#তুমি_ছিলে_বলেই
#পর্বঃ৯
#দিশা_মনি
নিপুণ স্নেহাকে সাথে নিয়ে আজ এসেছে প্রজ্ঞাদের বাড়িতে। পারভেজ ইসলামের সাথে কথা বলেই তারা দুজনে আজ এলো প্রজ্ঞাদের বাড়িতে। প্রজ্ঞা কিছুদিন আগেই নিজের বাড়িতে ফিরেছে। কিন্তু এরপর থেকেই সে নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্ধ করে নিয়েছে৷
নিপুণ প্রজ্ঞার ঘরে গেল। প্রজ্ঞা তখন উদাস মনে বিছানায় বসে ছিল। আনমনে ভাবছিল সেই ভয়াবহ রাতের কথা। প্রজ্ঞা আজো সেই দূর্বিষহ স্মৃতি ভুলতে পারে না৷ নিপুণ আলতো করে স্পর্শ করে প্রজ্ঞাকে। প্রজ্ঞা পিছনে ফিরে তাকিয়ে নিপুণকে দেখতে পায়৷ নিপুণ প্রজ্ঞার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“নিজেকে এভাবে ঘরে বন্দি করে রেখেছ কেন তুমি?”
“আমার খুব ভয় লাগে। বাইরে গেলে যদি সবাই আমাকে খারাপ কথা শোনায়..সবাই যে এটা জেনে গেছে যে আমি ধর্ষি..”
“তুমি একদম ভয় পাবে না। একটা কথা সবসময় মনে রাখবা যে তুমি কোন অন্যায় করো নি। বরং তুমি অন্যায়ের শিকার হয়েছ। তাই তোমার এরকম ভীত বা লজ্জিত হয়ে থাকার কোন কারণ নেই। তুমি বুক ফুলিয়ে ফুলবে চলবে সমাজে। বুঝলে?”
প্রজ্ঞা সম্মতি জানায়। স্নেহা ও পারভেজ ইসলামও ততক্ষণে চলে আসেন সেখানে। পারভেজ ইসলাম বলেন,
“শুনলাম রাজীব চৌধুরীর রাহাত চৌধুরীর কেস লড়ার জন্য শহরের একজন বড় উকিল ঠিক করেছেন। ওনারা তো অনেক ক্ষমতাবান। নিশ্চয়ই এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওনার ছেলেকে বের করে আনবেন।”
নিপুণ এক অসহায় পিতার দিকে তাকালো। তার চোখে তার মেয়েকে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে আশংকা তৈরি হয়েছে। তাই নিপুণ দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আমি প্রজ্ঞার হয়ে কেস লড়ব। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, প্রজ্ঞাকে আমি ন্যায়বিচার পাইয়ে দেবোই।”
স্নেহাও বলে ওঠে,
“তাছাড়া রুদ্র চৌধুরী তো ন্যায়বিচারের কথা বলেছেন।”
নিপুণ স্নেহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এসব রাজনৈতিক নেতাদের কথা বিশ্বাস করো না স্নেহা। ওরা নিজেদের রাজনৈতিক লাভের জন্য অনেক কথাই বলে থাকে। আমাদের এই লড়াইটা নিজেদেরই লড়তে হবে।”
★★★
নিপুণ তার বাড়িতে আসে সন্ধ্যাবেলা। বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই শাহিনা খাতুন তার সামনে এসে বলে,
“নিপুণ, শুনলাম তুই নাকি কোন এমপির ভাইয়ের বিরুদ্ধে কেস লড়ছিস।”
“হ্যাঁ, তুমি কিভাবে শুনলে?”
“নিউজে দেখলাম। আচ্ছা, এসবের কি খুব দরকার ছিল? এরকম ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেস না লড়লেই কি নয়?”
নিপুণ কোন ভনিতা ছাড়াই বলে,
“তুমি তো জানো মা আল্লাহ ছাড়া আমি আর কাউকে ভয় পাইনা। ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করতে আমি কখনোই পিছপা হবো না। এটাই আমার বাবার আদর্শ, যা আমি লালন করে চলছি।”
“কিন্তু আমার যে তোকে নিয়ে খুব ভয় হচ্ছে নিপুণ। তুই যে এখন আমার একমাত্র অবলম্বন। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব?”
“তুমি একদম ভয় পেওনা। আমার কিছু হবে না।”
শাহিনা খাতুন আর কিছুই বললেন না নিজের মেয়েকে। কিন্তু তার মনে যে ভয় ঢুকেছে তা আর দূর হলো না। তিনি শুধু দুহাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই প্রার্থনা করলেন যেন তার মেয়েটার কোন বিপদ না হয়।
★★★
দীপ্রর পরিবারের সবাই দুপুরে লাঞ্চ করতে বসেছে৷ ডাইনিং টেবিলে পিনপতন নীরবতা। দীপ্র সবেমাত্র ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো। তাকে দেখেই তার বাবা আজিজ খান বলে উঠলেন,
“তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে দীপ।”
“জ্বি, আব্বু। বলুন।”
আজিজ খান রাসভারী স্বরে বললেন,
“রাজীব চৌধুরী আজ আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন।”
“রাজীব চৌধুরী মানে? সাবেক মন্ত্রী রাজীব চৌধুরী?”
“হ্যাঁ। ওনার সাথে আমার যে অনেক ভালো সম্পর্ক সেটা তোমাকে নিশ্চয়ই আর নতুন করে বলতে হবে না। উনি বানিজ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আমাদের ব্যবসায় অনেক উন্নতি হয়েছে এরজন্য ওনার অবদান অনেক। ওনার ছোট ছেলে রাহাতের নামে ইদানীং একটা ফলস কেস দাখিল করা হয়েছে। উনি বললেন নিপুণ নাকি এই কেসে জড়িয়েছে।”
দীপ্র অবাক হয়ে বলল,
“কই আমি তো এই ব্যাপারে কিছু জানি না।”
দিশা অবাক সুরে বলল,
“এটা তুমি কি বলছ ভাইয়া? কোন দুনিয়ায় থাকো তুমি? আজ তো নিউজে দেখালো যে এই কেসের ভিকটিমের হয়ে কেস লড়বে নিপুণ আপি।”
আজিজ চৌধুরী বলে উঠলেন,
“ঐ মেয়ে ভিকটিম নয়। এসব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। এরা নিজেদের স্বার্থে এমন নাটক করে। রাজীব চৌধুরীর ছোট ছেলেকে আমি চিনি। ছেলেটাকে তো ভালোই মনে হয়। মনে হয় ওকে ফাঁসানো হয়েছে।”
দীপ্র বলল,
“নিপুণকে আমি চিনি আব্বু। ও কখনো কোন মিথ্যা মামলা লড়বে না।”
“সত্য মিথ্যা বড় কথা নয় দীপ। কি দরকার এসব ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লড়ার? ওনাদের পাওয়ার সম্পর্কে তোমার বা নিপুণের কোন ধারণাই নেই। এসব ব্যাপারে জড়িয়ে গেলে নিপুণ নিজেই বিপদে পড়বে। তাছাড়া ও আমাদের বাড়ির হবু বউ৷ ওর জন্য না চৌধুরীদের সাথে আমাদেরও সম্পর্ক খারাপ হয়। এর পরিণাম কিন্তু ভালো হবে না।”
দিলারা খাতুন যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম। এমনিতেও নিপুণকে তার তেমন একটা পছন্দ নয়৷ তাই এই প্রসঙ্গ টেনেই তিনি বললেন,
“এইসব বাড়াবাড়ির জন্যই ঐ মেয়েটাকে শুরু থেকে আমার পছন্দ নয়। না জানি তোমরা বাবা-ছেলে ওর মধ্যে কি এমন দেখলে যে ওকে এই বাড়ির বউ করার জন্য একদম উঠে পড়ে লেগেছ।”
দিশা দিলারা খাতুনের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“তুমি শুধু শুধুই নিপুণ আপিকে দোষ দিচ্ছ মম। আমি তো শুনেছি যেই মেয়েটা রাহাত চৌধুরীর নামে রে* কেস করেছে সে হলো স্নেহার বান্ধবী। আমার তো মনে হয় ঐ স্নেহাই নিপুণ আপিকে ইনফ্লুয়েন্স করেছে। নিপুণ আপি তো এমনিতেই ভালো মানুষ। তাই স্নেহার কথায় হয়তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।”
দিলারা খাতুন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,
“ও তো আরেকটা আপদ! ঐ স্নেহাকে তো আমি একদম সহ্য করতে পারি না৷ ওর আসল সত্যিটা মনে পড়লেই আমার গা জ্বলে যায়।”
আজিজ খান কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
“এসব কথা বলা এখন বন্ধ করো। দীপ তুমি নিপুণকে সবটা বুঝিয়ে বলো।”
“জ্বি, আচ্ছা।”
★★★
নিপুণ কোর্টে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। নিপুণ ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে পায় দীপ্র ফোন করেছে। সে তড়িঘড়ি ফোনটা রিসিভ করে বলে,
“হ্যালো দীপ।”
“তোমার সাথে আমার খুব জরুরি কথা আছে নিপু।”
“বলো কি বলবে।”
“এভাবে নয়। সামনাসামনি বলতে হবে।”
“আমি তো কোর্টে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছি। পরে বললে কি খুব অসুবিধা হবে?”
“আ’ম অন দা ওয়ে। তুমি তোমার বাসাতেই ওয়েট করো। আমি দশ মিনিটে পৌঁছে যাব।”
“হ্যালো, দীপ। আমার কথাটা..”
দীপ্র আর কিছু না বলে ফোনটা কে’টে দেয়। নিপুণ দীপ্রের আসার অপেক্ষা করতে থাকে। কিছু সময়ের মধ্যে দীপ্র চলে আসে নিপুণদের বাসায়। দীপ্রকে দেখে নিপুণ বলে,
“দীপ তোমার কি বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমার অলরেডি অনেক লেইট হয়ে গেছে।”
“তুমি কেসটা ছেড়ে দাও।”
“মানে?”
“রাহাত চৌধুরীর বিরুদ্ধে তুমি যেই কেস লড়তে চাইছ সেই কেসটা ছাড়তে বলছি।”
“কিন্তু কেন?”
“কেন তুমি বুঝতে পারছ না? এরকম ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেস লড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তুমি অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারো।”
“আমি এই কেস লড়বোই।”
“নিপু! তুমি কেন বুঝতে চাইছ না।”
“আমার কিছু বোঝার নেই।”
ততক্ষণে শাহিনা খাতুনও চলে আসেন। তাকে দেখেই দীপ্র বলে,
“আন্টি আপনি নিপুকে বোঝান। ও কিন্তু আগুন নিয়ে খেলতে চাইছে।”
“ওকে আমি আর কি বোঝাবো বাবা? ও আমার কথা শুনলে তো!”
নিপুণ ঘড়িতে টাইম দেখে বলে,
“আমি আর এক মিনিটও অপেক্ষা করতে পারব না।”
নিপুণ যেতে চাইলে দীপ্র তার পথ আটকে বলে,
“আমার কথাটা মনযোগ দিয়ে শোন নিপু। তোমার সামনে মনে করো দুটি অপশন। তুমি কোনটাকে বেছে নিবা? আমাকে নাকি এই কেসটাকে?”
নিপুণ কোন সংকোচ ছাড়াই বলে দেয়,
“আমার কাছে সবার আগে আমার দায়িত্ব তারপর বাকি কিছু।”
“বেশ। তুমি থাকো তোমার দায়িত্ব নিয়ে। আমি চললাম।”
বলেই দীপ্র হনহন করে বেরিয়ে আসে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨