তুমি রবে ৩৯

0
1938
তুমি রবে ৩৯ . . বাড়িটা পুরো শ্মশানে পরিণত হয়েছে যেন। এত বড় অপমান বাহিরের মানুষের সামনে এসে করে গেল তাও আবার মাহির বন্ধুই! পরিবারের সব থেকে আদরের আর ভালোবাসার মানুষগুলোই কেন এত বেশি কষ্ট দেয়? এই সমাজে মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর শুধু এক সম্মান ছাড়া আছেই বা কী? যখন আলহাজ অসচ্ছল ছিলেন তখন তাঁর পরিবারটাকে সে আর তাঁর স্ত্রী মনিরা কত সুন্দরভাবে আগলে রেখেছিলেন। অভাব, কষ্ট এসব তাঁরা তাঁদের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে খুব কম পেতে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে আলহাজ দিশেহারা হয়ে ভাবতেন ড্রাইভারি, কর্মচারী যা হওয়া প্রয়োজন তা হয়েই সংসার টিকিয়ে রাখবে। তবুও বাচ্চাগুলোকে অভাবের মধ্যে রাখবে না। কিন্তু আত্মসম্মানের ভয়ে এই ধরনের মানুষগুলো না পারে ছোট কাজ করতে আর না পারে বড় কিছু করতে। এসবের অভাব থাকলেও সম্মানের অভাব তাঁর কোনোকালই ছিল না। রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরিভাবে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করতে থাকল। তখনো মানুষগুলো তাঁকে সেই পূর্বের সম্মানই প্রদান করে গেছে। কিন্তু আজ এ কী করে গেল তাঁর নাতনি? কলিজা তাঁর ছিঁড়ে আসতে চাইছে যেন। তবে নাতিটার সঙ্গে শেষবারের মতো হলেও কথা বলা উচিত ছিল। . – “আন্টি ফোন করেছিল কতবার। রিসিভ করলি না কেন?” মাহি অফিসের জন্য রেডি হতে হতে দিয়াকে জবাব দিলো, – “সময় হোক। ধরব।” – “আমি চুপ থাকতে পারছি না মাহি। ঐন্দ্রীকে অন্তত কিছু বলতে দে।” মাহি ফোনটা ব্যাগে ভরে দিয়াকে বলল, – “আমি তো এখানে ঐন্দ্রীর দোষ দেখছি না। তুই যদি এখন দেখিস তোর দিশানকে কোনো মেয়ে বাজেভাবে আকর্ষণ করতে চাইছে নিজের দিকে, তুই তা সামনে দেখেও চুপ থাকতে পারবি?” – “ওর দোষ এটাই ও বাড়ি বয়ে এসে এমন আচরণ কী করে করতে পারল? এটা কি ওর ভদ্রতার পরিচয়?” মাহি ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক পরে নিয়ে দিয়াকে উত্তর দিলো, – “আমি তো পেছনের মানুষটার আচরণে স্তব্ধ দিয়া। আর তার ইচ্ছাতেই ঐন্দ্রী আমার বাড়ি এসে এত কিছু বলে যেতে পেরেছে আমাকে। তাই ঐন্দ্রীকে বলার মতো আমার কিছুই নেই। তবে বলব না তা নয়। সময় আসুক।” মাহিকে দেখে দিয়া একটু বিস্মিত সুরে বলল, – “আমার বান্ধবীটাকে তো আজ দারুণ লাগছে। ভেতরের কষ্ট ডেবে রাখার দারুণ পদ্ধতি।” মাহি শুধু মৃদু হাসলো দিয়ার কথাতে। মাঝে প্রায় তিন দিন মাহি অফিস কামায় করেছে। হঠাৎ করেই সে জ্বরে পড়েছিল। আর এটা নতুন নয়৷ সে কোনো কিছুতে অনেক বেশি কষ্ট পেলে, অনেক বেশি দুশ্চিন্তা করলে তার শরীরে জ্বর চলে আসে। জ্বর ছুটতেই সেও আজ অফিস ছুটছে। অফিস পৌঁছে লিফ্টে ঢোকার মুহূর্তে আজ আশফি একটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি করল। মাহির ঢোকার মুহূর্তে সে লিফ্ট বন্ধ করে দেয়। তবে মাহি ছিল কোনো রিঅ্যাকশন ছাড়া। অফিসে ঢুকে কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ পরই মাহিকে হৃদয়ের সঙ্গে যেতে হলো শ্যুটিং স্পটে। বর্তমান তার কাজের প্রেশার অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে আশফি। ফটোশ্যুটের আজ কো অ্যাক্ট্রেস তনুজা। অনেক সাধনার পর সে আজ তার পূর্বের স্থান ফিরে পেয়েছে। অবশ্য এর পেছনে পুরো অনুদানই আশফির। তনুজা এসে এখনো পৌঁছায়নি। সে আসার পরই ফটোশ্যুট শুরু হবে। এক কাপ চা নিয়ে পত্রিকাটা হাতে ধরে কেবল আরাম করে বসেছে মাহি। বিনোদনের অংশে এসে চোখজোড়া তার কপালে উঠল হঠাৎ। এই হেডলাইনের নিউজগুলো আদৌ কি আশফি দেখেছে? সেটাই ভাবছে সে। দেখলে তো আজ সে তনুজাকে মার্ডার করতেও ভাববে না। এসব ভাবতেই গাড়ি থামার প্রকট আওয়াজ পেলো মাহি। পিছে ঘুরে দেখল আশফি মাহবুব তার রণমুর্তি ধারণ করে ফটোগ্রাফার তওহীদের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। তওহীদ নিজেও খবরটা দেখেছে মাত্র। পেপাড়টা তার গায়ে ছুঁড়ে মেরে চিল্লিয়ে সে তওহীদকে বলল, – “এগুলোর মানে কী তওহীদ? এই ফটোগুলো এত বাজে অ্যাঙ্গেলে কী করে তুলতে পারো তুমি? আর পত্রিকাতে এগুলো নিউজই বা হলো কী করে?” – “স্যার আপনি আমাকে ভিক্টিম করছেন? আমি কেন এই ছবিগুলো এভাবে তুলব?” – “তুমি ছাড়া ফটোশ্যুটের কাজে এখানে আর কে আছে? কোনো রিপোর্টারও তো এখানে ঢুকতে পারমিশন পাবে না। আমি তার ড্রেস চুজ করে দিয়েছি, তাকে নানাভাবে ডিরেকশন দিয়েছি মাঝে মাঝে। সেই মুহূর্তগুলো এত খারাপ ইঙ্গিত করে তোলা হয়েছে। আর নিউজ করা হয়েছে গোপন সম্পর্কে লিপ্ত শিল্পপতি আশফি মাহবুব আর মডেল তনুজা। তার সঙ্গে এই বাজে ছবিগুলোও অ্যাটাচড্ করেছে। এগুলো এখান থেকে না তোলা হলে তো কীভাবে গেল ওদের কাছে? তওহীদ সত্যি কথা বলো। আমি কিন্তু তোমার ক্যারিয়ার শেষ করে দেবো। তুমি আর তনুজা দুজনে মিলে এমন একটা গেম খেলেছো।” তওহীদ নত হয়ে কেঁদে ফেলল এবার। কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, – “এতটা খারাপ আর হীন মন মানসিকতা আমার নয় স্যার। তনুজা আমার বন্ধু হলেও আমি আমার পেশাতে অনেস্ট। আপনি বিশ্বাস করেন।” মাহি এবার কথা বলল। – “সারাটা দিন আমি তওহীদ ভাইয়ের সঙ্গে থেকেছি। তিনি এক মুহূর্ত তার সময় কাজে ছাড়া অন্য কিছুতে ব্যায় করেননি। ইভেন তাকে আমি তার এই চেয়ারটা ছাড়া দু মিনিটের জন্য কোথাও বসতে দেখিনি। আমার মনে হচ্ছে এখানে বাকি লোকগুলোকে জেরা করা উচিত। কারণ ফোন ক্যামেরাও এখন অনেক উন্নত।” আশফি সেই আগের সুরেই বলল, – “আমার মানুষকে বিশ্বাস করার পূর্বে একবার তাকে বিচার করে দেখা উচিত ছিল।”
কথাটা পুরোপুরি যে মাহিকে ইঙ্গিত করেই বলল সে, তা মাহি ঠিকই বুঝতে পারলো। কিন্তু তার সন্দেহপূর্ণ কথা যে একেবারে মিথ্যা তা মাহি তাকে বোঝাবে। সে বলল, – “তো ক্যামেরা ফিট করে রাখতেন। এত দারুণ চিন্তাচেতনা আপনার।” – “প্রমাণ পেলে আমি কাউকে ছেড়ে দেবো না। আর তওহীদ আমি জানি না কে দোষী। কিন্তু তনুজাকে আমি সত্যিই নিঃশেষ করে দেবো। মাথা তুলে দাঁড়ানোরও ক্ষমতা থাকবে না। তাকে ফোন করে এখনি আসতে বলো।” তওহীদ তার আদেশ মেনে বেশ কয়েকবার ফোনে ট্রাই করল তনুজাকে। অনেকক্ষণ পর তনুজার অ্যাসিসটেন্ট ফোন ধরে বলল সে গতকাল রাতেই ঢাকার বাইরে গেছে। আশফির আর বুঝতে কিছু বাদ রইল না। তনুজা তার শোধ তুলেই গা ঢাকা দিয়েছে। আশফির পায়ের রক্ত মাথায় চেপে গেল যেন। দাঁত কিড়মিড় করে সে বলে উঠল, – “পালিয়েছে না? আমি কি তাকে খুঁজে পাবো না? আজই খুঁজে বের করে তাকে উচিত শিক্ষা দেবো আমি।” মাহি শান্ত কণ্ঠে বলল, – “একটু ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাবা উচিত আগে আমাদের। এভাবে মাথা গরম করলে কী হবে? তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে?” – “এই তুমি কেন বাঁধা দিচ্ছো আমাকে? তারমানে তুমি নিজেও এর সঙ্গে যুক্ত না? আগে তনুজাকে খুঁজে বের করি তারপর সবাইকে দেখছি।” আশফি আর কারো কথা কানে না তুলে হনহনিয়ে চলে গেল গাড়ির কাছে। আনোয়ারও এসেছিল আশফির সঙ্গে। সে ভীতি কণ্ঠে বলল, – “বহুদিন পর স্যারের এই রূপ। আজ তান্ডবলীলা করেও ফেলতে পারে উনি।” মাহি আনোয়ারের এ কথা শুনতেই দৌঁড়ে এসে আশফির পাশে সিটে এসে বসে পড়ল। একে তো সে মাহিকেও সন্দেহের কাতারে ফেলেছে যা মাহি তাকে বোঝাতে চায় যে সে এখানে কতটা নির্দোষ। আর তার থেকেও বড় ব্যাপার আজ সে এক বিশ্রী ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে তনুজার সঙ্গে৷ এতে প্রেস মিডিয়া আরও বেশি দুর্দান্তকর নিউজ করার সুযোগ পাবে৷ যা এই মুহূর্তে আশফির মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। পত্রিকার নিউজগুলো মাহিকেও প্রচন্ড রাগিয়ে দিয়েছিল। তাই এখানে আশফির রাগ যে অসমীচীন নয় তা সে বুঝতে পারছে। কিন্তু সে তাই বলে আশফির মানহানি ব্যাপারটা হজম করতে পারবে না। যেভাবেই হোক আশফির রাগ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আশফি তিরিক্ষি মেজাজে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে মাহিকে বলল, – “গাড়ি থেকে বের হও।” জিদ্দি সুরে মাহি বলল, – “পারব না। অফিসে যাওয়ার পর গাড়ি থেকে নামব।” মাহির দিকে কতক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকল শুধু। এরপর আর কোনো কথা খরচ করল না তার জন্য। গাড়ি টেনে চলে এলো মেইন রাস্তাতে। তার গাড়ি চালানোর স্পিড মাহির হার্ট ব্লক করে দেওয়ার মতো। ড্রাইভিংয়ের মাঝে মাহি বহুবার তাকে অনুরোধ করল গাড়ি আস্তে চালাতে। কিন্তু তা আশফি ভ্রুক্ষেপ করল না। এরপর মাহি দেখল আশফি শুধু সোজা পথে চলছে। এর মাঝে অবশ্য ফোনে যেন কাদের সঙ্গে কথা বলেছে সে। মাহি শুধু এটুকু বুঝতে পারল তনুজা হয়তো এখন চট্টগ্রাম এবং আশফি সেদিকেই ছুটছে তার গাড়ি নিয়ে। তখন মাহি চেঁচিয়ে উঠে বলল, – “আশফি প্লিজ গাড়ি থামান। আমি যাব না কোথাও। আমি এখনি গাড়ি থেকে নেমে যাব।” আশফি তার কোনো কথায় কানে তুলল না। মাহি এবার আরও জোরে চিল্লিয়ে বলল, – “আরে প্লিজ গাড়ি থামান। আমি যাব না বললাম তো। আপনি যেখানে যাওয়ার যান। আমাকে নামিয়ে দিয়ে যান।” আশফি এবার ড্রাইভ করার মাঝে উত্তর দিলো, – “গাড়িতে ওঠার আগে মনে রাখা উচিত ছিল।” – “আচ্ছা বাবা আমার ভুল হয়েছে। এবার প্লিজ আপনি গাড়িটা থামান। আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে আগ্রহী না।” আশফি নিশ্চুপ। মাহি এবার আশফিকে ধাক্কা মারতে মারতে চেঁচিয়ে বলল, – “আশ্চর্য থামান না কেন?” আশফি ধমক দিয়ে বলল, – “একদম ড্রাইভিংয়ের সময় বিরক্ত করবে না। হাত পা বেঁধে গাড়ির ডিকি তুলে ঢুকিয়ে রাখব।” মাহি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও আবার ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, – “আপনার এত জোরে গাড়ি চালানোর ফলে আমার এখন মাথা ঘুরছে, বমি পাচ্ছে। গাড়ির মধ্যেই বমি করে দেবো কিন্তু।” আশফি কিছু বলল না। শুধু ভেতর থেকে ওষুধের বক্স বের করে এক পিস ট্যাবলেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, – “এটা খেয়ে চুপচাপ বসে থাকো।” মাহি চোখ কটমট করে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে একটার জায়গা দুটো খেয়ে দিলো। আশফি বাঁধা দিতে গিয়েও দিলো না। কারণ সেটা ঘুমের ওষুধ ছিল। মাহির বিরক্ত থেকে রক্ষা পাওয়ার হাতিয়ার কেবল সেটা। . . সমুদ্রের অপার সৌন্দর্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সূর্যের অস্তমন দৃশ্য, জেলেদের মাছ ধরা, ঝাউ বনে বাতাসের কানাকানি, উত্তাল সমুদ্রের ফেনায়িত তরঙ্গমালা। সাগরের হৃদয় উত্তাল করা ঢেউ আর বাতাস যেন আশফির বুকের ভেতর জমে থাকা সব কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। গাড়ির কাছে এসে গাড়িতে বসে থাকা গাঢ় নিদ্রায় নিদ্রারত মাহিকে এসে একবার দেখে নিলো সে। সেই যে ঘুমিয়েছে! এখনো সে ঘুমন্ত। এরপর আবার নেমে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে বালুকারাশির ওপর। নিচে তাকিয়ে দেখতে থাকল বালুকারাশির মাঝে কাঁকড়াদের খেলা করার দৃশ্য। বাম দিকে দূরে দেখা যায় গহিরার জেলে পল্লী, যেখানে জেলেদের কর্মযজ্ঞে মুখরিত থাকে সারা বেলা। মাথা গরম করে এলেও এই জায়গাটাতে আসার পর বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণ করার সুযোগ তো মিলেছে। এখানের সন্ধ্যার সৌন্দর্যটা যেন স্বর্গরূপী এক দৃশ্য। আশফির একবার ইচ্ছা করল ভেজা বালুকণার ওপরই বসে এই হৃদয় শান্ত করা বাতাসের ঘ্রাণ নিতে। কিন্তু দূরের আকাশে চোখে যেতেই মেঘাচ্ছন্ন রূপ দেখতে পেলো তার। তারপরই হঠাৎ এই তীব্র শীতের মাঝেও ঝুম বৃষ্টির আগমন ঘটল। গাড়ি অনেক দূরে বিধায় দৌঁড়ে যেতে গিয়েও অনেকটা ভিজে গেল সে। গাড়িতে ঢুকে হাত দিয়ে তার চুলগুলো ঝারার মুহূর্তে পানির ছিটা মাহির মুখে গিয়ে পড়ল ক’বার। আবার এদিকে প্রচন্ড শীত শীত অনুভব হচ্ছে মাহির। গাড়ির মধ্যে এসি তখনো অন। চোখ খুলে তাকিয়ে নজর পড়ল আশফির ওপর। চুলের মাঝে আঙুল চালাতে চালাতে ফোনে যেন কী দেখছে সে। সোজা হয়ে বসে নিজের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করল মাহি। এই অসময়ে বৃষ্টি দেখে খানিটা বিরক্ত লাগল তার। আবার চারপাশের পরিবেশটাও কেমন চেনা চেনা লাগল। – “এটা কোথায়? তনুজা কি এখানে?” বাহিরে চোখ বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করল সে। আশফির নেভানো আগুন আবার ধপ করে জ্বলে উঠল যেন। চট্টগ্রাম পৌঁছানোর পর তনুজাকে ট্রেস করতে না পেরে প্রচন্ড অস্থির লাগতে শুরু করে আশফির। এরপর হঠাৎই সে পারকী সমুদ্র সৈকতে এসে তার গাড়ি দাঁড় করিয়েছে। তার কথা মনে পড়তেই মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেল আশফির। কিন্তু কিছুই বলল না সে মাহিকে। বৃষ্টির তেজ দশ মিনিটের মধ্যেই কমে এলো। ইলশেগুঁড়ি পড়ছে এখন শুধু। আশফি মাহির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। মাহিও আর বসে থাকল না। গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নিচে নামতেই চেনা পারকী সমুদ্র সৈকত চোখে পড়ল। আশফি গাড়িটা লক করে নীরবে হেঁটে চলে গেল সামনে। মাহি এই লোকটার ভাবমূর্তি কিছুই ঠাঁওর করতে পারছে না। তনুজাকে না খুঁজে সে সি বীচে কী করছে সেটাই ভাবছে মাহি। ওদিকে আশফি তার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। দাঁড়িয়ে না থেকে মাহিও নেমে এলো বীচের ওপর। বৃষ্টি হওয়ার দরুন পর্যটকদের ভীড় কিছুটা হালকা। মাহি এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো একটা দোকান থেকে আশফি সিগারেট কিনে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে গিয়ে। মাহির এই মুহূর্তে অত্যাধিক পরিমাণ মেজাজ খারাপ লাগছে। বোকামির খেসারত এখন এই লোকটার সাথে সারাটাক্ষণ থেকে তার এই সিগারেট ফুঁকা দেখতে হবে। কী প্রয়োজন ছিল এত মায়া দেখানোর? লোকটা তো তার কেউ নয়। অথচ তার কী হলো, সম্মান থাকলো না গেল এসব এত তার ভাবার কি কোনো দরকার ছিল? কোনো দরকার ছিল না। এই লোকটা সেই ব্যক্তি যার জন্য আজ তার চরিত্রে দাগ লেগেছে৷ আর তা দেখে সেই ব্যক্তি প্রচন্ড উৎফুল্লও হয়েছিল। আজ আবার তার চিন্তা করেই তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে সে কিনা ছুটে চলে এলো তার সঙ্গে! আর বেশি সময় তার সাথে ব্যায় করা যাবে না। মাহি এগিয়ে গেল তার কাছে। আশফি আঁড়দৃষ্টিতে তাকে আসতে দেখেও নির্বিকার হয়ে রইল। – “ঢাকা যাব কখন?” আশফি নিশ্চুপ। মাহি আবার জিজ্ঞেস করল, – “কিছু জিজ্ঞেস করছিলাম। আমরা ঢাকা যাব কখন?” – “আমি কাউকে টেনে আনিনি আমার সঙ্গে।” – “আমি তা কখন বলেছি? তনুজাকে পাওয়া গেছে?” – “না।” – “ও, তো আর এখানে সময় নষ্ট করে কী হবে? আর বৃষ্টিও পড়ছে তো।” এই বলে সে হাত ঘড়িটা দেখে নিলো একবার। সময় দেখে তার চোখ কপালে উঠল। রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। সেই যে সকাল এগারোটায় বেরিয়েছে তারা৷ চট্টগ্রাম পৌঁছাতে সর্বোচ্চ ঘন্টা এক বা দেড় লেগেছে। তাও সে ঘুমিয়েছিল বলে কিছুই টের পায়নি। তাই বলে এত সময় ঘুমিয়েছে! ওষুধটা কি তাহলে ঘুমের ওষুধ ছিল? এমনটাই প্রশ্ন করল তার মন। বেশ বিস্মিত কণ্ঠে মাহি বলে উঠল, – “মানে আমি সকাল এগারোটা থেকে রাত দশটা অবধি ঘুমিয়েছি!” আশফি ভ্রুকুটি করে একবার তাকাল মাহির দিকে। এরপর আবার আর একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকল সমুদ্র পানে চেয়ে। – “আর কত সময় দাঁড়িয়ে থাকবেন? চলুন।” আশফি চড়া কণ্ঠে বলল, – “আমি কি কাউকে ধরে রেখেছি? যেতে হলে যান।” মাহি অবাকের শীর্ষে এখন! ভালোবাসা না থাকলেও নূন্যতম মানবতাবোধটুকুও কি নেই তার প্রতি? মাহি রাগে দুঃখে কিছুই যেন বলতে পারছে না। যেখানে তাকে খেয়াল রাখতেই সে ছুটে এলো। সেখানে সেই ব্যক্তিটি তার চিন্তা একবারও না করে নিজের মতো করে চলে যেতে বলল। বেশ গম্ভীর কণ্ঠে মাহি বলল, – “আমি এসেছি আপনার সঙ্গে। একা কেন যাব? আপনি আমাকে পৌঁছে দেবেন।” আশফি হালকা অবজ্ঞা ভরা হাসি হাসলো। তারপর ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার একটা নোট বের করে মাহির দিকে এগিয়ে দিলে মাহি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল তার দিকে। আশফি তখন বলল, – “ভাড়া।” মাহি চেতে উঠে বলল, – “তো আমার কাছে কি টাকা নেই? আপনার তাই মনে হলো? আপনিই আমাকে পৌঁছে দেবেন।” আশফি হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, – “তো আমাকে কিছু দিন।” – “ফাজলামি করছেন?” – “থাকলে দিন না থাকলে নিন। তারপর বিদায় হতে পারেন।” মাহি ব্যাগ থেকে টাকা বের করার জন্য ব্যাগে হাত ঢুকাতেই আশফি ঝট করে ব্যাগটা মাহির থেকে নিয়ে নিলো। তারপর ব্যাগে খুচরাসহ প্রায় সাড়ে তিনহাজার টাকার পুরোটাই নিয়ে ব্যাগ ফেরত দিলো মাহিকে। মাহি স্তব্ধ হয়ে শুধু এই দৃশ্যটুকু দেখল। এরপর চিল্লিয়ে উঠল সে। – “আপনি আমার পুরো টাকাটা নিয়ে নিচ্ছেন কেন?” আশফি তার জবাব না দিয়ে একটু দূরে বসে থাকা এক ঝালমুড়িওয়ালার কাছে গেল। তার সঙ্গে কী কথা বলছে আশফি তা শুনতে পেলো না সে। তবে কিছু কথা বলার পর টাকাটা তার পাশে বসে থাকা ছোট ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে এলো। ঝালমুড়িওয়ালাকে মাহি লক্ষ্য করল একটু। সে নির্বাক হয়েছে আশফির আচরণে তা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এবার তার চোখদুটোতেও পানি টলমল করে উঠল। আশফি ফিরে আসতেই মাহি তাকে জিজ্ঞেস করল, – “টাকাগুলো কী করলেন আপনি?” আশফি আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে বলল, – “ঝালমুড়িওয়ালাকে দিলাম।” – “সে তো আমি দেখতেই পেলাম।” আশফি কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ সিগারেট টেনে তারপর উত্তর দিলো, – “মুড়িগুলো নিচে পড়ে গিয়েছিল ওনার। প্রায় সবটাই ভিজে গেছে। বাকি কিছু ভালো অংশ ওপর থেকে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু কেউ আর কিনতে আসেনি ওনার ঝালমুড়ি। আর ওই ছোট ছেলেটা ওনার নাতি। শুনলাম নাতিটা এতিম। উনিই একমাত্র গার্ডিয়ান। আর ওনার আয়ের উৎসও শুধু এই ঝালমুড়ি বিক্রি। তাই টাকার প্রয়োজন যার বেশি তার কাছেই দিয়ে আসলাম।” – “খুবই দারুণ। কিন্তু তাই বলে পুরো টাকাটাই দিয়ে আসবেন আপনি? ওটা কি আপনার টাকা? আর আপনার নিজের কাছে টাকা ছিল না?” – “ছিল। তবে কার্ডে।” – “কার্ডে নাকি জানি না। আমার টাকাটা ব্যাক দিন। আমি বাসে করে চলে যাব।” – “ওইযে জেলে পল্লীতে গিয়ে সাহায্য চেয়ে আসুন।” – “আপনি কিন্তু প্রচুর বাড়াবাড়ি করছেন। আমি এখন যাব কী করে?” – “তা কি আমি জানি? আমি আজ ঢাকায় ফিরব না। আর আপনার নাকি এখানে রিলেটিভ আছে। তাদের কাছে চলে গেলেই তো হয়।” – “হ্যাঁ তার জন্যও তো টাকা প্রয়োজন। দিন তো আমার টাকা ব্যাক দিন।” – “টাকা নেই।” – “ভালো হচ্ছে না কিন্তু আশফি!” চকিতে ঘুরে তাকাল আশফি মাহির দিকে। কয়েক মুহূর্ত আবেগঘন বেশ নীরব চোখে সে মাহিকে দেখল। মাহি তার চাহনিতে কিছুটা মিইয়ে গিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। হঠাৎ কী মনে করে মানুষটা এভাবে তাকাল তার দিকে তা মাহি বুঝতে পারেনি। তবে তার এই চাহনিতে প্রচন্ড ধার। ভেতরটা ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার মতো। তাই তো সে বেশি সময় দৃষ্টি মেলে থাকতে পারেনি। – “আপনি কি সত্যিই ফিরবেন না ঢাকা?” – “না।” – “তবে আমাকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।” – “দায় নেই আমার।” – “তাহলে আমি কি আপনার চেহারা দেখব এখানে বসে বসে?” – “আমার চেহারা কি বিশেষ কিছু মনে হলো আপনার? ও হ্যাঁ বিশেষ কিছুই তো অবশ্যই। না হলে শাড়ির ফাঁক থেকে শরীর দেখিয়ে ইমপ্রেস করার চেষ্টা কেন?” মাহি এবার থমকে গেল তার কথাতে। তার ক্রুদ্ধ চাহনি কিছুক্ষণ গ্রাস করে নিতে থাকল আশফিকে। কিছু না বলেই সে ফিরে আসলো। কিন্তু পরক্ষণেই আবার হেঁটে এসে আশফির সামনে এসে দাঁড়িয়ে কোনো কথা ছাড়াই সমুদ্রের ভেতর আশফিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। . . চুপচুপে ভেজা শরীর নিয়ে আশফি গাড়িতে এসে বসলো। মাহির বদলে অন্য কেউ হলো চর একটাও মাটিতে পড়তো না। প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে আছে আশফি মাহির প্রতি। মাহি যেন প্রচন্ড উল্লাসে আছে। আশফি গাড়িতে উঠে চেঁচিয়ে বলল, – “অথর্ব তা জানি। পাগলও যে আছেন তা তো জানা ছিল না।” – “হু।” মাহির নির্বিকার আচরণ আশফির আরও বেশি অসহ্য লাগল। – “এখন এই ভেজা শরীরে আমি কতক্ষণ থাকতে পারব? কী করে করতে পারলেন আপনি এটা?” – “দেখতেই তো পেলেন কী করে করলাম। আপনার ভাগ্য ভালো আপনাকে মাঝ সমুদ্রে ফেলিনি।” আশফি আর কোনো কথা বাড়াল না। গাড়ি স্টার্ট করতেই পড়ল আর এক বিপত্তিতে। গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। কয়েকবার চেষ্টা করার পরও নিলো না। গাড়ির হুড উঠিয়ে সব চেক করল। তেমন কিছুই বুঝতে পারল না প্রবলেমটা কী মূলত। বাম্পারে লাথি মেরে মাহিকে বলল, – “আপনি মানুষটাই আমার জীবনে ঝামেলা। সবকিছুই নষ্ট করে দেন।” – “হ্যাঁ আমি এভিল। এখন গাড়িটা কী করে ঠিক করবেন সেটা করুন। আপনার সাথে থাকতে আমার রুচিতে বাঁধছে এখন।” আশফি বুঝতে পারল গাড়ি এখন ঠিক হওয়ার নেই। সে তার ড্রাইভারকে কল করল। কিন্ত দুঃখের বিষয় রিসিভ করল না সে। মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল তার। মাহিকে বলল, – “আমি এই অবস্থায় বাস জার্নি বা কোনো জার্নিই করতে পারব না। কোনো হোটেলে উঠব আমি। যদি পারেন তো আসুন আমার সঙ্গে নয়তো নিজের রাস্তা নিজে মাপুন।” – “আমি আমার রাস্তা মাপতে পারব না। আপনিই মাপবেন। আর আমি কোনো হোটেলেও উঠব না এই এত রাতে আপনার সঙ্গে। সাঁপকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু আপনাকে না। আমি গাড়িতেই বসে থাকব দরকার হলে।” – “ও তাহলে তো আরও ভালো। গাড়ির পাহারাদার তো জুটল আমার। ঠিক আছে আপনি উঠে বসুন আমি লক করে দিচ্ছি। এখানে কোনো হোটেল বা মোটেল কিছুই নেই। আমি বেরিয়ে পড়ছি এখান থেকে।” – “আপনি কি পাগল! আমাকে একা রেখে চলে যাবেন?” – “আপনি আমার নিজেরও কেউ না যে ভাবতে যাব আপনাকে নিয়ে। এত কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আপনার সঙ্গে। যদি ইচ্ছা হয় তো আসুন।” – “আশফি!” আশফি চলতে পথে থেমে গেল। মাহির কণ্ঠে তার নাম সে যতবারই উচ্চারণ হতে শুনেছে তার শুধু একটা জিনিসই বারবার মনে হয়। খুব আপনজন তাকে ডাকছে। ফিরে তাকাল আশফি। মাহি মুখটা মলিন করে বলল, – “আমি সত্যিই কোনো হোটেল উঠব না।” আশফি শীতল কণ্ঠে এবার বলল, – “আপনার রিলেটিভের অ্যাড্রেস বলুন। পৌঁছে দিচ্ছি।” – “সেই জায়গাটুকুও তো রাখেননি।” আশফি এর প্রেক্ষিতে কিছুই বলল না। মাহি সেদিনের পর থেকে শুধু একটা ব্যাপারই ভেবে চলেছে। এমনটা কি সত্যি আশফি করতে পেরেছে? তবে কি সে ভুল চিনেছে আশফিকে? . এসে পৌঁছালো টিলার ওপর ছোট্ট একটা বাড়ির সামনে। আশফির এক সময়ের ভার্সিটির বন্ধু রিফাত থাকতো এখানে। চাকরির সুবাদে তাকে এখন সিলেট থাকতে হয়। তার সঙ্গে যোগাযোগ করল আশফি বহুদিন পর। আর যোগাযোগ হওয়ার পরই জানতে পারল সে আর তার বউ প্রায় এক বছর হলো সিলেট চলে গেছে। তবে তার বাসাটা ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে নির্দ্বিধায় সে আশফিকে থাকতে বলেছে। তবে এখানেও মাহি ঝামেলা করল একটু। যেহেতু বাসায় কেউই নেই সে কিছুতেই আশফির সঙ্গে একা থাকবে না সেই বাসায়। আশফি খুব ধৈর্যের সাথে মাহির অত্যাচারগুলো সহ্য করে যাচ্ছে। তবে ঝামেলা হলো বাসাতে তালা ঝুলতে দেখে। রিফাত তাকে জানালো তালাটা কোনোভাবে ভেঙে ফেলতে পারলে ভেঙেই ঘরে ঢুকুক তারা। এই সময়ে আশফি তালা ভাঙার জন্য লোহাদন্ডই বা কোথা থেকে পাবে! সেটাই ভাবতে থাকল দাঁড়িয়ে৷ আবার লোকালয়ে ফিরে এসে একটা ছোটাখাটো লোহার দন্ড সংগ্রহ করে নিয়ে এলো কোনো একটি দোকান থেকে। এদিকে মাহি তাকে বকাঝকা করতেই আছে। সে কেন তাকে নিয়ে একটা ফাঁকা বাসায় উঠবে? আশফি মাঝপথে থেমে গিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, – “বিশ্বাস করুন, আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে একটা থাপ্পড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিতাম। আমার রুচির প্রবলেম হয়েছিল কিছুদিন আগে। বান্দরবন থেকে ফিরে আসার পর আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি সত্যিই আমার রুচি কত নিচে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আমার রুচি এতটাও নোংরা হয়নি যে আপনাকে ছুঁয়ে হাত গন্ধ করব।” কথাগুলো শেষ হতেই আশফি হাঁচি দিতে আরম্ভ করল। মাহি এবারও আশফির কথার কোনো উত্তর দিলো না। শুধু মনে মনে বলে গেল আল্লাহকে, – “অন্তত সেই দিনটা অবধি আমার ধৈর্যধারণের ক্ষমতা প্রদান করো মাবুদ।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাহি আশফির পিছু পিছু চলে এলো সেই টিলার ওপর বাড়িটার সামনে। বেশ কয়েকটা আঘাতে আশফি তালা ভাঙতে সক্ষম হলো। রুমে ঢুকে ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে সুইচটা খুঁজে নিলো আশফি। লাইট জ্বলতেই তারা আবিষ্কার করল একটা প্রায় ফাঁকা এক রুমের মাঝারি আয়তনের ঘর। তার সঙ্গে কিচেন, বাথরুম আর সামনে প্রশস্ত একটা বারান্দা। রুমের মধ্যে ফার্নিচার বলতে একটা খাট, পাশে একটা ইজিচেয়ার আর রুমের বামদিকে পুরোনো একটা কাঠের আলমারি। এছাড়া টুকিটাকি কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো খাটের ওপর একটা রেজাই অবধি নেই। শুধু একটা বেশ পুরোনো পাটি বিছানো। আর বেডশিট তো দূরের কথা। তবে ভুলবশত তার বন্ধু নিশ্চয় একটা বালিশ ফেলে গেছে। বন্ধুর আশ্রয়দানের প্রশংসায় আশফি পুরোই স্তব্ধ। দরজাটা বন্ধ করে দিলো আশফি। বাইরে থেকে হু হু করে বাতাস ঢুকছিল ভেতরে। কিন্তু অবস্থা খুব বেহাল তার। সেকেন্ডে সেকেন্ডে হাঁচি দিচ্ছে সে। তাকে নাক টানতেও দেখল মাহি। আশফি গায়ের ভেজা শার্টটা খুলে ফেলে চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে বসলো। ঠান্ডাতে তার ফর্সা শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে বারবার। তাও স্পষ্টভাবে চোখে পড়ল মাহির। কিছুটা দোনোমনা করে মাহি তাকে বলল, – “চেঞ্জ করার মতো কিছু পেলে প্যান্টটাও পাল্টে নিন।” অত্যন্ত বিরক্তি চোখে তাকাল আশফি তার দিকে৷ তার বিরক্ত হওয়ার ব্যাপারটাও মাহি বুঝতে পেরে বলল, – “হ্যাঁ বুঝলাম কারো ব্যবহৃত জিনিস ব্যবহার করেন না হয়তো। কিন্তু দুঃসময়ে এত কিছু মাথায় রাখলে চলে না।” আশফি কিছুই বলল না তাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই উঠে এসে আলমারিটা খুলল সে। ভাগ্যিস এটা লক করা ছিল না। কিন্তু হতাশ হলো খুলে। ধুলো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না তার। ঠাস করে আলমারিট্ বন্ধ করার আওয়াজ পেলো মাহি। – “কিছুই নেই?” – “না।” – “একটা লুঙ্গিও না?” আশফি এবার সরু চোখ করে তাকাল মাহির দিকে। মাহি কিছু না বলে দ্রুত বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। হঠাৎ আবার বেরিয়ে এসে তার গায়ের চাদরটা আশফির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, – “লুঙ্গির কাজ করবে। অন্তত হাঁটু অবধি।” আশফির গরম দৃষ্টি দেখে মাহি কিছুটা গলা উঁচু করে বলল, – “নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। ঠান্ডায় ভেজা কাপড় পড়ে থাকলে ডাবল নিউমোনিয়াও হতে পারে৷ তাই দিয়েছিলাম।” চাদরটা খাটের ওপর রেখে মাহি বাথরুমে ঢুকল আবার। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চাদরটার দিকে তাকিয়ে থেকে সেটা হাতে তুলে নিলো আশফি। বাথরুমের দরজায় এসে নক করতে শুরু করল। – “একটু দ্রুত বের হোন।” বাথরুমের দরজা খুলে মাহি বের হতেই আশফি তার ভেজা শার্ট আর চাদরটা হাতে করে ঢুকে গেল বাথরুমে। কিছুক্ষণ পর চাদরটা লুঙ্গির মতো করে পরে বেরিয়ে এসে তার ভেজা শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে দরজা খুলে বারান্দাতে চলে গেল। সেগুলো মেলে দিয়ে চেয়ারটাতে এসে আবার বসে পড়ল সে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। কথাটা একদমই সত্য। মাহি না চাইতেও এই নতুনরূপের আশফিকে বারবার আঁড়চোখে দেখতে থাকল সে। আশফি তা ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে কয়েকবার। হঠাৎ কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল আশফির শরীর। বুঝতে পারল সে ঝাঁকুনি দিয়ে জ্বর আসছে শরীরে। একে তো বৃষ্টির পানিতে ভিজে চুলের পানি চুলের মধ্যেই শুকিয়েছে, সেই অবস্থাতে আবার সৈকতের ঠান্ডা বাতাসে কতক্ষণ সময় কাটিয়েছে। আর তার উপর মাহি তাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়ার পর ভেজা কাপড়ে অনেকক্ষণ থাকার দরুন এখন তার এই অবস্থা। মাথা যন্ত্রণাও হতে শুরু করল তার। মাহি আশফির খারাপ অবস্থার সবটাই বুঝতে পারছে৷ কিন্ত কিছু করার মতো অধিকার তার নেই। আশফি কাতর কণ্ঠে মাহিকে বলল, – “আপনি কি একটু চেয়ারে এসে বসতে পারবেন?” মাহি দ্রুত উঠে পড়ল। মেঝে থেকে একটা ক্ষয় হয়ে যাওয়া ঝাড়ু দিয়ে খাটের ওপর ঝেরে দিলো সে। হাত দিয়ে বালিশটা ঝেরে খাটের ওপর রাখল সেটা। এরপর আশফি বিনাবাক্যেই শুয়ে পড়ল ওই শক্ত বিছানাতে। এক সময় ঘুমিয়েও পড়ল সে। মাহি খেয়াল করল শীতে তার ফর্সা শরীরের বেশ কিছু জায়গায় জায়গায় নীলচে কালো হয়ে গেছে। বুঝতে পারল কী পরিমাণ শীত সহ্য করছে সে। মাহি উঠে দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বারান্দাতে চলে গেল। আশফির ভেজা শার্টটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে শাড়ি খুলে শার্টটা গায়ে পড়ে শাড়িটা কয়েক ভাঁজ করে নিলো। এরপর রুমে এসে সেটা আশফির গায়ের ওপর ভালো করে চাদরের মতো করে মেলে দিলো। তারপর বসলো চেয়ারটাতে। তাকিয়ে রইল বিছানাতে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে। মনে পড়তে থাকল তার এই মানুষটার সাথে কাটানো নানান কিছু মুহূর্ত। কিছু ঘটনাও মনে পড়ল তার। তবে বেশ কিছু হিসাব সে মেলাতে পারল না। এরপর হঠাৎ কী মনে করে আশফির মাথার কাছে এসে বসলো। কিছুদিন পূর্বেও এই লোকটা সুযোগ পেলেই মাহির মুখটার দিকে বেহায়ার মতো করে চেয়ে থাকতো। আর আজ সে তাকে এত কাছাকাছি এত সময় পেয়েও একটাবার ফিরে তাকায়নি। যতবার চোখ পড়েছে তার দিকে ততবার সে তীব্র ক্রোধ দেখতে পেয়েছে আশফির চোখে। তবে সেই ক্রোধ যে মাহির কাছে সেদিন থেকেই মূল্যহীন হয়েছে যেদিন ঐন্দ্রীর পেছনের মানুষটা সে ছিল। . . ঘুমের মাঝে হঠাৎ খুব উষ্ণত্ব অনুভব করল আশফি। চোখদুটো হালকাভাবে খুলে দেখল শাড়ির ভাঁজের মাঝে জড়িয়ে আছে তারা দুটো মানব মানবী। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে বিস্মিত হলেও আচমকা মাহিকে তার বুকের আরও কাছে টেনে নিলো। তাকে দেখেই বুঝতে পারল মাত্রই ঘুমে বিভোর হয়েছে সে। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুটা স্মিত হাসলো। আর মনে মনে বলল, – “সোহাগ আর ভালোবাসার কাছে আজ সেও বেহায়া।” গালে উষ্ণ স্পর্শেই মাহির ঘুমন্ত ভাব কেটে গেল। চোখ খুলতেই আশফির এতটা কাছে নিজেকে দেখে চমকে উঠল সে। তার গরম নিঃশ্বাসটুকুও মাহির ঠোঁট, নাক আর চিবুকে ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক এতটাই কাছে সে। তবে মুহূর্তের মধ্যে আরও কয়েকধাপ চমকিত হতে হলো তাকে। আশফির বাহুবন্ধনী থেকে তার মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টার ফলে আশফি আরও বেশি আষ্টপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল তাকে। একটা দৃশ্যমান জোর খাটানো যাকে বলে। তার কানের নিচ থেকে ঘাড়ের কাছটাতে এলোমেলোভাবে আশফির আঙুলগুলো চলছে। এক নিষিদ্ধ অনুভূতির ঘরে ধীরে ধীরে বন্দি পড়ছে তারা দুজন। মাহি নিজেকে সেই ঘর থেকে মুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করল। কিন্তু তাতে ওই মানুষটি তার হাতটাও নিজের হাতের মাঝে বন্দি করে নিলো। শরীরের সর্বোচ্চ সামর্থ্য খরচ করেও হার মানতে বাধ্য হলো মাহি। আচমকা এক উষ্ণ বন্ধনে আটকা পড়তে হলো তাকে। আশফির ওষ্ঠদ্বয়ের সেই দীর্ঘ সময়ের উষ্ণ স্পর্শ যেন তাকে প্রবলভাবে গ্রাস করে নিতে থাকল। শত সামর্থ্য ব্যায় করেও তার কিশলয়তুল্য কোমল ওষ্ঠ মুক্তি পেলো না। কত সময় কেটেছিল এভাবে তারা কেউই জানে না। তবে আরও কিছু প্রহর বাদে ঘুম ভেঙে দেখতে পেলো মাহি, জানালার কাছে চেয়ারে বসা সেই মানুষটাকে। পরনে শুধু তার কালো প্যান্টটাই। উঠে বসতে খেয়াল করল সময়টা এখন সকাল। বিছানা থেকে নেমে নিজের ফোনটা খুঁজে সেটা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়াল আশফির সামনে। এরপর সোজাসোজি প্রশ্ন করল তাকে, – “জ্বর কমেছে?” আশফি তার ফোনের দিক থেকে চোখ উঠিয়ে একবার মাহির দিকে তাকাল। তার প্রশ্ন অবজ্ঞা করে আশফি ফোনটা কানে নিয়ে ওপাশের ব্যক্তিকে বলল, – “ঘুম কি ভেঙেছে তোমার?” ড্রাইভার আরিফ বলল, – “স্যরি স্যার। আসলে কাইল জলদি জলদি ঘুমাইয়া গেছিলাম। আপনার মেসেজ পাইয়াই আমি চইলা আসছি চট্টগ্রাম। গাড়িটার ব্যবস্থা করে আমি আপনার পাঠানো ঠিকানায় চলে আইতাছি এখনি।” ফোনটা রেখে আশফি মাহিকে বলল, – “তাড়াতাড়ি রেডি হোন।” কথাটা শুনতেই মাহির মনে পড়ল সে তো কাল রাতে আশফির ভেজা শার্ট গায়ে পরেছিল। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতেই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরল তাকে। পেটিকোটের ওপর সাদা শার্ট পরে আছে সে। আশফি মাথাটা ঝুঁকে বসে আছে। খাটের ওপর থেকে শাড়িটা তুলে মাহি ছুটে চলে গেল বাথরুমে। তার গায়ের তাপমাত্রাতে শার্টটা প্রায় শুকিয়েই গেছে। শাড়ি পরে এসে শার্টটা আশফির দিকে এগিয়ে দিলো। এক ঘন্টা পরই আরিফ চলে এলো। গাড়িতে ওঠার পূর্ব মুহূর্তে আশফির কাছে ফোন এলো ঐন্দ্রীর। ওপাশের কথা কী ছিল জানে না মাহি। তবে আশফির উত্তর ছিল, – “এত টেনশনের কী আছে ঐন্দ্রী? আমি পৌঁছে কল ব্যাক করব। রাখছি।” গাড়িতে ওঠার সময় আশফি খেয়াল করল মাহি বাহিরে দৃষ্টি ফেলে কেমন মুচকি হাসছে। আশফি কিছু যেন বলতে চাইলো তাকে। কিন্তু কিছুই বলল না। তবে গাড়িতে ওঠার পর আশফি নিজেও সেই একইভাবে একটু হেসে উঠল। . ঢাকা আসার পর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল আশফি মাহিকে তার অফিসে খুব কম দেখে। মানেটা এমন, যখন সে অফিসে ঢুকে তখন মাহি তার ডেস্কে থাকে না। যখন লাঞ্চ করতে কেবিন থেকে বের হয় সে তখন মাহি তার আগেই লাঞ্চ করতে বেরিয়ে পড়ে। আর ছুটির সময়ও মাহি তার কাজ শেষ করে আগেই বেরিয়ে যায়। কোনো কাজের জন্যও তাকে নিজের কেবিনে পায়নি আশফি। কাজগুলো কমপ্লিট করে নিজের ডেস্কে পরিপাটি করে রেখে দেয়। মাঝেমাঝে আনোয়ারের মাধ্যমেও তার ফাইলগুলো জমা দেওয়া হয় আশফির কেবিনে। ব্যাপারটা নিয়ে প্রচন্ড ভাবতে থাকে সে সারাদিন। রাত দিনের অর্ধেকটাই তার বর্তমান বিভিন্ন চিন্তাতে পার হচ্ছে। যে চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু মাহি। গায়ে হলুদের তারিখও ঘনিয়ে এলো। আশফির নতুন বাড়িতেই আশফি আর ঐন্দ্রী দুজনের এক সঙ্গে গায়ে হলুদ হবে। এমনটাই দু’পরিবারের পরিকল্পনা। সকাল থেকে দু’পরিবারের কাছের আত্মীয়তে বাড়ি ভরে গেছে। গান বাজনা ছাড়াই সবাই খুব আনন্দ উল্লাস করছে। তবে দিশানের আগমন হতেই গানের আওয়াজে সবাই আরও বেশি আনন্দে লাফিয়ে উঠল। হিন্দি, বাংলা সব গানের ধুম পড়েছে। ব্যান্ড পার্টির আয়োজনও করেছে দিশান। দারুণভাবে সবাই একইরকমভাবে নাচছে বাড়ির লন সাইডে। সেখানেই এক পাশে সবার বসার আয়োজন, গায়ে হলুদ আর ব্যান্ড পার্টির নাচ চলবে। আশফি তৈরি হয়ে নিচে নামলেই হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে। খুব ব্রাইডাল সাজে ঐন্দ্রী গায়ে হলুদের সাজ সেজেছে। আত্মীয়, বন্ধু সবাই তার পাশ জুড়ে বসে গল্প, হৈ-হুল্লোড় করছে। বেলা সাড়ে এগারোটার সময় আশফি রেডি হয়ে নিচে নামল। কিন্তু তার পরনের পোশাক দেখে সবাই কিছুটা বিস্মিত। চাচি জেবা এসে জিজ্ঞেস করল, – “দাদা না বলেছিল লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরতে? প্যান্ট, টিশার্ট পরে নেমেছিস কেন? যা চেঞ্জ করে আয় বাবা। একদিনেরই তো ব্যাপার।” – “চাচি আমি গোসল সেড়ে একবারে নেমেছি। আর কিছু করতে পারব না।” আশফির কথা শুনে তার আরও কিছু চাচি, ফুপু, বোন এসে অনুরোধ করতে থাকল তাকে হলুদ দিয়ে গোসল করার জন্য। তাদের সঙ্গে তর্কবিতর্কের মাঝে হঠাৎ আশফির নজর গেল লিভিংরুমে মাত্র আসা সাদা শারি পরনের এক শুভ্র সুন্দরীর দিকে। দিয়া এসে দাঁড়াতেই দিশান এক ঝটকায় তার টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে কোথায় যেন চলে গেল। মাহি একা দাঁড়িয়ে পড়ে চারপাশের সজ্জা আর আয়োজন দেখতে রইল। এদিকে প্রায় দশদিন পর আশফি এই শুভ্র সুন্দরী মাহিকে দেখে নির্বাক চোখে তাকিয়ে তাকে দেখছে কেবল। এরপর বেশ চড়া কণ্ঠে সে সবাইকে বলে উঠল, – “দ্বিতীয়বার আর কোনো গোসল আমি করতে পারব না।” এরপর আর কেউ জোর করেনি আশফিকে। মাহি আশফির দিকে ক্ষণিকের জন্য তাকিয়ে বেরিয়ে গেল লিভিংরুম থেকে লন সাইডে। সেখানে নাচ চলছে গানের সঙ্গে, ঐন্দ্রীও সেখানে। আশফিও এলো কিছুক্ষণ পর। বাধ্য হয়ে সব আশফিকে ছাড়াই ঐন্দ্রীকে হলুদ দিয়ে গোসল করানো হলো। গোসল শেষে ঐন্দ্রীকে সাজিয়ে সবাই বসিয়ে দিলো একটা জায়গায়। অনেকখানি ঘোমটা টাঙিয়ে রেখেছে সে মুখের ওপর। তার পাশে পরপর আরও চারজন একই সাজে ঘোমটা টাঙিয়ে বসলো। এরপর কিছু মেয়ে এসে আশফিকে টেনে ধরে নিয়ে গেল তাদের সামনে। এখানে একটা খেলা ঠিক করেছে সবাই। যেটা আশফি বুঝতে পারলো। শাওন বলল, – “বিগব্রো, এদের মাঝে আমার ভাবিকে খুঁজে বের করে তোমাকে ভাবির হাতটা ধরতে হবে।” মাহি বেশ আগ্রহ নিয়ে ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে খেলাটা দেখতে থাকল। আর আশফি অনাগ্রহীভাবে পাঁচজনকে একবার করে দেখে নিলো। এরপর সঠিক মানুষটির ঘোমটা সে উঁচু করে দিলো। সবাই হাত তালি দিয়ে রিকোয়েস্ট করল ঐন্দ্রীর হাতটা ধরে তার হাতের পিঠে একটা চুমু খেতে। তবে আশফি তা অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে আসতে গেলে মাহিকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে আবার ফিরে এসে ঐন্দ্রীর হাতের পিঠে আলতো করে চুমু খেয়ে একবার বাঁকা চোখে তাকাল মাহির দিকে। মাহির মুখে তখন প্রশস্ত হাসি। এরপর আশফি খেয়াল করল মাহি সে জায়গাটা ছেড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। . বেলা সাড়ে বারোটা। লিভিংরুমে মুরুব্বি, মাঝ বয়সী, তরুণী, কিশোরী সব বয়সের মেয়েরা উপস্থিত। ঐন্দ্রীকে ঘিরে বেশ মজা চলছে তাদের মাঝে। মাঝেমধ্যে আশফিকে টেনে এনে ঐন্দ্রীর পাশে বসানোর চেষ্টা করছে কিছু মেয়েরা। আশফি মিনিট সময় বসে থেকে উঠে যেতেই দিশান এসে ঠাস করে বসে পড়ল মেয়েগুলোর মাঝে। মজা শুরু হলো তাকে নিয়েই। হীরা আশফিকে ডেকে জোর করে কয়েক চামচ পায়েস খাইয়ে দিলো। পানি খাওয়ার মুহূর্তে আশফি দেখল সেই শুভ্র সুন্দরি মুখে এক আকাশ কালো মেঘের ছায়া এনে সিঁড়ি বেঁয়ে হেঁটে আসছে নিচে। তাকে ওপর থেকে নামতে দেখল ঐন্দ্রীও। প্রচন্ড রাগ হলো তার। তবে সে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর পূর্বে তার বান্ধবী তার ফোনটা ঐন্দ্রীর হাতে ধরিয়ে দিলো। মাহি নেমে আসার পরই আবরারও বেশ বিমর্ষ আর ভারী ভাবপূর্ণের মাঝে নেমে এসে হঠাৎ আশফিকে সোজা টেনে নিয়ে গেল নিচের রুমটাতে। এদিকে ঐন্দ্রীও বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। হাত পা তার প্রচন্ড কাঁপছে, চোখের পানির বাঁধ আজ ভেঙে পড়ছে তার। মাহি এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া খুব শক্ত করে তার হাতটা ধরে আছে। কারণ মাহির অবস্থাও তখন ঐন্দ্রীর মতো। শুধু চোখের পানিটুকু আটকে রেখেছে সে। ঐন্দ্রীর নীরব দৃষ্টি কিন্তু যন্ত্রণাপূর্ণ চাহনিতে দেখছে সে মাহিকে। আবরার বেরিয়ে এলো রুম থেকে। তার পিছে এলো আশফি। চোয়ালজোড়া প্রচন্ড শক্ত হয়ে আছে তার। প্রজ্জ্বলিত শিখার ন্যায় তার ক্রুদ্ধ চাহনি মেলে তাকাল সে মাহির দিকে। আশফি এসে দাঁড়াতেই আবরার তীব্র নিন্দার সুরে বলল আশফিকে, – “ঘেন্না হচ্ছে আমার শুধু। ছিঃ!” আবরার আর কিচ্ছু না বলে চলে গেল ওপরে। দিয়া বলল মাহিকে, – “তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি। হাতগুলো কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে তোর। চল বাড়িতে যায়।” আশফি শুধু চেয়ে আছে তার দাদার চলে যাওয়ার পথে। মাহি যখন তার জায়গা ছেড়ে আশফির পাশ কাটিয়ে চলে গেল তখন মাহির বলা একটা কথা তার কানে বেজে উঠল। ঠিক যেই কথাটি সে ঐন্দ্রীকে রিং পরিয়ে দেওয়ার পর মাহির কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিল। – “হ্যাপি এন্ডিং।” একইভাবে মাহিও আশফির কানে ফিসফিস করে এই কথাটিই বলে চলে গেল। মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল আশফি। …………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin পেজে আমি ছাড়াও আমার কিছু বোন আছে। যাদের থেকে রিপ্লাইগুলো মাঝেমাঝে পান আপনারা। আমি শুধু গল্প দিয়েই খালাস। খুব কম সময় পাই কমেন্টের রিপ্লাই করার। তবুও চেষ্টা করি। তাই পেজ থেকে রিপ্লাই পেলে আর কেউ না পেলে প্লিজ মন খারাপ করে বলবেন না “আপু আমার কমেন্টের রিপ্লাই করলা না”। এমনটা ভেবে কেউ কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকবেন না। আপনাদের জন্য কত বড় করে পর্বগুলো দিই তাই না?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে