#তুমি_ছিলে_বলেই
#পর্বঃ১৬
#দিশা_মনি
স্নেহা মন খারাপ করে নিজের ঘরে বসে রয়েছে। নিজের কাছেই এখন নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে তার। যদি সে তার বাবার জমানো টাকা গুলো অনুপমকে না দিত তাহলে এখন সেই টাকা দিয়ে সে তার বাবাকে সাহায্য করতে পারত। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না। এরমধ্যে হঠাৎ সে তাদের বাড়ির দরজায় কাউকে কড়া নাড়তে শুনল। তৎক্ষণাৎ গিয়ে সে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই দেখতে পেল তাদের প্রতিবেশী শাহিন ইসলামকে। শাহিন ইসলাম হাফাতে হাফাতে উত্তেজিত গলায় স্নেহাকে বলেন,
“তোর আব্বায় বাজারে হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে রে। সবাই মিলে তাকে ধরে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তুই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে চলে যা।”
নিজের বাবার অসুস্থতার কথা শুনে স্নেহা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কোন রকমে বাড়িতে তালা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল স্থানীয় হাসপাতালের দিকে। সেখানে পৌঁছে সে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করল। ডাক্তার স্নেহাকে জানালো,
“আপনার বাবার অবস্থা বেশি ভালো না। এখানে ওনার চিকিৎসা করা সম্ভব না। যদি ওনাকে বাঁচাতে চান তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শহরে নিয়ে যান।”
স্নেহা অসহায় ভাবে ডাক্তারের কথা শুনতে থাকে। তার যে বাবা ছাড়া এই গ্রামে আপন বলতে কেউ নেই। একা এতকিছু কিভাবে সামলাবে সে?
স্নেহার এই দুঃখের সময় তাদের গ্রামের কিছু লোক এগিয়ে আসে। তাঁরা অ্যাম্বুল্যেন্সে করে আব্বাস খানকে শহরে নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। স্নেহাও তার বাবাকে নিয়ে শহরের হাসপাতালে চলে আসে।
আব্বাস খানকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়৷ একজন ডাক্তার তার চেকআপ করে স্নেহাকে ডেকে বলেন,
“আপনার বাবার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। ওনাকে বাঁচানোর জন্য অপারেশনের কোন বিকল্প নেই। এরজন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনাকে ৫ লাখ টাকা জোগাড় করতে হবে।”
স্নেহার অসহায়ত্ব বাড়তে থাকে। কোথায় পাবে সে এত টাকা? তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। এ মুহুর্তে নিজেকে সব থেকে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে।
স্নেহার সাথে তার গ্রামের কিছু লোকও এসেছিলেন। তারা স্নেহাকে পরামর্শ দিয়ে বলেন,
“তোমার চাচা আজিজ খান তো এই শহরেই থাকে। তুমি তার সাথে যোগাযোগ করো। তিনি নিশ্চয়ই নিজের ভাইয়ের জন্য টাকার ব্যবস্থা করে দেবেন।”
স্নেহা বুঝতে পারে না তার কি করা উচিত। দিলারা খাতুনকে সেদিন যে সে বড় মুখ করে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়ে এসেছিল। এখন যদি ঐ বাড়িতে সাহায্য চাইতে যায় তাহলে যে তার আত্মসম্মান পুরোপুরি মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু স্নেহার কাছে যে এখন আর উপায় নেই। তাই স্নেহা ভাবে যতই অপমানিত হতে হোক না কেন সে আবার দীপ্রদের বাড়িতে যাবে। তাছাড়া এই অবস্থার জন্য সে নিজেও তো কোথাও না কোথাও দায়ী৷ সে যদি অনুপমকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে তার হাতে টাকাগুলো তুলে না দিত তাহলে তো আর আজকে তাকে এই দিন দেখতে হতো না৷ সেই টাকা দিয়েই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। এসব ভেবেই স্নেহা দীপ্রদের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
★★★
দিলারা খাতুন বেশ খোশ মেজাজে আছেন। ঘটক মারফত ইমাম চৌধুরীর সাথে তার আলাপ হয়েছে। ইমাম চৌধুরী দীপ্রর সাথে তার মেয়ে ইশার বিয়ে নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। আগামীকাল তাদের দীপ্রকে দেখতে আসার কথা। দিলারা খাতুনের মনে খুশি আর ধরে না। তিনি কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজে নিজেই বলছেন,
“যাক! ঐ নিপুণ নামক আপদ নিজে থেকেই দূর হয়েছে। ওকে এমনিতেও আমার পছন্দ ছিল না। ওরকম একজন সাধারণ উকিলের সাথে ছেলের বিয়ে দিয়ে আমার কি লাভ হতো? এবার আমি আমার ছেলের সাথে একজন বড় ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেব। এতে করে তার সম্পত্তি তো ভবিষ্যতে তার মেয়েই পাবে। এরকম সোনার ডিম পাড়া হাঁসই তো আমার দরকার।”
তার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটে কলিং বেলের আওয়াজে। দিলারা খাতুন বিরক্ত করে বলেন,
“এই ভরদুপুরে আবার কে এলো?!”
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে অতঃপর পা বাড়ালেন দরজার দিকে। দরজার খুলে স্নেহাকে দেখামাত্রই তার মেজাজ বিগড়ে গেল। তার চোখমুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। তিনি মুখটা গম্ভীর করে বললেন,
“কি চাই?”
স্নেহা মিনমিনে স্বরে বলল,
“চাচা বাড়িতে আছেন?”
“না, নেই। কি দরকার আমায় বলো। খুব তো বড় মুখ করে বলেছিলে আমাদের বাড়িতে আর কখনো পা রাখবে না। সেই তো ডেং ডেং করে আসতেই হলো।”
স্নেহার খুব খারাপ লাগল দিলারা খাতুনের এহেন কথা। তবুও সে এসব গায়ে মাখল না। এখন তাকে এটুকু সহ্য করতেই হবে৷ স্নেহা বলল,
“আসলে চাচি আমার আব্বু খুব অসুস্থ। বর্তমানে উনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ওনার চিকিৎসার জন্য ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন।”
“তো আমি কি করব?”
“আপনারা যদি টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন তাহলে…”
“তোমার কি মনে হয় আমরা এখানে দাতা সংস্থা খুলে বসে আছি? টাকার দরকার হলে রাস্তায় গিয়ে ভিক্ষা করো।”
“চাচি…আপনি কি করে এমন কথা বলছেন? আমরা তো আপনাদের আত্মীয়।”
“আত্মীয়? কিসের আত্মীয়? তোমাদের সাথে আমাদের ক্লাসের কোন মিল আছে?”
“রক্তের সম্পর্ককে আপনি কিভাবে উপেক্ষা করতে পারেন? আচ্ছা, আমার উপর এত রাগ কেন আপনার? আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি বলতে পারতেন?”
“জানতে চাও তুমি, তোমার উপর আমার কিসের রাগ? তাহলে শোনো, তুমি একটা জা**রজ, অবৈধ সন্তান। আর তোমার উপর রাগ করার জন্য এই কারণটাই যথেষ্ট।”
“চাচী!! আপনি আমার সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারেন না। আমি কি করে জা*রজ হতে পারি? আমি আমার মা-বাবার মেয়ে।”
“ভুল জানো তুমি। তুমি তোমার মা-বাবার মেয়ে নও। তোমার মায়ের কিছু শারীরিক সমস্যা ছিল যে কারণে সে কখনো মা হতে পারত না। তবে তোমার বাবা তোমার মাকে খুব ভালোবাসত এজন্য সে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়নি, বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়েছিল। এরপরই তারা একটা অনাথ আশ্রম থেকে তোমাকে দত্তক নিয়ে আসে। পরবর্তীতে আমি তোমার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখি তোমাকে জন্মের পরই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল তোমার মা। সেখান থেকে উদ্ধার করেই তোমাকে অনাথ আশ্রমে পাঠানো হয়েছিল। এখন তোমাকে নিশ্চয়ই আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না এইসব ডাস্টবিনে কেমন বাচ্চাদের জায়গা হয়?”
স্নেহা হতবাক হয়ে সমস্ত কথা শুনতে থাকে। সব শুনে তার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে। স্নেহা কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছিল না। সে নিজের মাথায় হাত দিয়ে নিচে বসে পড়ে। দিলারা খাতুন স্নেহার থেকে দূরে সরে এসে বলে,
“সত্যটা জানার পর থেকেই আমি চেয়েছিলাম তোমাকে যেন আবার অনাথ আশ্রমে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তোমার বাবা-মা এটা চায় নি। যার কারণে তাদের সাথেও আমার সম্পর্ক খারাপ হয়। এরপর শহরে চলে আসার পর আমি চেষ্টা করি তোমাদের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে।”
স্নেহা কিছু সময়ের জন্য মূর্তির মতো বসে থাকে। সত্য নিষ্ঠুর হয় সে শুনেছিল কিন্তু এত নিষ্ঠুর হয় সেটা তার জানা ছিল না। স্নেহা নিজের চোখের জল মুছে বলে,
“আমাকে নিয়ে আপনার সমস্যা থাকতেই পারে কিন্তু তাই বলে আপনি আমার বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা দেবেন না?”
দিলারা খাতুন সরাসরি বলে দেন,
“না। এখন দূর হয়ে যাও এখান থেকে।”
বলেই তিনি স্নেহার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেন। স্নেহা বিমূর্ষ, হতাশাগ্রস্ত হয়ে ফিরে যেতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ করে পিছন থেকে দীপ্র তার নাম ধরে ডাকে। স্নেহা পিছন ফিরে তাকাতেই দীপ্র স্নেহার হাতে একটা চেক তুলে দিয়ে বলে,
“এই নে তোর টাকা। এটা দিয়ে তোর বাবার চিকিৎসা করিয়ে নিস। আর কোনদিন আমাদের বাড়িতে আছিস না তুই।”
স্নেহা নিজের চোখের জল মুছে বলে,
“তুমি আর দিশা আপু আমার সত্যটা জেনে গেছ তাই না? সেইজন্য হঠাৎ করে আমার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছিলে। তাই তো আমি ভাবছিলাম তোমরা হঠাৎ কেন বদলে গেলে।”
দীপ্র কোন উত্তর দেয়না। স্নেহা সরল মনে দীপ্রকে শুধায়,
“আচ্ছা আমার জন্মের সাথে কি আমার কোন হাত আছে? আমি যে এভাবে জন্ম নিয়েছি সেটা কি আমার দোষ?”
দীপ্র কোন উত্তর না দিয়েই নিজের বাড়ির দিকে চলে যেতে থাকে। স্নেহা দীপ্রর যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨