তুমি রবে ৪
.
.
অত শত ভেবে আর ফায়দা নেই। আর এক মুহূর্তও এই রুমে থাকা যাবে না। সোফা থেকে এক ঝটকায় ব্যাগটা তুলে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো সে। ঐন্দ্রী তখনো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মাহির মুখ চোখের অবস্থা দেখে ঐন্দ্রী ওকে জিজ্ঞেস করল,
– “কোনো সমস্যা?”
মাহি বলতে পারল না তার চরম বোকামির কথা। ঐন্দ্রীকে বলল,
– “আমাকে একটু অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে নিয়ে চল।”
ঐন্দ্রী মাহিকে নিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট আনোয়ার সাহেবের কাছে এলো। মাহি তার কাছে এসে নিজের পরিচয় বলতেই সে তাকে বলল,
– “আপনার জয়েনিং লেটার স্যারের কাছে। উনি আপনার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলবেন। তারপর আপনার জয়েনিং লেটার দেবেন।”
মাহির কপাল কুচকে গেল আনোয়ারের কথা শুনে। এমনিতেই সে প্রচন্ড ঘাবড়ে আছে তার উপর আবার তার কাছে ভাইবা এক্সাম দেবে! ঐন্দ্রী মাহিকে বলল,
– “কার রেফারেন্স ছিল মাহি?”
মাহি নার্ভাসনেস মুখ করে বলল,
– “আমার দাদুর বন্ধুর ছিল। উনি কথা বলে আমাকে এখানে পাঠালেন।”
– “রেফারেন্স থাকলে তো কোনো ভাইবার প্রয়োজনবোধ পড়ে না।”
আনোয়ার তখন বলল,
– “দুঃখিত আপনাদের কথার মাঝে কথা বলার জন্য। আসলে যত রেফারেন্সই আসুক না কেন, আমাদের স্যার এত স্ট্রিক্ট যে কারো রেফারেন্সকেই উনি তোয়াক্কা করেন না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর থেকে হলেও না। আপনি আর সময় নষ্ট না করে ওই সামনে স্যারের কেবিনে চলে যান।”
মাহি পুরো থমকে গেল। তার হাত পাও অসাড় হয়ে এলো মনে হলো। মাহিকে রীতিমতো ঘামতে দেখে ঐন্দ্রী আনোয়ারের ডেস্ক থেকে পানির গ্লাস নিয়ে মাহির হাতে তুলে দিলো। মাহি পানিটা শেষ করে গ্লাসটা রেখে ঐন্দ্রীর হাত ধরে মিনতির সুরে বলল,
– “লাস্ট হেল্প কর দোস্ত। আমি ওনার সামনে একা যেতে পারব না। তুই চল না আমার সাথে।”
ঐন্দ্রী ইতস্তত করে বলল,
– “এটা তোর ভাইবা মাহি। আর ভাইবার সময় কারো কোনো ফ্রেন্ডস, রিলেটিভ গ্রহণযোগ্য নয়।”
– “আরে তা কি আমি জানি না? কিন্তু তাও তোকে যেতে হবে। উনি তো তোর বন্ধু মনে হলো। তুই গেলে কিছু বলবে না। আমি তোর পায়ে পড়ি বোন। চল না! আমার চাকরিটা কোনো প্রয়োজন নেই এখন আর। শুধু দাদুর সম্মান রক্ষার্থে আমি ওই কেবিনে ঢুকব। ওনার প্রশ্নের উত্তর জানলেও দেবো না আর না জানলে তো দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই।”
– “তুই এত নার্ভাস হচ্ছিস কেন হঠাৎ বুঝলাম না। তুই তো এমন ছিলি না মাহি। আর এসব কী কথা? উত্তর জানলেও দিবি না মানে কী? চল তুই, আমি যাচ্ছি তোর সাথে। পাগল একটা!”
.
ঐন্দ্রী ডোর নক করে আশফির পারমিশনে কেবিনে ঢুকল। তারপর আশফিকে বলল,
– “একটু কথা ছিল আশফি।”
আশফি ঐন্দ্রীকে বলল,
– “ব্যক্তিগত সম্পর্ক অফিসের বাহিরে ঐন্দ্রী। অফিসে আমাকে নাম ধরে না ডেকে স্যার বললে খুশি হবো। আর দুঃখিত এখন আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। ভাইবার সময় হয়ে গেছে। কিছু রেফারেন্সগত লোক আছে। আগে তাদের ভাইবাটা নিয়ে তারপর আমরা বাকি সবার ভাইবা নেব। আপনি পরে আসুন।”
অফিস রুলসের প্রতি আশফির এত বেশি স্ট্রিক্ট হওয়াটা দেখে ঐন্দ্রীর রাগে আর অপমানে মুখ থমথমে হয়ে উঠল। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক রেখে একজন অফিসের কর্মী হয়ে বলল,
– “স্যরি স্যার। নেক্সট আর ভুলগুলো হবে না।”
ঐন্দ্রী গটগটিয়ে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে। মাহির দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঐন্দ্রী মাহিকে বলে গেল,
– “ওখানে কাউকে অ্যালাও করবে না। তুই যা, গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাইবা এক্সাম দে।”
মুখটা অনাহারীর মতো করে অগত্যা মাহি আশফির কেবিনে ঢুকল। এত বেশি বিব্রত মাহি আগে কখনো হয়নি। কিন্তু যখনই এই লোকটার সামনে সে আসে, ঠিক কোনো না কোনোভাবে ওকে বিব্রত হতেই হয়। আর এখন এত বেশি বিব্রত হওয়ার একটায় কারণ, এই লোকটা তখন তাকে লক্ষ্য করেছিল কি না। যদি করে থাকে তবে তার এখনকার এক্সপ্রেশনেই তা প্রমাণ পাবে। মাহি তার নার্ভাসনেস খুব একটা কাটাতে পারল না। মুখটা শুকনা করে টেবিলের কাছে এসে অনুমতি চাইল,
– “বসতে পারি?”
আশফি দু হাতের উল্টো পিঠে থুঁতনি ভর করে মাহির দিকে তাকাল। মাহির ভেজা শরীরের পা থেকে মাথা অবধি তার দৃষ্টি বিচরণ করতে থাকল। ভেজা কাপড় শরীরের সঙ্গে লেপ্টে শরীরের গঠন বোঝা যায় বলে মাহি আগেই ওড়না দিয়ে সারা শরীর ঘিরে নিয়েছিল। আশফির নজর থামল মাহির পেটের ওপর। ওড়নাতে শরীরের সবজায়গা ঢাকা পড়লেও ভুলবশত পেটের ওপরটা আর ঢাকা পড়েনি। কাপড় পেটের সঙ্গে লেপ্টে তার নাভির গভীরতা আশফির পরিমাপ করা হয়ে গেল। কিছুটা বিব্রত হয়ে সেখান থেকে দ্রুত দৃষ্টি প্রস্থান করে মাহিকে বসার অনুমতি প্রদান করল। মাহির প্রাথমিক পরিচয় জেনে আশফি ঠোঁট চোঁখা করে বলল,
– “ওওও, তো আপনিই আমার দাদার বন্ধুর নাতনি? তাহলে আপনার আর কী ভাইবা নেব বলুন তো। আপনি এমন একজন মানুষের রেফারেন্স নিয়ে এসেছেন ভাইবাতে আপনি না টিকলেও চাকরিটা যে আপনাকে দিতেই হবে। না হলে দেখা গেল আমার চাকরিই থাকবে না। দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাতনি বলে কথা!”
থমথমে মুখে মাহি নিচে তাকিয়ে বলল,
– “আপনার যা জিজ্ঞাসার তা জিজ্ঞাসা করুন। আমি বাকিদের মতো নিজের যোগ্যতা দ্বারাই চাকরি নেব।”
– “দারুণ। ঠিক আছে, তবে তাই হোক।”
আশফি কর্মাস সংক্রান্ত মোট তিনটি প্রশ্ন করল মাহিকে। কিন্তু মাহি সে প্রশ্নের কোনো উত্তরই দিতে পারল না। আশফি শেষ প্রশ্ন করল বাংলাদেশের প্রথম বস্ত্র শিল্প সম্পর্কে। সেখানেও মাহির অপারগতা। কিন্তু মূল কথা মাহি ইচ্ছাকৃতভাবে একটি প্রশ্নের উত্তরও দেয়নি। আশফি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে তখন বলল,
– “এরপর আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই ম্যাম।”
– “ধন্যবাদ।”
মাহি চেয়ারটা ছেড়ে উঠতে গেলে আশফি তখন বলল,
– “আপনার সিভি দেখে যা বুঝলাম আপনি তেমন মেধাবী স্টুডেন্ট ছিলেন না। যাই হোক, পুঁথিগত বিদ্যার চাইতে আমি বেশি পছন্দ করি পরীশ্রম আর নিষ্ঠা। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আপনি এত দূর অবধি এসেছেন, তাতে পরিষ্কার এ দুটো গুণই আপনার মাঝে আছে।”
আশফি জয়েনিং লেটারটা টেবিলের ওপর রেখে বলল,
– “এটা নিয়ে যান। কাল থেকে ছাতা মাথায় করে সময় মতো অফিস জয়েন করবেন। আর হ্যাঁ, আপনার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে আপনি এই চাকরি করতে ইচ্ছুক নন। যদি আপনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সমস্যাকে ইস্যু করে এই চাকরিকে রিজেক্ট করে থাকেন তবে আপনি শুধু এখানে নয়, দেশের কোথাও আপনি চাকরি করতে পারবেন না। করলেও তা স্থায়ী হবে না। আমার জীবনে আমার কারো সঙ্গে পার্সোনাল প্রবলেম থাকলে তা এক স্থানে আর তার সঙ্গে আমার বিজনেস বা কাজ সংক্রান্ত ব্যাপার তা অন্য স্থানে। এ দুটোকে আমি কখনোই এক জায়গায় রাখি না। আমার জীবনে তা ভিন্ন স্থানে অবস্থান করে। আর এই পদ্ধতিতে যে বাহিরে বা সমাজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সে সব পারে। জীবনে সাফল্য, সম্মান, টাকা ইনকাম সব পারে। এখন আপনি বিবেচনা করে এই লেটারটা অ্যাক্সেপ্ট করতে পারেন।”
খুব ধ্যান দিয়ে মাহি আশফির কথাগুলো শুনল। আশফি মানুষটাকে তার পছন্দ না হলেও তার কথাগুলো মাহির বেশ ভালো লেগেছে। সত্যিই সে টিনেজারদের মতো আবেগ ইমোশোন দিয়ে ভেবে চাকরি না করার ব্যাপারটা ভেবেছিল। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তটা একেবারেই ভুল। টেবিলের ওপর থেকে সে লেটারটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। এত সময়
মাহি একটা ব্যাপার খেয়াল করছিল আশফি তার ভাইবা নেওয়ার সময় থেকে এখন অবধি দৃষ্টি নত করে তার সঙ্গে কথা বলেছে। আর তার চোখের দৃষ্টি বা মুখের এক্সপ্রেশন, কথা কোনো কিছুতেই মনে হয়নি সে তখন মাহিকে লক্ষ্য করেছিল। মাহি যেন বিরাট বড় লজ্জার হাত থেকে বাঁচল। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লেটারটার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “অতি সভ্য আচরণ দেখানো হলো বুঝি? একদম চোখ নিচে রেখে কথা বললে প্রমাণ হয়ে যাবে আপনি একজন ভদ্র মানুষ? আমার চাকরি আমি করব, কিন্তু আপনি যদি এখানেও আর কোনোরকম লুচ্চামি দেখাতে আসেন তাহলে তা পুরো অফিসে জানিয়ে আপনার রেপুটেশন নষ্ট করে তারপর চাকরি ছাড়ব আমি।”
.
.
সারাদিনের কর্মব্যস্ততা কাটিয়ে সন্ধ্যায় আশফি বাসায় ফিরল। রুমে ঢুকে ছোট ভাইকে দেখে ভ্রু কুচকে বলল,
– “তুমি এখানে?”
মুখটা ভার করে উত্তর দিলো দিশান,
– “তোমার দাদি তাড়িয়ে দিয়েছে।”
– “অবশেষে।”
আশফি গা থেকে স্যুটটা খুলতে খুলতে বলল। তারপর সোফায় বসে পায়ের জুতা খুলে টান টান হয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ল।
দিশান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
– “সামান্য চুমুই তো খেয়েছিলাম। তার জন্য বাসা থেকে বের করে দেবে?”
আশফি ঘাড় ঘুড়িয়ে বিস্মিত চোখে চেয়ে বলল,
– “দাদিকে?”
– “নিশিকে। তাকে চুমু দেওয়ার সাহস আছে? আবরার সাহেব তো আগেই ৩৪৪ ধারা জারি করে রেখেছেন। একদম কল্লা কেটে নেবে।”
– “নিশিটা আবার কে?”
– “আছে, তুমি চিনবে না।”
– “রুমে নিয়ে আসার কী দরকার ছিল?”
– “ইচ্ছা করে এনেছি? তার খুব শখ, আমার রুমে বসে আমাকে চুমু খাওয়ার। বজ্জাত মেয়েটাকে শায়েস্তা করার জন্য নিয়ে এলাম। আর তোমার দাদি আমাকেই শায়েস্তা করে ছাড়ল।”
– “রেগে গেলে আমার দাদি! আর এক্সট্রা বোনাস পেলে তখন তোমার দাদি না?”
– “বাদ দাও। যাব না এবার আর। দেখি কতদিন থাকতে পারে বুড়ি আমাকে ছাড়া। বড়জনের জন্য এতদিন হাঁ হুতাশ করছিল। আজ থেকে আমার জন্যও করতে হবে।”
– “হ্যাঁ সেটা তো দেখাই যাবে কে কার জন্য করে। আচ্ছা এখন ওঠ যা, দ্রুত কিছু বানিয়ে নিয়ে আয়।”
দিশান ক্ষেপে গিয়ে বলল,
– “বাহ্ঃ! এখানে এলে তো আবার আমাকে আর একজনের সার্ভেন্ট সাজতে হয়।”
আশফি ঘাড় কাত করে এবার চোখ গরম করে তাকাল। দিশান চেঁচিয়ে বলল,
– “যাচ্ছি।”
ফ্রিজ থেকে জুস আর কয়েকটা আপেল নিয়ে এসে আশফির সামনে ধরল। আশফি জুসটা হাতে নিয়ে বলল,
– “এগুলো তুমি বানিয়েছো?”
দিশান ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ধরে রেখে বলল,
– “কেন সুগন্ধ পাচ্ছো না? কী নাইস স্মেল! আহা!”
ফলগুলো নাকের কাছে ধরে বলল সে। আশফি উঠে জুসটুকু দিশানের মাথায় ঢেলে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
– “পনেরো মিনিট টাইম। জলদি গরম কিছু তৈরি করে ফ্যাল। না হলে কপালে কষ্ট আছে।”
সন্ধ্যাটুকু দুই ভাই আড্ডা, ফাজলামি করে কাটিয়ে রাতে ডিনার শেষে মুভি দেখতে বসল। চাইনিজ বেশ রোমান্টিক একটা মুভি চলছে তখন। আশফি দিশানের কাছে রিমোট চেয়ে বলল,
– “রিমোট দে, প্রচন্ড বোর হচ্ছি।”
দিশান মুভির দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। আশফি একই কথা এবার চেঁচিয়ে বলল। দিশান তখন মিনতির সুরে বলল,
– “প্রচন্ড রোমান্টিক একটা ফিল্ম ভাই। প্লিজ দেখতে দাও।”
– “এটাকে রোমান্টিসিজম ফিল্ম বলে না। এটাকে অ্যাডাল্ট প্লাস ফিল্ম বলে।”
– “তো আমাকে দেখে তোমার কি টিনেজার মনে হয়?”
– “আমি প্রচন্ড বোর হই এসব মুভিতে।”
দিশান ভাইয়ের কোনো কথা কানে তুলল না। এর মাঝে মুভিতে একটা সিন এলো যেখানে হিরোইনের জামা ছিঁড়ে পেছন থেকে তার নিতম্বের নিচে প্রদর্শন হচ্ছে। আর হিরো তাকে সিকিউরিটি দেওয়ার জন্য আর তাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সারা পথ তার পিছু পিছু হেঁটে তাকে আড়াল করে এসেছে। যাতে পেছন থেকে কেউ তার নিচে লক্ষ্য করতে না পারে। সিনটা বেশ মনে ধরল আশফির। কারণ তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল আজ সকালের বৃষ্টিতে ভেজা মাহিকে। সব থেকে বেশি মনে পড়ল তার কেবিনের দৃশ্যটুকু। মেয়েটা কতখানি বোকা হলে কোনোদিক না খেয়াল করে এক টানে জামা খুলে ফেলতে পারে! সে মুহূর্তে আশফির হঠাৎ করে সেদিকে দৃষ্টি আটকে যায় দৃশ্যটি চোখে পড়ে। প্রথম পলক দ্রুত ফিরিয়ে নিলেও দ্বিতীয়বার সে কোনোভাবে চেয়েও যেন চোখ ফেরাতে পারেনি। ছেলে মানুষের কাছে ধন সম্পদের চেয়ে অধিকতর লোভনীয় হলো রমণী। কোনো সুশ্রী রমণী খোলামেলা রূপে কোনো পুরুষের সামনে এলে তো সেখান থেকে একজন পুরুষের সুচরিত্রবান পুরুষ হয়ে ফিরে আসা দুসাধ্য। কারণ পুরুষেরা কোনো ফেরেশতা নয়। আশফির ক্ষেত্রেও তার বিপরীত কিছু হয়নি। আর মাহি যখন আশফির সামনে এলো তখন যেন তার কোমল আর্দ্র চেহারা আর তার সিক্ত শরীর দেখে আশফির ভেতরের কামনাযুক্ত পুরুষও ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। কিন্তু সে তো এতখানি বেহায়া কোনোদিনও ছিল না। কম সুন্দরী তার আগে পিছে ঘোরে না। বরং কিছু কিছু সময় তারা খুব প্রবলভাবে আশফিকে সরাসরি তাদের উন্মুক্ত সৌন্দর্যের ফাঁদেও আটকাতে চেয়েছে। সেই মুহূর্তেও তাদের প্রতি আশফির ভেতরের তীব্র অনুভূতি কখনোই কাজ করেনি। খুব কৌশলেই তাদের এড়িয়ে আসতে পেরেছে সে। কিন্তু আজ যে তার কী হয়ে গিয়েছিল তা নিয়ে সে নিজেও চিন্তিত। তখন সে খুব কষ্টের সঙ্গে নিজের দৃষ্টি নত রেখেছিল। আর একটিবার মেয়েটির পানে তাকালে সে নির্ঘাৎ খুন হয়ে যেত। এই দৃশ্যের কথা মনে পড়তেই আশফি আর বসে থাকতে পারল না। সোফা ছেড়ে সে রুমে এসে শুয়ে পড়ল। মাথার মধ্যে এখন ভন ভন করে মাহি নামক একটি পোকা দৌড়াচ্ছে শুধু। যাকে থামানো এই মুহূর্তে ভীষণ জরুরি। চোখদুটো বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রথম দিনের সেই অর্ধখোলা পোশাকের মাহিকে। আশফি সেদিন তাকে সুক্ষ্মভাবে লক্ষ্য না করলেও তার মনে আছে মাহির গলার নিচে একটি কালো কুচকুচে বড় তিল। যা শুধু পোশাক খুললেই প্রদর্শন হবে। উবু হয়ে শুয়ে ছিল আশফি। দৃশ্যটি চোখে ভাসতেই চোখদুটো খুলে দ্রুত উর্ধ্বমুখী হলো। এই মুহূর্তে এই বিশ্রীকর চিন্তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ঘুম হলো একমাত্র কার্যকরী টনিক। বিছানা থেকে উঠে একটি নরমাল পাওয়ারের স্লিপিং পিল খেয়ে ডোর লক করে শুয়ে পড়ল আবার। শোয়ার পর সেই একই পরিণতি। মাহি নামক পোকা! কিছুক্ষণ পর মাথার মধ্যে মাহি নামক পোকাটা দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় থেমে গেল। তখন ঘুম ঘুম ভাব কেবল আশফির। চোখের অন্ধকার ঝাঁপির মধ্যে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সেই গাঢ়ো কালো তিল, কেবিনে সেই উন্মুক্ত পিঠ, সেই নাভির গভীরতা। আশফি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে অস্ফুটে প্রলাপ করে উঠল,
– “ইউ আর নট নাথিং টু স্পেশাল ফর মি। সো স্টপ ইয়োর রানিং নাও, নাও, নাও…”
তারপর সে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে তলিয়ে গেল।
.
সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠে হালকা নাস্তা সেড়ে আশফি অফিসের উদ্দেশে গেল। অফিস পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় নয়টা পঁয়তাল্লিশ বেজে যায়। কথা ছিল আজ ঐন্দ্রীকে রিসিভ করে এক সঙ্গে আসা। দাদির আদেশ ছিল যেটা। কারণ পরিবারের ভাবী নাতবউ হিসেবে হিরা ঐন্দ্রীকে বেশ পছন্দ করে নিয়েছে। আবরার সাহেবেরও এতে আপত্তি নেই। আপত্তি আশফিরও নেই। কিন্তু সে আরও কিছুদিন সময় কাটাতে চায় নিজের ব্যাচেলর লাইফ নিয়ে। অফিসে ঢুকে ফার্স্ট মিট হলো ঐন্দ্রীর সাথেই। যে অপেক্ষা করতে করতে নিজেই চলে এসেছে। তবে সে একজন নিউ ডিজাইনার হিসেবে কোম্পানিতে জয়েন করেছে। সেখানে তাকে তার কাজ ছেড়ে খামখা করিডরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশফির বেশ বিরক্ত লাগল সাথে রাগও হলো। তবে তার কোনোটাই আশফি প্রকাশ না করে তাকে এড়িয়ে সোজা কেবিনে চলে গেল। ঐন্দ্রী প্রচন্ড অপমানবোধ করে তখন দিশানের কেবিনে চলে গেল।
মাহি তার ডেস্কে বসে তার নতুন কলিগদের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত ছিল। এর মাঝে মাহির সিনিয়র খুশি রহমান মাহিকে এসে বলল,
– “তুমি নুসরাত মাহি?”
– “জি।”
মাহি দাঁড়িয়ে জবাব দিলো। খুশি বলল,
– “তুমি আমার আন্ডারে আছ। কিছু কাজ এখন বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। সবকিছু সলভ্ করে আমার কেবিনে পৌঁছে দিয়ে আসবে।”
– “ওকে।”
খুশি চলে যেতেই মাহির পাশের স্টাফ মিলি বলল,
– “তোমার নসীবই খারাপ। দেখে শুনে স্যার তোমাকে এই বদমেজাজি মহিলার আন্ডারেই দিলো? খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে মেরে ফেলার উপক্রম করে ফেলে এই মহিলা।”
এতটুকু শুনেই মাহির ভেতরটা ভয়ে কেঁপে উঠল। সে খুব ইমোশোনাল মনের মানুষ। কখন বকা খেয়ে বাচ্চাদের মতো চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলবে তার ঠিক নেই। খুব সর্তকতার সাথে মাহি খুশির দেখানো কাজগুলো কমপ্লিট করে তার কেবিনে গেল। সেখানে খুশি দেড় ঘন্টা তাকে আরও কিছু কাজ করিয়ে বলল,
– “আমি এখন একটু কফি খাব। তুমি এগুলো নিয়ে স্যারের কেবিনে যাও। আমি গেলেও যা তুমি গেলেও তাই।”
মাহি খুশির কথার কোনো হ্যাঁ না জবাব না দিয়ে গুটি গুটি পায়ে আশফির চেম্বারের দিকে যেতে থাকল। এই মানুষটার নাম শুনলেই কেমন ভেতরটা অস্থির হয়ে পড়ে তার। প্রচন্ড আনইজি ফিল করে সে। আর তার সামনে গেলে শুধু সময় গুণতে থাকে কখন সে বের হতে পারবে তার কেবিন থেকে।
আশফি যখন ল্যাপটপের দিকে চেয়ে কফি খেতে ব্যস্ত তখন মাহি চেম্বারে ঢুকল। হাতের কাজগুলো নিয়ে টেবিলের কাছাকাছি আসতেই জানালা থেকে দমকা হাওয়া এসে মাহির লাল ওড়নাটা উড়িয়ে চেয়ারের ওপর ফেলল। আর ঠিক তখনই আশফি নজর তুলে তাকাল। সে মুহূর্তে মাহির দিকে নজর গিয়ে তার কফির কিছু অংশ হাতে এসে পড়ে। আশফি যতবার মাহির সাথে মিলিত হয়েছে তাতে আশফি তাকে এটুকু চিনে গেছে মাহি এই যুগের মেয়ে হলেও তার মাঝে বিশাল লাজুকতার ব্যাপার আছে। তাই সে চেষ্টা করে মাহি যাতে তার সামনে কোনোভাবে আনইজি ফিল না করে তেমন ব্যবহার দেওয়ার। সে দ্রুত আবার ল্যাপটপের দিকে নজর ফেরাল কফিটা রেখে। আসল ব্যাপার হচ্ছে আশফি নিজেও প্রচন্ড আপডেট। দেশে, বাহিরে তার প্রচুর ফিমেল ফ্রেন্ড রয়েছে যারা বেশ খোলামেলাভাবেই তার সামনে চলা ফেরা করে। তাদের দিকে কখনো তার স্বাভাবিক নজর ছাড়া কখনো বিশেষ নজরে চোখও যায়নি। কিন্তু মাহির ব্যাপারখানা সে কিছুতেই বুঝতে পারে না। এই যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হাতে তার কফিটা পড়ল, এটা কেন পড়ল আশফি তা জানে। কারণ মাহিকে ওড়না ছাড়া দেখে তার ভেতরেও কেমন অজানা একটা বারি দিয়ে উঠেছে। বারি লাগাটার কারণ এমন যে সে নিজেও অপ্রস্তুত বা বিব্রত যেটাই হোক সে হয়েছে। যেটা তার হওয়ার কথা নয়। কারণ সে অভ্যস্ত মেয়েদের খোলামেলাভাবে দেখে। কিন্তু কেন সে মাহির ক্ষেত্রে বার বার অপ্রস্তুত আর বিব্রতবোধের শিকাড় হচ্ছে তা সে জানে না। এই কেন’র উত্তর সে কোনোভাবেই পাচ্ছে না। মাহি ছুটে এসে ওড়নাটা তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলো। তারপর কাগজের ফাইলগুলো টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল,
– “খুশি ম্যাম পাঠিয়েছেন।”
আশফি তার উত্তরে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে সম্মতি জানাল মাথা নাড়িয়ে। তারপর ফাইলগুলো চেক করতে শুরু করল। মাহি জিজ্ঞেস করল,
– “আমি কী আসব?”
আশফি ফাইলের দিকে ভ্রু কুচকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে বলল,
– “না বসুন। এই কাজগুলো এখনো কিছুটা ইনকমপ্লিট দেখছি।”
আশফি খুব নম্রতার সঙ্গে ফাইলের কাজগুলো মাহিকে বুঝিয়ে দিতে শুরু করল। যেখানে অন্য কেউ হলে মাহি নতুন হওয়াতে হয় তাকে কথা শুনাতো বা তার সিনিয়রকে ডেকে দুজনকে এক সঙ্গেই বকা দিতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আশফি নতুনদের সঙ্গে খুব ক্লোজলি মিশে তাদের কাজে সে নিজেই সহায়তা করে। কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্য জায়গায়। একে তো সে কিছুক্ষণ আগের ঘটনার জন্য অপ্রস্তুত তার উপর বাহিরের বাতাসের তেজ এত বেশি যে বার বার মাহিকে কাজগুলোর সঙ্গে ওড়নাও আর এক হাতে সামলাতে হচ্ছে। যার জন্য মাহি বার বার কাজ থেকে অ্যাটেনশন হারাচ্ছে আর সেই সাথে আশফির অ্যাটেনশনও বারবার মাহির দিকেই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আশফি ডিস্টার্বড হয়ে কলমটা টেবিলের ওপর ঠাস করে রেখে মাহির দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে তাকে বলল,
– “কী সমস্যা আপনার?”
……..……………………….
(চলবে)
– Israt Jahan Sobrin