#তুমি আসবে বলে
#পর্ব_৮
#ইভা রহমান
দাদিমণি কে তার হাঁটুর ডক্টর দেখিয়ে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে তখন রাত সাড়ে আটটা।বাড়িতে ঢুকেই স্পর্শকে তার মায়ের কোলে দেখে খুব একটা অবাক না হয়ে বরং খুশি হলো উজান। যাগ সারাদিনে তার মায়ের মুখে হাসি ফুটেছে তাহলে। কিছুক্ষন তার মা, মেহু দাদিমণির সাথে একান্তে একটা মিষ্টি মুহুর্ত কাটিয়ে উজান ফ্রেশ হতে তার রুমে আসলো। ফ্রেশ হয়ে কিছু ব্যাবসায়িক কাগজপএ দেখে নিতে থাকলো উজান। এদিকে রাতে তখন খাবারের সময়ো হয়ে আসলে উজান সব গুছিয়ে ডাইনিং এ এসে তার চেয়ারে বসে যায়। সাথে তার এপাশে লম্বালম্বি বসে যায় তার মা, মেহু দাদিমণি। নিবিড় এসে উজানের পাশে বসলো৷ নিবিড়ের চোয়াল শক্ত। রাগে দুচোখ জলজল করছে তার। একটু আগে হিয়াকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসলো সে। কতোবার সে তার স্যারকে ফোন করলো কিন্তু স্যারের কি একটু সময় হলো না তার ফোন টা রিসিভ করার। উজান নিজের মতো কথা বলে যাচ্ছিলো সবার সাথে। যথারীতি সার্ভেন্ট এসে খাবার দিতেই উজান খেয়াল করলো দাদিমণির পাশে আজ হিয়া নেই। একটু অবাক হলো উজান। সোজা হ’য়ে বসে দাদিমণিকে প্রশ্ন করলো হিয়া কোথায় দাদিমণি?দাদিমণি অবাক চোখে উওর করলো,
-হিয়া কোথায় মানে। আমি তো ভাবলাম স্পর্শকে নিয়ে সে তোর রুমে আছে।
-আমার রুমে আছে মানে। কোথায়,উনি তো আমার রুমে নেই!
-তাহলে আছে হয়তো কোথাও। ছাঁদে গিয়ে দেখ এই রাতেও বসে বাচ্চা টাকে নিয়ে গল্প দিচ্ছে।
-তাই বলে খাবার সময় খেতে আসবেন না উনি। আচ্ছা তোমরা বসো আমি গিয়ে ওনাকে ডেকে আনছি। ইদানীং বড্ড অবাধ্য হয়ে যাচ্ছেন উনি আমার। একটু যদি নিজের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে যত্নবান হোন।
উজান উঠতে যাবে ওমনি নিবিড় বলে উঠে”হিয়া ম্যাম ছাঁদে নেই।খুঁজতে হলে অন্য কোথাও গিয়ে খুঁজেন,এখানে নয়”উজান হতবাক হয়ে গেলো।যেনো মনে হলো নিবিড় কি বলছে তা সে বুঝতে পারেনি।
-অন্য কোথাও গিয়ে খুঁজবো মানে। কোথায় হিয়া?_______আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করছি নিবিড় উওর দেও?
নিবিড় কিছু বলার আগে উজানের মা দূঢ় হয়ে বলতে শুরু করলেন,
-হিয়া আর এ বাড়িতে নেই।
উজান অবাক দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো,
-বাড়িতে নেই মানে?
-বাড়িতে নেই মানে আমি ওকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। দেখ উজান এখন তো আমি এসে গিয়েছি তাই না আর আমি ঠিক করেছি আমি এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবো তাই স্পর্শের জন্য আলাদা করে কাউকে তোকে রাখতে হবে না। আমি পাড়বো তাকে সামলাতে।
উজান ক্ষেপে উঠলো। এরকম একটা কথার জন্য সে মোটেও তৈরি ছিলো না।
-তুমি আমাকে না জানিয়ে কি করে এই সিদ্ধান্ত টা নিতে পারলে। তোমার কি একবারো মনে হয় নি যে কথাটা আমাকে একবার জানানো কতো টা জরুরি। প্রথমদিম এসেই তুমি কি করে,
– কি করে মানে। আমি থাকতে স্পর্শের জন্য কোনো আয়ার প্রয়োজন নেই বলে আমি মনে করি তাই আমি!
-হিয়া স্পর্শের কোনো আয়া না। হিয়া স্পর্শের মা!
কথাটা কাঠ কাঠ কন্ঠে উজান সবাইকে জানিয়ে দিলো।
-হিয়া কোথায় নিবিড়? আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি নিবিড় এ্যান্সর মি ড্যাম ইট।
-চলে গেছে। সে আর কখনো আসবে না বলেছে। ঠিকি আছে তার চলে যাওয়াই ভালো হয়েছে। কি পেলো আপনাদের জন্য এতো করে। এ-ই এতো অপমান। আমি তো ভাবতেও পারছি না আমি আপনাদের মতো মানুষদের বাড়িতে কাজ করে এসেছি এতোদিন। যাদের কাছে মানুষের কর্মের কোনো দাম নেই ছিঃ
– কোথায় রেখে আসছো তুমি হিয়াকে নিবিড়?
-স্টেশনে রেখে দিয়ে আসছি।
-কয়টার ট্রেন?
-দশ-টা দশ। যাগ চলে ম্যাম। তখন দেখবো স্পর্শ বাবাকে কে সামলে রাখে। কে আপনাদের স্পর্শকে সারারাত জেগে সুস্থ করে তুলে।
উজান একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। গাড়ির চাবিটা টেবিল থেকে তুলে রওনা দিলো সোজা স্টেশনের উদ্দেশ্যে।
ঘড়িতে তখন নয়টা চল্লিশ। আর কিছুক্ষণ বাদে ট্রেন ছাড়ার সময়। কিন্তু দেশের ট্রেন যে আধা ঘণ্টা দেড়িতে হলেও ছাড়বে এটা এ দেশের নিয়মই। সবাই প্লাটফর্মে যার যার লাগেজ নিয়ে ট্রেন আসার অপেক্ষায় বসে আছে। কেউ কেউ ফাঁকা চেয়ার পেয়ে গা এলিয়ে শুইয়ে আছে কেউ বা সময় কাটাতে টিপছে ফোন৷ কেউ বা হাঁটাহাটি করছে তার প্রিয় মানুষ টার সাথে। এ-তো ভীড়ের মধ্যে এক কোণে একটা ছোট্ট বসার জায়গায় বসে আছে হিয়া। লাগেজ টা ডান দিকে রেখে মাথা টা সেখানে দিয়ে চুপ হয়ে আছে। এতো কোলাহলের মাঝেও বুকে তার আকাশ সমান শূন্যতা এসে জোড়ো হচ্ছে। একদিকে উজানের মায়ের সেই নোংরা অপবাদ তো আরেকদিকে স্পর্শের চিন্তা চুবিয়ে খাচ্ছে হিয়াকে। উজানের মায়ের কথাটা যাও বা হিয়া ভুলতে চেষ্টা করলো কিন্তু স্পর্শের কথা ভেবেই তার বুক খালি হ’য়ে আসছে। তার অনুপস্থিতিতে দাদিমণি,উজান,নিবিড় এরা পারবে তো তার বাচ্চা টাকে ভালো রাখতে। বের হবার পথে সে যাও বা বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে একটু আদর করতে চাইলো কিন্তু মেহু কিরকম করে তার কোল থেকে বাচ্চা টাকে কেঁড়ে নিয়ে নিলো। বাচ্চা টার সেই চিৎকারো কি মেহুর মন গলাতে পারলো না। চোখের পানি অঝোরে বয়ে পড়ছে হিয়ার। বারবার সেই পানি গুলো মুছে নিয়ে হিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই স্পর্শকে রেখে আসার যন্ত্রণা তার সহ্য হচ্ছে না। আচ্ছা স্পর্শের নিজের মা হলে কি এটা করতে পারতো। হিয়া কি পারতো না সব অপমান সহ্য করে বাচ্চা টার জন্য থেকে যেতে। হিয়া কি স্পর্শের কাছে স্বার্থপর মা হ’য়ে পরিচয় দিয়ে বসলো। এসব আকাশকুসুম চিন্তা ভাবনা এসে ঘিরে ধরতে থাকলো হিয়াকে। বুক ফেটে চিৎকার করে কাঁদতে পেলে হয়তো একটু শান্তি মিটতো তার। ফোন টা বের করে ওয়ালপেপারে রাখা স্পর্শের খালি গায়ের নাদুসনুদুস ছবি টা বের করে দেখতে গিয়ে কান্নার বাঁধ পুরোটাই ভেঙে গেলো হিয়ার। ফোনটা বুকে চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো সে।
-আমার বাচ্চাটার তো খাওয়ার সময় হইছে। কেউ কি আছে ওকে খাওয়ানোর। দাদিমণি কি আসছে। উনি পারবে তো ধর্য্য ধরে তাকে খাওয়াতে। আমার বাচ্চা টা নিশ্চয় এতোক্ষণে আমাকে দেখতে না পেয়ে কাঁদছে। আমি কি যাবো ফিরে তার কাছে। আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে ওরা…
হিয়া স্পর্শের ছবিটা বুকে জড়িয়ে নিজ মনে কথা গুলো বলতে বলতে কান্না করতে থাকে।কিছু সময় বাদে উজান আসে। এতো ভীড়ের মাঝেও তাকে তার হিয়াকে খুঁজে পেতে খুব একটা খাটনি করতে হয় না। হিয়াকে খুঁজে হিয়ার পাশে বসে হিয়ার মাথায় নিজের একটা হাত রাখে উজান। হিয়া চোখ না খুলেই অনুভব করতে পারে এটা ঠিক কার নিশ্বাসের গন্ধ। হিয়া অকপটে জড়িয়ে ধরে উজানকে। ডুকরে কেঁদে উঠে উজানকে গায়ের সর্বশক্তিদিয়ে জাপ্টে ধরে হিয়া,কান্না রত কন্ঠে বলতে থাকে,
-আমার বাচ্চা টার তো খাওয়ার সময় হয়ে গেছে উজান। আপনারা কি খেতে দিয়েছেন ওকে। ওহ তো আমি ছাড়া কারো কাছে খেতে চায় না। দাদিমণি পারবে আমার বাচ্চা টাকে খাওয়াতে। দাদিমণি কে বলে দিন না স্পর্শকে ফো ফোনে কার্টুন চালিয়ে না দিলে সে খায় না। ও উজান বলুন না আমার বাচ্চা টা ঠিক আছে তো!
উজান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো,
-এতো যখন কষ্ট হচ্ছে নিজের বাচ্চার জন্য তাহলে ওকে এভাবে রেখে চলে আসলেন কিসের জন্য আপনি। আপনি জানেন না পরশ তার এই ইয়া মা’কে কতোটা ভালোবাসে।
-এতো অপমান নিয়ে ও বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না উজান। এতোটা মেরুদণ্ডহীন আমি নই।
উজান নিজের বুক থেকে হিয়ার মুখ তুলে হিয়ার দু গালে হাত রাখলো। হিয়ার চোখের পানি গুলো মুছে দিয়ে বললো “আমি জানি আপনি কিরকম। আর কারো না জানলেও চলবে। চলুন এখন বাড়ি ফিরবো আমরা” হিয়া দুহাতে তার চোখ মুছে বললো না সে ফিরবে না। উজান অনেক বার হিয়াকে অনুরোধ করলো,স্পর্শের দোহাই দিয়ে হলেও বললো বাচ্চা টার জন্য ফিরুন একবার। হিয়া শুনলো না। আর যা-ই হোক এ-তো অপমান হয়তো বিহান বিয়ে ভেঙে দিয়েও তার সাথে করে নি।
-আমি আপনার ভোগের বস্তু নই উজান। আপনার মা আমাকে বাজারের মেয়ের সাথে তুলনা করেছে এরপরো আপনি বলছেন ওরকম একটা বাড়িতে ফিরে যেতে।
-আর কি বলেছে মা আপনাকে?
-আমি বলতে পারবো না। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে আমায় ফিরতে হবে।
– আপনি কোত্থাও যাবেন না হিয়া!
-আপনি আমাকে আর দূর্বল করবেন না দয়া করে। আমাকে যেতে দিন এমনিতেও আমার বৈশাখের পরে ইনকোর্স হবার কথা।আমাকে তখন এমনিতেও ঢাকা ফিরতে হতো। হয়তো এজন্যই আজ। আমি আসছি শুধু একটা অনুরোধ করবো আর যা-ই হোক বাচ্চা টাকে আপনি কখনো একা করে দিবেন না৷ ওর জন্য আমার চাইতেও একটা ভালো মা নিয়ে এসে দিবেন। কথা দিন।
– আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিবো না হিয়া।
-জেদ করবেন না আপনি। ভালো থাকবেন।
হিয়া নিজের চোখের পানি টা কোনো রকমে আড়াল করে তার সীটে গিয়ে বসে পড়লো। উজান দেখতেও গেলো না হিয়া ঠিক কোন জায়গায় বসে কিভাবে ফিরছে৷ ট্রেন তার নিজের গন্তব্যে রওনা দিলো। আস্তে-ধীরে ফাঁকা হতে থাকলো প্লাটফর্ম। এটাই হয়তো রাতের শেষ ট্রেন ছিলো তাই সেখানে থাকলো না আর যাএীদের কোনো আনাগোনা। উজান এখনো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে হিয়াকে এখন হাজার জোর করলেও সে ফিরতো না৷ হিয়া যে তার চাইতেও কঠিন, খুব কঠিন! উজানের শরীর রাগে গটগট করে কাঁপছে। রাগ, অভিমান, অভিযোগ সব এসে ভর করছে তার পুরো শরীরে। কপালের রগ থেকে সারা শরীরের রগ বেড়িয়ে তার এ-ই পাহাড় সমান রাগের জানান দিচ্ছে। গাড়ি ড্রাইভ করে উজান বাড়িতে আসলো। সবাই ড্রয়িংরুমে বসে তখন উজানের ফেরারই অপেক্ষা করছিলো। কারো আর খাওয়া হয়ে উঠে নি উজান চলে যাবার পর। ড্রয়িংরুমে এসেই উজান সর্বপ্রথমে আছাড় মারলো সেন্টার টেবিলে সাজিয়ে রাখা বড় কাঁচের ফুলদানি টা। সবাই উঠে দাঁড়ালো। মেহু ভয়ে উজানের মা’র শাড়ির আঁচল চিপে পেছনে দাঁড়ালো। উজানের মা আজ ছেলের এ-ই অগ্নিরুপ দেখে হতবাক হ’য়ে শুধু তাকিয়ে রইলেন৷ নিবিড় হেঁসে দিলো। কটাক্ষ করে বলতে শুরু করলো,
– আসে নি হিয়া ম্যাম তাই না। আমি জানতাম আমি জানতাম উনি আসবেন না। নির্লজ্জ, বেহায়া, বাজারের মেয়ে আরো কি কি বললেন আপনারা। এতোটাও অপমান কি উনি ডিজার্ভ করতো স্যার!
নিবিড়ের কথা গুলো যেনো আরো কাটা গায়ে নুন ছিটিয়ে দিলো। এতো অপমান কি সত্যি হিয়ার প্রাপ্য ছিলো। রাগের পাহাড় টা আরো একটু নড়েচড়ে বসতেই উজান কাচের ঔ সেন্টার টেবিল টাকেই আছড়ে গুড়ো গুড়ো করে রাখলো। শুধু কি তাই হাতের কাছে যা আসলো সব একদম ভেঙে নিজের রাগ টাকে জাহির করতে মরিয়া হয়ে উঠলো। দাদিমণির কথাও আজ উজান শুনতে চাইছে না। উজানকে থামানোর সাধ্য,সাহস কোনোটাই জুটছে না কারো। যা পাচ্ছে সব ত*ছনছ করে রাখছে উজান। পারলে বুঝি বাড়ির প্রত্যেককে সে খু*ন করে দেয় এমন। একজন সার্ভেন্টের কোলে ছিলো স্পর্শ। সার্ভেন্ট টা স্পর্শকে উজানের কাছে নিয়ে আসতেই স্পর্শ কেঁদে উঠলো তার কান্নার সুরে এটা স্পষ্ট মামা আমার ইয়া মা কোথায়। কোথায় রেখে আসছো তুমি আমার ইয়া মা’কে। উজান আর কিছু ভাঙ্গতে গিয়েও ভাঙ্গতে পারলো না। স্পর্শকে দেখে তার শরীরের সব শক্তি ফুরিয়ে আসলো। দাদিমণি স্পর্শকে কোলে নিয়ে চুপ করাতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো আর কোথায়।
– তুমি মুনতাসীর সম্পর্কে কতো টা জানতে মা। একটা মেয়ের সম্পর্কে না জানে…হিয়ার কথা বাদ দেও আমি তো তোমার ছেলে আমি ঠিক কতোদূর যেতে পারি এটা তুমি আন্দাজ করতে পারলে না। আমাকে আর হিয়াকে কাল ওভাবে দেখে তুমি ভেবে নিলে আমরা খারাপ কিছু করছি!
উজানের মা সামনে এসে উজানকে কিছু বলতে যাবে কিন্তু উজান শুনলো না। তার কাছে তার মায়েই এ-ই ব্যবহার বড্ড অচেনা!
– তুই একটা বাহিরের মেয়ের জন্য আমাকে ভুল বুঝে এরকম করবি। এভাবে এভাবে বাড়ির সব কিছু ভেঙে..
-উনি বাহিরের কেউ না মা। উনি স্পর্শের মা।
-একদম বাজে কথা বলবি না। দুদিন কি বাচ্চা টাকে সামলেছে ওমনি মা হ’য়ে গেলো। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে তুই নিজের বোনের সাথে কি করে এরকম একটা আয়া’র তুলনা করছিস ছিঃ
– বাহ! আজকে তোমার কথার শ্রী দেখে সত্যি খুব অবাক হচ্ছি মা। তোমার মনে এতো বিষ কে তৈরি করলো মা,মেহু?……দাদিমণি আমার মনে হয় মোহিনীকে এবার বিয়ে দিয়ে এ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া উচিৎ। আর কতো পুষবে মানুষের বাচ্চাকে। ওনাদেরতো কিছু দায় দায়িত্ব আছে তাই নয় কি!
উজানের কথাটা মেহুর বুকে গিয়ে লাগলো। উজান তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলছে। মেহু কিছু বলার আগে উজানের মা বলে উঠলো।
– বিয়ে দিয়ে মেহু এ বাড়িতেই থাকবে। আমি ঠিক করেছি বৈশাখ টা চলে গেলেই আমি তোর সাথে মোহিনীর বিয়ের আয়োজন করবো।
উজান হাসলো। এ মুহুর্তে তার মায়ের এই কথা গুলো শুনে বড্ড হাসি পাচ্ছে তার।
– আমি তো মেহুকে বিয়ে করবো না মা।
– তাহলে কাকে করবি ঔ আয়া টাকে। দেখ উজান আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি। একটা অশিক্ষিত নির্লজ্জ গেয়ো মেয়ে কিনা হবে তোর বউ তুই ভাব তো!
সাথে সাথে পাশে থাকা অর্ধ ভাঙ্গা ফুলের টব টা আবারো তুলে আছাড় মারে উজান।
– কে অশিক্ষিত কতো টুকু জানো তুমি হিয়া সম্পর্কে। ইংলিশে অনার্সে করছেন উনি আর আনফরচুনেটলি তুমিও ইংলিশেরই টিচার মা। এরপরো তুমি বলবে উনি অশিক্ষিত।
উজানের মা অবাক হ’য়ে গেলো কারণ মেহু তো তাকে বলেছিলো হিয়া পড়াশোনা করে না।বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
-আমাকে যে মেহু বললো মেয়েটা উচ্চ ম্যাধমিকো পাস করে উঠতে পারেনি।
– আর তুমি বিশ্বাসো করে নিলে। তা মেহু আর কি কি বানিয়ে বলা হয়েছে হিয়া সম্পর্কে তোমার_____হিয়া ঢাকা শহরে মানুষ মা চাইলেই আমার চাইতে ভালো কাউকে বেছে নিতে পারেন উনি৷ কি আছে আমার এই পারিবারিক ব্যবসা আর শাহরিয়ার বংশের তকমা তাই তো। আমি তো শুধু এটা ভেবে অবাক হচ্ছি আমার মা হয়ে তুমি কি করে একটা মেয়ের সাথে।
আর কিছু বলতে পারলো না উজান। রাগে গটগট করে নিজের রুমে চলে গেলো। এদিকে দাদিমণি এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেহুর দিকে। তার কাছে এখন সবটা পরিষ্কার!
!
!
ভোরের দিকে হিয়া এসে পৌঁছালো ঢাকায়। নিজের বাড়িতে না গিয়ে উঠলো অর্পার ওখানে। ঘটনার আদ্যপান্ত সব খুলে বললো অর্পাকে। শুনেই রেগে উঠলো অর্পা। আর সব থেকে রাগ এসে জমা হলো উজানের জন্য। হিয়া বললো উনি সেসময় বাড়ি ছিলেন। উনি আমাকে নিতে এসেছিলেন আমি যাই নি। অর্পা বললে বেশ করেছিস আর যেতেও হবে না তোকে। পরের বাচ্চাকে আপন করতে গিয়ে দেখলি তো কি হলো। হিয়া অর্পাকে থামিয়ে দিয়ে বললো আমি একটু একা থাকতে চাই অর্পা। এসব কিছু এখন আর আমার শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। হিয়া অর্পার রুমে গিয়ে শুইয়ে পড়লো। স্পর্শের জন্য মন টা ছিঁড়ে খাচ্ছে তার। এদিকে কাল রাত থেকে উজান,দাদিমণি সবাই হিয়াকে ফোনে হাজারবার চেষ্টা করতে থাকলো কিন্তু হিয়া ফোন রিসিভ করলো না উপরন্ত মাঝরাতে সব নাম্বার ওফ করে রাখলো। না তাকে দূর্বল হলে চালবে না। কিছুতেই না।
কিন্তু হিয়ার এই মনোবল বেশিক্ষণ থাকলো না। গোটা একটা দিন পাড় হ’য়ে আসলো। স্পর্শের জন্য হিয়ার মায়ের মন পাগল হ’য়ে যাচ্ছিলো। আজকে সারাদিন শুধু হিয়া চোখের পানি ফেলেছে৷ ফোনটা নিয়ে বারবার কল করবে বলেও রেখে দিচ্ছে। কোথায় সকালের পর থেকে তো আর কেউ ফোন করলো না তাহলে সবাই কি তাকে ভুলে গেলো এক রাতেই। রাত তখন এগারোটার কাছাকাছি। অর্পার বাড়ির ছাঁদে বসে আছে হিয়া। সেই সন্ধ্যা থেকেই সে ছাঁদে বসে আছে আর স্পর্শ স্পর্শ করে কেঁদেই যাচ্ছে। অর্পা আসলো। এসে হিয়ার কাঁধে হাত রাখতেই হিয়া চিৎকার করে কেঁদে দিয়েই অর্পাকে জড়িয়ে ধরলো।
-আমার খুব কষ্ট হচ্ছে অর্পা। আমাকে এনে দে না আমার বাচ্চা টাকে। আমার কি কোনো অধিকার থাকতে নেই ওর উপর। আমি যে নিজের হাতে ওকে নাড়াচাড়া করেছি____আমি আমি কি ঠিক করেছি জানিস আমি গিয়ে স্পর্শকে চুরি করে নিয়ে আসবো। হু। কেউ জানবে না৷ তারপর আমি আর আমার বাচ্চা অনেকদূরে একটা কোথাও হারিয়ে যাবো। কেউ খুঁজে পাবে না উজানো না। বল এটা ঠিক হবে না।
অর্পা মুচকি হাসলো। বললো তার আর দরকার নেই পাগলি। ওদিকে দেখ। হিয়া অর্পার হাতের ইশারায় গেট বরাবর তাকাতেই দেখতে পেলো উজান দাঁড়িয়ে আছে! আর উজানের কোলে স্পর্শ। হিয়াকে দেখেই স্পর্শ তার মামার কোলে খুশিতে হাত পা ছড়াতে থাকলো। ইয়া মা বলে বলে ডাকতে থাকলো হিয়াকে। হিয়া এদিক ওদিক না তাকিয়েই দৌড়ে এসে স্পর্শকে জাপ্টে ধরে তার কোলে জড়িয়ে নিলো। স্পর্শের পুরো মুখে তার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে মায়ের কোলের সব আদর ঢেলে দিতে থাকলো। স্পর্শো হিয়াকে জাপ্টে নিলো। বাবুনি একে দিলো হিয়ার গালে। হয়তো মায়ের জন্য তারো মনটা ছিঁড়ে আসছিলো।
-ফিরে চলুন হিয়া। আপনাকে ছাড়া আমরা কেউ ভালো নেই।
হিয়া চোখ মুছলো। স্পর্শকে আরো কিছুক্ষণ আদর করে বললো আপনি ফিরে যান উজান। স্পর্শ থাক আমার কাছে। চিন্তা করবেন না আমি আমার বাচ্চা টাকে খুব ভালো রাখবো। উজান অভিযোগের সুরে বললো আর আমার ভালো থাকা টা। হিয়া উওর খুঁজে পেলো না। সে যে কিছুতেই তার ঔ অপমান নিয়ে সে বাড়িতে ফিরবে না। উজান হিয়াকে আস্বস্ত করে বললো আপনি আর একবার আমাকে ভরসা করুন আপনাকে আমি আর হতাশ করবো না। হিয়া রাজি হলো না৷ হিয়া যে কতোটা আত্নমর্যাদা সম্পূর্ণ মেয়ে তা বুঝতে পেরেই উজান তার মা’কে দিয়ে হিয়াকে ফোন করে কথা বলালো। উজানের মায়ের কন্ঠে অনুতপ্তের ছোঁয়া ছিলো। মেহু যে ইচ্ছে করে হিয়ার নামে তার কান ভারি করেছে সেটা বুঝতে পেয়েই উনি লজ্জিত হলেন। অকপটে ক্ষমা চেয়ে নিলেন হিয়ার কাছে। হিয়ার মন একটু শান্ত হলো। উজান হাসলো। এরকম একটা জেদী মেয়েকে নিয়ে তার সারাজীবন পাড় করতে হবে ভেবেই অবাক হলো সে!
!
!
হিয়াকে নিয়ে সেদিনই বাড়িতে ফিরলো উজান। এদিকে উজানের মা’র সাথে মুখোমুখি হতে সংকোচ হচ্ছিলো হিয়ার। হিয়ার সব সংকোচ কাটিয়ে উনি নিজে থেকে হিয়াকে পাশে বসিয়ে কথা শুরু করলেন। মেহু বাড়িতে নেই। উজানের সেই অপমান গুলো সইতে না পেরে সে সেদিনই বাড়ি ছেড়ে ঢাকার চলে এসেছে। বলেছে সামনের মাসে বৈশাখের অনুষ্ঠানে বিহানদের সাথে বাড়িতে আসবে নয়তো না।
দিন গুলো দেখতে দেখতে বৈশাখের আগমন হলো। এ কদিনে মেহুর অনুপস্থিতিতে উজান হিয়া অনেকটা কাছাকাছি চলে আসেছে। সকাল থেকে শুরু হলো বৈশাখের যাবতীয় আয়োজন। দাদিমণি যা বলেছিলো তার চাইতেও দ্বিগুণ আনন্দ বিরাজ করতে থাকলো বাড়িতে। সব আত্মীয় স্বজন কিছুদিন আগে থেকে এসেই জোড়ো হতে থাকলো। ফাঁকা বাড়িটা মুহুর্তে কিরকম ভরা আসরে জমে উঠলো। ছোট ছোট নাতি নাতনিদের বিচরণে পূর্ণতা লাভ করলো পুরো শাহরিয়ার কুঞ্জ। দাদিমণি হিয়ার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই হিয়াকে পছন্দ করলেও কেউ কেউ হিয়াকে নিয়ে দাদিমণির এতো আদিক্ষ্যেতা সহ্য করতে পারছিলেন না। মেহুও এসেছে। কিন্তু তাকে না কেউ গুরত্ব দিয়েছে না সে নিজে কাউকে গুরত্ব দিচ্ছে। বিহান আসে নি এখনো। সবার কথা শুনে যা বোঝা গেলো সে হয়তো কাল পরশু আসবে। কিন্তু সে আসবে। হালখাতায় সব পাওনা মেটানো হবে আর সে তার পাওনা নিতে আসবে না। তা কি হয় নাকি!
চলবে….