তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-২৯+৩০

0
715

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ২৯

বসার ঘর জুরে পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেলো। কারো মুখে কোনো কথায় নেই।

একটু আগে ইসহাক আহমেদ পারফিকে এতো বিচলিত হতে দেখে ভাঙা গলায় সব খুলে বললো। সব শুনে পারফি স্তব্ধ হয়ে গেলো। তাকালো ইয়ানার নিস্তব্ধ নীরব মুখশ্রীর দিকে। ওই মুখের দিকে তাকিয়ে যেনো কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো।
কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে ইয়ানাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইয়ানা উঠে দাঁড়িয়ে কোনো রকম বললো

আমি একটু একা থাকতে চাই এ বলে দৌড়ে রুমে চলে গেলো।

ইয়ানার পিছু পিছু পারফিও দ্রুত গেলো। এখন কিছুতে ওকে একা ছাড়া যাবে না। ইয়ানা যেই রুমের দরজা লাগাতে যাবে তার আগেই পারফি রুমে ঢুকে গেলো।

পারফিকে দেখে ইয়ানা ভাঙা গলায় বললো –

আমাকে একটু একটা থাকতে দিন প্লিজ।

পারফি কোনো কথা না বলে ইয়ানাকে বুকের মাঝে আগলে নিলো।

ইয়ানা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ডুকরে কান্না করে উঠলো।

ইয়ানার কান্নায় পারফির বুকের ভিতর ও ঝড় বয়ে গেলো কিন্তু ইয়ানার কান্না থামালো না। কান্না করে মনটা হালকা করতে দিলো। পাথর হয়ে থাকাট চেয়ে কান্না করে মন হালকা করাটা জরুরি।

অনেক সময় ধরে এক নাগারে কান্না করেই চলেছে ইয়ানা, তা দেখে পারফি ইয়ানাকে ছাড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে দু গালে হাত রেখে বললো –

আর কান্না করো না বিড়াল ছানা তাহলে শরীর খারাপ করবে। সবার জীবনে কোনো না কোনো অতীত থাকে। ধরে নেও এটা তোমার এক দুঃস্বপ্ন। তুৃৃমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো কারণ সেদিন তোমার সাথে খারাপ কিছুও ঘটতে পারতো। কিন্তু দেখো আল্লাহ তোমাকে এতো ভালো একটা বাবা এনে দিয়েছে। যে কোনো দিন একটা বারের জন্য ভাবে ও নি সে তোমার বাবা না। এমনকি তোমাকে তোমার অতীত থেকে দূরে রাখার জন্য নিজের এলাকা ছেড়ে এখানে চলে এসেছে পর্যন্ত।
জানো তো সবার ভাগ্যে এতো ভালো বাবা জোটে না কিন্তু দেখে তুমি কতো ভালো একটা বাবা পেয়েছো যে তোমার জন্য নিজের জীবন টাও দিতে রাজি। আজ তোমার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে ওই বাবাটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে ইয়ানা।
মানছি সে তোমার আসল বাবা না কিন্তু সে তোমার আসল বাবার থেকেও অনেক বেশি কিছু। আজ নিজেকে এভাবে কষ্ট দিয়ে আমাদের সবাইকে এভাবে কষ্ট দিও না বিড়াল ছানা। ছোট বেলার ওই ঘটনাটা একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে জীবন থেকে মুছে ফেলো। ওই যে দেখো তোমার বাবা-মা, বোন সবাই আছে। তুৃৃমি আরো গর্ব করে বলবে আমার এতো সুন্দর একটা পরিবার আছে। যাদের সবার কলিজার টুকরো তুৃমি।

কথা গুলো বলে পারফি ফের ইয়ানাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো-

সব ভুলে যাও বিড়াল ছানা। আমরা আছি তো, আমরা সবাই তেমার পাশে আছি। তুমি অনেক লাকি গার্ল কারণ তোমার একটা না দু দুটো করে বাবা-মা। আমার বাবা-মা, তোমার বাবা-মা সবার কলিজার টুকরো মেয়ে তুমি। এতোগুলো ভালোবাসার মানুষ থাকতে তুমি নিজেকে কেনো একা ভাববে বলো? আমরা সবাই আছি তোমার পাশে আর সারাজীবন থাকবো। এগুলো নিয়ে আর ভাববে না ওগুলো সব তোমার এক দুঃস্বপ্ন ওঁকে?

পারফির কথায় ইয়ানার কান্না আস্তে ধীরে কমে আসলো। এক পর্যায়ে নীরব হয়ে পারফির বুকে সাথে লেপ্টে রইলো। কিছুক্ষণ পর পর হেকচি উঠছে কান্নার ফলে। জীবনের এতো বড় ধাক্কটা যেনো জীবনটা এলোমেলো করে দিলো।

ইয়ানাকে শান্ত হতে দেখে পারফি ইয়ানার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিলো একটা সময় ইয়ানার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পারফি ইয়ানাকে নিজ থেকে ছাড়িয়ে দেখলো ইয়ানা হুঁশে নেই। পারফি কয়েকবার ডাকলো ইয়ানাকে কিন্তু কোনে সাড়াশব্দ পেলো না। তারাতাড়ি করে ইয়ানাকে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিয়ে ইসহাক আহমেদ আর ইতি বেগমকে বিষয়টা জানালো। ইয়ানার অবস্থা দেখে ইসহাক আহমেদের পাগলপ্রায় অবস্থা। ইতি বেগম ও বিচলিত হয়ে পড়েছে। পারফি দ্রুত পরিচিত ডাক্তারকে কল করে এখানে আসতে বললো।

ডক্টর এসে ইয়ানাকে দেখে গেলো, যাওয়ার সময় বলে গেলো শরীর প্রচুর দুর্বল তার উপরে কোনো কিছু নিয়ে মেবি মাথায় প্রেশার পড়েছে তাই জ্ঞান হারিয়েছে। আস্তে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসবে ঘন্টা খানেকের ভিতরে কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে ওর কোনে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। যতটা পারেন রোগীকে টেনশনমুক্ত রাখার ট্রাই করবেন।

ডক্টরের কথায় সম্মতি দিয়ে পারফি যেয়ে বাসার নিচ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসে আবার ফিরে আসলো। রুমে এসে চোখে পড়লো ইয়ানার নিস্তব্ধ মুখশ্রীর দিকে।
বুকটা খুব ভারী লাগছে, স্নিগ্ধ ফুলের এমন বিধ্বস্ত রূপে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। ওই বিধ্বস্ত মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাধ্য হলো না, বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
————————-
ড্রয়িংরুমে বসে আছে পাভেল চৌধুরী, শরীফ শিকদার , পিয়াসা বেগম, শাহানা বেগম, শাফিন, প্রীতি ও পারফি।
তাদের সবার চোখমুখে একরাশ বিষ্ময়ক। ঘন্টাখানেক আগে ইসহাক আহমেদ ফোন করে সবাইকে আসতে বলেছে এখানে। এখানে এসে এমন কিছু শুনবে কেউ কল্পনাও করে নি।
কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবার মাঝে নীরবতা বিরাজমান। কি এই বা বলবে? কেউ কল্পনাও করতে পারছে না ইয়ানার জীবনে এমন একটা অতীত ছিলো। একটু আগে ইসহাক আহমেদ শুরু থেকে সবটা খুলে বলেছে সবাইকে। সব শোনার পর থেকে সবাই থম মেরে বসে রইলো।

অবশেষে নীরবতা ভেঙে ইসহাক আহমেদ ফের বললো

সব তো শুনলেন এবার আসল কথাটা বলছি কিছু মনে করবেন না। জানি আপনারা অমন মানুষ না তবুও বিষয়টা ক্লিয়ার করতে চাই। আমি চাইনা আমার মেয়েটা আর এক বিন্দু কষ্ট পাক। হ্যা ইয়ানা শুধু আমার এই মেয়ে আমার কলিজার টুকরো। শুধু জন্ম দিলেই যে বাবা-মা হওয়া যায় তা না, ও আমার রক্তের না হলেও ও আমার মেয়ে আর সারাজীবন আমার মেয়ে হয়েই থাকবে।
এখন কথা হলো আপনাদের কারো যদি কোনো সমস্যা থাকে ইয়ানাকে নিয়ে যে ইয়ানা আমার মেয়ে না, কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে তাকে আপনারা আপনাদের ছেলের বউ হিসেবে মানতে পারবেন না তাহলে আমি বলবো আমার মেয়েকে নির্দ্বিধায় আমার কাছে রেখে যেতে পারেন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

আমার কথায় আপনারা কষ্ট পেলে বা আমার কথায় কোনো ভুল হলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু আমি একজন বাবা আমি চাইনা আমার কলিজার টুকরো মেয়ে আর এক বিন্দু পরিমাণ কষ্ট পাক। আমার মা টাকে নিয়ে আপনাদের কোনো সমস্যা হলে আমার কাছে আমার কলিজাটাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। আমি আমার কলিজাটাকে বুকের ভিতর আগলে বাকি জীবন বেঁচে থাকবো, কাউকে কষ্ট দিতে দিবো না আমার মেয়েটাকে। দরকার হলে আমি আবার এই শহর ছেড়ে চলে যাবো। আমার মেয়ের জন্য আমি সব করতে পারি, আমার মেয়ের এক বিন্দু কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না বলতে বলতে চোখজোড়া ভিজে উঠলো ইসহাক আহমেদের।

ইসহাক আহমেদের কথায় সবার চোখ ছলছল করে উঠলো। মেয়ের প্রতি বাবার এতো গভীর ভালোবাসা সবাইকে মুগ্ধ করে দিলো। কে বলেছে ইয়ানা তার মেয়ে না? ইয়ানা তার মেয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু।

পাভেল চৌধুরী ইসহাক আহমেদের কাঁধে হাত রেখে বললো –

কি বলছেন ভাই এসব কথা? ইয়ানা মামনী কি শুধু আপনার একার মেয়ে নাকি? ইয়ানা আমাদের সবার মেয়ে। মানছি ইয়ানা মামনীর অতীত এর কথা কিন্তু ওটা একটা দুঃস্বপ্ন হিসেবে ভেবে নিলাম আমরা। কে বলেছে ইয়ানা মামনী আপনার মেয়ে না, ইয়ানা মামনী শুধু আপনার মেয়ে আর সারাজীবন আপনার কলিজার টুকরো মেয়ে হয়েই থাকবে সাথে আমাদের ও মেয়ে। আমার ছেলের বিয়ের আগে আমরা কি বলেছিলাম মনে নেই? আমরা বলে ছিলাম ইয়ানা মামনীকে আমরা পুত্রবধূ না নিজেদের মেয়ে হিসেবে নিতে এসেছি। ও আমাদের ও মেয়ে তাহলে মেয়ের এই দুঃস্বপ্নময় অতীত শুনে মেয়েকে পর করে দিবো নাকি?

পাভেল চৌধুরীর কথায় ইসহাক আহমেদ ছলছল চোখে তাকালেন তাদের দিকে তখন শরীফ শিকদার বললো-

আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ভাই। আমরা সবাই আপনাদের পাশে আছি। ইয়ানা সারাজীবন আমাদের সবার মেয়ে হয়ে থাকবে। ও কখনো নিজের বাবা-মার অভাব অনুভব ও করতে পারবে না কারণ আমরা সবাই আছি ইয়ানা মামনীর পাশে।

পিয়াসা বেগম, শাহানা বেগম সবাই ইসহাক আহমেদকে আস্বস্ত করলো যে ইয়ানাকে তারা সবাই আগলে রাখবে। কারো এক বিন্দু পরিমাণ আপত্তি নেই নিয়ানার অতীত নিয়ে।

সবার এই আস্বস্ততা দেখে ইসহাক আহমেদ একটু শান্তি অনুভব করলো। তার মেয়ে যে সবার এতো আদরের হয়ে উঠেছে সেটা ভেবেই ভালো লাগছে যে তা মেয়েকে কখনো কষ্ট পেতে হবে না।
———————-
সেদিনের পর কেটে গেলো আরো কিছু দিন। ইয়ানা এখন কিছুটা স্বাভাবিক। সবার এতো এতো ভালোবাসার মাঝে খারাপ থাকা যায় নাকি? পিয়াসা,শাহানা, ইতি বেগমের মতো তিনটি মা পেয়েছে। পাভেল চৌধুরী, শরীফ শিকদার, ইসহাক আহমেদের মতো তিনটি বাবা পেয়েছে। শাফিন, প্রীতি, ইমার মতো তিনটি ভাইবোন পেয়েছে এর চেয়ে বেশি আর কি লাগে?
সব শেষে পারফির মতো বন্ধুসুলভ একজন জীবনসঙ্গী যে ওর কষ্টে কষ্ট পায়, ওর আনন্দে আনন্দ পায়, ছায়া হয়ে প্রতিটা মুহূর্ত পাশে থাকে তারপর ও কি খারাপ থাকা যায়? আদো কি কেউ খারাপ থাকতে দেয় ওকে? সব সময় ছায়া হয়ে প্রতিটা মানুষ ওর পাশে থাকে। সবার এতো এতো ভালোবাসায় নিজেকে খুব লাকি গার্ল মনে হয়। ভাগ্য করে এতোগুলো ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে।

মাঝে মাঝে মন খারাপ হতো এ ভেবে যে ও কারো অবৈধ সন্তান হয়তো তাই ওকে ওভাবে ফেলে দিয়েছিলো, নিজেকে অপবিত্র মনে করে কষ্ট পেতো তখন পারফি ইয়ানাকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে বোঝাতো ওর ধারণা ভুল। ও পবিত্র একটা ফুল, সবার চোখের মনি স্নিগ্ধ ফুল।

ইয়ানা বসে কথা গুলো ভাবছিলো তখন পারফি ইয়ানার সামনে এসে ইয়ানার দিকে হাতে টাই বাড়িয়ে দিয়ে বললো

বিড়াল ছানা এটা বেঁধে দেও।

ইয়ানা টাইটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে টাই বাঁধতে বাঁধতে বললো-

আমার এতো সুন্দর একটা নাম রেখে সব সময় বিড়াল ছানা ডাকেন কেনো?

পারফির ইয়ানার গাল টেনে দিয়ে হেঁসে বললো

কারণ তুমি শুধু আমার বিড়াল ছানা।
পারফির কথায় ইয়ানা ও হেসে ফেললো। টাই বাঁধা শেষ হতে বললো-

হয়ে গেছে।

পারফি ইয়ানার হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে ইয়ানার দু গালে হাত রেখে কোমল স্বরে বললো-

সবসময় এভাবে হাসিখুশি থাকবে। স্নিগ্ধ ফুলের মুখে শুধু হাসি টাই মানায় বুঝলে?

পারফির কথায় ইয়ানা মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো।

পারফি ইয়ানাকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে কপালে আলতো করে চুমু একে দিলো। কেঁপে উঠলো ইয়ানা পারফির এই আলতে স্পর্শে। এটা পারফির রোজকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে আফিসে যাওয়ার আগে কপালে অধর ছুঁয়ে দেওয়া। প্রতিবার এই পারফির এই স্পর্শ টুকুতে ইয়ানা কেঁপে উঠে যা দেখে পারফি ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে উঠলো:-

সামন্য কাঁপলে চুমুতে তোমার কাঁপা কাঁপি উঠে যায় যদি অন্য কিছু করি তাহলে কি অবস্থা হবে শুনি?

পারফির কথায় ইয়ানার কান কোন দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে লাগলো। লজ্জায় নুইয়ে গেলো, এই ঠোঁট কাটা ছেলের সামনে থাকলে এক একটা কথা বলে লজ্জায় ফেলে দেবেই।

ইয়ানার লজ্জায় রাঙা রক্তিম মুখশ্রী দেখে পারফি ফট করে ফের ইয়ানার গালে চুমু দিয়ে বললো –

এই চুমুটার জন্য তুমি নিজে দায়ী। তোমার লজ্জা রাঙা রক্তিম টমেটোর মতো গাল দেখলে আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। কে বলেছে তোমাকে লজ্জা পেয়ে এমন ভয়ংকর রকম সুন্দর হতে? এখন চুৃুমু, কমড় টামড় খেয়ে বসলে আমার দোষ নেই বলে দিলাম।

পারফি কাজে ইয়ানা আরো লজ্জায় পড়ে গেলো। লজ্জায় হাসফাস করতে করতে বলে উঠলো অসভ্য ছেলে।

ইয়ানার কথায় পারফি ফের ঠোঁট কামড়ে হেসে ইয়ানার কানে ফিসফিস করে বললো

এখনো তো কিছুই করলাম না এর ভিতরেই অসভ্য উপাধি দিয়ে দিলে? পারফির ফিসফিসানিতে কেঁপে উঠলো ইয়ানা। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-

স..সরুন আ..আপনার দেরি হয়ে য..যাচ্ছে।

ইয়ানার এমন কাঁপা কাঁপি অবস্থা দেখতে বেশ মজা লাগছে পারফির। ইয়ানাকে আর জ্বালাতন না করে ইয়ানর থেকে দূরে সরে বললো –

যাচ্ছি তাহলে, সাবধানে থেকো আমার আদুরে বিড়াল ছানা।

পারফি যেতে ইয়ানা বিরবির করে বললো দিনদিন এই লোক আরো বেশি ঠোঁট কাটা স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে। মুখে কিছু আটকায় না।

#চলবে?

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ৩০

সকাল সকাল প্রীতি ফুল গাছে পানি দিচ্ছিলো। আজ হঠাৎ কলেজ বন্ধ কোনো এক কারণে তাই রিলাক্স মুডে সকাল সকাল গাছে পানি দিতে নামলো।

এদিকে শাফিন এক প্রকার দৌড়ে বাসা থেকে বের হচ্ছে। পারফি বলেছিলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তাই যেনো আজ ঠিক টাইমে আফিসে পৌঁছায়। ওর কাজ তো সবসময় লেট লতিফের মতো লেট করে অফিসে উপস্থিত হওয়া। এর জন্য জীবনে পারফির থেকে কম বকা খায় নি। পারফি যখন বকা দিতো তখন ঠোঁট উল্টে মনে মনে ভাবতো শালা তোর মতো যদি সব কিছু টাইম মতো করতে পারতাম তাহলে কি আর লেট লতিফ উপাধি পেতাম সবার কাছে? শুধু শুধু আমাকে বকা দেস শালা। সকাল সকাল ঘুম ভাঙে না তাতে আমার কি দোষ? তোরতো বউ আছে তোর বউ তোকে ডেকে দেয়। আমারতো বউ নাই তাই ডেকে দেওয়ার মানুষ ও নাই। শালা পাষাণ এতোগুলা বকা না দিয়া একটা বউ ওতো এনে দিতে পারিস। কথা গুলো মনে মনে ভাবলেও সামনা সামনি বলা হয় নাই কখনো। এগুলো সামনা সামনি বললো পারফি ওকে এক থাবড়ে উগান্ডা পাঠিয়ে দিবে।

এই যে আজ আবার কতোগুলো বচন খাওয়া লাগবে ভাবতেই শাফিনের ইচ্ছে করছে নিজের মাথা নিজে টাকাতে। সকাল বেলা এতো ঘুম কই থেকে যে আসে তাই মাথায় আসে না। যেখানে ৮ টা বাজে অফিসে থাকতে বলেছে সেখানে ৯ টা বাজে ভেঙেছে ঘুম। শালা ঘুমের সাথে আমার কি এতো শত্রুতামি বুঝি না। যেদিন তারাতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা লাগবে সেদিন শালার ঘুম হাত-পা টিপে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে যাতে পারফির থেকে ঝারি খেতে পারি। এই শালা*র ঘুম ও আমার বিরুদ্ধে চলে, এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে ভাবতে ভাবতে শাফিন ছুট লাগালো অফিসের উদ্দেশ্যে।

কোনোদিক না তাকিয়ে এভাবে ছোটার জন্য হঠাৎ করো সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো। কারো সাথে বেখেয়ালি ভাবে ধাক্কা লাগায় সরি বলতে যাবে অমনি সামনে তাকাতে হো হো করে হেঁসে উঠলো। কারণ সামনে হাত-পা মুখে কাঁদা পানি লেগে প্রীতির অবস্থা জোকারের মতো হয়ে গেছে। প্রীতির এই জোকার রুপ দেখে নিজের হাসি আর কন্ট্রোল করতে পারলো না।

একেতো শাফিন ধাক্কা মেরে প্রীতিকে ফেলে দিয়েছে তার উপর এভাবে আবার হাসছে তা দেখে প্রীতি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল,

শাফিনের বাচ্চা তুই আমাকে ফেলে দিয়েছিস আবার দাঁত কেলিয়ে হাসছিস আজতো তোকে আমি কি করবো আমি নিজেও জানিনা।

প্রীতির মুখে আবার ও তুইতোকারি শুনে শাফিনের হাসি থেমে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

আবার তুই আমাকে তুই তোকারি করছিস?

করেছি বেশ করেছি, আরো করবো। সকাল সকাল ডাকাতি করতে বের হচ্ছো যে কোনো দিকে না তাকিয়ে কানার মতো দৌড়াচ্ছো, তোমার জন্য আমার কি অবস্থা হয়েছে? যেখানে সরি বলবা তানা উল্টা দাঁত কেলিয়ে হাসছো।

হাসছিস বেশ করেছি, আরো হাসবো। তোর মতো ঘাড় ত্যারা মেয়েকে সরি বললে জীবনেও মানতি না আমি জানি। তোকে বেকার সরি বলার চেয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসা অধিক উত্তম।

প্রীতি ক্ষেপে যেয়ে বললো,

কি বললে তুমি আমি ঘাড় ত্যারা? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা এ বলে এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে পানির পাইপটা হাতে উঠিয়ে শাফিনকে ভিজিয়ে দিতে লাগলো।

প্রীতি কি করছে বুঝে উঠতে শাফিন তারাতাড়ি প্রীতিকে আটকানোর জন্য ওকে ধরতে যাবে তার আগে প্রীতি ছুটে অন্য পাশে চলে যেয়ে শাফিনকে ভেজাতে ভেজাতে বললো,

এবার দেখো কেমন লাগে? আমার সাথে লাগতে আসা তাইনা এবার দেখো প্রীতির সাথে লাগতে আসার ফল।

শাফিন প্রীতির দিকে তেরে যেতে যেতে বললো প্রীতি থাম বলছি, আমি একবার তোকে ধরতে পারলে থাপ্পড় খাবি কিন্তু বলে দিলাম।

প্রীতি থামলো না বরং এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে শাফিনকে ভেজাতে লাগলো। এক পর্যায়ে শাফিন প্রীতির হাত ক্ষপ করে ধরে ফেলে পাইপটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। শাফিন এবার এক হাত দিয়ে প্রীতিকে ধরে রেখে আরেক হাত দিয়ে প্রীতির দিকে পাইপ ঘুরিয়ে দিলো। প্রীতি ছাড়া পাওয়ার জন্য হাত মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো কিন্তু কোনো লাভ হলো না।

বাহিরে হঠাৎ এমন শোরগোলের শব্দ শুনে শাহানা বেগম ছুটে আসলো। দুই ছেলে মেয়ের এমন পাগলামো দেখে তার মাথায় হাত। এই দুটোকে নিয়ে আর পারে না সব সময় মা/রা/মা/রি ঝগড়া বিবাধ লাগিয়েই রাখবে।
তখন সেখানে এসে আরো উপস্থিত হলো পিয়াসা বেগম আর ইয়ানা। শাহানা বেগমের মতো পিয়াসা বেগমের ও একি অবস্থা হলো দুজনের অবস্থা দেখে।

এদিকে প্রীতি আর শাফিনের অবস্থা দেখে ইয়ানা শব্দ করে হেঁসে ফেললো। দুজনে কাঁদা পানি মেখে এক একার অবস্থা। দুজনের এমন পাগলামো দেখে নিজের হাসি আর কন্ট্রোল করতে পারলো না।

কারো হাসির শব্দ শুনে শাফিন আর প্রীতি ওদের লড়াই বন্ধ করে পিছু ঘুরলো। পিছু ঘুরে সবাইকে এমন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতে থাকা পাইপ ফেলে দিয়ে ভদ্রের মতো দাঁড়িয়ে গেলো। দেখে যেনো মনে হচ্ছে এদের মতো ইনোসেন্ট মানুষ আর দুটো নেই।

শাহানা বেগম এবার বলল,

কি হলো থামলি কেনো? আরো কর মা/রা/মা/রি।

শাহানা বেগমের কথায় শাফিন বলল,

আম্মু আমার কোনো দোষ নাই এই রাক্ষসী আমাকে আগে ভিজিয়েছে। শাফিনের কথায় প্রীতি ফোঁস ফোঁস বললে উঠলো,

নিজে যে আগে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছো তার দোষ নেই? আসছে আমার নামে বিচার দিতে।

মিথ্যা বললে একটা থাপ্পড় খাবি আমি কি ইচ্ছে করে ফেলেছি? এক্সিডেন্টলি ধাক্কা লেগে গিয়েছিলো।

আসছে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে এখন এক্সিডেন্ট বলতে।

শাফিন রেগে বলল,

একদম মিথ্যা বলবি না প্রীতি তাহলে কিন্তু তোর কপালে শনি আছে বলে দিলাম।

প্রীতি আর শাফিনকে আবার ও ঝগড়া বাজাতে দেখে পিয়াসা বেগম এবার এদের থামানোর জন্য বলল,

থামবি দুটোয়? আর নাহলে এখন দুটোকে ধরেই পেটাবো বলে দিলাম।

পিয়াসা বেগমের ধমকে দুজনে থামলো। শাফিন কিছু বলতে যাবে তার আগে শাহানা বেগম শাফিনের কান টেনে ধরে বলল,

বাচ্চা মেয়েটার সাথে তোর না বাজালে হয় না? তোর না অফিসে যেতে লেট হয়ে গিয়েছে তার জন্য না খেয়ে বের হয়ে গিয়েছিস আর এখন এভাবে মা/রা/মা/রি করছিস তাতে দেরি হচ্ছে না?

পিয়াসা বেগম বলল ওকে একা বলছো কেনো পাশেরটাকে ধরেও কিছু বলো। ও ছোট হয়ে কেনো শাফিনের সাথে লাগতে যাবে? তোমার লাই পেয়ে পেয়ে এটায় আজ বাঁদর হয়েছে।

পিয়াসা বেগমর কথায় শাহানা বেগম বললো,

আজ দুটোকে ধরেই মার দিবো এ বলে প্রীতির আরেক কান ধরে বললো দুটোয় দিন দিন বাঁদর হচ্ছিস। এই তোরা না বড় হেয়েছিস এখন তো একটু মিলেমিশে থাক এভাবে ঝগড়া মা/রা/মা/রি না করে। আর কতোদিন এভাবে ঝগড়া মা/রা/মা/রি করে কাটাবি?

শাহানা বেগম কান ধরায় প্রীতি ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,

আন্টি এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না সব দোষ তোমার বাঁদর ছেলের।

হ এখন সব দোষ আমার আর তুইতো ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারিস না ইনোসেন্ট বান্দর।

দুজনকে আবার বাজাতে দেখে শাহানা বেগম বললো,

আবার শুরু করেছিস এবার কিন্তু সত্যি দুটোয় মার খাবি।

শাহানা বেগমের কথায় প্রীতি আর শাফিন ঠোঁট উল্টে তাকালো শাহানা বেগমের দিকে তা দেখে তিনি কান ছেড়ে দিয়ে বললো দুটোয় এখন দুজনের কাছে সরি বলে বল আর কখনো ঝগড়া করবি না।

প্রীতি আর শাফিন এক সাথে বলে উঠলো জীবনেও না।

দুজনের কথায় মাথায় হাত শাহানা বেগমের।

এদিকে প্রীতি আর শাফিনের অবস্থা দেখে ইয়ানা মুখ টিপে হেসেই চলেছে তা প্রীতির চোখে পড়তে প্রীতি বলে উঠলো,

খুব মজা নেওয়া হচ্ছে ওখানে বসে তাইনা? আর একটু হাসলে তোকেও ভিজিয়ে দিবো বেলে দিলাম।

প্রীতির কথায় পিয়াসা বেগম বলল,

আর তুই ভেজাতে আমার মেয়েকে। তোর মতো বাঁদর নাকি আমার মেয়ে যে তুই আমার মাকে ভেজাতে আসবি? পিটিয়ে তোর বাঁদরামি ছুটাবো আমি।

পিয়াসা বেগমের কথায় ইয়ানা হেঁসে ফেললো। পিয়াসা বেগমকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে প্রীতির দিকে তাকিয়ে জ্বিভ ভেঙচিয়ে বলল ,

কতোবড় সাহস আমার ভালো মার মেয়েকে ভেজাতে চাস। আমার মা তোকে পিটিয়ে বাঁদর থেকে মানুষ বানিয়ে দিবে একদম।

ইয়ানার কথায় শাফিন বলে উঠলো,

একদম ঠিক বলেছো ফুল পরী আমার বনু। এটা আসলেই বাঁদর,এটাকে পিটিয়ে মানুষ বানাতে হবে।

শাফিনের কথায় শাহানা বেগম ফের শাফিনের কান টেনে ধরে বলল,

আবার শুরু করেছিস? তুইতো ওর থেকেও বড় বাঁদর আবার কথা বলিস।

শাফিনকে বাঁদর বলায় প্রীতি যেনো ঈদের থেকেও বেশি খুশি হলো।

প্রীতিকে এমন খুশি হতে দেখে শাফিন বিড়বিড় করে বললো তোকে পড়ে দেখে নিবো আগে এখান থেকে ছাড়া পাই। তারপর শাহানা বেগমকে বলল,

উফফ আম্মু এবার তো ছাড়ো অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখানে তোমার মার খাচ্ছি অফিসে যেয়ে এই বাঁদরের ভাইর হাতে মার খাওয়া লাগবে। এতো মার খেয়ে কবে জানি চেপ্টা হয়ে যাবো আমি।

শাহানা বেগম কান ছেড়ে দিয়ে বলল,

তোর জন্য মার এই ঠিক আছে, যা সর এখান থেকে।

শাফিন ছাড়া পেয়ে বিড়বিড় করতে করতে বাসার প্রবেশ করলো চেঞ্জ করার জন্য।

শাফিন যেতে শাহানা বেগম প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল,

যা ফ্রেশ হয়ে নে ঠান্ডা লেগে যাবে।

পিয়াসা বেগম বললো এটাকে এতো সহজে ছেড়ে দিচ্ছো কেনো? আগে পিঠের উপরে দুটো দেও আর নাহলে জীবনেও সোজা হবে না বলতে বলতে ভিতরে চলে গেলো।

পিয়াসা বেগমের কথায় প্রীতি ঠোঁট উল্টে বলল,

দেখেছো আমার সাথে কেমন করে?

প্রীতি কথায় শাহানা বেগম হেঁসে ফেললো তারপর প্রীতিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,

রাগের মাথায় বলেছে এবার যা তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে এ বলে শাহানা বেগম ও চলে গেলো।

শাহানা বেগম যেতে ইয়ানা হো হো করে হেঁসে বলল,

দোস্ত তোকে দারুণ লাগছে। আয় একটা সেলফি তুলি তোর সাথে।

ইয়ানার কথায় প্রীতি ইয়ানার দিকে তেরে যেতে যেতে বলল তবে রে দেখাচ্ছি মজা।

এদিকে প্রীতিকে নিজের দিকে আসতে দেখে ইয়ানা ভো দৌড়। এক দৌড়ে যেয়ে পিয়াসা বেগমের পিছে লুকালো।

পিয়াসা বেগমের পিছে লুকাতে প্রীতি আর কিছু বলতে পারলো না। পিছ থেকে বলে গেলো কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবি? তোকে তো পড়ে দেখে নিবো আমি হুহ্।

ইয়ানা প্রীতিকে জ্বিভ দিয়ে ভেঙচি কাটলো।

তা দেখে প্রীতি দাঁতে দাঁত চেপে উপরে উঠে গেলো ফ্রেশ হতে।
—————–
এদিকে শাফিন অফিসে পৌঁছে নিজের কেবিনে যেয়ে বসতে একজন স্টাফ এসে বলল শাফিন স্যার পারফি স্যার বলেছে আপনাকে তার সাথে দেখা করতে।

অফিসে আসতে না আসতে পারফির ডাক পড়াতে শুকনো ঢোক গিললো শাফিন। আজ যে কপালে শনি আছে তা ঢের বুঝতে পারছে।

কিছুক্ষণ বসে থেকে কথা সাজিয়ে নিলো কি বলবে পারফিকে তারপর ঢোক গিলে পা বারালো পারফির কেবিনে।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে