তুমি আমার ব্যাকুলতা পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
587

#তুমি_আমার_ব্যাকুলতা
#পর্ব-০৩ ও শেষ
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

যেখান থেকে মানহা কে কিডন্যাপ করা হয়, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আবার সেখানেই দিয়ে যায় তারা! অদ্ভুত হলেও এটাই সত্যি।

দুদিন পর,
মানহা কল করে হাসান কে তাদের বাসায় আসতে বলে। মানহার কল পেয়ে হাসান মায়ের কাছে বলে চলে যায় সেখানে।
শশুরের বাসায় গিয়ে দেখতে পায় ড্রয়িং রুমে সবাই তার জন্য‌ই অপেক্ষা করে বসে আছে, বিশেষ করে মানহা।
সজিব নিজের আসন ছেড়ে দুলাভাই কে বসার সুযোগ করে দিয়ে, নিজে একটা মোড়া নিয়ে এসে বসে। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছে এতোদিন মেয়েটা কোথায় ছিল, কি পরিস্থিতে ছিল তা জানার জন্য।

মানহা বলতে শুরু করে,
তার শশুর বাড়ির কাছাকাছি যে পার্কটা আছে ওখানে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসেছিল সে। তখন পড়ন্ত বিকেল ছিল, যখন সে এসেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন আলোর রেখা নিভু হয়ে যাচ্ছিল তখন পার্ক জনশূন্য হতে শুরু হলো। মানহা ঠাঁয় বসেই ছিল ভেবেছিল কেউ একজন তার রাগ ভাঙিয়ে বাসায় নিয়ে যাবে। কারণ সে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে এখানে এসে বসেছিল।
তারপর যখন পুরো পার্ক জনশূন্য হয়ে গেল তখন, আবছা আলোর রেশ শুধু ছিল তখন ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। আর তাই বেঞ্চ থেকে উঠে সামনের দিকে পা বাড়ায়। তখনি কেউ মুখ চেপে ধরে…… এরপরের সমস্ত ঘটনা বলার পর মাকে ধরে আবারো কেঁদে দেয় মেয়েটা। খুব ভয় পেয়েছে, এখনো মনে হয় এই বুঝি আবারো ধরে নিয়ে যাবে। সারাক্ষণ ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে।
সবাই খুব চিন্তিত কে কিসের জন্য এমন করলো তা নিয়ে। রোজিনা বলে উঠে,
–” আমার মেয়েটা কোথায় পা ফেলতেও চিন্তা করে ফেলে যদি না কোন ভুল হয়ে যায়। অথচ সেই মেয়েকে কে এমন নিষ্ঠুর ভাবে বন্দি করে রেখেছে? তারপর মানহার বাবা করিম সাহেব হাসান কে উদ্দেশ্য করে বলে,
–” জানি না বাবা তুমি আর তোমার পরিবার বিষয়টা কিভাবে নিচ্ছ বা নিবে? তবে জানো আমার মেয়েটা কে আমি নিজ হাতে মানুষ করেছি তাই ও কি করতে পারে আর না পারে, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মেয়েটাকে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করিয়েছি। জ্ঞান হ‌ওয়ার পর থেকে ওর কাজিনরাও ওকে দেখতে পায়না সেখানে অন্য…

করিম সাহেব কে থামিয়ে দিয়ে হাসান বলল,
–” প্লিজ বাবা আর বলবেন না। আমাদের বিয়ের প্রায় এক বছর হতে চলেছে, তাই মানহা কেমন মেয়ে এটা অন্যকারো থেকে জানতে হবে না আমার। আমি আমার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। আমার পরিবার যদি কিছু বলে তাহলে তাদের কে বুঝানোর দায়িত্ব আমার। আপনি এগুলো নিয়ে একদল দুশ্চিন্তা করবেন না।

জামাই এর কথায় করিম সাহেব দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়। হাসান তখন মানহা কে তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বললে, রোজিনা বলে,
–” মেয়েটার উপর দিয়ে কতটা ঝড় গেল তার উপর প্রেগন্যান্ট! এই অবস্থায় কিছুদিন এখানে থেকে গেলে হয় না বাবা?

মানহা প্রেগন্যান্ট শুনে স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো তাকায় মানহার দিকে। কিছুটা অভিমান হয় তার। সে বাবা হতে চলেছে অথচ মানহা একবার ও তাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো না?

হাসান কে চুপ করে বসে থাকতে দেখে রোজিনা ইতস্তত বোধ করে বললেন,
–” কি হলো বাবা কিছু বললে না যে?
হাসান ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলে,
–” জ্বি?
–” মানহাকে এখানে থাকার ব্যাপারে বলছিলাম যে।
হাসান সম্মতি দিয়ে বলল,
–” ঠিক আছে আপনারা যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই হবে। আমি তাহলে আজকে উঠি?
–” সেকি এই রাতের বেলায় কোথায় যাবে? আজকে কোথাও যাওয়া নেই। কিছুদিন এখানে মানহার সাথে থাকো তোমার ও ভালো লাগবে।

তারপর মানহা কে বলে হাসান কে নিয়ে রুমে পাঠিয়ে দেয় রোজিনা। এর কিছুক্ষণ পর সজীব নাস্তার ট্রে নিয়ে দরজা নক করে। হাসান শালাবাবুর সাথে কিছুক্ষণ মজা করে নাস্তা খায়। খাওয়া শেষে সজীব চলে গেলে হাসান ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে মানহার খুব কাছে বসে। অভিমানী কন্ঠে বলে,
–” খুশীর খবরটা আমাকে আগে জানালে না কেন?

মানহা মাথা নিচু করে বলে,
–” তুমি যদি ভুল বুঝ তাই..
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হাসান বলল,
–” প্লিজ এসব মুখেও আনবে না। যাই হোক, ঐ ঘটনা গুলো নিছক একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও। যে আসছে তার কথা ভেবে অন্তত নিজেকে সুস্থ করে তুল।
.
.
২ বছর পর,
মানহা রান্না ঘরে থেকে মেয়ের কান্না শুনে দৌড়ে আসে। দশ মিনিট আগে খুব কষ্ট করে মেয়েকে ঘুম পারিয়ে রান্না করতে যায় সে, এর মধ্যেই উঠে গেছে। মেয়েকে নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছে মানহা। কিছুতেই চোখের আড়াল হতে দেয় না পুঁচকে মেয়েটা। মাকে যেন সবসময় চোখে হারায়।

মেয়ের ডায়াপার চেঞ্জ করতে নিলে কলিং বেল বেজে উঠে। দ্রুত চেঞ্জ করে হিজাবের নিকাব টা লাগিয়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
মানহা সবসময় সুতি কাপড়ের হিজাব পরে থাকে বাসায়। যখন কোন প্রয়োজন হয় তখন নিকাব টা লাগিয়ে নেয়।
যাই হোক,
দরজা খোলার পর একজন ভদ্রলোক বললেন,
–” ম্যাম আপনার পার্সেল!
তারপর মানহার সাইন নিয়ে, পার্সেল দিয়ে চলে যায় ভদ্রলোক। মানহা বুঝতে পারছে না কে দিতে পারে এটা? মেয়েকে পাশে বসিয়ে পার্সেল খোলা শুরু করে।
তার মেয়ের জন্য দুটো পার্টি ড্রেস আর সাথে একটা চিঠি দেখতে পায়। চিঠির খাম খুলে ভিতরে চিরকুট পড়া শুরু করে,
প্রিয় সম্বোধন করে আবার কেটে লেখা হয়েছে বোন!
আমি তোমার বড় খালার ছেলে সাফ‌ওয়ান। যে তোমার কিডন্যাপারার! ভাগ্যক্রমে আমি তোমাকে একবার দেখেছিলাম! সেই থেকেই ভীষণ পছন্দ করে ফেলি। ভেবেছিলাম ভালো একটা চাকরি পেলে মাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। কিন্তু ততদিনে খালু তোমার বিয়ে দিয়ে দেয়। তবুও তোমার বিয়ের কথা শুনে মাকে রাজি করিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেই কিন্তু খালু রাজি হয় না। ঐ মুহুর্তে বিয়ে ভাঙ্গতে পারবে না বলে অযুহাত দেখায়। আমি বুঝতে পারি তোমার স্বামীর মতো তো সরকারি চাকরি করি না তাই দাম নেই আমার। তাই ঠিক করি এর প্রতি*শোধ নিব আমি! আর সেটা তোমার সংসার নষ্ট করে। সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছিলাম। তোমাকে দিয়ে মিথ্যা চিঠি ও লিখিয়েছিলাম তোমার স্বামীকে পাঠাবো বলে! কিন্তু তোমার চোখে তোমার স্বামীর জন্য ভালোবাসা দেখে আর বেশিদূর এগোতে পারলাম না। রা*গ ছিল খালুর উপর কিন্তু তুমি তো কোন দোষ করোনি। একসময় বুঝতে পারলাম অন্যের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমি আমার পছন্দের মানুষটিকে কষ্ট দিচ্ছি। তাই তোমাকে আবার ফিরিয়ে দিলাম। তুমি সুখী হও আমি না হয় দূর থেকেই ভালোবাসবো তোমায়। চিন্তা করো না বোন হিসাবেই ভালোবাসবো। কারণ কোন বেগানা নারীকে কল্পনা করা ও আকাঙ্ক্ষা করা মনের যিনা। তাই নিজেকে সুধরে নিব ইনশা আল্লাহ। আমাকে মাফ করে দিও আর পারলে আমার হেদায়েত এর জন্য দুআ ক‌ইরো। আল্লাহ হাফেজ।
সাফ‌ওয়ান।
.
চিঠিটা পড়ে মানহা কি রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না। তার মেয়ে নাযাহ কেঁদে উঠলে তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে কান্না থামানোর চেষ্টা করে তখন ফোনে কল আসে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে মা কল করেছে। রিসিভ করে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে রোজিনা বললেন, তার বড় বোনের ছেলে সাফ‌ওয়ান আজকে ভোরের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর চলে গেছে!
মানহা উত্তরে শুধু বলে,
–” অহ আচ্ছা।

মানহা নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখতে পছন্দ করতো। তাছাড়া কোন এক কারনে সাফ‌ওয়ান এর বাবার সাথে করিম সাহেবের সম্পর্কটা স্বাভাবিক ছিল না। তাই দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসা নাই বললেই চলে। শুধু রোজিনা আর তার বোনের মধ্যে সম্পর্ক টা টিকে আছে। যাই হোক মানহা অতীত নিয়ে ভবিষ্যত নষ্ট করতে চায় না।তাই এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। চিঠিটা ছিঁড়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে ড্রেস গুলো আলমারির এক কোনায় রেখে দেয়। যদি কখনো ইচ্ছে হয় মেয়েকে পরাবে আর না হয় এমনেই পরে থাকবে।
রাতের বেলা ঘুমানোর সময় হাসান কে সবটা বলে মানহা। সবটা শুনে হাসান বলে আলহামদুলিল্লাহ।
মানহা অবাক হয়ে তাকালে হাসান বলে,
–” সবশেষে তো তুমি আমার স্ত্রী, আমার হয়ে থাকবে। আজকে যদি অন্যত্র তোমার বিয়ে হতো তাহলে তো আর তোমাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া হতো না আমার সেই জন্য আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল।
স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে খানিকটা লজ্জা পায় মানহা। তখন হাসান তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে বলে এখন ঘুমাও। আমাদের কথা শুনে কখন আবার নাযাহ কেঁদে উঠবে তার ঠিক নেই।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে