তুমি আসবে বলে পর্ব-১০(শেষ পর্ব)

0
1655

#তুমি আসবে বলে
#পর্ব_১০ ও শেষ পর্ব
#ইভা রহমান

সোফার রুমের বড় সোফাটার মাঝে চোয়াল শক্ত করে বসে আছে উজান। দৃষ্টি তার লাল কার্পেটের দিকে রাখা। তাকে ঘিরে বসে আছে বাকি সবাই। বিহান আছে তারই ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে। সাথে আছে মেহু৷ হিয়াকে রুমে তালা দিয়ে রেখে আসছে উজান। বড্ড ছটফট করছিলো সে। এখন একটু শান্ত হয়ে বসে থাকুক কিছুক্ষণ। এদিকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত বিহান। সাথে তো রস ঢালতে মরিয়া মেহু।

– ভাইয়া বিশ্বাস কর,ঔ মেয়ে টা একদম সুবিধের না। ও তোকে ফাঁসাতে এই বাড়িতে এসেছে। হ্যা আমি মানছি আমি তোদের মতো সৎ না। মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করা মজা করা আমার স্বভাব কিন্তু বিশ্বাস কর আমি কখনো কোনো মেয়েকে জোর করে। হিয়া নিজেই আমাকে ওর শরীরের লোভ দেখিয়ে ওর কথাতে…

বিহানের সাথে তাল মিলিয়ে ফোড়ন কাটলো মেহু,

– আমি তো সেই প্রথম দিনই সন্দেহ করেছিলাম ঔ মেয়েটা নির্ঘাত এ বাড়িতে কিছু না কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে তো বটেই। কিন্তু আমার দাদিমণি তো হিয়া বলতেই অন্ধ। আরেএএ পর কখনো আপন হয় না আর কবে বুঝবা তোমরা।

– ভাইয়া বিশ্বাস কর হিয়া মেয়েটা খুবই বাজে একটা মেয়ে। নাহলে তুই দেখ ওহ কি বললো যে ও নাকি এ বাড়িতে সব সত্যি জানতে এসেছিলো তা যখন জেনে গেলো তখন কি ও পারতো না এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। তুই এখনো চোখে পট্টি দিয়ে রাখবি। আর কিসের বিয়ে আমি কোনোদিন ওকে বলিনি আমি ওকে বিয়ে করবো। তোর তোর আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো। ওয়েট ওর বাড়ির লোকের সাথে আমি তোর কথা বলে দিচ্ছি থাম

বলেই বিহান হিয়ার ফুফুর মেয়ে বুলিকে ফোন করলো। উজান বুলির নাম্বার চিনে একবার হিয়া বাড়িতে ফোন করাতে সে এই নাম্বার নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলো। বুলির স্পষ্ট উওর হিয়া নাকি সত্যি ছেলেধরা টাইপ। বিহান নাকি তার বুবুকে সত্যি মন থেকে কাছে পেতে চেয়েছিলো কিন্তু যখন হিয়া শুনলো আপনি এই শাহরিয়ার কুঞ্জের একরওি মালিক তখন ওহ ঠিক সুযোগ বুঝে আপনার কাছে গিয়ে একটা ছলনার আশ্রয় নিলো। এদিকে উপস্থিত সবাই এতোক্ষণ যাওবা বিহান আর মেহুকে বিশ্বাস করতে চাইছিলো না তারাও এখন হিয়ার নিজের বাড়ির লোকের মুখে এ-ই কথা গুলো শুনে ছি চিৎকার করতে থাকলো। কারো কারো তো অভিমত এসে জুটলো দাদিমণি নাকি এতোদিন দুধ দিয়ে হিয়ার মতো একটা কালসাপ পুষে রেখেছে। দাদিমণি কিছু বলতে পারলেন না তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না হিয়া এ বাড়িতে তার কিছু উদ্দেশ্য সফল করতে এসেছিলো বা তার প্রিয় নাতি উজানের থেকে প্রতিশোধ তুলতে। সাথে উনি এটাও মানতে পারছিলেন না যে হিয়া সত্যি এ-তো খারাপ কি? হিয়ার প্রতি উজানের মা’র যেই দূর্বলতা তৈরি হয়ে এসেছিলো নিমিষে সেটা ভেঙে গিয়ে ছন্নছাড়া হয়ে আসলো। তাতে আরো বিষ ঢাললো মেহু,

– যার নিজের বোনই তার সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করছে তাহলে সে কতোটা জঘন্য হতে পারে তোমরা শুধু একবার ভাবো আন্টি। সেদিন না খুব আত্মসম্মান এর কথা বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলো তাহলে আজ কি হলো সেই বড় বড় কথা গুলোর। গেলো তো সব চুপসে। বাজে মেয়ে একটা।

সবার এতো কথার মাঝে উজান উঠে দাঁড়ালো। পেছন ঘুরে দাদিমণিকে উদ্দেশ্য করে বললো তুমি কি চাও দাদিমণি,তোমার মন কি বলে?

দাদিমণি গম্ভীর কন্ঠে উওর করলেন “” তুই সবসময় সবকিছু চিন্তাভাবনা করে সঠিক প্রমাণের উপর ভিওি করে তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিস উজান। আশা করবো এ ব্যাপারেও তুই নিজের বিচক্ষণতার পরিচয় দিবি””

উজান আর কিছু বললো না। সোজা হেঁটে উপরে উঠতে শুরু করলো। এদিকে তো বিহান চিৎকার করেই যাচ্ছিলো “ভাইয়া হিয়া মেয়েটা সত্যি চরিএহীন। এরা নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে আমাদের মতো বড়লোক ছেলেদের ফাঁসাতে চায় ভাইয়া। একটু বিশ্বাস কর, ভাইয়া”

!
!

উপরে এসেই তালা খুলে রুমে ঢুকলো উজান। আবার দরজার খিল লাগিয়ে বিছানায় এসে হিয়ার পাশে বসে যেতেই হিয়া উঠে দাঁড়ালো। হিয়ার মনে হাজার টা চিন্তা এসে ঘুরপাক খাচ্ছে এ-ই মুহুর্তে। নিচে কি হলো এতোক্ষণ, কি বুঝালো বিহান তাকে, উজান বিহানের কথা বিশ্বাস করে নিলো না তো। আর বললেই বিশ্বাস করে নিতে হবে তাহলে কি ভালোবাসলো সে এতোদিন হিয়াকে। ভয়,ক্ষোভ,আর্তনাদ সব এসে জড়ো হচ্ছে হিয়ার সারা শরীর জুড়ে!

– আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন তো উজান। আমি আপনাকে সব বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি প্রতিবারেই আমাকে সেটা বলতে দেন নি

উজান একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলতে শুরু করলো

-তাই বলে প্রতিশোধ হিয়া। সবাই আমাকে শুধু স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে হিয়া। সবাই। আজ আপনিও আমাকে

কান্নার বাঁধ ভাঙ্গলো হিয়ার। অঝোরে কেঁদে দিয়ে বললো,

-না আমি আপনাকে ব্যবহার করিনি। আমি সত্যি আপনাকে মন থেকে..আর একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন না আমায়। আমি তো আপনাকে সব বলতেই চেয়েছিলাম।

উজান উঠে এসে কান্নারত হিয়াকে বুকে আগলে নিলো। আজ সত্যি তার খুব কষ্ট হচ্ছে। জীবনে প্রথম কাউকে এতোটা ভালোবাসার পর সেই মানুষটাই যখন তাকে সত্যি ভালোবাসে কি না এই প্রশ্ন উঠে আসে তখন সত্যি সেটার মতো যন্এনাদায়ক কিচ্ছু হয় না কিচ্ছু না। উজান হিয়ার মাথায় হাত রাখলো,রেখে বললো

– আর কখনো আমাকে কষ্ট দিবেন না তো আপনি?

– এবারো কি দিয়েছি সব তো বলতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তো।

উজান হু বলে হিয়ার চোখের পানি টা মুছিয়ে দিয়ে নিচে আসলো। সবাই উজানের সিদ্ধান্ত শোনার অপেক্ষায় ছিলো। উজান নামাতে সবাই এসে ঘিরে ধরলো তাকে। সবার চোখে কৌতূহল স্পষ্ট! দাদিমণি এসে উজানের কাঁধে হাত রাখলেন,,উজান তার হাতে নিজের হাত রেখে বললেন

– তুমি হিয়ার বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যাও দাদিমণি। আমি সামনের সপ্তাহেই হিয়াকে বিয়ে করতে চাই।

দাদিমণি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তার বিশ্বাস ছিলো হিয়া কখনো এরকম হতেই পারে না। উজান নিবিড়কে ইশারা করে তার সাথে উপরে আসতে বললেন৷ মেহু এসে উজানের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো বিয়ে করবো মানে টা কি? ঔ মেয়েকে শাস্তি না দিয়ে তুমি কি করে ওকে এ বাড়ির বউ বানিয়ে আনতে চাইছো উজান। উজান মেহুর প্রশ্নের কোনো উওর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। বরং উপস্থিত সবাইকে তুচ্ছ করে নিবিড়কে নিয়ে উপরে উঠে গেলো। আর নিবিড়কে দায়িত্ব দিলো হিয়ার বোন থেকে শুরু করে বাড়ির সবার ডিটেইলস নিতে। তার কেনো জানি মনে হচ্ছে বিহান জোর করে হিয়ার বোনকে দিয়ে ওসব বলে নিয়েছে। নিবিড়কে বিদায় দিয়ে হিয়ার রুমে আসতে যাবে কিন্তু তার আগে সেখানে পৌঁছে যায় বিহান। দরজা খোলার শব্দে দূত পায়ে এগিয়ে আসে হিয়া। বিহান রুমে এসেই হিয়ার দিকে আসতে যাবে ওমনি হিয়া দু কদম পিছিয়ে গেলো,

_খবরদার বিহান একদম আমার কাছে আসবে না। তোমাকে দেখলেই এখন ঘেন্না লাগে আমার

-বিশ্বাস করো হিয়া। আমি সেদিন আসতেই চেয়েছিলাম কিন্তু উজান ভাই আমাকে। উজান ভাইকে তুমি চেনো না হিয়া উনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না তাই জন্য তো। আমি আজো তোমাকে খুব ভালো বাসি হিয়া বিলিভ মি

– বিশ্বাস আর তোমাকে। আর একটা কথা উজান ঠিক কি রকম আমাকে তুমি বলতে এসো না বিহান। আর যা-ই হোক সে তোমার মতো পশু না

বিহান হাসলো৷ একটা ডেভিল টাইপ চোখ মুখ করে হিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো।

– ইসস এ কয়দিনে দেখছি ভাইয়ের সব জেনে বসে আছো তুমি। খুব এ বাড়ির উপর টান দেখছি তা নিজের বাড়িতে কি হচ্ছে সেটা খেয়াল রাখো নিশ্চয়ই

বিহানের কথার ইঙ্গিতে একটা ধাক্কা খেলো হিয়া। কি বোঝাতে চাইলো বিহান ওর পরিবারের কথা তুলে।

-কি মিন করতে চাইছো তুমি বিহান?

-তোমার একটা ছোট বোন ছিলো না বুলি। খুব আহ্লাদী একটুতে ইমোশনাল হ’য়ে পড়তো। সে ঠিক আছে তো হিয়া!

-তুমি হঠাৎ আমাদের মাঝে বুলিকে কেনো আনছো বিহান। কি ক্ষতি করেছে তুমি আমার বোনের। আমার বোনের যদি কিচ্ছু হয় আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না বিহান

-যা ভয় পেয়ে গেলাম তো। কতো বোকা তুমি হিয়া। আজো সেই বোকাই আছো। শুনলাম ভাই নাকি কিছু দিনের জন্য ব্যবসার কাজে সিলেট যাচ্ছে তা সে নিরাপদে আবার এ বাড়িতে ফিরবে তো সে হিয়া! বলা তো যায় না মানুষের কখন…

বলেই বিহান চুল গুলো উঁচুতে মেলে দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লো,তার কিছু মুহুর্ত পর উজান রুমের কাছে এসে দেখলো রুমের দরজা খোলা। তাহলে কি দাদিমণি। উজান রুমে আসতেই হিয়ার ভয়ার্ত মুখ দেখে নিজেও অনেকটা ভয় পেয়ে গেলো, দূত পায়ে হিয়ার দিকে এগোতেই হিয়া উজানকে ধরে কিসব বলতে থাকলো।

– বিহান ওসব কি বলে গেলো। আমার বোন টার কি হয়েছে। ও কেনো বললো বুলি বুলি ঠিক নেই। ওহ উজান আমি বাড়ি যাবো। আমার বোনের কাছে যাবো। ফুফু ঠিক আছে তো? কোথায় আজ যে সকালে কথা হলো কেউ তো আমায় কিছু বললো না।

উজান হিয়াকে ধরে তাকে শান্ত করতে চাইলো,

-চুপ কিচ্ছু হয়নি কারোর। সবাই ঠিক আছে। আমি নিজে সবাইকে ফোন করে দেখলাম। ওল ওকে

-না কিচ্ছু ওকে নেই। আমার মন বলছে আমার বোনটা ভালো নেই। বিহান ওকে…

– বিহানকে নিয়ে সমস্যা তো। আমি ওর কাছে গিয়ে বলছি যে..

উজান কিছু বলার আগেই হিয়া উজানের হাত ধরে বললো না আপনি যাবেন না বিহানের কাছে।

– আরে কেনো যাবো না৷ কিচ্ছু হবে না আমার।

হিয়া অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,

-আপনি কেনো বুঝতে চাইছেন না বিহান আপনাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে গেছে। আপনি তারপরো কি করে,,

উজান হাসলো। সে খুব ভালো করে জানে বিহান এরকমই। এর আগেও এরকম হুমকি সে দিয়েছিলো কিন্তু পারে নি। এবারো হিয়াকে ভয় দেখাতে সে। হিয়া উজানকে বুঝিয়ে যাচ্ছিলো তার বিপদ খুব বিপদ। উজান বুঝতে চাইছিলো না কিছুই। বললো সে থাকতে ভয় নেই আর কিছুর। হিয়া শান্ত হতে পারলো না। আপনজন হারানোর ভয় এসে চেপে ধরতে শুরু করলো তাকে।

সেদিন টা কোনোরকমে পাড় করে হিয়া দাদিমণি সহ তার বাড়িতে আসলো। হিয়ার উদ্দেশ্য ছিলো বাড়িতে সবাই ভালো আছে কিনা তার খোঁজ নেওয়া কিন্তু দাদিমণির উদ্দেশ্য ছিলো হিয়ার ফুফুর সাথে কথা বলে হিয়াকে সব আয়োজন করে ঘরে তুলে নেওয়ার সব কথা সেরে ফেলা। যথারীতি হিয়ার বাড়িতে আসলো সবাই। দাদিমণি খুব সৌজন্যেতার সাথে হিয়ার বাড়ির সবার সাথে কথা বললেন। সবাই সুস্থ আছে দেখে হিয়াও কিছুটা স্বস্তি পেলো। কিন্তু হিয়ার এই স্বস্তি বেশিক্ষণ বহাল থাকলো না। তার ছোট বোন বুলি তাকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে এমন কিছু কথা বললো যার জন্য মোটেও তৈরি ছিলো না হিয়া। বুলি অঝোরে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে নিজের অসহায়ত্বের কথা সব খুলে বললো হিয়াকে। বিহানের ফাঁদে পা দিয়ে সে কি মারাত্মক ভুল টাই না করে এসেছিলো এতোদিন। বুলি প্রেগন্যান্ট। তাও আবার বিহানের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে এটা যেনো কিছুতেই হজম হচ্ছিলো না হিয়ার। বুলি তো জানতো যে বিহান হিয়ার সাথে তারপরো সে কি করে। হিয়ার মুখে বুলিকে বলার কোনো ভাষা ছিলো না। একদিকে নিজের বোনের করুন পরিণতি তো অন্য দিকে আপনজনদেরই এরকম প্রতরণা চুপসে ফেললো হিয়াকে। বুলির কথা মতে বিহান তাকে এতোদিন ভোগের পণ্য হিসাবে ব্যবহার করেছিলো কিন্তু যেই জানতে পারলো বুলি প্রেগন্যান্ট তখনি নিজের আসল রুপ দেখাতে শুরু করলো। বুলিকে ফোর্স করলো বাচ্চা টাকে নষ্ট করতে। কিন্তু আর সময় নেই। এটা জানার পর বিহান একদম যোগাযোগ ওফ করে দিলো। শুরু করলো বুলির উপর মানসিক নির্যাতন।

এ মুহুর্তে পাথর হয়ে আছে হিয়া। হিয়া জানতো তার বোনের একটু বেশি রঙীন দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ। তাই বলে কিছু প্রাচুর্যের লোভে সে এরকম জঘন্য কাজ করবে এটা তার কল্পনারো অতীত ছিলো। হিয়ার ফুফু হিয়ার সামনে এসে দু-হাত পেতে অনুরোধ করলো হিয়া কিছু একটা কর। উজানকে বলে যদি! হিয়ার মস্তিস্কের সব নিউরন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। আর যাই হোক তার ফুফু কোনোদিন তাকে তার অনাথ হবার জন্য কোনো কমতি করেন নি। নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন। আজ তাদেরই এরকম করুন অবস্থায় সে হেঁসে খেলে বিয়ে করে নিজের জীবনটা সাজাবে এটা যেনো তার বিবেকে এসে বাঁধছিল। এদিকে বিহানের মতো একটা পশুর সাথেও যে সে বুলিকে কোনো মতে বিয়ে দিতে দিবে না এটাও সে ঠিক করলো।

নিজেকে শান্ত করে এ বাড়িতে ফিরলো হিয়া। এ-ই একদিনেই বাড়িতে বিয়ের অনেকটা আয়োজন শুরু হয়েছে দেখে মনটা মুহুর্তে ভারাক্রান্ত হয়ে আসলো তার। রাতের দিকে স্পর্শকে ঘুম পাড়িয়ে হিয়া উজানের রুমে আসলো। খুলে বললো ঘটনার আদ্যপান্ত সব কিছু। রাগ ক্ষোভ লজ্জা অনুতাপ সব এসে জমা হলো উজানের মাঝে। পারলে এখনি সে বিহানকে খুন করে দিয়ে আসে এরকম। উজান হিয়াকে শান্ত করতে চেয়েও ব্যার্থ হলো। উপরন্তু হিয়ার এক প্রস্তাবে হতবাক হতে হলো তাকে।

– আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি হিয়া। আপনার বোনের সাথে কোনো অন্যায় হবে না। বিহান তাকে স্ব সম্মানে এ বাড়িতে বিয়ে করে নিয়ে আসবে।

-কিন্তু আমি যে চাই না বুলি বিহানের বউ হয়ে এ বাড়িতে আসুক। আচ্ছা আপনি না হয় আজ জোর করে বিহানকে ভয় দেখিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করালেন কিন্তু এরপর। এরপর আমার বোনের সারাজীবনের নিরাপত্তা দিতে পারবেন তো আপনি৷ বিহানের যা চরিএ সে তো বুলিকে ঘরে রেখে বাহিরে অন্য মেয়ের সাথে,

উজান কিছু বলতে পারলো না কারণ বিহান যে এরকমই চরিএের তা সে খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু এ ছাড়া বুলিকে এ মুহুর্তে বাঁচানোর উপায় টাই বা কি!

– আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করবো উজান,রাখবেন। আমি চাই আপনি বুলিকে বিয়ে করুন!

হিয়ার কথা শুনে বিস্ময়ে তাকিয়ে উঠলো উজান। একি কি করতে বলছে হিয়া তাকে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো উজানের। নিজের বোনকে বাঁচাতে হিয়া কি-না তাদের সম্পর্ক টাকেই!

– এ অবস্থায় আমার বোনকে কেউ গ্রহন করবে না কেউ না। শুধু আপনি পারেন তাকে এ-ই বিপদ থেকে বাঁচাতে। আমি জানি আপনার কাছে বুলি সারাজীবন নিরাপদ থাকবে। ওর কোনো অবহেলা আপনি হতে দিবেন না।

উজান রাগান্বিত কন্ঠে এবার গর্জে উঠে হিয়ার দু বাহু এসে শক্ত করে চেপে ধরলো। কাঠ কাঠ কন্ঠে জানালো,

– যা বলেছেন সেটা আর কখনো মুখে আনবেন না। আপনাকে ভালোবেসেছি অন্য কাউকে বিয়ে করবার জন্য না। আর আপনি কি হ্যা আপনার বোন নিজের স্বার্থে আপনাকে দিনের পর দিন ব্যবহার করে যাচ্ছে আর আপনি তারই জন্য

– আমি ছোট থেকে ওদের বাড়িতে মানুষ উজান। ফুফুর এ-ই কষ্ট টা আমি কিছুতেই..

হিয়া আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগে গলা ধরে আসলো তার। কান্নারত হিয়াকে বুকে আগলে নিলো উজান। আশ্বাস দিলো সব ঠিক করে দেবার।

!
!

উজানের আশ্বাসে শান্ত হতে পারলো না হিয়া। তারউপর বিহানের আকার ইঙ্গিতে করে যাওয়া সেই হুমকি সব দিক দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ এসে ঘিরে ধরলো হিয়াকে। সে কিছুতেই বিহানের সাথে তার বোনের বিয়ে দিবে না। আবার উজানকে বিয়ে করলে যদি বিহান উজানের ক্ষতি করে দেয় তখন। এদিকে উজান এই সমস্যার সমাধানো কিছু খুঁজে বের করতে পারছিলো না৷ সে ঠিক করলো সে বিহানকে পুলিশে দিবে এতো বড় ক্রাইমের শাস্তি তার প্রাপ্য। হিয়ার সাহস জুটলো না। সে উজানকে এই কাজটা আপতত রেখে তার বোনের বিষয় টা ভাবতে বললো। এদিকে সময়ো ফুরিয়ে আসতে যাচ্ছে আর কিছু দিন দেড়ি হলেই কথাটা পাঁচ কান হয়ে আসবে। হিয়া উজানকে ফোর্স করতে থাকলো বুলিকে বিয়ে করে নেবার জন্য। বলতে থাকলো আপনি তো সবার সমস্যা কতো সহজে দূর করে দেন তাহলে আমার বোনের এই অবস্থার জন্য যে আপনার ভাই দায়ী তার কি করবেন৷ দু এক কথাতে লেগে যেতে থাকলো দু’জনের। কি করা উচিৎ কিছুই মাথায় আসছিলো না তার। শেষমেশ উজান বাধ্য হলো এটা বলতে যে হ্যা আপনি এটাই চান তো আমি বুলিকে বিয়ে করি তাহলে তাই হোক। শুরু হলো বিয়ের আয়োজন। কোনো জমকালো কিছু না জাস্ট ঘরোয়া আয়োজন। বিহানকে সবকিছু থেকে ত্যাগ করলো উজান। সাথে রাগের বশে বলে দিলো এরপর থেকে ব্যবসায় যার যা প্রাপ্য নিজে পরিশ্রম করে নিয়ে যাবেন৷ অনেক অন্যায় সহ্য করা হয়েছে কিন্তু আর না।

বিয়ের আগের দিন হিয়া স্পর্শকে নিয়ে কাউকে না জানিয়ে শাহরিয়ার কুঞ্জ থেকে বেড়িয়ে আসলো। যদিও এ-ই কথাটা শুধুমাএ দাদিমণি জানতো। হিয়া ঠিক করলো সে এমন কোথাও পারি জমাবে যেখানে তাকে আর স্পর্শকে আর কেউ কখনো খুঁজে পাবে না কেউ না। উজানকে হারানোর কষ্ট চুবিয়ে খাচ্ছিলো তাকে। সে জানে সে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলছে উজানের সাথে। নিজের বোনের সম্মান রক্ষাতে সে অপমান করছে তার প্রতি উজানের ভালোবাসা টাকে। হয়তো এরপর আর কখনো সে উজানের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস মুখ কোনোটাই তার থাকবে না।

!
!

আজ প্রায় পাঁচ মাস পর,

হিয়া এতোদিন যাবৎ ঔ যে চলে গেলো আর পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজনটুকু মনে করলো না। সে তো ভেবে নিয়েছে উজান এখন আর তার নেই। আর উজানের সাথে সে যে অন্যায় করেছে তাতে তার সামনে গিয়ে হাসি মুখে কয়েকটাব কথা বলাও মানায় না তার। স্পর্শকে নিয়ে নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি হয়েছিলো হিয়ার। বেশ ভালোই চলছিলো সবকিছু তবে উজানের জন্য প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়ে কাঁদতে একটুও কার্পণ্য করতো না সে।

আজ এতোদিন বাদে ফুফুর অসুস্থতার কথা শুনে বাড়িতে আসে হিয়া। হিয়ার সাথে বাড়িতে আসে বুলি নিজেও। পাশাপাশি বসে আছে হিয়া আর বুলি। মাতৃত্বের পুরো বৈশিষ্ট্য ভরে আছে তার শরীর জুড়ে হয়তো আর কিছু মাস বাদে ডেলিভারি তার। বুলিকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছু বলতে চাইছে সে হিয়াকে কিন্তু কি যেনো একটা তাকে বাঁধা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে হিয়াকে অবাক করে দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো নিবিড়। হিয়ার চোখে চোখ পড়তেই শুধু সৌজন্যের খাতিরে মুচকি হাসলো সে। তার যে হিয়ার উপর অনেক অভিমান তা তার চোখে স্পষ্ট।

ফুফুমণিকে দেখে বাড়ি ফিরতে তৈরি হচ্ছিলো হিয়া এমন সময় ফুফুমণি বলে উঠলো এসেছিস যখন তখন দুটোদিন থেকে যা না মা। বুলিও তো জামাইয়ের সাথে আসলো দুদিন হচ্ছে তুই যদি থেকে যেতি ভালো লাগতো আমার। হিয়া একটু অবাক হলো জামাইয়ের সাথে এসেছে কিন্তু কোথায়, উজানকে তো সে দেখলো না একবারো বুলির সাথে। হিয়া কৌতূহল মনে ফুফুকে জিজ্ঞেস করলো জামাই কোথায় তোমার। ওনাকে তো দেখলাম না একবারো। ফুফু অবাক হয়ে গেলেন বললেন, দেখলি না মানে একটু আগেই তো তোর সাথে কথা বলে গেলো, হিয়া হতবাক হয়ে জানতে চাইলো কোথায় উজান এসে কথা বললো আমার সাথে, কি দেখতে কি দেখেছো তুমি শুধু শুধু। ফুফু অবাক কন্ঠে বললেন উজান কেনো আসতে যাবে। বুলিকে তো নিবিড় বিয়ে করেছে উজান এখানে কোথায় থেকে আসলো!!!!

থমকে গেলো হিয়া। নিবিড় বুলিকে বিয়ে করেছে মানে। কিন্তু বিয়ের আগের দিন তো। হিয়া ছুটে এসে বুলিকে বললো এসবের মানে কি। বুলি হিয়াকে সেদিনের সব কথা খুলে বললো। তাকে যে উজান না বরং উজানের কথা রাখতে নিবিড় বিয়ে করেছিলো কথা টা শুনেই হিয়ার সাড়া শরীর কেপে উঠলো। সারা শরীরের রক্ত জমে গিয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো তার। হিয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জানতে চাইলো তাহলে এ-ই কথাটা আমাকে জানাসনি কেনো তোরা কেউ এতোদিনে। বুলি বললো উজান ভাইয়ার কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিলো যাতে কোনোভাবে এ-ই কথাটা তোর কানে না পৌঁছানো না হয় উনি৷ তুই তো তাকে একা করে রেখে চলে গিয়েছিলি তাই সে আর চাই নি তোকে কিছু জানাতে দিতে।

পাশে থাকা বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো হিয়া। চারপাশের সবকিছু তাকে চেপে ধরতে শুরু করলো। বুলি বললো বুবু তুই ফিরে যা ওনার কাছে,ভাইয়া হয়তো অনেক অভিমান পুষে রেখেছে কিন্তু সে আজো তোর ফেরার অপেক্ষায় আছে। কবে তুই নিজে থেকে ওনার কাছে ফিরে আসবি। ওনার বিশ্বাস তুই আসবি!

নিজেকে আর নিজের মধ্যে রাখতে পারলো না হিয়া। স্পর্শকে নিয়ে সেই সময়ের গাড়িতে উঠে পৌঁছালো উজানের কাছে। দাদিমণি তখন সোফায় বসে ওনার সেলাই করাতে ব্যস্ত। হিয়াকে আর হিয়ার কোলে তাদের স্পর্শকে দেখে থেমে গেলেন উনি। মুহুর্তে চোখ ভিজে গেলো তার। সাথে অঝোরে কেঁদে দিলো হিয়া নিজেও। হিয়াকে আর স্পর্কে আগলে উনি হিয়া আর স্পর্শকে চুমু এঁকে দিলেন। গলা ধরে আসলো তার। কান্নারত কন্ঠ আর অভিযোগের সুরে হিয়া বললো

– উনি তোমাদেরকে জানাতে বারণ করেছে আর তোমরাও আমাকে জানালে না, জানো ওনাকে হারানোর কষ্ট টা কতো টা শেষ করে দিয়েছে আমাকে,

– তাহলে চলে কেনো গিয়েছিলি তুই। দায় দায়িত্ব গুলো মেটাতে নিজের ভালোবাসাকে শেষ করে দিতে তোর মনে বাঁধলো না

– কি করবো পারতাম না তো ওনাকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে,তাই চলে গিয়েছিলাম। ওনাকে হারিয়ে কি খুব সুখে ছিলাম৷ এই বাচ্চা টা না থাকলে তখনি আত্মহত্যা করে মরে যেতাম

দাদিমণি রেগে গেলেন,রেগে গিয়ে বললেন

– এসব কি বাজে কথা হ্যা। কেউ তোর থেকে হারিয়ে যায় নি। গিয়ে একটু মান ভাঙ্গিয়ে দে দেখবি আবার আগের মতো হিয়া হিয়া করে আমার কান টাতে ব্যাথা তুলে দিবে

হেঁসে দিলেন দাদিমণি৷ লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো হিয়া। দাদিমণি ইশারায় বললেন ছাঁদে আছে এখন তোমার উনি। হিয়া কিছু বললো না। লজ্জায় ভেঙে গিয়ে স্পর্শকে দাদিমণির কোলে দিয়ে এক দৌড়ে ছাঁদে এসে পৌঁছালো।

গাছ গুলোতে পানি দেবার কাজে মগ্ন ছিলো উজান। উজানের দিকে চোখ পড়তেই বিলম্ব না করেই দৌড়ে এসে উজানকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো হিয়া। হাতে থাকা পানি দেবার পট টা ধপাস করে নিচে গড়িয়ে গেলো উজানের হাত থেকে৷ অঝোরে কেঁদে দিলো হিয়া।

– আমি না হয় কিছু দায় মেটাতে এরকম একটা কাজ করতে বলেছিলাম তাই জন্য আপনি। এটা আপনি ঠিক করেননি উজান। এতোদিন আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখে একদম ঠিক কাজ করেননি আপনি। একটুও না।

উজান বুকের কাছে রাখা হিয়ার হাত গুলোকে জাপ্টে ধরলো। অভিযোগের কন্ঠে বললো,

– আর একটু ভরসা করতে পারলেন না আপনি আমাকে। চলে গেলেন আমাকে রেখে। গেলেন তো গেলেন স্পর্শকে নিয়েও চলে গেলেন। একবারো ভাবলেন না আমার দিক টা।

উজানকে আরো জোরো জাপ্টে নিলো হিয়া।

– কি করতাম আমি পারতাম না তো আপনাকে অন্য মেয়ের সাথে সহ্য করতে তাই জন্য তো। আর বিহান বারবার আমাকে আপনার প্রাণের হুমকি দিচ্ছিলো। ভয়ে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো সে সময়টাতে।

উজান হিয়ার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। হিয়ার দু গালে আলতো হাতে হাত রাখলো তার।

– আপনার মনে হয় বিহান আমার থেকেও ক্ষমতাবান৷ চাইলেই ক্ষতি করে দিতে পারে আমার।

– আমি জানি না। আমার শুধু ভয় হচ্ছিলো যে আমার অজান্তে আমার বোনের এ অবস্থা করতে পারে সে তো আপনাকে..

আবারো কান্নায় ভেঙে গেলো হিয়া। উজান হিয়াকে তার বুকের মাঝে শক্ত করে জাপ্টে নিলো। হিয়ার মাথা টা শক্ত করে চিপে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ।

– তাহলে বোঝেন প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্ট টা কি? আপনি ভাববেন না আমি আপনাকে এতো সহজে ক্ষমা করে দিয়েছি। অনেক শাস্তি পাওনা আছে আপনার। অনেক হিসাব মেটানো বাকি আছে,

– পাঁচ মাস দূরে রেখেও শান্তি মিটেনি আপনার। আরো কি শাস্তি দিতে চান বলুন। সব মাথা পেতে নিবো শুধু দূরে সরিয়ে রাখবেন না দয়া করে।

উজানের হিয়ার কপালে স্নেহের পরশ বুলে দিয়ে বললো না রাখবো না তবে শাস্তি আপনাকে দেবো। বিয়ে করে সারাজীবন শাস্তি দেবো। খুব শাস্তি!

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে