#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ২
“অসম্ভব, আমার মেয়েকে আমি এখন বিয়ে দিবো না। মেয়ে পড়াশোনা শিখবে আগে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তারপর অন্য কথা চিন্তা করবো।”
মার্জিয়া বেগম স্বামীর কথায় বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকায়।
কবির শাহ নরম গলায় বললো,”আমার কথা শুনো প্রিয়তার মা। আমি একজন শিক্ষক। আমি অন্যদের শিক্ষা দিই, মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব। সেখানে আমার নিজের মেয়েকে যদি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিই, মানুষ কি বলবে?”
মার্জিয়া বেগম চোখ লাল করে বললো,”তার আগেই মেয়ে যদি কোনো কেলেংকারী করে বসে? সেই দায় কে নিবে? এরপর কি মেয়েকে আর বিয়ে দিতে পারবে?”
কবির শাহ হতবাক হয়ে বললো,”এসব কি বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার? কি কেলেংকারী করবে আমার মেয়ে?”
“আমার মাথা ঠিক আছে। ঘরে যে প্রাপ্তবয়স্কা দুইটা মেয়ে আছে সে খেয়াল তোমার নেই। বাইরের একটা ছেলেকে ঘরে এনে তুলেছো। ওদের বয়সটাই তো ভুল করার। যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় সেই দায়ভার কে নিবে? ওই ছেলে তো এতীম, ওর কোনো পিছুটান নেই। ও একটা অঘটন ঘটিয়ে কেটে পড়বে। কিন্তু আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে?”
কবির শাহ আরো অবাক হয়ে বললো,”তুমি কি উচ্ছ্বাসের কথা বলছো?”
মার্জিয়া বেগম দাঁত কিড়মিড় করে।
“উচ্ছ্বাস মোটেই এমন ছেলে নয় মার্জিয়া। এসব ভুলভাল চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।”
মার্জিয়া বেগম এবার একটু চিৎকার করে ওঠে।
“বেশ তো, তোমার ওই মহাপুরুষ ভাবলাম ফেরেশতা পর্যায়ের মানুষ। কিন্তু আমার মেয়ে তো নয়।”
কবির শাহ চুপ করে যায়। আসলেই কিছু বলার নেই তার। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে, এই কথাগুলো নিজে থেকে মার্জিয়ার মাথায় আসেনি। কেউ তার মাথায় ঢুকিয়েছে। হয়তো তার বড় বোন মর্জিনা বেগম এসব বলেছে। এসব কারণেই সে তার স্ত্রীর বড় বোনকে খুব একটা পছন্দ করেনা। তার স্ত্রী একটু রাগী হলেও সহজ সরল। কিন্তু যতবার তার বড় বোন এ বাড়িতে এসেছে, ততবারই মার্জিয়াকে কোনো না কোনো বিষয়ে কানপড়া দিয়ে বিষিয়ে তুলেছে সংসারের প্রতি।
কবির শাহকে চুপ থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় মার্জিয়া।
“আমার মতো অসুখী আমি আমার মেয়েদের হতে দিবো না। টাকা ছাড়া সুখ নেই। মেয়ে যদি সুখী হয়, তাতেই আমার শান্তি।”
কবির শাহ মুচকি হেসে বললো,”তুমি আমার সাথে অসুখী?”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা দমে যায়।
“হয় মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করবে নাহয় ওই ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করবে। এখন দেখো তোমার কোনটা ভালো মনে হয়।”
হনহন করে হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে যায় মার্জিয়া। কবির শাহ হতাশ মুখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
গান থামিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে প্রিয়তা আর পেখমের দিকে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাস। প্রিয়তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে, পেখম সেই তুলনায় হাসিখুশি।
“উচ্ছ্বাস ভাই, আপনি কিন্তু দারুণ গান করেন। চেষ্টা করলে বড় গায়ক হতে পারবেন।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে পেখমের দিকে তাকায়।
প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো,”নিচে চল পেখম।”
“আরে আপা দাঁড়া তো। উচ্ছ্বাস ভাই আরেকটা গান করুন না।”
উচ্ছ্বাস একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,”এখানে এসেছো কেনো তোমরা?”
পেখম হাসিমুখে বললো,”আসা কি নিষেধ? জানতাম না তো উচ্ছ্বাস ভাই। জানলে আসতাম না।”
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে একবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায় আর একবার বোনের দিকে। উচ্ছ্বাস রাগী মুখে পেখমের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু পেখমের সেদিকে খেয়াল নেই।
“কান খুলে শুনে রাখো তোমরা দুইজনই। আমার আশেপাশে তোমাদের যেনো আর না দেখি। একদম আমাকে বিরক্ত করবে না তোমরা।”
পেখম চোখ কপালে তুলে বললো,”আমরা আপনাকে বিরক্ত করেছি? আমরা তো চুপ করে আপনার গান শুনছিলাম। একটা কথাও বলিনি।”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না। হাতের আধখাওয়া সিগারেটটা পিষে ফেলে হাতের মধ্যেই।
প্রিয়তা আঁৎকে উঠে বললো,”আরে কি করছেন? আপনার হাত পুড়ে যাবে তো।”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝড়ের বেগে চলে যায় ওদের সামনে থেকে। খানিক বাদেই সিঁড়িতে তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।
প্রিয়তা মুখ ভার করে বললো,”কি দরকার ছিলো উনাকে রাগানোর বল তো?”
পেখম মুখ টিপে হেসে বললো,”তুই থাম তো আপা। উনার দেমাগ আমি বের করবো। একটু ভালো চেহারা আর ভালো গান করে দেখে অহংকারে পা মাটিতে পড়ে না। মজা বুঝাবো আমার।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”তার মানে কি? কি করতে চাচ্ছিস তুই?”
“আরে তুই দেখ না।”
“দেখ পেখম উল্টাপাল্টা কিছু করিস না। উনার বোধহয় পছন্দ না আমরা উনার সামনে আসি। যার যেটা পছন্দ না, কি দরকার তবে? উনাকে উনার মতো ছেড়ে দে।”
“না রে আপা, আমার মনে হয় না এটা উনার আসল রূপ। আমার কি মনে হয় জানিস?”
“কি?”
“উনার মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর আর নির্মল একটা শিশুসুলভ মানুষ বাস করে। কোনো এক পরিস্থিতির চাপে পড়ে উনি এমন হয়ে গেছে বা ইচ্ছা করে এমন করছে।”
প্রিয়তা জোর করে হাসার চেষ্টা করে। হাসতে পারেনা ঠিক। তার বোনকে বিশ্বাস নেই। সে যখন বলেছে কিছু একটা করবে তো করেই ছাড়বে।
সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছে পেখম। প্রিয়তাও আজ পেখমের সাথে একসাথেই কলেজের উদ্দেশ্যে বের হবে। মার্জিয়া বেগম এক হাতে নাশতা আর ওদের টিফিন বানাচ্ছে। মেজাজ আজকেও চড়ে আছে তার।
কবির শাহ উচ্ছ্বাসের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে ঘর থেকে। ছেলেটা যে কেনো এমন চেইনস্মোকার হয়ে গেলো সে বুঝতে পারছে না। ও তো এমন ছিলো না। ঘরে ঢুকতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করে সে।
“মামা আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”
কবির শাহ অপ্রস্তুত হয়ে হাসে।
“ভিতরে আসুন।”
“বাবা তোমার এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? কোনো কিছুর দরকার হলে সোজা আমাকে বলবে। একদম লজ্জা করবে না।”
উচ্ছ্বাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কবির শাহ উচ্ছ্বাসের মাথায় হাত রাখে, উচ্ছ্বাস কিছুটা কেঁপে ওঠে।
“তোমার মনটা কি খারাপ বাবা?”
“একটা কথা বলবো মামা?”
“হ্যা বলো।”
“আমি আসায় আপনাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। আমি বরং চলে যাই।”
কবির শাহর মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়।
“এমন কথা বলছো কেনো তুমি? কেউ কি তোমাকে কিছু বলেছে?”
কবির শাহ খুব ভালো করেই জানে মার্জিয়ার ব্যবহারেই উচ্ছ্বাস এমন কথা বলছে।
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না, ছোট্ট করে হাসে। এতো সুন্দর হাসি দেখেও কবির শাহের বুকটা কেমন হাহাকার করে ওঠে। বিষাদে মাখা হাসিটা দেখে তার এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো?
“কারো কথায় কিছু মনে করবে না তুমি। আমি যতদিন বেঁচে আছি তুমি আমার কাছেই থাকবে। কেউ না জানুক, আমি জানি আমার দু:সময়ে যখন কেউ ছিলো না আমার পাশে, পেট ভরে খেতে পর্যন্ত পারতাম না তখন তোমার বাবা মা-ই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি যে এতোটা অকৃতজ্ঞ হতে পারবো না বাবা।”
উচ্ছ্বাস কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়।
“চলো আজ থেকে তুমি আমাদের সাথে টেবিলে বসে খাবে।”
উচ্ছ্বাস নিচু গলায় বললো,”না মামা, আমি ঘরেই খাবো।”
কবির শাহ উচ্ছ্বাসের হাত ধরে টেনে টেবিলের কাছে নিয়ে আসে।
পেখম আর প্রিয়তা মাত্রই খেতে বসেছে৷ মার্জিয়া বেগম তাদের খাবার দিচ্ছে। উচ্ছ্বাসকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। এতোদিন সে নিজের ঘরে বসেই খেতো।
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”প্রিয়তার মা ওকে এখানেই খেতে দাও। আজ থেকে ও আমাদের সাথে বসে খাবে।”
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকায়। মনে মনে বলে,’মা দয়া করে কিছু বলো না উনাকে, তোমার দোহাই লাগে। উনাকে কষ্ট দিও না মা।’
মার্জিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”বসে পড়ো, খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো সবাই।”
কবির শাহের মনটা ভালো হয়ে যায়। তার স্ত্রী বাইরে যতোই কঠিন হোক, ভিতরে তার মধ্যেও একটা মমতাময়ী মা বাস করে। পেখম বাঁকা চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা মুগ্ধ চোখে একদৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। ধূসর রঙা শার্টে একজন যুবককে এতো সুন্দর লাগতে পারে?
“উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাস কঠিন চোখে পেখমের দিকে তাকায়।
“যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলবো?”
“কি কথা?”
“আপাকে একটু কলেজ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবেন?”
“কি বললে তুমি? আমি এগিয়ে দিয়ে আসবো?”
“আসলে হয়েছে কি উচ্ছ্বাস ভাই, আমার স্কুল তো কাছেই। আপার কলেজ আরো দূরে। আমি স্কুলে ঢুকে যাওয়ার পর আপাকে আরো অনেকটা রাস্তা একা যেতে হবে। তাই আপনি যদি……”
“তোমার আপা কি ছোট বাচ্চা? আর তোমাকে না বলেছি তোমরা দুই বোন আমার সামনে আসবে না অকারণে? তোমরা কি একটু কম বুঝো?”
প্রিয়তা আড়ালে দাঁড়িয়ে পেখমের জামা টানতে থাকে।
ফিসফিস করে বললো,”বাড়াবাড়ি করিস না পেখম, চল এখান থেকে।”
পেখম একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো,”আসলে পাড়ার মোড়ের কিছু বখাটে ছেলে আপাকে খুব বিরক্ত করে। এজন্যই আপনাকে বলেছিলাম।”
“তো আমি কি করবো? একদম বিরক্ত করবে না আমাকে।”
পেখম কিছুটা দমে যায়। তাহলে কি তার ভাবনা ভুল? এই মানুষটা আদতেই এমন রগচটা?
“চল রে আপা, কি আর করবি? বাবার তো বয়স হয়েছে। আমাদের বাড়িতে তো আর কোনো পুরুষও নেই। একটু নাহয় সহ্য করে নে।”
সে এটুকু বলে আড়চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। চোখমুখ একদম লাল হয়ে গেছে তার পেখমের খোঁচা দেওয়া কথা শুনে। মুখ টিপে হাসে পেখম
“কি দরকার ছিলো উনাকে এসব বলার? তোর সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। এগুলো আমার একদম পছন্দ না।”
প্রিয়তা রাগ করে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। তার চোখে পানি চলে আসছে বারবার। চোখজোড়া ভীষণ জ্বালা করছে তার। সে পেখমকে নিষেধ করলেও তার অবচেতন মন বলছিলো মানুষটা তার সাথে আসবে। কিন্তু তার মনটা ভেঙে গেছে একদম। পেখমও মুখ ভার করে হাঁটতে থাকে।
পেখম স্কুলের গেটে ঢুকতে যাবে ঠিক এমন সময় আচমকা স্তম্ভিত হয়ে যায় সে। প্রিয়তার শরীরে খোঁচা দেয় সে।
“আপা আমাকে একটা চিমটি কেটে দে তো।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।
“রাস্তার ওপাশে দেখ।”
প্রিয়তা পেখমের কথামতো সেদিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
বুকে দুই হাত বেঁধে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে তার মুখ থমথম করছে।
পেখম ঠোঁট কামড়ে হাসে। প্রিয়তার এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে। এটাও কি সম্ভব?
“যা আপা, দেরি করিস না। মানুষটা কতোক্ষণ অপেক্ষা করবে?”
প্রিয়তা ঘোর লাগা চোখে তাকায় বোনের দিকে। ছোট বাচ্চা মেয়ের মতো খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে তার। বহু কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রাখে সে।
প্রিয়তা দাঁড়ায় উচ্ছ্বাসের মুখোমুখি। এখনো পর্যন্ত একবারও উচ্ছ্বাস তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি এখানে দাঁড়িয়ে।
“একটা কথা কান খুলে শুনো এবং সেই সাথে মাথায় ঢুকিয়ে নাও। আহ্লাদী করা আমার পছন্দ নয়। আমার সামনে কেউ করুক তাও আমার ভালো লাগেনা। রাস্তায় এমন ভাবে হাঁটবে যেনো কেউ বুঝতে না পারে আমরা পরিচিত। তুমি সামনে সামনে হাঁটবে, আমি পিছনে। একবারও পিছন ঘুরে আমার দিকে তাকাবে না। মনে থাকবে?”
প্রিয়তা আস্তে আস্তে ঘাড় কাৎ করে। খুশিতে তার মনটা কানায় কানায় ভরে আছে। সে যে তাকে কলেজ পর্যন্ত এগিয়ে দিবে এটাই তো অনেক, আর কি চাই?
প্রিয়তা মনে মনে দোয়া করছে আজ যেনো কোনোভাবেই ওই বখাটে ছেলেগুলো চায়ের দোকানে আড্ডা না দেয়। উচ্ছ্বাসের সামনে যদি তারা প্রিয়তাকে নোংরা কথা বলে? কি লজ্জার একটা ব্যাপার হবে?
কিন্তু প্রিয়তার দোয়া কবুল হলোনা।
আজ আরো কয়েকজন বেশি ছেলে আজ বসে আছে ওদের সাথে। সবাই আগে থেকেই বিশ্রীভাবে হাসছিলো কিছু একটা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে করতে।
প্রিয়তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে যায় পিছনে উচ্ছ্বাস আছে কিনা। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে নিষেধাজ্ঞা। ব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ধরে আগাতে থাকে সে।
শেষ রক্ষা হয়না। ছেলেগুলো ততক্ষণে প্রিয়তাকে দেখে ফেলেছে।
কালো করে একটা ছেলে অন্য একজনকে খোঁচা দিয়ে বললো,”দেখ মা’লটা এসেছে। উফফ আজ একদম পরী লাগছে রে।”
প্রিয়তার কান গরম হয়ে ওঠে। বুক কাঁপতে থাকে তার। মনে হচ্ছে সে আর আগাতেই পারছে না। পা দু’টো অনড় হয়ে আছে তার।
“আরে এমন কালো বুঝি পরী হয়?”
“ব্লাক ডায়মন্ড রে। কালো তাতে কি? চেহারার আর্টটা দেখছিস? উফ!”
“এই চুপ সবাই, তোদের ভাবী হয় ও।”
“বন্ধু ভাবী বানাইলে আমাদেরও একটু দিস, চেখে দেখবো কেমন।”
এই বলে আরো বিশ্রীভাবে হাসতে থাকে ওরা। প্রিয়তাকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন নামে ডাকতেও থাকে ওরা। প্রিয়তা এক রকম দৌড়েই জায়গাটা পার করে। লজ্জায়, অপমানে চোখে পানি চলে আসে তার। হয়তো সে চেয়েছিলো উচ্ছ্বাস প্রতিবাদ করবে। কিন্তু কোনো কথাই সে বলেনা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে তার রাস্তার মধ্যেই।
কলেজ গেটে প্রিয়তা এসে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাস দাঁড়ায় তার কাছে এসে।
প্রিয়তা একটু ঝাঁঝের সাথে বললো,”অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এই পর্যন্ত আসার জন্য। না আসলেও হতো। পেখম অতিরিক্তই করে সবসময়। এটা তো আমার নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে গেছে। আর আমি সহ্য করেও নিয়েছি। আপনি কেনো আমার জন্য কিছু বলতে যাবেন তাদের? আমি আপনার কে? আপনি তো আবার আমাদের বাড়ির দুই দিনের অতিথি। আজ আছেন কাল নেই। আগামীকাল থেকে আমি একাই আসবো। কাউকেই আমার সাথে আসতে হবে না।”
একদম কথাগুলো শেষ করে প্রিয়তা। সে নিজেও জানেনা এসব কেনো বলছে সে। তার মনের কোনো একটা কোণায় হয়তো এমন বাসনা ছিলো, তার হয়ে মানুষটা কিছু বলবে, প্রতিবাদ করবে। মানুষের মন বড় অদ্ভুত এক জিনিস। অনেক সময় সেই মন মস্তিষ্কের চিন্তাধারাও বন্ধ করে দেয়।
উচ্ছ্বাস শান্ত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। হয়তো কাজল দিয়েছে মেয়েটা। কিছুটা লেপ্টে আছে চোখের পানিতে। আচ্ছা, এই কাজল কি শুধু শ্যামলা মেয়েদের জন্যই বানানো হয়েছে? সামান্য কালো রঙের কি এমন শক্তি যে একটা মেয়ের সৌন্দর্য এভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে?
প্রিয়তা আর কোনো কথা না বলে কলেজ গেটে ঢুকে যায়। সেদিকে তাকিয়ে একটা ক্রুর হাসি দেয় উচ্ছ্বাস।
বড় গাড়ি এসে থেমেছে প্রিয়তাদের ছোট্ট বাড়িটার সামনে। মর্জিনা বেগম নতুন গাড়ি কিনেছে। মূলত সেইটা দেখানোর জন্যই এসেছে সে। সাথে আরো কিছু বড়লোকি আলাপ। মার্জিয়া বেগম মুগ্ধ হয়ে গাড়িটা দেখছে। কি সুন্দর কচুয়া রঙের গাড়ি। সচারাচর দেখা যায়না এমন রঙের গাড়ি। মার্জিয়া বেগম ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে গাড়িটা।
“কি রে কেমন লাগলো?”
“খুব সুন্দর গাড়ি আপা। রঙটা এতো সুন্দর।”
“আর বলিস না, তোর দুলাভাইকে তো চিনিস। কবে একদিন বলেছিলাম এই রঙটা আমার ভীষণ প্রিয়। হঠাৎ এসে বললো চলো তোমার পছন্দের রঙের কিছু কিনে দিই। ভেবেছিলাম এই রঙের একটা শাড়ি কিনে দিবে। ওমা, সে যে এই রঙের গাড়ি কিনে আনবে তা কে জানতো?”
মর্জিনা বেগম খুব হাসতে থাকে এতোটুকু বলে। মার্জিয়া তার দিকে তাকায়। চোখজোড়া কড়কড় করে ওঠে তার। আজ কি তার জীবনটাও এমন হতে পারতো না? একই মায়ের পেটের দুই বোন। একজনের স্বামী গাড়ি উপহার দেয় আর একজনের স্বামীর দশ টাকা রিকশা ভাড়া বাঁচানোর জন্য হেঁটে বাড়ি ফেরে।
“মন খারাপ করে কি করবি বল? যার কপালে যেমন থাকে আর কি। তবে এখনো সবকিছু হাতছাড়া হয়ে যায়নি। যদি মেয়েদেরও এমন রাজকপাল দেখতে চাস, আমার কথা শোন। ছেলেপক্ষ খুব তাড়াতাড়ি মেয়েকে দেখতে আসতে চায়। কবিরকে জানিয়েছিস তো সব?”
মার্জিয়া মিনমিন করে বললো,”আসলে আপা, প্রিয়তার বাবা এখন রাজি হচ্ছে না। আমি সব বলেছি তাকে।”
মর্জিনা বেগমের মুখ কালো হয়ে সায় সাথে সাথে।
“তা রাজি হবে কেনো? সারাটা জীবন আমার বোনটাকে যেমন কষ্টে রেখেছে, মেয়েগুলোকেও তাই চায়।”
রাগে গজগজ করতে থাকে মর্জিনা বেগম। মার্জিয়ার মনটা খচখচ করতে থাকে। সে যা পায়নি, মেয়েদের পাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই সুখ পেতে চায় সে।
“বুঝেছি, তোকে দিয়ে কিছুই হবে না।আমি কথা বলবো কবিরের সাথে। সবকিছু ঠিক থাকলে, আগামী পরশুই মেয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করবো আমি।”
মার্জিয়া বেগম ক্ষীণ গলায় বললো,”আপা কিছুদিন দেরি করলে হয়না? মানে মেয়েটা অন্তুত উচ্চমাধ্যমিকটা পার করুক। বুঝতেই পারছো, একদমই কাঁচা বয়স।”
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”ছেলেপক্ষের তো খেয়ে কাজ নেই, তোর মেয়ের জন্য এতোদিন অপেক্ষা করতে যাবে। কতো মেয়ের বাবা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে জানিস? আহামরি কোনো রসগোল্লাও নয় তোর মেয়ে। রাজি হয়েছে তোর দুলাভাইয়ের বিজনেস পার্টনার এই সুবাদে।”
মার্জিয়া বেগম তবুও উশখুশ করতে থাকে। সে-ও চায় তার আপা মতো এমন রাজকপাল, এতো সুখ তার মেয়েদেরও হোক। এই সম্বন্ধ হাতছাড়া হয়ে গেলে কি এমন আর পাওয়া যাবে? মেয়ে আহামরি সুন্দরীও নয়। পেখমকে নিয়ে চিন্তা নেই, ও যথেষ্ট সুন্দরী। যতো দুশ্চিন্তা তার বড় মেয়েটাকে নিয়ে। তবুও তার ভয় হয়। তার মেয়েটা বোকা, বেশ বোকা। সবকিছু সামাল দিতে পারবে তো? মার্জিয়া বেগম কচুয়া রঙের গাড়িটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে এসব রাজ্যের চিন্তা করতে থাকে।
রাতের খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। প্রিয়তার খেতে ইচ্ছা করছিলো না। মূলত সে উচ্ছ্বাসের সামনে আসতে চায়নি। তার বাবা জোর করে তাকে ডেকে এনেছে। সে আবার তার বাবার অনুরোধ ফেলতে পারেনা। উচ্ছ্বাসের সেদিকে খেয়াল নেই। সে নিজের মতো চুপচাপ বসে আছে। পেখম একবার আপার দিকে, আরেকবার উচ্ছ্বাস ভাইয়ের দিকে তাকায়। বাড়ি ফেরার পর থেকে আপার মুখ ভার। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
মার্জিয়া বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,”কি হয়েছে তোমার? এতো খুশি লাগছে কেনো তোমাকে?”
কবির শাহ খেতে খেতে বললো,”যদিও খুশি হওয়া উচিত নয়, তবুও আজ যা ঘটেছে তাতে খুশি লাগছে আমার বটে।”
পেখম বললো,”কি হয়েছে বাবা?”
“আর বলিস না, আমাদের এলাকার হারুণ মিস্ত্রীর ছেলে মজিদ আছে না?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা চোখে তাকায় বাবার দিকে। মজিদ তো ওই ছেলেগুলোর মধ্যে একজন। সে আবার কি করেছে?
“ছেলেটা আমার ছাত্র ছিলো। কিন্তু কলেজে ওঠার পর থেকে একদম বখে গিয়েছিলো। পাড়ায় মোড়ে মোড়ে মেয়েদের বাজে ইঙ্গিত দিতো, নোংরা কথা বলতো। পাড়ার কোনো মুরুব্বিকেও মানতো না। আরো কিছু বন্ধু জুটিয়েছিলো ওর মতোই। আমি কতো নিষেধ করেছি, ওর বাবাকেও জানিয়েছি। কোনোভাবেই কাজ হয়নি। আমার নিজের চোখের সামনে একদিন দেখেছি স্কুল পড়ুয়া একটা মেয়েকে কতো বিশ্রী ভাষায় খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমি বাঁধা দিতে গিয়েছিলাম, শিক্ষক হিসেবে আমাকে একটু মানলো না। বরং আমাকেও কিছু কথা শুনিয়ে দিলো। শিক্ষক হিসেবে এটা যে আমার জন্য কতোটা লজ্জার। কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছিলো না ওদের দলটাকে। উপরন্তু দিন দিন বাড়ছিলো। এমন একটা অবস্থা যে মেয়েরা ওদের সামনে দিয়ে যেতেই ভয় পাচ্ছিলো।”
প্রিয়তার বুক ধকধক করতে থাকে। বাবা যদি জানতো ওই বদমাশটা তার মেয়ের পিছনেও লেগেছে তাহলে তো আরো রেগে যেতো।
মার্জিয়া বেগম বললো,”কি হয়েছে তাদের?”
“আর বলো না, কে বা কারা আজ সন্ধ্যায় ওদের খুব করে মেরে আমাদের পূবের খেলার মাঠটায় ফেলে রেখেছে। একদমই চেহারা চেনার মতো নেই, এমন অবস্থা। কারো নাক ফাটিয়েছো তো কারো হাত ভেঙেছে। পরে স্থানীয়রা দেখতে পেয়ে তাদের হাসপাতালে পাঠিয়েছে। যতোই হোক আমার ছাত্র তো ছিলো। আমার দায়িত্ববোধ থেকে আমি ওদের দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। খুবই ভয় পেয়ে আছে ওরা।”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে বললো,”কে করলো এই কাজ?”
“কি জানি, তবে এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিলো।”
প্রিয়তা খাওয়া থামিয়ে মুখ হা করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। পেখম হতবাক হয়ে তাকায় আপার দিকে। আপাকেও হতবিহ্বল মুখে দেখলো। তার মানে কি সে যা ভাবছে আপাও তাই ভাবছে? দুইজনই একসাথে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। তার এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একমনে খেয়ে যাচ্ছে সে। যেনো এতোগুলো কথা তার কানেই যায়নি।
প্রিয়তার বুক কাঁপছে, ধাতস্থ হতে পারছে না সে কোনোভাবেই। তার মন বলছে এই কাজ এই মানুষটা ছাড়া আর কারো নয়। প্রিয়তাকে খারাপ কথা বলেছে বলেই কি উচ্ছ্বাস এমন কাজ করলো?
সূক্ষ একটা হাসি ফুটে ওঠে প্রিয়তার ঠোঁটের কোণে। তবে কি তার মতো একই অনুভূতি বিপরীত দিকেও আছে?
(চলবে…..)