#তুমি_গহীন_অনুভব
#পর্ব_১০
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
“ফুল আপা ফুল আপা তাড়াতাড়ি দরজা খুলেন।
রাত দুইটার সময় কেউ ইরজার রুমের দরজা নক করছে। দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ইরজার ঘুম ভেঙে গেল। পাশে তাকাতেই দেখতে পেল তার প্রান ঘুমাচ্ছে নিশ্চিন্তে তার হাত ধরে । সে মুচকি হেসে কপালে একটা চুমু খেয়ে হাত ছাড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলো। এত রাতে তাকে ডাকছে কেন ভেবেই তাড়াতাড়ি দরজা খুললো। দরজা খুলতেই পঁচিশ বছর বয়সী একটা মেয়েকে দেখা গেল যে নরমাল একটা সুতির থ্রিপিস পড়েছে। ইরজা বলল,,
“কি হয়েছে আয়না? এত রাতে ডাকছো কেন? ”
“ফুল আপা তাড়াতাড়ি চলুন গ্ৰাম থেকে দূরে কোন একটা জায়গায় একটা গাড়ি নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেটা দেখে কয়েকজন নাকি গাড়িতে থাকা দুইজন কে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। হাসপাতালে একজন আছে তবে সে সামাল দিতে পারছে না। এখন তো আশেপাশে আপনি ছাড়া কেউ নাই। আপনাকে এখনি হাসপাতালে যেতে হবে।”
“কতক্ষন আগে এক্সিডেন্ট হয়েছে?”
“দু ঘন্টার মতো হবে?”
“ওহ আচ্ছা তুমি যাও আর হাসপাতালে সব রেডি রাখতে বলো আমি বোরকা টা পড়েই আসছি।”
ইরজা তাড়াতাড়ি রুমে এসে বোরকা পড়ে নিল। রুম থেকে বেড়িয়েই ওর ছোটভাই ইমদাদ কে দেখতে পেল। ও মুচকি হেসে ছোট ভাইয়ের সাথে আয়নাকে নিয়ে চলল ওদের হাসপাতালে। হাসপাতালে পৌছে দিয়েই ইমদাদ আবার বাড়ি চলে গেল। হাসপাতালে যেতেই দু’জন নার্স ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল,,
“ম্যাডাম সবকিছু রেডি করে রেখেছি ।”
“গুড এখন দেখি কতোটা কি হয়েছে।”
ইরজা লোক দুটো কে দেখে চমকে গেল। এ যে ওর পরিচিত দুটো মুখ তিশা আর ওর হাজবেন্ড ইরজা এক পা পিছিয়ে গেল ও ঘামতে শুরু করলো। কিন্তু এখন যে পেছানোর সময় নয় কারণ ওদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। ইরজা বড় বড় কয়েকটি বড় বড় শ্বাস নিল তারপর ওদের ট্রিটমেন্ট শুরু করলো। কয়েক ঘন্টা পর ওদের ট্রিটমেন্ট শেষে ওদের কেবিনে দেওয়া হয়েছে। ওদের ট্রিটমেন্ট করে বের হয়ে দেখলো কেবল ৪:৩০ টা বাজে আর কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান দেবে। ও ফ্রেশ হয়ে এলো আর ওযু করে এলো। কিছুক্ষণ পর আজান দিলে ও ফজরের সালাত আদায় করে নিল। আজ কেন যেন খুব কষ্ট লাগছে। ও গিয়ে সকল প্রেশেন্ট কে দেখে এলো। ওর মনটা অস্থির লাগছে তাই সুরা রহমান ছেড়ে হেডফোন দিয়ে শুনতে লাগলো। আর রহমান সূরাটি শুনলেই মনের ভেতর অদ্ভুত রকম শান্তি লাগে। সূরা রহমান শুনতে শুনতে কখন যে ইরজা ঘুমিয়ে পড়েছে ওর ঠিক খেয়ালে নেই। ওর ঘুম ভাঙল হাসপাতালের চেঁচামেচি তবে কেউ এসে চিৎকার করছে “এইরকম ছোট হাসপাতালে তার মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে কেন আনা হয়েছে” এই নিয়ে। ইরজা বেরিয়ে দেখলো বেশ ছোট খাটো একটা জটলা। তা দেখে ইরজা গম্ভীর গলায় বলল,,,
“কি হচ্ছে এখানে? এটা হাসপাতাল কোন মাছের বাজার নয় যে এখানে এসে ইচ্ছে মতো চিৎকার করবেন।”
পেছনে কারো এরকম কথা শুনে সবাই পেছনে তাকালো। আর তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল। সাথে ইরজা নিজেও । ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুরো চৌধুরী পরিবার এটা দেখে ইরজার মুখে দুশ্চিন্তা দেখা গেল। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর এদের সবাইকে সামনে দেখলো। ইরজার ভেতরটা হাহাকার করে উঠলেও ইরজা ওপরে শক্ত ভাবে বলল,,
“এখানে হচ্ছে টা কি আয়না?”
তখন আয়না এগিয়ে এসে তমা চৌধুরী এর দিকে ইশারা করে বলল,,
“ফুল আপু উনি বলছে তার মেয়ে আর তার মেয়ের জামাইকে এত ছোট হাসপাতালে কে নিয়ে এসেছে। এটা কোন হাসপাতাল হলো নাকি উনি এখনি এখান থেকে তাদের নিয়ে চলে যাবে।”
এসব শুনে ইরজা মুখ শক্ত করে বলল,,
“এত ছোট হাসপাতালে কে নিয়েছে এসেছে তাকে কথা না শুনিয়ে বরং তার শুকরিয়া আদায় করুন। কারন সে সঠিক সময় হাসপাতালে না আনলে আপনার মেয়ে আর মেয়ের জামাই দুজনেই মর্গে থাকতো। এ হাসপাতাল শুধু দেখানোর জন্য বানানো হয় নি মানুষের সেবার জন্য বানানো হয়েছে। আপনার ইচ্ছে হলে এখনি ওনাদের নিয়ে যান আমরা কিছু বলবো না।”
ইরজা এতটুকু বলেই যেতে নিল সকলে অবাক চোখে ইরজাকে দেখতে লাগলো ইরজা এখানে কিন্তু কেন?তখন ফায়জা ভাবি বলে ইরজাকে জড়িয়ে ধরলো। ইরজার এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে এই মানুষ গুলো কে ও ফেস করতে পারছে না।ফায়জা বলল,,
“কতোদিন পর তোমায় দেখলাম ভাবি। প্রায় পাঁচ বছর পর। তুমি কোথায় ছিলে?”
ইরজা ফায়জাকে ছাড়িয়ে বলল ,,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি তবে আমি আপনার ভাবি নই। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আয়না আমার কেবিনে স্ট্রং কফি পাঠাও।”
বলেই ইরজা ওর কেবিনে চলে গেল। ইশতিয়াক চৌধুরী কিছু বলতে চেয়েও বললেন না। আয়েশা চৌধুরীর আর ফায়জার চোখ ছলছল করে উঠলো। তুহিন একজন নার্সকে বলল,,
“ইনি কে?”
তখন নার্সটা উত্তরে বলল,,
“ইনিই আমাদের হাসপাতালের ডাক্তার। এই হাসপাতাল টা ওনার বাবা দিয়েছিল। উনি যখন বিদেশে থেকে পড়ে দেশে ফিরে আসেন তখন ওনার বাবা এই হাসপাতাল বানান। উনি ফিরে আসার কিছু মাস পর ওনার বাবাকে মেরে ফেলা হয় উনার বাবা ছিলেন বড় ব্যবসায়ী আর এখানকার চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান সাহেব মারা যাওয়ার পর তিনি এখানে ছিলেন না কোথায় যেন গিয়েছিলেন। তার একবছর পর উনি আবার গ্ৰামে ফিরে আসেন আর এই হাসপাতাল এ ডাক্তারি শুরু করেন উনি প্রায় চার বছর বছরের বেশি সময় ধরে এখানে আছেন। এত বড় ডাক্তার সেই বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসে এই ছোট্ট হাসপাতালে কাজ করে। মাঝে মাঝে অবশ্য ঢাকায় বড়বড় অপারেশন করতে যায় কিন্তু দিনশেষে এই গ্ৰামেই সে ফিরে আসে। আর আপনাদের পেশেন্ট দুজনের চিকিৎসা তো উনিই করছে।”
বলেই নার্সটা চলে গেল। ইরজা এমন কেউ ছিল ওরা বুঝতেই পারে নি। তখন ফায়জা বলল,,
“ভাবি ডাক্তার ছিল অথচ আমরা কেউ বুঝতেই পারি নি। এই জন্যই বোধহয় ভাইয়ার এক্সিডেন্ট এর সময় ওতো ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল। আর কাগজটায় ওষুধ লিখেছিল। ভাবিকে মলি আপু কতো কথা শুনিয়েছেন আমার খালাতো বোন কত কথা বলেছে কিন্তু ভাবি কখনো বলে নি সে একজন বিদেশ ফেরত ডাক্তার।”
ইশতিয়াক চৌধুরী চুপ করে বেঞ্চে বসে রইলো। চৌধুরী বাড়ির সকলেই হতবাক কারো মুখে কোন কথা নেই। আয়েশা চৌধুরীর চোখ ছলছল করে উঠলো। তিনি এই মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এমন কি ওদের থেকে এই ইরজা নামক অস্তিত্ব কে মুছে ফেলেছে। ইরজা নিজের কেবিনে গিয়ে মাথা ধরে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর আয়না কফি নিয়ে এলো। আয়না ইরজাকে দেখছে চারবছরে আগে । আয়নার সাথে দেখা হয়েছিল ঢাকায় আয়নার আইজানদের ওখান থেকে আসার পর ওর ভাইয়েরা ওর দেখাশোনার জন্য রেখেছিল। তারপর ঢাকায় থেকে গ্ৰামে চলে আসার পর আয়নাও ওর সাথে আসে আর ইরজার সবকিছু দেখাশোনা করে। ও কফি দেখে মাথা তুলে কফিটা নেয়। তখন আয়না বলে ,,
‘ফুল আপু তুমি ঠিক আছো?”
ইরজা মুচকি হেসে বলল,,
“আমার আবার কি হবে আমি ঠিক আছি!’
“তুমি কি ওনাদের চেনো না মানে তোমাকে দেখে মনে হলো তুমি চেনো কিন্তু তুমি তা স্বীকার করতে চাইতো না।”
“যারা আমার কেউ নয় তাদেরকে স্বীকার করায় আর না করায় কি আসে যায়।”
আয়না আর কিছু বললো না। কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ইরজা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আট টা বাজে তা দেখে ও অন্য কিছু ভাবতে লাগলো।
__________________
“মামনি দেখেছো আজ হাসপাতালে কতো মানুষ। আম্মু মনে হয় আজ খুব ব্যস্ত বুঝতে পারলে। ”
ছোট্ট চার কি পাঁচ বছরের ছেলে ইয়াদ এর কথা শুনে হাসলো আইরিন। সে আজ হাসপাতালে এসেছে তার মায়ের সাথে খাবে বলে। সকালে ঘুম থেকে পাশে মাকে না পেয়ে কি কান্না। আইরিন বুঝিয়ে সুঝিয়ে কোন রকমে কান্না থামিয়েছে। কান্নার থামার পরে তার আবদার হয়েছে হাসপাতালে এসে তার মায়ের সাথে খাবে। হাসপাতালে আসতেই অনেকগুলো লোকের দেখা পেল। সচরাচর এত লোকের দেখা পাওয়া যায় গ্ৰামের ভেতরে হাসপাতাল তো তাই। আইরিন মুচকি হেসে বলল,,
“ইয়াদ বাবা এত মানুষ হলেও কিন্তু তোমার মা ওতো ব্যস্ত না যে তোমার সাথে খাবার খাবে না। চলো ভেতরে যাই তারপর দেখি।”
একটু সামনে আগাতেই আইরিন চৌধুরী বাড়ির সকল কে দেখে থমকে গেল ওনারা এখানে কি করছে। ওর ইরজার কথা মনে পরতেই আইরিন তাড়াতাড়ি করে ইরজার কেবিনের দিকে হাঁটা ধরলো। তখন ইয়াদ বলল,,
“মামনি এতো তাড়াতাড়ি হাটছো কেন আমি ছোট মানুষ আমি কি তোমার সাথে হেঁটে পারি বলো তো!”
এ কথা শুনে আইরিন হাঁটা থামিয়ে দিল আর বলল,,
“ওহ হো যে সারাদিন বিগ বয়! বিগ বয়! বলে চেঁচায় সে এখন নিজেকে ছোট মানুষ বলছে।”
ইয়াদ মুচকি হেসে বলল,,
“সব জায়গায় বিগ বয় হতে নেই নাহলে সে লস খায়।”
তখনি ইরজা বেরিয়ে তিশার রুমের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। তিশা রেস্পন্স করছে কিন্তু ওর মনে হয় ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ইরজার দৌড় দেখে চৌধুরী বাড়ির সকলে দাঁড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগেই একটা নার্স ওদের সামনে দিয়ে গেছে। আর এখন ইরজা দৌড়ে সেদিকে গেল। তিশা আর তিশার হাজবেন্ড কে সকলে একবার করে দেখে গেছে। তিশার হাজবেন্ড এর থেকে তিশার অবস্থা বেশি খারাপ। তখন ইশতিয়াক চৌধুরী একটা নার্স কে জিজ্ঞেস করল,,
“কি হয়েছে সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে কেন?
“পেসেন্ট মনে হয় শ্বাস নিতে পারছে না। ম্যাডাম তো দেখছে ইনশাআল্লাহ্ খারাপ কিছু হবে না।”
চৌধুরী পরিবার চিন্তায় পড়ে গেল। তখন ইয়াদ গুটি গুটি পায়ে ইশতিয়াক চৌধুরীর পাশে দাঁড়ালো তমা চৌধুরী তো কেঁদে উঠলো। আইরিন ও গেল ইয়াদের সাথে। ইয়াদ ইশতিয়াক চৌধুরীর হাত ধরে বলল,,
“ঐ দাদুটা কান্না করছে কেন? কারো কি কিছু হয়েছে?”
এ কথা শুনে ইশতিয়াক চৌধুরী ইয়াদের দিকে তাকালো পিচ্চি একটা বাচ্চা ওনার হাত ধরে জিজ্ঞেস করছে। উনি নিচু হয়ে বলল,,
“ওনার মেয়ে অসুস্থ তাই উনি কাঁদছে।”
“কি হয়েছে ওনার মেয়ের?”
“একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
তখন ইয়াদ তমা চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলল,,
“কান্না করো না দাদু দেখবে তোমার মেয়ে একদম সুস্থ হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে দোয়া করো। জানো আমার আম্মু বলে আল্লাহ তায়ালা সব ঠিক করে দেয়। আমি অসুস্থ হলেই আম্মু আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া করে জানো। আর আমিও খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাই।”
এই কথাগুলো শুনে তমা চৌধুরী কান্না বন্ধ করে ইয়াদের দিকে তাকালো। ইয়াদ মুচকি হেসে আইরিনের কাছে চলে গেল আর আইরিন কে বলল,,
“চলো মামনি আমরা কেবিনে যাই।”
তখন আয়েশা চৌধুরী আইরিন কে বললেন,,
“তোমার ছেলে বুঝি?”
তখন আইরিন মুচকি হেসে বলল,,
“বলতে পারেন আমার ছেলেই।”
“নাম কি ওর!”
তখন ইয়াদ বলল,,
“আমার নাম ইয়াদ।’
তখনি ইরজা রুমে থেকে বেরিয়ে এলো ইয়াদ “আম্মু বলে দৌড়ে ইরজার কাছে গেল। আজ যেন সকলের অবাক হওয়ার দিন। কি হচ্ছে এখানে কারো মাথায় ঢুকছে না। ইরজার ইয়াদকে দেখে হাসি ফুটে উঠল। ইয়াদ ইরজার সামনে দাড়াতেই ইরজা বলল,,
“কি রাজকুমার আজ সকাল সকাল হাসপাতালে?”
“একসাথে নাস্তা করবো তাই। তাছাড়া ইয়াদ তার আম্মুকে অনেক মিস করছিল সকাল বেলা ঘুম থেকে তার আম্মুর চেহারা দেখেনি তাই।”
“আচ্ছা তুমি কেবিনে গিয়ে বসো আমি আসছি!”
“ঠিক আছে!”
বলেই ইয়াদ চলে গেল। ইরজা সকল কে বলল,,
” ভয়ের কোন কারন নেই। আপনাদের মেয়ে এবং মেয়ের জামাই দুজনেই ভালো আছেন। দুদিনের মতো এখানে থাকতেই হবে। কারন এ অবস্থায় তাদের অন্য জায়গায় শিপ্ট করতে পারবেন না। তাদের অসুবিধা হবে।”
বলেই ইরজা যেতে নিল। তখন আয়েশা চৌধুরী বললেন,,
“ইরজা শুনো?
ইরজার পা দুটো যেন আপনাআপনি থেমে গেল। আয়েশা চৌধুরী আবার ও বললেন,,
“এই ছেলেটা কি তোমার? ইরজা ও কি আমার আই,,
ইরজা বাকিটুকু আর বলতে দিল না। তার আগেই বলল,,
“আমার জানামতে আপনাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আর আমার সাথে যেহেতু নেই সেহেতু আমার ছেলের সাথেও থাকার কথা নয়।”
বলেই ইরজা হাঁটতে লাগলো। আয়েশা চৌধুরীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরল। ইশতিয়াক চৌধুরী নির্বাক শ্রোতা ওনার কিছু বলার নেই। আইরিন ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। আইরিন ও ইরজার সাথে হাঁটতে লাগলো ও আইরিনকে বলল,,
“ভাবি তুমি ওকে এখানে এনেছো কেন?”
“জেদ করছিল তাই ওর জেদ তো জানিসই। সকাল বেলা তোকে না পেয়ে সে কি কান্না।”
“কি! ও কান্না করেছে?”
“হুম।”
“তুমি খেয়েছো?”
“হুম আমি খেয়েই এসেছি। আমরা অনেক বলেও ইয়াদ কে খাওয়াতে পারি নি। তাই তো নিয়ে এলাম।”
“ওহ আচ্ছা।”
“মন খারাপ?”
তখন ইরজা আইরিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,,
“অতীত মুছে ফেলার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে স্থান পালটানো। আর আমাকে তো সেই স্থান থেকেই বের করে দেওয়া হয়েছে। আহা এর থেকে শান্তির আর কি হতে পারে।”
আইরিন কিছু বললো না অসহায় চোখে ইরজার দিকে তাকালো তখন ইরজা বলল,,
“ভাবি তুমি এখন বাড়ি যাও ওনাদের খাবারের ব্যবস্থা করো আমার জানামতে এখানে ওনাদের কেউ নেই। আর ভাইয়াকে দিয়ে খাবার গুলো একটু হাসপাতালে পাঠিয়ে দিও।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আইরিন চলে গেল আইরিন হচ্ছে ইরজার বড় ভাবী।সাথে ইরজার বেস্ট ফ্রেন্ড। ইরজা কেবিনে ঢুকে দেখতে পেল ইয়াদ চুপ করে বসে আছে। ইরজা গিয়ে মুচকি হেসে বলল,,
“তা রাজকুমার এত বেলা হয়ে গেছে খায় নি কেন? আবার শুনলাম কান্নাও করেছে বিগ বয়রা কাঁদে নাকি হুম।”
তখন ইয়াদ বলল,,
“আমি কেঁদেছি তোমাকে কে বলল মামনি তাই না। আর আমি তো রোজ তোমার সাথেই খাই তাই আজ ও খাবো। তাছাড়া তোমার হাতে ছাড়া খেলে আমার পেট-ই ভরেনা।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চলো খেয়ে নাও।
ইরজা আয়াজ কে খাওয়াতে লাগলো আর নিজে খেতে লাগলো। পর্দার আড়াল থেকে আয়েশা চৌধুরী দেখলেন। ওদের খাওয়া শেষে ইরজা ইয়াদ কে আয়নার সাথে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। হাসপাতালে থেকে ওদের বাড়ি যেতে দশ মিনিট সময় লাগে। তখন ইরজার ভাই ইরফান আসলো খাবার হাতে নিয়ে ও গিয়ে ইশতিয়াক চৌধুরীর কাছে গেল আর বলল,,
“আসসালামু আলাইকুম বড় বাবা!”
ইশতিয়াক চৌধুরী মাথা তুলে ইরফান কে দেখে বলল,,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি এখন এখানে ?”
“আপনাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি এখানে তো আপনাদের পরিচিত কেউ নেই। আমরাই আছি তাই এখন সবাই খেয়ে নিন তারপর বাসায় যেয়ে রেস্ট নিন। এদিকটা ফুল দেখে নিবে।”
“তোমাকে কে বলল আমরা এখানে?”
“একটু আগে আমার স্ত্রী এসেছিল ইয়াদের সাথে। ও গিয়ে খবর বলেছে?”
“তোমার স্ত্রী আমাদের চিনলো কিভাবে?’
“ও সবাইকে চিনে যাক এসব বাদ দিন এখন খাবার খেয়ে নিন অনেক বেলা হয়ে গেছে।”
তখন ফয়জা বলল,,
“বাবা উনি কে?”
“ও হচ্ছে ইরজার ভাই আমার বন্ধু আজাহার এর ছেলে।”
ইরফান সকলকে বলে কয়ে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল। এতগুলো মানুষ থাকবে কোথায়। এত কিছুর মাঝে ইসহাক চৌধুরী কে দেখা গেল না। (ইরজার দুই ভাই বড়ভাই ইরফান আর ছোটভাই ইমদাদ । ইরফানের থেকে ইমদাদ আর ইরজা পাঁচ বছরের ছোট। ইরজা আর ইমদাদ টুইন ছিল।
______________________
ইরা আজ দুপুরেও বাড়ি যায় নি। তিশার জ্ঞান ফিরে এগারোটার দিকে সকলে তিশা আর ওর হাজবেন্ড এর সাথে দেখা করে। বিকেল ইরজা একটা খোলা মাঠের কিনারে দাঁড়িয়ে নদী দেখছে । আকাশটা মেঘলা ঠিক ওর মনের মতো কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো ইরজার কোন হেলদোল নেই ও চোখ বন্ধ করে বৃষ্টিকে অনেক কাছ থেকে অনুভব করতে লাগলো। । ঠিক তখনি ওর পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,,,
“একা একা বৃষ্টি বিলাস করা কিন্তু উচিৎ নয় মেয়ে।”
ইরজা পাশে ফিরেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে বলল,,
“আপনি এলেন কখন?”
“এই তো কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু তোমার প্রেমিক পুরুষ যে তোমার ওপর অভিমান করেছে ?”
“কেন অভিমান করেছে কেন?”
“এই যে তার প্রেমিক পুরুষ কে ছাড়া সে বৃষ্টি বিলাস করছে।”
“ওকে বাবা সরি চলুন এখন একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো।”
“হুম চলো। শুভ্রপরী একটা গান শোনাবে?”
“গান আর আমি!”
“হুম তুমি এমনিতে তো আমিই শোনাই আজ তুমি শোনাও! এই বৃষ্টির মাঝে গান মন্দ লাগবে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে!”
ইরজা তার প্রেমিক পুরুষ এর দিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করলো,,
তারে ধরি ধরি মনে করি,
ধরতে গেলেম আর পেলেম না!
ধরি ধরি মনে করি,
ধরতে গেলেম আর পেলেম না!
দেখেছি,দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা!
দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা !
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ফিরিতেছি পাগল হয়ে,
মরমে জ্বলছে আগুন আর নিভে না,
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ফিরিতেছি পাগল হয়ে
মরমে জ্বলছে আগুন আর নিভে না!
আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ,
বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না!
বলে বলুক লোকে মন্দ,
বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না!
দেখেছি,দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা!
পথিক কয় ভেবো নারে ডুবে যাও রূপসাগরে,
পথিক কয় ভেবো নারে ডুবে যাও রূপসাগরে,
বিরলে বসে করো যোগ-সাধনা!
পথিক কয় ভেবো নারে ডুবে যাও রূপসাগরে,
বিরলে বসে করো যোগ-সাধনা!
একবার ধরতে পেলে মনের মানুষ,
ছেড়ে যেতে আর দিও না!
ধরতে পেলে মনের মানুষ,
ছেড়ে যেতে আর দিও না!
দেখেছি,দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা,
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা!
ইরজার চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল। তা দেখেও তার প্রেমিক পুরুষ মুচকি হাসলো। তা দেখে ইরজা বলল,,
“আপনি খুব খারাপ আইজান! আপনি খুব খারাপ।”
এ কথা শুনে আইজানের মুখের হাসি আরো চওড়া হলো। তখন আইজান মুচকি হেসে বলল,,
“শুভ্রপরী তোমার আমার প্রথম দেখা মনে আছে তো নাকি ভুলে গেছো?”
“আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর আপনার সাথে কাটানো সব মুহুর্ত আমার পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মনে আছে।”
~চলবে,,