#তুমি আসবে বলে
#পর্ব_৬
#ইভা রহমান
প্যাকেট টা হাতে নিয়ে হিয়া থ হয়ে গেলো। এই লোকটা তো তার সামনেই বসে ছিলো তাহলে এটা রাখলো কখন তার বালিশের তলে এভাবে। ধুর ওসব পড়ে ভাবা যাবে কি আছে আগে তাই দেখে নেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ প্যাকেট টা খুলতেই হতবাক হ’য়ে গেলো হিয়া। পায়েল! আরে এটা তো সেই পায়েল যেটা সেদিন দাদিমণির সাথে বাজারে গিয়ে পছন্দ হয়েছিলো তার। কিন্তু হাতে টাকা না থাকাতে মুখ ফুটে বলতে পারে নি সে। স্পর্শ তখন উজানের কোলে ছিলো কিন্তু উজান কি করে আর কখন’ই বা! হিয়ার অজান্তেই হিয়া খুশি হয়ে লাফিয়ে উঠলো। ঝটপট পায়ে পায়েল টা দিয়েই দাদিমণিকে গিয়ে বলতে থাকলো দাদিমণি দেখো কেমন মানিয়েছে পায়েল টা পায়ে আমার!
!
!
নির্ঘুম এক রাত কাটিয়ে ফেললো হিয়া। না এই কৌতূহল মনের জানার আগ্রহ টা যেনো আজ ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলছে। কোথায় নিয়ে যেতে পারে উজান তাকে। ভোরে হাঁটতে বের হতে চাইলে নিশ্চয়ই উজান এতো আবেদনময়ী কন্ঠে তাকে অনুরোধ করতো না। সারারাত আর ঘুম আসে না হিয়ার। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে কখন যে রাত ফুরিয়ে ভোরের আগমন ঘটতে থাকে তা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয় হিয়াকে। হিয়া উঠে গিয়ে ওর ব্যাগ থেকে কি পড়ে বের হবে তাই খুঁজতে থাকে। কিছুই যেনো তার মনে ধরছে না৷ উপরন্ত আজ তার নিজেকে আবেদনময়ী সাজে উজানের কাছে মেলে ধরতে ইচ্ছে করছে। যদিও হিয়া জানে এটা ঠিক না৷ অর্পার কাছ থেকে চেয়ে আনা নীল শাড়িটা এ-ই নিয়ে তিনবার বের করেও কি মনে করে হিয়া রেখে দিলো। না মনকে আশকারা দিলে যে চলবে না। কিন্তু মন টাও আজ বড্ড বেহায়াপনা করছে। ঠিক একটা সময় হিয়াকে রাজি করিয়ে নিলো শাড়িতে নিজেকে মুড়ে নিতে। নীল শাড়ি হাত ভর্তি নীল চুড়ি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই লজ্জায় নিজের চোখ থেকেই চোখ নামিয়ে নিলো হিয়া৷ না আর সাজগোছ কিচ্ছু করা যাবে না কিচ্ছু না মানে কিচ্ছু না। স্পর্শকে ঘুমের মধ্যে আরো এক ফিডারের অর্ধেক খাবার খাইয়ে হিয়া তাকে আবারো ঘুম পাড়িয়ে দিলো। দাদিমণিকে আবারো ডেকে বললো আমি আসছি তুমি একটু দেখে রেখো আমার বাচ্চা টাকে। দাদিমণি হাসলেন সাথে হিয়াকে দিয়ে প্রমিসো করিয়ে নিলেন তার নাতি আর সে মিলে কি কি করলো তার পুরোটা এসে তাকে শোনাতে। হিয়া হাসলো। লজ্জারত মুখে নিচে নামলো। নেমে এসে খুব সাবধানে সদর দরজা পেড়িয়ে উজানের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো হিয়া। আপাতত আকাশে আলো অন্ধকার নিজেদের মধ্যে কম্পিটিশনে নেমেছে কে থাকবে আর কে মিলিয়ে যাবে। হিয়াকে দেওয়া সময় অনুযায়ী উজান নিজেও তৈরি হয়ে নিচে নামলো। হিয়ার সামনে এসে দাঁড়াতেই খেয়াল করলো হিয়ার পড়নে শাড়ি। আবছা আলো আবছা অন্ধকারের মিশেল থাকায় উজান ঠিক বুঝতে পারছিলো না শাড়িটার রঙ টা ঠিক কি রকম। কৌতূহল চাহনি মেটাতে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি রঙের শাড়ি পড়েছেন হিয়া,নীল? হিয়া নিজের দিকে তাকালো। হঠাৎ সে কি রঙের শাড়ি পড়েছে এটা কেনো জানতে চাইলো উজান। হিয়া বললো হু নীল,কেনো? উজান উওর দিলো না। এপাশের দরজা টা খুলে দিয়ে হিয়াকে সামনের সীটে বসিয়ে দিলো আর বললো আপনি একটু বসুন আমি উপর থেকে আসছি। হিয়া কথা বাড়ালো না। চুপচাপ গাড়ির মধ্যে বসে রইলো। গাড়িতে এসি ওন করা কিন্তু এসির এই ঠান্ডা হাওয়া টা হিয়ার গায়ে সইছিলো না। ভোরের এমনিতেই একটা ঠান্ডা শিহরণ থাকে তার সাথে এই কৃত্রিম এসি বড্ড বেমানান। পাঁচ মিনিট বাদে উজান আসলো। ড্রাইভিং সীটের দরজা খুলে সীটে বসতেই হিয়া উজানের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলো। ওহ তাহলে এ-ই জন্যেই শাহরিয়ার সাহেব উপরে গিয়েছিলেন। হিয়াকে নীল শাড়ি তে দেখে নিজেকে তার বড্ড হিমু সাজতে মন চেয়েছিলো তাই আর কিচ্ছু চিন্তা না করে উজান তার ঘিড়ে রঙের শার্ট টা পাল্টে হলুদ পাঞ্জাবি টা ঝটপট পড়ে নিচে নামলো। গাড়ি চলতে থাকলো গন্তব্যে। দু’জনে আপাতত চুপচাপ আছে। হিয়ার পাশের জানালা টা বেশি অর্ধেক খুলে রাখা৷ সেই খুলে রাখা জানালা দিয়ে হিমেল বাতাস এসে পরতে পরতে রাঙিয়ে দিচ্ছে হিয়াকে। দু হাতে হিয়া মুড়ে নিলো নিজেকে। হিয়াকে ঠান্ডায় জর্জরিত দেখে উজান নিজে থেকেই গাড়ির এসি টা বন্ধ করে দিলো। হিয়া একটু উষ্ণতা অনুভব করলো। এদিকে প্রতিযোগীতায় নামা আলো আর অন্ধকারের মধ্যে আলো বিজয়ী লাভ করলো। অন্ধকারকে ঢেকে দিয়ে আস্তে আস্তে পুরো আকাশ জুড়ে তার তেজ দেখাতে শুরু করলো। হিয়া সীটে মাথা এলিয়ে দিয়েই উজানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কথার ফোড়ন কাটতে শুরু করলো;
-তাহলে ব্যবসার ফাঁকে গল্প উপন্যাসও পড়া হয় দেখছি।
– কেনো,সাহিত্য কি শুধু আপনি পড়তে পারেন আমি বোধহয় মানুষ না। আমার বুঝি অনুভূতি থাকতে নেই।
– তা তো বলি নি আমি৷ তবে আপনার মতো কঠিন একটা মানুষ যে বইয়ের মোলাটে নিজেকেও মোড়াতে পারে এটা জানা ছিলো না।
-আমি কি সত্যি খুব কঠিন,হিয়া! (অস্ফুটে)
– লোকে তো তাই বলে,
-আপনি কি বলেন?
– কঠিন প্রশ্ন করে ফেললেন! যদি বলতেই হয় তাহলে আমার কাছে আপনি ঠিক নারকোলের মতো। বাহির টা শক্তপোক্ত ভেতর টা একদম নরম!
হিয়ার কথায় উজান একটা প্রশান্তি অনুভব করলো। যাগ দাদিমণির পরে তাহলে কেউ তো আছে যে তার ভেতর টা ঠিক চিনতে পেরেছে!উজান হেঁসে দিয়েই হিয়াকে বললো,
-ধন্যবাদ! তা হিমু হিসাবে আমাকে কি রকম লাগলো বললেন না তো?
হিয়া মুচকি হাসলো। হেঁসে দিয়েই বললো,
_ দুঃখিত হিমু আমার পছন্দের চরিত্র না!
উজান হালকা ভীষম খেলো। গাড়িটা আলতো করে ব্রেক দিয়ে আবার চালাতে শুরু করলো। হিয়ার হিমু হতে তার এই হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে আসা আর সেই হিয়ারই নাকি হিমুকে পছন্দ না। হতাশ কন্ঠে উজান বলে উঠলো,
-তাহলে আপনার কাকে পছন্দ মিস?
-শুভ্রকে!
উজান বিস্মিত কন্ঠে বললো শুভ্রকে! উজানের এই বাংলার পাঁচের মতো মুখ দেখে হিয়া হাসলো শুধু। ভীষণ মায়া হলো তার উজানের মুখটার দিকে চেয়ে।কি একটা ভেবে নিয়ে উজান বললো,
-দেখুন মিস মুনতাসীর আমার হয়তো চুল গুলো শুভ্রর মতো কোঁকড়ানো নয় তবে বেশি স্লিকিও নয় কিন্তু, ধরে দেখতে পারেন। ঠোঁট গুলো দেখুন অনেকটা শুভ্রের সাথে মিল খুঁজে পাবেন৷ সাথে আমার শরীরের রঙ টাও কিন্তু ধবধবে সাদা এ-ই দেখুন। আর হ্যা আমি হয়তো শুভ্রের মতো হাই পাওয়ারের চশমা পড়ি না কিন্তু আমার একটা রিডিং চশমা আছে। যখন হিসাব নিকাশ দেখতে বসি তখন পড়ি। এখন কেউ যদি সত্যি শুভ্রকে চায় তাহলে আমি আমার চোখের পাওয়ার টাকে বাড়িয়ে রেগুলার চশমা ইউস করতে পারি সেটা ব্যাপার না!
উজানের কথায় হিয়া কিছুক্ষণ থ হয়ে জমে গেলো। লোকটা কি সত্যি পাগল নাকি। হিমু হতে না পেরে শুভ্র হবার জন্য তার কতোই না জলপনা৷ কিছু মুহুর্ত থেমে পরমুহূর্তেই হিয়া খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। হিয়ার জোড়ালো কন্ঠের খিলখিল হাসি ভোরের প্রকৃতিতে বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে উজানের কানে এসে পৌঁছাতে শুরু করলো। উজান লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। না মেয়েটা তো তাকে অর্ধেক পাগল বানিয়ে দিয়েছে এবার তার এ-ই জোড়ালো হাসিতে না সে খু*ন হ’য়ে যায়। হিয়া নিজের হাসি থামাতে পাড়লো না। উজানের শুভ্র হবার প্রচেষ্টা তার সাড়া অঙ্গ জুড়ে হাসি ছড়িয়ে দিলো। শেষমেশ উজান বাধ্য হ’য়েই বললো আপনি কি থামবেন মিস!
!
!
গাড়ি এসে গন্তব্যে থামলো। জানালার থাই খুলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে ইশারা করলো উজান৷ লোকটা উজানকে দেখে সালাম দিলো। জ্বী স্যার বলে লোহার বড় গেইট টা মেলে দিতেই উজান তার গাড়ি নিয়ে অনেক ভেতরে গিয়ে গাড়িটা থামালো। জায়গাটা ছিলো শহরের সার্কিট হাউস। সার্কিট হাউস টা যেমনি বিশাল তেমনি সু পরিকল্পিত ভবনে মোড়া। সেই সুবিশাল সার্কিট হাউজের একদম পেছনে বৃহৎকার বনাঞ্চলের মতো জায়গা। যার পুরোটা জুড়ে বিরাজ করছে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি। একটু দূরে দেখা মিলছে পর পর বেড়ে ওঠা সাত টা মোটা তাজা কৃষ্ণচূড়া গাছের সাড়ি!
গাড়িটা থামিয়ে উজান আগে নিচে নামলো। এপাশের দরজা লক করে হিয়ার দিকে এসে দরজা খুলে হিয়াকে বের হতে বললো। হিয়া বের হয়ে নামতে উজান গাড়ি লক করেই হিয়াকে নিয়ে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ গুলোর মাঝে এসে দাঁড়ালো।
সবুজ রঙের প্রতিটি পাতার গোড়ায় আগুন হয়ে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া। রক্তিম আবরণে নিজেকে রাঙিয়ে দিয়ে জানান দিচ্ছে তার লাল রঙা সমাহারের। শুধুকি উপরের দিকে কৃষ্ণচূড়া তার আল আভা ছড়াচ্ছে তা কিন্তু নয় একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে মাটিতে এক লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়ে হিয়াকে সে তার বন্দনা উপহার দিয়ে স্বাগতম জানাচ্ছে। হিয়া স্তব্ধ। কৃষ্ণচড়ার এই রঙ রুপ গন্ধে মন্ত্রমুগ্ধ। এ কেমন সৌন্দর্যে ভাসিয়ে দিতে নিয়ে আসলো উজান তাকে!…….হিয়া উজানকে রেখে সামনে হেঁটে দাঁড়িয়ে গেলো। আকাশপানে চেয়ে চোখ বন্ধ করলো। একটা কাক ভোরের দমকা বাতাস এসে হিয়াকে ছুঁইয়ে দেবার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ভর্তি ডাল গুলোকে নাড়িয়ে দিলো। মুহুর্তে টপ টপ টপ বৃষ্টির মতো লাল ফুল গুলো ঝড়ে পড়লো হিয়ার সাড়া শরীর জুড়ে। উজান হিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালো। হিয়ার সাথে সেও আকাশ পানে তাকিয়ে কৃষ্ণচূড়া পড়ার অপেক্ষায় রইলো। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া ফুলের তাকে বোধহয় একদমই পছন্দ হয়নি। তাই তো বাতাস থেমে গিয়ে যাও একটা টুপ করে ঝড়ে গেলো সেটা উজানকে পাওা না দিয়ে হিয়ার মুখে এসে আঁটকে গেলো। উজান মুখ নামিয়ে,ঘাড় ঘুড়িয়ে হিয়ার দিকে তাকিয়ে ভূকূঁচকে নিলো। এটা কোনো কথা। এই লাল আভাতে হিয়াকে নিয়ে আসলো কে? সে! তাহলে কৃষ্ণচড়ার এই দল বদলানোর কারণ….উপরের দিকে তাকিয়ে উজান মাথা নাড়ালো যার মানে কাজ টা তুমি মোটেও ঠিক করলে না কৃষ্ণচূড়া। টোটালি আনফেয়ার! মুখ নামিয়ে হিয়ার দিকে তাকালো উজান। চোখ আঁটকে গেলো তার। হিয়া এখনো কৃষ্ণচূড়ার স্বাদ নিতে চোখ বন্ধ করে আছে। ভোরের আলো অনেকটা ফুটে গেছে সেই মলিন আলো এসে পড়ছে হিয়ার মুখে। রক্তিম পরিবেশে আরো স্নিগ্ধ করছে হিয়ার মুখ। হিমেল বাতাসে খুলে রাখা কিছু চুল এসে হিয়ার নাকে আঁটকে গেলো। যার শিহরণ মুহুর্তে গিয়ে লাগলো উজানের বুকে। মেহু সেদিন হিয়ার সামনের এই চুল গুলো কেটে দিয়ে ভালোই করেছিলো এতো গুলো সময়েও যেনো সেগুলো বড় হতে না পেরে জড়ো হলো হিয়ার মুখে।
না তার মনের এই রুপবতীর রুমে নিজেকে আর বেশিক্ষণ ভাসিয়ে দিলে উজানের পুরুষ সত্বা বিপাকে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। উজান আর তাই নিজের মনকে আশাকারা না দিয়ে হাত বাকিয়ে হিয়ার মুখে লেগে থাকা কৃষ্ণচূড়া টা আলতো করে তুলে নিতেই হিয়ার ঘোর কাটলো। চোখ মেলে তাকালো হিয়া। বড্ড বিরক্ত সে। কেনো এ-ই বসন্ত বন্দনা উজান তাকে সর্বাঙ্গে গ্রহন করতে দিলো না,আজব!
হিয়ার চোখের ভাষা পড়তে পেয়ে উজান বললো আর কতোক্ষন এভাবে থাকবেন চলুন সামনে হাঁটি। হিয়া হাঁটার উদ্দেশ্য পা বাড়াতে উজান তাকে থামিয়ে দিলো। একটা গাছের গোঁড়ায় নিজের পায়ের চামড়ার ফ্লাট জুতো গুলো খুলে রেখে দিলো। হিয়াকে চোখের ইশারায় বললো তার পায়ের জুতোটাও খুলতে। হিয়াও সহমত পোষণ করে জুতো টা খুলে উজানের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো।
দু’জনে এই অবলীল সৌন্দর্য উপভোগ করতে খালি পায়ে পাশাপাশি হাঁটছে। উজানের খুব ইচ্ছে হচ্ছে হিয়ার হাতটা যদি একটা বার সে ধরে হাঁটতে পারতো। কিন্তু থাক। হিয়ার অনুমতি ব্যতীত তার এ মুহুর্তে কিচ্ছু করার ইচ্ছে জাগলো না। একটু হাঁটতে হাঁটতে হিয়া পা উঁচু করে লাফ দিলো। পায়ের তলে লাল ফুল গুলোকে পিষে দিতে বেশ মজাই লাগছিলো তার। হিয়া একটু হাঁটছে একটু লাফাচ্ছে বেশ মজা লাগছে তার। মনে হচ্ছে একটু হাত ছড়িয়ে নাচ করতে পারলে মনের আনন্দ টা জাহির হতো ভালো মতো।এদিকে উজান প্রাণবন্ত হিয়ার এই চাঞ্চল্যের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছে পুরোটা। হারিয়ে যাচ্ছে হিয়ার নারীত্বের মাধুর্যে।…….এদিকে আরেকবার লাফাতে গিয়ে ফুলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইটে পা লেগে হিয়ার পা টা পিছলে যায়। খুব ব্যাথা লাগে হিয়ার। আহ বলে উঠতেই উজান দৌড়ে এসে হিয়ার দু বাহু ধরে হিয়াকে সামলে নেয়। সর্তকভাবে হিয়াকে নিয়ে বসিয়ে দেয় পাশে এক বসার জায়গায়। অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করে আপনি ঠিক আছেন তো হিয়া? হিয়া উওরে বলে তার পায়ে কি যেনো একটা বিঁধে ছিলো। উজান নিচে এক হাটু গেড়ে বসে হিয়ার সেই পা টা নিজের হাঁটুতে তুলে নিতেই হিয়া সংকোচে কি বলবে বুঝতে পারলো না। উজান হিয়ার পা টা বাকিয়ে নিয়ে দেখতে থাকে সব ঠিক আছে কি না। দেখলো না সব ঠিক আছে। পা পরিষ্কার শুধু মাটি লেগে আছে হালকা। উজান হিয়ার পা টা বুলে দিয়ে উঠতে যাবে ওমনি খেয়াল করলো শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা পায়েলের দিকে। যাগ হিয়া পড়েছে তাহলে তার দেওয়া উপহার। উজান হিয়ার শাড়িটা একটু উঁচু করে তুললো। মুহুর্তে কেঁপে উঠলো হিয়া। ফর্সা পা দুটোতে লাল সবুজ স্টোনের পায়েল টা সত্যি অনেক আকর্ষনীয় লাগছে। উজান মুচকি হাসলো উঠে এসে হিয়ার পাশে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করে উজানই কথা শুরু করলো।
– আমরা বাঙালিরা শুধু বাহিরের দুনিয়ার চেরি ফুলে মগ্ন হয়ে থাকি এদিকে আমাদের দেশেও যে এতো সুন্দর কৃষ্ণচূড়া রাজ করে তা আমরা দেখেও বুঝতে পারি না।
-হুম আজ আপনি আমার ভুল ভেঙে দিলেন। ধন্যবাদ।
উজান মুচকি হাসলো কিছু বললো না।
-আচ্ছা এটা তো সার্কিট হাউস তাই না। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া আপনাকে এভাবে এলাও করলো কি করে?
-আপনি হয়তো এখনো শাহরিয়ার বংশের পাওয়ার টা ঠিক বুঝতে পারেন নি মিস মুনতাসীর।
হিয়া ভেংচি কাটলো।কেটে উওর দিলো,
-বুঝতে পাবারো কোনো প্রয়োজন নেই। বংশ দিয়ে কি হবে কর্মই যদি হয় না মনুষ্যত্বের,তখন!
-আপনার কি মনে হয় আমি অমানবিক কাজে যুক্ত!
-না মিস্টার শাহরিয়ার আপনি তো দয়ার ভান্ডার।
-ব্যঙ্গ করলেন তো____আচ্ছা বাদ দিন জানেন আমি দেখেছি আমাদের দেশে মেয়েদের অনার্স লেভেলে পড়তেই বিয়ে দিয়ে দেয় আপনারো নিশ্চয় বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।
-আপনি আসলে ঠিক কি বলতে চাইছেন খুলে বলুন তো?
– না মাস্টার্স তো শেষ করেছি অনেকদিন হলো। বিয়ে করবার বয়স পেড়িয়ে যাচ্ছে তাই আর কি,
-আপনার বিয়ের বয়স হয়েছে আপনি বিয়ে করুন আমাকে কেনো বলছেন। দাদিমণিকে কি বলবো তার আদরের নাতির জন্য মেয়ে দেখতে?হুম?
-আপনি কি সত্যি কিছু বুঝতে পারেন না হিয়া(অস্ফুটে)
হিয়া কিছু বললো না একটা দীর্ঘ শ্বাস টানলো।না এর চাইতে বেশি হবার আগেই মানুষটাকে সত্যি টা জানানো জরুরি। পরিবেশ টাতেও তারা ছাড়া কেউ নেই এটাই হয়তো সুযোগ!
-একটা কথা বলি আপনাকে…….আমার একটা অতীত আছে। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি যখন সেটা জানবেন আপনি কখনো আমাকে গ্রহন করতে চাইবেন না।
হিয়ার কথায় উজান একটু অবাক হলো।কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
-আপনার কোনো অতীত সম্পর্কে আমার জানার কোনো আগ্রহ নেই হিয়া।
-না থাকলেও আপনাকে শুনতে হবে। কারণ আমি জানি আমার অতীত জানলে আপনি আমাকে গ্রহন তো দূর শাহরিয়ার কুঞ্জ থেকে ইভেন নিজের জীবন থেকেও দূর ছাই করে তাড়িয়ে দিবেন,
-তাহলে তো আমি সেটা আরোও শুনবো না।যেই অতীত আপনাকে আমার থেকে কেঁড়ে নেবার ক্ষমতা রাখে সেই অতীত আমি কখনোই শুনতে চাই না হিয়া,কখনোই না❤️
-কিন্তু আপনাকে জানতে হবে।
উজান হিয়ার হাত টা এবার হিয়ার অনুমতি ছাড়াই চেপে ধরলো। চাপা হাতেই বললো না হিয়া এই অতীত আপনি আপনার কাছেই রাখুন।যেই অতীত আপনাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার শক্তি রাখে সেই অতীত সে কখনেই জানতে চায় না কখনোই না। হিয়া দমে গেলো। উজান হিয়াকে বললো আপনার যতোটা সময় লাগে আপনি নিন। আমি অপেক্ষা করবো। হিয়া শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো উজানের দিকে। লোকটা তাকে এতো কেনো ভালোবাসে!
-কিছু ভাবছেন মিস?
-হুম। ভাবছি আপনার কি দুটো আত্মা?
উজান ভূ কুঁচকে বললো,
-এক্সকিউজ মি!
হিয়া হাসলো, হেঁসে উওর দিলো,
-না যখন বাড়িতে থাকেন একটা গোমড়ামুখে থাকেন, কিসব কঠিন কঠিন কথা বলেন, সবাইকে কি কঠিন কঠিন কাজ করতে দেন, কিন্তু যখন আমার কাছে আসেন তখন আমার কি মনে হয় জানেন?
-কি!
-মনে হয় আপনার রাগী আত্না টা বেড়িয়ে একটা শান্ত নরম আত্মা ঢুকে যায়। মুহুর্তে কেমন পাল্টে যান আপনি। এক অন্য শাহরিয়ার সাহেবকে দেখতে পারি আমি! একদম একটা বাচ্চা যাকে বলে।
উজান হাসলো হেঁসে উওর দিয়ে বললো বাচ্চাই তো। আপনার আর স্পর্শের জন্যই তো বাচ্চা হ’য়ে যাই আমি মাঝেমধ্যে। হিয়া মুখ ঘুরিয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসলো। বললো চলুন এবার অনেক হয়েছে মেহু উঠে দু’জনকে না দেখতে পেলেই রেগে যাবে। আবার ওদিকে স্পর্শ উঠেই তো আগে তার পটি করতে বসে যায়,ওকে ধুইয়ে মুছে দিতে দাদিমণির কষ্ট হবে ভীষণ। উজান বললো ঠিক আছে আসুন ফেরা যাক। দু’জনে আবার হাঁটছে। হিয়া আবার লাফাচ্ছে। উজান আর কিছু বলছে না। ফোনে জরুরি কথা বলতে বলতে উজান সামনে হাটছিলো আর এদিকে এবার হিয়া লাফাতে গিয়ে বাঁধলো ঘোর বিপদ। শাড়ির নিচে পা আঁটকে গেলো হিয়ার। সাথে সাথে কুঁচি গুলো খুলে আসতেই হিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠলো সেগুলো ধরে নিতে। কিন্তু পারলো না। সব খুলে যাচ্ছে তাই অবস্থা। এখন! উজান কথা বলা শেষে হিয়ার কাছে আসতেই হিয়ার নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে চোখ সারিয়ে নিলো। হিয়া কাঁপা হাতে কোনোমতে কুঁচি গুলো কোমড়ে গুঁজে নিতেই সেগুলো পটলা হয়ে গেলো। হিয়া চেষ্টা করেও আগের মতো করতে পারলো না। বাধ্য হয়ে ওভাবেই উজানের সামনে এসে দাঁড়াতেই উজান হিয়াকে দেখে হেঁসে দিলো৷ রাগ হলো হিয়ার। রাগে গটগট করে সে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হিয়ার শাড়ির এই বারো তেরো অবস্থা দেখে উজান নিজের হাসি টা আর থামাতে পারছিলো না। হিয়া আরো রেগে গেলো। উজান ওদের জুতো গুলো নিয়ে এসে হিয়ার সামনে রাখলো। উজান গেট খুলে দিতেই হিয়া সেগুলো পড়ে নিয়ে সীটে বসে গেলো। উজান নিজের জুতো গুলো পড়ে ড্রাইভিং সীটে এসে গেট লাগিয়ে দিলো। সীট বেল্ট লাগাতে লাগাতে ফোড়ন কাটলো,
-আমার কথা না শুনে চললে এরকমই হয়। বললাম লাফালাফি না করতে দেখলেন তো।
হিয়া ভেংচি কেটে সীটে মাথা এলিয়ে দিলো। খুব ঘুম পাচ্ছে তার। সারারাতের ঘুম যেনো এখন গভীরভাবে হানা দিচ্ছে তার দু চোখে। উজান গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো। ভোরকে সকালে পরিণত করে সূর্য্যিমামা তার আলো বিলিয়ে দিচ্ছে। সরু আলো জানালা ভেদ করে গাড়ির সামনে এসে জোড়ো হচ্ছে। যানজটে ঢাকা পড়তে শুরু করলো পথঘাট। চলতে চলতে ট্রাফিকে আঁটকে পড়লো গাড়ি। গাড়ি থামলো। হঠাৎই নিজের মাথা টা উজানের বা হাতের বাহুতে এলিয়ে না বরং স্ব ইচ্ছায় তার কপাল ঠেকে দিলো হিয়া। দীর্ঘ শ্বাস এসে পড়তে থাকলো উজানের বাহু জুড়ে। উজান হিয়ার মাথায় ওর ডান হাত টা রাখলো❤️ রেখে বললো “খুব ঘুম পাচ্ছে তাই না” হিয়া উজানের বাহুতে তার নাক টা ঘষে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো হু। উজান হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবারো বললো ” কাল আমিও সারারাত ঘুমোয়নি” হিয়া এবারো উওর দিলো হুম। উজান হাসলো। হিয়া যে নিজের মধ্যে নেই বেশ বুঝতে পারলো উজান। হিয়াকে আর ডাকলো না। তার হাত তখনো হিয়ার মাথায় রাখা। গাড়ির হর্ণের শব্দে হুশ ফিরলো হিয়ার। কি করছে কি এটা সে। ধ্যাত। হুঁশে আসতেই হিয়া সোজা হয়ে বসলো। লজ্জায় নিজের মাথায় নিজে বারি মারতে ইচ্ছে করছিলো তার। উজান সামনে না থাকলে তাই করতো হয়তো সে। হিয়া তার ঘাড়ে হাত রাখলো মনে হচ্ছে ঘাড় টা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। হিয়াকে ঘাড়ে হাত রাখতে দেখে উজান বললো,
– সারারাত বালিশে না ঘুমিয়ে এমনি এমনি শুলে তো ঘাড় ব্যাথা করবেই।
উজানের কথায় হিয়া একটু অবাক হলো। সে যে বালিশে ঘুমোয় না এটা উজান কি করে জানলো।
-আপনি কি করে জানলেন আমি বালিশে ঘুমোতে পারি না? তারমানে আপনি রাতে চুপিসারে রুমে এসে আমাকে দেখতেন!
-সন্দেহ আছে আপনার!
হিয়া লজ্জা পেলো ভীষণ। এই লোকটা তারমানে রাতে এসে তাকে দেখে যেতো ইসস!
গাড়ি এসে থামলো শাহরিয়ার কুঞ্জে। উজান নেমে গেলো। সাথে হিয়াও। হাঁটতে হাঁটতে কি মনে করে থেমে গেলো হিয়া। মাথায় হঠাৎই নাড়া দিলো এক প্রশ্ন “সে তো বালিশে ঘুমোতে পারে না ঠিকই কিন্তু প্রতি সকালে সে তার নিজেকে বালিশের মাথায় আবিষ্কার করে কি করে। বুঝে আসতে মুখ দু হাত ঢেকে লজ্জায় লুটে পড়লো হিয়া। তারমানে উজান প্রতিরাতে এসে তার মাথাটা বালিশে দিয়ে দেয়❤️ ইসস জামাকাপড় কি রকম হয়ে থাকে তখন কে জানে। গায়ের ওড়নাটাও তো খুলে মাথার কাছে রেখে দেয় সে। ধ্যাত উজান কি না তাকে ওভাবে! আর ভাবতে পারলো না হিয়া। দৌড়ে দরজা ডিঙিয়ে উজানের নাগাল পেতে ভেতরে প্রবেশ করে থমকে গেলো সে। উজানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহু। চোখে তার আগুনের দাবানল। ভয়ে আঁতকে উঠলো হিয়া!
-কোথায় গিয়েছিলে তোমরা এই সাত সকালে উজান?
উজানের সোজাসাপ্টা উওর সে হিয়াকে নিয়ে বাহিরে গিয়েছিলো কিছু জিনিস দেখাতে কোনো সমস্যা? মেহু কিছু বলার আগেই উজান বলে উঠলো হিয়াকে আমি নিয়ে বেড়িয়েছিলাম, আশা করবো এই নিয়ে বাড়িতে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবে না আর। বলেই উজান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। মেহুকে পাশ কাটিয়ে হিয়া উপরে যাবে কিন্তু মেহু হিয়ার বাহু খামচে ধরে হিয়াকে আঁটকে দিয়ে বললো,
-তোমার শাড়ির এই অবস্থা কিসের জন্য!
মেহুর কথায় নোংরা ইঙ্গিত অনুভব করলো হিয়া। মেহুর চাইতেও কোটিগুন আগুনের লাভা এসে জমা হলো তার দু চোখে।মেহু হিয়ার এই চোখের আগুন সহ্য করতে পারলো না৷ আরো জোরে হিয়ার হাত চিপে ধরে বললো,
-নিজেকে বিলিয়ে দিতে গিয়েছিলা তাই না। কি ভাবো শরীর দিয়ে আমার উজানকে নিজের করে নিতে পারবে তুমি।
-ঠিক করে কথা বলেন মেহু। মাএা ছাড়াবেন না। আপনি এর আগেও আমাকে অনেক অপমান করেছেন আমি কিচ্ছু বলি নি কিন্তু
-কিন্তু কি,ভয় দেখাচ্ছো আমাকে। চরিএ হীন মেয়ে কোথাকার।
-আমি আপনাকে শেষ বার বলছি। আজ যা বলেছেন বলেছেন নেক্সট টাইম আমার সম্পর্কে এরকম বাজে মন্তব্য করলে এই আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না কেউ না।বলে রাখলাম।
ব’লেই নিজের বাহু থেকে মেহুর হাত টা ছাড়িয়ে উপরে চলে গেলো হিয়া!
-তুমি আমাকে চোখ রাঙালে তো হিয়া। এরপর দেখো আমি কি করি। আন্টি আসছে তো সামনের সপ্তাহে। আমি ওনার কানে তোমার নামে এতো বিষ ঢালবো যে উজানকে অগ্রাহ্য করে হলেও উনি তোমাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হবে।
চলবে,,