তুমি আসবে বলে পর্ব-০৭

0
955

#তুমি আসবে বলে
#পর্ব_৭
#ইভা রহমান

সময় গড়িয়ে হিয়ার এ বাড়িতে আসার আট মাসের কাছাকাছি হয়ে আসলো। এই এতো গুলো মাসে স্পর্শ যেমন নিজের মা’কে হিয়ার মাঝে খুঁজে নিয়েছে হিয়াও তেমনি তার সব কিছু উজার করে স্পর্শকে নিজের বাচ্চার মতোই তার বুকে আগলে রেখেছে। হিয়া আর স্পর্শকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাদের সম্পর্কের কোনো ভিওি নেই। এই সম্পর্ক যেনো রক্তের সম্পর্ক কেও হার মানিয়ে দিবে।

!
!

আজ ভোর রাত থেকেই স্পর্শের শরীর টা হালকা খারাপ করতে শুরু করে। সকালে ৮টার আগেই তার ঘুম ভেঙে গিয়ে হিয়ার কোলে নেতিয়ে পড়ে সে। হিয়া খেয়াল করে স্পর্শের গা গরম। বুকটাও ধরফর করছে যেনো শ্বাস নিতে বাচ্চা টার খুব কষ্ট হচ্ছে। হিয়া সেই ভোর রাত থেকে জাগনা। কোনো মতে মুখটা ব্রাশ করে এ-ই যে স্পর্শকে কোলে নিয়ে সে বসে আছে তো আছে। এদিকে যে তার কাল রাত থেকে ঘুম হয়নি আর সকাল থেকে পেটে কিছু যাই নি এদিকে তার কোনো হুঁশ নেই। উপরন্তু হিয়াকে জাপ্টে ধরে স্পর্শের কান্না যেনো ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে চলছে। হিয়া স্পর্শকে তার বুকে শক্ত করে জাপ্টে ধরে আছে আর দাদিমণি হিয়ার পায়ের কাছে বসে বারবার বলছে হিয়া একটু খেয়ে নে আর কতোক্ষন এভাবে না খেয়ে থাকবি তুই।

-কি হইছে আমার বাচ্চা টার। আর কাঁদে না বাবা। ওলেএ। ইয়া মা আছে তো। ইয়া মা তোমাকে কোলে নিয়ে আছে তো। এ-ই যে। মামা আসবে তারপর আমরা ডাক্তারের কাছে যাবো। তারপর আমার বাচ্চা টা আবার আগের মতো হ’য়ে যাবে। তাই নাআআ।

– হিয়া দেখি দে তো আমার কোলে স্পর্শকে। দিয়ে তুই গিয়ে আগে খেয়ে নে তো যা। উজান শুনলে বড্ড রেগে যাবে। একটু বুঝ

-না দাদিমণি বাচ্চা টা আমার কেনো এরকম করছে সকাল থেকে। আমার যে কিচ্ছু ভালো লাগছে না। উনি কখন আসবে আর। আমি তো শুনেছি তোমাদের মতো এরকম পরিবারে ফ্যামিলি ডক্টর থাকে। ফোন দিলেই চলে আসে। তাহলে সেই ডাক্তার টাকে ফোন দিয়ে নিয়ে আসো না তুমি।

– হ্যা রে মা নিবিড়কে বললাম ফোন করে,সে আনছে তো ডাক্তার টাকে। তুই এতো অস্থির কেনো হচ্ছিস বল দেখি নি। বাচ্চা দের এসময় একটু আধটু জ্বর হয় এরকম। ওটা ব্যাপার না

-না তুমি বুঝতে পারছো না। এটা একটু আধটু জ্বর না। আমি তো বুঝছি আমার বাচ্চা টার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমাকে যে বললাম একটু রসুন সরিষার তেলে গরম করে আনতে৷ কেনো তুমি এতো অবহেলা করছো বলবা। (অভিযোগের কন্ঠে)

– আনছি রে মা আনছি। মনে তো হচ্ছে স্পর্শ তোর নিজেরই বাচ্চা আমাদের কেউ না।

-আমার নিজের বাচ্চাই তো ও বুঝছো তুমি। এখন এরকম করে না থেকে যাও গিয়ে আমার কথা শুনো।

দাদিমণি হিয়ার কথামতো রসুন তেলে গরম করে নিয়ে এসে হিয়াকে দেয়। হিয়া স্পর্শকে সোজা করে আলতো হাতে সেই তেল মালিশ করে দেয় স্পর্শের বুকে। স্পর্শের কান্না একটু থামে। হিয়া চেষ্টা করে শক্ত কিছু না খাক অন্তত এক ফিডার দুধ টা খেলেও তো পেটে থাকবে বাচ্চা টার। অনেক কষ্টে স্পর্শকে অর্ধেক ফিডার খাইয়ে হিয়া তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এখন শুধু উজানের অপেক্ষা কখন আসবে সে আর। হিয়া স্পর্শের মাথার কাছে একদম গা ঘেঁসে শুইয়ে আছে। দাদিমনি হিয়ার পায়ের কাছে হেলান দিয়ে কি জেনো একটা সেলাই করছে। আজ তার মনটা অনেক হালকা লাগছে। তিনি আর উজানের মা তো স্পর্শকে নিয়ে অনেক চিন্তায় ছিলো। যাক স্পর্শের একটা যোগ্য মা জুটেছে কপালে। সেলাই করতে করতে দাদি গল্প জুড়ে দিলো। টেনে নিয়ে আসলো অতীতকে। যা শোনার জন্য মোটেও তৈরি ছিলো না হিয়া, এরকম একটা মুহুর্তে তো নয়ই।

– আগে ছোট বেলায় উজান,বিহান মেহু এদের যখন এরকম জ্বর আসতেো,সর্দি হতো তখন আমিও এরকম করে তেল মালিশ করে দিতাম। সারারাত বাচ্চা গুলোকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম৷ তারপর তো সবাই বড় হয়ে গেলো, যে যার মতো জীবন বেঁচে নিলো। আমাকে, তোদের রাহেলা খালাকে সবাই এখন সৌজন্যের খাতিরে মান্য করে এ-ই যা

-আর উনি?(আনমনে)

-কে উজান! উজান একদম আলাদা। সে তো হয়েছে ঠিক আমার বড় ছেলের মতো৷ যেমনি আদর্শবান ওমনি ভদ্রতার গুনে সম্পূর্ণ। তার কথার আঘাতে কখনো আঘাত করে নি আমাকে। বৈশাখে তো আসবে সবাই তখন তুই নিজেই বুঝতে পারবি উজান কি রকম আর তার সব ভাই বোন গুলো ঠিক কতোটা ভিন্ন।

হিয়ার আজ উজানের পরিবার সম্পর্কে জানার কোনো আগ্রহ নেই। তবুও সে হতাশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-তোমরা সবাই আলাদা কেনো হয়ে গেলে দাদিমণি?

দাদি মনি সেলাই থামিয়ে দিলেন হতাশ সুরে বলতে শুরু করলেন এই বিবাদের আসল কাহিনী।

– ঔ জমিজমা নিয়ে যা হয় প্রতি বাড়িতে। আমার তো তিন ছেলে উজানের বাবা বড় সব থেকে। শমসেদ মারা যাবার পর দুই ছেলেই অনেকদিন এ বাড়িতে থেকে ঢাকা শহরে পাড়ি জমায়। তার বেশ কিছুদিন পর সম্পতি ভাগের কথা উঠলো। উজান নিয়ম করে যার যতোটুকু পাওনা মিটিয়ে দিলো। কিন্তু আমার মেজো ছেলের যে ছেলে বিহান তার স্বাদ মিটলো না। তার পাওয়া জমিজমা গুলো বিক্রি করে করে সে আবার সম্পতিতে ভাগ চেয়ে বসলো। উজান কিছু বললো না তার দাবি দেওয়ার চাইতেও বেশি দিয়ে দিলো। যাতে হোক কারো যেনো কোনো কিছুতে কমতি না থাকে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। আবার কিছু দিন পর বিহানের আরো টাকার প্রয়োজন হলো উজান সেবারো তাকে কিছু বললো না। কিন্তু শেষমেশ যখন সব কিছু সীমার বাহিরে চলে আসতে শুরু করলো উজান আর সহ্য করতে পারলো না। শুরু হলো দু ভাইয়ের রেশারেশি। সাথে চাচাদের সাথে সম্পর্ক গুলোও খারাপ হয়ে আসলো সবাই আলাদা হয়ে গেলাম। তারা চেয়েছিলো আমাকে নিয়ে ঢাকাতে ভীড়তে কিন্তু নিজের স্বামীর খুটি ছেড়ে আর কিছুতেই কোথাও যেতে মন চাইলো না রে মা আমার।

হিয়া উঠে বসলো। বিহান তো তাকে বলেছিলো যদি তাদের বিয়ে টা হয় উজান নাকি তাকে তাদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত করবে কিন্তু দাদিমণি যে বলছে! হিয়া কৌতূহলী মনে জিজ্ঞেস করলো,

-বিহান এতো টাকা পয়সা দিয়ে কি করতো দাদিমণি!

– কি আর করতো আগে তো জুয়ার খুব বাজে নেশা ছিলো বিহানের। জুয়া তে টাকা জিতলে মেয়ে নিয়ে ফূ*র্তি করতো আর হারলে বাড়ির টাকাতে ভাগ বসাতো। উজান অনেক চেষ্টা করেছিলো তার মেজো চাচা কে বলে বিহানকে শুধরে নিতে কিন্তু সে আর শুনলে কারো কথা। তবে এখন অবশ্য ওর এসব নেশা কমেছে কিন্তু টাকার চাহিদা কমে নেই। আজো প্রতি মাসে বিহানের পাশাপাশি ছোট চাচার দুই ছেলেকে উজান ব্যবসা থেকে টাকা পাঠিয়ে দেয়।

হিয়া রেগে গেলো। হাড় ভা*ঙা পরিশ্রম করে উজান। আর সবাই কিনা বিনা পরিশ্রমে এভাবে!

-পরিশ্রম তো করে উনি। নিজের রাতের ঘুম ন*ষ্ট করে তোমাদের পারিবারিক ব্যবসাটাকে টিকিয়ে রাখতে কতো কি না করে। আর টাকা এলে উনি এভাবে,কে বলেছে ওনাকে এতো উদার হতে?

– উজানের সম্পর্কে তোকে যতই বলবো তোতোই কম হবে মা। আসলে সে তার ভাই বোনদের খুব ভালোবাসে। দেখিস না মেহু এতো কিছু করে বের হবার পরো মেহুর জন্য সব করে দেয়। কিসে মেহু ভালো থাকবে কি করলে মেহুর চাহিদা পূরণ হবে সব মিটিয়ে দেয়। তার উপর স্নিগ্ধার মৃত্যুতে উজান অনেক ভেঙে পড়েছিলো। তার আর কোনো ভাই বোনের যাতে এরকম কোনো কষ্ট না হয় তাই সে নিজে পরিশ্রম করে হলেও সবার চাহিদা টা মেটাবার চেষ্টা করে। সে তো হয়েছে একদম আমার বড় ছেলের মতো কারো কষ্ট স*হ্য করতে পারতো না।

!
!
দাদিমণির ডাক আসলো। উনি সেলাই থুইয়ে নিচে নেমে আসলেন। এদিকে হিয়ার কাছে আজ সবটা পরিষ্কার হলো যদিও সে আগেই অনেকটা আন্দাজ করেছিলো কিন্তু আজ তো সব কিছু সে__হিয়ার মনে যেমন ঘে*ন্না আর রাগের পাহাড় জমা হতে থাকলো ওমনি উল্টোদিকে উজানের কথা মনে পড়তেই হিয়ার বুক কেঁপে উঠলো। এ-ই মানুষ টার সাথে প্রতিশোধ নিতে না-কি সে। হিয়া কান্নায় ভেঙে পড়লো কি করে এতো বড় ভূল সে করতে পারলো কি করে। হিয়া কাঁদছে খুব কাঁদছে। সে জানে উজান প্রতর*ণা মি*থ্যে একদম সহ্য করতে পারে না। যদি কখনো তার সত্য সামনে আসে উজান কি মাফ করতে পারবে তাকে। হিয়ার কান্নার মাঝে অর্পার ফোন আসলো। হিয়া কান্নারত কন্ঠে ফোনটা রিসিভ করে বড় করিডোরে এসে কথা বলতে গিয়েই আরো অঝোরে কেঁদে উঠলো,

-তুই কাঁদছিস হিয়া? হেই মেয়ে_হিয়া। কিছু হয়েছে। স্পর্শ ঠিক আছে তো। আরে না কেঁদে বলবি তো কি হয়েছে। হিয়া?

-আমি অনেক বড় ভূল করে ফেলেছি অর্পা অনেক বড়। বিহান আমাকে মিথ্যে বলেছে সব। বিহান বিহান আমাকে কি বলেছিলো মনে আছে তোর যে আমাকে বিয়ে করলে নাকি উজান শাহরিয়ার তাকে তার সব সম্পতি থেকে বঞ্চিত করবে এটা পুরোটাই ভূল। বরং উনি তো বিহানকে তার পাওনার চাইতেও

-হিয়া হিয়া হিয়া। চুপ কর প্লিজজ। আমি তোকে আগেই বলেছিলাম বিহান কে ঠিক আমার সুবিধের মনে হয় না। দেখলি মিললো তো।

-আমি কি করে এতো বড় একটা ভুল করে বসলাম অর্পা কি করে। বিহানের প্রতি আমার অন্ধ বিশ্বাস আমাকে ওনার মতো একটা মানুষের সাথে এভাবে প্রতরণা করতে বাধ্য করেছে। আমি কিভাবে ওনার সামনে!

-আচ্ছা একটু শান্ত। আমাকে একটা কথা বল তো তুই উজান বলে লোকটাকে ভালোবেসে ফেলেছিস তাই না?

– এখন আর সেসব বলে কি লাভ তুই বলতে পারবি। তুই বিশ্বাস করবি কি না অর্পা, তুই তুই জানিস আমি বিহানের সাথে সম্পর্কে ছিলাম ঠিকই কিন্তু বিহানের প্রতি আমি যেই অনুভূতি টা অনুভব করতে পারিননি ওনার জন্য সেই অনুভূতি আমার মনে তৈরি হয়েছে। বিহান আমার হাত টা ধরলেও আমার গা টা কিরকম জানি একটা করতো কিন্তু আমি ওনার কতো কাছাকাছি চলে আসি মাঝেমধ্যে কিন্তু কখনো তার জন্য আমার একটুও খারাপ লাগে না বিশ্বাস কর।

-আমি তো সেই প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম সবটা, তুই প্র*তিশোধ তুলতে গিয়ে লোকটাকে ভালোবেসে ফেলেছিস খুব ভালো।

– উনি আমার সত্যি টা জানলে কখনো আমাকে গ্রহন করবেন না অর্পা। উনি যদি জানতে পারেন আমি ওনার থেকে প্র*তিশোধ নিতে এতো বড় ছ*লনার আশ্রয় নিয়েছি উনি তো আমাকে..

হিয়া আর বলতে পারে না। কান্নায় ভেঙে যায় পুরোপুরি।

-আচ্ছা শোন এটা কোনো ছলনা না৷ আর তুই তো ওনাকে সবটা বলতে চেয়েছিলি উনি শুনতে চায় নি….হ্যালো হিয়া শুনতে পারছিস হ্যালো…হ্যালো হিয়া

অর্পার কোনো কথা হিয়ার কানে পৌঁচ্ছাছে না। সামন থেকে হেঁটে আসা উজানের দিকে চোখ পড়তেই হিয়া থমকে যায়। কি করে এই মানুষটাকে সে এতোদিন খারাপ ভেবে এসেছিলো। হিয়া একটু থেমে এক ছুটে উজানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। দিক বিদিক ভুলে উজানকে দু’হাতে জাপ্টে ধরে। শুরু হয় চোখের পানির বর্ণা। উজান হতবাক হ’য়ে যায়। সাহস করে যেই মেয়ের হাত টা সে কোনোদিন ধরতে পারে নি সেই মেয়ে কি না এখন ঠিক তার বুকে। উজান কাঁপা হাতে ওর এক হাতে রাখে হিয়ার মাথায়।রেখে দিয়ে বলে

– কি হয়েছে হিয়া। আপনি কাঁদছেন কেনো?___কেউ কিছু বলেছে আপনাকে? মেহু কিছু বলে নি তো। হিয়া?

উজানের কন্ঠে হিয়া যেনো আরো আহ্লাদী হয়ে উঠলো। আরো জোরে জাপ্টে নিলো উজানকে। উজানের চওয়া বুকের ঠিক বা পাশে রাখা হিয়ার মাথা। উজানের হৃৎকম্পন আবেগি হিয়াকে আরো কাঁদিয়ে দিচ্ছে। উজানের হাত তখনো হিয়ার মাথায় রাখা। কিছুক্ষণ বাদে হিয়ার হুশ ফিরলো। দূত হাতে উজানকে ছাড়িয়ে হিয়া মুখ ফিরে এপাশে তাকালো।

– না কিছু হয়নি আমার। আমি ঠিক আছি। কিন্তু আমার, আমার বাচ্চা টার খুব কষ্ট হচ্ছে এটা আপনার আসার সময় হলো।

-এজন্য এভাবে কাঁদতে হয়। আমি এসে গিয়েছি তো না-কি আর কিচ্ছু হবে না আপনার বাচ্চার। দেখি আসুন তো।

উজান কান্নারত হিয়ার কান্না থামিয়ে হিয়াকে নিয়ে স্পর্শের কাছে আসে। বাচ্চা টা তো এখন ঘুমোচ্ছে। হিয়া বললো ঔ ডক্টর এসে দেখে গেলে তার না-কি হবে না আপনি শহরের বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তারপর তারা কি বলে,কি পরীক্ষা করতে দেয় দেখুন। উজান হিয়ার হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে বললো আপনি এতো অস্থির হবেন হিয়া, কিচ্ছু হবে না আপনার স্পর্শের কিচ্ছু না। হিয়া শান্ত হতে পারলো না। উপরন্তু স্পর্শের নেতিয়ে পড়া শরীর, কান্নার ধ্বনি তার মনকে আরো কেঁপে তুললো। স্পর্শকে শহরের বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার দেখে পরীক্ষা করে বললেন বাচ্চা টার হালকা নিউমোনিয়া হয়েছে। ভাগ্যিস হেলাফেলা না করে ঠিক সময় নিয়ে এসেছিলেন। নাহলে আর এক দুদিন গেলে সেটা মারাত্মক আকারে পৌঁছে যেতো। স্পর্শকে ডাক্তার কিছু ঔষধ আর চারটে ইনজেকশন দিয়ে বললো প্রত্যেক রাতে একটা করে দিতে চারদিন৷ আর ঔষধ গুলো টানা দশদিন খাবারের সাথে গুলিয়ে যদি সে খেতে না চায়। স্পর্শকে নিয়ে বাড়ি ফেরা হলো। এতো বড় ডাক্তার দেখিয়েও হিয়ার মন শান্ত হতে পারলো না।দাদিমণি আর উজানকে আঁকড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো আমার বাচ্চা টাকে সুস্থ করে দিন আপনারা আমার বাচ্চা টাকে সুস্থ করে দিন। এদিকে স্পর্শ নিজেও হিয়া ছাড়া কিছু বুঝতে চাইছিলো না। আজ দুদিন হলো সে হিয়ার কোল ছাড়া কারো কোলে পাঁচ টা মিনিটের জন্যেও গিয়ে থাকতে চাইছিলো না। কেউ কোলে নিতে আসলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠতো। তার হিয়া মা’র কোল ছাড়া অন্য সবার কোলই তার কাছে অনিরাপদ বলে মনে হচ্ছিলো। এদিকে তো হিয়ার নাওয়াখাওয়া ঘুম সব হারাম হ’য়ে আছে। বা পাশে স্পর্শ কে নিয়ে থাকতে থাকতে বা সাইড টা অবশ হ’য়ে যাচ্ছে তবুও হিয়ার ক্লান্তি নেই। এদিকে হিয়া তো ঔষধজ্যেঠুর সাথে কাজ করতে গিয়ে কতো মানুষকে ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু কিছুতেই এই ছোট্ট ইনজেকশন চারটা সে স্পর্শের শরীরে পুশ করতে পারছিলো না। আবার বাহির থেকে নার্স এনেও সেটা পুশ করতে দিচ্ছিলো না যদি তারা তার বাচ্চা টাকে আঘাত দিয়ে বসে। কাপা কাপা হাতে স্পর্শকে ইনজেকশন দিতে গিয়েই হিয়া নিজেই ডুকরে কেঁদে উঠছিলো। উজান হিয়ার এই পাগলামি তে হাসবে না কাঁদবে না বিরক্ত হবে কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছিলো না। পাঁচ দিনের মাথায় স্পর্শ একটু সুস্থ হয়,একটু হেঁসে উজানের কোলে উঠতে রাজি হয়। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য না। একটু পর পরই তার হিয়া মা’কে দেখার জন্য তার মন কেঁদে ওঠে। দুপুরের দিকে স্পর্শ কে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে হিয়াও চোখ টা বন্ধ করেছিলো। এতোদিন স্পর্শের চিন্তায় মাথার ব্যাথা টা সে বুঝে উঠতে পারে নি। কিন্তু আজ যেনো বড্ড খারাপ লাগছে মাথার এই যন্ত্রণাটা। নিবিড়কে বলে একটা মাথা ব্যাথার ঔষধ আনতে বললো হিয়া। নিবিড় ঔষধ আনতে গিয়ে উজানের সাথে তার দেখা হলো। উজান জানতে চাইলো ঔষধ কিসের জন্য। নিবিড় বললো হিয়া ম্যাডাম আনতে পাঠালো স্যার,ম্যামের নাকি মাথা টা ভীষণ ব্যাথা করছে। উজান বললো ঠিক আছে আমাকে দেও। নিবিড় উজানকে ঔষধ দিয়ে তার কাজে চলে গেলো। উজান ঔষধ নিয়ে রুমে এসে দেখলো হিয়া তার বা হাত টা স্পর্শের মাথার কাছ দিয়ে সোজা করে দিয়ে সেখানে ভর রেখে একদম স্পর্শের গা ঘেঁষে শুইয়ে আছে। উজান হাসলো। না এ-ই মেয়ে তো দেখছি স্পর্শকে কেঁড়েই নিয়ে নিবে। একদম গা ছাড়া করে না। উজান হিয়ার পাশে গিয়ে বসতে হিয়া ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো। উজান পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে মাথা ব্যাথার ঔষধ টা হিয়ার হাতে দিলো। হিয়া সেটা খেয়ে নিতে উজান গ্লাস টা আবার আগের জায়গায় রেখে হিয়ার পাশে এসে বসলো। হিয়া ঘুমন্ত চোখে উজানের কাঁধে তার কপাল ঠেকালো। উজান হিয়াকে রাগানোর জন্য বললো,

-আপনি কি পরশকে আমাদের থেকে কেড়ে নিতে চাইছেন না-কি মুনতাসীর। এরকম করলে তো স্পর্শ আর আমাদের কাউকে চিনতে পারবে না।

উজান হাসলো। হিয়া রেগে যাবার বদলে কেঁদে দিলো। উজান বুঝতে পারলো না হিয়া হঠাৎ কাঁদছে কেনো। উজান কি করবে বুঝতে পারছিলো না। হিয়াকে কি একটু ধরবে। যদি হিয়া কিছু মনে করে।

– দাদিমণি বলে আমি না-কি স্পর্শের দ্বিতীয় মা। কিন্তু মা’রা এরকম হয় না। আমি স্পর্শের ভালো মা হতে পারিনি। আজ আমার জন্য তাকে কতো কষ্ট পেতে হলো। সব সব সব আমার জন্য। আমি পারিনি তাকে ঠিক মতো দেখে রাখতে।

– আরে কি মুশকিল। বাচ্চাদের তো এরকম হবে। কিন্তু আপনি যেভাবে ওর যত্ন নিয়েছেন সবসময় চোখে চোখে রেখেছেন তাই জন্য না ও এতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলো।

-না ওহ সুস্থ হইনি। আপনি আমার স্পর্শকে ঠিক করে দিন। আগের মতো করে দিন। ওহ কেনো আগের মতো হাসছে না৷ কেনো খেলছে না। ডাক্তার কি ওকে ঠিক মতো দেখে নি

-চুপ চুপ। কাম ডাউন কাম ডাউন হিয়া। স্পর্শ আগের চাইতে অনেক বেটার এখন। দেখলেন না আজ নিজে থেকে আমার কোলে আসতে চাইলো। কতোক্ষন খেললো। দেখি আর না। দেখুন আপনি কাঁদছেন ওদিকে স্পর্শ নড়ছে। আপনি চান আপনার জন্য বাচ্চা টার ঘুম নষ্ট হোক।

হিয়া চোখ মুছে মাথা নাড়িয়ে বললো না সে চায় না। উজান হিয়ার চোখের পানি গুলো মুছে দিয়ে একটা বালিশ মেলে হিয়াকে শুইয়ে দিলো। বললো এবার আপনি যদি না ঘুমোন আমি কিন্তু স্পর্শ কে নিয়ে আমার ঘরে চলে যাবো। হিয়া আর অবাধ্য হলো না,সে যে কোনোভাবেই স্পর্শকে গা ছাড়া করবে না। হিয়া স্পর্শের মশারি টা ঠিক করে দিয়ে নিজে শুইয়ে চোখ বন্ধ করলো আর উজানকে বললো এবার যান আপনি গিয়ে দাদিমণিকে পাঠিয়ে দিন। উজান গেলো না বরং দুটো বালিশে হেলান দিয়ে তার দু হাত রাখলো হিয়ার কপালের দু’দিকে। হিয়া অবাক হয়ে চোখ খুলে উজানের দিকে তাকালো,
বিস্মিত কন্ঠে বললো,

-আপনি কি করছেন এসব। প্লিজ এরকম করবেন না। মেহু দেখলে ব্যাপারটা সত্যি খুব খারাপ দেখাবে

-আপনি চুপ করুন৷ কালকেও সারারাত ঘুমোনননি৷ আমি মাথা টিপে দিচ্ছি ভদ্রবাচ্চার মতো একটা ভাত ঘুম দিন।

-না দেখুন এরকম করবেন না। মেহ..

হিয়া আর কথা বাড়াবার আগে উজান চোখ বড় বড় করে তাকালো। হিয়া দমে গেলো। এদিকে মাথাটাও অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে একটু কেউ টিপে দিলে সত্যি ভালো লাগতো। হিয়া চোখ বন্ধ করলো। উজান হিয়ার মাথা টিপে দিতে থাকলো। একটা পর্যায় হিয়া গভীর ঘুমে ডুবে গেলো। এদিকে হিয়ার মাথা টিপে দিতে উজানের চোখ টাও হালকা লেগে আসাতে সেও তার অজান্তে হিয়ার পাশে ঘুমিয়ে গেলো। ঘুমের ঘোরে হিয়া উজানের হাত টা চিপে ধরে উজানের পেট বরাবর তার মুখ টা রাখলো। আর তাদের এই পবিএ মুহুর্ত টাকে অপবিত্র করে তুলতে বিন্দুমাত্র দেড়ি করলো না মেহু।

আজ উজানের মা বাড়িতে আসছে কথাটা মেহু ছাড়া আর কেউ জানতো না। মেহু তো আবার এরি মধ্যে উজানের মায়ের মনে হিয়ার সম্পর্কে যতো বি*ষ আছে সব ঢেলে তি*ক্ততা তৈরি করে দিতে চেষ্টা করেছে। আর সেই তিক্ত*তাকে ঘে*ন্নার রুপান্তর করতে বাড়িতে আসতে না আসতেই মেহু তাকে সোজা নিয়ে আসলো স্পর্শের রুমে। আর নিজের ছেলেকে এভাবে একটা মেয়ের সাথে বিছানায় দেখে ব্যাপারটা কিছুতেই হজম করতে পারলেন না তিনি। মেহু বললো দেখলে তো আন্টি কি বলেছিলাম এ-ই মেয়ের চরিত্রের ঠিক নেই,তোমার উজানকে নিজের সব দিয়ে সে….উজানের মা মেহুকে থামিয়ে দিলো। নিজের ছেলে সম্পর্কে এরকম নোং*রা কিছু তার সহ্য হচ্ছিলো না। মেহু তো তার মনে হিয়া সম্পর্কে যা মিথ্যে বলার সব বলে ঘেন্না জন্মাতে বাধ্য করেছিলো সাথে বাড়িতে এসেই এই দৃশ্য সেটাতে যেনো ঘী ঢেলে আরো আগুন জ্বালিয়ে তুললো।

!
!

পরের দিন, উজানের মা একটা গম্ভীর ভাবে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। তার যে হিয়াকে বেশি একটা পছন্দ হয়নি তা বুঝতে আর বেশি দেড়ি হয়নি দাদিমণির। তিনি ঠিক করলেন আজ উজানের সাথে ডক্টর টা দেখিয়ে নিয়ে এসেই তিনি উজানের মা’র সাথে বসে সবটা পরিষ্কার করে কথা বলে নিবেন। উজান দাদিমণিকে নিয়ে হসপিটালে আসতেই মেহু শুরু করলো তার আসল চাল। উজানের মা’কে কনভিন্স করে সে হিয়াকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হলো। হিয়ার কাছে এটা ছিলো সম্পূর্ণ অনা*কাঙ্ক্ষিত। উজানের মা যে প্রথম দিন এসেই তার সম্পর্কে কিছু না জেনে এতো বাজে মন্তব্য করবেন এটা ছিলো তার কাছে পুরোপুরি অবিশ্বাস্যযোগ। একটা পর্যায় হিয়াও তার সব ধর্য্য টুকু হারিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়লো,

– ঠিক করে কথা বলুন আন্টি। আপনি আমার সম্পর্কে কতোটুকু জানেন। না জেনে এভাবে একটা মেয়েকে আপনারা দুজন মিলে হ্যা*রেজ করছেন। আর উল্টে প্রশ্ন তুলছেন আমার শিক্ষার ব্যাপারে

– দেখো মেয়ে। আমি একজন শিক্ষক মানুষ কার রুচি কিরকম তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি কাল। কি ভাবো, নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে আমার ছেলের মন জুগিয়ে এ বাড়ির বউ হয়ে আসবে। তোমার পরিচয় কিন্তু একটা আয়া’র কথা টা মাথায় রেখো।

-বলতে বাধ্য হচ্ছি আন্টি আপনি শিক্ষিকা হতে পারেন ঠিকই কিন্তু আসল শিক্ষা টাই আপনি অর্জন করতে পারেন নি। আয়া’রা কি মানুষ হয় না। তারা সেবা করেই বলে আপনারা সুস্থ হোন। আমার তো এটাই ভেবে অবাক লাগছে আপনার মতো একটা মায়ের ছেলে নাকি উনি।

-বড্ড সাহস তোমার। অনেক হয়েছে তুমি এ-ই মুহুর্তে এই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে ব্যাছ। তোমার মতো একটা নি*র্লজ্জ বে*হায়া যে নিজের ই*জ্জতের ঠিক করে মান রাখতে পারে না তার কোনো জায়গা নেই এই শাহরিয়ার কুঞ্জে।

– এতো অপমান নিয়ে আমি এ বাড়িতে আর থাকতেও চাই না আন্টি। (একটু থেমে গিয়ে)বাচ্চা টা অসুস্থ তাকে একটু দেখে রাখবেন।

হিয়ার গলা ধরে আসলো। একদিকে এই অপমান তো অন্য দিকে স্পর্শের মলিন মুখ হিয়াকে একবারে চেপে ধরলো। স্পর্শকে রেখে চলে আসতে বুক ছিঁড়ে যাচ্ছিলো হিয়ার। কিন্তু সে নিজেকে বুঝিয়ে নিলো স্পর্শের উপর তার কোনো অধিকার থাকতে নেই কোনো না। হিয়া নিজের মনে পাথর চাপা দিয়ে তার সব কিছু গুছিয়ে বেড়িয়ে আসলো। নিবিড় সাহেব কে ডেকে বললো তাকে স্টেশনে রেখে আসতে।

-না ম্যাম আপনি উজান স্যারের মায়ের কথা গুলো শুনে এভাবে চলে যেতে পারেন না। আপনি বিশ্বাস করুন বড় ম্যাডাম এরকম না। উনি কখনো কাউকে এভাবে আঘাত করেননি। আমি সিউর যে মেহু ওনাকে আপনার সম্পর্কে

-নিবিড় প্লিজ আমি এ বিষয়ে আর একটা কথা বাড়াতে চাই না।আর আমি আপনাকে এর আগেও বলেছি আমাকে এভাবে ম্যাম বলে ডাকবেন না। আমি এ বাড়ির কেউ হই না। একটু বুঝুন।

– সে বুঝলাম। কিন্তু আপনি এখন এভাবে চলে যাবেন না প্লিজ। স্যার যদি এসে আপনাকে না দেখতে পারে বাড়িতে কিন্তু একটা তুলকালাম বেঁধে যাবে। স্যার রেগে গেলে কিন্তু অন্যরকম রুপ ধারণ করে আপনি হয়তো সেটা জানেন না।

-সেটা আপনাদের পারিবারিক সমস্যা নিবিড়। আমার এখানে কিছু করার নেই। স্পর্শের জন্য আমার কতো টা কষ্ট হচ্ছে আমি আপনাকে সেটা ভাষায় বলতে পারবো না। আমার বাচ্চা টাকে একটু দেখে রাখবেন। কিন্তু এতো কিছু অপ*মান সহ্য করে এ বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। ক্ষমা করবেন।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে