তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-২৩+২৪

0
667

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ২৩

এইযে মিস্টার খাটাশ তখন এর জন্য সরি। ভেবো না আমি নিজ থেকে বলছি সরি। মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে বলছি তাই এখন ভাব নিয়ে লাভ নেই মুখ ভেঙচি কেটে শাফিনকে বললো প্রীতি।

শাফিন বসে বসে ফোন টিপছিলো তখন প্রীতির এই কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্রীতির দিকে। প্রীতির কথার আগা মাথা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো। কথার মানে বুঝতে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো তোর সরি এক্সেপ্ট করি নাই আমি।

সরি বলেছি এই অনেক এখন এক্সেপ্ট করবা কিনা সেটা তোমার ব্যপার।

শাফিন ভ্রু কুঁচকে বললো জানি তুই সরি বলার মেয়ে না। আন্টি বলতে বলেছে তাই বলেছিস এখন আমি আন্টির কাছে যেয়ে বললো তুই আমাকে সরি বলিস নি উল্টো বেয়াদবি করেছিস তখন আন্টি তোর কি হাল করবে? উফফ ভাবতেই ভালো লাগছে। তাহলে তুই থাক আমি যাই কেমন? আন্টিকে খবরটা দিয়ে আসি এ বলে উঠে যেতে নিলে প্রীতি তারাতড়ি সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো এই না না।

শাফিন ভ্রু নাচিয়ে বললো কি না?

প্রীতি দাঁতে দাঁত চেপে বললো আম্মুর কাছে বিচার দিবে না। আমি কিন্তু সরি বলেছি এখম আম্মুর কাছে মিথ্যাে কেনো বলবা?

তোর সরি আমার পছন্দ হয় নাই তাই এক্সেপ্ট করি নাই আমি, তাই বিচার দিবো এবার সর সামনে থেকে আমাকে যেতে দে।

প্রীতি পড়ে গেলো এবার বিপাকে। মন চাচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হনুমানের মাথা ফাটিয়ে দিতে কিন্তু আপাতত তা করতে পারবে না। মায়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য হলেও মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে তাই শাফিনের দিকে তাকিয়ে বোকা হাসি দিয়ে বললো এখন কি করলে সরি এক্সেপ্ট হবে শুনি?

শাফিন বাকা হেঁসে বললো এবার এসেছিস লাইনে। কিন্তু আমি যা করতে বলবো তুই এখন তা করবি না আমি জানি তাই বাদ দে আমি বরং আন্টির কাছে যাই এ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আবার ও প্রীতি সামনে এসে দাঁত কটমট করে বললো কি করতে হবে?

বেশি কিছু না এখন কান ধরে ১০ বার ওঠবস করবি এবং সাথে বলবি তখন এর বেয়াদবির জন্য সরি।

প্রীতি ছিটকে দূরে যেয়ে বললো মরে গেলেও করবো না এহ্ আসছে কান ধরে ওঠবস করাতে। তোকে কান ধরে ওঠবস করাবো, আবার বলে আমি বেয়াদবি করেছি। তুই তাহলে দাঁত কেলিয়ে হাসছিলি কেনো তার দোষ নাই?

শাফিন দাঁত কটমট করে প্রীতির হাত শক্ত করে ধরে বললো আর একবার তুই তোকারি করলে খুব খারাপ হবে বলে দিলাম প্রীতি।

শাফিনকে এমন রেগে যেতে দেখে প্রীতি কিছুটা ভড়কে গেলো। আমতা আমতা করে বললো হাত ছাড়ো লাগছে আমার।

শাফিন দাঁতে দাঁত চেপে বললো তোর শাস্তি দিগুণ হলো এবার শাস্তির জন্য প্রস্তুত হ।

প্রীতি কাঁপা কন্ঠে বললো ক..কিসের শাস্তি? আ.. আমি কিন্তু আন্টিকে ড…ডাক দিবো বলে দিলাম।

শাফিন ভ্রু কুঁচকে বললো আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? ভয় দেখাতে হলেও মাথায় বুদ্ধি লাগে সেটা তোর মতো গাধার মাথায় নাই। ডাক মাকে, সারা রাত বসে ডাকলেও শুনবে না কারণ একটু আগে তুই নিজেই আব্বু আম্মুকে তোদের বাসায় পাঠিয়েছিস।

প্রীতি এবার গেলো ফেঁসে এখন এখান থেকে কিভাবে ছাড়া পাবে তাই ভাবতে লাগলো। ঠিক করলো সেদিনের মতো কামড় দিয়ে দৌড়ে দিবে কিন্তু সেই আশায় ও পানি ঢেলে শাফিন বলে উঠলো কামড় দেওয়ার কথা ভুলে যা। এখন কামড় দিলে তোর দাঁত একটাও আস্তো রাখবো না।

প্রীতি এবার কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো ছেড়ে দেওনা।

শাফিন বাঁকা হেসে আচমকা প্রীতির ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিলো।

শাফিনের এমন আচমকা আক্রমণে প্রীতি আর্তনাদ করে উঠলো।

প্রীতির আর্তনাদে শাফিন সরে যেয়ে তাকালো প্রীতির দিকে। ফর্সা ঘাড়ে কামড়ের লালচে দাগ পড়ে গেছে তা দেখে বাঁকা হেসে বললো এটাই তোর শাস্তি এ বলে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো।

এদিকে প্রীতি যেনো কিছু বলার ভাষা এই হারিয়ে ফেললো। শাফিনের এমন আচমকা আক্রমণে যেনো জমে বরফ হয়ে গেলো। কি হয়েছে ভালো করে মাথায় ঢুকতেই বুকের ভিতর ধুকপুক করতে লাগলো। শাফিনের এমন আচরণটা ঠিক হজম করতে পারলো না। এটা কি আসলেই শাস্তি ছিলো?
——————–
সবাই এক সাথে খাচ্ছে আর প্রীতি ইয়ানার রান্নার খুব প্রশংসা করছে। প্রথমবার রান্না হিসেবে অনেক ভালো রান্না করেছে।

শাফিন খাওয়ার মাঝে আরচোখে প্রীতির দিকে তাকাচ্ছে। প্রীতি ওর্না দিয়ে ভালো করে মাথা পেচিয়ে আছে। মূলত ঘাড়ের দাগ লুকানোর চেষ্টা। প্রীতির এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো শাফিন তা দেখে প্রীতি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। রাগী চোখে বার বার শাফিনের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু সবাই আছে তাই কিছু বলতেও পারছে না দাঁতে দাঁত চেপে খাবার গিলতে লাগলো।

খাওয়া শেষ হলে বড়রা কিছু নিয়ে আলোচনা করতে বসলো তাই প্রীতি আর ইয়ানা উপরে চলে গেলো। এখন এখানে ওদের থেকে কোনো লাভ নেই।

সিঁড়ী দিয়ে উপরো উঠতে উঠতে ইয়ানা প্রীতির উদ্দেশ্যে বললো তুই এমন মাথা পেঁচিয়ে আছিস কেনো?

ইয়ানার প্রশ্নে প্রীতি কি জবাব দিবে খুঁজে পেলো না। তাই একটু সময় নিয়ে কথা সাজিয়ে বললো তেমন কিছু না রাতে গোসল করার জন্য গলা ব্যথা করছে।

ইয়ানা বিষয়টা নিয়ে বেশি ঘাটলো না রুমে যেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো, রাতে গোসল করার জন্য এখন প্রচন্ড মাথা ধরেছে, শরীর টাও ম্যাজ ম্যাজ করছে।

কিছুক্ষণ পর পারফি আসলো রুমে। ইয়ানাকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে বললো কোনো সমস্যা?

ইয়ানা মাথা থেকে হাত সরিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললো না কোনো সমস্যা না।

পারফি ইয়ানার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সোফার কাছে যেতে যেতে বললো কোনো সমস্যা হলে বলতে পারো।

ইয়ানা আমতা আমতা করে বললো তেমন কিছু না, আপনি কি এখন কোনো কাজ করবেন?

পারফি ভ্রু কুঁচকে বললো কেনো?

আ..আসলে রুমের লাইটটা নিভিয়ে দিলে ভালো হতো ঘুম পাচ্ছে খুব।

পারফি তাকালো ইয়ানার দিকে। কেনো যেনো ইয়ানাকে ঠিক লাগছে না কিন্তু কিছু বললো না। উঠে যেয়ে রুমের লাইটটা বন্ধ করে ড্রিমলাইট জ্বালানি দিয়ে ফের সোফায় যেয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো।

রুমের লাইট বন্ধ করতে ইয়ানা পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। প্রচন্ড শীত লাগছে তাই ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে শুলো। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

পারফি ল্যাপটপে কাজ করছিলো তখন হঠাৎ কারো গোঙানির শব্দ শুনে ল্যাপটপ থেকে চোখ সরালো। গোঙানির উৎস খুঁজতে চারপাশে চোখ বুলাতে চোখে পড়লো বেড থেকে শব্দটা আসছে। পারফি ল্যাপটপ বন্ধ করে বেডের কাছে এগিয়ে গেলো। বেডের কাছে যেতে দেখলো ইয়ানা থরথর করে কাঁপছে আর বিরবির করে কিছু বলছে।

পারফি দ্রুত ইয়ানার পাশে বসে কপালে হাত রাখতে চমকে গেলো। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে, সব কিছু যে এই শীতের ভিতর রাতে গোসল করার জন্য হয়েছে তা ঢের বুঝতে পারছে। এই জন্য তখন ঠিক লাগছিলো না আর এই মেয়ে বলেছে কিছু না। মন চাচ্ছে এখন ঠাটিয়ে একটা চর মারতে তখন সত্যি না বলার জন্য। তখন সত্যি বললে মেডিসিন খাইয়ে দিলে এখন এই অবস্থা হতো?

শরীরের তাপমাত্রা অধিক হওয়ার জন্য পারফি পানি এনে রুমাল ভিজিয়ে কপালে দিতে লাগলো। এভাবে অনেক সময় জলপট্টি দেওয়াতে তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসলো। তাপমাত্রা একটু কমতে পারফি ইয়ানার গালে হালকা করে চাপর মেরে ডাক দিলো। কয়েকবার ডাকার পর ইয়ানা হালকা করে সারা দিলো।

পারফি ঔষধ আর পানির গ্লাস পাশে রেখে ইয়ানার হাত ধরে উঠিয়ে বাসাতে বসাতে বললো একটু উঠে বসে ঔষধ টা খেয়ে নেও তাহলে ভালো লাগবে।

ইয়ানা ঢুলুমুলু হয়ে বসে পারফির হাত আকরে ধরে ধীর গলায় বললো খুব খারাপ লাগছে একটু ঘুমাতে দেন না পরে খাবো।

ইয়ানাকে এমন হাত আকরে ধরতে দেখে পারফি বুঝলো যে ইয়ানা হুঁশে নেই। তাই জোর করে ইয়ানাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে শুইয়ে দিলো। তারপর শরীরে ব্লাংকেট জড়িয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। একসময় ইয়ানা ঘুমিয়ে পড়লো তা দেখে পারফি বেড থেকে উঠতে যাবে অমনি হাতে টান পড়লো। পিছু ঘুরে তাকিয়ে দেখে ইয়ানা এখনো ওর এক হাত জড়িয়ে ধরে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে।

পারফি এবার দ্বিধায় পরে গেলো এখনে থাকবে নাকি সোফায় চলে যাবে। কিন্তু এখন হাত ছাড়াবে কিভাবে যদি ঘুম ভেঙে যায় হাত ছাড়ালে? আবার রাতে যদি জ্বর আসে তখন কি হবে তাই সব ভেবে চিন্তে ইয়ানার পাশে শুয়ে পড়লো। তারপর আলতো করে ইয়ানাকে বুকের মাঝে আগলে নিলো। স্নিগ্ধ ফুলের একটু কষ্টেই যেনো নিজের বুকের ভিতর হাহাকার শুরু হয়ে যায়। এখন কিছুটা শান্তি লাগছে আদুরে বিড়াল ছানাকে নিজের বুকে আগলে নিতে।

পারফির মনে পড়ে গেলো সেদিন রাতের কথা যেদিন ইয়ানাদের বাসায় ছিলো। মেয়েটা সেদিন রাতে ঘুমের মাঝে ওর কাছে চলে এসেছিলো। বুকের মাঝে গুটিশুটি হয়ে বিড়াল ছানার মতো সারারাত ঘুমিয়ে ছিলো। সকাল সকাল পারফি আবার ইয়ানাকে ওর জায়গায় শুইয়ে দিয়েছিলো আর নাহলে এই মেয়ে যেই লজ্জাবতী, ঘুৃম ভেঙে ওভাবে নিজেকে দেখলে লজ্জায় স্ট্রোক না করে বসতো। সেদিনের কথা মনে করে মুচকি হাসলো পারফি।
———————————————
সকালে ঘুম ভাঙতে কারো বাহুডোরে নিজেকে আবধ্য দেখে চমকে গেলো ইয়ানা। চমকে উপরে তাকাতে পারফির ঘুমন্ত মুখশ্রী চোখের সামনে ভেসে উঠলো। পারফি এখানে কিভাবে আসলো ভাবতেই মাথা শূন্য হয়ে গেলো। তখন মনে পড়লো কাল রাতের আবছা আবছা কিছু ঘটনা। জ্বরের ঘোরে পারফির হাত আকরে ধরা, পারফির ঔষধ খাইয়ে দেও, মাথায় জলপট্টি দেওয়া তারপর আর কিছুই মনে নেই। ইয়ানা ফের তাকালো পারফির দিকে লোকটা নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ ইয়ানার একরাশ লজ্জায় ঘিরে ধরলো কারণ বুঝতে পারছে ওর জন্যই পারফি এখানে এসেছে কারণ পারফি ওমন ছেলে না যে ওর অনুমতি ব্যতীত ওর কাছে আসবে।

ইয়ানা লজ্জায় হাসফাস করতে লাগলো কিভাবে এখান থেকে ছাড়া পাবে সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। পারফির বাহুডোর থেকে ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো৷

ইয়ানার মোচড়ামুচড়িতে পারফির ঘুম ছুটে গেলো। পিটপিট করে তাকাতে চোখে পড়লো ইয়ানার লজ্জামাখা মুখশ্রী। ঘুম থেকে উঠেই এমন মুখশ্রী দেখে থমকে গেলো পারফি।

পারফিকে কোনো কথা বলতে না দেখে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইয়ানা আরো অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। ছোটার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বললো ছাড়ুন উঠবো আমি।

ইয়ানার কথায় ঘোর থেকে বের হলো পারফি। ইয়ানার অস্বস্তি বুঝতে পেরে ছেড়ে দিতে যেয়েও কিছু একটা মনে করে ছাড়লো না। হাত এগিয়ে নিয়ে আলতো করে ইয়ানার কপালে হাত রাখলো সাথে সাথে কেঁপে উঠলো ইয়ানা।

পারফি একবার ইয়ানার দিকে তাকিয়ে তারপর বললো ত্যাড়ামো করে রাতে জ্বর উঠিয়ে জ্বালিয়ে মেরেছো। যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম কি হয়েছে তখন সত্যিটা বললে এমন হতো?

ইয়ানা কি বলবে খুঁজে পেলো না। একেতে পারফি এতো কাছে যেনো জমে বরফ হয়ে যাবে আরেকটু হলে। এখন কি করা উচিত বা কি করবে কিছুই মাথায় আসলো না।

ইয়ানাকে কোনো কথা না বলে থম মেরে থাকতে দেখে পারফি উঠতে উঠতে বললো নেক্সট টাইম কোনো সমস্যা হলে আমার থেকে লুকাতে যেনো না দেখি।

পারফি উঠে যাওয়াতে ইয়ানা বড় করে নিঃশ্বাস নিলো তারপর আস্তে ধীরে উঠে বসে পারফির কথায় মাথা উপর নিচ ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো যে আর লুকাবে না।

#চলবে?

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ২৪

চারদিকে বাচ্চাদের শোরগোল মেতে উঠেছে চৌধুরী আর শিকদার বাড়িতে। আর সেই বাচ্চাদের সাথে ইয়ানা আর প্রীতি খেলা করছে। আজ যেনো এই বাচ্চাদের সাথে ওরাও বাচ্চা হয়ে গেছে। ক্ষনিক খেলছে কানামাছি, আবার খেলছে লুকালুকি আবার খেলছে দৌড়াদৌড়ি কে কাকে ধরতে পারে।

কিছুটা দূরে শরীফ আহমেদ, পাভেল শিকদার, পারফি, শাফিন ও আরো কিছু স্টাফ মিলে রান্নায় ব্যস্ত।
পাশেই পিয়াসা বেগম আর শাহানা বেগম গল্প করছে বসে বসে। আজ মহিলাদের ছুটি কারণ এই দিনটার সব কাজ ছেলেদের দায়িত্বে থাকে৷ প্রতিবছর এই দিনটা সবার এভাবেই কাটে।

আজ শ্রুতির জন্মদিন তাই এতো আয়োজন। এই জন্মদিনটা অন্য পাঁচটা জন্মদিনের মতো কেক কেটে পার্টি করে পালন করা হয় না। এটা একটু বেতিক্রম ভাবে পালন করা হয়। প্রতি বছর শ্রুতির জন্মদিন আসলে এলাকার সকল এতিম বাচ্চাদের এনে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ানো হয়। সাথে সকল বাচ্চাদের নতুন জামাকাপড়, চকলেট, খেলনা আরো অনেক কিছু দেওয়া হয়। প্রতিবাদেরে মতো এবার ও সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

দিনটি সবার জন্য মন খারাপ এর হলেও এতো গুলো বাচ্চার মুখে হাসি ফুটাতে পেরে সবার মন ভালো হয়ে যায়।
এইযে এতক্ষণ শানাহা বেগম মন খারাপ করে বসে ছিলো। বার বার শুধু মনের ভিতর হানা দিচ্ছিলো আজ আমার মেয়েটা আমার কাছে থাকলে কতো সুন্দর হতো। নিজের হাতে সাজিয়ে দিতাম, খাইয়ে দিতাম আরো কতো কি এসব ভেবে মন খারাপ লাগছিলো কিন্তু বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড়ে সেই মন খারাপটা কেটে গেলো। ওই দূরে ইয়ানা আর প্রীতি বাচ্চাদের সাথে খেলা করছে আর মন খুলে হাসছে তা দেখে মন শান্ত হয়ে গেলো। তার মেয়ে তার কাছে নেই কিন্তু এই দুটো মেয়েতো কাছে আছে তাতেই মনে শান্তি অনুভব করছে।

পিয়াসা বেগম পাশ থেকে বলে উঠলো দেখছো ভাবি মেয়ে দুটো কেমন ছেলেমানুষী করছে। এভাবে দৌড়াদৌড়ি করে যদি পড়ে যেয়ে ব্যথা পায়।

শাহানা বেগম প্রীতি আর ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো থাকনা করুক আজ একটা দিন মন খুলে দুষ্টমি। দেখো আজ কতোটা প্রাণবন্ত ওরা যেটা দেখতেও ভালো লাগছে।

তা ঠিক বলেছো পাগলি দুটি মেয়ে আমার।

সবাই রান্না করছিলো তখন পারফির ফোনে কল আসলো, পারফি ফোনটা নিয়ে একটু সাইডে গেলো কথা বলতে। কথা শেষ করে ফিরে আসতে নিবে তখন হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেলো। সামনের ব্যক্তি ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে পারফি কোমর আকরে ধরে পড়া থেকে বাঁচালো।

এদিকে ইয়ানা হঠাৎ দৌড়াদৌড়ির মাঝে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিতে ভয়ে চোখমুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। একটু পর অনুভব করলো নিচে পড়ে নি তার আগেই কেউ কোমর আকরে ধরে পড়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কে পড়া থেকে বাঁচিয়েছে দেখার জন্য চোখ খুলতে পারফির মুখশ্রী ভেসে উঠলো। পারফিকে এই মুহুর্তে দেখে চমকে গেলো ইয়ানা। তারাতাড়ি আশেপাশে তাকালো কেউ দেখছে কিনা। কিন্তু না কেউ দেখছে না সবাই সবার কাজ নিয়ে বিজি তা দেখে ইয়ানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

পারফি ইয়ানাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো এই মেয়ে তুমি না অসুস্থ তাহলে এমন ছোটাছুটি করছো কেনো? মাত্র এইতো পড়ে হাত-পা ভাঙতে।

পারফির ধমক খেয়ে ইয়ানা আমতা আমতা করে বললো আ..আসলে সরি খেয়াল করি নি আপনি এখানে।

ইয়ানার নরম গলা শুনে পারফি ইয়ানার দিকে তাকিয়ে আর ধমক দিলো না। এবার কোমল স্বরে বললো শরীর দুর্বল তোমার তাই এখন এমন ছোটাছুটি করা ঠিক হবে না। অনেক খেলেছো এবার যাও আম্মুদের ওখানে যেয়ে বসে বসে গল্প করো।

ইয়ানা ভদ্রমেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো তা দেখে পারফি ইয়ানার গাল টেনে দিয়ে বললো গুড।

পারফিকে গাল টানতে দেখে ইয়ানা ঠোঁট উল্টে বললো আপনি আবার আমার গাল টানছেন।

পারফি ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো বাচ্চাদের গাল দেখলে আমার টানতে ইচ্ছে করে তাতে আমার কি দোষ?

পারফির কথায় ইয়ানা চোখ ছোট ছোট করে বললো আমি বাচ্চা?

তো তোমার কি নিজেকে বড় মনে হয়? আমারতো মনে হয় না।

তখন প্রীতি ইয়ানার কাছে আসতে আসতে বললো এই ইয়ানা এখানে কি করছিস? কখন থেকে খুঁজছি তোকে আয় তারাতাড়ি খেলা শেষ হয়ে গেলো।

প্রীতির কথায় পারফি প্রীতির মাথায় গাট্টা মেরে বললো বানরের মতো ছোটাছুটি না করে এবার যেয়ে চুপচাপ বস আর নাহলে কাজ করতে লাগিয়ে দিবো কিন্তু।

প্রীতি কোমরে হাত দিয়ে বললো তুৃমি আমাকে বানর বললে কেনো?

বানরের মতো ছোটাছুটি করলে বানর বলবো নয়তো কি বলবো?

ভাইয়া আরেকবার যদি আমাকে বানর বলছো না তাহলে কিন্তু আমি আব্বুর কাছে তোমার নামে বিচার দিবো।

তুই কি আমাকে ভায় দেখাচ্ছিস?

সরো তুমি তোমার সাথে কথা নেই এ বলে ইয়ানাকে নিয়ে পিয়াসা আর শাহানা বেগমের কাছে চলে গেলো তারপর সবাই মিলে গল্পের আসর জমিয়ে দিলো।

গল্পগুজবের মাঝে রান্না কমপ্লিট হয়ে গেলো। রান্না শেষ হতে সব বাচ্চাদের এক সাথে বসিয়ে দিয়ে শাফিন, ইয়ানা, প্রীতি, পারফি মিলে খাবার বেরে দিলো।
বাচ্চাদের খাওয়া হলে সবাই মিলে ওদের নতুন জামাকাপড় দিলো। ইয়ানা চকলেট এর বক্স হাতে নিয়ে সব বাচ্চাদের হাতে চকলেট দিচ্ছে। সব বাচ্চাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ওদের হাসি দেখে সবাই তৃপ্তির হাসি হাসলো।

খাবার দাবার বাচ্চাদের নিয়ে মোট কথা আজকের দিনটা খুব ভালো কাটলো। বাচ্চারা সবাই চলে গেছে আরো অনেক সময় হলো। সবাই মোটামুটি পরিশ্রম করেছে তাই সবাই রেস্ট করতো যার যার রুমে চলে গেলো।

বিকেলের দিকে পারফি আর শাফিন বেড়িয়ে গেলো কাজ আছে বলে।
পারফি আর শাফিন সোজা চলে গেলো ওদের গোপন আস্তানায়। আস্তানার ভিতর প্রবেশ করতে হাত পা বাঁধা অবস্থায় ৫ জন মানুষকে পড়ে থাকতে দেখলো। সেই সিমকার্ড থেকে যে কয়টা নাম্বার কালেক্ট করেছে এরা এক এক জন তারাই। সিম কার্ডের ভিতর ৬ জনের নাম্বার পাওয়া গিয়েছিলো তার ভিতরে ৫ জনকে গার্ডরা খুঁজে বের করেছে, বাকি আছে একজন তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। তবে আশা করছে কিছুদিনের মাঝেই খোঁজ পেয়ে যাবে।

পারফি আর শাফিন গিয়ে লোকগুলোর সামনে বসলো। লোকগুলো ভয়ে কেঁপে উঠলো। এক এক জনে থর থর কারে কাঁপতে লাগলো।

পারফি শান্ত গলায় বললো আমি জানি সেদিন তোরা সব কয়জন ওই জায়গায় উপস্থিত ছিলি এবার সরাসরি শিকার করবি কার কথায় এমন করেছিস নাকি অন্য উপায়ে কথা বের করবো?

লোকগুলো ভয়ে ঘামতে লাগলো। কিন্তু কেউ শিকার করলো না কার কথায় এমন করছে। তা দেখে পারফি গার্ডদের ইশারা করলো এদের উত্তম মাধ্যম দিতে। পারফির কথায় গার্ডরা সবকয়জনকে মারতে মারতে আধমরা করে ফেললো তবুও কোনো কথা বের করলো না মুখ দিয়ে।

পারফি এবার গার্ডদের ইশারা করলো থামতে। গার্ডরা থামতে পারফি ফের বললো শেষ বারের মতো বলছি কার কথায় এমন করছিস।

৫ জনের ভিতরে একজন বলে উঠলো আমাদের মেরে ফেলুন তবুও আমাদের মুখ দিয়ে কথা বের হবে না। আমরা মুখ খুললে এমনিও আমরা মারা পড়বো সাথে আমাদের পরিবার ও ধ্বংস হয়ে যাবে।

লোকগুলোর কথা শুনে বুঝলো এরা জীবন দিতে রাজি কিন্তু মুখ খুলতে রাজি না তা দেখে পারফি বললো এদের থেকো কিছু জানা যাবে না, এদের লিডার বাকি যেই একজন আছে ওটাকে আগে খুঁজে বের করতে হবে। ওটার থেকেই সব জানা যাবে।

পারফি চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে গার্ডদের নির্দেশ দিলো যেই একজনকে খুঁজে পাওয়া যায় নি তাকে খুঁজে বের করতে সাথে এদের সব কয়টার একটা ব্যবস্থা করতে।

গার্ডরা সম্মতি দিতে পারফি আর শাফিন বেড়িয়ে গেলো। আস্তানার বাহিরে আসতে শুনতে পেলো বাহির থেকে লোকগুলোর আর্তনাদ। তা শুনে শাফিন বললো শালা গুলোর দম আছে বেশ। জীবন দিবে তবুও মুখ খুলবে না।
——-
রাত ১০ টার দিকে পারফি আর শাফিন বাসায় আসলো তা দেখে প্রীতি কোমরে হাত দিয়ে দুজনের দিকে রাগি লুকে তাকিয়ে রইলো।

প্রীতির এমন রনোচন্ডি রুপ দেখে শাফিন বললো এমন শাঁকচুন্নির মতো তাকিয়ে আছিস কেনো?

প্রীতি ক্ষেপে গিয়ে বললো আর একটা কথা বললে মাথার চুল একটাও আস্ত রাখবো না বলে দিলাম।

পারফি প্রীতিকে শান্ত করার জন্য বললো থাম তোরা, কি হয়েছে সেটা বল, কিছু না বলে এমন করে তাকিয়ে থাকলে হবে?

প্রীতি তেতে গিয়ে বললো এতো সময় লাগলো কেনো তোমাদের আসতে? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি।

শাফিন খোঁচা মেরে বললো তোর মতো সারাদিন কি বেকার ঘুরি যে বললি আর চলে আসলাম।

প্রীতি ক্ষেপে কিছু বলতে যাবে তার আগে পারফি আবার থামিয়ে দিয়ে বললো হয়েছে থাম এখন ঝগড়া বাজানোর সময় না। ঝগড়া করার অনেক টাইম আছে তখন করিস আপাতত চুপ থাক, একটু বিজি ছিলাম তাই আসতে লেট হয়েছে।

পারফির কথায় প্রীতি শাফিনের দিকে দাঁত কটমট করে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। তারপর পারফির দিকে তাকিয়ে বললো যা যা আনতে বলেছি সব এনেছো?

পারফি প্রীতির হাতে কতোগুলো ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললো সব আছে।

প্রীতি খুশি হয়ে বললো চলো তাহলে এখন ছাঁদে যাই।

পারফি প্রীতি আর শাফিনের উদ্দেশ্যে বললো তোরা যেয়ে কাজে লেগে পড় আমি একটু আসছি এ বলে উপরে উঠতে নিয়ে আবার কিছু একটা মনে করে পিছু তাকিয়ে বললো যেয়ে যদি দেখি দুইটায় আবার ঝগড়া লাগিয়েছিস তাহলে দুটোকে ধরে সুইমিংপুলের ভিতরে চুবিয়ে রাখবো মনে রাখিস।

শাফিন প্রীতির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো এই কথা তোর বোনের মাথায় ঢুকা, আমার সাথে যেনো কেউ লাগতে না আসে।

প্রীতি ও চোখ পাকিয়ে বললো বয়েই গেছে যা তা মানুষের সাথে আমার লাগতে।

শাফিন রেগে বললো তুই আমাকে যা-তা বললি কেনো? আজতো তোকে আমি….

পারফি হতাশ হয়ে উপরে চলে গেলো। ঝগড়া না করার জন্য এদের বুঝানোর থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাকে কথা শেখানো সহজ। এদের বোঝানো মানে যেই লাউ সেই কদু।
পারফি সোজা রুমে চলে গেলো। রুমে আসতে দেখতে পেলো ইয়ানা এলোমেলো ভাবে ঘুমিয়ে আছে। এতো তারাতাড়ি ইয়ানাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে পারফি এগিয়ে গেলো ইয়ানার কাছে। ইয়ানার দিকে কিছুটা ঝুঁকে কপালে আলতো করে হাত রাখলো জ্বর চেক করার জন্য। কপালে হাত রাখতে হালকা গরম অনুভব করলো। শরীরে হালকা জ্বর আছে তাই হয়তো শরীর খারাপ লাগার জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে।

পারফি কিছুক্ষণ ঘুমন্ত স্নিগ্ধ ফুলের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর ইয়ানাকে ঠিক ভাবে শুইয়ে দিয়ে ব্লাংকেট টেনে দিলো শরীরে। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে ফের ইয়ানার দিকে একপলক তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো ছাঁদের উদ্দেশ্যে।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে