তুমি ছিলে বলেই পর্ব-২৫

0
558

#তুমি_ছিলে_বলেই
#পর্বঃ২৫
#দিশা_মনি

নিপুণ ঘরে এসে দরজা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় রুদ্র এসে দরজাটা বন্ধ করতে বাঁধা প্রদান করে। নিপুণ রুদ্রর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনি এখন এখানে এসেছেন কেন? যান গিয়ে নাচুন না। কত সুন্দর নাচছিলেন আপনার বান্ধবীর সাথে। সবাই হাততালি দিচ্ছিল৷ যান কন্টিনিউ করুন।”

“ইশা শুধুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নিপুণ। তার থেকে বেশি কিছু নয়।”

“আমি কি কিছু জানতে চেয়েছি আপনার কাছে? তাহলে শুধু শুধু কৈফিয়ত দিতে এসেছেন কেন?”

“তুমি হঠাৎ এভাবে চলে এলে তাই আমি ভাবলাম…”

“কি ভেবেছেন যে আপনাকে আপনার বান্ধবীর সাথে নাচতে দেখে আমার খারাপ লাগছিল৷ তাই আমি চলে এসেছি। কি এটাই ভাবছিলেন তো?”

রুদ্র কিছু বলে না। তার এই মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে নিপুণ বলে,
“একটা কথা বেশ কান খুলে শুনে রাখুন আমার আপনাকে নিয়ে কোন মাথাব্যাথা। আপনি আমার চোখে শুধু একজন অপরাধী, একজন খু***নি। আপনাকে আমি সহ্য করছি শুধু নিজের মায়ের জন্য। তাই আপনি কার সাথে নাচলেন বা গাইলেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”

রুদ্র আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই আচমকা ইশা রুদ্রর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সেখানে চলে আসে৷ রুদ্রর একদম পাশে এসে রুদ্রর হাত ধরে সে বলে,
“তুই এভাবে চলে এলি কেন রুদ্রা? নিচে সবাই তোর খোঁজ করছে।”

“ইশু তুই যা আমি আসছি।”

“আঙ্কেল আমায় পাঠিয়েছে তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তোর জন্য নাকি উনি অনেক বড় সারপ্রাইজ প্ল্যান করে রেখেছেন৷ তুই চল তো আমার সাথে।”

বলেই রুদ্রর হাত ধরে জোরপূর্বক টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে ইশা৷ যা দেখে নিপুণের আরো একদফা খারাপ লাগে। সে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলে,
“রুদ্র চৌধুরীকে নিয়ে আমার এমন অনুভূতি হচ্ছে কেন? কেন আমি ঐ ইশাকে ওনার পাশে মেনে নিতে পারছি না?”

এই প্রশ্নের কোন উত্তর নিপুণ খুঁজে পায়না৷ অগত্যা সে নিজের ভাবনাতেই মগ্ন থাকে।

★★★
স্নেহাকে খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হচ্ছে। তাদের কিছু প্রতিবেশীই স্নেহাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। এই সাজানোর পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণও আছে বৈকি! আজ স্নেহাকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসছে। আব্বাস খান নিজে স্নেহার জন্য যোগ্য পাত্র খোঁজার ঘটকের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন৷ স্নেহার ছবিও দিয়েছিলেন ঘটককে৷ সেই ছবি দেখেই আজ স্নেহাকে পছন্দ করে ফেলেছে পাত্রপক্ষ। তারাই আজ স্নেহাকে দেখতে আসছে।।

স্নেহাকে সাজিয়ে তাকে আয়নার সামনে দাড় করায় তাদেরই পাশের বাড়ির এক মেয়ে তোহা। অতঃপর মুচকি হেসে বলে,
“তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে স্নেহা। পাত্রপক্ষ আজ নিশ্চয়ই তোমাকে পছন্দ করবে।”

এই কথা শোনামাত্র তোহার ছোট বোন তাবাসসুম বলে ওঠে,
“পাত্রপক্ষ পছন্দ করলে তো আমাদের স্নেহার ভাগ্যই খুলে যাবে। শুনেছি ওকে যারা দেখতে আসছে তারা ভীষণ বড়লোক। ছেলে নাকি ডাক্তার। সব মিলিয়ে একদম সোনায় সোহাগা।”

স্নেহা সব কথাই নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল। নিজের বিয়ে নিয়ে তার মধ্যে কোন উন্মাদনা নেই৷ এই বিয়েতে না করার জন্য তার কাছে কোন উপযুক্ত কারণ নেই। আগে নাহয় সে একজনকে ভালোবাসত কিন্তু সেও তো একজন প্রতারক বের হলো। তাই এখন নিজের বাবার পছন্দের উপরেই ভরসা রাখছে সে। তবুও তার মনটা কিছুতেই খুশি হতে পারছে না৷ এরমধ্যে আব্বাস খান এসে তাড়া দিলেন। স্নেহার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“তোর সাজসজ্জা শেষ হয়েছে স্নেহা? ওনারা তো চলে এসেছেন।”

তোহা বলে,
“জ্বি চাচা। সাজগোজ একদম কমপ্লিট। আপনি দেখুন তো স্নেহাকে কেমন লাগছে?”

আব্বাস খান স্নেহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেন,
“মাশাল্লাহ। কারো নজর না লাগুক।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নেহাকে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। স্নেহা সবার সামনে গিয়ে সালাম দিলো৷ তারপর চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ল৷ ডাঃ সোহাগ রহমান মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল স্নেহাকে। ছবিতে যতটা না সুন্দর লাগছিল বাস্তবে তার থেকেও সুন্দর লাগছে স্নেহাকে। সোহাগ একদম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়। সাথে এও প্রতিজ্ঞা করে নেয় তার যদি বিয়ে করতে হয় তাহলে এই মেয়েটাকেই করবে।

সোহাগের মা সালমা খাতুনের অবশ্য স্নেহাকে তেমন একটা পছন্দ হয়না। স্নেহা দেখতে সুন্দরী হলেও তাদের পারিবারিক অবস্থা বেশি ভালো না৷ সালমা খাতুন চান আরো স্বচ্ছল পরিবারে নিজের ছেলের বিয়ে দিতে। তাই তিনি স্নেহাকে নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখান। টুকটাক কয়েকটা প্রশ্নই শুধু করেন। তবে সোহাগের বাবা হাবিব হাসান স্নেহাকে বেশ পছন্দ করে ফেলেন৷ তাই তিনি স্নেহাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন৷ সালমা খাতুন এসবে বিরক্ত হন। একপর্যায়ে নিজের স্বামীকে থামিয়ে তিনি আব্বাস খানের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“আজ তাহলে আমরা উঠি৷ ঘটকের মাধ্যমে নাহয় আমাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবো।”

এই বলেই তিনি উঠে পড়েন। সোহাগ যাওয়ার আগেও বারবার স্নেহার দিকে তাকায়৷ আর মনে মনে বলে,
“আমি তোমাকেই বিয়ে করব হৃদয়হরিণী। শুধু অপেক্ষা করো আমার বউ হওয়ার জন্য।”

★★★
নিপুণের একা ঘরে থাকতে ভালো লাগছিল না৷ তাই সে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের স্থলে চলে আসল৷ এসেই তার চোখ খুঁজতে লাগল রুদ্রকে। তার অবচেতন মন একটিবার দেখতে চাইছে রুদ্রকে।

হঠাৎ করেই কারো একটা সাথে ধাক্কা খায় নিপুণ। তাল সামলাতে না পেরে চলে যেতে নিলে রুদ্র তাকে সামলে নেয়৷ রুদ্রর সাথেই সে ধাক্কাটা খেয়েছে। রুদ্র নিপুণকে স্বাভাবিক ভাবে দাড় করিয়ে দিয়ে বলে,
“একটু দেখেশুনে চলে ফেরা করো। কোন চিন্তায় মগ্ন ছিলে?”

“তেমন কিছু না।”

“তোমায় দেখে কেন জানি মনে হচ্ছিল তুমি কাউকে খুঁজছিলে। বাই এনি চান্স তুমি কি আমাকে খুঁজছিলে?”

“আপনাকে খুঁজতে যাব কেন? আমি তো এমনিই…”

নিপুণ নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না। তার আগেই শুনতে পেল রাহাত মাইক হাতে নিয়ে সবার উদ্দ্যেশ্যে এনাউন্সমেন্ট করে বলছে,
“লেডিস এন্ড জেন্টালম্যান আপনাদের সবাইকে শুভ সন্ধ্যা, গুড ইভেনিং। আজকের এই সন্ধ্যা সবার আনন্দময় হয়ে উঠুক। আপনারা সবাই জানেন আজ আমাদের এমপি মহোদয় মোঃ রুদ্র চৌধুরীর জন্মদিন। তার এই জন্মদিন উপলক্ষে আমি তার জন্য একটা সারপ্রাইজের আয়োজন করেছি। এখন আমি সেটা রিপ্রেজেন্ট করব।”

সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে রাহাতের সারপ্রাইজ কি সেটা জানার জন্য। রাহাত আবারো বলা শুরু করে,
“আজ যেহেতু রুদ্র চৌধুরীর জন্মদিন তাই তার জন্ম সংক্রান্ত কিছু কথা আগে জেনে নেওয়া যাক, যেটা হয়তো আপনারা অনেকেই জানেন না। আপনারা অনেকে মনে করেন রুদ্র চৌধুরী রাজীব চৌধুরীর সন্তান, আজ বড় ভাই। কিন্তু এটা সত্য নয়৷ রুদ্র চৌধুরী আমার নিজের বড় ভাই নয় আর না তো রাজীব চৌধুরী মানে আমার বাবার বৈধ সন্তান। বরঞ্চ সে হলো আমার বাবার সাথে অন্য একজন মহিলার অবৈধ মেলামেশার ফসল।”

বার্থডে পার্টিতে উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে যায় এসব কথা শুনে। রুদ্র চৌধুরীর ব্যাপারে এসব কথা সবার অজানা ছিল৷ সব শুনে সবাই কানাঘুষা শুরু করে দেয়। রুদ্র ঠায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। নিপুণও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাজীব চৌধুরী রাহাতের হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে রাগী গলায় বলেন,
“এসব কি বাজে বকছ তুমি?”

“বাজে কোথায় বকছি? যা সত্যি তাই তো বলছি আমি!”

“তুমি সবার সামনে আমার আর তোমার ভাইয়ের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলে। তোমাকে তো আমি বলেছিলাম ধৈর্য ধরতে। এর কি খুব দরকার ছিল?”

“অবশ্যই৷ এটাই আমার রিভেঞ্জ।”

আজকে প্রেসের কিছু লোকজনও রুদ্র চৌধুরীর বার্থডে কভারেজ করতে এসেছিল৷ তারা রুদ্রকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে৷ তাদের প্রশ্নের ধরণ ছিল কিছুটা এরকম,
“আপনার ভাই রাহাত চৌধুরী কি ঠিক বলছে মিস্টার রুদ্র চৌধুরী? সত্যিই কি আপনি রাজীব চৌধুরীর অবৈধ সন্তান?”

রুদ্র ভীষণ রেগে গিয়ে সাংবাদিকের কলার চেপে ধরে বলে,
“আর একবার এই কথা উচ্চারণ করলে আমি তোর জিভ চিড়ে ফেলব।”

বলেই সে নিজের ঘরের দিকে রওনা দেয়৷ নিপুণও রুদ্রর পিছু পিছু যায়। রুদ্র ঘরে এসে দরজা বন্ধ করতে নিলে নিপুণ তাকে আটকে দেয়। রুদ্র আজ অনেক ভেঙে পড়েছে। সে আজ কাদো কাদো গলায় বলে,
“কেন এসেছ তুমি? আমায় অপমান করতে? আমার জন্মপরিচয় নিয়ে খোচা দিতে?”

“আমার মধ্যে মানবিকতা নামক একটা ব্যাপার আছে রুদ্র চৌধুরী। তাই আমার সম্পর্কে এমন ভাববেন না।”

রুদ্রর আচমকা কি হলো সে নিজেও জানে না। সে হঠাৎ করে নিপুণকে জড়িয়ে ধরে করুণ গলায় বলল,
“বিশ্বাস করো আমি অবৈধ সন্তান নই। আমার মাও কোন খারাপ চরিত্রের মহিলা নন। আমি রাজীব চৌধুরীর বৈধভাবে বিয়ে করা স্ত্রীর সন্তান। যেই স্ত্রীকে রাজীব চৌধুরী কখনোই স্বীকৃতি দেননি৷ যার কারণে আজ আমার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে