তুমি রবে ৩১

0
1950
তুমি রবে ৩১ . . জলপাই আর হলুদ রঙার মিশ্রণে একটা জামদানী শাড়ি পরনে, চুলগুলো সুন্দর করে ঝুলানো খোঁপা করা, কানে ছোট দুটো সাদা পাথরের ঝকঝকে দুল, ডানহাতে চারটা সাদা পাথরের চুরি আর বাঁহাতে ব্রেসলেট সিস্টেম একটি দামী ঘড়ি। আর তার সাজসোজ্জা কেবল চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে তার ঠোঁটের গাঢ় গোলাপি বর্ণটায় বেশ যায়। সেখানে নতুন করে আর কোনো অধরারঞ্জনীর প্রয়োজন না হলেও চলে। আশফি দূরে দাঁড়িয়ে মানবীটির এই নতুন রূপ দেখছে হা করে। যেন আপাদমস্তক মানুষটাই এক নতুন কেউ। শুধু একটা জিনিসই পরিবর্তন হয়নি তার। ঘড়িটা সে বরাবরই বাঁহাতে পরে আসছে। তাকে দেখে তার কাছে কেবল মনে হচ্ছে, পড়ন্ত বিকেলের লালচে হলুদ মিষ্টি রৌদ্রের মাঝে একগুচ্ছ স্বর্ণচাঁপা দুপুর বা গন্ধরাজ বিকেল জুড়ে আছে ছাদের মাঝখানটাতে। কিন্তু কথা হচ্ছে সে তড়িঘড়ি করে বিকাল চারটার সময় অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা এই রেস্টুরেন্টে চলে এসেছে। তারপর প্রায় পনেরো মিনিট ধরে সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। আশফির ইচ্ছা ছিল অফিস শেষে মাহি আর দিশানকে নিয়ে সে একটা পরিকল্পনা করবে তাদের অফিস থেকে ট্রিপে যাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু যখন সে মাহিকে কল করল তখন ফোনটা রিসিভ হলো না। আনোয়ারকে ডাকতে পাঠালে সে এসে আশফিকে বলে, – “স্যার উনি কিছুক্ষণ আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছেন।” আশফি জিজ্ঞেস করে, – “আজ উনি অফিসে এসেছিলেন কখন?” – “অফিসে তো জাস্ট টাইমেই এসেছিলেন। কাজগুলো কমপ্লিট করে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েই তারপর বের হয়েছেন।” হীরার শরীরটা খারাপ থাকার কারণে আজ আশফি অনেক দেরি করেই অফিসে আসে৷ আর তা প্রায় নয়দিন পর সে অফিসে পা ফেলেছে। আসার পর মাহির সঙ্গে কথা বলাও হয়নি তার। আশফির ধারণা ছিল মাহি নিজে থেকেই তার রুমে একবার আসবে। তার বদলে মেয়েটা তড়িঘড়ি করে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল! এরপর হঠাৎ দিশান কল করে জানায় সে মাহিকে একটা রেস্টুরেন্ট ঢুকতে দেখেছে। এ খবর পাওয়ার পর আশফি আর দেরি না করে চলে আসে সেখানে। এখন সে ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে দিশানের সঙ্গে। মাহি কার জন্য অপেক্ষা করছে এটা না দেখা অবধি সে বসতেও পারছে না শান্তিতে। আর এদিকে ভাইয়ের জন্য দিশানের দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিম ধরে আসা অবস্থা প্রায়। বিরক্তিকর সময় যাচ্ছে একটা। এর মাঝে দিশান দেখল দিয়া একটা ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করতে করতে ভেতরে আসছে। এ দৃশ্যটাই তার বিরক্তির মুহূর্তগুলোকে তিক্তকর মুহূর্তে পরিণত করে দিলো। দিশান হঠাৎ আশফির হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে দূরে সরিয়ে নিয়ে এলো। অনেকটা আড়ালে এসে দাঁড়াল তারা। – “কী হলো তোমার? এভাবে টেনে আনলে কেন?” – “কোনো কথা বলো না। সামনে দেখো।” আশফিও দেখল দিয়া একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে বসলো মাহির পাশে। মাহি কিছুটা হাত গুটিয়ে বসলো। বুঝাই যাচ্ছে একটু জড়তা কাজ করছে তার মাঝে। এর কিছুক্ষণ পর এলো হিমু আর অনিক। মাহি আর দিয়া উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল হিমুকে। ওদিকে অনিক আর সেই ছেলেটা মুলাকাতে ব্যস্ত। এরপর পাঁচজন বসে প্রচুর গল্প শুরু করল নিজেদের মাঝে। আশফি আর দিশানের কাছে অচেনা লাগা ছেলেটা গল্প করার মাঝে একবার দিয়ার হাতের ওপর হাত রেখে গল্প করছে আবার কখনো মাহির প্লেট থেকে খাবার তুলে খাচ্ছে৷ তার কান্ডে মাহিও খুব মজা নিচ্ছে। দুজনের মনের পরিস্থিতি এখন একইরকম। এদের দুজনের মাঝে যে কোনো একজন ছেলেটার হাসি মুখটাতে কখন যেন পাঞ্চ করে বসবে। দুজনের তীক্ষ্ণ চাহনিতেই তার প্রকাশ ঘটছে। আশফি এসে বসলো একটা টেবিলে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে লক্ষ্য করছে সে তাদের।
– “আমি কিন্তু মাহিকে দেখে চিনতেই পারিনি।” ধ্রুবর কথায় হিমু বলল, – “তুই কী চিনবি? আমি নিজেই তো আমার বেস্টিকে চিনতে কয়েক সেকেন্ড লাগিয়েছি।” মাহি কপট অভিমানের সুরে বলল, – “দিয়া শুনলি! সেই কুট্টি থেকে ও আমার দুধ ভাতের প্লেট থেকে ভাগ বসিয়েছে। আর ওর নাকি আমাকে চিনতে কয়েক সেকেন্ড লেগেছে। মানুষ ঠিকই বলে, বিয়ে করলে সব পর হয়ে যায় মেয়েদের কাছে। শুধু আপন হয় স্বামী সংসার।” – “মোটেও না। দিয়া তুই বল, ও কতটা পাল্টেছে? কতটা সুন্দর হয়েছে?” দিয়া নির্বিকারভাবে বলল, – “আমি তো রোজই দেখি। আমি কী বলব? তবে হ্যাঁ দোস্ত, তুই সত্যিই খুব পাল্টেছিস। চট্টগ্রাম থেকে আসার পর প্রথমদিন দেখে আমারও লেগেছিল।” অনিক ধ্রুবকে বলল, – “ভাই দ্যাখ, মেয়ে মানুষের প্যাচালের মাঝে আমার এর জন্যই ভাল্লাগে না। কে কত মোটা হলো, কে কতখানি ক্যালরি বার্ন করল এই দুনিয়ার হাবিজাবি প্যাচাল। উফ্!” ধ্রুব হেসে কথায় সায় দিলো। এদিকে দিয়া আর হিমুর মার পড়ছে অনিকের পিঠে। ধ্রুব পকেট থেকে ফোন বের করে খটখট করে কয়েকটা সেল্ফি তুলে নিলো। মাহির সঙ্গে একাকীভাবেও কতগুলো সেল্ফি তুলল। পাশে দিয়া বসেছিল। দিয়ার চেয়ারের ওপর থেকে ওর কাঁধ ধরে যখন ধ্রুব সেল্ফি নিচ্ছে তখন দিশান এসে উপস্থিত সেখানে। প্রথমে মাহির সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। মাহির থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দিশান যখন ধ্রুবকে দেখছিল, মাহি তার দৃষ্টি দেখে কিছু আন্দাজ করতেই মাহি উঠে এসে দিশানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, – “দিশান তুমি এখানে? সারপ্রাইজড ভাই।” – “আমিও সারপ্রাইজড।” দিয়া পিছু ফিরে দিশানকে দেখে উঠে দাঁড়াল। দিশান মুখে কৃত্তিম হাসি টেনে বলল, – “আমরা একটা আর্জেন্ট মিটিংয়ে এসেছিলাম এখানে। তোমাদের দেখে এগিয়ে এলাম একটু। তো ঠিক আছে তোমরা এনজয় করো কেমন!” অনিক উঠে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে দিশানকে বলল, – “কেমন আছেন ভাই?” দিশান হাত মিলিয়ে বলল, – “খুবই ভালো। আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবিনি। ভালো লাগল খুব।” – “তো এসে জয়েন করেন আমাদের সাথে।” – “না ভাই। ভেতরে আমার ভাই বসে আছে। আমরা এখনি ফিরব। আপনারা এনজয় করুন। সমস্যা নেই, আবার পরে কখনো দেখা হবে।” আশফির ফিরে আসার খবরটা পেয়ে বেশ উৎসুকভাবে মাহি বলল, – “উনি ফিরেছেন আজ?” – “না কাল এসেছে।” – “ওহ, আজ তো অফিসে দেখিনি ওনাকে তাই জিজ্ঞেস করলাম।” – “তো চলো এখন দেখা করে আসবে।” – “না ঠিক আছে। কাল অফিসেই তো দেখা হবে।” – “নাও হতে পারে। আজ রাতে ঢাকার বাইরে যাবে।” মাহির পরবর্তী প্রশ্নের আগেই দিশান বলল, – “আচ্ছা আসি। তোমরা বসো তাহলে।” অনিক বলল, – “ভাইয়া দাঁড়ান, আমি একটু ভাইয়ার সাথে দেখা করব। উনি মানুষটাকে আমার খুব ভালো লাগে। সেদিন বিজনেস সম্পর্কিত অনেক ব্যাপারই আমি ওনার থেকে বুঝেছি আর জেনেছিও। এত বড় শিল্পপতি হয়েও ওনার মাঝে আমি দাম্ভিকতার ব্যাপারটা এক ফোঁটাও দেখিনি।” দিশান হাসলো শুধু। তারপর মাহি বলল, – “আচ্ছা তোরা বস। আমার বসের সঙ্গে একটু দেখা করে আসি।” সামনে একটা কোল্ড কফি নিয়ে ফোন চাপছে সে। অনিক এসে আশফির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কুশল বিনিময় করল। মাহি মুখে হালকা হাসি টেনে জিজ্ঞেস করল, – “কেমন আছেন স্যার?” – “জি ভালো। আপনি?” গাম্ভীর্যের ছায়া আশফির মুখে। মাহি শুধু হেসে মাথা নাড়াল। অনিক বলল, – “কিছু মনে না করলে আমাদের বন্ধুদের আসরে এসে বসেন না আপনারা। আপনাদের সঙ্গ সত্যিই খুব উপভোগ্য।” মাহি জানে আশফি এখন তার গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখ করে বলবে ‘আমি ব্যস্ত একটু। পরে কখনো আবার।’ আশফি কথা বলার জন্য ঠোঁট নাড়তেই মাহি বলে উঠল, – “স্যার হয়তো খুব ব্যস্ত অনিক। শুনলাম রাতে উনি ঢাকার বাইরে যাবেন।” মুহূর্তেই আশফির চোখদুটো জ্বলে উঠল। তবে তার দৃষ্টি শীতল। পকেটে হাতদুটো পুরে স্মিত হাস্যে সে বলল, – “হু, আমার আর সময় কই এত আস মোমেন্ট কাটানোর!” আশফি রেস্টুরেন্টের একজন পরিচারককে ডেকে বলল, – “ওনাদের অর্ডারকৃত ডিশগুলো আমার তরফ থেকে।” – “ওকে স্যার।” – “আরে এটা কী করলেন ভাইয়া? এটার কোনো প্রয়োজন ছিল কি?” আশফি হেসে অনিককে বলল, – “হ্যাঁ ছিল হয়তো। তাতে কারো প্লেটের খাবার রক্ষা পাবে।” ব্যাপারটা অনিক না বুঝলেও মাহি বুঝতেই তার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে উঠল। এই লোকটা কখন কাকে কীভাবে কত ভয়ানকভাবে অপমান করে বসে তা সেই ব্যক্তির চিন্তাশক্তির পুরো বাইরে থাকে। প্রচন্ড রাগ হলো মাহির। দিশানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, – “সময় মাত্র পাঁচটা। আমাদের সঙ্গে ত্রিশ মিনিট বসলে হয়তো খুব বেশি সময় অপচয় হবে না আপনাদের?” আশফি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে মাহি তার দেওয়া ট্রিটটা গ্রহণ করবে না বিধায় এখন তাদের থাকতে অনুরোধ করছে। মেয়েটার যে প্রচুর আত্মসম্মানবোধ আছে সে বিষয়ে আশফি অবগত। এদিকে এই সুযোগটা আশফির একদমই নেওয়া উচিত নয়। তাতে তার ট্রিটটা তাকে খাইয়িয়েই পুষিয়ে দেওয়া হবে। আবার এই মুহূর্তে সে চাইছে না মাহিকে ফেলে গিয়ে ওই ছেলেটার সাথে মাহির খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়ার সুযোগ দিতে। মাহির বলার পর অনিক বলল, – “জয়েন করলে প্রচন্ড খুশি হবো।” আশফি এখনো দোনোমনার মাঝে। আশফির নীরবতা দিশানের মনে হলো সে হয়তো থাকতে চায়। আর তাছাড়া দিশানেরও ইচ্ছে করছে না দিয়াকে ওই ছেলের সাথে সেল্ফি তোলার সুযোগ দিতে। তাই সে বলল, – “ভাইয়া এমন বন্ধুমহল আমরা বহুদূরে ফেলে এসেছি। চলো ওদের সঙ্গে বসে ওই সময়গুলো একটু ফিল করি।” . . কথায় আছে না ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।’ মাহি তখন দিশানের সরু দৃষ্টি দেখে আর আশফির ট্রিট দেওয়ার ব্যাপারটা ধরতে পেরে সে বুঝে নিয়েছিল ধ্রুবকে এরা মোটেও স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। আর এই দুই ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে তার একটা ছোটখাটো সলিড ধারণা হয়ে গেছে। তাই সে চেয়েছিল ধ্রুবকে অনিকের পাশে বসাতে। কিন্তু হলো তার বিপরীতটা। আশফি আর দিশান হুট করেই ধ্রুবর দুই পাশে এসে বসলো। যেখানে কিছুক্ষণ আগে ধ্রুব দিয়া আর মাহির মাঝে বসেছিল। এখন মাহির পাশে আশফি তারপর ধ্রুব, তারপর দিশান, তারপর দিয়া আর তারপর হিমু এবং অনিক। ধ্রুবর চেহারাতে কিছুটা আনইজি ভাব ফুটে উঠেছে। কারণ এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে এরা দুজনের কেউই পরিচিত হয়নি। মাহি ধ্রুবকে বলল, – “ধ্রুব ওনারা আমার কোম্পানির বস।” ধ্রুব সৌজন্যের হাসি হেসে হাত বাড়িয়ে হ্যালো বলল আশফি আর দিশানকে। তখন পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু যখন ধ্রুব বলল, – ”অনেকদিন পর আমরা সব জিগারের দোস্ত এক সঙ্গে হলাম।” আশফি কাটাচামচাটা খাবারের মাঝে ঘোরাতে ঘোরাত মাহির দিকে তাকাল। – “আচ্ছা! আপনার জিগারের দোস্ত আছে নাকি?” মাহি ভ্রু কিঞ্চিত উঁচিয়ে বলল, – “মানে?” জুসের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে আশফি খাবারগুলো নাড়তে নাড়তে বলল, – “শুনেছিলাম কোনো ছেলে বন্ধু নাকি ছিল না আপনার। এখন আবার শুনছি জিগারের দোস্তও আছে।” দিয়া হাসতে হাসতে বলল, – “ঠিকই শুনেছেন ভাইয়া। ওর তো কোনো মেয়ে বন্ধুও ছিল না খালি হিমু ছাড়া। তাও হিমু ওর প্রতিবেশী ছিল তাই। ধ্রুব আমার জিগারের দোস্ত। আমরা সেই নার্সারী থেকে এক সঙ্গে। আর কলেজে আসার পর হিমু আর অনিক মানে আমাদের সবার জিগারের দোস্ত সে। ক্লাসের মধ্যে এক নাম্বারের জোকার কিং ছিল সে। আর এখনো।” দিয়া খুশি মনে আরও বলল, – “ছোটবেলায় যে কত মারামারি করেছি আমরা! আমার হাতে এখনো ওর কামড়ের দাগটা আছে।” ধ্রুব নিমিষে বলে উঠল, – “বাহ্! এত যত্ন করে রেখেছিস দাগটা।” – “ধুরঃ পাজি।” দিয়া সাবলীলভাবে গল্পগুলো বলে যাচ্ছে। করুণ দৃষ্টিতে মাহি চেয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। দিয়া মেয়েটা বন্ধুমহলে বরাবরই বেশি কথা বলে। আর ইয়ারকি ফাজলামির মাঝে সে কোনো বাছবিচার ছাড়াই মজা করে। যাকে বলে সরল মনের মানুষ। সে যদি জানতো আর বুঝতো তার দয়িত এই গল্পগুলো বিষ সেবনের মতো করে গিলছে! – “আমি একটু বিরতি নিচ্ছি।” দিয়া চলে গেল ওয়াশরুমে। এর কিছুক্ষণ বাদই দিশান বলল, – “স্যরি। আমি একটা আর্জেন্ট কল করে আসছি।” দিশান ফোনটা হাতে করে সরাসরি চলে গেল ওয়াশরুমের সামনে। দিয়া ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই দিশান ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। দিয়া তাজ্জব বনে গেল দিশানের কান্ডে। – “কী হয়েছে?” দিশান উত্তর না দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ার মুখোমুখি দাঁড়াল। – “ওই ছেলেটা তোমার হাতে কোথায় কামড় দিয়েছিল দেখি।” – “মানে?” দিশান কোমরে ডান হাত দিয়ে দাঁড়াল এবার। তারপর বলল, – “চলো কিছু সেল্ফি তুলব।” দিয়ার পাশে এসে দিয়ার কাঁধ জড়িয়ে ধরতে গেলে দিয়া দূরে সরে এসে বলল, – “কী হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? এই জায়গায় কেউ সেল্ফি নেয়? মাথা ঠিক আছে আপনার?” – “না। গরম আছে। অনেক গরম। তুমি কি একটু আমার মাথায় বাতাস করতে পারবে?” – “হ্যাঁ অবশ্যই।” দিশান সেই আগের মতো কোমরে এক হাত ভর করে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে দিলো। দিয়া তার ওড়নার আঁচল তুলে দিশানের মাথায় বাতাস করে যাচ্ছে। প্রায় কয়েক মিনিট হলো। দিয়ার মুখে মুচকি হাসি। বাতাস করতে করতে দিয়া কখন যেন দিশানের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মৃদুস্বরে সে প্রশ্ন করল, – “হয়েছে?” দিশান মাথা তুলে দেখল দিয়ার মুখে সেই মুচকি হাসি। সেই হাসিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ দিয়ার হাতটা ধরে টেরে আনল নিজের খুব কাছে। . . – “তাহলে মাহি তোকে কিন্তু আগামী সপ্তাহে ছুটি মঞ্জুর করতেই হবে। তোর বস তো এখানেই আছে। ছুটিটা এখনি নিয়ে নে না।” হিমু হাসতে হাসতে বলল। আশফি প্রশ্নবিধ চোখে মাহির দিকে তাকালে মাহি বলল, – “আমার বস অফিসের কাজ অফিসে করাটাই পছন্দ করেন। তাই আমি এ বিষয়ে অফিসে গিয়েই কথা বলব।” – “কী বিষয়ে জানতে পারি?” – “হ্যাঁ তা জানতে পারেন।” হিমু বলল, – “আসলে আমার বিয়ের পর আমাদের বন্ধু সমাবেশ অনেকদিন গড়ে ওঠেনি। তাই ভাবছি আমরা দুই তিনদিনের একটা ট্রিপে যাব। আগে তো মূল সমস্যা ছিল মাহিকে নিয়ে। এখন আর ওকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।” – “কবে যাবেন আপনারা?” – “আগামী সপ্তাহে।” – “কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়।” আশফির কথা শুনে সবার মুখটা মলিন হয়ে গেল। আশফি ব্যাপারটা খেয়াল করল। এভাবে তার কথাটা ঠিক বলা উচিত হয়নি। নিজের কাছেই নিজের খুব খারাপ লাগল আশফির। সে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে মাহিকে বলল, – “আপনার সঙ্গে আজ আমার একটা মিটিং ছিল। কিন্তু আপনি তো বেরিয়ে এসেছিলেন অনেক আগে। পাঁচ মিনিটের জন্য যদি আমার সঙ্গে কোথাও বসতেন তো….যদি কারো আপত্তি না থাকে।” হিমু বলল, – “না না সমস্যা নেই।” আশফি আর মাহি উঠে আলাদা একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। আশফির কাছ থেকে সব শোনার পর মাহির খুশি হওয়া উচিত নাকি বন্ধুদের সাথে না যেতে পারার জন্য কষ্ট পাওয়া উচিত সে বুঝতে পারছে না। কিন্ত তার বন্ধুদের জন্য কিছুটা হলেও খারাপ লাগছে। কত আশা করে হিমু আর অনিক এসেছে, তারা প্ল্যান করেছে ট্রিপে যাওয়ার। এতদিন শুধু মাহির জন্যই তারা কোথাও যায়নি। এদিকে আশফি ভাবছে কত প্ল্যান প্রোগ্রাম করা হয়ে গেছে। এখন যদি শেষমেশ মাহি না বলে তো সে জানে না সে কী করবে। মাহির নিস্তব্ধতা আশফির কিছুটা চিন্তার বিষয়। সে মাহিকে বলল, – “কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফ্রিলি বলুন মাহি।” মাহি কী বলবে বুঝতে পারছে না। আশফির সঙ্গ মিলবে কিছুদিন সবুজ ঘেরা পাহাড় আর প্রকৃতির মাঝে। এ যেন খুশির বন্যা তার কাছে। কিন্তু বন্ধুদেরই বা কী করে না বলবে সে? – “আপনি তো শুনতেই পেলেন ওরা একটা ট্রিপের আয়োজন করেছে। আমার জন্য ওরা গতবছর বান্দরবানের ট্রিপটা ক্যান্সেল করেছিল। এবারও যদি…” – “কোথায় যাবেন?” – “বান্দরবন।” আশফি যেন অনেকখানি স্বস্তি পেলো। সে হেসে বলল, – “আমাদের ট্যুরটাও কিন্তু ওখানেই। তো আপনার বন্ধুদের যদি আপত্তি না থাকে আমাদের সাথে জয়েন করুক? আমার রিসোর্টেই সব স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট দেওয়া হবে ওনাদের জন্য।” মাহি একগাল হেসে বলল, – “প্রচন্ড খুশি লাগছে আমার। আমাদেরকে নিয়ে এতটা ভাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।” – “আপনাদেরকে নিয়ে মানে? আমি শুধু আপনার জন্য মানে আমার অফিস এমপ্লয়ির জন্য ভেবেছি।” অপ্রতিভ হলো মাহি। হাস্যজ্জ্বল মুখটা নিভে গেল তার। মুখটা গম্ভীর করে বলল, – “ওকে থ্যাংকস বস।” মাহি উঠে গেল ওদের কাছে। আশফি একটু মুচকি হেসে মাহির পিছু পিছু এলো। মাহি ওদের সবকিছু বলতেই অনিক বলল, – “কিন্তু এটা তো তোদের অফিস ট্যুর তাই না? আমরা কীভাবে?” আশফি বলল, – “অ্যাস অ্যা ফ্রেন্ড। মানে আমাকেও আপনাদের বন্ধু ভেবে যাবেন আমার সঙ্গে৷ আর তাছাড়া এই ট্যুরটা বিশেষ কিছু এমপ্লয়িদের জন্য। যাদের পরীশ্রমের জন্য অনেক বড় একটা বেনিফিট পেয়েছি আমি।” হিমু বলল, – “তাহলে তো আর কোনো অসুবিধায় রইল না।” ধ্রুব বলল, – “আচ্ছা সে তো ঠিক আছে। কিন্তু দিয়া কোথায় গেল?” আশফি খেয়াল করল দিশানও নেই। আশফি ফোনটা বের করে দিশানকে কল করল। কিন্ত রিসিভ হলো না। মাহি দিয়ার নাম্বার ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করে বলল, – “হ্যালো ডিয়ারিং তোমার বেস্টি আমার সঙ্গে। আমরা একটু দূরে গাড়ির মধ্যে বসে আছি। কিছুক্ষণ পরই আমি ওকে নিজে ড্রপ করে দিয়ে আসব। আর কোনো প্রশ্ন? মানে যে প্রশ্নগুলো করতে পারো তার উত্তর তো দিয়ে দিয়েছি।” মাহি হেসে বলল, – “না আর কোনো প্রশ্ন নেই।” ফোনটা রাখতেই হিমু বলল, – “দিয়াকে কল করেছিলি না?” – “হ্যাঁ।” – “ও কি ওয়াশরুমেই বসে আছে?” – “না গাড়িতে।” – “মানে?” মাহি দেখল আশফি বারবার কল করছে কাউকে। মাহি প্রশ্ন করল, – “দিশান?” আশফি মাথা নাড়াল। মাহি বলল, – “আমার কথা হয়েছে ওর সাথে। এখন সেও গাড়িতে।” – “কী?” মাহি শুধু হাসলো আশফির প্রশ্নে। মাহির হাসির কারণটা বুঝতে সবারই কিছুক্ষণ লেগে গেল। . রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে হিমু আর অনিক একটা ট্যাক্সি করে চলে গেল মাহি আর ধ্রুবর থেকে বিদায় নিয়ে। ধ্রুব বাইকে উঠে মাহিকে বলল, – “মাহি চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।” মাহির পেছনে এসে আশফি তখন দাঁড়িয়েছে। মাহি তা খেয়াল করেনি। মাহি বলল, – “সমস্যা নেই ধ্রুব। তুমি যাও। আমি উবার কল করে নেবো।” – “আরে আসো না। এত কেন ভাবো বলো তো?” আশফি গলায় হালকা কাশির শব্দ করতেই মাহি পিছু তাকাল। আশফি তার দিকে না তাকিয়েই গাড়িতে গিয়ে বসে। ধ্রুব আবার বলল, – “কী হলো আসো।” মাহি তাকিয়ে আছে আশফির দিকে। আশফির গাড়ির সামনেই ধ্রুব বাইক নিয়ে বসে আছে। আশফি গাড়িতে স্টার্ট করল। তার মুখের ভাবমূর্তি তখন অনেকটা এমনটা যে সে ধ্রুবকে এখনই তার গাড়ির নিচে পিষে দেবে। এটা মনে হতেই মাহি ধ্রুবকে সরাসরি না জানিয়ে দিলো। আর তারপর মাহি সেখানে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। হেঁটে চলে এলো ডানদিকে। ধ্রুব ততক্ষণে বাইক টেনে সামনে চলে গেছে। আশফি তার গাড়িটা নিয়ে মাহির প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড় করাল। মাহি তা ভ্রুক্ষেপ না করে আবার হাঁটতে শুরু করলে আশফি এবার তার গাড়ি মাহির সামনে নিয়ে ব্রেক করল। মাহি দূরে দাঁড়িয়েই বলল, – “আমার কারো গাড়িতে ওঠার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।” আশফি গাড়ির দরজাটা খুলে এমনভাবে নামল যে মাহি ভয়েই এক পা পিছিয়ে এলো। মাহির কাছে এসে দাঁড়িয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে তাকে বলল, – “আমি যখন আপনার সঙ্গে থাকব তখন আমার গাড়িতেই আপনাকে উঠতে হবে। আমি যখন আপনার সঙ্গে থাকব তখন আমার সঙ্গেই আপনাকে যেতে হবে। এবং আমি যখন আপনার সাথে থাকব তখন আমার সঙ্গেই আপনাকে কথা বলতে হবে। এমন অনেক কিছুই আমার সঙ্গেই আপনাকে করতে হবে। বাকিটা গাড়িতে ওঠার পর বলব।” এতটুকু বলে আশফি আবার গাড়িতে গিয়ে বসলো। মুহূর্তের জন্য মাহি একদম নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্মিত হেসে উঠল মাহি। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সে হাসলো। এরপর চুপচাপ গাড়িতে উঠে এলো। গাড়িটা টেনে দিয়াবাড়ি চলে আসে আশফি। রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে গাড়িটা লক করে দিলো সে। মাহি কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, – “আমরা এখানে এলাম কেন? আর গাড়িটাই বা লক করলেন কেন? এখন কয়টা বাজে? ফিরতে ফিরতে আমার কত রাত হবে জানেন?” আশফি মাহির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ির পেছন সিট থেকে একটা প্যাকেট আনলো। – “এটা ধরুন।” – “কী এটা?” – “বাসায় গিয়ে খুলে আমাকে জানিয়েন। তারপর বলব কী।” আশফির কথা শুনে মাহি কপট রেগে বলল, – “কী মশকরা করছেন? গাড়ি লক করলেন কেন আর এখানেই বা এলেন কেন?” – “আমার সঙ্গে থাকলে আপনাকে আরও কী কী করতে হবে তা জানানোর জন্য এখানে আসা।” – “তাতে গাড়ি লক করে রাখার কী সম্পর্ক?” গলার টাইটা খুলতে খুলতে বলল আশফি, – “যাতে পালাতে না পারেন।” ক্ষণিকের মধ্যে মাহির স্বাভাবিক মুখের চেহারার রংটা পুরো বদলে গেল। ………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ রইল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে