসি দেখে মাহি এবার কপট রেগে বলল, – “যা ভেবে হাসছিস তার কিছুই হয়নি।” – “কিছুই হয়নি?” মিমির মুখভঙ্গিতে মাহি এতক্ষণে বুঝতে পারল তার বোন কী উদ্দেশে তার কাছে বসে আছে। খানিকটা ধমকের সুরে বলল তাকে, – “কাকুকে বলি জলদি ছেলে দেখতে না কি?” – “শোন, তোর কাকুকে বলতে হবে না। সে অলমোস্ট দেখতে শুরু করেছে। এখন আমি যা জিজ্ঞেস করি তার সত্যি সত্যি জবাব দে বোন। আমি প্রচন্ড এক্সাইটেড।” – “সে তো বুঝতেই পারছি।” – “বলে ফেলো আপুই। জলদি জলদি।” মিমি কথাগুলো বলার পর মাহির কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর মাহি পুরো রাতের ঘটনা খুলে বললেও শেষে এসে তার গলা ধরে এলো। মিমি দ্রুত উঠে বসে বোনের ভিজে ওঠা চোখদুটো দেখে বলল, – “তুই এটা কী বলেছিস আপু?” – “কী করব? ও আমার যত বেশি কাছে আসতে চায় ঠিত তত বেশি আমার সেই দিনের দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। বিশ্বাস কর আমি ওই কথাগুলো বলার পর ওর ওই নেশা ভরা চাউনি তারপর ওর সেই নিভৃতে আর বিনা অনুমতিতে আমার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরা যতটা দূর্বল করে আমার, ওই দিনের কথা মনে পড়লে ঠিক ততটাই বিক্ষিপ্ত করে দেয় আমাকে।” – “কিন্তু তুই ওনাকে কীভাবে বলতে পারলি ওই কথাগুলো আপু? তুই তো বেঁচে থাকতেই ওনাকে ছাড়া থাকতে পারবি না।” – “জানি না আমি।” চোখের পানি এবার ছেড়ে দিলো সে। রাতের শেষ মুহূর্তে মাহির মুখ থেকে ওই কথাগুলো শোনার পর আশফি বিনা অনুমতিতেই মাহির ঠোঁটটা আঁকড়ে ধরেছিল তার ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে। আর সে সময় মাহি চোখজোড়া ঠেসে বন্ধ করে শুধু চোখের পানি আটকে রাখার প্রচেষ্টাতে ছিল। তারপর আশফি তাকে বলেছিল, – “শুধু সেই দিনের অপেক্ষাতেই থাকব যেদিন তুমি নিজে বুঝতে পারবে। এর আগে আমি তোমাকে কখনোই কাছে টানব না, জোরও করব না।” কিছু মুহূর্ত মাহি নির্বাক হয়ে সিক্ত চোখে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকলেও পরক্ষণে সে ক্রোধে ফেঁটে পড়ে বলেছিল, – “বুঝতে কি কিছু বাকি আছে? কী বাকি আছে বলুন? আজকে এইখানে বসে আমি মাহি বলছি, আমি শুধু পরিচয়েই থাকব মিসেস আশফি মাহবুব। শুধুই পরিচয়ে। এর বেশি কিছু কোনোদিনও হবে না আমাদের মাঝে। এমনকি মৃত্যুর পর পরকালেও আমি সেই নারী হিসেবে থাকব যে নারীর কোনো জীবনসঙ্গী থাকবে না। এমন মানুষ কোনোদিনও কারো জীবনসঙ্গী হতে পারে না যে আমার চরিত্রে দাগ লাগাতে পারে।” . . ঘড়িতে এখন বেলা দুটো। কিন্তু ঐন্দ্রীর কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আঁধার নেমে পড়েছে। সারা পৃথিবী ঘুরছে যেন। এক পর্যায়ে বাড়ির মূল ফটকের সামনেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল সে। গেটের কাছে তখন কেউ ছিল না। যখন তার চেতনা ফিরল তখন সে তার রুমে। আর তার মাথার কাছে তখন বসে আছেন তার মা শিউলি। নীরবে কান্না করছে সে। ঐন্দ্রী উঠে বসে কিছুক্ষণ তার মায়ের দিকে চেয়ে থাকল। কয়েক মুহূর্ত পর তার মা বলে উঠলেন, – “জীবন নিয়ে মানুষ এভাবে তামাশা করতে পারে তা তোকে না দেখলে জানতাম না। সবকিছু কি পানির মতো সহজ লাগে তোর? এমন কিছুই যদি করবি তাহলে বিয়ে করতে গেলি কেন?” ঐন্দ্রী নিশ্চুপ। তিনি আবার বললেন, – “একটা মাত্র মেয়ে ছিলি তুই। কী পরিমাণ ভালোবেসে তোকে আগলে রাখতো তোর বাবা। আজ সেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এক মাত্র তোর জিদের কাছে হেরে গিয়ে এই বিয়েতে সে রাজি হয়েছিল। আর কী করলি তুই? দু’দিন পরই সব ছেড়ে চলে এলি।” – “মা! আমার কাছে কোনো প্রশ্ন করো না। এর কোনো উত্তর নেই আমার কাছে।” শিউলি চিল্লিয়ে উঠলেন এবার। বললেন, – “তুই ওই বাড়িতে ফিরে না গেলে তোর বাবা তোকে এখানে থাকতে দেবে না। শুনতে পাসনি সে কী বলেছে? সবকিছু কি খেলা মনে হয় তোর?” ঐন্দ্রী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের লাগেজটা হাতে নিয়ে বলল, – “বাবার কথায় তবে থাকল। আসছি।” মা এগিয়ে এসে তার পথ আগলে ধরে বললেন, – “আসছি মানে কী? কোথায় যাচ্ছিস?” – “না জানলেও চলবে তোমাদের। আমি জানি না কার ভুলের জন্য আমি আজ সব হারাচ্ছি। তবে যেদিন এই হারানো সব ফিরিয়ে আনতে পারব সেদিন ফিরব মা। ভালো থেকো।”
শিউলি কোনোভাবেই মেয়েকে আটকাতে পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতে ঐন্দ্রী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এই মুহূর্তে তার যাওয়ার জায়গা কোনো হোটেল হবে হয়তো। কিন্তু তার বেঁচে থাকার জায়গাটা কোথায় তা সে জানে না। কী করবে? কীভাবে থাকবে আর কী নিয়ে বাঁচবে কিছুই সে জানে না সে। তাই বলে যাকে সে কোনোদিন মানতেই পারবে না তার কাছে অন্তত ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। . . – “রাতের খাবার না খেয়ে যেতে দিতে পারি না বাবা। থাকতে পারবে না জানি। তাই বলে খেয়ে যেতে পারবে না এমনটা বলো না।” শায়খ মুখটা কাচুমাচু করে সোফায় বসে আছে। চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে মাহির মা, চাচি, ভাবি, বাবা, দাদু সবাই। এই মুহূর্তে মাহির মায়ের অনুরোধ সে একেবারেই ফেলতে পারছে না যেন। এত বেশি অনুরোধের মাঝে সে জীবনে পড়েনি। শেষ পর্যায়ে মাহির দাদু বললেন, – “কী খাও তুমি বলো তো? তাড়াতাড়ি বলে ফেলো।” শায়খ মুচকি হেসে বলল, – “দাদু রাতে ডিউটি আছে। এখন একটা কেসের জন্য বাইরে যেতে হবে। অন্য একদিন আসব।” – “আরে তোমার জুনিয়র কাউকে বলে দাও আজকের দিনটা সামলাতে। একদিনের জন্য কিছু হবে না।” এতক্ষণ পর মাহি আর মিমি এক সঙ্গে এসে দাঁড়াল। মাহি হেসে বলল, – “ভাইয়া তোমার সঙ্গে আমার তেমন কোনো কথা হয়নি। কিন্তু তুমি যে দিশানের থেকেও অনেক মিষ্টি তা আমি বুঝেছি।” – “কী বললেন ভাবি! এই কথাটা আর কিছুক্ষণ আগে বললে আজকের সব কাজ ফাইলে বন্ধ করে ফেলতাম। কিন্তু দেরি হয়ে গেল যে।” – “অত কিছু জানি না। দিশান তো আসবে না এখন। কিন্তু তুমি যে এসেছো তা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যেন। আজকের দিনটা অন্তত না রেখে তোমাকে ছাড়তে পারছি না ভাই।” মিমি এবার ঠোঁট চেপে হেসে বলল, – “যুগ পাল্টেছে। বরের পরিবর্তে দেবর আসে জামাই আদর নিতে।” – “আসলেই তাই। আমিও এটাই বলতে চাইছিলাম। যার বিয়ে তার খোঁজ নেই পারা পড়শির ঘুম নেই।” মাহি চুপ হয়ে রইল। মাহির বাবা বললেন, – “তাকে ফোন করেছিলাম। বলল চেষ্টা করবে কাল আসার। আসলে কিছু মনে করো না শায়খ। জোর করার জায়গাটুকু এখনো তৈরি হয়নি আমাদের মাঝে আর আমাদের জোর দাবি রক্ষা করার জায়গাও তার মাঝে তৈরি হয়নি। কিন্তু তাই বলে কি তোমরাও এভাবে ফিরে ফিরে যাবে?” – “না না আঙ্কেল। এমন কিছুই নয়। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আজ শুধু দিনটা না আজ রাতটাও থাকব। তবে একটা শর্ত আছে।” সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে শায়খ মুচকি হেসে বলল, – “আমি দেবর আদর না, জামাই আদর চাই।” তার এই কথাটা যে খুব ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল তা একজনের বুঝতে বাকি রইল না। সবাই হেসে উঠল শায়খের কথা শুনে। . . তিনটা দিন অতিবাহিত হতে চলল, আশফি এর মাঝে মাহিকে কোনো কল করেনি। তবে ঠিক তিন দিনের মাথায় সে দিশান আর শায়খ দুজনকে এক সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে মাহিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। দ্বিতীয় দিনে আবরার যখন আলহাজকে ফোন করে মাহির ফেরার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আবরার মাহির ফেরার প্রতি অনাগ্রহ দেখে সেদিন নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারেননি। আর সেদিনই আশফি বুঝে গিয়েছে এই সময়টাতে মাহিকে তার জোর না দেখালে তাকে সে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কিন্তু এদিকে সে নিজেও এই মুহূর্তে মাহির পরিবারের মুখোমুখি হতে চায় না। তাই সে বাধ্য হয়ে দুই ভাইকে পাঠিয়েছে। রাতে যখন মাহি ওদের দুজনের সঙ্গে ফিরে এলো আর তখন এসেই জানতে পারল ঐন্দ্রীর না ফেরার কথা। সবকিছু মিলিয়ে যেন মাহি প্রচন্ড হয়রান বোধ করল। দিন যত যাচ্ছে আর তার চারপাশের পরিবেশটা যেন ততবেশি ঘোলাটে হচ্ছে। এর মাঝে সে কতগুলো দিন কাটাতে পারবে কে জানে! নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই তার বুকের ভেতরটা যেন কেমন কেঁপে উঠল। সেই রাত আর সেই রাতের শেষ মুহূর্তগুলো তার মনে পড়ল। প্রচন্ড ভার লাগছে তার বুকের মাঝে। দরজার সামনে দাঁড়াতেই পেছন থেকে হঠাৎ শায়খ বলল, – “ভাবিজান! আপনি কি জানেন আজ আপনার জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু হতে চলেছে?” এ কথা শুনতেই মাহি পেছন ফিরে তাকাল। আর দেখল তার সামনে তখন তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে। শাওন, শায়খ আর দিশান। তিনজনের হাতেই সাদা টিউলিপের স্তবক। তিনজন এক সঙ্গে হেসে মাহির দিকে স্তবক তিনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, – “ওয়েলকাম টু আওয়ার ব্রাদার’স প্যারাডাইজ।” হঠাৎ মাহির মনটা খুব খুশি হয়ে উঠল যেন। এক গাল হেসে ফুলের স্তবক তিনটা হাতে নিতেই দিশান এগিয়ে এসে বলল, – “মানে সত্যি তুমি আশফি মাহবুবকে ছেড়ে থাকার প্ল্যান করেছিলে? মাহি ডিয়ার তুমি যাকে যতবার ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছো ততবার সে….! থাক বলব না। আমার ভাই সে মাহি। সে আশফি মাহবুব।” স্মিত হেসে দিশান তাকে আবার বলল, – “অপেক্ষার পালা তোমার আজ। যাও ভেতরে।” ওরা তিনজন এক সঙ্গেই বিদায় নিয়ে চলে গেল। দরজাটা খুলতেই এক দমকা হওয়া গায়ে এসে আছড়ে পড়তেই পায়ের নিচে লাল গালিচার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোলাপের পাপড়ি ঘরের বাহিরে অবধি উড়ে চলে গেল। এক অচিন্তনীয় নেশাঘোর মুহূর্তের মাঝে সে বন্দী হতে চলেছে ইতোমধ্যেই। তা সে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে। কিন্তু তারপরও কেন যেন সে পিছিয়ে আসতে পারছে না। ……………………………. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin ইন শা আল্লাহ আগামীকালও এক পর্ব পাবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে