তুমি প্রেম হলে আমি প্রেমিক পর্ব-০১

0
98

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১

সকাল সকাল মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে মার্জিয়া বেগমের। তার একটা বদ অভ্যাস আছে, সকালে একবার মেজাজ কোনোভাবে খারাপ হয়ে গেলে সারাদিনে আর মেজাজ ভালো হয়না তার। যাকে সামনে পায় তার উপরই রাগ ঝাড়তে থাকে। তার এই অভ্যাসের কথা তার স্বামী আর দুই মেয়ে খুব ভালো করেই জানে। তাই সকালবেলাটায় তারা খুব সাবধানে থাকে, কোনোভাবেই মার্জিয়া বেগমকে রাগাতে চায়না তারা।
“আমার হয়েছে যতো জ্বালা। আমার স্বামী তো যেনোতেনো পুরুষ নয়, যেনো ফাদার তেরেসা।”
মার্জিয়া বেগমের ছোট মেয়ে পেখম। এইবারই নবম শ্রেণিতে উঠেছে। একটু চটপটে স্বভাবের মেয়ে। মায়ের মুখে ফাদার তেরেসা শুনে ভীষণ হাসি পাচ্ছে তার। কিন্তু হাসতে পারছে না। এখন তাকে হাসতে দেখলেই তার মা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে। সমস্ত রাগ তার উপরই ঝাড়বে পরে।
কাজের মেয়ে শেফালি আসতে দেরি করেছে আজ। ভয়ে ভয়ে সে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। আজকের রাগের কারণ কি তবে তার দেরিতে আসা? বুঝতে পারছে না সে।
ঝমঝম করে স্টিলের বাসনকোসনের শব্দ করে মার্জিয়া বেগম। যেনো কাউকে না পেয়ে এগুলোর উপরই মেজাজ দেখাবে সে।
শেফালি মুখ কাচুমাচু করে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”খালাম্মা কোনো সমস্যা হইছে?”
মার্জিয়া বেগম সেদিকে না তাকিয়েই নিজের মনে চিৎকার করতে থাকে।
“সমস্যা আর কি? এই সংসারে আমি নিজেই তো সমস্যা। আমার কথা এখানে কে শোনে?”
শেফালি কথা বাড়ায় না। সে বুঝতে পারে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যা বলার মার্জিয়া বেগম নিজেই বলবে।

“বলা নেই কওনা নেই, একটা হাড়হাভাতে ঘরের এতীম ছেলেকে বাড়ি এনে তুলছে। তার নাকি কোন জন্মের বোনের ছেলে। তাও নিজের বোন হলেও মানা যেতো। চেনা নেই জানা নেই, এসেই বললো আজ থেকে ও আমাদের সাথে থাকবে। অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম আমি এই সংসারে।”
স্ত্রীর চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হয়ে আসে কবির শাহ। পেশায় একজন হাইস্কুলের গণিতের শিক্ষক। অন্যান্য গণিতের শিক্ষকদের মতো মোটেই রাগী নয় সে, বরং খুব শান্ত মেজাজের।
“কি হচ্ছে কি প্রিয়তার মা? এভাবে চিৎকার করছো কেনো? ছেলেটা শুনতে পাবে তো।”
তেলেবেগুনে যেনো জ্বলে ওঠে মার্জিয়া বেগম। চোখ দিয়ে আগুন ঝরতে থাকে তার।
“শুনুক, শোনার জন্যই তো বলছি। দুই মাস হয়ে গেলো আপদ এনে জুটিয়েছো আমার ঘাড়ে। কবে বিদায় নিবে তার কোনো ঠিক নেই। কোনো চাকরিবাকরি খোঁজার ইচ্ছাও নেই। পরের কাঁধে বসে খেতে পারলে কে কষ্ট করে চাকরি খোঁজে?”
কবির শাহ হতভম্ব হয়ে যায় স্ত্রীর কথা শুনে। বার বার ও ঘরের দিকে তাকায়। ছেলেটা আবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে না তো এতো কিছু শুনে? সে বের হয়ে যাবেই বা কোথায়? তার তো যাওয়ার জায়গা নেই।
“প্রিয়তার মা, আমি হাতজোড় করছি তোমার সামনে। দয়া করে চিৎকার করোনা এভাবে। আর ও তো তোমাকে কোনোরকম বিরক্ত করছে না।”
মার্জিয়া বেগম চুপ করে থাকে। ভিতর ভিতর রাগে ফুঁসতে থাকে সে।
কবির শাহ আস্তে আস্তে হেঁটে মার্জিয়া বেগমের কাছে যেয়ে দাঁড়ায়।
নরম গলায় বললো,”কি হয়েছে প্রিয়তার মা? আমাকে বলো।”
“কি হবে তোমাকে বললে? কোনো সমাধান করতে পারবে তুমি?”
“তবুও বলো, চেষ্টা তো করতে পারি।”
“ঘরে কোনো সবজি ছিলো না। তাই ওকে যেয়ে বললাম কিছু সবজি এনে দিতে সামনের বাজার থেকে। কি এনেছে জানো? বাজারের সব পঁচা, নষ্ট সবজিগুলো ব্যাগ ভরে নিয়ে চলে এসেছে। টাকাগুলো সব জলে গেলো আমার।”
কবির শাহ অবাক হয়ে বললো,”তুমি ওকে দিয়ে বাজার করিয়েছো? কেনো আমাকে বলতে পারতে না?”
মার্জিয়া বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”কেনো ও কোন জমিদারের ছেলে? হাতে ফোস্কা পড়েছে ওর বাজার করতে? বলেছি বলে ইচ্ছা করে এমন বাজার করেছে, যাতে আর কোনোদিন ওকে না বলি।”
কবির শাহ মুখ কালো করে বললো,”তুমি জানো ও ওর বাবা মায়ের কতো আদরের সন্তান ছিলো? কোনোদিন গ্লাস থেকে পানি ঢেলে পর্যন্ত খেতে হয়নি তাকে। এগুলো ও শিখবে কীভাবে?”
“এটা ওর বাড়ি নয়, এটা আমার বাড়ি। এখানে থাকতে হলে কাজ করে খেতে হবে।”
মার্জিয়া বেগম কিছু বলতে যাবে তার আগে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ায় তাদের বড় মেয়ে প্রিয়তা। প্রিয়তার চোখ ঈষৎ ভেজা। মনে হচ্ছে কেঁদেছে কিছুক্ষণ আগে।
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি হয়েছে? এখানে কেনো তুই?”
“এক কাপ চা লাগবে।”
“তুই তো চা খাস না।”
কবির শাহ বিরক্ত হয়ে বললো,”এতো প্রশ্ন করছো কেনো? নাহয় আজ খেতে ইচ্ছা করছে ওর। আয় মা, তোকে আমি আজ চা বানিয়ে দিই। দেখবি কেমন মজা করে চা বানাই।”
প্রিয়তা কঠিন গলায় বললো,”প্রয়োজন নেই বাবা। আমি নিজেই বানাবো।”

কবির শাহ এক গাল হেসে তাকায় মেয়ের দিকে। দুই মেয়ে তার জগতের সবকিছু। পুরো পৃথিবী একদিকে আর তার মেয়েরা একদিকে।
মার্জিয়া বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকায়। আজকাল মেয়ের ভাবগতিক কিছুই ভালো লাগেনা তার। এমনিও ছোট থেকে মেয়েটা ভীষণ চুপচাপ, শান্ত। আর পেখম চঞ্চল। তবুও ইদানীং প্রিয়তাকে আরো বেশি বিষন্ন লাগে। মার্জিয়া বেগমের দুশ্চিন্তা হয়। অষ্টাদশী কিশোরী সে। এই বয়সটা ভয়ংকর। সে নিজেও এমন একটা বয়স পার করে এসেছে বলে বুঝতে পারে। এই বয়সে হেমলক বিষকেও অমৃত লাগে।

প্রিয়তা চায়ের কাপ নিয়ে বেরিয়ে যায়। মেয়েটাকে অতিরিক্ত সুন্দরী বলা যায়না। গায়ের রঙ নেহাৎ চাপা, তার বাবার মতো। এই সমাজ গায়ের রঙের উপর ভিত্তি করে সৌন্দর্য নির্ধারণ করে মেয়েদের। কিন্তু যদি কেউ খুব ভালো করে মেয়েটাকে লক্ষ্য করে সে মুগ্ধ হতে বাধ্য। চোখজোড়া একদম দীঘিতে ভাসতে থাকা ফুটন্ত পদ্মের মতো টানাটানা। দীর্ঘ অক্ষিপল্লবের পাপড়িগুলো যেনো ওর পুরো মুখের আদল আরো আবেদনময়ী করে তুলেছে। সুবিন্যস্ত দন্তপাটি মেলে যখন হাসে, তখন মার্জিয়া বেগম তাকাতে পারে না মেয়ের দিকে। বাবা মায়ের নজর বেশি লাগে কিনা! বাম গালের টোলটা তার হাসিকে আরো সুন্দর করে দিয়েছে। মার্জিয়া বেগম প্রায় মনে মনে বলে,’ইশ মেয়েটা যদি আরেকটু ফর্সা হতো!”
কবির শাহ মুচকি হেসে বললো,”মেয়েগুলো দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে তাইনা? কিছুদিন পরেই উচ্চমাধ্যমিক দিবে মেয়েটা। অথচ সেদিনই এতোটুকু ছিলো।”
মার্জিয়া বেগম ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,”মেয়েদের উপর থেকে টানটা এবার একটু কমাও। দুইদিন বাদে মেয়েরা পরের ঘরে যাবে, তখন নিজেই কষ্ট পাবে।”
কবির শাহ কিছু বলেনা, শুধু কুটকুট করে হাসতে থাকে।

বদ্ধ দরজার সামনে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। সে ভালো করেই জানে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ নয় এই ঘরের। একটু ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। তবুও সে ঢুকতে পারছে না। হাঁটু দু’টো অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে তার। মায়ের বলা কথাগুলো সে ঘর থেকে শুনতে পেয়েছে, নিশ্চয়ই ওই মানুষটাও শুনেছে। কান গরম হয়ে যাচ্ছিলো প্রিয়তার কথাগুলো শুনতে। চোখটা কেনো অকারণে ভিজে গেলো সে বুঝতেই পারেনি। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে তার ভিতরে, সে ধরতে পারছে না।
“দরজার বাইরে এভাবে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। কিছু বলতে হলে ভিতরে এসো।”
চমকে ওঠে প্রিয়তা। কাপ থেকে চা কিছুটা ছিলকে এসে পড়ে তার হাতের উপর। উনি কীভাবে জানলো প্রিয়তা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে?
দরজা ঠেলে ধীর পায়ে প্রিয়তা ঘরে ঢোকে। ঢুকতেই একরাশ ধোঁয়ায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। সিগারেটের গন্ধে শ্বাস নেওয়া দায়। একটা মানুষ এতো ধূমপান করে কেনো?
“আমাকে মহাপুরুষ ধরণের কিছু ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ ছিলো না। সেখান থেকে তোমার ওড়না দেখা যাচ্ছিলো।”
প্রিয়তা হাঁপ ছাড়ে, তবুও অস্বস্তি কমেনা তার।
“কি চাও এখানে?”
প্রিয়তার চোখটা আবার ভিজে ওঠে। এমনিতে সে খুব শক্ত মেয়ে, সহজে কাঁদে না। কিন্তু এই মানুষটার কঠোর আওয়াজ শুনলে তার কেমন কষ্ট হয়। আচ্ছা, উনি সবসময় এভাবে কেনো কথা বলে? একটু ভালো করে কথা বলা যায়না?
“অদ্ভুত তো, সমস্যা কি তোমার? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
প্রিয়তা পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। হঠাৎ করেই যেনো তার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একটা পুরুষ এতো সুন্দর হবে কেনো? এতোটা সুন্দর হওয়ার কি দরকার যাতে চোখ ফেরানোই না যায়? মুখভর্তি দাড়িগোঁফের জঙ্গল থাকা সত্ত্বেও কাউকে এতো ভালো লাগতে পারে?
“এই মেয়ে, তোমার কানে সমস্যা নাকি? তখন থেকে এতোগুলো কথা বলছি। শুনতে পাচ্ছো না?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় উচ্ছ্বাসের দিকে।
“আপনার চা।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমি কি চা চেয়েছি তোমার কাছে?”
প্রিয়তার শরীরটা কেমন জমে ওঠে।
“কি হলো বলো? আমি কি চেয়েছি?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে বললো,”আমি খুব ভালো চা বানাই জানেন তো? সবাই খুব প্রশংসা করে। আমার বাবা বলে, আমার হাতের চা খেলে নাকি মন ভালো হয়ে যায়।”
উচ্ছ্বাস হঠাৎ মুচকি হাসে। আচমকা সেদিকে চোখ পড়তেই প্রিয়তার পা যেনো অবশ হয়ে আসে। এতো সুন্দর স্বর্গীয় হাসি একটা পুরুষের আছে, অথচ সে হাসে না।
“তো তোমার মনে হলো যে আমার মন খারাপ তাই চা দিয়ে আমার মন ভালো করতে এসেছো?”
প্রিয়তা বোকার মতো মাথা নেড়ে বললো,”না না….”
উচ্ছ্বাস থামিয়ে দেয় তাকে।
“আমার এতো সহজে মন খারাপ হয়না বুঝেছো? চোখের সামনে বাবা-মাকে একসাথে মারা যেতে দেখেছি। তারপর থেকে আর কিছুই আমার মন খারাপ করাতে পারেনা।”
প্রিয়তা হতাশ মুখে তাকিয়ে থাকে। সে শুনেছে উচ্ছ্বাসের বাবা মা একই সাথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। উচ্ছ্বাসও ছিলো তাদের সাথেই। কাকতালীয়ভাবে তার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
“যাই হোক, চা প্রয়োজন নেই আমার। এটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।”
প্রিয়তা আহত চোখে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। এতো কঠিন হতে পারে একজন মানুষ?
“আপনার জন্য বানিয়েছি, একটু খান।”
উচ্ছ্বাস শান্ত গলায় বললো,”বললাম তো খাবো না। এক কথা বার বার বলবে না। তোমাদের বাড়িতে আশ্রিত আছি মানে এটা নয় যে তোমাদের সব কথা শুনতে হবে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে তাকায়। এসব কি বলছে সে?
“আর একটা কথা, সময়ে অসময়ে এভাবে চা নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত হবে না। কিছুদিনের অতিথি আমি এখানে। হঠাৎ একদিন চলে যাবো। আর হ্যা, এখানে চোখের পানি ফেলবে না। কাঁদতে ইচ্ছা করলে ঘরে যেয়ে যতো খুশি কাঁদো।”
এতোটুকু বলে সে আরেকটা সিগারেট ধরায়।
লজ্জায়, অপমানে আর কষ্টে প্রিয়তার পা দু’টো অনড় হয়ে আছে। তার বাবা মধ্যবিত্ত হতে পারে, কিন্তু তারা দুই বোন সবসময় রাজকন্যার মতো বড় হয়েছে। কেউ তাদের সাথে কঠিন গলায় কথা বলেনি। এই লোকটার এতো দেমাগ কিসের? কোন রহস্যের দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছে নিজেকে?

ঘরে ফিরে মুখ অন্ধকার করে বসে আছে প্রিয়তা। নিজের উপর অসম্ভব রাগ হচ্ছে তার। কে বলেছিলো চা বানিয়ে নিয়ে দরদ দেখাতে? ইচ্ছা করছে নিজের গালে দুইটা থাপ্পড় মারতে।
“কি রে আপা? এভাবে মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস কেনো? মনে হচ্ছে কেউ তোকে মেরেছে।”
প্রিয়তা সরু চোখে তাকায় পেখমের দিকে। ঠোঁট টিপে হাসছে মেয়েটা। প্রিয়তার ইচ্ছা করছে নিজের উপরের রাগটা বোনের উপর ঝাড়তে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে।
পেখম পা তুলে খাটে বসে প্রিয়তার পাশে। পাশের টেবিলে চায়ের কাপ দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”সে কি রে আপা? চা বানিয়ে এনেছিস তো অনেকক্ষণ হলো। এখনো খাসনি? ওটা তো একদম ঠান্ডা হয়ে গেলো। আমাকে দে, আমি খাই।”
প্রিয়তা কঠিন গলায় বললো,”কেউ খাবি না ওই চা। ওটা আমি বাথরুমে ফেলে দিবো।”
“সে আবার কি কথা? তোর বানানো চা এতো মজা হয়, আর তুই সেইটা বাথরুমে ফেলে দিবি?”
“এখান থেকে যা পেখম। তোকে দেখলে আমার ভয়ংকর রাগ হচ্ছে।”
পেখম চোখ কপালে তুলে বললো,”আপা কি হয়েছে তোর? আমি কি করেছি?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। সে জানে এখন সে মুখ খুললেই কেঁদে দিবে। ছোট থেকেই তার ভয়ানক রাগ হলে চোখে পানি চলে আসে।
পেখম কিছুক্ষণ বিজ্ঞের মতো কিছু একটা ভাবে। এরপর প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা একটা কথা বলবো?”
প্রিয়তা চুপ করে থাকে, এখন কোনো কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না তার।
“আপা তুই কি কারো প্রেমে পড়েছিস?”
প্রিয়তা স্তম্ভিত হয়ে যায় পেখমের কথা শুনে।
“কি বললি তুই?”
“না মানে আমার বান্ধবীরা সেদিন বলাবলি করছিলো জানিস? ওরা নাকি নতুন নতুন প্রেমে পড়েছে। ওদের নাকি হঠাৎ হঠাৎ কান্না পায়, আবার হঠাৎই হাসি পায়, হঠাৎই রাগ হয় কোনো কারণ ছাড়া। কিছুদিন ধরে তোর মধ্যেও এমন দেখছি। সেদিন কোনো কারণ ছাড়াই কেমন মুচকি মুচকি হাসা শুরু করলি। আবার সেদিন রাতে দেখি একা একাই জানালার পাশে দাঁড়ায় কাঁদছিস।”
হতবিহ্বল মুখে প্রিয়তা তাকিয়ে থাকে পেখমের দিকে। সে নিজেও জানেনা এসব অনুভূতির কারণ কি, কেনোই বা এমন করছে সে। যদি সত্যিই এমনটা হয়ে থাকে তবে সে কার প্রেমে পড়েছে? ওই রগচটা আগন্তুক উচ্ছ্বাসের প্রেমে?
“আমাকে বলতে পারিস আপা। বিশ্বাস কর আমি কাউকে বলবো না, মা কেও না।”
প্রিয়তা কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললো,”স্কুল নেই তোর? যা আমার সামনে থেকে এখন। একদম বিরক্ত করবি না আমাকে।”
পেখম মুখ অন্ধকার করে উঠে চলে যায়। এই আপাটার হঠাৎ কি হলো সে বুঝতে পারেনা। এমনিতেও খুবই চুপচাপ সে, তবুও কিছুদিন হলো একদম যেনো কেমন হয়ে গেছে। আপার এই বদলে যাওয়াটা তার একদমই ভালো লাগছে না।

আজ দুপুরে প্রিয়তার বড় খালা মর্জিনা বেগম এসেছে তাদের বাড়িতে। মর্জিনা বেগম শহরের একজন বিশাল শিল্পপতির স্ত্রী। সেই তুলনায় মার্জিয়া কিছুই না। তাদের আর কোনো আত্নীয় এতো বড়লোক না। তাই মর্জিনা বেগমকে এ বাড়িতে বেশ ভক্তি করা হয়। সে-ই সিদ্ধান্ত নেয় প্রিয়তা, পেখমের সব ব্যাপারে।

মার্জিয়া বেগম ছোটাছুটি করছে বোনের সন্তুষ্টির জন্য। মর্জিনা বেগম আবার অল্পতেই খুঁত ধরতে থাকে সবকিছুতে। আর সবকিছু নিখুঁত হতে হবে।
মর্জিনা বেগম বিরক্ত মুখে বললো,”তোদের ফ্যানটা কি ভালোমতো ঘোরে না রে? একটা নতুন কিনলেই তো পারিস। ঘরমে সিদ্ধ হয়ে গেলাম।”
মার্জিয়া ছুটে এসে পাখা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে থাকে বোনকে।
“এই পেখম, দৌড়ে যা খালাম্মার জন্য ঠান্ডা শরবত নিয়ে আয়।”
পেখম বিরস মুখে উঠে চলে যায়।
“তুই বোস তো আমার পাশে। আমি এখানে শরবত খেতে আসিনি। তোর সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার। বলেই চলে যাবো।”
“সে কি কথা আপা? দুপুরে না খেয়েই চলে যাবে তুমি? তা হবে না বলে দিচ্ছি। আমি তোমার জন্য রান্না করছি।”
মর্জিনা বেগম চোখমুখ কুঁচকে বললো,”রাখ তো তোর রান্না, আমার সামনে এসে বোস।”
মার্জিয়া বেগম অনিচ্ছাসত্ত্বেও এসে বসে বোনের সামনে।
“বলো আপা।”
“আচ্ছা কবিরের আক্কেলটা কি বল তো?”
“কেনো সে আবার কি করলো?”
“কি করলো মানে? চেনা নেই জানা নেই একটা ছেলেকে ঘরে এনে উঠিয়েছে। দুই মাস হয়ে গেলো, এখনো যাচ্ছে না।”
মার্জিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”এই সংসারে আমার কোনো দাম আছে আপা? বাবা ঠিকই বড়লোক, ভালো পরিবার দেখে তোমাকে বিয়ে দিলো। আর আমার সাথে কি করলো? চেহারাছবি তো খারাপ ছিলো না আমার। তবুও একটা সামান্য বেতনের শিক্ষকের সাথে বিয়ে দিলো আমাকে। ছেলের চরিত্র এতোই ভালো যে বাবা আর হাতছাড়া করলেন না। এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমার কথা কে শোনে এ বাড়িতে?”
মার্জিয়া বেগমের চোখে পানি চলে আসে।
মর্জিনা বেগম হাত রাখে বোনের মাথায়।
“ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নেই রে। কিন্তু কবির আসলেই মানুষ হিসেবে ভালো। ও কেনো এই কাজটা করলো আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।”
মার্জিয়া বেগম চুপ করে থাকে।
“শোন মার্জিয়া, ছেলেটা প্রাপ্তবয়স্ক, তার উপর রূপবান। আর তোর মেয়েরাও বড় হচ্ছে। এই বয়সের মেয়েরা হলো আগুন, আর ছেলে হলো বারুদ। বারুদ আর আগুন পাশাপাশি থাকলে কি হয় বুঝিস তো?”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে তাকায় মর্জিনা বেগমের দিকে। এভাবে তো সে কখনো ভেবে দেখেনি।
“তুই তো আজীবনই বোকা থেকেই গেলি। এসব যে তোর মাথায় আসেনি আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। শোন, বয়সটা ভুল করার। এতে মেয়েদের দোষ নেই। এই বয়সে প্রেম জেঁকে ধরে। হাতের কাছে যদি এমন একজন সুদর্শন যুবক পায়, মেয়ে তো প্রেমে পড়তে বাধ্য।”

খালাকে শরবত দিতে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তার সব কথা শোনে পেখম। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তবে কি তার ধারণা ঠিক? আপা কি তবে উচ্ছ্বাস ভাইয়ের প্রেমে পড়েছে? এখন সে কি করবে?

“তাহলে আপা এখন কি করবো আমি? আমার তো হাত-পা কাঁপছে তোমার কথা শুনে।”
মর্জিনা বেগম বিরক্ত হয়ে বললো,”তোকে নিয়ে এই এক সমস্যা। কিছু হলেই চিন্তাভাবনা না করে কাঁপা-কাঁপি করতে থাকিস। আমার কথা শোন মন দিয়ে।”
মর্জিনা বেগম গলার স্বর নামিয়ে বললো,”প্রিয়তার জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ ঠিক করেছি। বড় ঘর, আদি ব্যবসা। তোর মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকবে। সচারাচর এমন সম্বন্ধ পাওয়া যায়না।”
মার্জিয়া বেগম আঁৎকে উঠে বললো,”এসব কি বলছো আপা? একটা বাইরের ছেলের ভয়ে এতোটুকু বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবো?”
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”তোর ঢং দেখে বাঁচিনা। মেয়েকে বিদুষী বানিয়ে ঘরে রেখে বুড়ি বানাবি? আমার তো আরো আগেই বিয়ে হয়েছিলো, স্কুল গন্ডিও পার হইনি তখন। আমি কি খারাপ আছি? তুই এতো পড়াশোনা করে কি করলি? ঠিকই তো এখন বাসন মাজা লাগে। বিয়ের জন্য এই বয়সটাই ঠিক আছে। তাছাড়া তোর মেয়ে আহামরি রূপবতীও না। তারা ছবি দেখে পছন্দ করেছে, এখন সামনাসামনি দেখতে চায়।”
“তুমি তাদের ছবিও দেখিয়েছো?”
“আমি কি তোর মেয়েদের খারাপ চাই?”
মার্জিয়া বেগম তবুও খুঁতখুঁত করতে থাকে। মেয়ে তো মাত্রই কলেজে পড়ে। এখনই সংসারের কি বুঝবে ও?
“কবিরকে বোঝা তুই। শিক্ষক মানুষ, অনেক ঝামেলা করবে। মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবে না। তুই ওই বাইরের ছেলেটার অযুহাত দিবি। এক ঢিলে দুই পাখি মারবি।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”আচ্ছা দেখি ওদের বাবার সাথে কথা বলে।”
“ওসব দেখাদেখি নেই। এমন বনেদি ঘর আর পাওয়া যাবে না। পরে তো আরেকটা মেয়ে আছে, সেদিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে নাকি? তুই কি চাস তোর মতো এমন কপাল তোর মেয়েদেরও হোক? এভাবে বাসন মেজে, রান্নাঘরেই দিন কাটিয়ে দিক? মধ্যবিত্ত একটা জীবন নিয়েই দুনিয়া ত্যাগ করুক?”
মার্জিয়া বেগম মাথা নিচু করে বললো,”আমি কিন্তু এই জীবনে অসুখী নই আপা। রাগের মাথায় অনেক কিছু বলি, কিন্তু আমি ওদের বাবার মতো মানুষকে পেয়ে অনেক সুখী।”
“তোর সিনেমার ডায়লগ বন্ধ কর। জীবন আবেগ দিয়ে চলবে না। যেভাবেই হোক কবিরকে রাজি করাবি তুই আজকের মধ্যে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়ে দেখাদেখির ব্যবস্থা করতে হবে।”
মার্জিয়া বেগমকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে মর্জিনা বেগম উঠে দাঁড়ায়।
“ওই ছোকরাটাকেও তাড়ানোর ব্যবস্থা করবো আমি যতো তাড়াতাড়ি পারা যায়।”
হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় সে। মার্জিয়া বেগম থম মেরে বসে থাকে খাটের উপর।

পড়ার টেবিলে বইতে মুখ গুঁজে বসে আছে প্রিয়তা। বারবার সকালের ঘটনাগুলো মনে পড়ছে তার। লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে বারবার নিজের মধ্যে। পড়ায় এক বিন্দুও মন নেই তার।
হঠাৎ গীটারের টুংটাং আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরে পায় সে। সে জানে কে বাজাচ্ছে। আগেও দুইদিন শুনেছে সে। অদ্ভুত সুন্দর গানের গলা তার। ইচ্ছা করে সারাদিন শুনতে। কিন্তু এমন রগচটা লোক, দুই মাসে মাত্র দুইবারই গান করেছে। একটু ভালো গলা বলে এতো দেমাগ হবে?
“আপা।”
চমকে ওঠে প্রিয়তা। পেখম কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে জানেনা।
“কি হয়েছে বল।”
“ছাদে যাবি?”
“হঠাৎ ছাদে যাবো কেনো?”
“অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নায় থইথই করছে একদম।”
“আমার এখন ভালো লাগছে না, তুই যা।”
পেখম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো,”ছাদে উচ্ছ্বাস ভাই আছে। গান করছে উনি।”
প্রিয়তা ঈষৎ কেঁপে ওঠে।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”আমার কি তাতে?”
পেখম প্রিয়তার হাত ধরে বললো,”চল গান শুনি উনার ওখানে যেয়ে।”
প্রিয়তা প্রতিবার করতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পেখমের দিকে।

(চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে