#তুমি_ছিলে_বলেই
#পর্বঃ২৬
#দিশা_মনি
নিপুণ রুদ্রের মাথায় ভরসায় হাত বুলিয়ে দেয়। রুদ্রকে নম্ন স্বরে শান্তনা দিয়ে বলে,
“আপনি নিজেকে সামলান।”
রুদ্র বলে ওঠে,
“কিভাবে সামলাবো আমি নিজেকে? ছোটবেলা থেকে আমাকে শুনতে হয়েছে আমি একজন অ*বৈ-ধ সন্তান। জানেন, ছোটবেলায় আমার মা ঘুমানোর পর রাতে আমি একা একা কাঁদতাম। মাকে দেখতে দিতাম না সেই কান্না যাতে তার কষ্ট না হয়৷ আমার মাকেও সবাই নানা বাজে কথা বলত। যার কোনটাই সত্য না। আমার মা গ্রামের এক সাধারণ মেয়ে ছিল৷ আমার দাদা ও নানা অনেক ভালো বন্ধু ছিলেন৷ ছোটবেলাতেই পারিবারিক ভাবে আমার মা-বাবার বিয়ে হয়ে যায়৷ তারপর বাবা শহরে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তারপর অবস্থার উন্নতি হয়। ক্ষমতার নেশা তাকে অন্ধ করে তোলে। সেইসময় একজন হেভিওয়েট নেতার মেয়ে ওনাকে ভালো বেসে ফেলেন৷ বাবা নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কথা ভেবে নিজের বিবাহিত হওয়ার সত্য লুকিয়ে তাকে বিয়ে করেন। এভাবে দিন চলতে থাকে। আমি পৃথিবীতে আসি। অন্যদিকে রাহাতও জন্ম দেয় তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে। একদিন এক গাড়ি দূর্ঘটনায় আমার নানা-নানী, মামা-মামী এবং দাদা সবাই প্রাণ হারান। আমি আর মা তখন সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ি। মা তখন গর্ভবতী ছিলেন। এমতাবস্থায় বাবার সাথেও আমাদের যোগাযোগ ছিল না। তাই আমাকে নিয়ে মা শহরে চলে আসে বাবার সন্ধানে৷ অনেক খুঁজে বাবার সন্ধান পাই। তাই বাড়িতে গিয়ে উঠতেই তিনি আমাকে এবং মাকে অস্বীকার করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী আমাদের দূর দূর করে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এরপর আমরা অসহায়ের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকি৷ এরপর বাবা একদিন আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে যান। কিন্তু একটা শর্ত দেন। শর্ত অনুযায়ী মাকে কাজের লোক হয়ে থাকতে হবে এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সামনে বলতে হবে যে সে আগে যা বলেছিল সব মিথ্যা ছিল এবং মা সব লোভের বসে বলেছিলেন। মা আমার কথা ভেবে বাবার সব শর্ত মেনে নেয়। তারপর আমার মাকে নিজেরই স্বামীর বাড়িতে কাজের লোক হয়ে থাকতে হয়। তবে কথায় আছে না সত্য কোনদিন চাপা থাকে না তেমনি আমার সত্যিটাও একদিন বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সামনে আসে। সেদিনই সবথেকে বড় আঘাত নেমে আসে আমাদের জীবনে। বাবা ওনার দ্বিতীয় স্ত্রীকে বলেন আমি ওনার অবৈধ সন্তান এবং মাকেও তিনি নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। মা সেদিন খুব ভেঙে পড়েছিলেন। এরপর হঠাৎ একদিন মা সিড়ি থেকে পড়ে যান। সেইসময় তার ৯ মাসের প্রেগ্যান্সি চলছিল৷ মাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আমার মা এবং আমার অনাগত সহোদর দুজনকেই আমি হারিয়ে ফেলি। আমার জীবন আরো নরকময় হয়ে ওঠে। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী আমাকে দুচোখে সহ্য করতে পারতেন না। অনেক অত্যাচার করতেন। আমি মুখ বুজে সব মেনে নিতাম। তবে বেশিদিন আমাকে এসব মানতে হয়নি। কিছু বছর পর উনিও একটি সড়ক দূর্ঘটনায় মা*রা যান। তারপর থেকে রাহাত আর আমাকে আমার বাবাই মানুষ করতে থাকেন।”
রুদ্রের কাছ থেকে সকল কথা শোনার পর নিপুণের ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে। রাজীব চৌধুরীর প্রতি তার মনে এক রাশ ঘৃণা সৃষ্টি হয়৷ নিপুণ বুঝতে পারে রুদ্রের শৈশব কতোটা কষ্টে কে’টেছে। তার মায়া হতে থাকে রুদ্রের জন্য। নিপুণ রুদ্রের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনার অতীত সত্যিই ভীষণ কষ্টদায়ক ছিল। আপনার জন্য আমার ভীষণ খারাপও লাগছে। কিন্তু আপনার অতীত বিবেচনা করে বর্তমানে আপনি যে অন্যায় করেছেন সেটা ক্ষমা করে দেওয়ার কোন মানে হয়না। আপনি একটা নিরপরাধ মেয়ের হ–ত্যা***কারী। আপনাকে আমি এইজন্য কখনো মাফ করতে পারি না৷ তাই আপনাকে উপযুক্ত শাস্তি পাইয়ে দেওয়ার কথা আমি কখনো ভুলতে পারি না।”
রুদ্র করুণ কন্ঠে নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আমি যদি প্রজ্ঞার খু***নি না হতাম তাহলে কি তুমি আমাকে ক্ষমা করতে?”
নিপুণ বলে,
“তাও হয়তো করতাম না। কারণ আপনি আমার মাকে কিডন্যাপ করেছেন, আমাকে জোর করে বিয়ে করেছেন। এসব আমি এত সহজে ভুলতে পারব না মিস্টার রুদ্র চৌধুরী। তাই আপনাকে ক্ষমা করাও কখনো আমার দ্বারা সম্ভব নয়।”
রুদ্র নিপুণের থেকে দূরে সরে আসে। অতঃপর উদাস মনে চলে সেখান থেকে চলে আসে।
রুদ্র ও নিপুণের বলা সব কথা লুকিয়ে লুকিয়ে শুনে নেয় ইশা। এত গোপন কথা একসাথে জেনে সে ভীষণ অবাক হয়। সাথে অনেক খুশিও হয়। ইশা বাকা হেসে বলতে থাকে,
“ব্যস, আমার সব জানা হয়ে গেছে। যা জেনেছি তাই এনাফ। এখন এসব কথা যদি আমি রাজীব আঙ্কেলকে গিয়ে বলি তাহলেই কেল্লাফতে।”
ইশা খুশি খুশি মনে রাজীব চৌধুরীর রুমে যায়। রাজীব চৌধুরী ইশাকে দেখে বলেন,
“তুমি কিছু বলবে? আমার মন মেজাজ আজ বেশি ভালো নেই। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে চলে যাও।”
“কুল আঙ্কেল, কুল। আপনার জন্য আমি এমন সুখবর এনেছি যা শোনামাত্র আপনার খারাপ মেজাজ একদম চাঙা হয়ে উঠবে।”
“যা বলার স্পষ্ট করে বলো।”
ইশা একে একে রাজীব চৌধুরীকে সব রুদ্র ও নিপুণের সব কথা খুলে বলে। সব শুনে রাজীব চৌধুরী ভীষণ খু্শি হন। তিনি বলেন,
“এই তাহলে আসল কাহিনি। আমি শুধু শুধুই নিপুণকে নিয়ে তাহলে ভয় পাচ্ছিলাম। রুদ্র তাহলে ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি৷ করেছে অন্য উদ্দ্যেশ্যে।”
ইশা রাজীব চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“নিপুণকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে আঙ্কেল। রুদ্রা হয়তো ওকে ভালোবেসে বিয়ে করে নি কিন্তু এখন রুদ্রার মনে হয়তো ওর মনে অনুভূতি তৈরি হয়েছে। ওর আচার ব্যবহারই তো সেটা প্রমাণ করে দিচ্ছে। আপনিই ভেবে দেখুন ঐ মেয়েটার জন্য রুদ্রা রাহাতের গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছিল। তাছাড়া নিজের অতীতের ব্যাপারে ও সবকিছু ঐ নিপুণকে সব খুলে বলেছে। যেটা আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড হয়েও এতদিন জানতাম না।”
“এটা তো তুমি একদম ঠিকই বলেছ ইশা। তাহলে এখন কি করা যায়?”
“আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে আঙ্কেল যার মাধ্যমে ঐ নিপুণ নামের পথের কাঁ’টা দূর হবে।'”
“কি প্ল্যান?”
“রুদ্রা নিপুণের মাকে কিডন্যাপ করে কোথায় রেখেছে সেটা নিশ্চয়ই রুদ্রার সেক্রেটারি জানে। আপনি রুদ্রার সেক্রেটারির মুখ থেকে সব সত্য বের করে আনার ব্যবস্থা করুন। আর তারপর সেটা আমাকে জানান। বাকি কাজ আমিই করে নেব।”
“ঠিক আছে, কিন্তু এতে কাজ হবে তো?”
“আলবাত হবে। নাহলে আমি আর আছি কি করতে? আপনি জাস্ট নিজের করা প্রমিসের কথা ভুলবেন না। আপনার কাজ করে দেওয়ার বিনিময়ে কিন্তু আপনাকে আজিজ চৌধুরীর ব্যবসা ধ্বংস করে দিতে হবে।”
“ঠিক আছে।”
ইশা এবার কুটিল হাসি দেয়। সবকিছু তার প্ল্যানমাফিকই এগোচ্ছে।
★★★
ভোরের আলো চোখে এসে পড়তেই ঘুম ভাঙে নিপুণের। চারিদিকে পাখিদের কিচির মিচির শব্দ আর ভোরের আলোয় ভীষণ সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে। নিপুণ চোখ মেলে তাকানোর পর দেখে রুদ্র ঘরে নেই। প্রতিদিন সোফায় শুয়ে ঘুমায় রুদ্র। কিন্তু আজ রুদ্রকে দেখাই যাচ্ছে না।
নিপুণ হঠাৎ টেবিলের উপর একটা চিঠি দেখতে পায়। সেটা খুলতেই দেখে সেখানে লেখা,
“যদি নিজের মাকে ফেরত পেতে চাও তাহলে ** ঠিকানায় চলে এসো।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨