তুমি রবে ২৬

0
2008
তুমি রবে ২৬ . . আশফি হাতটা উঠিয়ে নিলো ঠিকই কিন্তু খুব সাংঘাতিক কিছু ঘটানোর প্রস্তুতি নিলো সে। ব্যাপারটা বুঝতেই মাহি গাড়ির একদম কিনারাতে সেঁটে গিয়ে বসলো। কারণ সে মুহূর্তে আশফি খুব কাছে আসার চেষ্টা করছে তার। আর শেষ পর্যায়ে আশফি যখন মাহির খুব কাছে এসে মৃদু স্বরে বলল, – “যা চাই তা ভালোই ভালোই দিয়ে দিন।” মাহি তাকে প্রশ্ন করতেও ভুলে গেল যেন। মুহূর্তেই সে নজর বন্দি হয়ে গেল আশফির। তার চোখদুটোর আয়তন খুব বেশি বড় নয়। কিন্তু সে যখন হেসে কথা বলে, তখন সেই চোখদুটোর মাঝে মৃদু ঔজ্বল্য দেখতে পায় মাহি। ইচ্ছা করে না তখন সেই নজর থেকে নজর ফিরিয়ে নিতে। কতবার যে সে এভাবে এই মৃদু দীপ্তি চোখদুটোর মাঝে নিজেকে খুইয়েছে তা হিসাবহীন। কিন্তু সে সময়টা সে পিছে ফেলে এসেছে। নতুন করে চায় না সে সেই একই পরিণতি। মাহির এই সংকুচিত ভীত চাহনি দেখে আশফির ভেতরের ইচ্ছাটা এবার খুব করে পূরণ করতে ইচ্ছে করল তার। তপ্ত আদরে ছুঁতে ইচ্ছে করল মাহির রাঙা কপোল। একটু একটু করে যখন আশফি এগিয়ে এসে মাহির কপোল ছুঁতে চাইল তার ওষ্ঠদুটি, সে মুহূর্তে আশফির বুকের ঠিক মাঝখানটাতে উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করল সে। মাহি তার বুকের মাখখানটাতে হাত রেখে বাধ সেধে দিলো। . ________বিকালের পুরো সময়টা মাহি আশফির সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল তাদের কোম্পানির অর্ডারকৃত তৈরি প্রোডাক্টের কাজগুলো। যত সময় অবধি মাহি ছিল আশফির সঙ্গে, তত সময় অবধি আশফি শুধু চেয়ে দেখছিল বদলে যাওয়া মাহিটাকে। যেন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে সে মাহির মাঝে। কাজপাগল এক গম্ভীর চরিত্রের মানুষ এখন মাহি। কাজের মাঝে থাকাকালীন কাজের বাহিরের কোনো আলোচনা যেন করতেই ইচ্ছুক নয় সে। গাড়ির মাঝের দ্বিধাপূর্ণ ঘটনাটির পর থেকে মাহি আশফির সঙ্গে কাজ সম্পর্কিত বিশেষ কথা ছাড়া কোনো কথায় সে বলল না। সময় যখন সাড়ে পাঁচটা তখন কল এলো মাহির ফোনে। নাম্বারটা অচেনা আর কাজের মধ্যে থাকার জন্য বলে মাহি রিসিভ করল না। এরপর দ্বিতীয়বার বেজে ফোনটা কেটে গেল। তৃতীয়বার বেজে চলেছে। পাশ থেকে আশফি তখন বলল, – “জরুরি বলেই বারবার কল করছে সে।” এ কথা শোনার পর মাহি রিসিভ করেই ওপাশের অজ্ঞাত ব্যক্তিকে বলল, – “দেখছেন ফোনটা তুলছি না তাহলে অবশ্যই ব্যস্ত আছি।” – “দুঃখিত আমি। রাখছি।” কণ্ঠের মানুষটা খুব চেনা মাহির। কিছুটা হাসতে চেষ্টা করে বলল, – “কেমন আছেন সোম ভাইয়া?” সোম হেসে বলল, – “জি আলহামদুলিল্লাহ। তবে আপনার কাজের ব্যাঘাত দিয়ে ফেলার জন্য স্যরি। আপনি ফ্রি হওয়ার পর চাইলে কল করতে পারেন।” – “আরে না না। আমি আসলে অচেনা নাম্বার দেখে রিসিভ করতে চাইছিলাম না।” – “কখনো অচেনা মানুষটার পিছে খুব চেনা কেউও থাকতে পারে। সেটা মাথায় রাখা উচিত। আচ্ছা যাই হোক, আমি রাখছি। যদি ফোন করতে ইচ্ছা করে তো ফ্রি হয়ে কল করিস। ঠিক আছে রাখছি তাহলে।” – “আচ্ছা।” ফোনটা কেটে দেওয়ার পর মাহি ফোনটা স্ক্রল করতে করতে আশফিকে বলল, – “আমি এখন বের হবো। আর সবকিছুই পারফেক্ট আছে। আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলে নেব বেরিয়ে।” এ কথা বলে মাহি ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে গেল। ফোন কেটে দেওয়ার পর একবার যদি মাহি আশফির দিকে তাকাত, তবে দেখতে পেত আশফির চোয়াল শক্ত, রাগে লাল হয়ে যাওয়া তার মুখটা। ________গতদিন পার করে আগামী দিনের রৌদ্রমুখর সকালটার মাঝে কর্মমুখর চাষী যখন নতুন আমেজে মাঠে নেমে পড়ে আর তখন হঠাৎ আশাতীত বর্ষণ হলে তাদের মনের যে মলিন অবস্থা হয় আজ আশফির ঠিক একই অবস্থা। ষোল মাস পূর্বে কী হয়েছিল তাদের মাঝে তা সব ভুলে চেষ্টায় নেমেছিল সে মাহিকে অর্জন করে নেওয়ার এক নতুন পরিকল্পনাতে। কিন্তু মাহির হঠাৎ এই আমূল পরিবর্তন আর সোমের সেই নতুন করে আবির্ভাবে অনেকটা মুষড়ে পড়েছে আশফি। গাড়িটা নিয়ে অফিস পার করে সামনে এগোতেই সে দেখল মাহি নিজের অফিসের সামনে কানে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
– “হ্যাঁ সোম ভাই বলো।” – “তুই কি এখন ফ্রি আছিস?” – “হ্যাঁ মাত্রই সব কাজ শেষ করে বের হলাম। কেন কোনো দরকার?” – “না ঠিক দরকার না। আসলে…” – “এত সংকোচ করছো কেন? বলো কী দরকার?” – “তোর যদি সমস্যা না হয় তো আমি কি তোকে পিক করতে আসব?” – “হঠাৎ?” – “একটু কফিশপে যেতাম আর কী। না পারলে থাক সমস্যা নেই। শুধু বললাম যা।” – “ও এই কথা? উম্ম…আচ্ছা সমস্যা নেই। এখন তো ছয়টা বাজে। সাতটা অবধি থাকতে পারব।” – “সত্যি!” মাহি খানিকটা হেসে বলল, – “মিথ্যা তো বলি না আমি। কিন্তু তুমি কি এখন আমার অফিসের কাছে?” – “হ্যাঁ।” – “আচ্ছা তবে এসো।” আশফি দূরে গাড়িতে বসেই দেখল সোম তার বাইক নিয়ে মাহিকে বাইকে চড়িয়ে চলে গেল। তাদের পিছু করল আশফি। তারা দুজন একসাথে একটা কফিশপে গিয়ে ঢুকল। এরপর আশফি আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। . . – “দাদীবু আমি শখ করে তো আর দূরে থাকি না তাই না? কেন এমন পাগলামি করছেন বলেন তো? আর আগামী সপ্তাহে তো নতুন বাড়িতে চলে যাব। তখন আপনি এসে থাকবেন তো আমার কাছে।” – “এত ছুতা দেখাস না আমাকে। কখন মরে যাব আর তোদের মুখটাও তখন দেখে যেতে পারব না। এই-ই চাস তোরা।” হীরা কাঁদতে কাঁদতে ফোনটা দিশানের কাছে দিয়ে দিলো। – “খুবই অসুস্থ?” দিশান একটু দূরে সরে এসে দাঁড়াল। তারপর বলল, – “বাথরুমে পড়ে ভালোই চোট পেয়েছে কোমরে। ভয় তো পেয়েছিলাম হার ভেঙে গেছে কিনা। আল্লাহর অশেষ রহমত মারাত্মক কিছু হয়নি। জানোই তো একটু অসুস্থ হলেই ভাবে মরে যাবে। তাই সবাইকে দেখার জন্য ছটফট করে।” – “আচ্ছা খেয়াল রাখিস ভালো করে। আমি কাল সকালেই আসব।” – “হু। কিন্ত তোমার কি মন খারাপ? কেমন যেন লাগছে তোমার কথার সুর।” – “কিছুই না। আর কিছু হবেও না। রাখছি।” – “রেখো না। কী হয়েছে আগে বলো?” একটু চুপ থেকে খুব হতাশ সুরে আশফি বলল, – “মাহি অসম্ভবভাবে এড়িয়ে চলছে আমাকে। আর আজ দেখলাম সোমের সঙ্গে সন্ধ্যায় কফিশপে ঢুকল।” – “স্বাভাবিক।” – “কোনটা স্বাভাবিক?” – “তোমাকে এড়িয়ে যাওয়াটা।” – “তাহলে তো আর চেষ্টারই প্রয়োজন নেই। সে আমাকে পছন্দ করে না জেনেও শুধু শুধু সব…” ছোট করে শ্বাস ছাড়ল আশফি। দিশান বলল, – “খুব করে।” – “কী?” – “অস্বাভাবিকভাবে পছন্দ করে ও তোমাকে। না হলে সেদিন ওয়াশরুমের ঘটনাতে ওর উচিত ছিল তোমাকে থাপ্পড় মারা। কিন্তু তা সে করেনি। সাংঘাতিকরূপে আসক্ত সে তোমার প্রতি। তোমাকে অবশ্যই প্রচুর কাটখড় পোরাতে হবে। আর তার জন্য তোমাকে যেভাবেই হোক মাহিকে প্যারোটে আনতে হবে।” – “প্যারোটে আনা জরুরি কি?” – “খুব জরুরি। নয়তো তার প্রতি তোমার মাতোয়ারা রূপ সে দেখবে কী করে?” এরপর দুজন আরও কিছু কথা বলল। খুব হাসি ঠাট্টাও হলো দুজনের মাঝে। সবশেষে দিশান বলল, – “কাঁটা দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে তোমায়।” . ________ঠিক রাত আটটার সময় সোম এসে পৌঁছে দিয়ে গেল মাহিকে। ঘরে এসে ঢুকতেই মিমি এসে বলল, – “ও আবার শুরু করেছে?” – “কী?” – “গার্ড দেওয়াগিরি।” – “একটু অবাকই হলাম সোম ভাইকে দেখে।” – “কেন?” – “অনেকটা পাল্টিয়েছে নিজেকে। আজকে কফিশপে গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে। আসলে মুখের ওপর না বলতে পারিনি বলে। কফিশপে যাওয়ার পর দেখলাম ওর দুটো বন্ধু আর তাদের গার্লফ্রেন্ড সেখানে। ওর বন্ধুরা খুব হাসি মজা করছিল আমার সঙ্গে। কিন্তু ও সেখানে পুরোপুরিই চুপ। আগে যেমনটা কোনো ছেলে বা ওর কোনো বন্ধুর সাথেও আমার কথা বলা পছন্দ করতো না, আজ তেমন কিছুই করল না। উল্টো সে নিজেও যোগ দিলো। আর সবকিছুতেই কেমন আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করে দেখলাম।” – “এত পরিবর্তন! কী করে?” – “তা তো জানি না। আসার পথে আমার কাছে মাফ চাইল পূর্বের ঘটনাগুলোর জন্য।” – “বাহ্ দারুণ! এত ভালো হলো কি তোর দূরে থাকার বিরহে?” – “যাহ্ ফাজলামি করিস না তো।” . ________সময়গুলো ভালো খারাপ মিলিয়েই চলছিল দুজনের। নতুন কোম্পানিতে মাহি খুব দারুণভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। আর তার একনিষ্ঠ কাজের প্রতিও সবাই খুব প্রশংসিত তার প্রতি। সোমের পরিবর্তনের জন্য তার সঙ্গেও এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে মাহির। এদিকে আশফিও নিজের নতুন কিছু প্রজেক্টের কাজে ভীষণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে দুজনের দেখা হলেও অনাগ্রহীভাবে দুজন দুজনকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুজনের চাহিদাটা থাকে এমন, যেন একটাবার হলেও কোনোভাবে কথা বলার সুযোগ হয় তাদের। কিন্তু দুজনেরই একই জিদ থাকে যে সে গিয়ে যেচে পড়ে কখনোই কথা বলবে না আগে। আর অপ্রত্যক্ষভাবে আশফি তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটালেও সে কোনোভাবে নিজের ইগোকে মূল্যহীন করতে রাজি নয়। দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল নতুন কোম্পানিতে মাহির। খুব দ্রুতই সে ভালো একটি পজিশনে আসতে পারবে বলে আশা রাখে সে। কিন্তু বিপত্তি ঘটল সেদিন। যেদিন মাহি কোম্পানির প্রথম সেলারি পেল সেদিন অফিস বেশ দেরিতেই ছুটি হলো তার। রাস্তায় তারপর আবার জ্যামের ফাঁদে পড়ে রাত বেজে গেল নয়টা। নিজের বাড়ির গলির মোড়ে ঢুকতেই এক ভয়াবহ বিপদের শিকার হলো সে। খুব শক্ত করেই পেছন থেকে কেউ তাকে জাপটে ধরে মুখ চেপে ধরেছে। সেই পুরোনো ভয়ংকর দিনটার পুনরাবৃত্তি। যে আতংকে দু দুটো বছরেও সে একা পথে যাতায়াত করার সাহস পায়নি। মানুষটা মাহিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল কোনো একটা চিপা জায়গাতে। চারপাশে এত বেশি অন্ধকার যে মাহি নিজের গায়ের সাদা শাড়িটাও দেখতে পাচ্ছে না। চিৎকার করার সুযোগটুকুও সে পেল না। মুখে কস্টেপ ধরনের কী যেন লাগিয়ে দেওয়া হলো। এরপর হাতদুটোও বেঁধে দিতে চেষ্টা করল পেছনে নিয়ে। চোখের পানিতে পুরো গালটা ভিজে একাকার মাহির। সেদিনটাতে রক্ষা পেলেও আজ আর বোধহয় সে রক্ষা পাবে না। ……………………………. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে