তুমি ছিলে বলেই পর্ব-০৭

0
517

#তুমি_ছিলে_বলেই
#পর্বঃ৭
#দিশা_মনি

স্নেহা অনুপমকে সাথে নিয়ে চলে আসে প্রজ্ঞার দেওয়া ঠিকানাতে৷ এখানে এসে তারা প্রজ্ঞার কোন খোঁজ পায় না৷ স্নেহা ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে উদ্বিগ্ন গলায় অনুপমকে বলে,
“প্রজ্ঞার কোন বড় বিপদ হয়ে গেল না তো? আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।”

অনুপম স্নেহাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
“তুমি চিন্তা করো না৷ চলো আমরা দুজনে আরো একটু খুঁজে দেখি৷ হয়তো আশেপাশে ওকে পেয়ে যাব।”

স্নেহা ও অনুপম প্রজ্ঞার খোঁজ অব্যাহত রাখে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই তারা দুজনে রাস্তায় প্রজ্ঞাকে পড়ে থাকতে দেখে৷ প্রজ্ঞাকে একদম নিস্তেজ লাগছিল। তার সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন। প্রজ্ঞাকেই দেখেই স্নেহা বুঝতে পারে যা অঘটন ঘটার ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। তাই স্নেহা প্রজ্ঞার পাশে বসে কাঁদতে শুরু করে। তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু পড়তে থাকে। সে প্রজ্ঞাকে ডাকতে থাকে কিন্তু প্রজ্ঞা কোন সাড়া দেয় না। স্নেহা অনুপমকে বলে,
“অনুপম চলো আমরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”

“পাগল নাকি তুমি? আমি যেতে পারব না।”

“কেন পারবে না অনুপম? দেখছ না প্রজ্ঞার কি অবস্থা?”

“এজন্যই তো বলছি। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওকে হয়তো রে*প করা হয়েছে। এখন আমি যদি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই পুলিশ তো আমাকেই সাহায্য করবে। তাই আমি যেতে পারবো না। তুমি অন্য কারো সাহায্য নাও।”

“কিন্তু এই মুহুর্তে কে সাহায্য করবে আমায়?”

হঠাৎ করেই স্নেহার মনে পড়ে যায় নিপুণের কথা। তাই সে নিজের ফোন করে এবং নিপুণকে ফোন দেয়। নিপুণ ফোন রিসিভ করলে সে বলে,
“আপু আমি অনেক বড় একটা বিপদে পড়েছি আপনার সাহায্য প্রয়োজন। দয়া করে পদ্মাঘাট এলাকায় চলে আসুন।”

“ঠিক আছে। তুমি ওখানেই থাকো আমি যাচ্ছি।”

এটুকু বলেই নিপুণ ফোনটা রেখে দেয়। স্নেহা ফোনটা রেখে দিয়ে অনুপমকে বলে,
“আমি নিপুণ আপুকে ফোন সাহায্য চেয়েছি। উনি আসছেন।”

“ঠিক আছে। তাহলে তুমি এখানে থাকো আমি আসছি।”

“তুমি আমাকে এভাবে বিপদে একা রেখে চলে যাবে অনুপম?”

“আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি আশেপাশেই আছি তোমার উপর নজর রাখব। তুমি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো স্নেহা। এই মুহুর্তে হঠাৎ কেউ চলে আসলে আমাকেই সন্দেহ করবে।”

স্নেহা আর কিছু বলে না। অনুপম বিদায় নেয়।

★★★
নিপুণের সহায়তায় প্রজ্ঞাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে স্নেহা। প্রজ্ঞার চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে। নিজের বান্ধবীর এহেন অবস্থায় ভীষণ ভেঙে পড়েছে স্নেহা। সে সমানে কেঁদে চলেছে। নিপুণ স্নেহাকে সামলাচ্ছে।

কিছু সময়ের মধ্যে একজন নার্স এসে বলেন,
“পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। উনি অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন। ওনাকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না।”

স্নেহা বলে,
“আমি কি ওর সাথে দেখা করতে পারি?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই।”

স্নেহা ও নিপুণ দুজনেই প্রজ্ঞার সাথে দেখা করতে তার কেবিনে প্রবেশ করে। সেখানে প্রবেশ করতেই তারা দেখতে পায় প্রজ্ঞা কিরকম পাগলামী করছে। সে সমানে বলে চলেছে,
“ওরা আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে…আমি সমাজে মুখ দেখাবো কি করে…আমি আর বাঁচতে চাই না। প্লিজ ডাক্তার আমাকে মে*রে ফেলুন।”

প্রজ্ঞাকে এরকম করতে দেখে স্নেহার ভীষণ খারাপ লাগে। সে নিজেকেই দোষ দিতে থাকে। সে সঠিক সময় পৌঁছে গেলে হয়তো আজ প্রজ্ঞার সাথে এরকম হতো না। স্নেহা প্রজ্ঞার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“নিজেকে সামলা প্রজ্ঞা। তোর এখন এত ভেঙে পড়লে চলবে না।”

প্রজ্ঞা স্নেহাকে দেখে আরো বেশি ভেঙে পড়ে। সে বলতে থাকে,
“কি ভাবে নিজেকে সামলানো আমি স্নেহা? ঐ জানো*রগুলো আমার এত বড় ক্ষতি করে দিলো। আমি এখনো সেই বিভৎস সময়টা ভুলতে পারছি না।”

নিপুণ এবার এগিয়ে এসে বলে,
“তোমায় নিজেকে সামলাতে হবে প্রজ্ঞা। তোমার সাথে যারা এই অন্যায় করেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য হলেও তোমায় নিজেকে সামলাতে হবে।”

স্নেহা প্রজ্ঞার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“উনি হলেন নিপুণ খান। উনি একজন উকিল। তুই নিঃসংকোচে তোর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা ওনাকে বলতে পারিস। উনি নিশ্চয়ই তোকে সাহায্য করবে।”

প্রজ্ঞা নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়। তারপর বলে,
“ওদের সবাইকে আমি চিনি। আমাদের ভার্সিটির ছাত্রনেতা রাহাত আছে এসবের পেছনে। ঐ লোকটা কিছুদিন আগে আমাকে নোংরা প্রস্তাব দিয়েছিল৷ আমি সেইসময় ওনার মুখের উপর না করে দিয়েছিলাম৷ ওনাকে ভালো মন্দ অনেক কথাও বলেছিলাম। আর তাই উনি এভাবে….”

প্রজ্ঞা আর কিছু বলতে পারলো না। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া বিভৎস ঘটনার স্মৃতি তার মানসপটে ভেসে ওঠে। সে নিজের মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে দেয়।

স্নেহা আতংকমিশ্রিত গলায় শুধায়,
“রাহাত! উনি সংসদ সদস্য রুদ্র চৌধুরীর ভাই না?”

প্রজ্ঞা উত্তরে বলে,
“হ্যাঁ, ওনার আরো একটা পরিচয় হচ্ছে উনি সাবেক মন্ত্রী রাজীব চৌধুরীর ছেলে। ওনারা অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি স্নেহা। আমি মনে হয় কোনদিনও ন্যায়বিচার পাবো না।”

নিপুণ দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলে,
“অপরাধী যতই ক্ষমতাবান হোক শাস্তি তাদের পেতেই হবে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। তুমি কোন চিন্তা করো না প্রজ্ঞা, তোমায় ন্যায় বিচার পাইয়ে দিতে আমি তোমার পাশে থাকব।”

অতঃপর সে একজন ডাক্তারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনারা পুলিশকে খবর দেন নি?”

“হুম। জানিয়েছি।”

এরইমধ্যে প্রজ্ঞার বাবা মা চলে আসেন হাসপাতালে। স্নেহা তাদের ফোন করে বলেছিল স্নেহা হাসপাতালে ভর্তি। বিস্তারিত ভাবে কিছু সে বলেনি। এখানে এসে তাই তারা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। প্রজ্ঞার কেবিনে প্রবেশ করেই তারা স্নেহাকে শুধায়,
“কি হয়েছে আমাদের মেয়ের?”

স্নেহা তাদের সব খুলে বলে। সব শুনে তাদের দুজনের অবস্থাই খারাপ হয়ে যায়। প্রজ্ঞার বাবা পারভেজ হোসেন একজন সাধারণ স্কুলশিক্ষক এবং তার মা মনিরা খাতুন একজন গৃহিণী। তারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাদের কাছে সম্মানটাই সব। মনিরা খাতুন তো আহাজারি করে বলতে শুরু করেন,
“এজন্যই তোমায় বলেছিলাম মেয়েটার এত পড়ানোর দরকার নাই। এখন দেখলা তো ওর কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল।”

পারভেজ ইসলাম একদম চুপ করে রইলেন। হঠাৎ করে এই আঘাতটা তিনি নিতে পারলেন না। ততক্ষণে পুলিশও এসে উপস্থিত হয়। পুলিশকে আসতে দেখেই নিপুণ এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে কথাবার্তা বলে। সে শক্তভাবে অবস্থান নেয় প্রজ্ঞার পক্ষে৷ অপরাধীও বিচারের দাবি করে। পুলিশ অফিসার নিপুণকে বলে,
“আমাদের কাজ আমরা ঠিকই করব। আমাদের আগে ভিকটিম ও তার পরিবারের সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে দিন।”

পুলিশ প্রথমে প্রজ্ঞার সাথে কথা বলে। প্রজ্ঞা তো সহজে তাদের সামনে সব ঘটনা বলতে পারছিল না কিন্তু নিপুণ ভরসা দেওয়ায় সে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শোনার পর তারা পারভেজ ইসলাম ও মনিরা খাতুনকে বলেন,
“আপনারা থানায় এসে এফআইয়ার দায়ের করুন। তারপর আমরা স্টেপ নেবো।”

পারভেজ ইসলাম তাই করতে চান। তখন মনিরা খাতুন বলেন,
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছ নাকি? এমনিতেই মেয়েটার এত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। এখন যদি থানা পুলিশ হয় তাহলে তো ব্যাপারটা লোক জানাজানি হয়ে যাবে। এমনিতেও ওত ক্ষমতাবান লোকের সাথে আমরা পারব না। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাই ভালো হবে।”

“আমি আমার মেয়ের জন্য ন্যায়বিচার চাই মনিরা। প্রয়োজনে নিজের যা আছে, যতটুকু আছে তাই দিয়ে লড়াই করব। তুমি একদম আমাকে বাঁধা দেবে না।”

মনিরা খাতুন আর কিছু বলতে পারেন না।

★★★
পারভেজ ইসলাম থানায় এফআইয়ার করতে গেলে একজন পুলিশ অফিসার তাকে বলেন,
“কি হবে খামোখা এসব এফআইয়ার করে? কার নামে এফআইয়ার করছেন জানেন তো? রাহাত চৌধুরী। এমপি রুদ্র চৌধুরীর ভাই। ওনাদের ক্ষমতার কাছে আপনারা ধোপে টিকবেন না। কি হবে শুধু শুধু ঝামেলা করে? তার থেকে ভালো হবে আপনারা নিজেরা নিজেরা সব মিটমাট করে নিন।”

পারভেজ ইসলাম নিদ্বিধায় বলেন,
“পুলিশের পোশাক পড়ে এমন কথা বলতে আপনার লজ্জা করছে না? আপনাদের কাজ কি নেতার চামচামি করা? আমাকে এসব কুপরামর্শ দিতে আসবেন না।”

পুলিশ অফিসার এবার থমথমে মুখে বললেন,
“দেখা যাক। আপনি কতদূর যেতে পারেন। আমরা এফআইয়ার তো নিলাম। কিন্তু সঠিক প্রমাণ ছাড়া এত বড় একজন লোকের বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে পারব না।”

“আমার মেয়ে নিজের মুখে সব বলেছে সেটা কি যথেষ্ট নয়?”

“না। আইন প্রমাণে বিশ্বাসী।”

পারভেজ ইসলাম এবার রেগে যান। বলেন,
“আপনার কোন স্টেপ নেবেন না তাই তো? এবার দেখুন একজন বাবা তার মেয়েকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য কত দূর যেতে পারে।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে